ড্রাইভারের ঢাউস সিটের মধ্যে গুটিসুটি মেরে বসে গাড়িটায় স্টার্ট দিল রমজান। রমজান আলী। বাড়ি সুন্দরবনের কুলতলী থানায়। নতুন এই গড়ে ওঠা এলাকাটায় যে নতুন নতুন কোঅপারেটিভ ফ্ল্যাট উঠছে তারই একটাতে দারোয়ানি করে।
সম্প্রতি বিয়ে করেছে রমজান। কেয়ারটেকারের ঘরে সঙ্গে তার বৌ জুলেখাও থাকে। তার আর সেজন্য খরচ যেমন বেড়েছে তেমনি উপায়ের রাস্তাও বাতলেছে একটা ভালো। সকাল থেকে শ্বেতা কাকিমার গাড়িখানা চালায় রমজান। রেট পাঁচঘন্টায় চারশো টাকা। শ্বেতা কলেজে যায় রোজ সাদা মারুতি সুইফ্ট গাড়ি চড়ে। আর যেদিন সরকারি অপিসে ছুটিছাটা থাকে সেদিন গাড়ি চড়ে কাজে বেরোন আকাশ কাকু।
ভারি হাসিখুশি গপ্পবাজ ছেলে রমজান।রোজ স্টিয়ারিং এ হাত দিয়ে গাড়ির চাবি ঘোরানোর সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হয় তার গল্প। শ্বেতা জিগ্যেস করার আগেই রমজান বলে চলে ” বৌকে বললাম তুমি উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা টায় বসে পড়ো কাকু-কাকিমা আছে সাহায্য করবে…..”
” হ্যাঁ তা কি বললো তোমার বউ?” শ্বেতা শুধোয়
“বললো আমার এখন বিয়ে হয়ে গেছে ছোট ছেলেমেয়েদের সঙ্গে এক বেঞ্চে…….. আমার লজ্জা করে।”
ওমা সে কি কথা? পড়াশুনোর আবার বয়েস আছে নাকি? কাগজে দেখো না ? মা-মেয়ে একসঙ্গে পরীক্ষা পাস করছে…..। লেখাপড়া সবসময়ই ভালো। কতো বিয়ে হওয়া মেয়ে ইশকুল কলেজ যায়।লেখাপড়া করে পাস করে।” শ্বেতা বলে।
“বলি তো কাকিমা। কিন্তু ও রাজি নয়।বরঞ্চ আমার আরও একটু পড়াশুনো করার ইচ্ছে হয়। সেই ছোটবেলা থেকে খাটাখাটুনি করছি। একসময় কী কষ্ট ছিল আমাদের।খাওয়াই জুটতো না। ভেরিতে জাল টানতো বাপ-জেঠারা। আমরাও ভোর থেকে উঠে মাঠে কাজে লাগতাম। সকালে উঠে সেই পান্তা খাবার অভ্যাসটা থেকে গেছে এখনও।”
গেরামের ইশকুলটায় কেলাস সিক্স অবধি পড়েছিলাম। তো সে মনেও নাই। তারপর বাপ বললো “আর পড়াশুনো করে কাজ নাই।কাজে লাগো।সংসারের জন্য দুটো রোজগার করে আনো।” সেই থেকে… কি আর হবে…… সংসারের জোয়াল টানছি।”
তো গাড়ি চালাতে শিখলে কখন? ভালোইতো চালাও। ড্রাইভিং লাইসেন্স? শ্বেতা বলে।
“ওইটাই খেতখামারি কাজে একটু কামাই দিয়ে শিখে নিয়েছিলাম কাকিমা। দেখলাম এই লাইনটাতে তবু দুটো পয়সা আছে। এ লাইনে থাকলে দুটো লেখাপড়া জানা মানুষের সঙ্গে মেলামেশা করার সুযোগও পাওয়া যায়।ওই যে তুমি রোজ কলেজ যাও খুব ভাল্লাগে আমার।কলেজময় ছেলেরামেয়েরা ঘুরে ঘুরে বেড়ায় বেশ লাগে। আমি তো কোনোদিন কলেজ দেখিইনি কাকিমা। এই যে তোমাকে রোজ নিয়ে যাই এই আমার কলেজ দেখা।”
শ্বেতার মনে পড়ে কদিন আগেই খবরের কাগজের উত্তর সম্পাদকীয়তে বেরিয়েছিল প্যানডেমিকে যেমন অজস্র মানুষ কাজ হারিয়েছে তেমনি বহু স্কুল বা কলেজ ছাত্র স্কুল-কলেজ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় পড়াশুনো ছেড়ে হাতের কাছে যা কাজ পেয়েছে সেখানেই ঢুকে গেছে। এখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে গেলেও তারা স্কুল কলেজে ফিরতে পারবে না।তার মানে একটা বিরাট সংখ্যক স্কুলছুট। এর বিরাট পরিসংখ্যান দিয়েছিলেন সাংবাদিক। কিন্তু রমজানের ব্যাপারটা তো তা নয়। এতোটাই গরিব আর পিছিয়ে পড়া গ্রামীণ পরিবার যে লেখাপড়া ব্যাপারটাই তাদের কাছে বাড়তি।
