দিনেশ দাস (১৯১৩-১৯৮৫) বাংলা সাহিত্য অঙ্গনে এমন এক সময় আবির্ভূত হয়েছিলেন যখন সাম্রাজ্যবাদী শক্তির কবলে ধ্বংসের মুখোমুখি আমরা উপস্থিত হয়েছিলাম। একদিকে মূল্যবোধহীন শোষণ শাসনের অরাজকতা, অন্যদিকে দেশভাগ, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় বিপর্যস্ত দেশ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ হানাহানির অমানবিক প্রচ্ছায়া কবিকেও বিচলিত করেছিল। ফ্যাসিস্ট বিরোধী সাম্যবাদী চেতনায় দীক্ষিত কবি সেদিন কমিউনিজম আন্দোলনে পূর্ণ সমর্থন রেখেই হাতে কলম তুলে নিয়েছিলেন। কিশোর অবস্থাতেই ঝুঁকে পড়েছিলেন চেতলার ডকের ধারে সেই সময়ের জাতীয় রাজনৈতিক দলের আন্দোলনের সঙ্গে। ১৯৩৩-৩৪ সালে স্কটিশচার্চ কলেজে বি. এ. পড়ার সময়ই তাঁর প্রথম কবিতা প্রকাশ হয় সাপ্তাহিক ‘দেশ’ পত্রিকায়। এই সময় তিনি ফরাসি ও জার্মান ভাষা শিক্ষা করেন এবং অনুবাদের কাজেও হাত দেন। কিন্তু বিপ্লবী সমিতি এবং দুটি লাইব্রেরির সম্পাদক রূপে যোগদান করায় তাঁর পড়াশোনা এবং সাহিত্যচর্চায় ভাটা পড়ে।
স্বাধীনচেতা কবি ব্রিটিশ সরকারের অধীনে কোনও চাকুরি গ্রহণ করলেন না। কার্শিয়াং চা বাগান অঞ্চলে টিউশন করেই এবং পরে চাকুরি নিয়েই এক বছর কাটালেন। ১৯৩৫-এ কলকাতায় আবার চলে এলেন। ‘প্রথম বৃষ্টির ফোঁটা’ নামে গদ্যকবিতা দিয়েই নতুনধারার লেখা শুরু করলেন ‘অগ্রগতি’ নামে সাপ্তাহিক পত্রিকায়। সেসময় সঞ্জয় ভট্টাচার্য তাঁর সম্পাদিত পত্রিকা ‘পূর্বাশা’য় একটি প্রবন্ধ লিখে শক্তিশালী কবি দিনেশ দাসকে স্বীকৃতি জানালেন। রাজনৈতিক চেতনা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে মার্কস,এঙ্গেলস, র্যালফ ফক্স প্রমুখ সমাজতাত্ত্বিক মনীষীদের বই পড়ে সাম্যবাদী চেতনায় নিজেকে আরও শানিত করে নিলেন। বাস্তবের মুখোমুখি হয়ে মানুষের যন্ত্রণা আর বাঁচার আবেদন শুনলেন। যুদ্ধোন্মাদ পৃথিবীর মৃত্যু আর রক্তলোলুপ হৃদয়হীন কারবার কখনোই সভ্যতায় কাম্য নয়। সভ্যতার ধারক ও বাহক হলেন শ্রমজীবী কৃষক সম্প্রদায়। তাদের ঘামঝরা ফসলই সভ্যতাকে রক্ষা করতে পারে। খালি পেট কখনো কল্পনা পোষে না। খিদের তাড়নায় কোনও রোমান্সই বাঁচতে পারে না। বামপন্থী আন্দোলনে তখন ‘কাস্তে হাতুড়ি তারা’র জোয়ার আসতেও শুরু করেছে। কবি ফসল তোলার প্রতীক কৃষকের হাতিয়ার কাস্তেকে চাঁদের সঙ্গে উপমিত করে লিখলেন ‘কাস্তে’ কবিতা। কিন্তু ‘কাস্তে’ রাজনৈতিক দলের প্রতীক হওয়ায় কোথাও ছাপানো হল না। অবশেষে চার বছর পর কবি অরুণ মিত্রের সহায়তায় ১৯৩৮-এর শারদীয়া ‘আনন্দবাজার’ পত্রিকায় প্রকাশিত হল। তখন থেকেই কবির পথ চলা শুরু।
