ডোডো যেভাবে এলো
আমরা, মানে মা, ছোট বোন রূপকথা আর আমি সপ্তর্ষি; বাবার জন্য অপেক্ষা করছি। হিসাব মতো নয়টায় বাসায় পৌছানোর কথা, কিন্তু এখন রাত বারোটা। এগারোটার দিকে কল করি, বাবা তখন গাজীপুর চৌরাস্তায়, এখন দেখছি মোবাইল বন্ধ। বাবার জন্য দুশ্চিন্তা হচ্ছে।
এদিকে হয়েছে আর এক যন্ত্রণা। মোবাইল বন্ধের কথা শুনে রূপকথা যে কান্না শুরু করেছে তা থামছেই না। এটা তার পুরানো অভ্যাস, বাবার মোবাইল বন্ধ পেলেই সে কান্না শুরু করে দেয়।
রূপকথা পড়ে ক্লাস ফোরে, সে হয়েছে ঠাকুরমার মতো, ঠাকুরমা আকাশে কালো মেঘ দেখা দিলেও বাবার জন্য উদ্বিগ্ন থাকতেন। কিছুক্ষণ পর পর কল করিয়ে জানতেন বাসায় ফিরতে কত সময় লাগবে।
রূপকথার কান্নার একটা ধরন আছে, সে খাটের মাঝখানে পা মেলে বসবে, কোলে একটা বালিশ নিয়ে থেমে থেমে কাঁদতে থাকবে। তার বসার এই স্টাইলটাও ঠাকুরমার মতো।
মা তার এই আচরণে খুব বিরক্ত; কিন্তু তা প্রকাশ না করে তাকে বুঝানোর চেষ্টা করেন, তিনি বলেন, ‘কান্নার কি হলো, মোবাইলের চার্জ শেষ হয়ে গেছে, এই জন্য বন্ধ, আর চার্জ শেষ হতেই পারে।’
আমিও রূপকথাকে বুঝানোর চেষ্টা করি তবু রূপকথার কান্না থামে না।
এই সময় সিঁড়িতে পায়ের শব্দ পাই, এটা যে বাবার পায়ের শব্দ আমি নিশ্চিত। আমি চিৎকার করে বলি, ‘বাবা এসে গেছেন।’
কিসের কী কান্না, রূপকথা আমাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দৌড়ে গিয়ে দরজা খোলে। বাবা রূপকথার হাতে দুটো মিষ্টির প্যাকেট ধরিয়ে দিয়ে সোজা বাথরুমে ঢোকেন, আমি দরজার হাতল ও প্যাকেট দুটো স্প্রে করে সাবান দিয়ে হাত ধুই।
এক নজরে বাবাকে দেখেছি, বাবার মুখটা ক্লান্তিতে ভিষণ বিমর্ষ দেখায়।
মা বাবাকে বলে, ‘তোমার মোবাইল বন্ধ, আর এদিকে ঘরের মধ্যে তাণ্ডব শুরু হয়েছে। তুমি জানো না তোমার মোবাইল বন্ধ থাকলে ঘরের মধ্যে কি হয়?’
এর মধ্যে রূপকথা ছটফট করতে থাকে। মা তাকে শাসিয়েছেন যেন এক্ষুণি বাবাকে কিছু না বলে। একটা লোক এতো দূর থেকে জার্নি করে এসেছেন, খাবার-দাবার শেষে সুস্থির হয়ে বসলে বলা যাবে।
মধ্যরাতে আমরা চার জন খেতে বসি, বাবা আমাদের দুই বোনের প্লেটে কাঁটা ছাড়িয়ে মাছ দেন।
মা বলেন, ‘তা হলে শেষ পর্যন্ত খামারটা বন্ধ করে দিলে।’
‘আর কী উপায় আছে বলো।’
‘ছেলেগুলোকেও কি করেছে?’
‘বেতন দিয়ে বিদায় করে দিয়েছি, আর শেডের মালিককেও শেডটা বুঝিয়ে দিয়েছি।’
‘চিন্তা করো না, পরিস্থিতি একটু স্বাভাবিক হোক আবার শুরু করবো।’
একটু থেমে বাবা আমাদের দিকে তাকিয়ে বলেন, ‘মেয়েরা কেমন যেন অস্থির অস্থির করছে, বাসায় কিছু হয়েছে কি?’
‘কী আর হবে, বাসায় যখন এসেছ, সবই জানতে পারবে।’
খাওয়ার পর আমরা দুই বোন বাবার দুই পাশে শরীর ঘেঁষে বসি। আমি রূপকথাকে ইশারা করি কথাটা বলার জন্য। আমাদের কোন আবদারের কথা রূপকথাকে দিয়েই বলাই, সে বাবাকে পটাতে পটু, বাবা কখনোই তার আবদার উপেক্ষা করতে পারেন না। আমাদের কিছু একটা পরিকল্পনা আছে বাবা তা ইতোমধ্যে বুঝে গেছেন।
‘বাবা, একটা কাজ করেছি, বকা দিবা না বলো।’
‘কি কাজ করেছ?’
‘আগে বল, বকা দিবা না।’
‘বকা দেয়ার মতো হলে দেব, বকা দেয়ার মতো না হলে দেব না।’
রূপকথা এবার তার আসল অস্ত্র প্রয়োগ করে, বাবার গলা জড়িয়ে ঝুলতে ঝুলতে বলে,‘বলো না বকা দিবা না।’
‘ঠিক আছে, বকা দেব না।’
রূপকথা বাবার গলা ধরে ঝুলে আছে, আমি দৌড়ে বারান্দা থেকে একটা বিস্কুটের কার্টুন টেনে এনে বাবার সামনে রেখে বলি, ‘দেখ এটা কি?’
বাবা ভ্রু কুচকে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলেন,‘ এ তো দেখছি কুকুরের বাচ্চা, শুয়ে আছে, চোখ মেলতে পারছে না।’
মার দিকে তাকিয়ে বাবা বলেন,‘ এটা কি করে এলো?’
‘কি করে এলো, তোমার মেয়েদের মুখ থেকে শোন। ভেবো না আমি নিয়ে এসেছি।’
আমি তখন বলি, ‘শোন শোন, আমি বলছি, আমরা সন্ধ্যায় নিচে যাই বিসকিট কিনতে, আমাদের পাশের বাসার জাবেদ আঙ্কেল, ওই যে একটা জার্মান শেফার্ড পোষেন সেই জাবেদ আঙ্কেলের বাসার সামনে কে যেন বাচ্চাটাকে ফেলে যায়। বাচ্চাটা খুব কান্না করে। রাস্তার দিকে এলেই গাড়ি চাপা পড়ে মরে যাবে। তারপর আমরা বাসা থেকে ঝুড়ি নিয়ে তাকে বাসায় নিয়ে আসি। মা বলেন, ‘তোর বাবা বকা দেবে, আমরা বলি রাতটা থাক, পরে দেখা যাবে কি করা যায়। বাবা না চাইলে আমরা মাঠে রেখে আসবো।’
রূপকথা তখন বলে, ‘চোখের সামনে বাচ্চাটা মরে যেত গাড়ি চাপায়, এটা কি ঠিক হতো?’
