বসুন্ধরা সিনে কমপ্লেক্সে পর পর দুটি চলচ্চিত্র দেখলাম। মনে হল বাংলাদেশের চলচ্চিত্র অঙ্গনে সৃষ্টি সমৃদ্ধির নব উন্মেষ ঘটছে। এ উন্মেষ লগ্নে দর্শক হিসেবে কিছু লিখতে ইচ্ছে করল। এন রাশেদ চৌধুরীর নির্মাণে ‘চন্দ্রাবতী কথা’ নিয়েই প্রথমে শুরু করছি। অভিনয় করেছেন দিলরুবা হোসেন দোয়েল, এহসান রহমান বর্ষণ ইমতিয়াজ, কাজী নওশাবা আহমেদ, তনয় বিশ্বাস, জয়ন্ত চট্টোপাধ্যয়, মিতা রহমান, গাজী রাকায়েত, আরমান পারভেজ মুরাদসহ চন্দ্রাবতীর গ্রামের মানুষ এবং স্থানীয় পালাগান গাতক ও বয়াতি দলের সদস্যরা। শেষের শিল্পীরা চমক দিয়ে গেল চলচ্চিত্র বিমুখ আমার মনে। মনে হল, ‘চন্দ্রাবতী কথা’র মূল গুপ্ত ভাবটি প্রকাশ পেয়েছে এই গ্রামীণ গাতক এবং পালাকারদের সুর ও বয়ানের আর্ত ধ্বনিতে। এইত আমার আবহমানকালের বাংলাদেশ। জাতি ধর্ম বর্ণের শত শত আঘাত শেষেও অটুট বাঙ্গালী জাতির আজন্মের সুধাময়ী বর্ণন !
আমি প্রকৃতির সন্তান। আমার হৃদয় তলপুকুরের জলে গভীরভবে সমাহিত। তাতে তরঙ্গের আঘাতে বহুবর্ণ অভিঘাত সৃষ্টি না হলে বুঝে নিই, আমাকে ভাসাতে পারেনি দর্শনীয় কিম্বা শ্রবণীয় কোন ঘটনা, দৃশ্য, সুর বা ছবি। এমনকি ব্যক্তি মানুষও। নারী চন্দ্রাবতী, প্রেমিকা এবং প্রতারিত বিরহী চন্দ্রাবতী, কবি চন্দ্রাবতী, দশরথপুত্র, বিষ্ণুর সপ্তম অবতার অযোধ্যার গুণাধীশ রাজা রামকে দুয়ো দিয়ে সীতাকে অগ্রবর্তী করে রামায়ণ রচয়িতা ঋষি চন্দ্রাবতী আমার অনেক কাল আগের শোনা চেনা জানা চরিত্র। প্রত্যাখ্যাত প্রেমের ভুল, জ্বালা, অপমান যেন কোন মেয়েকে বিষপান কিম্বা গলার দড়ি দিতে উৎসাহিত না করে সে জন্যে গুরুজী আমাদের শিল্প সাহিত্য সৃষ্টির ব্রত নিতে শিক্ষা দিতেন। গুরুজীর কাছেই জেনেছিলাম প্রেম সে ত পাখির পালকসম উদ্দাম উড়ান। কিন্তু ঝরে গেলেই পলকা প্রাণহীন অর্থাৎ প্রেমহীন। তাতে অপরাহত শোক পেলে দুঃখ যন্ত্রণা হতাশা কিম্বা মরে যেতে ইচ্ছে করলে বই পড়, লেখ, ছবি আঁক কিম্বা রাগ ভৈঁরো তে মাঝরাতের আকাশ কাঁদিয়ে জাগিয়ে রাখ নিজের শুদ্ধ অন্তরাত্মাকে। চারশত বছর আগে হাওড় অঞ্চলের এক কবি দ্বিজ বংশীদাস ভট্টাচার্যের হৃদয়বতী কন্যা, কবি চন্দ্রাবতী যেমন করেছিলেন। মৃত্যু হোক যে কোন প্রকারে কিন্তু সৃষ্টি থাকুক অনলসম।
এন রাশেদ চৌধুরীর ‘চন্দ্রাবতী কথা’ বৈশিষ্ট্যপূর্ণ। কেবল কবি চন্দ্রাবতীতেই চলচ্চিত্রটি থেমে থাকেনি। তাই বসুন্ধরা সিনে কমপ্লেক্সের শীতল পরিবেশে যারা কেবল ‘চন্দ্রাবতী কথা’ দেখতে গিয়েছিলেন, তারা সত্যিকার অর্থে থমকে গেছেন। এ তারা কি দেখছেন ?
