Home » জীবিত অথবা মৃতের উপাখ্যান ।। মনিরা মিতা

জীবিত অথবা মৃতের উপাখ্যান ।। মনিরা মিতা

ঊনপঞ্চাশ বছর বয়সের মানুষটির মনে মাঝে মাঝে সাধ জাগে নতুন করে জীবন শুরু করার। সে মনের আনাচে কানাচে স্বপ্নের জাল বোনে, নতুন নতুন ছক কাটে। কিন্তু কোথা থেকে শুরু করবে বুঝতে পারে না। কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ে, মুখে ভেসে ওঠা রেখাগুলো লিকলিকে সাপের মতো মনে হয়।

লোকটির নাম নরিন, কিন্তু লোকের মুখে মুখে কখন যে নড়ি হয়ে গেছে তার কোন হিসেব নেই। ওর কুচকুচে ফিলফিলে শরীরটাকে ব্যঙ্গ করে নড়ি ডেকে মজা পায় সবাই। কোটরে ঢুকানো তার চোখ দুটো সব সময় লাল টকটকে থাকে হয়ত অতিরিক্ত তাড়ি খাওয়ার জন্যই এমন থাকে। আসলে নরিন তাড়ি খায় না বরং তাড়ি ওকে খায়। যদিও সে যে কাজ করে তার জন্য তাড়ি তাকে খেতেই হয়। নেশায় বুদ হয়ে না থাকলে মরা কাটা যায় না। লাশ কাটা গন্ধে ওর গা গুলিয়ে ওঠে। পেটের ভেতর নাড়িভুঁড়ি মুচড়ে ওঠে। ওর বমি পায়। তাছাড়া সুস্থ মনে লাশের দিকে তাকালে ওর বড্ড মায়া হয়, বুকটা খচখচ করে।

এতো বছরে কম লাশ কাটেনি সে। নেশা না করলে ওর হাত কাঁপে, ছুরি-কাঁচি ছিটকে পড়ে যায়। তাড়ি খেলে এসব কিছুই হয় না। লাশ মেয়ে না পুরুষ, বৃদ্ধ না জোয়ান নাকি শিশু কিছুই যায় আসে না। খ্যাঁচখ্যাঁচ করে ফেড়ে ফেলে বুক, অপ্রয়োজনীয় অংশ শরীর থেকে কেটে বাদ দেয় তারপর ছুঁড়ে দেয় পাশে শুয়ে থাকা কুউয়্যার দিকে। কুউয়্যা সব সময় মাংসের লোভে  নরিনের পিছু পিছু ঘোরে। মাঝে মধ্যে পঁচাগলা লাশের কলিজা ঘচ করে কেটে কুউয়্যাকে দেয়। লাশের কলিজা থাকলেই কি আর না থাকলেই কি! তার চেয়ে বরং কুউয়্যা কলিজা খেয়ে নিজের কলিজা বড় করুক।

সকাল থেকে একটা লাশ কাটা ছেঁড়া করে নরিন ক্লান্ত, ভাবে আজ হয়ত আর কোন লাশ আসবে না। ও নিমগাছের নিচে বসে বড় বড় শ্বাস নেয়। তপ্ত রোদে ওর চোখে ধাঁধা লাগে। ওর বড্ড খিদে পেয়েছে, মাথাটা ঝিমঝিম করছে কিন্তু তবুও ঘরে যেতে ইচ্ছে করছে না। গাছের নিচে চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ে, গাছের পাতার ফোকর গলে রোদ এসে গায়ে লাগে। মনে মনে সূর্যের উপর বিরক্ত হয়, পা দুটো দাপাদাপি করে লাল পিঁপড়ের বাসার উপরে পড়ে। বড় বড় লাল পিঁপড়ে ওর পা দুটোতে চেপে বসে, ইচ্ছে মতো কামড়ায় কিন্তু নরিন ওগুলো মারে না, পায়ের নিচে পিষেও ফেলে না। নরিন ডোম হতে পারে তবে অমানুষ না। ও মরা মানুষ কাটে কিন্তু জ্যান্ত মানুষের কদর করে, জন্তু-জানোয়ারের জন্যও মায়া করে। নরিন বিড়ি ধরায়, ওর কুচকুচে কালো ঠোঁট দুটো বিড়ির আগুনে পুড়ে গেছে। বিড়ির ধোঁয়া শিকলের মতো গোলগোল করে ছাড়ে নরিন তারপর ধোঁয়ার শিকলের দিকে তাকিয়ে থাকে। ওর মনে হয় জীবনটাও ধোঁয়ার মতো-এই আছে এই নাই। গত ত্রিশ বছর ধরে লাশ কাটে নরিন, মাঝে মাঝে লাশের সাথে কথা বলে।