শ্বেতা বসে বসে ভাবছিল। দু’বছর টানা বন্ধ থাকার পর সদ্য কদিন হোল কলেজটা খুলেছে।ছেলেমেয়েগুলোর এখন খুব উৎসাহ।আসলে স্কুল-কলেজ মানে তো শুধু ক’পাতা বই মুখস্ত করে একটা ডিগ্রি পাওয়াই নয়। যোগাযোগ মেলামেশা মানুষে মানুষে সম্পর্ক এসব সামাজিকতার বন্ধন তৈরি হয় তো স্কুল-কলেজ ক্লাব খেলার-মাঠ আড্ডা সাংস্কৃতিক সংগঠন এসব থেকেই। গত দুবছর এসব সমস্ত বন্ধ। চব্বিশঘন্টা ঘরের চারদেওয়ালে বন্দি জীবন কাটাচ্ছে একটা গোটা সমাজ। গরিব ঘরের ছেলেমেয়েদের তো কথাই নেই। স্কুল যবে থেকে বন্ধ, বন্ধ তাদের শিক্ষাসম্পর্কিত যাবতীয় এক্টিভিটিজ। অধিকাংশ পরিবারের সংগতি নেই স্মার্টফোন কিনে দেবার। কতোটুকু ডেরায় ঘাড় গুঁজে দিন কাটায় মানুষগুলো। হাতে কাজ নেই।রোজগারের রাস্তা বন্ধ। ছেলেমেয়েগুলো ধুলোধূসরিত দেহে ভবঘুরের মতো ঘুরছে সকাল থেকে। মিড ডে মিল বন্ধ। ফলে দুটো পেটভরা খাওয়ারও সংস্থান নেই।
এসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে একটু অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিল শ্বেতা। শেষ পর্যন্ত কি দেশটা চিরদুর্ভিক্ষের দেশ ইথিওপিয়া হয়ে যাবে?…..
চিন্তা সূত্র ছিঁড়ে গেল শ্বেতার রমজানের কথায়। ভারি গায়ে পড়া ছেলেটা। কাকিমা কাকিমা করে ডেকে বেশ মায়ার বাঁধনে বেঁধে ফেলেছে শ্বেতাকে। ছেলে রক্তিম দূর বিদেশে থাকে। লকডাউনে বহুদিন আসতে পারেনি। তো কিছুই তো খালি থাকে না। বছর তিরিশের ছেলে রমজান কে নিয়ে গাড়ি চড়ে ঘুরতে ঘুরতে কেমন মাতৃভাবটা চাগিয়ে উঠে স্নেহ গিয়ে ঢলে পড়েছে রমজানের ওপর। ভারি সৎ-ভদ্র -রমজান। সেইসঙ্গে এমন মায়াবী যে সবটুকু স্নেহ কেড়ে নেয়।
গল্পের ছলে কতো কথা বলে। গাড়িটা সিগন্যালে থামিয়ে হঠাৎ বললো…
পাশের বাড়ির একটা ছেলে জানো কাকিমা, বছর বারো বয়েস…..কবে নাকি মা কে মারতে গেছিল। কেন? না মা সকালবেলায় পান্তাভাতের থালা এগিয়ে দিয়েছিল।
বলেছে “খাবনি পান্তা যাহ্…..ডিম দে সয়াবিন দে ভাত দে। নইলে খাবনি।”
তা ওর বাপ বলেছে “খাবিনি তো যা। ঘর থেকেন বেরু।ইসস্…. লাট সায়েবের পো এসেচেন। খিদে লাগলে আপনি খাবি।”
আসলে ইশকুলে যেতো যখন মিডডে মিল পেতো তো
…….এখন আর গরিব বাড়িতে সেসব জুটছে না…..তো ছোট ছেলে কি বুঝে?মা কেই মারতে ছুটেছে।
শ্বেতার এসব গল্প শুনলে মনে মনে লজ্জা হয় ভারি। কতো আরামে কাটিয়ে দিল তারা।সরকারি চাকরির ঘেরাটোপে। উল্টোদিকে হাজারে হাজারে মানুষ বেকার হলো। অবসাদে কতো আত্মহত্যা করলো। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তালা ঝুলতে কতো ভালো ছাত্র লেখাপড়া জলাঞ্জলি দিয়ে বাজার-দোকান দিল। অটো রিক্সা টানতে শুরু করলো। পঞ্চাশ টাকার ডেলিভারি বয় হয়ে গেল।
হয়তো শেষপর্যন্ত একটা যে কোনো কাজ বা কোনোক্রমে বেঁচে টিঁকে থাকার জন্য একটা চাকরিই বুঝি সব মানুষের লক্ষ্য।সেখানে পড়াশুনো জ্ঞান-প্রজ্ঞা কিসের কতোটুকু মূল্য?