১৫২৬ সালে দিল্লির মসনদে বসেন মুঘলরা। বাংলা তখনও স্বাধীন। ১৫৭৬ সালে পরাজিত হয় বাংলার স্বাধীন শাসিনকর্তা দাউদ খান। দাউদ খান পরাজিত হলেও বাংলার স্বাধীনতা তখনও কব্জা করতে পারেনি পরাক্রান্ত মুঘল শাসকরা। আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সমানে লড়ে গেছে বাংলার বারো ভুঁইয়ারা। সেই সাথে বাংলার শাসন এবং সমাজব্যবস্থায় ছিল, ধর্মীয় জাত্যাভিমান, জাত পাতের শ্রেণীবিভাজন। একই সাথে ছিল সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং ধর্মীয় বিধি বিধানের উচ্চ নীচতা সৃষ্টির ফলে চলছিল অকথ্য অত্যাচার ও বঞ্চনা। ব্রাহ্মণ্যবাদের অত্যাচারে নাথ সম্প্রদায়ের দেশ ত্যাগ কিম্বা ধর্ম ত্যাগের এক ঝলক সত্য ইতিহাসের পাশাপাশি ছিল ইসলাম ধর্ম গ্রহনের জন্য জোরজুলুম। এরই সাথে এসেছে সোনাই কাহিনী। দিকচক্রবাল ঘিরে অপার অসহায়তার ধিক ধিক জলনিনাদের মাঝে মাঝগাঙে ডুবে যাচ্ছে সোনাই। সোনাই নাকি অপমানিত প্রিয়া সীতা ! বলে রাখি, এই দৃশ্যটি ‘চন্দ্রাবতী কথা’ চলচ্চিত্রের সর্বশ্রেষ্ঠ দৃশ্যচিত্র।
আর সেই স্বাধীন বাংলায় ১৫৫০ সালে, কিশোরগঞ্জ জেলার, সদর উপজেলার মাইজকাপন ইউনিয়নের, ‘ ধারাস্রোতে ফুলেশ্বরী নদী বহে যায়’—যে পাতুয়াইর গ্রাম, সেই গ্রামে কবি চন্দ্রাবতী জন্মগ্রহন করেন।
ভবিষ্যতে এ চলচ্চিত্রটি বাংলাদেশের চলচ্চিত্র জগতের এক অক্ষয় সম্পদ হয়ে থাকবে। আমি বলছি না, এন রাশেদ চৌধুরীর ‘চন্দ্রাবতী কথা’ একটি সর্বাঙ্গ সুন্দর চলচ্চিত্র। আলবৎ কিছু ত্রুটি আছে। যেমন, চন্দ্রাবতী চরিত্রের নির্বাচন মোটেও যথাযথ হয়নি। ভাবলেশহীন কাঠ কাঠ জড় অভিনয়। স্থুল অসহজ পদক্ষেপ। মডেলিংএর ষ্টিফ গ্রামার ভেঙ্গে অভিনয়শিল্পীতে রূপান্তরিত হতে প্রচুর খাটতে হয়। অভিনয় শিল্পীদের শরীর হবে কাদামাটির। তাছাড়া কেবল পরিচালকের নির্দেশনা নয়, অভিনেত্রীকেও আত্মস্থ করতে হয় চরিত্রের গভীরতাকে। নায়িকা চরিত্রে দোয়েল একেবারেই ব্যর্থ এখানে। আবার জয়ানন্দের স্ত্রী আসমানির বলা কথাগুলোতে অনর্থক কটুস্বর ব্যবহার করা হয়েছে। কঠিন কথা সাপের হিস্ এর মত অস্ফুট উচ্চারণেও বলা যায়। আরও আছে। এত বেশি ধোপদুরস্ত ধুতি শাড়ি একেবারে বেমানান ছিল। কটকট লেগেছে । দরকার ছিল নিত্য ব্যবহারের পোশাক পরিচ্ছদের। কারণ যাপিত জীবনে শরীরের গন্ধ মিশে পোশাকগুলো গাঢ় রঙ ধারণ করে।
