এশার নামাজের ঠিক আগে, অবিরাম বৃষ্টি ঝরছিল। পিঠের উপর ব্যাগে রাখা আরবী বইটি যেন বৃষ্টিতে না ভিজে, সেজন্য নিজের ওড়না দিয়ে ব্যাগ ঢেকে বৃষ্টির মধ্যেই তারান্নুম দৌঁড়ে ঘরে চলে আসে। চুল থেকে বৃষ্টির পানি ঝেড়ে ফেলতে ফেলতে চেঁচিয়ে ডাকতে থাকে, ‘আম্মি ! আম্মিইইইই !’ রাফিয়া কোন উত্তর না দিয়ে কয়লার উপর শুকনো আইলা মাছ রেখে ধীরেসুস্তে ভাজছিল। তারান্নুম সেখানে ছুটে এসে জানায়, ‘আম্মি, হাসিনা আর ওর আম্মা মসজিদে বসে আছে।’
‘তাই নাকি, কিন্তু কেন ?’
‘আজকে হয়ত কোন ফয়সালা হবে।’
‘আচ্ছা, তাই নাকি ?’
পড়াশুনার জন্য যখন রাফিকে মাদ্রাসায় পাঠানো হয়, তখন থেকেই রাফির অভ্যাস হয়ে গেছিল ওর সিটে বসে ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে ঘুমানোর। অথবা, দেখা যেত ইশকুলে বই আনার কথা ও বেমালুম ভুলে গেছে। এমনকি মাঝে মধ্যে টুপিটাও যেন কোথায় হারিয়ে ফেলত। সেদিন ছুটির শেষে রাফি ঘরে ফিরলে ওর আম্মু ওয়াসিমা ওকে মুখে তুলে খাওয়াতে গেলে রাফি হাত সরিয়ে দিয়ে বলে, ‘জানো আম্মু, হাসিনা আর ওর আম্মু সেই তখন থেকে মসজিদে বসে আছে।’
‘বলিস কী—এখন– এ সময়ে ? কিন্তু কেন রে?’
‘হয়ত আজকে কোন ফয়সালা নেওয়া হবে—’
‘অহো, তাই তো !’
মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের সাথে দেশলাই বাক্সোর লেবেল আর অভিনেতা অভিনেত্রীদের ছবির বিনিময়ে চকখড়ি নিয়ে হামিদের পকেট ভর্তি ছিল। কিন্তু হামিদ যখন ঘরে ফিরল, তখন ও পোকায় কাটা পচা দাঁতের জন্য কাঁদছিল আর ওর মাকে বলছিল, ‘আম্মি—- হাসিনা—’
সবাই ইশকুল থেকে ঘরে ফিরে যে যার পরিবারের সবাইকে হাসিনাদের খবরটি জানাচ্ছিল। ওই সময়ে মাজিদা, যাতে নোংরা না লাগে, সেজন্য বাম হাত দিয়ে সাবধানে ওর সালোয়ার উঁচুতে তুলে ডান হাত দিয়ে পবিত্র কুরআন বুকে জড়িয়ে ঘরে ঢুকে দেখে, ড্রয়িংরুমে ওর আব্বা আরামসে বসে আছে। কিছুটা থমকে গেল মাজিদা। তারপর টেবিলে রাখার আগে, দুহাতে কুরআন ধরে দুচোখে ছুঁইয়ে জিগ্যেস করল, ‘আব্বা, তুমি মসজিদে যাওনি?’
‘হুম, এখনও ত এশার নামাজের ওয়াক্তের বাকী আছে। আমি যাব, জামায়াত হতে আরও কিছু সময় আছে—’ মসজিদের মোতাওয়াল্লি আব্দুল কাদের সাহেব মেয়ে মাজিদাকে বলে টিপয়ের উপর থেকে টুপিটা নিয়ে আস্তে ধীরে মাথায় পরলেন। মাজিদা কিছুটা রেগে চেঁচিয়ে উঠল, ‘আব্বা আমি নামাজের কথা বলছি না। মসজিদে হাসিনা আর ওর আম্মু বসে বসে আপনার জন্য অপেক্ষা করছে। মনে হচ্ছে, আজ হয়ত ওদের ব্যাপারে কোন ফয়সালা হবে।’
‘ও, মানে — একমিনিট, কি বললে তুমি? অই মহিলা মসজিদে বসে আছে? মসজিদের কোথায় বসে আছে?’
মোতাওয়াল্লি সাহেব তার নিজের ডাকা কাউন্সিল সভার কথা ভুলে গেছিলেন। তিনি আঙ্গুলের ডগা দিয়ে তার ঘন, কালো দাড়ি আঁচড়াতে আঁচড়াতে গভীর চিন্তায় ডুবে গেলেন।
‘উফ্ আব্ববাজান, আপনি না—-! যেখানে মৃতদের জানাযা হয়, সেখানে, মানে জানাজা স্থলের কাছাকাছি, হাসিনা আর ওর ছোট দুই বোনকে নিয়ে ওর আম্মু বসে আছে। আপনাকে তাড়াতাড়ি যেতে হবে, আব্বাজান। এই ঠান্ডায় ওরা সবাই কাঁপছে। ইস্ বেচারারা।’
এই বৃষ্টিঝরা ঠান্ডা ঠান্ডা আবহাওয়ায় মোতাওয়াল্লি সাহেবের মন উষ্ণতার তাপে নিজেকে উত্তপ্ত করে তুলতে আকুলিবিকুলি করছে। আহা, খুবই মজাদার হয়ে উঠবে এই ভেজা সময়। যদি সাথে থাকে সিলন রুটি, প্রচুর মরিচ দিয়ে আদা টমেটোর ঝালযুক্ত ফাল, চিকেন কাবাব। খেতে খেতে আরও বৈচিত্র্যপূর্ণ অসাধারণ কিছু যেমন, নারীরত্ন বিশেষ আমিনা, যে বিয়ের দশ বছরের মধ্যে তাকে সাত সাতটি সন্তান উপহার দিয়েছে, তার উদগ্র শরীর পেলে, আহা, শাড়িতে রসুনের গন্ধ, তাজা আদা, গরম মশলার সুবাস জড়িত আমিনার গোল উদ্ধত ভরভরন্ত স্তন, সবচেয়ে ছোট বাচ্চাটি যে স্তন থেকে এখনও দুধ খাচ্ছে—-
মোতাওয়াল্লি সাহেবের কল্পনা যখন তুঙ্গে পৌঁছেছে, সে সময় দরোজা দিয়ে আমিনা নিজেই হাজির হয়। মসলামাখা হাত দুটো কাপড়ে মুছে, যুদ্ধ উদ্যত মুরগির মতো ঘাড় কাত করে মৃদু কাশি দেয়। মোতাওয়াল্লি সাহেব তার দিকে তাকালে আমিনা রাগে ফুঁসে উঠে বলে, ‘উফ আমি ত্যক্ত বিরক্ত হয়ে গেছি। কত হাজারবার আপনাকে বলেছি আপনি কানে তুলছেন না। আমার বয়েসি অন্য মেয়েরা বিয়েও করেনি আর আমি সন্তান জন্ম দিতে দিতে এখুনি বুড়ি হয়ে গেছি।’
‘কি ব্যাপার, তোমার আবার কি হল এখন?’
‘কি আর হওয়ার আছে ! আমার পিঠ ভেঙ্গে যাচ্ছে, আর পারছি না। এই বাচ্চাকাচ্চা, ঘর, সংসার — উফ, আমি কি এক মিনিট অবসর পাই? প্রতি বছর যদি এভাবে সন্তান পয়দা করে যাই– আমার কি হবে তাইলে ? আপনি কি চান না এই বাচ্চাগুলোর জন্য আমি যেন আরো কিছুদিন বেঁচে থাকি?’
‘চুপ কর। এসব নিয়ে কেন কথা বলছ? আমি কি তোমাকে কখনও কোন অভাব অনটনে রেখেছি? শোন, কান খুলে পরিষ্কার করে জেনে রাখো, তুমি যা চাইছ তা কখনও হবে না। আমি একজন মোতাওয়াল্লি হয়ে কি করে আমার নিজের ঘরের মহিলাকে জন্মনিরোধক অপারেশন করতে দিতে রাজি হই? লোকে জানলে আমি তাদের কাছে কি জবাবদিহি করব?’
স্বামী স্ত্রীর মধ্যে এই অনুযোগ অভিযোগের চাপানউতোর হয়ত আরও কিছুক্ষণ চলতো, কিন্তু এ সময় সদর দরোজার কাছে শব্দ হওয়ায় আমিনা দ্রুত বাড়ির ভিতরে চলে গেল।
‘আস্লামু আলাইকুম মোতাওয়াল্লি সাহেব।’
‘ওয়ালাইকুম আস্সালাম। আরে ইয়াকুব, আপনি এখন এসেছেন? কিন্তু আপনার তিনি ত অনেক আগে চলে এসেছেন আর দীর্ঘ সময় ধরে মসজিদে অপেক্ষা করছেন। ‘আমি কি কোন ফয়সালা নেব, নাকি নেব না বলুন ?’
