দশটি আফগান কবিতা ।। ভূমিকা ও অনুবাদ :: অজিত দাশ

গুমোট পাগলাটে গরম আর চারদিকে ন্যাড়া পাহাড়ের বুকে ছুটে চলা আফগানদের কবিতা চর্চার শুরু মূলত স্থানীয় বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মুখে মুখে প্রচলিত প্রথাগত গীতিকবিতার মাধ্যমে। তবে ঐতিহাসিকভাবে আফগান সাহিত্যের প্রাচীনতম উল্লেখ পাওয়া যায় আরবি লিপিতে, খ্রিস্টপূর্ব ৫ম ও ৬ষ্ঠ শতাব্দীতে অরাইমাক বর্ণমালার নবতিয়ান শিলালিপিগুলো থেকে। মূলত ইসলামী শতাব্দীর শুরুর দিকেই এর উদ্ভব। সাধারনভাবে আগফান কবিতা ও সংস্কৃতির সুফিবাদের সঙ্গে মিলিত এক দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। কয়েকটি আঞ্চলিক ভাষা-উজবেক, তুর্কমেন, বালুচি, পাশাই এবং পশতু ভাষার ঐতিহ্যবাহী নানান ঘরানার লোকসাহিত্যের সংমিশ্রনে ঋদ্ধ আফগান সাহিত্য ও সংস্কৃতি। সিল্করুটে অবস্থানের কারণে পাহাড়ি এই ভূমিকে সহ্য করতে হয়েছে বিভিন্ন সাম্রাজ্যিক আগ্রাসন। ব্যাবসায়িক কারণে ও বিদেশী সংস্কৃতির আদান প্রদানে এখানকার জনগোষ্ঠীতে মিশ্র সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট গড়ে ওঠে ধীরে ধীরে।

সুফি কবি মওলানা রুমি, যামি, রুদাকি, ফেরদৌসী এবং খাজা আবদুল্লাহ আনসারির ধারাবাহিকতায় দারি ও পশতু ভাষার কবিরা আফগান কবিতায় একটা নতুন রূপ দিয়েছেন যার পরম্পরা বিংশ শতাব্দীর তরুন আফগান কবিদের মধ্যেও স্পষ্ট। দারি ভাষা মূলত পার্সি ভাষার আফগান রূপ। দশম থেকে দ্বাদশ শতক পর্যন্ত আফগান কবিতার দারুন উন্মেষ ঘটে পারসি ভাষার মাধ্যমে, গজনভি ও ঘুরি বংশের সম্রাটদের হাতে। এমনকি মুঘল সাম্রাজ্যের যেসব জগৎ বিখ্যাত সম্রাট এই পাহাড়ি ভূমিতে পা রেখেছিলেন তাদের সবারই প্রিয় ভাষা ছিলো পারসি।

১৬শ থেকে ২০ শতকের মধ্যে আফগানদের রাজধানী কাবুল হয়ে ওঠে সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চার মূল কেন্দ্র। উনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে ফরাসী লেখক জেমস ডার্মেস্টেটর আফগান সাহিত্যের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট এবং কবিদের ভূমিকা নিয়ে লিখেছিলেন। তাছাড়াও ১৯৮৮ সালে প্রকাশিত শের জামান-তেইযির বিখ্যাত গ্রন্থ ‘দ্য ফিল্ড’ আফগান সাহিত্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। উপনিবেশ স্থাপনের প্রচলন ও নানা বিভক্তি আফগান সাহিত্যে বেশ প্রভাব ফেললেও সেই সময়ে প্রসিদ্ধ কবি খুশল খাত্তাক সহ আরো কয়েকজন কবি উঁচু মানের সঙ্গীত ও গজল রচনা করে সফলতা অর্জন করেন।

বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে একাধারে কবি ও সম্পাদক মাহমুদ তাযযি তার সম্পাদিত সাহিত্য পত্রিকা ‘সিরাজ আল আখবর’ প্রকাশের মাধ্যমে আফগান সাহিত্যে আধুনিকতার সূত্রপাত ঘটান। যার সূত্রপাত পাশের দেশ ইরানের পারসি কবিতার প্রভাবে, কবি নিমা ইজজিশ এর হাত ধরে। ধ্রুপদী কাব্যরীতি ভেঙ্গে দারি কবিতায় মুক্ত ঘরানার ভিন্ন যে ভাবনা শৈলীর প্রচলন শুরু হয় তা বিকশিত হয় গত শতকের ষাটের দশকে। যুদ্ধবিদ্ধস্ত আফগানিস্তানে আধুনিক আফগান কবিরা নিমায়ি শৈলীতে রচিত আধুনিক কাব্যধারাকে সমৃদ্ধ করতে শুরু করেন। এমনকি প্রবাসের শরণার্থী শিবিরে বাস করে পরবর্তী জীবনে পাশ্চাত্যের বিভিন্ন দেশে অভিবাসী হাওয়া আফগান কবিরাও নিমায়ি শৈলীতে আফগান কবিতাকে সমৃদ্ধ করেন। ‘সিরাজ আল আখবর’ পত্রিকার হাত ধরেই আত্ম প্রকাশ করেন সেই সময়ে শক্তিশালী আফগান কবি-সায়িদ বুহানিদ্দিন মারুহ এবং খলিলুল্লাহ খলিলি।

এদিকে পশতু ভাষাকে জাতীয় ভাষা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করার চেষ্টায় কবি ও সম্পাদক মাহমুদ তাযযি শিল্প সাহিত্যের পাশাপাশি তৎকালীন আফগানিস্তানের রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ সংস্কার সহ নানা বিষয় নিয়ে নিয়মিত প্রবন্ধ, নিবন্ধ, মতামত প্রকাশ করতে থাকেন তার সম্পাদিত পত্রিকায়। ‘সিরাজ আল আখবর’ হয়ে ওঠে আধুনিক শিক্ষিত জণগনের এক শক্তিশালী হাতিয়ার। স্বাধীন আফগানিস্তানে তাযযিই প্রথম লেখক যার বই ছাপা অক্ষরে প্রকাশিত হয়।

যুগে যুগে বিভিন্ন ভাষা ও গোত্রের নিজস্ব সংস্কৃতির সংমিশ্রণে প্রভাবিত হলেও আফগান কবিদের পরম্পরা এখনও মূল রূপে সুফিবাদ ও দেহতত্ত্বকেই চমৎকারভাবে ধারণ করে আছে। আধুনিক সময়কালে এসে সুফিবাদের সঙ্গে আরো উল্লেযোগ্যভাবে যুক্ত হয়েছে যুদ্ধের ভয়াবহতা, নির্বাসনের বেদনা-যা অত্যন্ত নান্দনিক ও সূক্ষ্মভাবে প্রকাশ করছেন আফগান কবিরা। আফগান সাহিত্যে ধারাবাহিকভাবে শক্তিশালী নারী কবিদের আত্মপ্রকাশের ইতিহাসও রয়েছে। সম্ভবত আর কোনো জাতিগোষ্ঠীর সাহিত্যে নারী কবিদের এতটা উপস্থিতি দেখা যায় না, যতটা আফগান সাহিত্যে দেখা যায়। আফগান নারী কবিদের মধ্যে প্রাচীনতম হলেন রাবিয়া বালখি। এছাড়াও প্রায় হাজার বছর পূর্বে পশতু নারী কবিদের মুখে মুখে রচিত দুই পঙক্তির ‘লান্দাই’ এর মূল সুর আজও আধুনিক নারী কবিদের ভাবনাকে উপস্থাপন করে তাদের কবিতায়।
কয়েকটি ইংরেজী ও হিন্দি অনলাইন সাহিত্য পত্রিকা থেকে অনূদিত কবিতাগুলো চয়ন ও ভাষান্তর করা হয়েছে। বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশি উত্তরাধিকারের ডিসেম্বর ২০২১ সংখ্যায় এইকবিতাগুলো প্রকাশিত হয়েছে। প্রিন্ট সংখ্যার পাঠকের পাশাপাশি অনলাইন পাঠকের কথা চিন্তা করেই মূলত লেখালেখির উঠানে এই কবিতাগুলো প্রকাশিত করা হলো।

✿ সমাপ্ত
আবদুল বারী জাহানি

প্রতিটি দিন আমি গতকালের অবশেষ দেখতে পাই
আমাকে সকাল অথবা আগামীকালের কথা বলো না
আলো থেকে বঞ্চিত ডানা ভাঙ্গা পাখির মতো আমি
আমাকে জীবনের গল্প বলো না।
সাবধান আমার মিথ্যে দ্বীর্ঘশ্বাসে কেঁদোনা
সাবধান আমার আতঙ্ক কিংবা বেদনায় বিশ্বাস করো না
শিকারীর ভয়ে আমি দলছুট হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি
বন্ধুদের থেকে বিচ্ছেদের গল্প আমাকে বলো না
তোমার প্রতারণা, ছলচাতুরি নিয়ে আর গর্ব করো না।
আমি স্ব-ইচ্ছায় ভাগ্যের জালে বন্ধি।

