গান্ধারী // সোমা বন্দ্যোপাধ্যায়

চল চল আর দেরি করিস না বাবা। মুখের সামনে যেটুকু খাবার আছে নিয়ে শিগগির বেরিয়ে পড়। দেখছিস না লোকগুলো সব যন্ত্রপাতি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে!!

ছোট্ট ছেলেটা মার মুখের দিকে করুণ চোখে তাকায়।

কোথায় যাব মা! আমাদের এই ঘরটা যে এত যত্ন করে তুমি সাজালে? এটা ছেড়ে চলে যাব আমরা?

ঘর? পাগল ছেলে। জংলীদের আবার ঘর হয় নাকি! কোন ঠিকানা হয় নাকি? ওই যে লোকগুলোকে দেখছিস! ওরা হল পরিষ্কারওয়ালা। আমাদের মত জংলীদের সাজানো ঘরদোর, গোছানো পরিবার, চোখের স্বপ্ন সবকিছু বিলকুল পরিষ্কার করে দেয় ওরা।

এত কথা বলার সময় নেই এখন। তাড়াতাড়ি কর নইলে বুকের রক্তটুকুও ওরা পরিষ্কার করে দেবে।

কোনওরকমে সব কিছু গুটিয়ে নিয়ে পিচের রাস্তায় উঠে পড়ল গান্ধারী। পিছনে তার পাঁচ পাঁচটি ছেলেপুলে। সবচেয়ে ছোটটা ভালো করে হাঁটতেও শেখেনি। তাকে যে আগলে নিয়ে যাবে সে উপায়ও গান্ধারীর নেই। পিচ রাস্তায় গাড়ি ঘোড়া সামলে আর একটা আস্তানায় পৌঁছোতে হবে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব।

গান্ধারী আর তার পরিবার রাস্তার মোড়টা ঘুরে গেল চোখের পলকে। খোলা বারান্দায় কফির কাপ হাতে নিয়ে দেখছিল রায়া। গান্ধারীর অস্থায়ী আস্তানাটা কেমন যেন ফেলে যাওয়া কাপড়ের মত আলুথালু হয়ে রয়েছে। সেইদিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে বকুল। রায়া একটু খেয়াল করে দেখার চেষ্টা করল বকুলের চোখে কি জল? গান্ধারীর পরিবারের সাথে বকুলের কতদিনের সখ্যতা। যেদিন ওরা দুটোতে মিলে মাটি খুঁড়ে খুঁড়ে তৈরী করেছিল এই আস্তানাটা, তখন বকুলের বাচ্চাগুলো খুব ছোট। জলা জায়গায় ছেলেপুলে নিয়ে থাকতে খুব ভয় করত বকুলের। সাপখোপের হাত থেকে বাচ্চাগুলোকে বাঁচিয়ে রাখা, তাদের খাবারের জোগাড় করা সবটাই খুব কঠিন ছিল বকুলের পক্ষে। বাচ্চাগুলো জন্মানোর পরই বকুলের মরদটা কোথায় যে হারিয়ে গেল! গান্ধারী তখন পাশে দাঁড়িয়েছিল বকুলের মুশকিল আসান হয়ে। গলা পর্যন্ত জলে ডুবে সাপখোপের ছোবল থেকে আগলে রাখত বকুলের বাচ্চাগুলোকে। সারাদিনের রসদ জোগাড় করে বাচ্চাগুলোর মুখে তুলে দেওয়ার জন্য হাঁপাতে হাঁপাতে যখন ছুটে আসত বকুল, দেখত সবচেয়ে ছোট বাচ্চাটা ভয়ে কুঁকড়ে শুয়ে আছে গান্ধারীর দু’হাতের ফাঁকে। ধীরে ধীরে গান্ধারীর ঘর আলো করে এলো ছেলেপুলেগুলো। বাচ্চাগুলোকে নিয়ে সেদিন রোদে খেলছিল ওদের বাবা। হঠাৎ এক বড়লোকের ছেলে গাড়ি চালানো শিখতে শিখতে আস্ত গাড়িটাই তুলে দিল ওদের বাবার ঘাড়ে। দু হাত আকাশের দিকে তুলে, রক্তে ভেসে যাওয়া শরীরটা ছটফট করতে করতে নিথর হয়ে গেল। হৈ হৈ করে ছুটে এল গান্ধারী, বকুল, বাসন্তী, ছেদিলাল সবাই। কিন্তু জংলীদের জীবনের মূল্য বোঝাতে পারল না গাড়ি চালানো শিখতে আসা নবাবের বেটাকে। গান্ধারীর আস্তানার দিকে তাকিয়ে সে কথা মনে পড়ে গেল বকুলের। আহা সেদিন গান্ধারীর দু:খ ভোলানোর জন্য কতরকম গান শুনিয়েছিল বাসন্তী। ঘুমপাড়ানি গান, মন ভালো করার গান, কান্না থামানোর গান আরও কত কি! আজ বাসন্তীর বসার জায়গাটাও পরিষ্কার করে দিল পরিষ্কারওয়ালারা। বাসন্তী জানতেও পারল না। কয়েকদিন পরে ছেদিলালের ওই বিশ্রী ঘরটাতে নিজের বাচ্চাগুলোকে চালান করার জন্য যখন বাসন্তী আসবে, খুব কষ্ট পাবে বেচারা। রায়া হয়তো তখনো বারান্দায় এসে দাঁড়াবে বাসন্তীর গান শোনার জন্য, কিন্তু মিষ্টি রোদের আড়ালে বসে গান গাওয়ার সুখটাই আর পাবে না বাসন্তী। রায়ারও আর গান শোনা হবে না। ছেদিলাল মনে মনে ভাবে যাক বাবা আমার গায়ে পরিষ্কারওয়ালারা কোন আঁচড় কাটতে পারেনি। ছেদিলালের এই অসাড় সন্তুষ্টি দেখে রায়ার ভারি অদ্ভুত লাগে। জংলীরা এত পরশ্রীকাতর হয় নাকি! ওতো সভ্যলোকের স্বভাব।

এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেল আচমকা। গান্ধারীর আস্তানার চারপাশটা বৃষ্টির ঝাপটায় কেমন এলোমেলো হয়ে গেল। যেন এক ঝটকায় মুছে দিয়ে গেল গান্ধারীর গোটা পরিবারটার অস্তিত্ব। ঝুপ করে অন্ধকার নামতেই একে একে ঘর ছেড়ে বেরোতে লাগল জুগনুর বন্ধুবান্ধবরা। প্রত্যেকের হাতে টিম টিম করে জ্বলছে লন্ঠন। একজন দুজন করে দলটা যখন বেশ ভারী হয়েছে, আকাশমুখো জুগনু চিৎকার করে বলে উঠল – ওরে তোরা আর উঠিস না, বিশ্রাম নেওয়ার আর কোন জায়গা নেই। চলতে চলতে ক্লান্ত হয়ে বসে লন্ঠনগুলো উসকে দিত ওরা। মিশকালো রাত্রিটা ওদের লন্ঠনের আলোয় কেমন স্বপ্নময় হয়ে উঠত। আর সেই আলোর রোশনাই দেখে সুরবাহার বেঁধে নিত পান্নাবাঈ আর তার মজলিশী  সঙ্গীসাথীরা। নিখুঁত সুরের মূর্চ্ছণায় কানায় কানায় ভরে উঠত জংলী দুনিয়াটা। গোধুলির আলোর ছোঁয়ায় অপরূপা  হয়ে ওঠা নববধু, প্রাণের পরশ পেত পান্নাবাঈ এর ইমনের আলাপে। মরমীয়ার উষ্ণ আলিঙ্গন বাঙ্ময় হয়ে উঠত দরবারীর তানে বিস্তারে। জুগনুদের লন্ঠনের আলো যখন ভোরের আকাশকে কুর্নিশ জানিয়ে নিভে যেত, সুখনিদ্রা শেষে যখন চোখ মেলত মরাল-মরালী, পূবালী বাতাসে তখন ছড়িয়ে যেত পান্নাবাঈ এর ভৈরবীর বন্দিশ। সমস্ত দৃশ্যটা যেন চোখের সামনে ভেসে উঠল রায়ার। পরিষ্কারওয়ালাদের বেলচা কোদালের ঝনঝনানি, কবর দিয়ে দিয়েছে সেই দৃশ্যপটের। ফতোয়া জারি করেছে বকুল, জুগনু, পান্নাবাঈদের। সমস্ত কিছু উপড়ে ফেলে পরিষ্কার করা এই নন্দনকাননে জংলীদের প্রবেশ নিষেধ।