রমজান বলে “কাকিমা বৌ পড়বে না বলছে। আমি পড়তে পারি না?”
হ্যাঁ।কেন পারবি না?পড়তেই পারিস। অবস্থাটা একটু স্বাভাবিক হোক…..তারপর না হয়…..
রমজান মন দিয়ে গাড়ি চালায়। সঙ্গে সঙ্গে চলে ওর নানারকম গপ্প।
“কাল একজন দিদিকে নিয়ে গেছিলাম জানো কাকিমা। আমাকে দুপুরে খাওয়ালো। মুরগিটা কেমন ভাজা বড়ার মতো। বড়ো হোটেল।খাবারগুলো কী ভালো খেতে।আমরা ওসব কখনও খাইই নি।খাবো কি, দেখিই নি জন্মে ওসব খাবার। আমারা কখনও কুত্থাও যাইনি কাকিমা। ওই ভাতডাল পান্তা ছাড়া কখনও কিছু খাইইনি।”
” শহরে ছিলি না।তাই খাসনি। এখন শহুরে হয়েছিস মাঝে মাঝেই ওসব খাবার সুযোগ পাবি।” শ্বেতা বলে।
সেদিন কী হলো জানো কাকিমা?
কি হোল?
“ফেলাটের মিটিং হচ্ছিল। সে কি ফাটাফাটি মিটিং কাকিমা কি বলবো। ”
ফাটাফাটি মানে? কি ফাটলো?
ও ই বাবুরা সব তর্কাতর্কি করতেছে। এ এটা বলে।তো ও ওটা। এই নিয়েই আর কি। কে বেশি জানে কে জানে না। বেশি জানলে পরে মানে না।
আমরা গরিবগুর্বো মানুষ।লেখাপড়াও বিশেষ শিখি নাই।জানি না। কতো বড়লোককে দেখেছি জানো কাকিমা গরিব মানুষকে কাজ করিয়ে পয়সা দেয় না।তাদের কি ভালো হয় কাকিমা? তাদের টাকা একসময় ডাক্তারে খায়।
একজন বাবুকে চিনতাম …..খুব বড়োলোক। নিউটাউনেই দু দুটো ফ্ল্যাট। এখন ক্যানসার হয়ে এক্কেবারে জব্দ। উনি মানুষকে খাটিয়ে পয়সা দিতেন না।ফাঁকি দিতেন।তো এখন ক্যানসার হয়ে রাশি রাশি টাকা ডাক্তারকে দিচ্ছেন। তার ইস্তিরি এখন আমাকে খুব ফলটল দ্যায়। টাকাও দিতে চায় আমি নিই না। ওই ফল ঘরে নিয়ে গেলে বৌ খুব রাগ করে।তো আমি ওকে বলি, কী হবে ফলগুলোর সঙ্গে রোগও তোমার ঘরে সেঁধোবে নাকি?তো বৌ রাগ করে বলে আর আনি না ওসব ফল।” তবে কাজকাম করিয়ে পয়সা না দিলে আল্লাতালা তাকে ঠিক চিনে নেন। মোটমজুরকে না দিলে শেষমেশ ডাক্তার বদ্যিকে দিতে হবে।
শ্বেতা চুপ করে ভাবতে থাকে। কী ভাবে এগোচ্ছে সমাজটা।একটা শ্রেণির হাতে অযচ্ছল টাকা।তাদের সংখ্যা গোটা দেশে হাতে গোনা যায়। উল্টোদিকের বিপুল শ্রেণি নিঃস্ব।খেয়ে-পরে বেঁচে থাকার সংস্থানটুকুও তাদের নেই।