 আবদুল বারী জাহানি
আবদুল বারী জাহানি পশতু ভাষার অন্যতম জনপ্রিয় কবি। তার জন্ম ১৯৪৮ সালে দক্ষিণ আফগানিস্তানের কান্দাহারে। ১৯৭২ সালে কাবুল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাহিত্য অনুষদ থেকে বিএ ডিগ্রি লাভ করা জাহানি কাবুল পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। সোভিয়েত আক্রমণের পূর্বে প্রায় দুই বছর আফগানিস্তানের শিক্ষামন্ত্রী হিসেবেও নিযুক্ত ছিলেন। পরবর্তিতে ১৯৮১ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি দেন। তাঁর বেশিরভাগই কবিতাই রচিত হয়েছে আফগানিস্তানের ইতিহাস এবং পশতু লোকসাহিত্যের উপর। এ পর্যন্ত তাঁর প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ২০ টি। আফগানিস্তানের বর্তমান জাতীয় সংগীতটির রচয়িতাও তিনি যেটি ২০০৬ সালে আফগানিস্তারে জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে নির্বাচিত হয়।

••✦••✦••

 মানুষ এবং ফুলেরা
পীর মুহাম্মদ কারওয়ান

পৃথিবী এবং ছাইয়ে জন্ম নেওয়া ফুলেরা,
কিছুটা স্বচ্ছ কিন্তু বেশিরভাগ অসচ্ছ জল পান করে
তবুও তারা পবিত্র, সুন্দর এবং সুগন্ধী
তাদের বাহারি রঙ পুলকিত করে আমাদের দৃষ্টি ও হৃদয়
কিন্তু মানুষ যাদের একসময় ফেরেশতারা সেজদা করেছিল
ফুলের দিকে তাকিয়ে যারা অশ্রুর চেয়ে পবিত্র জল পান করতো,
এবং যখন থেকে গাঢ় লাল রঙের আপেলে কামড় বসালো
সেই থেকে তারা কুৎসিত হয়ে গেল- কিন্তু কেন?

 পীর মুহাম্মদ কারওয়ান
পীর মুহাম্মদ কারওয়ান সুপরিচিত পশতু ভাষার কবি। জন্ম চল্লিশের দশকে আফগানিস্তানের খোস্ত শহরে। ১৯৯০ সালে পেশোয়ারে চলে যান এবং সেখানে এক দশকেরও বেশি সময় ধরে বসবাস করেন। পরবর্তীতে তালেবান শাসনের অবসানের পর তিনি কাবুলে ফিরে আসেন; তিনি বিবিসির আফগান শিক্ষা প্রকল্পে কর্মরত ছিলেন। তিনটি কাব্যগ্রন্থের পাশাপাশি পীর মুহাম্মদ কারওয়ানের ছোটগল্পের দুটি সংকলনও প্রকাশিত হয়েছে।

••✦••✦••

✿ আয়না
পারতাও নাদেরি

নির্বাসনের আয়নায় ডুবে থেকে আজন্ম
নিজেই বিলীন হয়েছি নিজের প্রতিবিম্বে
শোন- অন্তহীন প্রজ্ঞার দ্বন্দ্ব থেকে আমার জন্ম
আমি শূন্যতার সব রহস্য জেনে গেছি।

✿ জ্ঞাতিজন
পারতাও নাদেরি

আয়নার ভাষা আমি জানি

এর ভ্রম এবং আমার-
যেনো কোনো আদিবাসীর বসন্ত

আমাদের শেকড় তুমি খুঁজে পাবে
সত্যের কোনো প্রাচীন জনগোষ্ঠীর কাছে।

☛ পারতাও নাদেরি
পারতাও নাদেরির জন্ম ১৯৫৩ সালে আফগানিস্তানের উত্তরাঞ্চলীয় প্রদেশ বাদাখশানে। তিনি ১৯৭৬ সালে কাবুল বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান অনুষদ থেকে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। কবিতা লিখতে শুরু করার কয়েক বছরের মধ্যেই ১৯৭০-এর দশকে সোভিয়েত শাসনের সময়কালে তিন বছর কারাবন্দী ছিলেন। আফগানিস্তানের অন্যতম আধুনিকতাবাদী কবি হিসেবে সুপরিচিত নাদেরি তাঁর গীতধর্মী কবিতায় সাহসী ও প্রতিবাদী উচ্চারণের জন্য সম্পূর্ণ ব্যক্তিক্রমী এক মৌলিক কবি হিসেবে নিজের অবস্থান তৈরি করেছেন। বেশ কয়েকবছর নির্বাসনে থাকার পর সম্প্রতি তিনি কাবুলে ফিরে আসেন।