মা বলেন,‘বাচ্চা মানুষ নিয়ে এসেছে কি আর করা, একটু ঝরঝরে হোক মাঠে ছেড়ে দিয়ে আসবো।’
বাবা বলেন, ‘ঠিক আছে এনেছ ভালো করেছ, কয়েক দিন পরে মাঠে ছেড়ে দিয়ে এসো। আমরা নিজেরাই ঝামেলায় আছি, বাসায় উটকো ঝামেলা রেখো না।’
আমরা দুই বোন হু-র-রা বলে চিৎকার করে উঠি, দুই দিকে থেকে বাবাকে জড়িয়ে ধরে বলতে থাকি, ‘আমার বাবা, ভালো বাবা, আমাদের বাবা ভালো বাবা।’
ডোডো যখন এডাপশনে
কয়েদিনের মধ্যে মার যত্নে বাচ্চাটা চাঙ্গা হয়ে ওঠে, আর মার পিছ ছাড়ছে না, মার পিছে পিছে ঘুরঘুর করে সারাক্ষণ। এর মধ্যে বাবা কয়েক দিনের জন্য গ্রামের বাড়িতে যান, যাওয়ার আগে বাচ্চাটাকে মাঠে ছেড়ে দিতে বলেন।
বাবা চলে যাওয়ার পর আমরা চিন্তা করি কি করা যায়। মা আসলে বাচ্চাটাকে ছাড়তে চাইছেন না। এতোটুকু বাচ্চা, কি করে মাঠে ছেড়ে দেবেন। এর বিকল্প কি করা যায় ভাবছেন। হঠাৎ মাথায় এলো এডাপশনের বিষয়, এতে বাচ্চাটা যেখানে থাকুক ভালো থাকবে।
‘ক্যান্ডি লায়ন ওজি’ নামে একটা পেজের সঙ্গে মা আগে থেকে যুক্ত, এটি যিনি চালান তিনি একটা ছোটখাটো গার্মেন্টসের মালিক। বাসায় বেশ কয়েকটা কুকুর বিড়াল পোষেন, একটা কুকুরের নাম লায়ন, তার কারখানায়ও দুইটা কুকুর আছে; লালি-জুলি।
এরপর মা ফেসবুকে এডাপশন পোস্ট দিতে থাকেন, এবং কয়েকটা ডগ-লাভার গ্রুপের সন্ধান পেয়ে যান। ঢাকা শহরে যে এতোগুলো ডগ-লাভার গ্রুপ আছে আমাদের জানাই ছিল না। খিলগাঁও কুকুরের একটা রেসকিউ সেন্টার আছে জানতে পারি, রাস্তা-ঘাটে আহত কুকুরকে ধরে নিয়ে চিকিৎসা দিয়ে সুস্থ করে আবার ছেড়ে দেয়। এর কাছাকাছি কুকুরের চিকিৎসার জন্য আর একটা সেন্টার আছে। অনেকে চলতে-ফিরতে অকারণে কুকুরকে ঢিল মারে, লাঠি দিয়ে পেটায়। এই শহরে এদের জন্য এমন ব্যবস্থা ভাবতেও পারিনি।
মা আমাদের বলেন, ‘এই প্রাণীটাকে সবাই দূর দূর করে, অথচ মানুষের জন্য এদের মতো বিশ্বস্থ আর কেউ হতে পারে না। এদের মাথায় একবার যে হাত রাখে তাকে এরা কোন দিন ভুলে না। স্কুলে যাওয়ার সময় মাংসের দোকানের সামনে এরা কী সুন্দরভাবে বসে থাকে দেখোনি?’
এর মধ্যে বেশ কয়েকজন রেসপন্স করে। কিন্তু মা কাউকে পছন্দ করে না। অবশেষে পুরান ঢাকার আরজু নামের কলেজ পড়ুয়া এক আপুকে সিলেক্ট করা হয়। একদিন দুপুরে ওই আপু এসে হাজির। মা ভালো করে খাওয়া-দাওয়া করিয়ে একটা বাটি, প্লেট, কাঁথাসহ বাচ্চাটাকে একটা ঝুড়িতে দেয়। মা আপুটাকে নিয়মিত ডোডোর ভিডিও ক্লিপ পাঠানোর শর্ত দেয়।
আপু নিয়মিত বাচ্চাটার ভিডিও পাঠাতে থাকে। আমরা এসব ছবি দেখি। হঠাৎ ডোডোর ছবি পাঠানো বন্ধ, মোবাইল ফোনেও আপুকে পাওয়া যায় না। মা এ নিয়ে মহা দুশ্চিন্তায়; বলেন, ‘ছেলেটার নিশ্চয় বিপদ হয়েছে।’
বাবা মাকে বলেন, ‘বাদ দাও, মেয়েটা নিয়ে গেছে দায়-দায়িত্ব এখন তার, তুমি তোমার দায়িত্ব পালন করেছ, এখন ভুলে যাও।’
বাবার কথা শোনার পর মা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলেন, ‘তুমি বুঝবে না।’
ততক্ষণে মার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ে।
এর একদিন পর ওই আপু বাচ্চাটাকে বাসায় দিয়ে যান।
বাচ্চাটার অবস্থার খুব খারাপ, হাত পা ছেড়ে দিয়েছে। কিছুক্ষণ পর পর মা আর আমি সেলাইন আর স্যুপ খাওয়াই। ভাগ্যিস এই সময় বাবা বাসায় ছিল না, না হলে বাবা খুব বকা দিতেন।
আসলে অযত্নে বাচ্চাটা অসুস্থ হয়ে যায়, ওই আপু তার এর আত্মীয়ের বাসায় রেখে মামার বিয়েতে যায় রাজশাহীতে। ফিরে এসে দেখে বাচ্চাটা না খেয়ে খেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। ভয়ে ওই আপু আর ডোডোর ছবি দেয় না, কি করবে সেটাও বুঝে উঠতে পারে না। এ ছাড়া পরিবারের সবার চাপ ছিল। আপুটা মনে করেছে বাচ্চাটা মারা যাবে, কাজের লোককে ঠিক করে রেখেছিল মারা গেলে ডাস্টবিনে ফেলে আসার জন্য। মা ওই আপুর মামাকে কল করে চাপ দেয়ায় বাচ্চাটাকে দিয়ে যায়।
বাচ্চাটার এখন এন্টিবায়োটিক লাগবে। মার হাতে বাড়তি কোন টাকা নেই। বাবা সন্ধ্যায় বাসায় ঢুকে বাচ্চাটাকে বারান্দায় দেখে খুব বিরক্ত হন। বলেন,‘ আবার একে নিয়ে এসেছ? এ তো যখন তখন মারা যাবে।’
আমরা রূপকথাকে দায়িত্ব দিই বাবাকে বাচ্চাটার চিকিৎসার টাকা দিতে রাজি করাতে। যথারীতি রূপকথা সোফায় বসে টিভি দেখার সময় বাবার গলায় ঝুলে ঝুলে গল্প করতে থাকে।
‘বাচ্চাটার এন্টিবায়োটিক লাগবে, তুমি কিনে দেবে, না করতে পারবে না। কিনে না দিলে মা মন খারাপ করবে।’
বাবা পরদিন এক ভেট বন্ধুর সঙ্গে আলাপ করে এন্টিবায়োটিক ও কিছু ওষুধ কিনে দিয়ে খামারে চলে যান।
আমরা প্রথমে বাচ্চাটার আশা ছেড়ে দিই, কিন্তু মার যতœ আর ওষুধ পথ্য পেয়ে কয়েক দিনের মধ্যে পুরোপুরি সুস্থ হয়ে ওঠে, আবার ঘরে ঘরে রূপকথার সঙ্গে খেলতে থাকে।
