Home » জর্জ অরওয়েলের ‘দরিদ্র যেভাবে মরে’ ।। ভূমিকা ও অনুবাদঃ মধুসূদন মিহির চক্রবর্তী

জর্জ অরওয়েলের ‘দরিদ্র যেভাবে মরে’ ।। ভূমিকা ও অনুবাদঃ মধুসূদন মিহির চক্রবর্তী

{কোনো এক ফরাসি সরকারী হাসপাতালে অরওয়েলের অভিজ্ঞতার একটি অকল্পনীয় বিবরণ এই প্রবন্ধ ১৯ শতকের চিকিৎসা সেবার প্রেক্ষাপটে হাসপাতাল সাহিত্যের এক অনন্য নিদর্শন। ১৯২৮ সালে অরওয়েল ১৮ মাসের জন্য প্যারিসে যান। ১৯২৯ সালের মার্চ মাসে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং প্যারিসের ১৫ তম অ্যারোন্ডিসমেন্টের রুয়ে ফাউবুর্গ সেন্ট-জ্যাকসের কোচিন হাসপাতালে দুই সপ্তাহ কাটান। ফ্লুতে আক্রান্ত হয়ে অসুস্থ অরওয়েল ১৯২৯ সালের ৭ থেকে ২২ মার্চ ওই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। হাসপাতালে তিনি লিখতে থাকেন কারণ তিনি প্রকাশককে কথা দিয়েছিলেন। অরওয়েল সারা জীবন শ্বাসনালীর রোগে ভুগেছেন কিন্তু তিনি তখন ইনফ্লুয়েঞ্জা বা নিউমোনিয়ায় ভুগছিলেন কিনা তা নিশ্চিত নয়। প্যারিসে তাকে যক্ষ্মা সন্দেহে পরীক্ষা নিরীক্ষা করাও হয়েছিল কিন্তু যক্ষার জীবানু পাওয়া যায়নি।

১৯৩৩ সালের ডিসেম্বরে অরওয়েল যখন উক্সব্রিজে শিক্ষকতা করছেন তখন তিনি নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হন। তাকে উক্সব্রিজের একটি কুটির হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে কিছু সময়ের জন্য তার জীবন বিপন্ন বলে মনে করা হয়েছিল। বড়দিন ও নববর্ষে তাকে হাসপাতালে থাকতে হয়েছিল। ১৯৩৪ সালের জানুয়ারীতে তাকে ছাড়পত্র দেওয়ার পর তিনি সুস্থ হওয়ার জন্য সাউথওল্ডে ফিরে গিয়ে বেশ কয়েক মাস তার বাবা-মা র সাথে বসবাস করেন। তিনি আর শিক্ষকতায় ফিরে যাননি।

১৯৫০ সালের ২১ জানুয়ারি মাত্র ছেচল্লিশ বছর বয়সে জর্জ অরওয়েলের অকাল মৃত্যুর পর থেকে পচাত্তর বছরেরও বেশি সময় ধরে পশ্চিমা সাহিত্যের অন্যতম উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব হয়ে উঠেছেন তিনি। তার দুটি ডাইস্টোপিয়ান শ্রেষ্ঠ সাহিত্যকর্ম ‘এনিম্যাল ফার্ম’ (১৯৪৫) এবং ‘নাইনটিন এইটি ফোর’(১৯৪৯)। এই দুটি উপন্যাস মিলিয়ে মোট ৪০ মিলিয়ন বই বিক্রি হয়েছে। এমনকি এখনও তার লেখাসমূহ আন্তর্জাতিক ক্ষমতা ও রাজনীতি সম্পর্কে আমাদের উপলব্ধির ওপর এক প্রচ্ছন্ন প্রভাব প্রয়োগ করে চলেছে। “হাউ দ্য পুওর ডাই” জর্জ অরওয়েলের ১৯৪৬ সালে ‘নাও‘ সাময়িকীতে প্রকাশিত একটি প্রবন্ধ। সাময়িকীটি এর বছর ছয়েক আগে সাহিত্য বিষয়ক লেখা এবং বিতর্কিত লেখা প্রকাশের একটি শক্তিশালী ফোরাম হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়।

১৯৩৭ সালে স্পেনের গৃহযুদ্ধে রিপাবলিকান পক্ষের হয়ে কয়েক মাস রণাঙ্গনে কাটিয়েছেন। যুদ্ধের সময় তাকে দুইবার হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছে। প্রথমবার ভর্তি হন হাতের সংক্রমণের কারণে এবং শেষবার গলায় স্নাইপারের বুলেটে গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর প্রচণ্ড জীবন-মরণ সংকটের কালে। নিবন্ধটি তিনি কখন লিখেছিলেন তা সঠিকভাবে জানা যায়নি। ‘অরওয়েলের রচনা সংগ্রহ’ গ্রন্থের সম্পাদক পিটার ডেভিসন নিবন্ধটির রচনাকালের একটি সম্ভাব্য ইতিহাসের ইঙ্গিত দিয়েছেন যা ১৯৩১ এবং ১৯৩৬ সালের মাঝখানের কোনো একটি সময়। তখন অরওয়েলের স্বেচ্ছায় বেছে নেওয়া অভিনব জীবন কেটেছে বেকার, ভবঘুরে এবং ভিক্ষুক অধ্যুষিত দারিদ্র্যপীড়িত সমাজে। তিনি প্রবন্ধটি ১৯৪০ সালের গ্রীষ্ম এবং ১৯৪১ সালের বসন্তকালের মধ্যে পুনর্নির্মাণ করে হরাইজন পত্রিকায় জমা দেন। পাঠকরা এমন সময়ে ‘দরিদ্র যেভাবে মরে’ তা পড়তে অনিচ্ছুক –সম্ভবত এই মর্মে লেখাটি সেখান থেকে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। অবশেষে একটি অংশ পুনরায় টাইপ করা হয় এবং তারপর ১৯৪৬ সালের নভেম্বরে জর্জ উডকক -এর প্রতিষ্ঠিত বিখ্যাত ‘নাও’ সাময়িকীতে প্রকাশিত হয়। উল্লেখ করা দরকার যে প্রবন্ধটি মূলত ‘পোলেমিক’ কাগজে “জেমস বার্নহামের দ্বিতীয় চিন্তা” শিরোনামে মুদ্রিত হয়েছিল এবং পরে বর্তমান শিরোনামসহ‘নাও’ সাময়িকীতে পুনর্মুদ্রিত হয়। এছাড়াও উল্লেখ করা দরকার যে অত্যন্ত প্রভাবশালী এই প্রবন্ধটি লেখা হয়েছিল এক দশক বা তারও বেশি সময় আগে। ট্রিবিউন সাময়িকিতে অরওয়েলের একসময়ের সহকর্মী এবং তখনকার ক্ষমতাসীন লেবার সরকারের স্বাস্থ্যমন্ত্রী অ্যানিউরিন বেভান ১৯৪৮ সালে ব্রিটিশ ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিসকে সকলের জন্য “সর্বজনীন অর্থায়নকৃত চিকিৎসা ব্যবস্থা” হিসাবে প্ররোচিত করেন। ]

১৯২৯ সালে প্যারিসের পঞ্চদশ মহকুমা হাসপাতালে আমাকে বেশ কয়েক সপ্তাহ থাকতে হয়েছিল। অভ্যর্থনা ডেস্কের কেরাণীরা আমাকে পুলিশী কায়দায় কঠোর জিজ্ঞাসাবাদ করে তারপর ঢুকতে দেয়। আমাকে প্রবেশ করতে দেওয়ার আগে প্রায় কুড়ি মিনিট যাবত প্রশ্নোত্তর পর্ব চলতে থাকে। যদি কখনও কোনো ল্যাটিন দেশে আপনাকে ফরম পূরণ করতে হয় তবে আপনি হাড়ে হাড়ে টের পাবেন আমি কী ধরনের প্রশ্নের কথা বলছি।