-তুহি গলায় ফাঁস দিহা মরলিক ক্যাহে?

তোহার কি কষ্টক লাগিক নাই!

মাঝে মাঝে উত্তর পায় আবার মাঝে মাঝে লাশের অট্টহাসিতে নরিনের কান জ্বালা করে, ও দুই হাতে কান চেপে ধরে। হাসি থেমে গেলে ঘ্যাঁচঘ্যাঁচ কাঁচি চালায়।

নরিনের খুব ভাত খেতে ইচ্ছে করে কিন্তু ঘরে যেতে ইচ্ছে করে না। ঘরটাকে নরক বলে মনে হয় নরিনের।

ছোটবেলা থেকেই নরিন নরকের গল্প শুনে এসেছে। খুব জ্বালা যন্ত্রনার জায়গা ওটা। নরিন মনে মনে বলে

-উখানে জ্বালা হবি ঠিক লেকিন হামার ঘরত চেয়ে বেশি নেহি।

নরকের কথা ভাবলেই নরিনের খেন্তির মুখ মনে হয়। শরীর জরাজীর্ণ হবার সাথে সাথে খেন্তির মুখের ধার ক্ষুরের মতো হচ্ছে। প্যারালাইজড শরীরটাকে ধনুকের মতো বাঁকা করে অনবরত কথার বাণ ছুঁড়তে থাকে খেন্তি। প্রতিদিন ঘরে যুদ্ধ বাঁধে, এক পক্ষে খেন্তি অন্য পক্ষে নরিনের মা। বুড়ো হলেও তেজ একটুও কমেনি বুড়ির। সারাক্ষণ বিড়ির ভেতর গাঁজা খায় আর খকখক কাশে। আগে ঝাড়ুদারনী ছিল, লোকে বলতো সর্দারনী। আটপৌরে শাড়ি লুঙ্গির মতো গুজে, মাথার উপর টিকি বেঁধে, মাজায় টিনের কৌটা গুজে, হাতে ঝাড়ু নিয়ে সারাদিন ছুটাছুটি করতো সে। পোড়া কাঠের মতো পিটানো শরীরটা আজও টনটনে। তারচেয়ে আরও টনটনে তার জিহ্বা। নরিনের মনে হয় ওটা জিহ্বা নয় সাপের ছোবল।

মাঝে মাঝে নরিনের বৌ আর মা জিহ্বার তেজ দেখাতে উঠে পড়ে লাগে।

অশ্লীল গালগালি আর খিস্তিতে ঘরটা নরক হয়ে ওঠে। সে নরকে কিলবিল করে সাপ, বিচ্ছু। নরিন সে নরক ছেড়ে আশ্রয় নেয় লাশ কাটা ঘরে। এটাই ওর কাছে স্বর্গ। এখানের মরা লাশগুলো খেন্তি আর ওর মায়ের চেয়ে ভালো।

মাঝে মাঝে নরিন বুকে হাত দিয়ে দেখে ও বেঁচে আছে কিনা -হ্যাঁ, বুক থেকে টিকটিক শব্দ ওকে বুঝিয়ে দেয় ও বেঁচে আছে। আর তার বিটুয়া লাসমি যখন ওকে জড়িয়ে ধরে তখন টের পায় সে বেঁচে আছে। লাসমির জন্য বড্ড মায়া হয় নরিনের। ওর নিঃসন্তান জীবনে লাসমি একটুকরো স্বর্গ, যে স্বর্গের দিকে তাকালে নরিন দেখতে পায় সুগন্ধি ঝর্ণা, দুধের নহর, আঙ্গরের থোকা।