বাবা এসে কি বলে এই নিয়ে আমরা আবার চিন্তিত। প্রথমে ভাবি লুকিয়ে রাখবো, পরে ভাবি যা হবার হবে। বাবা আসার পর দেখি বাচ্চাটা এদিক সেদিক লাফালাফি করছে, ঘরময় ছুটে বেড়াচ্ছে। মাঝে মাঝে বাবাকে একবার দেখে নিয়ে লেজ উচিয়ে দৌড়ে খাটের নিচে লুকিয়ে পড়ছে। আবার উঁকি দিয়ে দেখে দৌড়ে বেরিয়ে বাবার বুড়ো আঙ্গুল কামড়ে দিয়ে দ্রুত পালিয়ে যাচ্ছে।
বাবা ভ্রু কুঁচকে বাচ্চাটার কর্মকাণ্ড দেখে কিন্তু কিছু বলে না। দুই এক দিনের মধ্যে দেখি বাবার সঙ্গে বেশ খাতির হয়ে গেছে। বাবা তার সঙ্গে একটু একটু রেসপন্স করছেন, তবে আমাদের দেখলে চোখ-মুখ শক্ত করে রাখেন।
একদিন দেখি বাচ্চাটা বাবার কোলে ওঠে চুপচাপ বসে আছে, বাবা তার মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করছে। আমি চুপিচুপি মাকে গিয়ে খবরটা জানাই।
মা চমকে ওঠে বলেন, ‘কি বলিস, তোর বাবা ডোডোকে আদর করছে!’ পায়ে পায়ে মা এসে বাবার সামনে দাঁড়ান, মায়ের চোখ পড়তেই বাবা একটু লজ্জা পান।
ডোডো যেভাবে ডোডো হলো
বাচ্চাটাকে বাবা মেনে নিতে শুরু করেছেন, এখন দরকার সুন্দর একটা নাম রাখা। এই নাম রাখা নিয়ে দেখা দিয়েছে নতুন জটিলতা। রূপকথা নামের একটা তালিকা তৈরি করে, কিন্তু তার কোন নামই আমার পছন্দ হয় না। আবার আমি যেসব নাম বলি সেগুলো তার অপছন্দ। অবশেষে আমরা গেলাম বাবার কাছে, বাবা যেসব নাম বলেন সেগুলো আমাদের কারো পছন্দ হয় না। বাবার দেয়া নাম শুনে মা তো রেগেমেগে আগুন। নাম জটিলতার মধ্যে বাবা আবার খামারে চলে যান।
বাবা যাওয়ার দুই দিন পর নানী এলেন কয়েক দিনের জন্য।
নাম সমস্যার সমাধানে আমরা এবার নানীর শরণাপন্ন হই।
নানী আমাদের সব কথা শুনে বলেন, আমি একটা সুন্দর নাম দিতে পারি, তবে দুটো শর্ত; প্রথম শর্ত আমি যে নাম রাখবো সেটাই ফাইনাল। দ্বিতীয় শর্ত, খালি মুখে নাম রাখা যাবে না, তার জন্য ছোটখাটো অনুষ্ঠান করতে হবে। আমরা নানীর প্রস্তাবে রাজী হয়ে যায়। বাচ্চাটার নামকরণ অনুষ্ঠান হবে আমরা মহা খুশি। আমাদের দুবোনের জমানো সব টাকা জড়ো করে দেখি দুইশ টাকার বেশি হয় না। আমরা এই টাকা নিয়ে অসহায়ের মতো মার কাছে যাই। মা বলেন, ‘বাকী টাকা তোমাদের নানী দেবে।’ আমরা দৌড়ে গিয়ে নানীকে ধরলাম।
মা নানীকে সঙ্গে নিয়ে টোপর, বেলুন, মোমবাতি, কেক আর মিষ্টি কিনে আনেন। শুরু হয় নামকরণ অনুষ্ঠান, রূপকথা এখানে সেখানে বেলুন রাখে, লম্বা দুই কান ঢেকে টোপর পরিয়ে দিই। বেলুন দেখে লম্ফঝম্প শুরু করে, আর একটার পর একটা বেলুন ফাটিয়ে চলছে বাচ্চাটা। সে কী কাণ্ড! কেক কাটার জন্য অপেক্ষা করছি, নানী নাম ঘোষণার পরপরই কেক কাটা হবে। আমরা নানীর মুখের দিকে তাকিয়ে আছি অধীর আগ্রহ নিয়ে ..।
নানী বলেন, ‘ডো .. . ডো .., ডোডো।’
আমরা ডোডো বলে চিৎকার করে উঠি, ডোডো আরো উত্তেজিত হয়ে লেজ উঁচিয়ে লাফাতে থাকে।
ডোডো গেল মামার বাড়ি
নাম ঠিক হলো। আবার সমস্যা দেখা দেয়। নানা কারণে বাবার সময় ভালো যাচ্ছে না। সবসময় মাথা গরম, সামান্য কিছুতে ক্ষেপে যান। বাবার কড়া নির্দেশ ডোডোকে এডাপশনে দিতে হবে। আমরা বাবাকে কনভিন্স করার সাহস পাই না, মা-ও সাহস পান না। আবার ডোডোর জন্য শুরু হলো এডাপশন পোস্ট, অনেক খোঁজাখুঁজির পর একজনকে পাওয়া যায়, তার নাম আল-আমীন, থাকেন নারায়ণগঞ্জে।
ডোডোকে দিয়ে দেয়া হবে শুনে রূপকথা আবার কান্না শুরু করে; এবার কান্না করে খাটে উপুড় হয়ে শুয়ে মাথার ওপর বালিশ চাপা দিয়ে। এটা তার কান্নার আর একটা স্টাইল। বাবা বহু চেষ্টা করে তাকে থামায়, তাকে বুঝানো হয়, কয়দিন পর ডোডোকে নিয়ে আসা হবে।
আমাদের সঙ্গে সঙ্গে ডোডোরও মন খারাপ। তাকে নিয়ে বাবা, আমি আর রূপকথা মেইন রোডে গিয়ে দাঁড়ায়, বাবার কোলে ডোডো মাথা রেখে চুপ করে শুয়ে আছে, একটুও ছটফট করছে না; কয়েক বছর আগে রূপকথাকে কোলে নিয়ে বাবা রাস্তায় গাড়ির জন্য যেভাবে অপেক্ষা করতো সেই রকম। পথচারীদের অনেকে বাবার দিকে তির্যকভাবে তাকায়, এক নারী তার ছেলেকে দেখিয়ে বলেন, ‘ দেখ দেখ লোকটা কুকুরের বাচ্চা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, মানুষের বাচ্চার মতো।’
কিছুক্ষণ পর একটা ছেলে এলো মজবুদ গড়নের, মাথার দুই দিকে চুল ছাঁটা। সঙ্গে মোটাসোটা একজন। ছেলেটা সরাসরি বাবার সামনে এসে বলে,‘আমি আল-আমিন, ডোডোকে নিতে এসেছি।’ আল-আমিন আঙ্কেল এসেছেন নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ থেকে, লক-ডাউনের মধ্যে। বাবা জিজ্ঞাসা করেন কিভাবে এলেন, গাড়ি-ঘোড়া চলছে না। সে বলে ভিতরের রাস্তা দিয়ে সিএজি নিয়ে এসেছি।
ডোডোকে ভালো করে দেখার জন্য নিচে ছেড়ে দেন বাবা, তখনও সে ভদ্র বাচ্চার মতো দাঁড়িয়ে আছে, এদিক সেদিক দৌড়াচ্ছে না। কেবল বাবার পা ঘেঁষে দাঁড়াচ্ছে। প্রথম দেখায় ডোডোকে আঙ্কেলের পছন্দ হয়।
বাবা বলেন, ‘এতো দূর কী করে নেবেন, কোলে করে এতো দূর নেয়া যাবে না।’