এখন অবশ্য আর অতিমারীর বাধানিষেধ বিশেষ মানতে চাইছে না কেউ। কলেজ সবেমাত্র খুলতেই ভেঙে পড়েছে ছাত্রছাত্রীদের ভীড়। অফিস কাছারি আদালত খুলে গেছে। কর্মী কর্মচারীদের কর্মস্থলে যেতেই হচ্ছে। কিন্তু পথে যথেষ্টসংখ্যক পরিবহন নেই। তাহলে সাধারণ মানুষ অপিসকাছারি যাবে কেমন করে? গোটা ব্যাপারটার মধ্যেই কেমন একটা দুষ্টচক্রের ঘূর্ণন । মেয়েদের মধ্যে স্কুলছুট হচ্ছে যারা অনেকেরই অল্পবয়সে বিয়ে হয়ে সন্তানের মা হয়ে যাচ্ছে প্রকৃতির নিজস্ব নিয়মে। বয়ঃসন্ধির ছেলেরা সবসময় মোবাইল গেমে কিংবা ইউটিউবের সস্তা চটুল বিনোদনে বুঁদ হয়ে থাকছে। বই পড়া নেই। নেই গান গাওয়া।সামগ্রিক সুস্থ সংস্কৃতির চর্চা। যা ই করতে হবে হবে রাজনৈতিক দল আর রাজনৈতিক দাদাদের তেলিয়ে।
আর লেখাপড়া শেষ করে কাজ?জীবিকা?কিছুই নেই যে ছেলেমেয়েগুলোর। এদের “মন দিয়ে লেখাপড়া করো”….” কেরিয়ার তৈরির সময় অন্য কোনোদিকে মন দিও না “…..এসব কথা বলে কি লাভ? বিশ্ববিদ্যালয় অনলাইন পরীক্ষা ব্যবস্থা চালু করেছে।সেইসঙ্গে ওপেন-বুক সিস্টেম। পড়ুয়ারা অপরিণত। ছেলেমানুষ। বই নকল করে লিখে ভুরিভুরি নম্বর পাচ্ছে অথচ কিছুই যে শিখছে না তা এখন বুঝছে না।পরে বুঝবে।বরং এই ব্যবস্থায় যেন কিরকম মজা পেয়ে গেছে তারা। তাৎক্ষণিক লাভের আনন্দ। কিন্তু কোথায় চাকরি-বাকরি কোথায়ই বা কর্মসংস্থান? এগুলো যে রাজনৈতিক ফায়দা তোলার পপুলিস্ট কায়দা সেটা তরুণ প্রজন্মের পক্ষে এখনই বোঝা সম্ভব নয়।
শ্বেতার মনে হয় খুব সৌভাগ্য যে তারা কিছু আগে জন্মে তবু একটা সুস্থ-স্বাভাবিক সমাজ দেখার সুযোগ পেয়েছিল। সেই সমাজে দাঁড়িয়ে তারা লেখাপড়া সুস্থ সংস্কৃতি রাজনীতির চর্চা অল্প হলেও করতে পেরেছিল। কিন্তু এখনকার ছেলেমেয়েদের সামনে আছে টা কি? কোনো আইডল আছে কি যাদের জীবনকে লক্ষ্য করে পাথেয় করে তারা এগিয়ে যাবে?জীবন আর মূল্যবোধ গড়বে?
তবে নতুন প্রজন্মের সবই কি খারাপ? সবই নেগেটিভ?নেতিবাচক? এই প্রজন্মের বহু ছেলেমেয়েই তো কতো কাজ করে। পড়াশুনো করে। কতো অজস্র ব্যাপারে তাদের আগ্রহ। জেন এক্স -ওয়াই- জেড…..বহু ভালো ছেলেমেয়ে আছে বিভিন্ন পরিসরে। আর তারা আছে বলেই গড়াচ্ছে ভুবন-সংসারের চাকা।
অনেকেই আছেন যা কিছু নতুন অবলীলায় তাকে নস্যাৎ করেন। পুরোনো যা সবকিছুকে নির্বিচারে ভালো বলেন। আজকের দিনের যা তা এক বাক্যে বলে দেন সবই নাকি খারাপ। শ্বেতা অবশ্য এই মতে মোটেই বিশ্বাসী নয়। ভালো-মন্দ সবযুগেই মিলিয়ে মিশিয়ে থাকে। শ্বেতা তন্ময় হয়ে এইসব ভাবছিল। চটক ভাঙলো রমজানের কথায়…..”কাকিমা সেদিন একটা কান্ড হলো জানো?”