এর আগের কিছু দিন ধরে আমি রিয়ামুরকে ফারেনহাইটে রূপান্তর করতে অসমর্থ ছিলাম কিন্তু জানতাম যে আমার তাপমাত্রা প্রায় ১০৩ ডিগ্রির কাছাকাছি উঠেছে। জিজ্ঞাসাবাদ শেষ হওয়ার পর নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে থাকতে আমার খুব অসুবিধা হচ্ছিল। আমার পিছনে বিভিন্ন রংয়ের কাপড়ে বাঁধা বোঁচকা ঘাড়ে নিয়ে নিরুপায় রোগীদের একটি ছোট জটলা তাদের জিজ্ঞাসাবাদের পালা আসার অপেক্ষা করছিল।

জিজ্ঞাসাবাদ পর্ব শেষ হতেই এলো স্নানের পালা -এটি নবাগত সব রোগীদের জন্য বাধ্যতামূলক এক নিয়ম। দৃশ্যত এই নিয়মটি খানিকটা কারাগার বা ভবঘুরে আশ্রমের অনুরুপ। আমার কাছ থেকে আমার জামাকাপড় কেড়ে নেওয়া হল, তারপর পাঁচ ইঞ্চি গরম জলে কয়েক মিনিট কাঁপতে কাঁপতে বসে থাকার পরে আমাকে একটি লিনেনের কাপড়ের রাত-পোশাক এবং একটি ছোট নীলরঙা আলখাল্লা পরতে দেওয়া হল। পায়ে দেওয়ার কোনো চপ্পল ছিল না, তারা জানায় তাদের কাছে আমার পায়ের মানানসই বড় চপ্পল মজুত নেই। তারপর উন্মুক্ত স্থানে নিয়ে চলল। তা ছিল ফেব্রুয়ারির এক রাত, আমি নিউমোনিয়ায় ভুগছিলাম। আমরা যে ওয়ার্ডে যাচ্ছি তা ২০০ গজ দূরে  এবং মনে হলো সেখানে যেতে হলে হাসপাতালের মাঠটি পার হয়ে যেতে হবে। কেউ একজন একটি লণ্ঠন হাতে আমার সামনে হোঁচট খেলো। নগ্ন পায়ের তলায় নুড়িপাথর বসানো পথটি প্রচণ্ড হিমশীতল লাগছে। নৈশ পোশাকের নিচের অংশে আমার হাঁটুর নিচের নগ্ন মাংশপেশির চারপাশে কনকনে বাতাস চাবুক মেরে চলছিল। ওয়ার্ডে ঢুকেছি এমন সময় আমি এক অদ্ভুত চেনা অনুভূতি টের পেলাম যার উৎসস্থল গভীর রাত পর্যন্ত আমি খুঁজে পাইনি। গোঙানির শব্দে পরিপূর্ণ, অপেক্ষাকৃত নিচু, বিস্ময়করভাবে ঘিঞ্জি তিনটি সারিতে বিছানা পেতে রাখা পাণ্ডুর আলোময় লম্বা কক্ষটি ছিল রোগীদের একটি ওয়ার্ড।

খানিকটা চটচটে আঠালো এবং খানিকটা মিঠে ধরনের একটি দুর্গন্ধ ভেসে আসছে। শুয়ে পড়ার পর আমি দেখলাম আমার প্রায় উল্টোদিকের একটি বিছানায় ছোটখাটো গোলাকার কাঁধ ও ধুসর কেশের একজন লোক অর্ধউলঙ্গ হয়ে বসে আছে। একজন চিকিৎসক এবং একজন ছাত্র তার উপর কিছু একটা অদ্ভুত ধরনের নিরীক্ষা করছে। প্রথমে চিকিৎসক তার কালো ব্যাগ থেকে মদের পেয়ালার মত ডজনখানেক ছোট পেয়ালা বের করলেন। তারপর ছাত্রটি প্রতিটি পেয়ালার ভিতর থেকে বাতাস বের করে দেওয়ার জন্য একটি করে দিয়াশলাই কাঠি পুড়িয়ে দিল। তারপর পেয়ালাটি লোকটির পিঠে বা বুকে লাগানো হল। এর ফলে বায়ুশূন্য পেয়ালাটি লোকটির শরীরে একটি বিশাল হলুদ ফোস্কা তৈরি করল। কয়েক মুহূর্ত যেতে না যেতেই আমি টের পেলাম যে তারা রোগীর সাথে কী করছে। এটাকে কাপিং বা শিংগা লাগানো বলে। আদ্যিকালের চিকিৎসা বিষয়ক গ্রন্থে এমন একটি চিকিৎসা পদ্ধতি সম্পর্কে পড়ে থাকতে পারেন কিন্তু তখন পর্যন্ত আমি কেবলমাত্র ঘোড়াদের চিকিৎসায় এরকম পদ্ধতির প্রয়োগ হতো বলেই অস্পষ্টভাবে জানতাম।

বাইরের ঠাণ্ডা হাওয়া সম্ভবত আমার গায়ের তাপমাত্রা নামিয়ে দিয়েছে। আমি অনাসক্তভাবে, বলা যেতে পারে কিছুটা বিনোদন হিশেবে এই বর্বর চিকিৎসা পদ্ধতিটির পানে তাকিয়ে রইলাম। যাইহোক, পর মুহুর্তে ডাক্তার এবং সেই ছাত্রটি আমার বিছানার কাছে এসে আমাকে সোজা করে ধরে বসিয়ে দিল। তারপর কোনো কথাবার্তা ছাড়াই জীবাণুমুক্ত না করে ওই একই পেয়ালা দিয়ে আমার শরীরেও শিংগা লাগাতে শুরু করল। আমি ক্ষীণ একটি প্রতিবাদ করলাম কিন্তু যেরকম উদাসীনতার সাথে তারা দুজন আমার ওপর তাদের বিদ্যা প্রয়োগ করতে শুরু করলেন তাতে আমি প্রচণ্ড হতাশ হয়ে পড়লাম। এর আগে আমি কখনও হাসপাতালের সাধারণ ওয়ার্ডে থাকিনি। বিষয়টি আমার কাছে নতুন ছিল কারণ এহেন অমানবিক চিকিৎসকদেরকে আমি আগে কখনো দেখিওনি। তারা গায়ে হাত দেওয়ার আগে রোগির সাথে কোনো কথা তো বলেই না, তদুপরি তারা ছিল অমানবিক এবং রোগির প্রতি ভ্রুক্ষেপহীন। তারা আমার ক্ষেত্রে মাত্র ছয়টি কাঁচের পেয়ালা লাগায় কিন্তু ওরকম করার পর তারা ফোস্কাগুলোকে চিরে ফেলে দিয়ে আবারও শিংগা লাগায়। প্রতিটি শিংগার পেয়ালা এখন প্রায় দইয়ের চামচ পমিাণ গাঢ় রঙের রক্ত টেনে তুলল। আমার সাথে যে আচরণ করা হয়েছে তাতে অপমানিত, বিরক্ত এবং ভীত আমি কেবলমাত্র শুয়েছি আর ভাবছি যে, তারা অন্তত এবারের মতো আমাকে ছেড়ে দিয়েছে। কিন্তু না, একটুও না। অন্য চিকিৎসা তখনও বাকি ছিল। এবার আসছে সরিষার পোল্টিস বা প্রলেপ, আপাতদৃষ্টিতে এটাও উষ্ণ স্নানের মতো নৈমিত্তিক ব্যাপার। দু’জন দজ্জাল নার্স ইতিমধ্যেই পোল্টিস প্রস্তুত করে নিয়েছে এবং তারা ওটিকে আমার বুকে আঁটশাট জামার মতো শক্ত করে ঠেসে ঠেসে ধরছিল। সেই মুহূর্তে জামা এবং ঢিলা পায়জামা পরিহিত ওয়ার্ডে হেঁটে বেড়ানো কতিপয় লোক অর্ধ-সহানুভূতিপূর্ণ কাষ্ঠহাসি হেসে আমার বিছানার চারপাশে জড়ো হতে শুরু করে। পরে আমি জেনেছি যে ওয়ার্ডে কোনো রোগীকে সরিষার পোল্টিস দেওয়ার দৃশ্য ছিল একটি চিত্তবিনোদনসম বিষয়। সাধারণত সিঁকি ঘন্টার তরে এইরকম পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয় এবং নিজের সাথে এই রকম না ঘটলে তবে অবশ্যই এগুলো যথেষ্ট কৌতুক উদ্রেককারী বটে। প্রথম পাঁচ মিনিট ব্যাথা তীব্রতর মনে হলেও আশা করা যায় যে আপনি এটি সহ্য করতে পারেন। দ্বিতীয় পাঁচ মিনিটের মধ্যে সেই আশাটি বাষ্পীভূত হয়ে যায় কারণ পোল্টিসটি পিঠেই আটকে থাকে আর তখন আপনি এর থেকে মুক্তি পেতে অপারগ। এই সময়টিতেই দর্শকরা সবচেয়ে বেশি মজা পায়। আমি লক্ষ করে দেখেছি শেষ পাঁচ মিনিটের সময় এক ধরণের অসাড়তা পুরো শরীরের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। পোল্টিস অপসারণ করার পর বরফ ভরতি একটি জলরোধী বালিশ আমার মাথার নীচে গুজে দেওয়া হল এবং আমি একা পড়ে রইলাম। আমি একটুও ঘুমাইনি, আমার জানামতে এটাই ছিল আমার জীবনের একমাত্র রাত – অর্থাৎ বিছানায় শুয়ে কাটালেও সেই রাতে আমি এক মিনিটও ঘুমাইনি।