পাঁচ বছর আগে লাশ কাটা ঘরে লাসমিকে তার বাবা-মায়ের সাথে রেখে গিয়েছিল পুলিশ। মারাত্মক রোড এক্সিডেন্ট, স্পট ডেড। তাড়ি খেয়ে একটা লাশ দুটো দেখলেও দুই বছরের লাসমির মুখটা দেখে থমকে যায় নরিনের দক্ষ কেঁচি। ওর শরীরে তেমন কোন আঘাতের চিহ্ন না থাকলেও নিঃশ্বাস বন্ধ ছিল। লাসমির শরীরে ছুরি চালাতে গিয়ে নরিনের হাত কেঁপে ওঠে। ওর মনে হয় লাসমির ঠোঁট নড়ে উঠলো। নরিন নেশার ঘোরে থাকলেও লাসমির আঙ্গলগুলোর কাঁপা দেখতে পায়। দ্রুত লেবু জল খেয়ে নিজেকে সুস্থ করে নরিন। এবার সে নিশ্চিত হয় লাসমি বেঁচে আছে। ওকে নিয়ে দ্রুত ঘরে ছুটে আসে নরিন, খেন্তির কোলে দেয়। খেন্তি ওর চোখে- মুখে কৎকৎ করে চুমু খায়, ওকে আঁচলের তলায় লুকিয়ে রাখে। খেন্তি আর নরিন মিলে চুপিচুপি লাসমিকে সুস্থ করে তোলে। অন্যদিকে বাবা-মায়ের পাশে শিশুর লাশ না দেখে পুলিশ ভাবে কুউয়্যা ওকে সাবাড় করেছে। নরিনকে গালাগালি দেয় পুলিশ, থাপ্পড় কষে ঘাড়ে তবুও নরিন মাথা নিঁচু করে থাকে,মুখে শব্দ করে না। পুলিশ বিরক্ত হয়ে ওকে উষ্টা মেরে চলে যায়।

সময় বইতে থাকে। নরিন তার সবটুকু মমতায় জড়িয়ে নেয় লাসমিকে। বড্ড আদরে বড় করে লাসমিকে কিন্তু এতো বছরেও ওর মুখে বুলি ফোটেনি। ডাক্তারবাবু বলেছে লাসমি জন্মগত বোবা, তবুও নরিন লাসমিকে অনুনয় করে বলে-‘বিটুয়া ইকবার বাপু বলিয়া ডাক।’

লাসমি কেবল বড় বড় কালো চোখে নরিনের দিকে চেয়ে থাকে। ওর শ্যামলা মুখটা দেখলে বড্ড মায়া হয় নরিনের।

গাছের ছায়ায় শুয়ে থেকে নরিনের তন্দ্রা আসে এমন সময় পিটু ডোম এসে ডাক দিলো।

নরিন ভাই ঘুমায়াছো, লেকিন আবারও লাশের গন্ধে ঘর ভরিয়াছে……………

আজ কি মরক লাগিয়া গেলে নাকিরে পিটু? মরা কি করিয়া মরিয়াছে যে পুলিশ টানিয়া আনিয়াছে?

গলায় ফাঁস দিয়া মরিছে বিটুয়া।

-উঁহ, খালি নরক রে,,,।

নরিন আবার চলে যায় লাশ কাটা ঘরে । তার আগে গলায় ঢেলে দেয় এক হাড়ি তাড়ি। কাঁপা কাঁপা হাতে ছুরি চালায়, গন্ধে ওর খালি পেটের নাড়িভুঁড়ি গলা দিয়ে উঠে আসতে চায়। নরিন ওয়াক ওয়াক বমি করে।

পড়ন্ত বিকেলে বিড়ি ফুকতে ফুকতে বাড়ি ঢোকে নরিন। বাড়ি ঢুকে নরিন দেখে পুরো বাড়ি ঠান্ডা। খেন্তির চিৎকার মায়ের খিস্তি কিছুই কানে আসে না নরিনের। ও ভাবে ওর কান কি বয়রা হয়ে গেল নাকি! সারা বাড়ি এতো নিশ্চুপ কেন? অজানা আশঙ্কায় ওর কলিজা ঠান্ডা হয়ে আসে।