‘কাস্তে’ প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে-সঙ্গেই সারা দেশের মানুষের কাছে একটা অভূতপূর্ব সাড়া পড়ে গেল। অগ্রজ কবিদ্বয় সুধীন্দ্রনাথ দত্ত ও বিষ্ণু দে কবিতাটির উদ্ধৃতি দিয়ে দুটি কবিতা লিখলেন। অন্যান্য তরুণ কবিরাও এই আদর্শ অনুসরণ করলেন। কথা সাহিত্যিক নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় ‘এ যুগের চাঁদ হল কাস্তে’ শিরোনামে একটি গল্পও লিখলেন। কবিতাটি মানুষের চৈতন্যে কী পরিমান প্রতিক্রিয়া জাগাল তা আজও একটা বিস্ময়কর ইতিহাস হয়ে আছে। বিভিন্ন ভাষায়ও এর যেমন প্রভাব পড়ল, তেমনি ইংরেজিতে অনূদিত হয়ে সকলের কাছে পৌঁছে গেল। রাতারাতি দিনেশ দাস ‘কাস্তে কবি’ নামে পরিচিতি পেলেন। কবিতাটির পটভূমি হিসেবে তিনি নিজেই উল্লেখ করলেন: ‘১৯৪১। হিটলারের পোল্যান্ড আক্রমণ। কলকাতায় খিদিরপুর ডক অঞ্চলে এবং ডালহৌসি পাড়ায় প্রথম জাপানি বোমা নিক্ষিপ্ত হল। সারা পৃথিবী তখন ফ্যাসিস্টদের ভয়ে থরথর করে কাঁপছে।…. সেই ভীত-ত্রস্ত, সংশায়িত যুগে স্থির বিশ্বাসের কবিতা ‘কাস্তে’। এতে বলতে চেয়েছিলুম—জার্মান ফ্যাসিস্টদের বেয়নেট যতই তীক্ষ্ণ হোক না কেন, কাস্তে-হাতুড়ি অর্থাৎ জনগণের শক্তির সঙ্গে তারা কিছুতেই পারবে না। তাই ঘটল। সোভিয়েত ইউনিয়ন ও মিত্রশক্তির ঘুষিতে তাদের শক্ত দাঁত একটি একটি করে খুলে পড়তে লাগল। অবশেষে ফ্যাসিস্ট চক্রশক্তির পরাজয় হল১৯৪৫ সালের ৯-মে।’ কবি বহু আগেই এই পরিবেশ আঁচ করতে পেরেছিলেন বলেই লৌহের পৃথিবীতে মাটির যুগ আনতে ডাক দিয়েছিলেন। কিংবদন্তির মতো লোকের মুখে মুখে এই কবিতার পংক্তি ঘুরত:
দিগন্তে মৃত্তিকা ঘনায়ে
আসে ওই!চেয়ে দ্যাখো বন্ধু!
কাস্তেটা রেখেছো কি শানায়ে
এ-মাটির কাস্তেটা বন্ধু!
বাঁকানো চাঁদের সাদা ফালিটিকে ভালোবাসার যুগ শেষ, এখন সেটিকে কাস্তে ভেবেই আমাদের ধ্বংসস্তূপে ফসল তোলার গান গাইতে হবে। বুভুক্ষু মানুষ খাবার চায়। যুদ্ধ বা রক্তপাত শুধু ধ্বংসই করে, সৃষ্টি করে না। তাই কবি একটা যুগের ইতিহাসের সন্ধিক্ষণের সঙ্গে সমাজতাত্ত্বিক দর্শনের আয়নায় মানবিক মূল্যবোধের জাগরণ ফেরাতে চেয়েছেন। মানুষ আবার ঘুরে দাঁড়িয়ে নতুন করে স্বপ্ন দেখতে শুরু করল। ‘পূর্বাশা’ প্রকাশনী থেকে কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘কবিতা’ (১৯৪২) প্রকাশিত হল। এই কাব্যেই প্রথম জীবনের লেখা (১৩৪৩-৪৮ বঙ্গাব্দ) কবিতাগুলি ঠাঁই পেল। ‘কাস্তে’ তারই অন্যতম। এরপর ‘ভুখ-মিছিল’ (১৯৪৪),’দিনেশ দাসের কবিতা’ (১৯৫১) একে একে প্রকাশ পেলে কবির লেখায় মানবিক বিশ্বাসের জায়গাটি দৃঢ় হয়ে গেল। সমকালীন ইতিহাসের সঙ্গে যুগের পীড়ন