হাসপাতালটিতে আমার শুরুর দিকের সময়ে আমাকে বিভিন্ন প্রকারের পরস্পরবিরোধী চিকিত্সার একটি সম্পূর্ণ ক্রম পার হতে হয়েছে। কিন্তু এটি ছিল বিভ্রান্তিকর কারণ সাধারণত আপনি কিছু আকর্ষণীয় এবং শিক্ষামূলক উপায়ে অসুস্থ না হন তাহলে ভাল বা খারাপ যাই হোক এমন চিকিত্সা আপনি খুব কমই পেয়েছেন। ভোর পাঁচটায় নার্সরা এলো, রোগীদের ঘুম থেকে জাগিয়ে তুলল এবং তাদের তাপমাত্রা মাপল। কিন্তু তারা রোগিদের ধৌত করল না। আপনি যদি যথেষ্ট সুস্থ অবস্থায় থাকেন তবে আপনি নিজেই পরিস্কার পরিচ্ছন্ন হতে পারবেন অন্যথায় আপনাকে হেঁটে বেড়ানো রোগিদের দয়ার উপর নির্ভর করতে হবে।

সাধারণত বিছানায় প্রম্রাবের বোতল বহনকারী এবং লা ক্যাসেরোল ডাকনামের ভয়ানক ধরনের বেডপ্যান ব্যবহারকারী রোগীদের বেলায়ও এমনতরই ছিল। সকাল আটটায় জলখাবার এল, যাকে বলে আর্মি-ফ্যাশন লা স্যুপ। এমনই একটি স্যুপ যেখানে পাতলা সবজির ঝোলের মধ্যে সরু পাউরুটি ভাসছে। পরের দিন কালো দাড়িওয়ালা দীর্ঘদেহী, গম্ভীর চেহারার চিকিৎসক তার অনুগমণকারী একজন শিক্ষানবিশসহ ছাত্রদের একটি দল নিয়ে ঘুরে ঘুরে দেখলেন। ওয়ার্ডে আমরা প্রায় ষাটজন ছিলাম। বিষয়টা স্পষ্ট যে অন্যান্য ওয়ার্ডেও তাকে এমনভাবেই হাজিরা দিতে হয়।

এইরকম অজস্র শয্যার পাশ দিয়ে তিনি দিনের পর দিন হেঁটে চলেন, মাঝে মাঝে কান্নাকাটিসহ কাকুতি মিনতি প্রত্যক্ষ করেন। তবে একটি বিষয়, আপনার যদি এমন কোনো রোগ থাকে যার সাথে শিক্ষার্থীরা নিজেদের পরিচিত করাতে চায় তাহলে আপনি তাতে প্রচুর মনোযোগ পেয়ে যাবেন। আমি নিজে শ্বাসনালীর একটি ব্যতিক্রমী ধরনের সূক্ষ্ম ঘর্ঘর শব্দ নিয়ে ভর্তি হই। কখনও কখনও এক ডজনের বেশি ছাত্র সারিবদ্ধ হয়ে আমার বুকের সেই শব্দ নিজ কানে শুনে পরখ করেছে। এটি ছিল একটি খুব অদ্ভুত উপলব্ধি  — সত্যিই একদম অদ্ভুত! আমি বলতে চাচ্ছি, রোগীরাও যে মানুষ -এমন অনুভুতি তাদের একদমই লোপ পেয়েছিল। এরকম ভাবনা অসমীচিন তবুও মাঝে মাঝে কোনো রোগীকে পরীক্ষা করার পালা এলেই কিছু তরুণ ছাত্র উত্তেজনায় শিহরিত হত। তাদের ভাবটি হয়ে উঠত একদম সেই ছেলেটির মতো যে কিনা নিজের মুঠোয় আশানুরুপ একটি মূল্যবান যন্ত্র পেয়ে গেছে। এবং তারপর কানের পর কান – যুবকদের কান, মেয়েদের কান, নিগ্রোদের কান, একে একে সবার কান আপনার পিঠে চেপে ধরতে থাকবে। এরপর ধারাবাহিকভাবে আঙ্গুল দিয়ে মৃদু ও এলোমেলো টোকা মারা চলতে থাকে। তাদের কারও মুখ থেকে আপনি কোনো টু-শব্দও শুনতে পাবেন না। তাদের কেউ সরাসরি আপনার মুখপানে তাকাবেও না। হাসপাতালের পোশাক গায়ে ফি প্রদানে অসক্ষম একজন রোগী হিশেবে আপনি কেবলমাত্র একটি নমুনায় পরিণত হয়েছেন। এহেন কর্মকাণ্ডের প্রতি আমি বিরক্তি প্রকাশ করিনি কিন্তু কখনও অভ্যস্ত হয়ে উঠতেও পারিনি।