‘যেখানে আপনি আছেন, সেখানে আপনিই সব। অই মহিলা কি আপনার চাইতে বেশি আইন জানে? আপনার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সবকিছু হতে দিন। ইয়ে– যদি আপনার খাওয়া দাওয়া শেষ না হয় তো আমার সাথে এখন— ’
ইয়াকুব মিনমিন করে কিছু বলে।
‘খাওয়া, ঠিক আছে। ও ছেড়ে দিন–কিছু একটা সেরম হয়ে যাবে।’ মোতাওয়াল্লি সাহেব উদাস হয়ে বললেন।
‘সে কিভাবে হতে পারে ? আগে ত আপনাকে খাবার খেতে হবে। আমি অটো নিয়ে এসেছি। আপনার খাওয়া শেষ হওয়ার পর, আমরা কথা বলতে পারব।’
‘অহো, খাবারে কি আসে যায়! এগুলো কোন ব্যাপার না। একবার মোতাওয়াল্লি হয়ে গেলে এইই যথেষ্ট। আমাদের ঘর সংসার সবকিছু ভুলে যেতে হয়। এমনকি কেউ যদি মাঝরাতে এসে ডাক দেয়, তো তার সেবায় আমাকে ত যেতেই হবে, কী বলেন আপনি ?’ অনুযোগের সুরে বললেন মোতাওয়াল্লি।
‘ছিছি! আপনি নিশ্চয় আমাকে ভুল বুঝবেন না। আল্লাহর আইন বলে, একজন নয়, অবশ্যই চারজন স্ত্রীলোককে বিয়ে করতে পারে একজন পুরুষ। কোন স্ত্রীলোকের কি উচিত তাদের সম্মান, মর্যাদা আভিজাত্য ছেড়ে মসজিদে এসে বসে থাকার? আমি একজন স্ত্রীর জন্য দশটি বছর অপেক্ষা করেছি। সে কি পেরেছে আমাকে একটি ছেলেসন্তান উপহার দিতে? আর সে যেভাবে মুখ চালায়! আহাহহা! এটা কী কোন অভিজাত পরিবারের নারীর লক্ষণ? এ কারণেই তো আমি অন্য একজনকে বিয়ে করেছি। তবে? আমার কি এটা করা উচিত হয়নি? আমি কি প্রতিবার তার সাথে দেখা করতে যেতাম না? যতবার আমার মন চেয়েছে আমি কি তার কাছে যাইনি? এর আগে একদিন গাড়ি চালাতে গিয়ে রাস্তায় হাসিনার সাথে দেখা হলে আমি তাকে গাড়িতে তুলে বাড়ির কাছে নামিয়ে দিয়েছিলাম। সেই সাথে ওর হাতে দশটি টাকাও দিয়েছিলাম। আমরা কি মানুষ নই? একজন মেয়ে হয়ে সে যদি এতটুকু মানিয়ে নিতে না পারে — তাহলে—‘ একটানে কথাগুলো বলল ইয়াকুব।
আমিনা দরোজার পেছন থেকে ওদের সমস্ত কথাবার্তাই শুনছিল। মনেপ্রাণে সে সারাক্ষণ ইয়াকুবকে অভিশাপ দিচ্ছিল, ‘আহাহা, শয়তানের শয়তান লোক! কেমন তেলমারা মিষ্টি মিষ্টি কথা বলছে। নিজের আত্মতৃপ্তির জন্য সে আল্লাকেও নীচে নামিয়ে আনতে পারে। কুরআন তুলে আনবে, হাদিস থেকে নানা উদ্ধৃতি শোনাবে। কিন্তু যখনই অই গরীব মহিলাকে খাওয়াপরা দেওয়ার জন্য কিছু খোরপোষ বা খর্চা দেওয়ার কথা বলা হবে, তখনই সে দায়িত্ব এড়াতে শুরু করবে। আল্লাহরাব্বুল, তুমি কি এই লোকটাকে কিছু ভালো বুদ্ধি দেবে?’ আমিনা চুপ করে দরজার আড়াল থেকে ভিতরে চলে গেল।
‘ঠিক আছে, ইয়াকুব, এখন এসব বাদ দিন তো। একবার শুরু করলে আপনি একটানা বকে যান।’
মোতাওয়াল্লি সাহেব তার কালো কোট পরে ইয়াকুবকে বললেন। স্যান্ডেল পরে রাস্তায় নেমে এলে ইয়াকুব তাকে বলল, ‘চলুন, প্রিন্সেস হোটেলে যাই। আমাদের সম্প্রদায়ের কেউ ওখানকার ফ্যামিলি রুমে উঁকি দেয় না।’ মোতাওয়াল্লি সাহেব ইয়াকুবকে বললেন, ‘আরে আরও কোন নিরাপদ জায়গায় যাই চলুন। এখানে কেউ যদি দেখে ফেলে! কী প্রয়োজন অযথা ঝামেলা বাড়িয়ে? কিছু হলে কে তাদের উত্তর দিবে তখন? আজকাল যা হচ্ছে, জানেনই ত লোকজন কেমন আচরণ করে। কি বৃষ্টি— বাপ রে বাপ, এত ঠান্ডা পড়েছে। এই আমিনা, আমি বাইরে যাচ্ছি। ফিরতে দেরি হবে, দরোজা বন্ধ করে দাও।’
জবাবে ভেতর থেকে ছুঁড়ে ফেলা বাসনের ঝনঝন শব্দ আর আমিনার রাগী গজগজানি ভেসে আসে,‘মোতাওয়াল্লি না ছাইয়ের মোতাওয়াল্লি। কেমন ধারার লোক সে? মোতাওয়াল্লি হওয়ার পর সে কী ঠিকমত পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে? সে কি সিনেমায় যাওয়া বন্ধ করেছে ? আচ্ছা এগুলো না হয় না করলো কিন্তু সে কি শয়তানের পেশাব খাওয়া বন্ধ করেছে ? আল্লাহ যেন তার মোতায়াল্লিপানা জাহান্নামের আগুনে পুড়িয়ে দেন।’
আমিনার গজগজানি তারা শুনতে পায়নি। কিন্তু মোতাওয়াল্লিকে নিয়ে ছুটে যাওয়া ইয়াকুবের অটোরিকশার তীব্র আওয়াজ আমিনার কান পর্যন্ত ঠিকই পৌঁছে যায়। এরকম নির্মম কঠিন ঠান্ডা আবহাওয়ার মধ্যে আশরাফ হচ্ছে সেই কপালপোড়া হতভাগিনী নারী, যে ভূতের মতো নির্জন নিস্তব্ধ মসজিদে বসে আছে। ‘বেচারী! কি দোষ করেছে ? সে শুধু পর পর তিনটি কন্যাসন্তানের জন্ম দিয়েছে। সে কী তার দোষে হয়েছে? সন্তান কি রুটি বানানোর মতো ব্যাপার যে, আমরা যা চাই ইচ্ছামতো সেভাবে বানিয়ে নেব? বাহ্ কি সুন্দর কথা!’ আমিনার মন তিক্ততায় ভরে উঠে।
আমিনা বাড়ির পেছনে দক্ষিণ দিক ঘুরে মসজিদের চারপাশ ঘিরে যে উঁচু দেওয়াল তোলা হয়েছে সেখানে গিয়ে দাঁড়ালো। মসজিদে খুতবা পড়ার সময়, সেগুলো শোনার জন্য, আর মসজিদের হাউজ থেকে দরকারে কেউ যেন কয়েকটি পানির পাত্র ভরে দিতে পারে সেজন্য দেওয়ালের কয়েকটি পাথর সে ঠেলে সরিয়ে দিয়েছিল। মাথার উপর ওড়না টেনে কিছুটা মুখ ঢেকে পাথরের উপর উঠে মসজিদের ভেতরে উঁকি মেরে দেখল আমিনা। এশার নামাজ শেষে মুসল্লিরা বিশাল প্রাঙ্গনের প্রধান গেট দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। আমিনা আরেকটু ঝুঁকে পড়ল। ওহো, মসজিদের উত্তর দিকের হলঘরে আশরাফ কুন্ঠিত সংশয় নিয়ে বসে আছে। আঁচল দিয়ে ওর মাথা ঢাকা। ছেঁড়া শাড়িতে জড়িয়ে শিশুটিকে ওর কোলের ভেতর আগলে রেখেছে। বড় মেয়ে হাসিনা ঠান্ডা মেঝেতে পা ছড়িয়ে বসে আছে। আর তিন বছরের হাবিবা অর্ধেক মেঝেতে আর অর্ধেক শরীর মায়ের কোলে গুঁজে নিজেকে গরম করার আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে।
নামাজ পড়তে আসা মুসুল্লিদের সকলেই ওর দিকে প্রশ্নবোধক চোখে তাকিয়ে একে একে চলে গেল। কারো বাড়ি থেকে বিরিয়ানির ঘ্রাণ ভেসে আসছে। মাছের ঝোলের ঘ্রাণ আসছিল আরেক বাড়ি থেকে। কারো নতুন বউ তার জন্য অপেক্ষা করছে। অন্য কারও ছেলে হয়ত সবে হাঁটতে শিখেছে। এক পা দুপা ফেলে টলোমলো পায়ে দুলে দুলে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে। এইসব নানাকিছু ভাবনা নিয়ে তাড়াতাড়ি করে তারা মসজিদ থেকে বেরিয়ে গেল। প্রত্যেকেই তাদের ঘরে ফেরার জন্য অপেক্ষা করে আছে। কেউ হয়ত সুখের অপেক্ষা করছে। কেউ হয়ত সীমাহীন কষ্ট আর দুর্দশা থেকে নিজেকে মুক্ত করার জন্য অপেক্ষায় আছে।
আশরাফ বসে রইল। গত দুদিন ধরে অনবরত ঝরে পড়া বৃষ্টি তার অন্তরের আগুনকে ঠান্ডা করতে পারেনি। হাড়ের ভেতর ঢুকে পড়া হিমঠান্ডা ওর শক্তিকে বিন্দুমাত্র কমাতে পারেনি। প্রচন্ড ক্ষুধা ওর পেটে ধারালো নখ দিয়ে সারাক্ষণ খুঁচে যাচ্ছে। তবু সে দুর্বল হয়ে পড়েনি। মহান আল্লাহর ঘরের বিশাল দরোজায় অনবরত সে করাঘাত করে যাচ্ছিল। নাহ, একদম ওর নিজের জন্য নয়— ওর তো কুকুরের পেট, সবকিছু খেয়ে হজম করতে পারে, কিন্তু এই বাচ্চারা? সে এই বাচ্চাদের জন্য ন্যায়বিচার চেয়ে আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ জানাতে এসেছে। বাচ্চাদের জীবন বাঁচানোর অধিকার চেয়ে সে লড়াই করতে প্রস্তুত। সে একা দৃঢ় মনে জানতে জানতে চাইলো, যে অপরাধ সে নিজে করেনি, তার জন্য সে কেন শাস্তি পাবে? কিন্তু আল্লাহর ঘরের দরোজা তখনও তার জন্য খোলা হয়নি। তার পাশে বসে থাকা তার সন্তানদের ফ্যাঁকাসে মুখ তাকে আরও দৃঢ় প্রতিজ্ঞ করে তুলেছে। যখন ওর কন্ঠস্বর আর শোনা যাচ্ছিল না, তখন মনে মনে সে একটি চিত্রকল্প তৈরি করছিল।