উনি একটা ঝুড়ি কিনে আনতে গেলে ডোডোকে আমি কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকি, কিন্তু বাবার কোলে যাওয়ার জন্য ছটফট করে। রূপকথা বলে, ‘আমি মনে করেছি ডোডোকে লোকটার পছন্দ হবে না।’
আমি মনে মনে চেয়েছি ডোডোকে যেন পছন্দ না হয়।
আঙ্কেল একটা ঝুড়ি নিয়ে এলে এক বোতল পানি আর কিছু বিস্কুট কিনে দেন বাবা। পথে সিএনজি থামিয়ে পানি আর বিস্কুট খাওয়াতে বলেন। ঝুড়িতে রাখার পরও ডোডো ঝাপাঝাপি করেনি, কেবল আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে করুণভাবে। আমি ভেবেছি রূপকথা ঝামেলা করবে কিন্তু সেরকম কিছু সে করেনি। সিএনজি ছেড়ে যাওয়ার পর আমরা দাঁড়িয়ে থাকি হতবিহ্বল হয়ে।
বাবা আমাদের আইসক্রিম কিনে দেন এবং আমাদের মনোযোগ সরানোর জন্য গল্প করেন, কিন্তু আমাদের ভীষণ মন খারাপ, বাবার কোন কথাই আমাদের মাথায় ঢুকে না।
বাসায় গিয়ে সোফায় বসতেই, ‘আমার ছেলেটাকে দিয়ে এলে’ বলে কাঁদতে থাকেন মা। বাবাকে এ সময় ভীষণ বিমর্ষ দেখায়। বাথরুমে ঢুকে অনেক সময় নিয়ে গোসল করেন এবং বাইরে চলে যান ফিরেন অনেক রাতে। পরদিন ভোরে বাবা ঢাকার বাইরে চলে যান। এদিকে ওই রাতে মা কিছুই খাননি।
এখানে একটা কথা বলে রাখি, ডোডো আসার আগে আমাদের দমবন্ধ হওয়ার মতো অবস্থা। ঘুমানো খাওয়া টিভি দেখা আর চার দেয়ালের মধ্যে ঘুরে বেড়ানো- আমরা একেবারে বিরক্ত হয়ে গেছি। রূপকথা তো রীতিমতো গেমে আসক্ত হয়ে পড়ে, মাঝে মাঝে শুয়ে শুয়ে কান্না করে। ডোডো চলে যাওয়ার পর সে দিনগুলোর কথা মনে পড়ে। আর ডোডো যদি ফিরে না আসে, তাকে যদি না পাঠায় তখন কি হবে ভাবি।
প্রতি সন্ধ্যায় আল-আমীন মামা ডোডোর ভিডিও পাঠান। আমারা সেগুলো দেখি। সারাদিন আমরা অপেক্ষা করি কখন সন্ধ্য হবে, কখন ডোডোর ভিডিও দেখতে পাবো। দুই একদিন পর ভিডিওতে দেখি ডোডো কিছু খাচ্ছে না, আল-আমীন মামা তাকে তার মুখে খাবার তুলে দেন সে খাবার ফেলে দেয়।
আমারা এই ভিডিও বাবাকে ফরওয়াড করি, বাবা উত্তর দেন ‘আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে, তোমাদের ভুলতে পারছে না সে জন্য এমন করছে।’
এভাবে দেখতে দেখতে সাত আট দিন চলে যায়। এক ভিডিওতে দেখি ডোডোর চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে, মামা তা মুছিয়ে দিচ্ছে। এই ভিডিও দেখার পর মা খাওয়া-দাওয়া ছেড়ে দেয়। এরপর দুই দিন কোন ভিডিও পাঠায় না আল-আমীন মামা।
তৃতীয় দিনের দিন দুপুরে হঠাৎ আল-আমীম মামা মাকে ফোন করে বলেন, ‘আপা আমি ডোডোকে নিয়ে এসেছি, বাসার ঠিকানাটা একটু বলেন।’
ফোন রেখে মা চিৎকার দিয়ে ওঠে, ‘ডোডো আসছে..। ডোডোর মামা আসছে ডোডোকে নিয়ে।’ রূপকথা খুশিতে লাফাতে থাকে। বাসায় ঢুকে ঝুড়ি থেকে বের করতেই ডোডো লাফিয়ে মায়ের কোলে গিয়ে মায়ের বুকের মধ্যে ল্যাপ্টে থাকে। আল-আমীন মামা বলেন, ‘আপা ডোডো আপনাদের ভুলতে পারছে না, আপনারা ভিডিওতে দেখেছেন এই কয়দিন পানি ছাড়া কিছুই খায়নি, আমার কাছে থাকলে ও না খেয়ে মারা যাবে। তাই বাধ্য হয়ে নিয়ে এসেছি।’
‘ভালো থাকিস ডোডো, মামা পরে এসে দেখে যাবো’ বলে আল-আমিন মামা কাঁদতে কাঁদতে চলে যান, মা কতো বললেন এককাপ চাও খেলেন না।’
ফিরে এলো ডোডো
সবাইকে পেয়ে ডোডো আবার উৎফুল্ল। তবে কয়েক দিন খাবারের অনিয়মে কিছুটা কাহিল। তবে মার যত্নে সে আবার শক্তি ফিরে পায়। দৌড়ে এসে মার কোলে ওঠে মুখটাকে লম্বা করে উ-উ-উ উ শব্দ করতে থাকে। আমি মাকে বলি, ‘সে বলতে চাইছে তুমি আমাকে ছেড়ে দিয়েছ কেন? তুমি কেমন মা এতোটুকু বাচ্চাকে ছেড়ে দাও। ’
ডোডো দৌড়ে এসে বাবার সামনে শুয়ে পড়ে তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করে।
রূপকথা বলে, দেখ দেখ ও তোমার সঙ্গে খেলতে চায়, তুমি একটু আদর করে দাও।
বাবা চোখমুখ শক্ত করে রাখেন, কিছু বলেন না।
রূপকথা বলে,‘বাবা তুমি বাচ্চাটাকে আদর করো না কেন? তুমি কেমন নিষ্ঠুর হয়ে যাচ্ছ।’
বাবা বলেন ‘করি তো।’
বাবা যখন সোফায় বসে কোন কাজ করেন, পায়ের কাছে সামনের পা দুটোর ওপর মাথা রেখে শুয়ে আড় চোখে দেখে বাবা কি করেন। আমার ধারণা সে বাবার মনোযোগ আকর্ষণ করার চেষ্টা করে।
বাবা ডাকেন ‘ডোডো’
সে একবার ডান দিকে আর একবার বাম দিকে মাথা নাড়ে, তারপর উঠে লেজ নাড়তে নাড়তে পায়ের কাছে বসে পড়ে।
বাবার বাইরে যাওয়া তার মোটেই পছন্দ নয়। মোজা পরার পর সে কামড়ে মোজাটা খুলে নিয়ে দৌড়ে অন্য ঘরে লুকিয়ে থাকে। বাবা বাইরে গেলে অস্থির হয়ে একবার বারান্দা দিয়ে একবার জানালা দিয়ে দেখার চেষ্টা করে। বাবা দোতলায় উঠার পর কি করে যেন বুঝে যায়, দরজা খুলে দেয়ার জন্য দুই পায়ে দরজা খামছাতে থাকে। বাবা ঢুকার সঙ্গে সঙ্গে বাবার বুকের মধ্যে ঝাপিয়ে পড়ে ডোডো।
তাকে আমি আর রূপকথা বলি, ‘বাবা কই, বাবা কই?’ সে দৌড়ে বারান্দায় গিয়ে মুখটা লম্বা করে ডাকতে থাকে ভু ভু ভু ..