কী কান্ড রে?শ্বেতা শুধোয়।
ওই আমাদের কোঅপারেটিভের বাবুদের মিটিং ছিল তো?……..
তো সেখানে কি হলো….ঝগড়া -মারামারি?…..ও তো লেগেই আছে। প্রেসিডেন্ট -সেক্রেটারি ক্যাশিয়ার হবার জন্য কামড়া-কামড়ি…..ও যে নিত্যদিন কতো দেখছি….শ্বেতা থামে।
হ্যাঁ। মারামারি নয়।তবে তর্ক ঝগড়া তো পচুরই হয়।
কাল আমি চা-বিস্কুট এনে দিলুম বাবুদের জন্য।
তারপর?
তখন মিটিং পেরায় শেষ। বাবুরা গল্পগুজব করতেছে।তো আমি বললুম “বাবু একটা কথা বলবো?”
তো তাঁরা বললেন, বল না…..
আমি বললাম আচ্ছা আমনারা যে বলক দুখানার নাম দিয়েছেন “তিতাস” আর “অবতংস” এর মানে কি?
সব্বাই চুপ মেরে রইলো জানো কাকিমা?কারুর মুখে রা-টি নেই।
দুইখানা টাওয়ারের বাড়ি তো……একখানার নাম দেছে “তিতাস” আর একখানার নাম “অবতংস”……অথচ
কেউ তার মানে জানে না।
তুই তো জানিস।তুই বলে দিলি? তো কি বললি?
তুমি আমাকে সেদিন বলে দিয়েছিলে না?
“অবতংস” মানে গয়না আর “তিতাস” হলো বাংলাদেশের একটা নদীর নাম।
আমি বললাম,বাবু কিছু মনে যদি না করেন……আমি জানি।বলবো?
তো বললাম। তো বাবুরা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছেন আমার পানে।
বলেন তুই জানলি কোত্থেকে? বললাম এক কাকিমার গাড়ি চালাই তিনি বলে দিয়েছেন।
আচ্ছা ওনারা মানে না জেনে নামটা ঠিক করলেন কেন? দিলেন ই বা কেন?
সে আর আমি কি জানি…..
সবাই না জানলেও নিশ্চয়ই কেউ না কেউ জানেন।অন্তত নামটা যিনি দিয়েছেন তিনি তো জানবেনই। শ্বেতার মুখে সামান্য হাসি।
তারপর? তুই বলে দিয়েছিস তো বাবুদের তিতাস আর অবতংস মানে?
হ্যাঁ কাকিমা বলে দিলাম। অবতংস মানে গয়না আর তিতাস একটি নদীর নাম।
বলতে বলতে রমজানের চোখদুটো আলোয় রঙিন স্বপ্নালু হয়ে ওঠে। তিতাসের তীরের মানুষজন আর রমজানেরই মতো তাদের নিত্য জীবনযুদ্ধ,নদীতীরের গ্রামগুলোর ঝড়ে-বন্যায় বচ্ছরকালের সর্বনাশ, পাড় ভাঙা, ঘর ভাঙা আবার ঘর গড়া…….তবু এই নদীই তাদের মা। নদীর মাছ নদীর বাতাস নদীর শ্বাসপ্রশ্বাস নদীতীরের বহু সুপ্রাচীন ম্যানগ্রোভ অরণ্যের দীর্ঘশ্বাস রমজানের বুকের ভিতর খেলা করতে থাকে।আর সেই খেলায় তিতাস-মাতলা-রায়মঙ্গল-বিদ্যেধরী-গোমর-বিদ্যেধরী এপার-ওপারের সব নদী মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়…..তার তীরবর্তী মানুষের জীবনের যাপনেও কোনো পার্থক্য থাকে না।
শ্বেতার বাড়ি থেকে কলেজের দীর্ঘ ষোল কিলোমিটার পথ ফুরিয়েছে। রমজান বলে “সাবধানে নামো কাকিমা। আমাকে এরকম অনেক শক্ত শক্ত বাংলা শব্দের মানে বলে দিও।”