১
এমন পঙ্খী তুমি
ঘর আছে কিন্তু নাই ফেরা,
আয়না দেখি না তাই
তোমার গন্ধে থাকি ঘেরা!
একপাল শুয়োর নিয়ে কাওড়ার দলটা এগোতে থাকে! কারো কারো মাথায় গামছা পাগড়ির মতো করে পেঁচানো, খাটো ধুতি হাঁটুর উপর উঠে গেছে, কেউ কেউ লুঙ্গি ভাঁজ করে নিয়েছে আর পিঠে একটা বোঁচকা! ওর মধ্যে শোয়ার কাঁথা,আর পরনের কাপড়! হাতে ধরা প্রত্যেকের আড়াই হাত লাঠি! মাথায় টোপা! গোলপাতা বা খড় দিয়ে বোনা এই ছাতি তাদের পরম্পরার চিহ্ন! শুয়োর গুলোকে পালের মধ্যে রাখতে ধাওয়া দিয়ে আগাচ্ছে কাওড়ারা! পাল থেকে কোন ধাড়ি বা বাচ্চা বেরিয়ে যেতে গেলেই লাঠির অবধারিত বাড়ি অথবা মুখ দিয়ে চিৎকার করে ওঠে, হে হে হেই হেই… উই উই! কিন্তু অষ্ট দেবতার নামে ছেড়ে দেয়া শুকরটার গায়ে লাঠি ছোঁয়ানো যাবে না! প্রতিটা পাল বেঁধে নামাবার সময় দেবতার নামে পালের মধ্যে একটা মর্দা শূকর ছেড়ে দেয় মহাজন! শুকরটা পালের সঙ্গে যাবে কিংবা চাইলে সে পাল ছেড়ে অন্য জঙ্গলেও চলে যেতে পারবে তবু তাকে লাঠি দিয়ে পেটানো যাবে না! ভগবানের নামে তাকে ছেড়ে দেয়া হয়েছে! শুকরটা একটা মাদির গায়ে লাফিয়ে উঠছে বারবার! দলের সর্দার মঙ্গল কাকা বার কয় চেঁচিয়ে উঠেছে! তবু লাভ নেই! ওর কাজ ও চলতে ফিরতেই চালাবে! দিপেন শুকরটার দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে! বারবার তার মনে ভাসছে নতুন বউটার মুখ! দিপেনের বিয়ে হয়েছে গেছে সপ্তাহ দুই আগে! চাক ভেঙে কেবল মধু নিংড়াতে শিখেছিল কিন্তু সে আমোদ জমতে না জমতেই পাল নিয়ে বেরিয়ে আসতে হল! এটা অবশ্য এদের জীবনে নতুন কিছু না! আগে ছিল এক পেট এখন হয়েছে দুই পেট সেই পেটে যদি ছাউ আসে সে জন্য তো খাবার জোগাড় করতে হবে! তার বাবাও এভাবে বের হয়েছিল তাকেও হতে হবে! কিন্তু মন বড় হারামজাদা জিনিস! বারবার বউটার মুখটা ভাসছে! আর এই জানোয়ার গুলোও সমানে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে! একটা শূকরীর ওলান চুষতে চুষতে এগোচ্ছিল কটা বাচ্চা, তাই দেখেও কেমন জানি শিরশির করে ওঠে দিপেনের শরীর! ছোট বেলা থেকে সে এই দৃশ্য দেখে আসছে কিন্তু আগে এমন হয় নাই! বউটার মাই মনে পড়ে! কেমন তুলতুলে খরগোশের মতো, দম উঠলে এঁটেল হয়ে যায়! বউটার নাম কালি! একবারে কাঁচা বয়স! এবয়সেই এদের বিয়ে হয়ে যায়। সেই বউটাতেই হামলে খাবলে দিপেন গেলো সপ্তাহ পর্যন্ত ডুবে ছিল! ভালোবাসাবাসি গভীর হলে কালি বলত, তুই মানুষ নাকি শুয়োরের ছাউ? ক দিনি! আমারে যে খাইয়ে ছাইনে থুইয়ে