এর মনে বাবা বাইরে গেছে।
ডোডো মাছ মাংস ডিম দুধ ছাড়া কিছু খায় না, সকালে মাংস খেলে দুপুরে মাংস দিয়ে খায় না, হয় মাছ কিংবা দুধ দিতে হয়। আমি বুঝতে পারি বাবা মা আমাদের খাবারের যোগান নিয়ে উদ্বিগ্ন।
মা দেখি বাবাকে এসে বলেন, ‘ডোডোর খাবারের মাংস নেই।’
বাবা দেখি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলেন, ‘ হয়ে যাবে।’
হঠাৎ একদিন মনে হয়, মা মাছ মাংস খাওয়া ছেড়ে দিয়েছেন। আমি মাকে বলি, ‘তুমি মাছ-মাংস খাওয়া ছেড়ে দিয়েছ কেন?’
মা কোন উত্তর দেয় না, পরে বলে, ‘তোমাকে এসব নিয়ে ভাবতে হবে না।’ আমার মন খারাপ হয়ে যায়, ভাবি রূপকথাকে এই কথা জানাবো, রূপকথা জানলে কান্নাকাটি করে পরিস্থিতি খারাপ করে তুলবে, পরে বাবা মা দুজনে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়বেন।
এর কিছু দিন পর আমি লক্ষ্য করি বাবাও মাছ মাংস খাওয়া ছেড়ে দিয়েছেন। আমি খাবার টেবিলে বলি, ‘বাবা তুমি মাছ-মাংস খাচ্ছ না কেন? কাজটা কিন্তু ভালো হচ্ছে না।’ বাবা বলেন, ‘ইদানীং আমার মাছ-মাংস খেতে ভালো লাগে না।’ মা বাবার দিকে নীরবে তাকিয়ে থাকেন।
বাবা কখনো দিনের বেলা শুয়ে থাকলে ডোডো এদিক সেদিক তাকাবে, তারপর দৌড়ে খাটে উঠে বাবার গাল চেটে নিয়ে আবার নেমে যায়। এই কাজটা সে অন্য কারো সঙ্গে করে না।
মা দুঃখ করে বলেন, ‘ডোডো, এই কাজটা আমাদের কারো সঙ্গে করে না, ওর সেবা যত্ন করলাম আমি, আর ভালোবাসে তার বাবাকে।’
বাবা বলেন, ‘ আমাকে ভালোবাসে তা সত্য, কিন্তু তার কাছে তোমার যে আসন সেটা অন্য কেউ নিতে পারবে না। সে আমাদের চারজনকে চার রকম ভালোবাসে।’
তাকে যদি বাবা বলেন, ‘ডোডো বোনেরা দুষ্টামি করছে, বকা দিয়ে আয়।’
সে দৌড় দিয়ে গিয়ে ভুক ভুক করে আসে।
আবার যদি বলা হয় তোর মাকে বকা দিয়ে আয়, সে উল্টা বাবার দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে ভুকতে থাকে।
এক সন্ধ্যায় আমরা সবাই বসে চা খাচ্ছি, ডোডো মার পায়ের কাছে শুয়ে আছে।
বাবা বলেন, ‘ডোডো আমাদের অবস্থা খুব খারাপ, তুই বড় হইছিস, তুই চলে যা না এবার। ’
কিছুক্ষণ পর দেখি ডোডো মনটা খারাপ করে আছে, তারপর উঠে গিয়ে বারান্দায় সামনের দুই পায়ের ওপর মাথা রেখে শুয়ে আছে, দুই চোখে অদ্ভূত চাহনি। তার এই আচরণ দেখে মার চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ে। এমন একটা বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়বেন বাবা ভাবতেও পারেননি। এখানেই শেষ নয়, ওই রাতে ডোডো কিছুই খায়নি। এরপর থেকে আমরা সবাই সতর্ক থাকার চেষ্টা করি, তবু কখনো কখনো বিরক্তি প্রকাশ করলে সে কিভাবে যেন বুঝে যায়, মন খারাপ করে থাকে।
ডোডোর নানা কীর্তি
আমি রূপকথা। ডোডোকে নিয়ে আমার পেটেও অনেক কথা জমে আছে। আমি কিছু কথা বলতে চাই। ডোডোরা আমাদের মতো কথা বলে মনের ভাব প্রকাশ করতে পারে না। তবে তারা অনেক কিছু বোঝে, মনের ভাবও প্রকাশ করে। আমরা চাইলে তাদের মনের অনেক কথা বুঝতে পারি। আমি যেমন ডোডোর অনেক কথা বুঝতে পারি। ডোডো কেবল ‘ভুক ভুক’, ‘ভু..য়ু’ আর ‘কুঁই কুঁই’ এই কয়টা শব্দ করতে পারে, কিন্তু এই কয়টা শব্দ দিয়েই মনের সব ভাষা প্রকাশ করতে পারে। আর ডোডোদের আছে লেজ, এই লেজ দিয়েও তারা মনের অনেক ভাব প্রকাশ করে। আমরা বলি লেজ গুটিয়ে থাকা, বা লেজ গুটিয়ে পালিয়ে যাওয়া; আসলে এরা ভয় পেলে লেজ গুটিয়ে রাখে।
আর খুশিতে তারা লেজ নাড়তে থাকে, কেউ যদি ভালোবেসে কিছু খাবার দেয় তখন কৃতজ্ঞতায় তারা যে লেজ নাড়ে তা দেখতে দারুণ লাগে। আর তারা যখন রেগে যায় তখন এরা লেজ একেবারে খাড়া করে ফেলে। অনেকে বলেন, কুকুরের লেজ কখনো সোজা হয় না, আসলে দরকার হলে সোজাও করে।
বাবা বাসার বাইরে থাকে তখন ডোডো বারান্দায় একটা চেয়ারে বসে রাস্তার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে, আর ঘরঘর পায়চারি করে। মাঝে মাঝে, বিশেষ করে সন্ধ্যার পর গলাটা বাড়িয়ে অত্যন্ত করুন একটা স্বরে ‘ভু-য়ু’ করে ডাকতে থাকে। বাবা যখন টানা কয়েক দিন বাইরে থাকে তখন ডোডো রাত হলে দরজার সামনে বসে থাকে কুঁইকুঁই করে কান্না করে।