উঠান জুড়ে শুকনো পাতা পড়ে। শনশন বাতাসে পাতাগুলো খসখস শব্দ করে। নরিনের কাছে এ বাড়ি অচেনা লাগে, বুকের ভেতর হৃদপিন্ড ধকধক করে। সামনে এগিয়ে দেখে মা মাথায় হাত দিয়ে কাঁঠাল গাছের নিচে বসে আছে, ঠোঁট দুটো বিড়বিড় করছে কিন্তু শব্দ হচ্ছে না। নরিন এক পা দুই পা করে ঘরে ঢোকে, একটা অচেনা আশঙ্কা ওর মনে চেপে বসে। ঘরে ঢুকেই দেখে খেন্তি চার হাত-পা ছাড়িয়ে বিছানায় পড়ে আছে। ওর চোখ দুটো খোলা আর মুখটা হা করা। মুখের উপর মাছি ভনভন করছে, ভকভকে একটা গন্ধ পুরো ঘরে ছড়িয়ে আছে।

লাসমি মায়ের পাশে বসে কাঁদছে। নরিনকে দেখেই ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরলো। ঈশারায় বুঝিয়ে দিল খেন্তি গুল খেয়ে স্বেচ্ছায় জীবন ত্যাগ করেছে। বরফ শীতল একটু অনুভূতি নরিনের শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে গেল। ওর চোখে পানি এলো না, ওর মনটা হাহাকার করলো না বরং ওর খিদে পেল।খুব খিদে। হাড়ি থেকে ভাত নিয়ে মুঠোয় মুঠোয় ভাত পেটে চালান করে দিল নরিন। কিন্তু একটু পর গা গুলিয়ে উঠলো, রক্ত বমি হলো।

সারারাত খেন্তির পাশে নির্বাক শুয়ে রইলো নরিন যেন কিছুই হয়নি, সকাল হলেই খেন্তির শাণিত জিহ্বা আবার চলতে শুরু করবে, খিস্তি দেবে। বলবে

-‘হামাক আর কত জ্বালাবি মিনসে, তোর মাক যদি তুই ছাড়বার লাই পারবি তো হামাক মার।’

সকালে পুলিশ এসে খেন্তির লাশ নিয়ে গেল লাশ কাটা ঘরে। প্রতিদিনের মতো আজও নরিন কাজে গেল যদিও ওকে আজ কাজ করতে সবাই নিষেধ করেছে। কিন্তু নরিন ছুটি নিতে চায় না, আজও সে লাশ কাটবে,,,লাশ। আজ ওর সামনে খেন্তির লাশ। নরিনের মাথাটা ঝিম ধরে আসে, এক হাড়ি তাড়ি টকটক করে গলায় ঢেলে দেয় নারিন তবুও ছুরি ধরতে ওর হাত কাঁপে।

পিটু এসে নরিনের কাঁধে হাত রাখে।

-‘তুমি পারবাক লাই নরিন ভাই। আজ বাড়িত যাও বিটুয়ার কাছে, হামি খেন্তিদির ব্যবস্থা করিয়া লইবে।’

-‘নেহি পিটু, হামার কুচ্ছু হইবেক লাই, হামি ঠিক পারবে।’

নরিন চোখ বন্ধ করে ছুরি চালায়, ওর শরীর ঘামে ভেজা। কুউয়্যা মাংসের লোভে ঘেউঘেউ করে ওঠে। নরিন খেন্তির বুক চিড়ে কলিজা বের করে, ওটা দেখতে পোড়া কয়লার মতো লাগে । কি যেন ভেবে নরিন ওর কলিজা কেটে কুউয়্যাকে ছুঁড়ে দেয়, কুউয়্যা, ওটার উপরে ঝাপিয়ে পড়ে।

নরিনের অট্টহাসিতে পুরো লাশ ঘর কেঁপে ওঠে , দূর থেকে সে হাসি কান্নার মতো শোনায়।

Ajit Dash

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ভাষা
Scroll to Top