সবচে বেশি শ্রীহীন লেগেছে ‘চন্দ্রাবতী কথা’ র পোষ্টার। সে সময় ব্লাউজ পরার প্রচলন যেমন ছিল না তেমনি এতখানি পিঠ বের করে পূজা করারও প্রচলন ছিল না। নারীর প্রেম এবং প্রার্থনার নৈবদ্য হয় সম্পূর্ণ সমর্পণের বিশ্বাসে রচিত। একই সাথে নারীরা এটিও জানে এবং চর্চা করে যে ঈশ্বরের কাছে তাদের সমর্পণ হবে শুদ্ধ নিবেদনে আপ্লুত। দেহজ ভাষায় নয়। তাছাড়া আলুলায়িত আঁচল কাছিয়ে নারীর নগ্ন পিঠের যে লালিত্য ফুটে উঠার আভাস ছিল তা মোটেও স্ফুট হয়ে ওঠেনি। বোঝাই যাচ্ছে চন্দ্রাবতীর পিঠের কাপড় জোর করে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। আর যাই হোক, অসুন্দরের চর্চা নেওয়া যায় না। তাই, নিইনি।
পাশাপাশি জয়ানন্দ ছিল দুরন্ত। অস্থির। প্রাণময়। কাজি নওশাবা স্নিগ্ধ, ব্যাপ্ত গভীর। অন্যদিকে তনয় বিশ্বাস চমৎকার। জয়ন্ত চট্টোপাধ্যয় টাইপড। অভিব্যক্তিতে কোন পরিবর্তন নেই। মিতা রহমান ভাল করেছেন। আরও একটি দৃশ্য মনে রাখার মত, জারি গান আর তার খন্ড খন্ড দৃশ্য চিত্রায়ণে মুসলিম গীতবাদ্যের ক্ষণিক আভাস। শুধু এই দৃশ্যটির জন্যে সুযোগ পেলে আমি আরেকবার ‘চন্দ্রাবতী কথা’ দেখব সুনিশ্চিত।
অশেষ ধন্যবাদ শিল্পী কলাকুশলীদের। এন রাশেদ চৌধুরীর জন্যে শুভেচ্ছা। তিনি এমন একটি সময়কে ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছেন, যা কিনা ছিল এ বঙ্গভূমির বিশাল ভাঙ্গনের এক আকুল সময়কাল। অসংখ্য কৌতুহলের নানাবিধ পথ মত মুখিয়ে উঠেছে ‘চন্দ্রাবতী কথা’য়। চলচ্চিত্রটি দেখে আমি নিজেই পলায়নণপর ‘নাথ’ সম্প্রদায় সম্পর্কে জানতে আসাম বাংলাদেশ গুগল ঘেঁটে ফেলেছি। ‘নাথ’ সম্প্রদায়ের সাথে চন্দ্রদ্বীপ বা বরিশা্লে যোগসূত্র পেয়ে বার বার মনে হয়েছে, আমার পূর্ব পুরুষ ব্রাহ্মণ না হয়ে ব্রাম্মণদের হাতে উৎপীড়িত, পলায়নে ব্যর্থ ‘নাথ’ সম্প্রদায়ভুক্ত ছিল না ত !
এখানেই একজন পরিচালকের সার্থকতা।
তবে সৃষ্টিশীল মানুষদের সার্থকতার সম্পূর্ণতা থাকতে নেই। তাই আশা রাখছি পরিচালক এন রাশেদের কাছ থেকে আরও চমৎকার কিছুর যা আমাদের জাতিসত্তার মর্মমূল কাঁপিয়ে অতীত সত্যের সামনে এনে দাঁড় করিয়ে দিবে।