ওর কোলে ঘুমিয়ে থাকা শিশুটি একটু নড়ে উঠল। আশরাফ ক্রমশ অবশ হয়ে পড়া ওর পা দুখানি সামান্য প্রসারিত করার চেষ্টা করে। তার আঁচল সরিয়ে সে বাচ্চাটির মুখের দিকে তাকিয়ে দেখল। অসুখ বাচ্চাটির মুখখানিকে বিবর্ণ করে ফেলেছে। এই অনুজ্জ্বল নিস্তেজ আলোতে বাচ্চাটিকে দেখতে আরও অসুস্থ লাগছে। তাছাড়া সর্দিতে ওর নাক বন্ধ হয়ে গেছে। নিঃশ্বাস -প্রশ্বাসের ছন্দে যখন বাচ্চাটির বুক উঁচু হয়ে প্রসারিত হয়, তখন পাঁজরের নীচে দুটি অবনমন দেখা যায়। শরীর জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে। আশরাফ বাচ্চাটির দিকে নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকে।
ওর এই বাচ্চাটির নাম মুন্নি। এর জন্মের সাথে সাথে আশরাফের কষ্ট চরম হয়ে ওঠে। প্রথম দুটি মেয়ে জন্মের পরেও ইয়াকুব হতাশ হয়ে গেছিল। কিন্তু তখনও সে বাড়িতে থাকত। ইয়াকুব যে আয়রোজগার করত সেখান থেকে কিছু টাকা জমিয়ে আশরাফ সোনার গয়না করেছিল। শুধু যে তাই, তা নয়। ও দুই আঙ্গুল পুরু রূপার নূপুরও কিনেছিল। এটা পরে হাঁটতে খুব ভালোবাসত। ঝুমুরঝম শব্দ হত আর ও আনন্দে খুশি হয়ে উঠত। কিন্তু তৃতীয় সন্তানটিও কন্যা হয়েছে শুনে ইয়াকুব অদৃশ্য হয়ে গেছে। হাসপাতালের দিকে সে ঘুরেও তাকায়নি। এমনকি বাড়ির ভেতরে একবারের জন্যও পা রাখেনি। বরং সে তার মায়ের কাছে থাকবে বলে চলে গেছে।
আশরাফ বেঁচে থাকার জন্য কুমড়োর পাতা সেদ্ধ করে খেয়েছিল। একই চায়ের গুঁড়ো সে দুই, তিন দিন ধরে ব্যবহার করত। এরকম সারহীন দুর্বল পানীয় পান করে সে নিজের জীবন বাঁচিয়ে রেখেছিল। স্বামীকে বুঝিয়ে শান্ত করার জন্য আর তাকে বাড়িতে ফিরিয়ে আনার জন্য সব রকমের চেষ্টা করেছিল। বাচ্চাটিকে কাঁধে করে বাজারের অটোরিকশা স্ট্যান্ডে গিয়ে ইয়াকুবের পায়ে পর্যন্ত পড়েছিল। অনেক কান্নাকাটি করেছিল। তাদের উপর মায়া করে ফিরে আসার জন্য অনুরোধও করেছিল। এমনকি ‘আল্লাহ তোমাকে ধ্বংস করবেন,’ এই অভিশাপও দিয়েছিল। কিন্তু সব প্রচেষ্টাই ব্যর্থ হয়েছিল।
যখন আর কোন উপায় দেখতে পেল না, তখন সে জুলেখা বেগমের বাড়িতে কাজ যেতে শুরু করল। ঘরের কাজ তার কাছে বোঝা মনে হচ্ছিল না। কিন্তু কিছু করার থাকুক বা না থাকুক, তাকে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত সেখানে থাকতে হত। জুলেখা বেগমের স্বামী কোন এক অফিসে কাজ করত। কলেজ পড়ুয়া দুটি সন্তান ছিল তাদের। জুলেখা বেগম সারাদিন বসে কোন না কোন বই পড়ত ।
একবার জুলেখা বেগম বই থেকে মাথা তুলে আশরাফকে জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘আচ্ছা তোমার স্বামী কী কাজ করে ?’
‘সে অটোরিকশা চালায়, আপা।’
‘তবে তো তার উপার্জনে সংসার ভালোভাবে চালানোর জন্য যথেষ্ট, তাই না?’
‘যথেষ্ট ছিল আপা।’ আশরাফ সেভাবে উত্তর দেয় না। ওর সমস্ত চিন্তা শিশু মুন্নিকে ঘিরে ঘুরপাক খাচ্ছিল। যাকে সে বড় মেয়ে হাসিনার দায়িত্বে বাড়িতে রেখে এসেছে। স্তন থেকে দুধ ঝরে তার ব্লাউজের সামনের অংশটুকু ভিজে যাচ্ছিল। ‘বাচ্চাটির নিশ্চয় খিদে পেয়ে গেছে’ এটা ভেবে মনে মনে সে কেঁদে ফেলে।
‘যদি যথেষ্ট ছিল —তাহলে তুমি কেন এখানে কাজ করতে এসেছ আশরাফ ?’ এবার আশরাফের কাছ থেকে সবকিছু শুনে জুলেখা বেগম অবাক হয়ে গেল। আজকের দিনে, এই যুগে, এখনও কি করে মানুষ এমন থাকতে পারে— জুলেখা বেগম ভাবতেও পারে না।
‘ আচ্ছা আশরাফ, তুমি কি জানো, কারও ঘরে কন্যা সন্তানের জন্ম হলে এটা ধরে নেওয়া হয়, নবীজী নিজে খুশি হয়ে সেই ঘরকে সালাম জানাচ্ছেন?’ ‘ অহ, আপা এসব ভালো কথা বাদ দেন । আমার মতো গরীবগুর্বোদের ঘরে কতবার নবীর সালাম পড়া উচিত বলুন তো আপা।’
‘ আচ্ছা পাগল তুমি ! শোন, নবীজীর শুধুই কন্যাসন্তান ছিল। যদিও একটি পুত্র সন্তান জন্মেছিল। কিন্তু শিশু অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। তুমি কি জানো যে, নবীজী তার কন্যাদের কত ভালবাসতেন? কিছু জানো এ ব্যাপারে? ছোট কন্যা বিবি ফাতিমা ছিলেন নবীজীর প্রাণ। বাবা এবং কন্যাসন্তানের মধ্যে যে গভীর বন্ধন থাকে – তার জীবন্ত প্রমাণ ছিলেন তারা’—আশরাফ জুলেখা বেগমের একটি কথাও বুঝতে পারল না। ওর মন তখন মুন্নির চিন্তায় আচ্ছন্ন ছিল। অবশেষে জুলেখা বেগম যখন বললেন, ‘এটা সম্পূর্ণ অবিচার হয়েছে। তুমি মসজিদে কেন দরখাস্ত করছ না?’
’আরে তাইতো, আমি কেন এটা ভাবিনি?’ আশরাফ লাফিয়ে ওঠে কেঁদে ফেললো,‘ আপা,দয়া করে আমাকে একটা দরখাস্ত লিখে দেন।’
আশরাফ মোতাওয়াল্লি সাহেবের বাড়িতে চার – পাঁচবার দরখাস্ত নিয়ে গেলেও তাঁর সাথে দেখা করতে পারেনি। এরপর একদিন মোতাওয়াল্লি সাহেব যখন রাস্তায় হাঁটছেন, ঠিক সে সময় দৌঁড়ে গিয়ে সে তাঁর হাতে দরখাস্তটি ধরিয়ে দিয়েছিল। উদাসীনভাবে কাগজের টুকরোটি কোটের পকেটে ঢুকিয়ে মোতাওয়াল্লি সাহেব আবার হাঁটতে শুরু করেছিলেন।
সেই সকালে রাস্তার ধারের পাবলিক ট্যাপে পানি সরবরাহ চালু ছিল। লাঠি ঝাড়ু নিয়ে হানিফা চিক্কাম্মা অর্ধেক রাস্তা ঝাড়ু দিচ্ছিল। মোতাওয়াল্লি সাহেবকে দেখে দ্রুত একটি মোটা দেওয়ালের আড়ালে সে নিজেকে লুকিয়ে ফেলল। রাফিয়া পানি নেওয়ার জন্য ট্যাপের কলের নীচে পাত্র রাখতে এসেছিল। হানিফা চিক্কাম্মাকে ‘শশশ’ ইশারা করতে দেখে তাড়াহুড়োয় ঘরে ফিরতে গিয়ে পানির পাত্রটি তার হাত থেকে পড়ে যায়। যে সমস্ত মহিলা বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত ছিল, তারা দ্রুত তাঁর দৃষ্টির আড়ালে চলে গেছিল। তার আদেশ সম্মানের সাথে পালিত হচ্ছে দেখে তিনি সন্তুষ্ট অনুভব করেন। তবে মহল্লার আর কোন মহিলা তাকে দেখে ভয় না পেয়ে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে কিনা সেটা চোখের কোণ দিয়ে পরীক্ষা করে দেখে মুতাওয়াল্লি সাহেব গম্ভীর মুখে হেঁটে চলে গেছিলেন।
এদিকে দরখাস্ত দেওয়ার পনেরো দিন পেরিয়ে গেছে। কিন্তু তাকে ডেকে পাঠাচ্ছে না দেখে আশরাফ বাধ্য হয়ে মোতাওয়াল্লি সাহেবের বাড়িতে চলে আসে। যথারীতি তিনি বাড়িতে ছিলেন না। আশরাফও অপেক্ষা করতে থাকে। সে বসে থাকে। বসেই থাকে। সে সময় আমিনা ওকে জিজ্ঞাসা করে, ‘ওরা যে বলে, গর্ভধারণ বন্ধ করতে যে নারীরা অপারেশন করবে তারা জান্নাতে যেতে পারবে না? আশরাফ, তুমি কি জানো এটা সত্য কিনা’
‘সেটা আবার কি আম্মা ! আমি তো আসলে এসব সম্পর্কে কিছুই আমি জানিনা আম্মা। জুলেখা আপাকে জিজ্ঞাসা করে জানতে হবে। তিনি সবসময় মোটা মোটা বই পড়েন।’
আমিনা ওর খুব কাছে এসে গোপন কথা বলার মতো করে, ফিসফিস করে বলল, ‘তাই যদি হয়, তাহলে তুমি কি তার কাছ থেকে জেনে আসতে পারবে ? পরের বার যখন এখানে আসবে তখন আমাকে জানাবে?’
