✿
নূর মিয়া
আজ চাইলে যে কেউ ভিক্টোরিয়া ছাপের কাজল লাগাতে পারে
অথবা সাধ্বী ঋতম্ভরা ছাপের অঞ্জন,
কিন্তু আসল ঘিয়ের সুরমা,
একমাত্র নূর মিয়ার হাতেই তৈরি হতো
অন্তত আমার দাদী তাই মানতেন।
নূর মিয়া যখনই আসতো
আমার দাদী অবশ্যই সুরমা কিনতেন
এক চিমটি সুরমা চোখে লাগালে
চোখ মেঘের মতো ভরে উঠতো
গঙ্গা যমুনার মতো ঢেউ খেলে যেতো
সমুদ্র হয়ে যেতো বুড়ির চোখ
সেখানে আমরা বাচ্চারা উঁকি দিলে
সব দেখতে পেতাম।
খুব দোয়া করতেন আমার দাদী,
নূর মিয়া আর তার সুরমাকে,
বলতেন-
নূর মিয়ার সুরমার কারণেই
বুড়ো বয়সেও যুবতী হয়ে ঘুরে বেড়াই
সুই গেঁথে ফেলি।
আর আমার ইচ্ছে করে বলি,
ও-রে বুড়ি!
তুইতো সুকন্যা,
আর তোর নূর মিয়া চ্যাবন ঋষি।
নূর মিয়ার সুরমা তোর চোখের চ্যাবনপ্রাশ
তোর চোখ, চোখ নয় দৃষ্টি
নূর মিয়ার সুরমা যেন সিন্নি,মালিদা!
আর
সেই নূর মিয়া পাকিস্তান চলে গেল!
কেন চলে গেল পাকিস্তান, নূর মিয়া?
শুনেছি নূর মিয়ার কেউ ছিলো না এখানে,
আমরা কি কেউ ছিলাম না নূর মিয়ার?
নূর মিয়া কেন চলে গেল পাকিস্তান?
আমাদের না জানিয়ে?
আমার দাদীকে না জানিয়ে,
নূর মিয়া কেন চলে গেল পাকিস্তান?
আর এখন, না সেই সুরমা আছে, না সেই চোখ,
আমার দাদী যে ঘাট থেকে এসেছিল,
সেই ঘাটে চলে গেল।
নদীঘাটে বিয়ে করে এসেছিলো আমার দাদী,
আর নদীঘাটে গিয়েই জ্বলেছে।
আমি যখন তার ছাইগুলো
নদীর জলে ফেলছি
আমার মনে হয়েছে এই নদী, নদী নয়
আমার দাদীর চোখ
আর এই ছাই, ছাই নয়,
নূর মিয়ার সুরমা,
যেনো আমার দাদীর চোখে পড়ছে।
এভাবে শেষবারের মতো নিজের হাতে
আমি,আমার দাদীর চোখে
নূর মিয়ার সুরমা দিয়েছি।
••• ✦ •••
কবির নিজ কন্ঠে কবিতাটি শুনতে ক্লিক করুন
❀ রমাশঙ্কর যাদব বিদ্রোহী
প্রায় তিন দশক ধরে জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বসবাস করেছেন বিপ্লবী কবি রমাশঙ্কর যাদব। যিনি কবি হিসবে’বিদ্রোহী’ নামেই জেএনইউ-তে সমধিক পরিচিত ছিলেন। জেএনইউর প্রাক্তন ছাত্র, একনিষ্ঠ সাংস্কৃতিক কর্মী এবং প্রগতিবাদী এই কবির জন্ম ৩ ডিসেম্বর ১৯৫৭, ভারতের উত্তরপ্রদেশের সুলতানপুরের এক কৃষক পরিবারে। ১৯৮০ সালে ভারতীয় ভাষায় এম.এ তে ভর্তি হওয়া রামশঙ্কর, জেএনইউর শিক্ষকদের অসহযোগীতা ও নানা অনিয়মের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে শুরু করেন। জড়িয়ে পড়েন প্রগতিশীল রাজনীতির সঙ্গে। ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত হয়ে পড়েন। ১৯৮৩ সালে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তার ছাত্রত্ব বাতিল করে দেয়। শিক্ষাজীবনের ইতি টেনে এরপর প্রায় ত্রিশ বছর কাটিয়ে দিয়েছেন জেএনইউর ক্যাম্পাসে। ছাত্রদের অধিকার আদায়ের আন্দোলনের সকল সভা, সমাবেশ, সাংস্কৃতিক কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন মৃত্যুর আগ পর্যন্ত। ৪ ডিসেম্বর ২০১৫ সালে ‘অকুপাই ইউজিসি’ স্লোগানে শুরু হওয়া ছাত্র আন্দোলনের এক মিছিলে ‘ব্রেইন ডেথ’ হয়ে মাত্র ৫৭ বছর বয়সে মৃত্যু হয় এই কবির।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শৃঙ্খলিত প্রাশাসনিক কাঠামো তাকে বহিষ্কার করলেও জেএনইওর ছাত্ররা তাকে নিয়েছিল আপন করে। নিজের কাব্যপ্রতিভায় অল্পসময়ে ‘বিদ্রোহী’ নামে জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন ক্যাম্পাসে। ছাত্রদের মুখে মুখে ছিলো তাঁর কবিতার পঙক্তি। বলা হয়ে থাকে, রমাশঙ্কর কখনো কবিতা কাগজে লিখতেন না। তিনি উপস্থিত কবিতা বলতেন। এক দুই লাইনের কবিতা থেকে অসংখ্য দীর্ঘ কবিতা ছিলো তার স্মৃতিতে। আর তা অনর্গল শ্রোতাদের চাহিদা মতো পাঠ করতেন সভা, সমাবেশে।