কিছু দিনের মধ্যে আমি উঠে বসতে সক্ষম হলাম এবং আশেপাশের রোগীদের ভালোভাবে বোঝার জন্য মোটামুটি সুস্থ হয়ে উঠলাম। ঠাসা কক্ষটিতে সংকীর্ণ বিছানাগুলো একসাথে এত গাদাগাদি করে রাখা যে আপনি সহজেই আপনার প্রতিবেশীর হাত স্পর্শ করতে পারবেন। আমার মনে হয়, তীব্র সংক্রামক রোগ ছাড়াও ওই হাতে সমস্ত ধরণের রোগ জীবানু বিদ্যমান। আমার ডান হাতের প্রতিবেশী ছিল ঈষৎ লাল চুলওয়ালা জনৈক মুচি যার এক পা অন্যটির চেয়ে ছিল খাটো। সে অন্য কোনো রোগীর মৃত্যু সংবাদ প্রচার করে বেড়াত (এইরকমটি বহুবার ঘটেছে, এবং আমার প্রতিবেশীই সর্বপ্রথম সেটি শুনতে পেত)। সে আমাকে শিস দিয়ে ইশারা দেওয়ার পর চিৎকার করে জানাতো ‘৪৩ নম্বর!’ (অথবা যে নম্বরই হোক না কেন)। নম্বর বলেই সে তার মাথার উপরে তার দুই বাহু চাপড়াত। এই লোকটির সাথে খুব বেশি অবিচার হয়নি। তবে আমার দৃষ্টিসীমার মধ্যে অন্যান্য শয্যার বেশিরভাগ রোগীর ভাগ্যে কতিপয় জঘন্য দুঃখজনক ঘটনা বা হর হামেশা আতঙ্কজনিত শিহরন তৈরি হতে দেখেছি। আমার পায়ের দিকের শয্যায় আমার পায়ে পা ঠেকিয়ে শুয়ে থাকা দুর্বল ক্ষীণকায় শরীরের লোকটি মারা যাওয়ার আগে কোন রোগে ভুগছিল তা আমি জানি না। আমি তাকে মৃত্যুবরন করতে দেখিনি, এর আগেই তারা তাকে অন্য বিছানায় সরানো হয়েছিল। ব্যাধিটি তার পুরো শরীরকে এতটাই সংবেদনশীল করে তুলেছিল যে পাশ ফেরার জন্য নড়াচড়া, এমনকি বিছানার চাদরের ওজনও তাকে ব্যথাকাতর করে তুলত। প্রস্রাব করার সময় তার অসহ্য বেদনা হত। সেই ভয়ানক বেদনার সাথেই তাকে প্রশ্রাব সারতে হত। একজন নার্স তার প্রশ্রাবের বোতলটি নিয়ে আসত। ঘোড়ার সহিস যেভাবে ঘোড়াকে প্রশ্রাব করানোর সময় শিস বাজাতে থাকে ঠিক তেমনিভাবে দীর্ঘ সময় ধরে তার বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে নার্স শিস বাজাত। শেষ পর্যন্ত ‘আমার প্রশ্রাব পেয়েছে!’ বলে তীব্র বেদনাদায়ক চিৎকার দিয়ে তিনি হিসু করে দিতেন। তার পাশের বিছানায় থাকা বালুরং চুলের লোকটিকে আমি শিংগা লাগাতে দেখেছিলাম, তার কাশির শ্লেষ্মার সাথে সবসময় রক্ত যেত। আমার বাম-হাতের প্রতিবেশী লম্বা, ঢিলেঢালা চেহারার যুবকটির পিঠে পর্যায়ক্রমে একটি নল ঢুকিয়ে দিয়ে তার শরীরের ভেতরের অংশ থেকে চমকে যাওয়া পরিমাণ ফেনীল তরল বের করে আনতে দেখতাম। তার ঠিক ওই পাশের বিছানায় ১৮৭০ সালের যুদ্ধে অংশ নেয়া একজন শ্বেতবর্ণের রাজকীয় সুদর্শন প্রবীণ ব্যক্তি অন্তিম প্রহর গুনছিলেন। দর্শনার্থীদের পরিদর্শন সময়ের পুরোটা জুড়ে স্পষ্টতই কাকের মতো কালো কুচকুচে পোশাক পরিহিতা চারজন বয়স্কা আত্মীয়া কিছু করুণ উত্তরাধিকারের যোগসাজশে তার বিছানার চারপাশে বসে থাকত। আমার বিপরীত সারির শয্যায় টাকমাথা একজন বৃদ্ধলোক ছিল। খুব ফুলে যাওয়া মুখ ও শরীরের  সেই লোকটির ছিল ঝুলে পড়া একজোড়া গোঁফ। সে এমন একটি রোগে ভুগছিল যার ফলে সে প্রায় অনবরত প্রস্রাব করতে বাধ্য হত। তার বিছানার পাশে একটি বিশাল কাঁচের পাত্র সবসময় দাঁড় করিয়ে রাখা থাকত। একদিন তার স্ত্রী ও কন্যা তার সাথে দেখা করতে এলো। তাদের দেখে বৃদ্ধের ফুলে ওঠা মুখটি আশ্চর্য মধুর হাসিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। আমি দেখলাম, প্রায় বিশ বছর বয়সী তার সুন্দরী মেয়েটি বিছানার কাছে আসতেই বৃদ্ধের হাতটি বিছানার চাদরের নীচে থেকে বের হয়ে ধীরে ধীরে নড়ে উঠছে। দেখে আমি ভাবছিলাম যে এক্ষুনি হয়তো এসেই মেয়েটি বিছানার পাশে হাঁটু গেড়ে বসবে, আর মৃত্যুকালীন আশীর্বাদ স্বরুপ বৃদ্ধ তার মাথায় হাত রাখবে। কিন্তু না, তিনি তার মেয়েকে কেবল প্রশ্রাবের ছোট বোতলটি ধরিয়ে দিলেন। আর মেয়েটি তার কাছ থেকে বোতলটিকে নিয়ে সাথে সাথে কাঁচের বড় পাত্রে পুরোটা ঢেলে দিল।

আমার বিছানা থেকে প্রায় এক ডজন শয্যা দূরে ছিল ৫৭ নম্বর — আমার মনে হয় সেটাই তার নম্বর ছিল— সে ছিল যকৃতের পচনরোগে অক্রান্ত রোগি। ওয়ার্ডের সবাই তাকে দেখেই চিনত কারণ সে প্রায়সময় চিকিৎসা বিষয়ক বক্তৃতার বিষয় ছিল। সপ্তাহে দুইদিন বিকেলে দীর্ঘদেহী গম্ভীর চেহারার ডাক্তার ছাত্রদের একটি দলকে ওয়ার্ডে এনে বক্তৃতা দিতেন। এছাড়াও একাধিক অনুষ্ঠানে এক ধরণের চাকাযুক্ত ট্রলিতে করে ওয়ার্ডের মাঝখানে বৃদ্ধ ৫৭ নম্বর রোগিকে নিয়ে যাওয়া হতো। সেখানে তার গায়ের নৈশপোশাক গুটিয়ে ডাক্তার লোকটির পেটের একটি বিশাল থলথলে স্ফীত অংশকে আঙ্গুল দিয়ে নির্দেশ করে বিশদভাবে ব্যাখ্যা করে বলতেন – আমি মনে করি এটি একটি রোগাক্রান্ত লিভার এবং রোগটির জন্য মদ্যপান দায়ী, এই রোগটি সচরাচর মদ্যপানকারী দেশসমূহে দেখা যায়। যথারীতি তিনি তার রোগীর সাথে কথা বলতেন না এবং তার দিকে হাসিমুখে তাকাতেনও না। রোগীর কোনোরকম সম্মতি বা স্বীকৃতির ধারও ধারতেন না। অতিশয় গম্ভীরভাবে সোজা দাঁড়িয়ে তিনি কথা বলতেন আর তার দুই হাতে বিধ্বস্ত শরীরটিকে ধরে কখনও কখনও নারীদের রুটি বেলার মতো কায়দায় এদিক ওদিক মৃদুভাবে গড়িয়ে দিতেন। এমন নয় যে ৫৭ নম্বর রোগী এই ধরনের আচরনে কিছু মনে করত। স্পষ্টতই সে ছিল হাসপাতালের একজন পুরানো বাসিন্দা, বক্তৃতাসমূহের নিয়মিত প্রদর্শনযোগ্য বিষয়। দীর্ঘদিন ধরে তার যকৃত কোনো চিকিৎসাবিদ্যা যাদুঘরের একটি বোতলের জন্য চিহ্নিত করা ছিল। তার সম্পর্কে যা বলা হতো তা নিয়ে একেবারেই অনাগ্রহী সে বর্ণহীন চোখে কোনোদিকে না তাকিয়ে শুয়ে থাকত। সেই সময় ডাক্তার তাকে সুপ্রাচীন চিনামাটির সামগ্রীর মতো প্রদর্শন করতেন।

তিনি ছিলেন ষাটের কাছাকাছি বয়সের অদ্ভুতভাবে সঙ্কুচিত একজন মানুষ। ধূসর কাগজের মতো এমনই ফ্যাকাশে আর সঙ্কুচিত হয়ে যাওয়ার ফলে তার মুখটিকে কোনো পুতুলের চেয়ে বড় বলে মনে হয়নি। একদিন সকালে নার্সরা এসে ঢুকবার আগে আমার চর্মকার প্রতিবেশী আমাকে আমার বালিশ টেনে ধরে জাগিয়ে তুলল। সে যথারীতি তার মাথার উপরে হাত চাপড়ে আক্ষেপের সুরে বলে উঠল ‘৫৭ নম্বর!’