যাবিনি তারপর আমি করবানি কী? উত্তর না দিয়ে দিপেন খাবলে ধরে আরও। দিপেন হোঁচট খায় ঐসব ভাবতে ভাবতে। মঙ্গল ব্যাপারটা টের পায় যে দিপেনের মাথার মধ্যে অন্য কিছু। মঙ্গল খেঁকিয়ে উঠে বলে, মাথাডা পালের মধ্যি দে। ভাবতিছির কী তুই? দিপেন অস্বস্তিতে কাচুমাচু হয়ে যায়। পালের অন্য দিক থেকে হরিপদ বলে ওঠে, মাথাডা তো কাকা গুঁইজে থুইয়ে আইছে। এহেন চলতেছে খুলিডা। পানি না ঢাল্লি ঠান্ডা হবে নানে। সবাই হো হো স্বরে হেসে ওঠে। মঙ্গলের চোখমুখ কুঁচকে থাকে। রাস্তা পেরিয়ে একটা বড় মাঠের মধ্যে শূকর পাল নিয়ে নেমে গিয়ে দিনেশ বলে ওঠে, সর্দার কাকা ইদিকে আজকেরে বাথান লাগাবো? মঙ্গল মাঠের তিনদিকে তাকায়, একদিকে জংলা দেখতে পায়, দিনেশকে বলে, নামায় দে, খাতি লাগুক। আর দিপেন আমার সাথে আয় দেহে আসি আশপাশ। দিপেন মঙ্গলের সাথে আগায়। হরিপদ চেঁচিয়ে বলে ওঠে, হেঁই সুবোধ, হুঁকোডা সাজ দিনি, এট্টু বাড়োয় নি। সকালের থ্যে হাটতিছি বাড়া তামুক তুমুক ছাড়া। সুবোধ এক কোনায় বসে পোটলা খুলে হুঁকো তামুক বের করে।
২
পাখি ডাকে ফোটে ভোর,
জবা ফুলে নাই ভোমর।
সুবোধ রান্নার জন্য চুলো খুঁচছে। দিপেন আশপাশ থেকে মরা ডাল এনে রাখে। সুবোধের মন চকমক করছে। এই এলাকায় সে গতবারও এসেছে। গেলো বছর যেই সর্দারের পালে কাজ করতো সুবোধ তার পাল এই পথে দিয়েই পাড়ি দিয়েছিল। এই এলাকায় তার বেশ কিছু বান্ধবী হয়েছে। একজনের মুখ এখনো মনে পড়লে বুকের মধ্যে টান লাগে। তাদের দেখা পাবার একটা তীব্র আকাঙ্ক্ষা আছে সুবোধের মনের মধ্যে গোপন। দিপেন শুকনো কিছু ডালপালা জোগাড় করে এনে রাখে। ব্যস্ত হাতে চুলো খুচতে হচ্ছে সূর্য মাথার উপর উঠে গেছে। কিছুক্ষণের মধ্যে কাওড়াদের সবার পেটে উথাল পাথাল টান পড়বে। তখন সবার মেজাজ আকাশে উঠে যাবে। কথা বললে, উত্তর পাওয়া যাবে ত্যাছরা! সর্দার গালমন্দ করবে। অবশ্য মঙ্গল সর্দারের সুনাম আছে, গালমন্দ খুব একটা না করেই কিভাবে কিভাবে যেন পাল নিয়ে চড়িয়ে বেড়ায়; কোথাও আটকে গেলে রাস্তা খুঁজে বের করে ফেলে। গালিগালাজ ছাড়া এতো শাগরেদ নিয়ে পাল চালানো সহজ না। দিপেন কাছে এসে বসতেই সুবোধ বলে, সকালের থে ইরাম ত্যানা মাইরে রইছির ক্যান দিপেন?
দিপেন : পুঙ্গায় লাইগে না দিনি বাড়া।
সুবোধ : বউ তো সবাই থুইয়ে আইছে। না হয় তোরডা নতুন। তা বইলে ইরাম দুঃখ দুঃখ মন কইরে ঘুরতি হয়? মনে করবি যে, লাক্স সাবান! একবার প্যাকেট খুললি ওডা পুরোনো হয়ে যায়! ধক ধাক্লিউ পুরোনো, ঘিরান থাক্লিউ পুরোনো!