মা বাইরে থেকে এলে ডোডো লাফ দিয়ে ওঠে মার ব্যাগ দেখবে কিছু এনেছে কি না তার জন্য, এরপর মায়ের হাতের তালুতে হাত রেখে অদ্ভূত একটা শব্দ করবে আর গরুর বাছুরের মতো মাথা দিয়ে ঢুস মারবে; এর মানে হচ্ছে কি এনেছ তাড়াতাড়ি দাও। খাওয়ার পর ল্যাজ নাড়তে থাকবে, এটা খুশিতে ল্যাজ নাড়ানো।
বল, পুতুল যা পায় তাই দিয়ে সে খেলতে চায়, আমার সবগুলো টেডিবিয়ার সে কামড়ে ছিঁড়ে ফেলেছে, এটা তার খেলা। এছাড়া বল নিয়েও সে খেলে। তার খেলনাগুলো কেড়ে নিলেই সে ক্ষেপে যায়, এই সময় গলার রগ ফুলিয়ে ভো ভো করে ভয়ঙ্কর শব্দে সে ডাকতে থাকে আর গোলগোল ঘুরতে থাকে।
মা তখন বলে, পাগল ক্ষেপেছে; মা দিদি আমাদের কারো কথা সে শুনে না, বাবা-ই কেবল তাকে শান্ত করতে পারে।
বাবা গলার আওয়াজ চড়া করে যখন বলেন ‘ডোডো এসব কি হচ্ছে?’ তখন আবার আ্যা অ্যা শব্দ করতে করতে বাবার সামনে শুয়ে গড়াগড়ি খেতে থাকে।
ডোডো আমাদের চার জনের বাইরে কাউকে গ্রহণ করতে পারে না। অবশ্য করোনার কারণে কেউ বাসায় আসেও না। মাঝখানে ডাক্তার দেখাতে আমার নানা ভাই এলেন বাসায়। নানা ভাই বাইপাসের রুগী, ডোডো তার সঙ্গে কি আচরণ করে এই নিয়ে আমরা সবাই চিন্তিত।
মা ওকে বুঝিয়ে বলে, তোমার নানা হয়, নানার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করো না, নানা ডাক্তার দেখিয়ে চলে যাবে। ডোডো মাথা নাড়ে, আর চোখ পিটপিট করে তাকিয়ে থাকে। তার এই অভিব্যক্তির মানে হচ্ছে চিন্তার কিছু নেই। সত্যি সে ভালো ব্যবহার করে; আমরা ভাবতেও পারিনি যে সে এতোটাই ভালো ব্যবহার করবে, এই ভালো ব্যবহার কখনো কখনো নানা ভাইয়ের জন্য বিড়ম্বনার কারণ হয়ে ওঠে।
নানা ভাই বাথরুমে গেলে সে বাথরুমের বাইরে বসে থাকে, ডাইনিং টেবিলে খেতে বসলে পায়ের কাছে বসে থাকে, রাতে ঘুমানোর সময় মাথার কাছে মেঝেতে শুয়ে থাকে, রাতে যতবার বাথরুমে যান ততোবার সে পিছে পিছে গিয়ে বাথরুমের সামনে বসে থাকে।
নানা ভাই তাকে ডাকে ভাই বলে, ‘তুই আমার পিছে পিছে থাকিস না ভাই।’
এক সন্ধ্যায় নাস্তা পর নানা ভাই সোফায় বসে টিভি দেখছেন, ডোডো পায়ের কাছে বসে আছে। দুজনেরই কোন সাড়া শব্দ নেই। মা উঁকি দিয়ে দেখে ডোডো কুট কুট শব্দ করে কি যেন খাচ্ছে।
‘বাবা, ডোডো কি খাচ্ছে?’
‘ভাই আমার সুপারি খাচ্ছে।’
‘তুমি ছেলেটাকে সুপারি দিলে কেন?’
‘ও খাইতে চাইল, দিলাম, দেখ না ভাই আমার কি সুন্দর করে খাচ্ছে।’
‘খাইতে চাইল, আর তুমি দিলা, কয়দিন পর কি পান বিড়ি খাওয়াবে?’
এর কিছু দিন পর বাবা মা দুই জনের জ্বর, বাবা মা একরুমে আমরা আরেক রুমে। আমাদের কভিড শুনে কাজের মেয়েটা কাজ ছেড়ে দিয়েছে। এমন একটা সময় আত্মীয়-স্বজন কাউকে কাছে ডাকা যায় না।
বাবা মা দুজনেই আমরা দুই বোন আর ডোডোকে নিয়ে চিন্তিত। ডোডোকে যতোটা সম্ভব আমাদের কাছে রাখার চেষ্টা করি। কিন্তু সে কিছু সময় পর পর তাদের গিয়ে দেখে আসে। বাবার জ্বর বেশি না হলেও খুব কাশি, মাঝে মাঝে শ্বাসকষ্ট। একদিন বাবা বালিশে হেলান দিয়ে শুয়ে আছেন, মা আছেন পাশে সোফায়। বাবা ভীষণ কাশছেন, হঠাৎ দেখি ডোডো দৌড়ে এসে বাবার বুকের ওপর দুই পা দিয়ে চেপে ধরে আছে, আর অ্যা অ্যা অ্যা অদ্ভূত শব্দ করছে। বুক চেপে ধরার কারণ বুঝতে পারি কিন্তু অ্যা অ্যা শব্দের কি কারণ বুঝতে পারিনি।
তার এই কাণ্ড দেখে আমরা সবাই অবাক। কিছুক্ষণ পরে মা ইচ্ছা করে কাশতে থাকে ডোডো কি করে দেখার জন্য। কাশির শব্দ শুনে ডোডো ঠিকই দৌড়ে এলো, তবে মাকে ভ্রু কুচকে দেখে নিয়ে ধমকের সুরে ভুক ভুক শব্দ করে দৌড়ে চলে যায়। এর মানে হচ্ছে, তুমি মিথ্যামিথ্যি কাশছ কেন?
ডোডো আমাদের দুবোনের মারামারি ঝগড়াঝাটি একেবারে পছন্দ করে না। কোন কারণে ঝগড়া বা মারামারি লাগলে সে প্রথমে মার সামনে গিয়ে গলা ফুলিয়ে ভুগ ভুগ করতে থাকে। আর দৌড়ে এসে মায়ের সামনে আসে আর একবার আমাদের কাছে আসে, শেষে মাকে ধমকের সুরে ভুকতে থাকে, এর মাধ্যমে সে মাকে বুঝাতে চায় বোনেরা ঝগড়া করছে তুমি কিছু বলছ না কেন?