ওয়ার্ডের আলোটি কোনো বস্তুকে দেখার জন্য যথেষ্ট ছিল। আমি দেখতে পেলাম বৃদ্ধ ৫৭ নম্বর আমার দিকে পাশ ফিরে শোয়া, তার মাথাটি বিছানার একপাশে ঝুলে আছে। রাতের বেলায় সে মারা গেছে, কখন মারা গেছে কেউ জানে না। নার্সরা এলো, তার মৃত্যুসংবাদ পেলেও উদাসীনভাবে নিজ কাজে লেগে গেল। দীর্ঘ সময় অর্থাৎ ঘণ্টাখানেক বা তারও বেশি সময় পরে আরও দু’জন নার্স সৈন্যদের মতো কুচকাওয়াজ করতে করতে এসে হাজির হল। একটি বিশাল ঝাঁকুনি দিযে শবদেহটিকে চাদরে গিঁট দিল। এরপরও বেশ একটা সময় পর্যন্ত তাকে সেখান থেকে সরানো হয়নি। এদিকে, আমি আরও ভাল আলোতে অনেক সময় ধরে ৫৭ নম্বরকে ভালো করে দেখতে থাকলাম। আশলে তাকে দেখার জন্যই আমি পাশ ফিরে শুয়েছিলাম। কৌতূহলজনকভাবে সে-ই ছিল আমার দেখা প্রথম কোনো মৃত ইউরোপীয় ব্যক্তি। এর আগেও আমি মৃত পুরুষ দেখেছি কিন্তু তারা সবাই এশীয় নাগরিক ছিল আর তাদের বেশিরভাগেরই সহিংস কারণে মৃত্যু হয়েছিল। ‘৫৭ নম্বর’- এর চোখ তখনও খোলা, তার মুখও হা করে খোলা, তার ক্ষীণকায় মুখটিতে যন্ত্রণার অভিব্যক্তি স্পষ্ট ফুটে রয়েছে। তবে তার মুখের শুভ্রতা আমাকে সবচেয়ে বেশি মুগ্ধ করে রাখল। মুখটি আগে ফ্যাকাশে ছিল কিন্তু এখন এটিকে কাফনের কাপড় থেকে একটু গাঢ় রংয়ের মনে হল। আমি যখন ক্ষীণকায় বিধ্বস্ত মুখটির দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলাম তখন সে যেন নিদারূণ বিরক্তিকর উপেক্ষার ভঙ্গিতে আমার অন্তরে ঘা মারছিল। ময়না তদন্ত কক্ষের মেঝের উপর পতিত হওয়ার অপেক্ষায় থাকা শবদেহটি ছিল ‘প্রাকৃতিক’ মৃত্যুর একটি উদাহরণ, যেরকমটি আপনি প্রার্থনা সঙ্গীতে গেয়ে থাকেন। আমি ভাবছিলাম ধরুন আপনি যদি এখানে থাকেন, এখন থেকে কুড়ি, ত্রিশ, চল্লিশ বছর পর এরকমটাই আপনার জন্য অপেক্ষা করছে। বৃদ্ধ হওয়ার জন্য বেঁচে থাকা ভাগ্যবানরা এভাবেই মারা যায়। অবশ্যই প্রকৃতপক্ষে কেউ বাঁচতে চায়, কেবল মৃত্যুর ভয়ের কারণেই বেঁচে থাকে। তবে তখন আমি যেমনটি ভাবতাম এখনও তেমনটিই মনে করি, অতি বৃদ্ধ হয়ে ধুঁকে ধুঁকে মরার চেয়ে অকস্মাৎ মৃত্যুবরনই শ্রেয়।

মানুষ যুদ্ধের ভয়াবহতার কথা বলে থাকে কিন্তু মানুষ এমন কোনো অস্ত্র কি আবিস্কার করেছে যা নিষ্ঠুরতায় কতিপয় সাধারণ রোগের সমতুল্য? মোটামুটি সংজ্ঞা অনুসারে ‘প্রাকৃতিক’ মৃত্যু মানে ধীর, দুর্গন্ধময় এবং বেদনাদায়ক কিছু। এমনকি কখনো কখনো মৃত্যু কিছুটা পার্থক্য তৈরি করে যদি আপনি সর্বজনীন প্রতিষ্ঠানের বদলে আপনার নিজ বাড়িতে মৃত্যুবরন করেন। এই যে দরিদ্র বৃদ্ধ হতভাগ্য লোকটি গুরুত্বহীনভাবে মোম-শিখার মতো একটু ধপ্ করে জ্বলে উঠে নিভে গেল, তাকে মৃত্যুশয্যায় অন্তিম বিদায় জানানোর উল্লেখযোগ্য কেউ ছিল না। হাসপাতালের বিছানাগুলো খুব কাছাকাছি ছিল এবং মাঝখানে ছিল না কোনও পর্দা। উদাহরণ স্বরূপ মনে করা যেতে পারে কিছুক্ষণের জন্য আমার সাথে পায়ে পায়ে লেগে থাকা সেই শয্যার মৃত ক্ষীণকায় মানুষটির কথা। যে লোকটি বিছানার চাদরের স্পর্শেই চিৎকার করে উঠত, আমি দায়িত্ব নিয়ে বলতে পারি যে তার শেষ উচ্চারিত কথাটি ছিল ‘ আমি প্রস্রাব করব!’। সম্ভবত মৃতরা এই ধরনের বিষয়াদি নিয়ে মাথা ঘামায় না। এটি অন্তত একটি আদর্শ উত্তর হতে পারে যে, মৃত ব্যক্তিরা তবুও হয়তো শেষের একদিন বা কম বেশি সময় মানসিকভাবে স্বাভাবিক থাকে।

হাসপাতালের সর্বজনীন ওয়ার্ডে আপনি এমন ভয়াবহতা দেখতে পাবেন যা নিজ বাড়িতে মারা যাওয়া লোকদের ক্ষেত্রে দেখবেন না। মনে হয় যেন কিছু রোগ শুধুমাত্র নিম্ন আয়ের শ্রেণীর লোকদেরই আক্রমণ করে থাকে। কিন্তু এটা সত্যি, প্যারিসের হাসপাতালটিতে আমি যা দেখেছি তার কোনো কিছুই আপনি বিলেতের কোনো হাসপাতালে দেখতে পাবেন না। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় আত্মীয় পরিজনহীন অবস্থায় অবহেলায় মানুষের এহেন পশুর মতো মৃত্যুবরন, মরে পড়ে থাকলেও সকালের আগে কেউ তাকে লক্ষ্য না করা – এধরনের ঘটনা একাধিকবার ঘটেছে।