••✦••✦••

 দীর্ঘ রাত
শাকিলা আজিজজাদা

ময়দার কাইয়ে ডুবানো
তোমার অদৃশ্য হাত দুটো দেখে
ভীষণ কষ্ট হচ্ছিলো আমার
লম্বা এক টুকরো কাপড়ে আঁটা
তোমার স্তন যেনো জোড়া পাকা আঙ্গুর।

তুমি সন্তানদের ছেড়ে দিয়েছ
তোমার মুখের এক কোন এবড়োথেবরো
দেখে ভীষন কষ্ট হচ্ছিল আমার

তোমার ঠোঁট থেকে রক্ত ঝরাতে
তোমার ছায়ায় ছুঁড়ে ফেলা
একটা ছোট্ট নুড়ি পাথরই যথেষ্ট
আমি যেটুকু লালা রেখেছি এবং থুথু
যে কেউ এটা ফেলে দিয়েছে তোমার মুখে

শব্দগুলো শুষ্ক হয়ে ঝড়ছে তোমার ঠোঁট থেকে
বছরগুলো ধীরে ধীরে কেটে গেল
ধুলো আর ধোয়ায় মিশে।

তারা ধীরে পায়ে চলে গেল
অথচ রাত তখন ঝুলছে তোমার পিতৃলয়ে।

 শাকিলা আজিজজাদা
শাকিলা আজিজজাদার জন্ম ১৯৬৪ সালে আফগানিস্তানের কাবুলে। তিনি দারি ভাষার অন্যতম আফগান নারী কবি। কাবুল বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিষয়ে স্নাতক শেষে নেদারল্যান্ড থেকে প্রাচ্যের ভাষা ও সংস্কৃতি নিয়ে উচ্চতর ডিগ্রি লাভ করেন। কবিতা ছাড়াও ছোটগল্প এবং নাটক লিখেছেন। তার নির্বাচিত কবিতাসমগ্র দারি এবং ডাচ ভাষায় প্রকাশিত ২০১২ সালে নেদারল্যান্ড থেকে।

••✦••✦••

✿ মরু পুষ্পের মতো
পারভীন ফয়েজ জাদাহ মালাল

মরু পুষ্পের মতো বৃষ্টির প্রতীক্ষায়,
নদীতীরের তৃষ্ণার মতো মাটির কলস স্পর্শের প্রতীক্ষায়,
ঊষার মতো দিনের আলোর প্রতীক্ষায়
এবং একটা ঘরের মতো কোনো নারীর প্রতীক্ষায়
ধ্বংসাবশেষ কোনো ছোট্ট কুটিরের মতো
ক্লান্ত, প্রাণ খুলে দীর্ঘ নিঃশ্বাসের অপেক্ষায়
চোখ বন্ধ করে একটু ঘুমানোর অপেক্ষায়
আহা শান্তির একটুকরো চাদরে, একটুকরো চাদরে।

☛ পারভীন ফয়েজ জাদাহ মালাল
পারভীন ফয়েজ জাদাহ মালাল পশতু ভাষার অন্যতম জনপ্রিয় আফগান নারী কবি। তার জন্ম ১৯৫৭ দক্ষিণ আফগানিস্তানের কান্দাহার প্রদেশে। পারভীন তার কর্মজীবন শুরু করেন কান্দাহারের দৈনিক টলো-ই-আফগান পত্রিকায় সাংবাদিক হিসেবে। তিনি রেডিও আফগানিস্তানের জন্য কাবুলেও কাজ করেছিলেন। পরবর্তীতে পাকিস্তানের পেশোয়ারে স্থায়ী বসবাস শুরু করেন। পেশোয়ার থেকেই তার ছোটগল্প এবং তিনটি কবিতার বই প্রকাশিত হয়।

••✦••✦••

✿ নওরোজের ঈদ
নাফিসা আজহর

আমার মা
আমার বোন আর আমার হাতে
মেহেদী লাগিয়েছে
নিশ্চুপ অন্ধকার রাতে
আমাদের হাতে লাগানো মেহেদী
বসন্তের ফুলের কলির মতো
মনে হচ্ছে সকালে হলেই ফুটে ওঠবে
ঈদের ছোট্ট ফুল নারীদের মুখে হাসি ফুটাবে