দিপেন : চুপ করো দিনি সাইয়ো। তুমি তো দাঁত ক্যালায় বেড়াচ্চ। তাই বেড়াও।
সুবোধ : ইদিকের মাইয়েরা কলাম সেইরাম বুইছির?
দিপেন : কিরাম?
সুবোধ : হেবি। কথা কয় রস মাইরে মাইরে।
দিপেন : তুমি ইদিকে আইছো আগে?
সুবোধ : হয়। গত বচ্ছর তপেন মহাজনের পাল ন্যে। আমার কয়জন বান্ধবি হইছে এহেনে।
দিপেন : বুঝিছি। সেই জন্যি কি মঙ্গল কাকার পালে জুড়িছো?
সুবোধ : মাইয়ে গুলোরে দেখলি তোর আর বউর দুঃখ থাকপে নানে বুইছির? ডপকা ডপকা।
বিরক্ত হয়ে দিপেন বলে, ওরে ভগবান তা দ্যে আমি করবো কী?
সুবোধ : তুই তো জম্মের ভুদাই। বিটা মানুষ ইরাম ভোদাই হলি কলাম বউ থাহে না!
দিপেন আগুন চোখে তাকায়। সুবোধ একটা চাপা হাসি নিয়ে উঠে পড়ে রান্নার পানি আনতে।
৩
গাছে বান্ধা ঠিলা তুমি
ঠিলার মধ্যে রস,
বেপোন্দা পুরুষ যেন
মাইয়্যে মান্সির বশ!
মঙ্গল এক পাশে টোপার মধ্যে বসে হুঁকো খাচ্ছে। অন্য কাওড়ারা ছড়িয়ে ছিটিয়ে পাল পাহারা দিচ্ছে। দিপেনকে আসতে দেখা যায়। রাস্তায় ঢাল বেয়ে মাঠে নামতেই অন্য কাওড়ারা রসিকতা শুরু করে। মঙ্গল চুপ করে থাকে সর্দার সুলভ ভার নিয়ে।
হরিপদ : হেঁই জামাই আয়েছে। জামাই আয়েছে। হুলু দেও। ধান দুব্বো আনো!
সবাই খোক খোক করে হেসে ওঠে।দিপেন গুটিয়ে যায়।দিনেশ হুট করে এগিয়ে এসে দিপেনের শিশ্ন ধরার চুক্কি দেয়। দিপেন লাফিয়ে উঠে নিজেকে বাঁচায়! অন্যরা মজা পায়!
দিনেশ : কই দেহি দেহি জামাই কত বড়? এক হাত না এক বিঘেত? কম হলি কলাম মাইয়ে দেবো না!
সবাই আবারো খোক্ খোক্ করে হেসে ওঠে। দিপেন গুটিয়ে যায়।ঠিক তখন একটা দাঁতাল শুয়োর পালের অন্য শুয়োরদের কামড়াতে থাকে। হরিপদ খেঁকিয়ে ওঠে!
হরিপদ : হেঁই হেঁই দাঁতাল দাঁতাল। দে বাড়ি দে বাড়ি।
দিনেশ ছুটে গিয়ে পিটিয়ে নিস্তার করে শুকরটাকে।
হরিপদ : দেখলি দিনেশ।আমাগের দিপেনের ধোন ধরলি কলাম দাঁতাল খেইপে ওঠে! খ্যাঁক খ্যাঁক খ্যাঁক।
সবাই হল্লা করে হাসে। দিপেনের অসহায় লাগে। মাথার উপর সূর্যের দিকে তাকায় সে। দূরে মঙ্গল সর্দার আত্মমগ্নের মত ধোঁয়া উড়িয়ে যাচ্ছে হুঁকো থেকে!

রোমেল রহমান
কবি, নাট্যকার ও গল্পকার। খুলনাতে বাস করেন। কাব্যগ্রন্থ: বিনিদ্র ক্যারাভান,. গদ্যগ্রন্থ: বাঘ, প্রপাগান্ডা, মহামারী দিনের প্যারাবল, আরোগ্যবিতান. ধারাবাহিক উপন্যাস কাওরামঙ্গল.