নিশ্চিতভাবে বলা যায় ইংল্যান্ডে আপনি এরকমটি দেখতে পাবেন না। আর অন্য রোগীদের চোখের সামনে কোনো শবদেহ হা-করে পড়ে থাকার মতো করুণ দৃশ্যও সেখানে অনুপস্থিত। আমার মনে আছে, একবার ইংল্যান্ডের একটি গ্রামীন হাসপাতালে আমাদের চা পান করার সময় একজন মানুষ মারা গিয়েছিল। যদিও ওয়ার্ডে আমরা মাত্র ছয়জন ছিলাম তবুও নার্সরা এত নিপূণভাবে পুরো বিষয়টি সামলে নেয় যে আমাদের চা পান করা শেষ হওয়ার আগেই আমাদের অজ্ঞাতসারে লোকটির মৃতদেহ সরিয়ে ফেলা হয়েছিল। ইংল্যান্ডে প্রচুর সংখ্যক সু-প্রশিক্ষিত এবং কঠোর শৃঙ্খলাবদ্ধ নার্স থাকার সুবিধাটি আমরা উপভোগ করলেও সম্ভবত এই বিষয়টিকে আমরা কমই মূল্যায়ন করি। নিঃসন্দেহে ইংরেজ নার্সরাও যথেষ্ট স্বল্পভাষী। তারা হয়তো চা-পাতা দিয়ে ভাগ্য গণনা করে, যুক্তরাজ্যের পতাকা সম্বলিত ব্যাজ পরে এবং হয়তো গরম চুল্লির তাকের ওপর মহারানীর ছবি রাখে তবুও তারা নিছক অলসতার কারণে আপনাকে আগোছালো বিছানায় শুইয়ে রাখবে না এবং কোষ্ঠকাঠিন্যে ভুগতে দিবে না। হাসপাতালটির নার্সদের সম্পর্কে চার্লস ডিকেনসের মিসেস গ্যাম্প চরিত্রটির একটি আভাস পেয়েছি এবং পরে প্রজাতান্ত্রিক স্পেনের সামরিক হাসপাতালেও যেসব নার্সদের দেখেছি তারা গায়ের তাপমাত্রা মাপতেও প্রায় অসমর্থ ছিল। ইংল্যান্ডের কোথাও আপনি এইরকম একটি নোংরা হাসপাতাল দেখতে পাবেন না। পরে, যখন আমি নিজে নিজে স্নান করতে সক্ষম হলাম তখন স্নানঘরে গিয়ে দেখলাম সেখানে একটি বিশাল বোঁচকা বাক্স পড়ে আছে যার মধ্যে সারা ওয়ার্ডের এঁটো খাবার এবং নোংরা পোশাক পরিচ্ছদ স্তুপ করে রাখা রয়েছে। দেয়ালের অর্ধেকজুড়ে থাকা শোভন কাঠের তক্তাগুলো ছিল উইপোকার দখলে। একটা সময় আমি আমার জামাকাপড় ফিরে পেলাম এবং নিজ পায়ে শক্ত হয়ে দাঁড়াতে সক্ষম হলাম। এরপর আমি আমার সময় শেষ হওয়ার আগেই, চিকিৎসা থেকে খালাস পাওয়ার অপেক্ষা না করেই হাসপাতাল থেকে পালিয়ে এলাম। আমি একমাত্র এই হাসপাতাল থেকেই পালিয়েছি তা নয়, তবে এর ঝাপসা আলো, অনটন, এর পুঁতিগন্ধময় বাতাস এবং সর্বোপরি এর মানসিক প্রতিবেশের কিছু ব্যতিক্রমী স্মৃতি আমার মনেতে গেঁথে আছে।

আমার বসবাসের মহকুমার অন্তর্গত হাসপাতাল ছিল বলেই আমাকে সেখানে ভর্তি করা হয়েছিল। আমি সেখানে অবস্থানের আগ পর্যন্ত জানতামই না যে হাসপাতালটি এক প্রকারের দুর্নাম বহন করে চলেছিল। এক বা দুই বছর পরে কুখ্যাত প্রতারক মাদাম হানউদ রিমান্ডে থাকাকালীন অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে এই হাসপাতালটিতে আনা হয়। কয়েকদিন যেতে না যেতেই তিনি রক্ষীদের ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে গিয়ে একটি ট্যাক্সি নিয়ে আবার জেলখানায় হাজির হন। তিনি ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন যে জেলে তিনি অপেক্ষাকৃত আরামদায়ক পরিবেশে ছিলেন।

হাসপাতালটি সেই সময়ের যেকোনো ফরাসি হাসপাতালের তুলনায় বেশ অস্বাভাবিক ছিল- এই বিষয়ে আমার কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু রোগীরা, যাদের প্রায় সবাই কর্মজীবী ছিল তারা বিস্ময়করভাবে হাঁফ ছেড়ে পালিয়েছিল। তাদের মধ্যে কেউ কেউ পরিস্থিতিকে প্রায় আরামদায়ক বলে মনে করতো কারণ রোগের ভান করা অন্তত দু’জন নিঃস্ব লোক ছিল যারা হাসপাতালটিকে শীতকাল পাড়ি দেওয়ার একটি ভাল উপায় বলে মনে করেছিল। নার্সরাও তাদের প্রশ্রয় দিত কারণ রোগের ভান করা লোকেরা এটা-ওটা কাজ করে নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠানের উপযোগী করে তুলেছিল। তবে সংখ্যাগরিষ্ঠদের মনোভাবে অবশ্যই এটি ছিল একটি জঘন্য জায়গা, তাহলে এর চেয়ে আর কী আশা করা যায়? তাদের কাছে বিষয়গুলো অদ্ভুত মনে হয়নি যে আপনাকে ভোর পাঁচটায় ঘুম থেকে জাগতে হবে এবং তারপরে পাতলা জলসম স্যুপে দিন শুরু করার আগে তিন ঘন্টা অপেক্ষা করতে হবে অথবা কিছু লোক আত্মীয়-পরিজনহীন বিছানায় মরে পড়ে থাকবেন। এমনকি পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়া ডাক্তারের নজরে পড়লেই কেবলমাত্র আপনার চিকিত্সা পাওয়ার সম্ভাবনা নির্ভর করবে। তাদের ঐতিহ্য অনুযায়ী হাসপাতালগুলো এমনই ছিল। আপনি যদি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং আপনার নিজের বাড়িতে চিকিত্সা করার সামর্থ্য না থাকে তাহলে আপনাকে অবশ্যই হাসপাতালে যেতে হবে। সেখানে একবার গেলেই আপনাকে অবশ্যই কঠোরতা এবং অস্বস্তি সহ্য করতে হবে,  মনে হবে যেন আপনি সেনাবাহিনীতে আছেন। কিন্তু সর্বোপরি আমি পুরনো গল্পগুলোর মাঝে একটি দীর্ঘস্থায়ী বিশ্বাস খুঁজে পেতে আগ্রহী যেসব গল্প এখন ইংল্যান্ডের স্মৃতি থেকে প্রায় বিবর্ণ হয়ে যাওয়ার উপক্রম। উদাহরণস্বরূপ ডাক্তারদের সম্পর্কে প্রচলিত সেই গল্পসমূহ রয়ে গেছে যেখানে নিছক কৌতূহল থেকে আপনার শরীরে অংশ কেটে উন্মুক্ত করে দিচ্ছেন বা আপনাকে সঠিকভাবে অজ্ঞান করে নেবার আগেই শল্যচিকিৎসা শুরু করাকে কৌতুক মনে করছেন। স্নানঘরের ঠিক ওপাশে থাকা একটি ছোট শল্যচিকিৎসা কক্ষ সম্পর্কিত অস্পষ্ট একটি গল্প প্রচলিত ছিল। বলা হতো সেই কক্ষ থেকে ভয়ঙ্কর আর্তনাদ শোনা যেত। আমি গল্পগুলো সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার মতো কোনো প্রমাণ পাইনি, আর নিঃসন্দেহে সেগুলোর সবই ছিল অপপ্রচার মাত্র। তবে আমি দেখেছি দুজন ছাত্র অনর্থক পরীক্ষার ছলে ষোল বছর বয়সী জনৈক কিশোরকে মেরেই ফেলছিল বা তাকে প্রায় মরার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দিয়েছিল (আমি হাসপাতাল থেকে পালানোর সময় সে মারা যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছিল কিন্তু সে হয়তো পরে বেঁচে ফিরেছে)। তারা নিশ্চয়ই অর্থপ্রদানকারী কোনো রোগীর সাথে এরকম অপচেষ্টা করার সাহস পেত না। স্মৃতি হাতড়ে যা পাওয়া যায়, লন্ডনে একসময় বিশ্বাস করা হত যে কতিপয় বড় হাসপাতালে ব্যবচ্ছেদ শিক্ষার উপকরণ সংগ্রহ করতে রোগীদের হত্যা করা হতো। এই হাসপাতালে এই গল্পটি কাউকে বলতে শুনিনি তবে আমার ধারণা সেখানকার কিছু রোগী এটিকে বিশ্বাসযোগ্য গল্প বলে মনে করত। কারণ, এই হাসপাতালটিতে কর্মপদ্ধতি নয় বরং ঊনবিংশ শতাব্দীর কিছু কিছু হালচাল টিকে ছিল এবং সেগুলোর মধ্যেই হাসপাতালটির যথাযথ স্বার্থ লুকিয়ে ছিল।