‘ঠিক আছে আম্মা। জানেন, তিনি যে আরও কত কিছু নিয়ে কথা বলেন! কিন্তু আমি তো বোকা। আমি কি জুলেখা আপার সব কথা বুঝতে পারব?’ আশরাফের কথা শেষ হওয়ার আগেই মোতাওয়াল্লি সাহেব ভেতরে এলেন। তাঁর মুখ রাগে গনগন করছে।
আশরাফকে দেখে তিনি বললেন, ‘ অহ, তোমার দরখাস্তটা কিভাবে কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। তুমি যদি চাও আরেকটা দরখাস্ত দিতে পার’ বলে তিনি ঘরের ভেতর চলে গেলেন। ‘ আমি যদি চাই— ওহো, না, আমি চাই না— আমার জন্য তো একদমই চাই না— আমি তো স্বামীকেও চাই না— কিন্তু আমার সন্তানরা — ওদের যে খাবার দরকার—ওরা যে বড্ড ক্ষুধার্ত থাকে–’
আশরাফের পাহাড় প্রমাণ সমস্যার মধ্যেও মুন্নি খুব সুস্বাস্থ্যবতী একটি শিশু থাকলেও ক্রমশ ওর ওজন কমতে শুরু করেছে। সেই সাথে খুব দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। পেট ফুলে, হাতপা সরু কাঠির মতো হয়ে গেছে। সর্দিকাশিতে সবসময় নাক ভরে থাকে। দিনরাত কান্নাকাটি করে। তবুও মা আশরাফ কখনও বাচ্চাটিকে ঝামেলা বা বোঝা মনে করে না। মুন্নিকে সে বড় দুই মেয়ের চাইতে বেশি আদর, স্নেহ, ভালোবাসা আর খাবার দেওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু মুন্নির সবচেয়ে বেশি দরকার, চিকিৎসা এবং ওষুধের। এর জন্য টাকা দরকার। কোথায় পাবে সে এতগুলো টাকা ? ইঞ্জেকশন, বড়ি, শক্তিবর্ধক টনিক, খাবার, ডাক্তারের ফি, তাছাড়া ডাক্তারের কাছে যাওয়ার জন্য তাকে দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়। মাঝে মাঝে যে ট্যাবলেটগুলো মুন্নিকে খাওয়াতে পেরেছিল, সেগুলো কোন কাজে আসেনি। মুন্নি বরং দিনকে দিন আরও অসুস্থ হয়ে পড়ছে।
এরমধ্যে জুলেখা বেগমকে আরেকটি দরখাস্ত লিখে দিতে অনুরোধ করে আশরাফ। চার পাঁচবার সে মোতাওয়াল্লি সাহেবের দয়া ভিক্ষা করতে তাঁর সাথে দেখা করতে তাঁর বাড়িতেও গেছে। সে সময় একটি গুজব শুনতে পায়, যা ওর অন্তরের গভীরে দাউদাউ করে জ্বলা আগুনকে নিভিয়ে দেয়। গুজবটি হলোঃ ‘ ইয়াকুব এ শহরে নেই। সে এখান থেকে চলে গেছে।’
আশরাফ খুব কষ্ট পেয়েছিল গুজবটি শুনে। ‘ সে কি পুরুষ নয়? সে এখানে বা যেখানেই থাকুক না কেন, সে কী দায়িত্ব পালন করে? সে কি তাদের অবহেলা করে না? কেন করে— এসব প্রশ্ন এখন কে তাকে জিজ্ঞাসা করবে ? কার কাছে সে জবাবদিহি করবে? সে একজন ল্যাঙ্গোটি ইয়ার, সবচে বড় কথা, সে একজন পুরুষ, সকলের সেরা বন্ধু। তার অতীত লোক সম্মুখে নেচে উঠে না, আর বর্তমান যেমন তাকে স্পর্শ করে না, তেমনি ভবিষ্যৎ তাকে কোন ইঙ্গিত দেয় না বা প্রশ্ন করে না। তাকে কখনও কোন লজ্জিত বিব্রত ছায়ায় থাকতে হয় না। তার সুবিধা হচ্ছে, তাকে বলতে হয় না, সে কার। এমনকি তার কৃতকর্মের জন্য তাকে কখনও ক্ষমাও চাইতে হয় না। কারণ সে যা করে তা কখনই ভুল বলে প্রমাণিত হয় না।
আশরাফ বড় দুঃখ যন্ত্রণায় ছিল, ওর কোলে অসুস্থ মুন্নি ক্রমশ দুর্বল হয়ে গলেমিশে যাচ্ছিল। ফলে মমতায় সিক্ত ওর হৃদয়ের আরও গভীরে চলে আসে বাচ্চাটি। কিন্তু অসুস্থ বাচ্চার জন্য কেবল মায়ের ভালোবাসা যথেষ্ট না। তার দরকার উপযুক্ত চিকিৎসা, সেবাযত্ন। দেখা গেল ছয়মাসের মধ্যে মাংস ক্ষয়ে গিয়ে চামড়ার নীচে মুন্নির হাড় জেগে উঠেছে।
ঠিক তখুনি, ডুবন্ত মানুষের খুড়কুটো ধরে বাঁচার মতো করে, আশরাফ শুনতে পেল, ইয়াকুব ফিরে এসেছে। সে অটোস্ট্যান্ডের দিকে ছুটে গেল। কিন্তু ইয়াকুব ওকে দেখতে পেয়েই পালিয়ে গেল। পরের বার আশরাফ বুদ্ধি করে, মেয়েদের নিয়ে ইয়াকুবের অটোর পেছন দিক দিয়ে এসে অটোর ভেতর বসে পড়ল। কোন কথা না বলে ইয়াকুব অটো চালাতে শুরু করল। একসময় তাদের ছোট্ট ঘরের সামনে এসে অটো থামিয়ে বলল, ‘একটি মেয়ে বাহিনী নিয়ে তুই কুকুরের মতো ঘুরে বেড়াচ্ছিস। অন্তত একটু ভদ্রতা শিখে নিস।‘ এরপর থুথু ফেলে মেয়েদের হ্যাঁচকা টানে মাটিতে ফেলে দিল। ঠিক অই সময়েই আশরাফ অটো থেকে বেরিয়ে আসতেই ইয়াকুব বিভ্রান্ত আশারাফকে পেছনে রেখে ‘ব্রারর ব্রারর’ শব্দ তুলে অটো স্টার্ট দিয়ে চলে গেল।
অশ্রুসিক্ত ভয়ার্ত শিশুদের শক্ত করে বুকে জড়িয়ে ধরল আশরাফ ।
আর কোন পথ নেই। আশরাফ কোন একটি উপায় পাওয়ার জন্য মসজিদ কমিটি এবং মোতাওয়াল্লি সাহেবের কাছে ডজন ডজন দরখাস্ত দিতে থাকল। সে শুধু তাদের কাছে বিনীত অনুরোধ করল, ইয়াকুব যেন তার অসুস্থ সন্তানের চিকিৎসার জন্য কিছু টাকা অন্তত জোগাড় করে দেয়। এর বিপরীতে কেবলই উত্তর ছিল, পরে এসো, আবার এসো, অন্য একদিন এসো, চলে যাও। এইসব ঘটনার মাঝে আরেকটি গুজব শোনা যেতে লাগল, ইয়াকুব আবার বিয়ে করতে চলেছে। তার একটি ছেলেসন্তান লাগবেই লাগবে। এজন্য যে, তার মৃত্যুর পর এই অটোরিকশাটি চালানোর জন্য একজন উত্তরাধিকার চাই-ই চাই ।
যে আশাটুকু বুকে নিয়ে আশরাফ ছুটে বেড়াচ্ছিল, তা ওর চোখের সামনে ভেঙ্গেচুরে পড়ল। সারারাত সে কান্নাকাটি করেছে। সকাল হলে আবার মোতাওয়াল্লি সাহেবের বাড়ির দরোজায় গিয়ে বসে রইল। সকাল নয়টার দিকে মোতাওয়াল্লি সাহেবের ঘুম ভাঙলে তিনি হাই তুলতে তুলতে বেরিয়ে এসে ওকে দেখে একরাশ বিরক্তি নিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কি ব্যাপার,তুমি যে এখানে?’