আমার মা
আমার বোন আর আমার হাতে মেহেদী লাগিয়েছে
তার উষ্ণ, ভালবাসা স্নিগ্ধ হাত
আর আমার উদাস হৃদয়
ঠান্ডা হাওয়ায় ছটফট করে ওঠে
বেদনায় নুইয়ে পড়া পাহাড়
তুমিই বলো-যদি ঈদ আসেও
তাহলে এমন কী হবে যে আমরা আনন্দিত হবো?
সবকিছু ধ্বংসাবশেষে চুরমা হয়ে গেছে
বসন্তের শুরু অথচ গাছের শাখায় কোথাও
ফুল চোখে পড়ছে না
যুদ্ধের কারণে পাশেই ঝিলের স্রোত বন্ধ হয়ে গেছে
আর সেখানে রক্ত জমা আছে

আমার মা
আমার বোন আর আমার হাতে
মেহেদী লাগিয়েছে
আনন্দিত আমার ছোট্ট বোন
কেননা কাল ঈদ
সে জানে না- মানুষ ছটফট করছে
আমি আর আমার মা শোকে ডুবে আছি

 নাফিসা আজহর
নাফিসা আজহর ইতিহাস এবং আইন বিষয়ে পিএইচডি ডিগ্রি শেষ করে বর্তমানে কাবুল বিজ্ঞান একাডেমিতে কাজ করছেন।
তার কবিতা প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৮১ সালে।

••✦••✦••

✿ তৃষ্ণা
নূজার ইলিয়াস

আমাদের ভেতর একটা তৃষ্ণা আছে
সাহসী, জ্বলন্ত মরুভূমির তৃষ্ণা
লালচে দিনের তৃষ্ণা
বুনো ঝড়ের তৃষ্ণা
আমাদের শাখাগুলো ঠা-ায় জমে গেছে
আমাদের শেকড় শুকিয়ে গেছে
আমাদের বাগান গায়েব হয়ে গেছে
আমাদের ঝোপ ঝাড় মরে গেছে
আমাদের ভেতর একটা তৃষ্ণা আছে
অনেকগুলো বছরের তৃষ্ণা
বোবা দীর্ঘ কতগুলু বছরের তৃষ্ণা

 নূজার ইলিয়াস
নূজার ইলিয়াস আফগানিস্তানের সুপরিচিত তরুন কবি। জন্ম হেরাত শহরে। তার বেশ কয়েকটি কাব্যগ্রন্থ রয়েছে।

••✦••✦••

✿ আমিও বিশ্বাস করি না
ইলিয়াস আলাভি

প্রিয়তমা আমার
যদি মৃত্যু এখানে অপেক্ষা করে তোমার জন্য
তাহলে আত্মঘাতী বোমা হামলার
শিকারের মতো নয়,
তাকে যক্ষার মতো হতে দাও
অথবা তিক্ত ঠা-া কোনো বরফের চাকার মতো

তোমার সময় থাকা উচিৎ ছিল-
স্মৃতির আঙিনায় ঘুরে বেড়ানোর জন্য
নিজেকে আপাদমস্তক দর্শন করার জন্য
কেবল নিজের ঘর থেকে বিদায় নেওয়া নয়
নিজের মৃত্যুর পরিকল্পনার জন্যও
তোমার সময় থাকা উচিৎ ছিল
অথচ আমরা কেবল তোমার এক জোড়া জুতো
বাজারে খুঁজে পেয়েছি।
না তোমার দুটো হাত, না তোমার ¯িœগ্ধ হাসি।
আমার কোথাও তোমার চোখ দুটো খুঁজে পাইনি।

আমার স্ব-চোখে
তোমার মৃত্যুর সাক্ষী থাকা উচিৎ ছিল
আমার নিজের হাতে তোমার দু-চোখের
পাপড়ি স্পর্শ করা উচিৎ ছিল
নাহলে কেউ তা বিশ্বাস করবে না
আমি নিজেও বিশ্বাস করিনা।