জেএনইউর এক প্রাক্তন ছাত্র ‘বিদ্রোহীর’ স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন, প্রথমবারের মতো ছাত্র আন্দোলনে অংশগ্রহণ করতে গিয়ে দেখা হয় এই কবির সঙ্গে। আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, আপনি কি করেন? তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, “কবি যখন গান করেন তখন কবিতা থাকে, আর কবি যখন কাঁদেন তখনও কবিতা থাকে। আমার কর্মই হল কবিতা, তবুও লোকে আমাকে জিজ্ঞেস করে, তুমি কী করো বিদ্রোহী?” প্রথমবার ছাত্র আন্দোলনে অংশগ্রহণ করার সময় আমার উপলব্ধি হলো, কবি বিদ্রোহী আর জেএনইউ ক্যাম্পাসের ছাত্র আন্দোলন অবিচ্ছেদ্য অংশ।
প্রায় তিন দশক ধরে জেএনইউতে বসবাস করা এই কবির কবিতা জেএনইউর অনগ্রসর জাতিগোষ্ঠী এবং সংখ্যালঘু জনজাতির ছাত্রদের অধিকার আদায়ের আন্দোলনের সঙ্গী হয়ে বিপুল গ্রহযোগ্যতা পায়। প্রতিটি আন্দোলন তাঁর কবিতাকে নতুন জীবন দিয়েছে। ২০১০ সালে অল ইন্ডিয়া ব্যাকওয়ার্ড স্টুডেন্টস ফোরাম গঠনের পরেই বিদ্রোহীর বহু-প্রতীক্ষিত কবিতা সংকলন ‘ন্যায়ি খেতি'(২০১১) প্রকাশিত হয়েছিল। একই সময়ে তাঁর উপর ডকুমেন্টারি এবং চলচ্চিত্র ‘ম্যায় তুমহারা কভি হুঁ’ নির্মান করেছেন নিতিন পামনানি যা পরবর্তীতে খুব বিখ্যাত হয়েছিল। মুম্বাই আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা বিভাগে সেরা তথ্যচিত্রের জন্য গোল্ডেন কাঞ্চ পুরস্কার অর্জন করেছিল এই ডকুমেন্ট্রি।
তাঁর কবিতা দৈন্যতার বিন্দু পরিমাণ ছাপ খুঁজে পাওয়া যাবে না। পরাজিত হলেও তিনি ছিলেন একজন যোদ্ধা। বিদ্রোহী একজন যোদ্ধার সমান সম্মান চায়। বিদ্রোহী বলতেন, তারা ছাত্র আন্দোলন থেকে বেরিয়ে এসে ছাত্র আন্দোলনেই তাদের আত্মত্যাগ চায়। কবি,যিনি জেএনইউ ছাত্রদের কয়েক প্রজন্মের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে হেঁটেছেন, তাঁর কবিতায় কখনও ব্যক্তিগত দুঃখ খুঁজে পাওয়া যাবে না। কবিতার মতো তার ব্যক্তিগত জীবনও ছিল একই রকম। বিদ্রোহী তার নিজের শর্তেই জীবনযাপন করেছিলেন। দেখতে ময়লা-ঢিলেঢালা জামা কাপড়, ক্ষুধার্ত-দরিদ্র, চামড়ায় ভাজ পড়ে যাওয়া এক ব্যক্তি যার দৈনন্দিন জীবন চলতো প্রধানত ছাত্র এবং কিছু শিক্ষকের সহায়তায়।
জেএনইউ ক্যাম্পাসে এই কবির জনপ্রিয়তা কতটুকু, তাঁর মৃত্যুর পর শেষ শ্রদ্ধা জানাতে জড়ো হওয়া ছাত্রদের ভিড় দেখেই সেদিন বোঝা গিয়েছিলো। বিদ্রোহী নেই কিন্তু আজও জেএনইউর ক্যাম্পাসে ছাত্র অধিকার আন্দোলনের সভা, সমাবেশে পাঠ করা হয় বিদ্রোহীর জনপ্রিয় কবিতা মহেঞ্জোদারো , গোলাম, অউরাতে, নূর মিয়া, ভূখালি হালউয়া, ম্যায় আহির হুঁ, পুরখৌ, ধর্ম, কথা দেশ কি, তুমহারা ভগবান।