গত পঞ্চাশ বছর বা সমধিক সময়ে ডাক্তার ও রোগীর সম্পর্কের ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগের আগের অধিকাংশ সাহিত্যের দিকে তাকালে দেখা যায় কোনো হাসপাতালকে প্রচলিতভাবে একটি কারাগারসম স্থাপনা হিশেবে বিবেচনা করা হয়েছে। সেটি অনেকটা পুরানো ধাঁচের একটি অন্ধকূপের ন্যায় কারাগার। হাসপাতাল হল কলুষপূর্ণ, নিপীড়ন ও মৃত্যুর স্থান, সমাধিগৃহ পূর্ববর্তী এক ধরণের খাস কামরা। কম-বেশি নিঃস্ব না হলে কেউ এমন জায়গায় চিকিৎসার জন্য যাওয়ার কথা ভাবে না। আর বিশেষ করে গত শতাব্দীর শুরুর দিকে যখন চিকিৎসা বিজ্ঞান তেমন কোনো সফলতা ছাড়াই আগের চেয়ে সপ্রতিভ হয়ে উঠল, তখন সাধারণ মানুষ ডাক্তারি পেশাকে ভয় ও আতঙ্কের সাথে দেখত। বিশেষ করে, অস্ত্রোপচারকে পীড়ন করার মানসিক বিকারের অদ্ভুত ভয়ঙ্কর রূপ ছাড়া আর কিছু মনে করা হত না। আর ব্যবচ্ছেদকে মনে করা হতো শুধুমাত্র মানব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ চুরির সহযোগিতার সমতুল্য ব্যাপার এবং কখনও কখনও ভবিষ্যত নিরুপনের যাদুবিদ্যায় সেগুলো ব্যবহার করা হতো বলেও মানুষ বিভ্রান্ত ছিল। ঊনবিংশ শতাব্দীর সাহিত্য থেকে আপনি ডাক্তার এবং হাসপাতাল সম্পৃক্ত একটি বিশালাকার রোমাঞ্চকর সাহিত্য সংগ্রহ করতে পারেন। বেচারা বৃদ্ধ তৃতীয় জর্জের ভীমরতিকালে তার কথা ভাবুন, যখন তিনি দেখেন যে তার শল্যচিকিৎসক ‘অজ্ঞান হওয়ার আগেই তাকে রক্তাক্ত করতে’ এগিয়ে আসছেন, তখন তিনি অনুকম্পা পেতে আর্তচিৎকার করতে থাকেন! চার্লস ডিকেনসের ‘বব সয়ার এবং বেঞ্জামিন এলিয়েন’র কথোপকথনের কথা ভাবুন, যেগুলো নিঃসন্দেহে লালিকা রচনা। ভাবুন টলস্টয়ের ‘ওয়ার অ্যান্ড পিস’ এবং এমিল জোলার ‘লা ডেবেকল’ এর ফিল্ড হাসপাতালের বর্ণনা অথবা হারমান মেলভিলের ‘হোয়াইট-জ্যাকেট’ গ্রন্থে একটি অঙ্গচ্ছেদের জঘন্য বর্ণনা! এমনকি ঊনবিংশ শতাব্দীর ইংরেজি কথাসাহিত্যে ডাক্তারদের দেওয়া নামগুলো স্ল্যাশার, কারভার, সয়ার, ফিলগ্রেভ ইত্যাদি এবং জাতিগত ডাকনাম ‘সওবোনস’ প্রভৃতি কমিকের চরিত্রের মতোই ভয়ানক। অস্ত্রোপচার বিরোধী ঐতিহ্য সম্ভবত টেনিসনের কবিতা `দ্য চিলড্রেনস হসপিটালে’ সবচেয়ে ভালোভাবে প্রকাশ পেয়েছে। কবিতাটি মূলত একটি প্রাক-ক্লোরোফর্ম প্রামাণ্য দলিল যদিও এটি ১৮৮০ সালের শেষের দিকে লেখা হয়েছে বলে প্রতিভাত হয়। তদুপরি, টেনিসন এই কবিতায় যে মনোভাব লিপিবদ্ধ করেছেন তার জন্য অনেক কিছু বলার ছিল। চেতনানাশক বিহীন একটি শল্যচিকিৎসা কেমনতর ছিল, কতটা ভয়াবহ ছিল – এই বিষয়গুলো আপনার বিবেচনায় আসার পর  যারা এই ধরনের কাজ করতো তাদের উদ্দেশ্য সম্পর্কে সন্দেহ না করা দুরুহই বটে। এই রক্তাক্ত ভয়াবহতার জন্য ছাত্ররা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে থাকত, (‘একটি দুর্দান্ত দৃশ্য যদি স্ল্যাশার এটি করে!’) যদিও স্বীকার করা হয় যে এরকম করা একদম অনর্থক ছিল। কোনো রোগী অভিঘাতে মারা না গিয়ে সাধারণত পচন ধরা রোগে মারা গেলে ফলাফলস্বরূপ ছাত্রদের কাটাকাটির তরে অনুমোদন দেওয়া হতো।

এমনকি এখনও এমন চিকিৎসক পাওয়া যেতে পারে যাদের উদ্দেশ্য প্রশ্নবিদ্ধ বটে। যদি কেউ প্রচণ্ড অসুস্থ হয়ে পড়ে বা যারা চিকিৎসাবিদ্যার ছাত্রদের আলাপচারিতা শুনেছে- আমি যা বলতে চাচ্ছি তারা তা স্পষ্ট বুঝতে পারবে। কিন্তু চেতনানাশকের আবিষ্কার ছিল একটি যুগান্তকারী ঘটনা এবং জীবাণুনাশক আবিষ্কারও ছিল তেমনই একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। বিশ্বের কোথাও না পেলেও আপনি এখন সম্ভবত দ্য ‘স্টোরি অফ সান মিশেল’-এ অ্যাক্সেল মুনথে বর্ণিত দৃশ্যটি পাবেন যখন মাথায় হ্যাট পরিহিত ফ্রক কোট পরা অলক্ষুণে শল্যচিকিৎসক একের পর এক রোগীকে কাটাছেঁড়া করতে করতে তার মাড় দেওয়া শার্টের সামনের অংশ রক্ত ও পূঁজে রঞ্জিত করে ফেলেন। এরপর সেই চিকিৎসক একই ছুরি দিয়ে কাটা বিচ্ছিন্ন অঙ্গসমূহকে টেবিলের পাশের স্তুপে নিক্ষেপ করতে থাকেন। অধিকন্তু, একজন শ্রমজীবী শ্রেণীর কপর্দকশূন্য মানুষ তুচ্ছ বিবেচনার যোগ্য- এই ভ্রান্ত ধারণাটি আংশিকভাবে দূর করে দিয়েছে যুগান্তকারী জাতীয় স্বাস্থ্য বীমাপত্র। এই শতাব্দীতেও বড় হাসপাতালে ‘বিনামূল্যের’ রোগীদের কোনো চেতনানাশক ছাড়াই দাঁত তোলা ছিল স্বাভাবিক ব্যাপার। তারা অর্থ পরিশোধ করেনি, তাহলে তাদের কেন চেতনানাশক প্রয়োগ করা হবে! – এরকম ছিল মনোভাব। সেটাও এখন পাল্টে গেছে।