কত না ঘুমোন রাত্রি রায়া কাটিয়েছে এই জুগনুর দলের লন্ঠন নৃত্য দেখে আর পান্নাবাঈ এর রাগরাগিণীর মজলিশ শুনে। রোজ সকালে গান্ধারী যখন তার ছেলেমেয়েদের সাথে নিয়ে হেঁটে যেত পিচ রাস্তার উপর দিয়ে, কি যে সুন্দর দেখতে লাগত! রায়া প্রাণ ভরে অনুভব করত গান্ধারীর মাতৃত্বের সৌরভ। বকুলের বাচ্চাগুলো রায়ার চোখের সামনে একটু একটু করে বেড়ে উঠল। সন্তান লালনের প্রতিটা ধাপের কঠিন চ্যালেঞ্জ একটু একটু করে কাটিয়ে উঠল বকুল, একেবারে একা। রায়াকে পড়িয়ে দিয়ে গেল জংলী লড়াইয়ের কঠিন পাঠ।

জংলী এই পরিবেশটাকে সাফসুতরো করার জন্য দরবার করেছে সবাই। উঠেপড়ে লেগেছে সমস্ত আগাছা উপড়ে ফেলার জন্য।  উন্নয়নের কাণ্ডারি  হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে পরিষ্কারওয়ালারা। কেউ ভেবে দেখেনি গান্ধারী, বকুল, বাসন্তী, জুগনু, পান্নাবাঈদের কথা। রায়া অনেকবার বলার চেষ্টা করেছে – থাকনা সবাই যে যেমন আছে! কিন্তু উন্নয়নের বিউগলের আওয়াজের আড়ালে রায়ার মৃদু প্রতিবাদ মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি।

পরিষ্কারওয়ালারা সদর্পে পরিষ্কার করে দিয়ে গেছে রায়ার বারান্দার সামনের আগাছায় ভর্তি জলা জঙ্গলটা। রায়া হারিয়ে ফেলেছে তার সেই জংলী বন্ধুদের, যাদের সাথে সে সারারাত সুখ দু:খের গল্প করত। রায়ার খারাপ মন ভাল করার জন্য কত কেরামতিই দেখাত তার জংলী বন্ধুরা।

আজ আর কে জেগে থাকবে বিনিদ্র রায়ার সাথে রাতের পর রাত! রায়ার চোখের অন্ধকার কাটাতে আর তো আসবে না জুগনুর দল। ক্লান্তিতে ভেঙে পড়া শরীরটা আর তো চনমনে হয়ে উঠবে না পান্নাবাঈ এর গানের আমেজে! ভাবতে ভাবতে দুচোখ ভিজে যায় রায়ার। বাসন্তীর দু:খহরণ সঙ্গীতের জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠে রায়ার মনটা। কেমন আছে গান্ধারী!  ওর ছোট বাচ্ছাগুলো! আদৌ কি আর কোন আস্তানার খোঁজ পেল তারা!

শীতের সকালের আমেজ চেটেপুটে নিতে নীচে নেমেছে রায়া। কেমন যেন খাঁ খাঁ করছে সামনের জায়গাটা। উপড়ে যাওয়া গাছ, ছেঁটে ফেলা ডালের স্তুপ, জড়ো করে রাখা শুকনো ঘাস, হেলে পড়া কচু গাছগুলো, সবটা মিলে যেন যুদ্ধের ধারাবিবরণী। রায়ার বিনিদ্র রাতগুলোর সাক্ষীরা এই অসম যুদ্ধের পরাজিত সৈনিক। রায়া হঠাৎ দেখল জড়ো করা ঘাসের স্তুপের মধ্যে কি যেন নড়াচড়া করছে। কিছুক্ষণ পর মাথায় এক দলা শুকনো ঘাস মুকুটের মত পরে বেরিয়ে এলেন রাজমহিষী গান্ধারী। হয়তো বা ফেলে যাওয়া সংসারে কিছু কেজো জিনিসের সন্ধানে এসেছেন তিনি। রায়াকে দেখে দুহাত তুলে শরীরটাকে সোজা করে দাঁড়াল গান্ধারী। কালো ভ্রমরের মত চোখগুলো দিয়ে কত কিছুই না বলতে চাইল সে। তার চোখের সব করুণ ভাষা পড়তে পারে না রায়া। দুপায়ে ভর দিয়ে সোজা দাঁড়িয়ে থাকা গান্ধারীকে দেখে রায়ার একটাই কথা মনে হয় এ গান্ধারী আপোষ  করে না বুক চিতিয়ে লড়তে জানে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ভাষা
Scroll to Top