আশরাফ তার অভিযোগগুলো বিশদভাবে মোতাওয়াল্লি সাহেবকে জানাল। তিনি গলা খাঁকারি দিয়ে সজোরে মাটিতে থুথু ফেলে বললেন, ‘ তা এখন সে এমন কী নিষিদ্ধ কাজ করেছে শুনি? আরেকটা বিয়ে করেছে এই তো তোমার অভিযোগ, তাই না? তো সে কি কারও সাথে পালিয়ে গেছে? তা তো যায়নি। তবে? তাকে বাঁধা না দিয়ে তার ইচ্ছেমতো এগুলো করতে দাও। তুমি কি জানো না, শরিয়া আইনে একজন পুরুষ চার চারটে নারীকে বিয়ে করতে পারে? এত কেন হিংসা করছ তুমি? আসলে তোমরা মহিলারা সবাই এরকম, যুক্তি বোঝ না, খালি হিংসা করতে জানো,’ চোখের কোণ দিয়ে ছোট বাচ্চাটিকে বুকের দুধ খাওয়ানো আমিনাকে দেখে মোতাওয়াল্লি সাহেব ইচ্ছে তাকে শুনিয়ে কথাগুলো বললেন। আর আমিনা তখন ভাবছিল, ‘এই পুরুষদের গলায় দড়ি! ছিঃ ঘেন্না!’ ওর মনের মধ্যে একটি গভীর পেরেক গেঁথে গেল। বুঝতে পারল, হয়ত সেদিন আর বেশি দূরে নয়, হয়ত তার সন্তানদেরকেও সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে বেচারি আশরাফের মতো ওকেও এভাবে ভিক্ষা করতে হবে।
খুবই সংকুচিত ক্ষীণ কন্ঠে আশরাফ জানালো, ‘ সে একবার নয়—হাজারবার বিয়ে করতে চাইলে করুক, আমি হিংসা করছি না। সে খুশি থাকলে আমার জন্য এটাই যথেষ্ট। আমি তাকে ঝামেলায় ফেলব না। কিন্তু মোতাওয়াল্লি সাহেব, এই নিষ্পাপ ছোট্ট শিশুটি যে মরতে চলেছে। ওষুধ পথ্যের কিছু একটা যদি —’
আশরাফের কথার মাঝখানেই তাকে থামিয়ে মোতাওয়াল্লি সাহেব বললেন, ‘ দেখো নির্বোধের মতো যা ইচ্ছে তাই বলো না। আমাদের মরণ বাঁচন, জীবন, আয়ু সবই আল্লাহ রব্বুল আল’আমিনের হাতে। তুমি কি জানো না, কিছু মানুষের মাথার উপর পাথর ভেঙ্গে পড়লেও সেই আঘাতে তাদের মৃত্যু হয় না। কারণ কি জানো? একমাত্র আল্লাহর ইচ্ছা এই যে তারা বেঁচে থাকুক। ঠিক তেমনি, আল্লাহ মেহেরবান, যদি এই শিশুটিকে বাঁচিয়ে রাখতে ইচ্ছা করেন, তো শিশুটি বাঁচবে। যদি করুণাময় আল্লাহর ইচ্ছা না হয়, তবে শিশুটি মারা যাবে। এর জন্যে তুমি কেন ইয়াকুবকে কষ্ট দিবে?’
মোতাওয়াল্লির এ ধরণের প্রশ্নবাণে আশরাফ বোবা হয়ে গেল। এটা সত্যি! নিজেকে ও অনেকবার সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করেছে, বারবার প্রবোধ দিয়েছে, এই যে ওর জীবনে যা কিছু ঘটছে, সবকিছু আল্লাহর ইচ্ছাতেই ঘটছে। কিন্তু শিশুটির অবিরাম দাস্থ্য হচ্ছে, ওর অসুস্থ মুখের দিকে তাকিয়ে সমস্ত দায়দায়িত্ব আল্লাহর উপর ছেড়ে দিয়ে সে চুপ করে বসে থাকতে পারছিল না। সে যে মা! আর কার কাছেই বা সে অভিযোগ জানাতে পারত? ইয়াকুব তো আবার বিয়ে করে তার নতুন বউয়ের গ্রামে চলে গেছে। তবে?
এরপর একদিন আশরাফের সঙ্গে যখন ইয়াকুবের দেখা হল, তখন তার নোখে মেহেন্দির রঙ আঁকা ছিল। বাম হাতের কব্জিতে চকচক করছিল একটি নতুন ঘড়ি। নতুন জুতা পায়ে অটোর পাশে দাঁড়িয়ে খুবই স্টাইল মেরে ইয়াকুব চুল আঁচড়াচ্ছিল। একেবারে অচেনা লোকের মতো লাগছিল দেখতে। নিজের সাজগোজে মগ্ন ইয়াকুব, আশরাফকে দেখে, যেন কোন ভিখারিকে দিচ্ছে এভাবে দশ টাকার একটি নোট ওর হাতে গুঁজে দিয়ে দ্রুত অটো চালিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল।
ইয়াকুবের এই আচরণে আশরাফ পাথর হয়ে গেলেও মুন্নির জীবন-মৃত্যুর প্রশ্ন ওকে আরও দৃঢ় ও স্থির করে তুলেছিল। সব শুনে জুলেখা বেগম বই থেকে মাথা তুলে বলল, ‘ দেখো, যে কোন পুরুষের চারটা বিয়ে করতে হলে কতগুলো যুক্তিসংগত কারণ থাকতে হবে। যেমন ধরো, যুদ্ধে যদি অনেক পুরুষ মারা যায়, তাহলে একজন পুরুষ একাধিক বিয়ে করতে পারে। যদি দীর্ঘদিন ধরে স্ত্রী কঠিনভাবে অসুস্থ থাকে অথবা ধরো, স্ত্রীর যদি সন্তান না হয়, তবে স্বামী আবার বিয়ে করতে পারে। কিম্বা ধরো, স্বামী যদি স্ত্রীর কাছ থেকে সন্তুষ্টি না পায় — ’ বাক্যটি তিনি শেষ করতে পারলেন না তার আগেই আশরাফ দুর্দমনীয় রাগে ফেটে পড়ে বলল, ‘ আমি এইসব শ্রেণীর কোনোটির মধ্যে পড়ি না। আমার কি সন্তান নেই ? আছে। সে যে আমাকে ছেড়ে চলে গেছে এটা কী ভুল নয়? আমার সন্তানদের নিঃস্ব করে দিয়ে চলে গেছে এটা অন্যায় নয়?’
‘ দেখো আশরাফ, যদি ইয়াকুব শরিয়া আইন মেনে আবার বিয়ে করে, তবে তাকে নিশ্চিত করতে হবে যে, শরিয়া আইন অনুযায়ী সে দুই স্ত্রীর মধ্যে বিন্দুমাত্র পার্থক্য করবে না এবং দুই স্ত্রীর সাথেই তাকে সমান আচরণ করতে হবে। ’
আশরাফ বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যায়, হয়, ‘ এর মানে কি আপা—এটা কিভাবে সম্ভব?’
‘ এর মানে, সে যদি তোমার জন্য একটি ঘর বানিয়ে দেয় তো, অন্য স্ত্রীর জন্যেও একই রকমের ঘর বানিয়ে দিতে হবে। তোমাকে যে রকম শাড়ি দিবে, ঠিক সেরকম শাড়ি সেই স্ত্রীকেও দিতে হবে। আরও আছে, যদি সে একরাত তোমার সঙ্গে থাকে, তবে তার সাথেও একরাত কাটাতে হবে।’
আশরাফের চোখ ছলছল করে উঠে, ‘ আপা গো, আমি ওসবের কিচ্ছু চাইনা। সে যদি শুধু আমার সন্তানদের জন্য কিছু টাকা খরচ করে, যদি এই বাচ্চাটির জীবন বাঁচাতে সাহায্য করে, আমি আর তার দিকে কোনদিন ফিরে তাকাবো না। কিছুই চাইবো না। তবে আপা, সে এখন যা করছে সেগুলো তো ভুল, একদম সঠিক নয়, তাইনা?’
‘ একদম তাই। একশ ভাগ ভুল করছে। এক্ষেত্রে এটা তার দোষ।’
‘ তাইলে আপা, মুতাওয়াল্লি সাহেব কেন এই সত্যিগুলো বলেন না?’
‘ দেখো আশরাফ, কি আর বলব বল! আমাদের সবচে বড় সমস্যা বা ব্যর্থতা তো এখানেই। আমাদের অনেক মোতাওয়াল্লি সত্যিকারভাবে নিজেরাই আইন জানে না, জানতে চায় না। দ্বিতীয় কথা হচ্ছে, এদের তো আইন প্রয়োগ করার ক্ষমতা নেই, তিন, এদের কথা কেউ কানেই তোলে না। তাছাড়া সবাই শুধু আইনের সেই অংশগুলো মেনে নেয়, যেগুলোতে তাদের নিজেদের সব রকমের সুযোগ সুবিধা হয়। আসলে এই শরিয়া আইনগুলো কোথায় আছে জানো? তোমাদের মতো হতদরিদ্র, অসহায়দের নারীদের কোলে কোলে। এই মুন্নিসোনাদের মতো।’
‘আপা গো, এ সমস্যার কি কোন ওষুধ আছে গো আপা ?’
‘আছে তো ! কেন থাকবে না বোন। আমাদের জামাতে জ্ঞানীগুণী পণ্ডিতরা নারীদের অধিকার সম্পর্কে কিছুই বলেন না। কেন জানো? কারণ, তারা নারীদের নিজের করায়ত্তে রেখে নিজেদের গণ্ডীতে আটকে রাখতে চায়। এই যে পৃথিবীটা দেখছ, এটা এমন একটা পর্যায়ে পৌঁছে গেছে যেখানে সবাই বলছে, নারী আর কন্যাশিশুদের জন্য মঙ্গলময় কিছু করা দরকার। কিন্তু আমাদের এই পণ্ডিতরা পবিত্র কুরআন আর হাদিস নিজেদের আয়ত্তে নিয়ে নিয়েছে। অথচ, এই বইগুলোতে যা অনুসরণ করতে বলা হয়েছে, সেরকম আচার আচরণ তো তাদের করা উচিত! তাদের উচিত মেয়েদেরকেও লেখাপড়া করার ব্যবস্থা করা। তবে শুধু মাদ্রাসায় পড়ালে হবে না। ইশকুল কলেজেও তাদের পড়তে দিতে হবে। স্ত্রী পছন্দ করার অধিকার স্বামীর আছে। কেন মেয়েদের পছন্দের মূল্য নেই! আমাদের ধর্মে মেয়েদেরকেও পছন্দ করার অধিকার দিয়েছে। এই অধিকার নারীদের দিতে হবে। এই অসভ্য কাপুরুষদের জানা দরকার, যৌতুক নিয়ে উচ্ছিষ্ট চেটে খাওয়ার চাইতে ধর্মীয় বিধান অনুযায়ী মোহরানা দিয়ে বিয়ে করার বিধান রয়েছে। একজন কন্যাসন্তানকে তার বাবামায়ের পরিবার থেকে সম্পত্তি দেওয়ারও বিধান রয়েছে। স্বামী স্ত্রীর মনের মিল না হয়ে যদি ঝগড়া ফ্যাসাদ সংঘাত হয় তবে যেন নারীর তালাক দেওয়ার অধিকারকে সম্মানের সঙ্গে মান্যতা দেওয়া হয়। যদি কোন নারীর তালাক হয়ে যায়, তবে কোন পুরুষ যেন নির্দ্বিধায় বিয়ে করতে এগিয়ে আসে। এমনকি কোন বিধবা নারীর জন্য উপযুক্ত সঙ্গী খুঁজে দিয়ে নতুন করে জীবন শুরু করতে আবার বিয়ে দেওয়ার বা করার বিধান দেওয়া আছে।’
আশরাফ প্রায় জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে এভাবে আর্ত স্বরে ডেকে উঠলো,’আপা, আপা, আপনি এসব কি বলছেন গো আপা। সত্যি এইসব বিধান আছে নারীদের জন্য?’