 ইলিয়াস আলাভি
দারি ভাষার তরুন সুপরিচিত কবি ইলিয়াস আলাভির জন্ম ১৯৮২ সালে আফগানিস্তানের দায়কোন্দি শহরে। ইরানে আফগান শরণার্থী হিসেবে থাকার পর বর্তমানে অস্ট্রেলিয়ার এডিলেড শহরে স্থায়ী বসবাস করেন। দারি ভাষায় তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘আমি এক দিবাস্বপ্ন দেখা নেকড়ে’ প্রকাশিত হওয়ার পর ইরান, তাজাকিস্তান এবং আফগানিস্তা থেকে পুরস্কৃত হয় এবং বেশ পাঠক প্রিয়তা অর্জন করে। এছাড়াও কবিতার জন্য আলাভি আরও তিনটি পুরস্কার অর্জন করেন। ২০১৩ সাল থেকে আলাভির কবিতাসমগ্র বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়ে পাঠকপ্রিয়তা অর্জন করছে।

••✦••✦••

✿ পাহাড়
ফাতেমা রোশান

ওহে চাচা! কেমন ধর্মান্ধ পুরুষ তুমি
ছোটবোন তার প্রেমিকের সঙ্গে পালিয়েছে তাই
শিকারি কুকুরে মতো পাহাড়
তছনছ করে তাদের খুঁজছো তুমি
এবং কেমন যুবতী আর তরতাজা ছিল পাহাড়ের হাড়
তোমার হাতে তছনছ হওয়ার আগে
হাওয়া চুমো খেয়েছিল এই পাহাড়ের গালে
আমি, ছোট্ট জানালা দিয়ে তাকিয়ে হাসছি
দলবেঁধে খেলতে থাকা বাচ্চাদের
পায়ের আওয়াজ শোনা যাচ্ছিল
আর মহিলারা তাদের স্তন শুকিয়ে যাওয়ার আগে
নিংড়ে পাওয়া দু-এক ফোঁটা দুধ
ঢেলে দিচ্ছে স্বর্ণকেশী সৈনিকদের গলায়।

বাবার হাততালির শব্দ শোনার আগে
কুমারী তার প্রেমিককে চুমো খেল
আমরা নিজেদের জামাকাপড় গোছিয়ে নিলাম
যেনো আমার ভাইয়েরা অন্য কোথাও
কারো প্রেমে পড়তে পারে,
যেখানে আমাদের নদীই হবে আমাদের সমুদ্র-
যদি বাবা তার ভাইদের ক্ষমা করে দেয়
এবং ক্ষমার অযোগ্য এই ভূমি
আমাদের ভালবাসতে দাও
আমার বোনেরা,
এই পাহাড় তোমাদের প্রেমিক।

 ফাতেমা রোশান
ফাতেমা রোশান এর জন্ম নব্বই এর দশকে।  আফগান দারি ভাষার এই কবি সমকালীন তরুণ কবিদের মধ্যে তার নীরিক্ষাধর্মী কবিতা রচনার জন্য এক পরিচিত নাম। কবিতার পাশাপাশি গদ্য লেখায়ও তিনি সমান পারদর্শী। ন্যাচারাল রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট নিয়ে পড়াশোনা করা এই কবি বর্তমান কাবুল নিবাসী এবং একজন এনজিও কর্মী। তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘কুইনুওয়া পারফিউম’ ছাড়াও একটি গল্পগ্রন্থ রয়েছে।

••✦••✦••

✿ অনন্তের জন্য দস্তখত
লায়লা সেরাহত রোশানি

আমার গভীরে তুমি
যেনো কোনো আয়না
অস্তিত্বের মতো বিস্তৃত,
নবীন আর নির্মল
কোনো বসন্তের মতো

আমি, আমার চোখ দুটো
রোপন করি সে আয়নায়
যেনো একটি চিহ্ন-
ছোট এবং সবুজ
মাথা উঁচিয়ে ঘোষনা
করতে পারে-বসন্তের নিত্যতা

☛ লায়লা সেরাহত রোশানি
লায়লা সেরাহত রোশানির জন্ম ১৯৫৯ কাবুলে। কাবুল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক শেষ করে মাধ্যমিক স্কুলে সাহিত্যের শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত হন। ১৯৯৮ এর পর অভিবাসী হিসেবে নেদারল্যান্ড পাড়ি দেন। জীবদ্দশায় তার চারটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে।নেদারল্যান্ডে থাকাকালীন ‘নির্বাসনে হাওয়া’ নাম দিয়ে একটি ফার্সি ত্রৈমাসিক সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদনা করেন। ৪৬ বছর বয়সে দূরারোগ্য ক্যান্সার আক্রান্ত হয়ে তার মৃত্যু হয়।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ভাষা
Scroll to Top