তা সত্বেও প্রতিটি প্রতিষ্ঠান সবসময় তার অতীতের কিছু দীর্ঘস্থায়ী স্মৃতি বহন করে চলবে। একটি ব্যারাক-কক্ষ এখনও রুডিয়ার্ড কিপলিং-এর ভূত দ্বারা আচ্ছন্ন এবং অলিভার টুইস্টের কথা মনে হওয়া ব্যাতিত সরাইখানায় প্রবেশ করা কঠিন। কুষ্ঠরোগীদের চিকিৎসা এবং তাদের মৃত্যুবরনের জন্য এক ধরণের নৈমিত্তিক ওয়ার্ড হিসাবে হাসপাতালগুলোর যাত্রা শুরু হয়েছিল। পরবর্তীতে সেই স্থানসমূহে দরিদ্রদের শরীরে চিকিৎসাবিদ্যার ছাত্ররা তাদের শিল্প রপ্ত করা অব্যহত রেখেছে। আপনি এখনও সেইসব ভবনের তমসাবৃত বৈশিষ্ট্যের স্থাপত্যে তাদের ইতিহাসের একটি ক্ষীণ ব্যঞ্জনা বুঝতে পারবেন। আমি কোনও বিলেতি হাসপাতালে যে ধরনের চিকিত্সা পেয়েছি সে সম্পর্কে কোনো অভিযোগ করার প্রশ্নই ওঠে না। তবে আমি জানি, যদি সম্ভব হয় এই লেখাটি হাসপাতাল থেকে দূরে থাকতে মানুষকে ভালভাবে উদ্বুদ্ধ করবে। বিশেষ করে সর্বজনীন ওয়ার্ডের বাইরে থাকতে সতর্ক করবে। আইনি অবস্থান যাই হোক না কেন, বিষয়টি প্রশ্নাতীত যে আপনার নিজের চিকিত্সা ক্ষেত্রে আপনার নিয়ন্ত্রণ খুবই কম। আপনার উপর অযৌক্তিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হবে না-এরকম নিশ্চয়তা নেই বললেই চলে, যখন এটি ‘শৃঙ্খলা মেনে চলুন অথবা বেরিয়ে যান’ এর মতো পরিস্থিতে থাকে।

আর নিজের বিছানায় মরতে পারাটা অনেক বড় ব্যাপার, যদিও সক্ষম শরীরেই মরে যাওয়া উত্তম। যতই উদারতা এবং দক্ষতার কথা বলা হোক না কেন, হাসপাতালের প্রতিটি মৃত্যুর সাথে কিছু নিষ্ঠুর ও জঘন্য বর্ণনা থাকবে। সেগুলো বলার মতো কিছু না হলেও পেছনে পড়ে থাকবে ভয়ঙ্কর বেদনাদায়ক স্মৃতি, কোলাহলমুখরতা এবং তাড়াহুড়ো করা কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা। সেখানে প্রতিদিন আত্মীয়-স্বজনহীন অবস্থায় মরেছে অসহায় মানুষ। 

সম্ভবত অতি দরিদ্রদের মধ্যে হাসপাতালের ভয় এখনও বিরাজমান এবং সম্প্রতি আমাদের সকলের মধ্যে বিরাজিত ভয়টি অদৃশ্য হয়ে গেছে। আমাদের সকলের মধ্যেকার ভয়টি হল আমাদের হৃদয়ের অদূরে থাকা এক টুকরো অন্ধকার। আমি আগেই বলেছি যে যখন আমি হাসপাতালের ওয়ার্ডে প্রবেশ করি তখন আমি এক অদ্ভুত পরিচিত অনুভূতির বিষয়ে সচেতন হলাম। দৃশ্যটি আমাকে ঊনবিংশ শতাব্দীর যন্ত্রণাদায়ক হাসপাতালগুলোর কথা মনে করিয়ে দিল, ওসব আমি কখনও দেখিনি কিন্তু সেগুলো সম্পর্কে আমার একটি পরম্পরাগত জানাশোনা ছিল। আরও বলতে গেলে, সম্ভবত পূতিগন্ধময় বিবর্ণ ব্যাগসমেত কালো আলখাল্লা পরিহিত চিকিৎসক অথবা সম্ভবত শুধুমাত্র রোগাটে দুর্গন্ধ, টেনিসনের “দ্য চিলড্রেনস হসপিটাল” কবিতাটি আমার স্মৃতি থেকে বের করে আনার অদ্ভুত খেলা খেলেছে, যেসব বিষয় আমি গত কুড়ি বছর ভুলে ছিলাম। আমার ছোটবেলায় এটা ঘটেছিল, জনৈকা বৃদ্ধা নার্স আমাকে কবিতাটি উচ্চস্বরে আবৃত্তি করে শুনিয়েছিলেন। হয়তো তার নিজের কর্মজীবনের সমান্তরাল সময়ে লর্ড টেনিসন এই কবিতাটি লিখেছেন। মান্ধাতার আমলের হাসপাতালের আতঙ্ক এবং দুর্ভোগসমূহ টেনিসনের কাছে ছিল এক অবিস্মরণীয় স্মৃতির মতো। আমরা কবিতাটি পাঠ করে যুগপৎ শিহরিত হয়ে উঠেছি এবং তারপরে মনে হয় আমি ভুলেও গিয়েছি। এমনকি কবিতাটির নামও সম্ভবত আমি ভুলে গিয়েছি। কিন্তু লঘু আলোকিত কলতানময় বিশাল কক্ষটিতে ঘিঞ্জি বিছানাগুলোর সারি দেখতে পেয়ে প্রথমেই হঠাৎ আমার হাসপাতাল বিষয়ক চিন্তার রেলগাড়িটি চলতে শুরু করে দিল। তার পরের রাতে কবিতাটির হুবহু অনেকগুলো পংক্তিসহ পুরো আখ্যান ও আবহ স্মরণে আনতে সক্ষম হয়েছিলাম।

.

.

.

মধুসূদন মিহির চক্রবর্তী

তথ্য ও বিজ্ঞাপন চলচ্চিত্র নির্মাণ, আবৃত্তি ও অনুবাদ করার পাশাপাশি মধুসূদন মিহির চক্রবর্তী একজন পরিব্রাজক। বিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর। কুমিল্লা জেলার ঐতিহাসিক প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান ময়নামতিতে তার পৈত্রিক আদিনিবাস। তিনি প্রথম ও পূর্ণাঙ্গভাবে ভারতবর্ষে আরবদের প্রথম বিজয় সম্পর্কিত ইসলামের ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ ও দুর্লভ গ্রন্থ চাচনামাহ অনুবাদ করেছেন। গ্রন্থটি বাংলাদেশসহ ভারতের বাংলা ভাষাভাষী অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে সহায়ক পাঠ্য হিসেবে বিবেচিত

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ভাষা
Scroll to Top