‘হ্যাঁ আশরাফ, আমি যা বলছি ঠিক বলছি। ইসলামে নারীদের জন্য এই সবকিছুর অধিকার রয়েছে। একজন মেয়ে অনায়াসে ইশকুলে যেতে পারে, দোকান ঘাটে বাজার সদাই করতে পারবে, এমনকি সে কাজেও যেতে পারবে। এর মানে সে বাড়ির বাইরেও জীবনযাপন করতে পারবে। তবে একটি নিয়ম আছে, তা হলো নারী তার শরীর এবং সৌন্দর্য খোলামেলাভাবে প্রদর্শন করতে পারবে না—’ জুলেখা বেগম আবেগতাড়িত হয়ে প্রায় একটি বক্তৃতাই দিয়ে ফেলল।
আশরাফ আসলে এগুলোর কিছুই চাইছিল না। বড় হতাশ হয়ে সে মাথা নাড়ল, ‘ আমি আমার মুন্নির জন্য কি চাইব আপা?’
‘ তুমি কী চাইবে ? কেন তোমার আর তোমার সন্তানদের খাওয়াপরার খরচ, থাকার জন্য একটি ঘর আর পালা করে তোমার সাথে রাতে থাকার দাবী জানাবে। এগুলো তোমার অধিকার। নিয়ম অনুসারে তাকে এগুলো তোমাকে দিতে হবে। যদি সে দিতে অস্বীকার করে তাহলে লোকজনের সামনে তার কলার ধরে দাবী করো আশরাফ। দরকার হলে তোমার পা থেকে জুতা খুলে হাতে নাও। এটা দিয়ে মোত্তাওয়াল্লিকে মেরে তোমার দাবি আদায়ের জন্য জিদ কর। ভিক্ষা চেও না আশরাফ, তুমি ন্যায়বিচার দাবী করো। তুমি কি জানো, যারা ন্যায়বিচার দাবি করে তারাই ন্যায় পায়। তোমার মতো অসহায় নারীরা ন্যায়বিচার না চাইলে কখনও পাবে না। তুমি আবার মসজিদে দরখাস্ত দাও, পঞ্চায়েত জড়ো করো আর সেই সাথে আমাকেও ডেকে নিও। আমি তোমার স্বামী লোকটিকে আর মোতাওয়াল্লি সাহেবকে শরিয়া আইন কি, ন্যায়বিচার কি সে সম্পর্কে জানিয়ে দেব। একজন প্রতারিত, অসহায় নারীর সাথে চালাকি করে তাদের ইচ্ছামতো কুরআন হাদিসকে বিকৃত করে ব্যাখ্যা দেওয়া ন্যায়বিচার নয়।’
জুলেখা বেগমের এমন বক্তব্য শুনে বেচারী আশারাফ ভয় পেয়ে গেল। ভয়ে ওর হাত পা পেটের মধ্যে সেঁধিয়ে গেল। ওর নিজের একটি পেটের প্রশ্ন হলে এইসব ঝুট ঝামেলার ভিতর ও যেত না। ‘জীবন দিয়েছেন যিনি, আহার যোগাবেন তিনি। অন্তত দুমুঠো ঘাস হলেও তিনি খেতে দেবেন, এমন সরল বিশ্বাসে আমি চুপ করে থাকতে পারতাম, কিন্তু এই মুন্নি—’
আশরাফ দ্বিধা ঝেড়ে প্রতিজ্ঞায় দৃঢ় হল। ইয়াকুবের কাছে ভিক্ষা না চেয়ে ও ন্যায়বিচার পাওয়ার জন্য স্থির সিদ্ধান্তে অটল হল। মুন্নি ওর কোলের ভিতর নড়ছিল। মেয়েটির নিঃশ্বাস ধীর তালে পড়ছিল। বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছিল কপালে। ঘাড় ভিজে গেছে ঘামে। আশারাফ পরনের শাড়ি দিয়ে সন্তানের ঘাড়, বগলের নীচ ভালো করে মুছে দিল। মুন্নির গায়ে হাত দিয়ে বুঝতে পারল জ্বর কিছুটা কমে আসছে। অই যন্ত্রণাক্ত বিষময় সময়ে বাচ্চাটির জ্বর কমেছে বলে কিছুটা শান্তি লাগছিল ওর মনে। কিছুক্ষণ আগেও ক্ষুধা লেগেছে বলে হাসিনা কান্নাকাটি করছিল। মসজিদের আবছা আলোয় হাসিনাকে খুঁজে না পেয়ে ওর হৃদস্পন্দন প্রায় বন্ধ হয়ে গেছিল। পরে দেখে, মেঝের ঠান্ডা সহ্য করতে না পেরে মেয়েটি লাশ বহন করার খাটিয়ায় পাতা একটি মাদুরের ভিতর হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকে অর্ধেক শরীর অই মাদুরে জড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। মেজ মেয়ে হাবিবা ওর কোল ঘেঁষে মেঝেতেই কুঁকড়ে মুকড়ে ছিল।
মসজিদের বারান্দা থেকে ঠিকরে আসা সবুজ আলো এক অসীম নিস্তব্ধ পরিবেশের সৃষ্টি করছিল। বাইরে প্রবল বৃষ্টি আর ঠান্ডা হাওয়া বইছিল বলে লোকজন ছিল না। আশরাফ মসজিদের পবিত্রতম পরিবেশেও অন্যরকমের আতঙ্ক অনুভব করছিল। বেলা কত বাজে সেই সময়ও জানতে পারছিল না বেচারি। বাইরের জগতের সবরকমের কাজকর্ম ব্যস্ততা এতক্ষনে নিশ্চয় শেষ গেছে ভেবে ওর ভয় লাগতে শুরু করে। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত মুসলিমরা পরম করুণাময় আল্লাহর নামের ধ্বনি তুলছিল। বৃষ্টি, ঠান্ডা বাতাস, ম্লান সবুজ আলো, লোকজনহীন পরিবেশে অসহায় আশরাফকে ঘিরে এমন পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছিল, যা দেখে আল্লাহ রব্বুলের হৃদয় করুণায় কেঁপে উঠত। এসময় মুন্নির জন্য একটু উত্তাপের দরকার ছিল। অন্য দুটি সন্তানের গায়েও শীত প্রতিরোধের জন্য যথেষ্ট পোশাকও ছিল না। এসব ভাবনা ওর হৃদয়কে হাজার হাজার কাঁচি দিয়ে কেঁচে দিচ্ছিল। গভীর দীর্ঘশ্বাসের সাথে অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে ভেসে এলোঃ ‘ ইয়া আল্লাহ রাব্বুল আলামীন।’ আল্লাহ কোন উত্তর দিলেন না। এতক্ষণ ওর কোন ক্ষুধাবোধ ছিল না। বেশ উষ্ণ এবং শান্ত ছিল ওর পেট। এখন মনে হচ্ছে পেটের ভিতর যেন হিমশীতল বরফের গোলাক ঘুরে বেড়াচ্ছে। ওর রক্ত শীতল হয়ে গেল; নড়াচড়া করতে না পেরে ওর শরীরের শিরা-উপশিরাগুলোও বরফের মতো জমাট বেঁধে গেছে। এমন ভয়াবহ সঙ্গীন অবস্থায় ওকে যে কেউ ডাকছে, এটা প্রথমে আশরাফ বুঝতে পারেনি। অবশেষে বুঝতে পারল, বেশ দূর থেকে আমিনা ওকে ডেকে যাচ্ছে।
মসজিদ প্রাঙ্গনের দেওয়ালের ওপাশে একটি প্লেট হাতে করে দাঁড়িয়ে আছে আমিনা। আশরাফকে সে ডাকছিল, ‘ তাড়াতাড়ি আসো আশরাফ। প্লেটটা নাও–এখানে কিছু রুটি আছে—দ্রুত আসো – শিগগীর ধরো। ’ আশরাফ ধীরে ধীরে বাস্তবে ফিরে আসে। অবিরাম বৃষ্টি ঝরছে, যেন এটাই এই নিষ্ঠুর পৃথিবীর নিয়ম। অন্যদিকে, দূরে রুটি হাতে এক মায়াবতী — আশরাফের শরীরে এক অভূতপূর্ব শক্তি বয়ে গেল। মুন্নিকে বুকের সাথে জড়িয়ে ও উঠে পড়ল। আর ঠিক তক্ষুণি —
ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দ করে মসজিদের গেটটা খুলে গেল। দেখে মনে হচ্ছে, ইয়াকুবকে সঙ্গে নিয়ে মোতাওল্লি সাহেব আনন্দে দুলতে দুলতে ভেতরে আসছেন। তিনি তার পেটে হাত বুলিয়ে তৃপ্তির ঢেকুর তুলছেন। পান খাওয়া লাল ঠোঁট চিপে ‘পিচিক’ শব্দে থুথু ফেলে আস্তে আস্তে মসজিদের সিঁড়ির উপরে উঠে গেলেন। ইয়াকুবও একইভাবে হেঁটে হেঁটে তাকে অনুসরণ করে কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে পড়ল। ‘দেখেছেন, এই মহিলা এখনও চলে যায়নি’ ইয়াকুবের মুখে এরকম অভিব্যক্তি খেলে যাচ্ছিল। ওদিকে দেয়ালের ওপারে রুটি ধরে রাখা আমিনার হাতখানি ধীরে ধীরে পেছনে সরে গেল।