তারপর মা যখন বলে, দেখতো ডোডো বোনেরা কেন ঝগড়া করছে কেন? সে দৌড়ে গিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে দেখে কে আসলে দোষী, মানে কে মার দিচ্ছে। যে মার দিচ্ছে তাকে গিয়ে কামড়ে ধরতো। কোন কোন সময় বুঝতে পরতো না কে দোষী, তখন আমাদের দুজনকেই কামড়াতো সমানে।
সবচেয়ে মজার কাণ্ডটা করে বাবার সঙ্গে। বাবা তাকে বকাবকি করলে সে চুপ করে শুনে, একটা সময় পর সে জোরে জোরে ভুকে, ভুকতে ভুকতে দৌড়ে এসে বাবার ঘাড়ে কামড়ে ধরে, যতক্ষণ না বাবা মেঝেতে শুইয়ে পড়ে ততক্ষণ কামড়ে ধরে। তার এই আচরণের মানে হচ্ছে তুমি আমাকে বকা দিচ্ছ কেন?
সত্যি সত্যি তার ওপর বাবা কখনো রাগ করলে সে সেটা বুঝতে পারে এবং খাটের নিচে বা সোফার নিচে লুকিয়ে যায়, পিটপিট চোখে বাবার মতিগতি বুঝার চেষ্টা করতো। বাবার রাগ কমলে পর বেরিয়ে আসে।
আমাদের নানা ভাই কই মাছ পছন্দ করেন। অনেকদিন পর বাসায় দেশি কই মাছ রান্না হয়, কই মাছ ভাজি হচ্ছে লাল লাল করে, আর লাউ দিয়ে কই মাছ।
কই মাছ ভাজার পর ডোডো মার পিছ ছাড়ে না। তাকে দুধ দিয়ে ভাত দেয়া হয়, সে না খেয়ে ডাইনিং টেবিলের দিকে মুখ তুলে গন্ধ সুঁকে।
মা বাবাকে বলেন, ‘দেখ না, কই মাছ ভাজার পর থেকে আমার পিছ ছাড়ছে না, দুধ ভাতও খায়নি।’
‘ও কইমাছ খাবে, ওকে মাছ দিয়ে একটু ভাত মেখে দাও।’
বাবা বলেন, ‘ডোডোকে কই মাছ দিয়ে ভাত মেখে দিতে পারি এক শর্তে তোমার বরাদ্দের মাছ দিতে পারবে না, তার জন্য একটা ভাজতে হবে।’
কইমাছ দিয়ে ভাত খেয়ে ডোডো মার পায়ের কাছে শুয়ে থাকে।
ডোডোর একটা সুন্দর পানির পাত্র ছিল, ওটাতেই সে পানি খেত। এই পানি সরবরাহের দায়িত্বে ছিল আমার। পানির দরকার হলে সে আমার কাছেই চাইতো, আর কারো কাছে নয়। পানির খালি পাত্রটা মুখে নিয়ে দৌড়ে আমার কাছে চলে আসে, অন্য কেউ পানি দিতে এগিয়ে এলে সে তেড়ে যায়।
কঠিন সময়ে ডোডো
মা গাছ খুব পছন্দ করেন, বিশেষ করে ফুলের গাছ। আমাদের স্কুল বন্ধ, কবে খুলবে জানি না, বাইরে যাওয়া নিষেধ, আত্মীয়-স্বজনদের বাসায় যাওয়া যাচ্ছে না, তারাও কেউ আসতে পারেন না- এই পরিস্থিতিতে সময় কাটানোর জন্য মা ছাদে বাগান করতে থাকেন। আমি আর দিদি মাকে সহযোগিতা করি, ডোডোও আমাদের সঙ্গে থাকে। বিকেল হলেও সে ছাদে যাওয়ার জন্য উৎপাত শুরু করে দেয়, ছাদের চাবি মুখে নিয়ে দৌড়ে ছাদের দরজার কাছে চলে যায়।
একটা দুইটা করতে করতে ছাদে অনেকগুলো গাছ হয়ে যায়। ড্রামে বাবা একটা নিম লাগায়। দেখতে দেখতে নিম গাছটা অনেক বড় হয়ে যায়। রোজ বিকেলে আমরা সবাই ছাদে চলে যাই, গাছের যত্ন নিই, ডোডো আমি দিদি খেলি। সন্ধ্যা হলে পুলিশ বাইরে বের হওয়া লোকদের তাড়া করে বাসায় ঢোকার জন্য, ছাদ থেকে আমরা সেই দৃশ্য দেখি। পুলিশের সিটি বাজানো, হইহুল্লোড়ের শব্দে ডোডো ধমকের সুরে ভুকতে থাকে।
এভাবে ভালোই সময় কেটে যাচ্ছে, কিন্তু আমাদের জন্য যে একটা খারাপ পরিস্থিতি অপেক্ষা করছে ভাবতে পারিনি। আমাদের কয়েক মাসের ভাড়া বকেয়া হয়ে গেছে। এই নিয়ে বাবা খুব দুশ্চিন্তায়। বাড়িওয়ালা ভাড়া আদায়ের কৌশল হিসেবে ছাদ থেকে সবগুলো গাছ সরিয়ে নিতে বলে, এর পরে বলে ডোডোকে ঘরে রাখা যাবে না। এ দুটো কাজ না করলে বাড়ি ছাড়তে হবে। বাবা কষ্টশিষ্ট করে বাড়িওয়ালাকে কিছু টাকা দেয়। কিন্তু বাড়িওয়ালা ওই দুটা শর্ত থেকে সরে আসে না। এর মধ্যে ছাদে যাওয়াও বন্ধ করে দেয়।
ছাদে যেতে না পেরে, সারাক্ষণ ঘরে থেকে থেকে ডোডো নিজেও বিরক্ত, বারান্দার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে গলা লম্বা করে কেবল ভুকতে থাকে।
এই পরিস্থিতিতে একটাই বিকল্প, হয় ডোডোকে কোথাও রেখে আসতে হবে, নইতো বাসা ছেড়ে দিতে হবে।
এতগুলো টাকা দিয়ে বাসা ছাড়া সম্ভব নয়, তাই ডোডোকে ছেড়ে দিতে হবে।
ডোডোকে রাখার একজনই আছেন, আল-আমীন মামা। তার সঙ্গে যোগাযোগ করে মা জানতে পারেন তার পরিবারের সবাই অসুস্থ, করোনা হতে পারে। তবু সে বলে তারা সুস্থ হয়ে ডোডোকে নিয়ে যাবে।
ডোডোকে নিয়ে আমরা আবার সমস্যায় পড়ে যাই।
মা বাবাকে বলেন, ‘তুমি একটা কাজ করো, রাজারবাগের দিকে কারো কাছে কিছু দিনের জন্য রাখা যায় কিনা দেখ। কয়দিন পর তো বাসা পাল্টে ফেলবো, তখন নিয়ে আসবো।’
কয়েকদিন থেকে মার চেহারা থমথমে, খাওয়া-দাওয়া ঠিক মতো করছে না। বাবাকে বলেন, ‘তোমাকে একটা কাজ দিয়েছি, তুমি কাজটা করছ না।’