মসজিদের আশেপাশের প্রতিবেশী বেশিরভাগ মানুষ রাতের খাওয়া শেষ করে ফেলেছিল। পুরুষরা দেখছিল টিভি অথবা কেউ কেউ ঘুমিয়ে পড়েছিল। আর মহিলারা কাজ শেষ করার অজুহাত দেখিয়ে বাড়ির শেষপ্রান্ত, যা মসজিদের দেওয়াল লাগোয়া, সেখানে উঁচু কোন কিছুর উপর পা রেখে কিম্বা মসজিদের ভেজা দেওয়ালে হাত চেপে ধরে ভিতরে কী ঘটছে সেটা দেখার চেষ্টা করতে লাগল ।
আশরাফ লড়াই করার জন্য প্রস্তুত হল। এই লড়াইয়ে ওর অণুপ্রেরণা ছোট্ট মুন্নিকে বুকে ধরে ধীরে ধীরে ও পুরুষদের দিকে এগিয়ে গেল। মোতাওল্লি সাহেব বসেছিলেন উপরের সিঁড়িতে। ইয়াকুব তার বাঁদিকে, সিঁড়ির এক ধাপ নীচে দাঁড়িয়েছিল। আশরাফ ওদের ডানদিকে তিন চার ধাপ নীচে এসে দাঁড়িয়েছিল। এখানে ছাদ আছে বলে বৃষ্টির হাত থেকে বেঁচে গেলেও, কনকনে ঠান্ডা ভেজা বাতাসে দাঁড়িয়ে থাকার শক্তিটুকুও হারিয়ে ফেলছিল আশরাফ।
ইয়াকুব রেগে ক্ষ্যাপা ষাঁড় হয়ে গেছে। পারলে তখুনি সে আশরাফকে মেরে রক্তাক্ত করার জন্য ক্ষেপে উঠেছিল। ছাদ থেকে টপটপ করে আশরাফের পিঠে পানি ঝরে পড়ছিল। ওর ভেজা আঁচল থেকেও টুপটুপ করে ঝরছিল পানি। উহ্! এই অঝোর বৃষ্টিও পুরুষদের ভিজিয়ে দিতে দ্বিধা করছে— বৃষ্টির পানি কেমন নরম কোমল, শ্রদ্ধাসম্ভ্রমে ঝরে পড়ছে। নিদারুণ অই মুহূর্তেও এটা ভেবে আশরাফ অবাক হয়ে গেল।
মোতাওল্লি সাহেব কোন কথা বলার আগে কিছুটা ইতস্তত করছিল। কারণ তাঁর মুখে প্রচুর পরিমাণে পানের রস জমে গেছিল। পানের পিক ফেলে এই পবিত্র সিঁড়িগুলো তো তিনি নোংরা করতে পারেন না। সেজন্য হেঁটে প্রাঙ্গনের দেওয়ালের কাছে পিচকারির ফোয়ারার মতো পিক ফেলে সিঁড়ি বেয়ে যখন উপরে উঠতে যাচ্ছিলেন, সে সময় ইয়াকুব আগুনের ফুলকির মতো থুতু ফেলে বলে উঠে, ‘মোতাওল্লি সাহেব এই বেশ্যামাগীটা এখানে কি চায় ?’
সহসা মোতাওল্লি সাহেব সচেতন হয়ে উঠলেন। পানের রস গিলে ফেলেছিলেন বলে সেকেন্ডের মতো তাঁর মাথাটা ঝাঁঝাঁ করে দুলছিল। যদিও তার সাধারণ জ্ঞানটুকু টনটনে ছিল। তিনি বুঝতে পারছিলেন, দেওয়ালের ওপারে অন্ধকারে মিশে নারী আকারের টিকটিকিগুলো বুড়ো আঙ্গুলে ভর দিয়ে সবকিছু দেখছে। তিনি আরও ভালো করে জানতেন, আমিনা নামের একটি বিশেষ টিকটিকি অবশ্যই দেওয়ালের সাথে ঠেসে নিজেকে আটকে রেখে তার দিকে এমন চোখে তাকিয়ে আছে, যেন তাকে পেলে মুহূর্তের মধ্যে গিলে খেয়ে ফেলবে। এইসব নারী টিকটিকিদের জন্য আর নিজের ক্ষমতা দেখানোর জন্য কিছুক্ষণ আগে ইয়াকুব যে তাকে ভাত, পান এবং অন্যান্য দ্রব্যসামগ্রী উপহার দিয়েছিল, তা গলার একপাশে চালান করে তিনি বললেন, ‘ আরে ইয়াকুব, এভাবে কথা বলা তোমার একদম উচিত হচ্ছে না।’
ইয়াকুব অবশ্য কোন কথা শোনার অবস্থায় ছিল না। রাগে জ্বলছিল সে। এই মহিলা তার পুরো জীবন নরক বানিয়ে তুলেছিল। একদম পায়ে লেগে থাকা গুয়ের মতো স্বভাব। এই শয়তান মহিলা তিন তিনটে মেয়ের বোঝা ওর ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে ওকে ধ্বংস করে ফেলেছিল। সে শুধু মুক্তি চেয়েছে। ওর নতুন বউয়ের কোলে সুখ খুঁজে নিয়ে খুব আশা করে আছে,যদি একটি ছেলে সন্তানের জন্ম হয় তবে সেই ছেলে হবে এই অটোরিকশার উত্তরাধিকারী। এই রাক্ষুসি ওকে সবসময় যন্ত্রণা দিয়েছে। ওর সঙ্গী গফুর, ইদ্রিস, নাসির ওদের সবার দুটি করে স্ত্রী আছে। তারা কত মজা উপভোগ করছে। ওদের কারও স্ত্রী তো কোন ঝামেলা করেনি! কোন অভিযোগ না করে তারা বাবামায়ের ঘরে ফিরে গেছে। কেউ আবার কুলিমজুর হয়েছে বা অন্য কোন কাজ করছে। এই কুত্তিমাগী গেল দুই বছর ধরে আমাকে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে চরম বিরক্ত করে এখন দেখি মসজিদের সিঁড়ি পর্যন্ত ধেয়ে উঠে এসেছে। ‘ সে — উহু, তার তো’ ইয়াকুব ঠান্ডার ভিতরেও অসহ্য রাগে জ্বলে উঠল। ‘ অই অই ! রে মাগী ! তুই যে বসে বসে পেশাব করিস,তার জন্য তুই এত দেমাগ দেখাচ্ছিস ! আমাকে দ্যাখ, আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পেশাব করি, তাইলে বুঝে নে তোর চেয়ে আমার কত বেশি অহংকার থাকতে পারে?’ ইয়াকুব অত্যন্ত গর্বিত গলায় চীৎকার করে উঠল।
ইয়াকুবের এমন বকাবাজিতে আশরাফের মুখে কোন কথা ফুটল না। সে একেবারে নিশ্চল স্থবির হয়ে গেল। তাছাড়া জুলেখা বেগম তো তাকে এ ধরণের প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে আগে বলে রাখেনি। এরকম প্রশ্ন আসবে সে ব্যাপারে কল্পনাও করেনি। এক ধরনের বিভ্রান্তিতে মুন্নিকে বুকের সাথে আরও শক্ত করে জাপটে ধরল আশরাফ। ততক্ষণে রাগে ফুঁসতে থাকা ইয়াকুব দ্রুত নেমে এসে শরীরের সমস্ত শক্তি জড়ো করে আশরাফকে লাত্থি মারল। একপাশে ছিটকে পড়ে যাওয়ার সাথে সাথে ওর বুক থেকে মুন্নিও পড়ে গেল। আশরাফ পড়ে গিয়েও মুন্নিকে রক্ষা করতে পারে না। ওর কপাল মেঝেতে লেগে ফেটে গেল আর ওর হাত থেকে ছিটকে উড়ে পড়ে গেল মুন্নি। আশরাফের কাছ থেকে এমন এক ভয়ঙ্কর যন্ত্রণার আর্ত চীৎকার বেরিয়ে এলো যা আগে কখনও কোন মসজিদে শোনা যায়নি। ওর দুটি সন্তান হামিদা আর জানাজার খাটিয়ার ভিতরে ঘুমিয়ে থাকা হাসিনাও ঘুম ভেঙ্গে জেগে উঠল। হয়ত যে সকল অসংখ্য মৃতদেহ গলে মাটিতে মিশে যাওয়ার অপেক্ষা করছিল, তারাও জেগে উঠেছিল। আশরাফ অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকে মাটিতে।
মোতাওল্লি সাহেব ঘটনা দেখে হতবাক হয়ে গেলেন। তার নেশা কেটে গেল। সেই মুহুর্তে অন্ধকারের অবগুন্ঠন ভেদ করে, হিম ঠান্ডা বাতাস আর বৃষ্টিকে অতিক্রম করে, পায়ে লেগে থাকা কাদা ঝেড়ে ফেলে মাথা ঢাকা অসংখ্য মহিলা ছুটে আসে। এরা কোথায় ছিল, এরা কারা, কোথা থেকে এসেছে এই মহিলাদল— এদের মধ্যে কি আমিনাও আছে? এদের কেউ আশরাফকে উপরে তুলে আনল। অন্যেরা মুন্নির দিকে এগিয়ে গেল। মুন্নির জ্বর একেবারে ছেড়ে গেছে, ওর নিঃশ্বাস আর খিঁচুনি চিরদিনের জন্য বন্ধ হয়ে গেছে। আর কোন কষ্ট নেই বাচ্চাটির। এই পৃথিবীর সব যন্ত্রণা থেকে মুক্ত হয়ে গেছে। মুন্নির দুঃখ,কষ্ট আর যন্ত্রণার ছোট্ট জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটেছে। বাচ্চাটি এতদিন বেঁচে থাকার জন্য লড়ে যাচ্ছিল। এবার মৃত্যুর কালো চাদরের কোলে লুটিয়ে পড়ল।