মা বাবাকে বলেন, ‘ডোডোর ব্যবস্থা হয়ে গেছে, এক মহিলাকে ঠিক করেছি, কাল তোমাকে নিয়ে যাবো।’
ওই মহিলার কাছে ডোডোকে দিয়ে এসে বাবা আবার খামারে চলে যান। দুইতিন পর মা দিদি আর আমি ডোডোকে দেখতে যায়, গিয়ে দেখি ওই মহিলার ঘরের সামনে এক কোণে ডোডো শুয়ে আছে, সারা শরীরে ময়লা, এখানে ওখানে আঘাতের চিহ্ন।
ওই মহিলা বলে, ‘আপনারা যে খাইয়ে গেলেন তারপর ডোডো আর কিছুই খায়নি, কত চেষ্টা করলাম সে কিছুতেই খাবে না। আর এখান থেকে বের হতেও পারেনি, যতবারই বাইরে যাওয়ার চেষ্টা করেছে ততবার বাইরের কুকুরগুলো তার ওপর হামলে পড়েছে। কুকুরটা আপনাদের ভালোবাসে।’
আমরা প্রতিদিন সন্ধ্যায় গিয়ে ডোডোকে খাবার দিয়ে আসি, প্রতিদিনই ডোডো আসার জন্য বায়না ধরে। কোন কোন দিন রিকশায় ওঠে বসে থাকে, কোন কোন দিন আমাদের আগে আগে হাঁটতে থাকে। এই করতে করতে মার শরীর দ্রুত খারাপ হতে থাকে।
ডোডো আবার মামার বাড়ি
ডোডোকে নিয়ে কি করবো বুঝে উঠতে পারি না আমরা, প্রতিদিন এত দূর গিয়ে খাবার দিয়ে দিয়ে আসা সম্ভব নয়, আর ওখানে তার থাকাও নিরাপদ নয়, কুকুরগুলো কোনভাবেই তাকে মেনে নিতে পারছে না। এই প্রথম বুঝতে পারি প্রতিটা এরিয়া কুকুরগুলোর দখলে থাকে, নতুন করে অন্য কুকুরের ওই এলাকায় প্রবেশ কঠিন। এর মধ্যে বাসা বদল করাও সম্ভব হয়নি। এমন পরিস্থিতিতে এক সকালে আল-আমীম মামা মাকে কল করে ডোডো কেমন আছে জানতে চায়। সে বলে, ‘আপা কিছু মনে না করলে একটা কথা বলি।’
‘বলেন ভাই।’
‘আমরা সবাই এখন সুস্থ, ডোডোকে যদি নিয়ে আসতে চাই দেবেন?’
মা বলেন, ‘দেবো না কেন, ডোডো আপনার কাছে থাকলে ভালো থাকবে।’
আমরা সবাই একদিন সকালে একটা সিএনজি ভাড়া করে ডোডোকে নিয়ে আল-আমীন মামার বাড়িতে যাই। ডোডোকে পেয়ে আল-আমীন মামা মহা খুশি, ডোডোও তাদের পেয়ে খুশি।
দুপুরে আল-আমীন মামার বাসায় খেয়ে আমরা সোনারগাঁও জাদুঘর, শীতলক্ষ্যা নদীতে ভ্রমণ করে ফিরে আসি, আসতে আসতে ডোডোর কথা চিন্তা করি।
বাবা বলেন,‘ ডোডোকে ছাড়া থাকতে আমাদের কষ্ট হলেও সে অন্তত ভালো জায়গায় নিরাপদে আছে।’
এর মধ্যে দেখতে দেখতে একমাস চলে যায়, মা ডোডোকে দেখতে যাওয়ার পরিকল্পনা করেন। কয়েকবার পিছানোর পর আমরা আবার ডোডোর মামার বাড়ি যাই। ডোডোর জন্য মা কইমাছ ভাজি করেন, ফালুদা বানান। ডোডো আমাদের সবাইকে একসঙ্গে পেয়ে মহা খুশি। সবই ঠিকঠাক ছিল, বিপত্তিটা বাধে আমরা যখন রওয়ানা দেব সে সময়। ডোডো কিছুতেই আমাদের ছাড়বে না, সে দৌড়ে সিএনজিতে উঠে বসে আছে, কোনভাবেই নামবে না। তার এই অবস্থা দেখে আমি আর রূপকথা বায়না ধরি যে, ডোডোকে ছাড়া আমরা বাসায় যাবো না। আমরা বলি, আমাদের এখন বড় বাসা, এছাড়া নিচে গ্যারেজে ডোডো থাকতে পারবে। অগত্যা ডোডোকে নিয়ে আসতে বাধ্য হলেন বাবা।
ডোডো এখন খামারে
অনেক অনেক দিন পর আমাদের স্কুল খুলতে যাচ্ছে, ধুলাবালি ঝেড়ে বইপত্র গুছাতে হবে, কত কত দিন পর বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হবে। তাই ডোডোর গল্প আমাদের শেষ করতে হবে। ধারদেনা করে নতুন করে বাবা আবার খামার চালু করেন। বাবা সপ্তাহে একবার বাসায় আসেন, পুরো সময়টা ডোডো মন খারাপ করে থাকে, বাইরে যাওয়ার জন্য ফটফট করে। বিকেল থেকে রাত অব্দি বারান্দায় বসে রাস্তার দিকে মনমরা হয়ে তাকিয়ে থাকে বাবার পথ চেয়ে, খাওয়া দাওয়াও ঠিকমতো করে না।
বাবাকে মা বলেন, ‘তুমি না থাকলে ডোডো অস্থির করে, ঠিক মতো খাওয়া দাওয়া করে না, আমাকে বাইরে নিয়ে যেতে বলে, আমি সামলাতে পারবো না। তার বোনদেরও খুব বিরক্ত করে। পড়তে বসলে বই খাতা নিয়ে টানাটানি করে। তুমি ওকে খামারে নিয়ে যাও, খামার পাহারা দেবে, তোমাকেও দেখে রাখবে।’
বাবা ডোডোকে সামনে বসিয়ে জিজ্ঞাসা করেন, ‘ডোডো তুই খামারে যাবি?’
বরাবরের মতো ডোডো মাথাটা একবার ডানদিকে আর একবার বাম দিকে কাত করে। এর মানে সে প্রস্তাবে সম্মত।
তার পর দৌড়ে গিয়ে বাবার দুই গাল চেটে দেয়।
বাবার এক বন্ধুর পুরানো একটা গাড়িতে করে একদিন সকালে আমরা সবাই ডোডোকে নিয়ে রওয়ানা দিই বাবার খামারের উদ্দেশ্যে। বাবার পায়ের কাছে ডোডো প্রথমে শুয়ে থাকে, পরে সিটে উঠে বসে জানালা দিয়ে বাইরের দৃশ্য দেখে। এক সময় মনের আনন্দে গলাটা লম্বা করে ডোডো চিৎকার করে ওঠে ভু ভু, ভু ভু, ভু ভু.।
আমরা সবাই একসঙ্গে বলে উঠি ভুভু.. .. ..