মোতাওল্লি সাহেব নড়াচড়ার শক্তি হারিয়ে স্থানুর মতো বসে রইলেন। হানিফা চিকাম্মা এসে আশরাফ আর তার মেয়েদের নিয়ে তার বাড়িতে চলে গেলেন। মুন্নির মৃতদেহ মসজিদেই থাকল। রাতের অন্ধকারকে চমকে দিয়ে মসজিদের সমস্ত আলো জ্বলে উঠল। পেছনের অংশে পানি গরম হয়ে ফুটে উঠলো আর ধীরে ধীরে ঘুম ভাঙ্গা মানুষরা বেরিয়ে এলো। কাপড়ের দোকানের মালিক মতিন সাহেব কোন কথা না বলে দোকান খুলে মুন্নির কাফনের জন্য লাল কাপড় নিয়ে এলেন। গোসল করিয়ে, শরীরে আতর আর আবির লেপে, লাল কাপড়ের কাফনে জড়িয়ে সবাই কাঁদতে কাঁদতে মুন্নিকে গোরস্তানে নিয়ে গেল।
গোরস্তানে এসে আশরাফ মুন্নিকে জড়িয়ে ধরে আকুলভাবে কেঁদে উঠল। কিন্তু ওর হৃদয়ের গভীর গহনে কোথায় যেন শান্তি নেমে আসছিল। এখানে এই পৃথিবীতে মুন্নি একবিন্দু পরিমাণ সুখ পায়নি,ওর এখানে থাকারও কোন কারণ নেই। সমস্ত দুঃখ কষ্ট থেকে মুন্নি মুক্তি পেয়েছে, আমাকেও মুক্তি দিয়ে গেছে। এখন ভিক্ষা চেয়ে আমাকে আর ইয়াকুবের কাছে ছুটতে হবে না, এই মোতাওয়াল্লির করুণা পেতে ওর পেছনেও আমাকে ছুটতে হবে না। এদের বিশ্রী অমানবিক প্রশ্নের উত্তরও আমাকে আর দিতে হবে না। আমার আরও দুটি সন্তান আছে। তবু কষ্ট লাগছে, খুব কষ্ট লাগছে। বেচারী মুন্নি! বেঁচে থাকতে একবারও নতুন পোশাক পরতে পারেনি, খেলার জন্য ওর হাতে কখনও কোন পুতুল উঠেনি। ও যা পেয়েছে, তাহলো, জন্মের পর থেকে ইঞ্জেকশন আর তিতা বড়ি। আশরাফের মনে উথলে ওঠে মায়ের মমতা; ও আবার অঝোর কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। এই কান্নার অশ্রুজলেই জেগে উঠবে ভোরের আলো আর অন্ধকারে পালিয়ে যাবে অজ্ঞতা আর কুসংস্কারের অশুভ মুরগি।
মোতাওয়াল্লি সাহেব ধীরে ধীরে হাঁটছিলেন। হানিফা চিকাম্মা ঝাড়ু নিয়ে রাস্তায় ছড়িয়ে থাকা কাদা ময়লা ঝেড়ে ঝুড়ে পরিষ্কার করছিল। মোতাওয়াল্লি সাহেবের গায়ে কয়েক ফোঁটা ময়লা কাদা ছিটকে গেছে বলে আজ আর লজ্জা বা বিচলিত হয় না সে। বরং ডান হাত দিয়ে ঝাড়ুটি পাখার মতো ধরে বাম হাতের তালুতে আঘাত করে অদৃশ্য বাতাসকে শুনিয়ে বলল, ‘ আল্লাহর গজব নাযিল হোক তোমার উপর। মনে হচ্ছে আমার সামনে আমি যেন শয়তানকে যেতে দেখছি।’ রাফিয়া কলে পানি তুলতে এসেছিল। পাত্র নামিয়ে রেখে অদেখা কোন কুকুরের উদ্দেশ্যে এক টুকরো পাথর তুলে কাছের একটি পাঁক ভর্তি ড্রেনে ছুঁড়ে মেরে অবজ্ঞার হাসি হাসতে হাসতে বলে ওঠে, ‘ হায় হায়! এ যে একটি কুকুর। স্রেফ কুকুর দেখছি যে।’
পিঠে সাদা আর ধূসর পালকে ছাওয়া, ছোট মোটা উরুর একটি মোরগকে ধরে ফেলে নাসিমা ঘৃণা ভরে বলে ওঠে, ‘ হে আল্লাহ ! তোমার দয়ায় এই অভিশপ্ত মোরগের বংশ নিপাত যাক। কারণ এর কোন মানমর্যাদা, লজ্জা বলে কিছু নেই। এমনকি আল্লাহর ভয়ও নেই। এই মোরগা, তুই কি কবরের পোকামাকড় খাওয়ার জন্য এমন মোটা হচ্ছিস রে পাপী? গাধার বাচ্চা, দূর হ এখান থেকে।’ আঙ্গুলের গিঁট ফুটিয়ে নাসিমা ঘৃণার সাথে ওর নিজের পোষা মোরগটাকে শাপশাপান্ত করতে লাগল।
একদম কোণের বাড়িতে, কাজী সাহেবের ছেলের বউ, যে বিয়ের দুবছরের মধ্যে কখনও বাড়ির সদর দরোজায় এসে দাঁড়ায়নি, সেই বউটি আজ তার স্বামীকে স্কুটারে আসতে দেখে উঠানের গেটে বেরিয়ে এলো। এ সময় মোতাওল্লি সাহেবকে দেখে ওর কোলে থাকা শিশুটিকে ডেকে বউটি বললো, ‘ সোনাবাবু তুমি কী একটা গোরিলা দেখতে চাও বাবা? অই দেখ, ওখান দিয়ে একটা গোরিলা যাচ্ছে।’ একথা শুনে মোতাওল্লি সাহেব যখনই পেছন ফিরেছে, তখনই বউটি মুখ চেপে হেসে গেটের দরোজা বন্ধ করে দিল।
কিছু দূরে জামিলা খালা যেন কাউকে খুব জোরে ধমকে বলল, ‘ তোমার শুভ কিছু হবে না। মহাবিচারের দিন কেয়ামতের মাঠে তুমি শুয়োরের মুখ নিয়ে জন্ম নেবে। কাল কেউটেরা তোমাকে ঘিরে থাকবে। আর তুমি যখন মরবে তোমার জিহবা যেন তখন পবিত্র কালেমা মনে করতে না পারে।’ জামিলা খালা অভিশাপের বোমা ছুঁড়ে মারল চারদিকে।
আসিফা মাথা থেকে খসে পড়া আঁচলের দিকে পাত্তা না দিয়ে ময়লা আবর্জনায় পরিপূর্ণ একটি ঝুড়ি নিয়ে বেরিয়ে এলো। আবর্জনাগুলো ফেলতে ফেলতে সে এত জোরে ‘থু থু’ ফেলতে লাগল যেন ওর গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। যেন ও জঘন্য কিছু দেখতে পেয়েছে বলে এত জোরে থুথু ফেলছিল তাতে কিছু থুথু মোতাওল্লি সাহেবের গায়েও পড়তে পারে।
মোতাওল্লি সাহেব লাল কাপড়ে মোড়ানো মুন্নির মুখটি কিছুতেই ভুলতে পারছিল না। বাচ্চাটির চোখ বন্ধ ছিল। কিন্তু মনে হচ্ছিল তার দিকেই তাকিয়ে আছে। অনেকগুলো কন্ঠস্বর তাকে সবদিক দিয়ে ঘিরে ধরেছে। তার হৃদয় ভারী হয়ে গেছে। পাগুলো চলতে পারছে না। ইয়াকুব তাকে যে বিরিয়ানী খাইয়েছিল তার প্রতিটি কণা যেন লোহা হয়ে পেটের মধ্যে খোঁচা মারছিল। যা কিছু সে পান করেছিল— আমিনা যে পানীয়কে শয়তানের প্রস্রাব বলে, তার বিশ্রী কটুগন্ধ তাকে ধাক্কা মারছিল, যেন সে দুর্গন্ধের ডোবায় ডুবে যাচ্ছে। তিনি ভয় পাচ্ছিলেন, বুঝতে পারছিলেন, তার পেটের মধ্যে বাজে রকমের কিছু ঘটছে ।
অবসন্ন, প্রায় অচল পা টেনে টেনে তিনি তার বাড়ির সিঁড়ি বেয়ে উঠার চেষ্টা করছিলেন। সে সময় ঝাপসা চোখে দেখলেন, আমিনা ওর মায়ের সঙ্গে কোথাও যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। তিনি প্রচণ্ড ক্লান্ত, বিধ্বস্ত ছিলেন। শরীরের ঘাম মুছতে পারলেও গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাওয়ায় কথা বলতে পারছিলেন না। তবু তিনি ইশারায় জানতে চাইলেন তারা কোথায় যাচ্ছে।
‘কোথায় যাব আর?’ রাগে ফেটে পড়ে আমিনা উত্তর দিল, ‘ আমি এরমধ্যে আপনাকে সাত সাতটি সন্তান দিয়েছি। এখন ত আমি অপারেশন করতে যেতে পারি। তাই যাচ্ছি।’
স্ত্রীকে থামানোর মত কোন শক্তি, বা তাকে বলার মত কোন কথা না পেয়ে, মোতাওল্লি সাহেব যখন বসতে যাচ্ছিলেন, সে সময় আমিনা, একদম তার মতো করে বলে উঠল,‘শোনেন, দরোজা সবসময় বন্ধ রাখবেন। আর বাচ্চাদের ভালো করে দেখেশুনে রাখবেন। আমার ফিরে আসতে এক সপ্তাহ বা তার বেশী সময় লাগতে পারে। বুঝতে পেরেছেন?’
——————————————————–
দীপা ভাস্তির ইংরেজী অনুবাদ থেকে গল্পটি বাংলা অনুবাদ

রুখসানা কাজল
রুখসানা কাজল পেশায় অধ্যাপক। পড়াশোনা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ থেকে। দেশ ও দেশের বাইরের পত্র পত্রিকায় গল্প ও নিবন্ধ লেখেন। এ পর্যন্ত দুইটি উপন্যাস, গল্পগ্রন্থ এবং অনুগল্পের বই প্রকাশিত হয়েছে।