ও মানবতাবোধের মৃত্যুকে খুব কাছ থেকে দেখলেন। স্বাভাবিকভাবেই আবেগ ও রোমান্সের হাতছানি উবে গেল। কবি ‘প্রথম চুম্বন’কে আকাশের একটি জ্বলন্ত তারার মতো দেখলেন। যৌবন বসন্তের আড়ালে অনুভব করলেন ‘আদিম যুগের ক্ষুধিত অজগর’কে। আধাবিদেশিনী এক সুন্দরী রমণীর হাতের আঙুলের নখ দেখে বুঝলেন এ এক যুবক শিকারিণী। কত তরুণের বুক ছিঁড়ে দিয়েছেন। কবি সতর্ক, তবু লিখলেন:
বুঝি আমারও হৃদপিণ্ডে
ওই নখের ডগা গিঁথে যাবে।
মৌমাছির গুনগুনোনিতে কেঁপে উঠতে দেখলেন ‘মাটির মসৃণতম গান’। চায়ের কাপে উপলব্ধি করলেন
পাথুরে চা-বাগানের
ফগ্ মাখানো গেরুয়া মাটির গুঁড়ো
আর ‘অগুন্তি পাহাড়ি মেয়ের/ রোদে-পোড়া তামাটে মুখ।’ কবি আরও গভীরভাবে অনুধাবন করলেন শ্রমিক আন্দোলনের ইতিহাস: ‘আর ভাসে কত হাজার হাজার রক্তাক্ত প্রাণ।’
এই চা পান করার বিলাসিতাও কবির কাছে দূর হল। বর্ণ, আলো, ফুল সচেতন কবি বুঝলেন এগুলি রোমান্টিক উপলব্ধির এক-একটি অঙ্গ। স্বাভাবিক কারণেই এগুলিকে দিয়ে অ্যান্টিরোমান্টিক পথে হাঁটলেন। মাটিকাটা, পাথরকাটা শ্রমিকের ‘গাঁইতি’ নামক হাতিয়ারকে বর্ণ-আলো-ফুলের সঙ্গে উপমিত করে কবিতা লিখলেন। কল্পনাকে বাস্তবের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত করতে চাইলেন। দৃশ্য ও উপলব্ধির মধ্যে সত্যতা খুঁজলেন। সেই উচ্চারণেই ‘গাঁইতি’ কবিতা:
এবার সফল হ’ল :
হলুদ গোলাপের মত রাশি রাশি রোদ
ফুটে উঠল খোয়ার খোদলে খোদলে:
সোনালি আলোয় চকচকে গাঁইতিগুলো
শত শত বর্শার মত ঝলসে উঠেছে—
যেন হাজার হাজার সৈনিক
শাণিত অস্ত্র নিয়ে
বন্ধ্যা মাটিতে ট্রেঞ্চ কাটছে!
কাস্তে যেমন শ্রমজীবী কৃষকের হাতিয়ার, গাঁইতিও তেমনিই হাতিয়ার। শ্রমজীবী মানুষেরা সৈনিক; সভ্যতাকে গড়ে তুলবার দায়িত্ব তাদেরই। কোথায় রোমান্টিকতার হাতছানি? নীলআকাশ সমবেদনায় রাঙা। মেঘে ঝড় উঠছে: ‘ঝড়েই আমাদের ভাষা ফোটে, ঝড়েই আমাদের পরিচয়।’ এভাবেই বাস্তবের মুখোমুখি হয়ে বিপ্লবের ডাক দিলেন কবি। যুদ্ধবিধ্বস্ত কলকাতার অসহায় চিত্র উঠে এল। পাণ্ডুর আলোয় ভাঙা চাঁদ জেগে উঠল রাতে। কবিও নিঃসঙ্গ ব্যথাতুর হয়ে দাঁড়ালেন একাকী। ‘আন্দামান ১৯৩৭’ কবিতায় রাতের শহরে কান্না আর গোঙানির লোনাটে ঘ্রাণে উতল হলেন। দ্বীপান্তরের বন্দিজীবন ও কষ্টকে নিজের সত্তায় অনুরণিত হতে দেখলেন। কবির মনে হল:
জনগণ= রক্ত
দেশ= দেহ
শিরা-উপশিরা= রাস্তা
সমাসোক্তি অলংকারে কবির বোধ উজ্জীবিত হল। হাহাকার, দীর্ঘশ্বাস জীবন্ত মানবসত্তারই ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া হয়ে উঠল সমগ্র দেশ। তবুও নতুন মানবিক পৃথিবীর আকাঙ্ক্ষা কবির। ‘আগামী’ (১৯৩৮) কবিতায় লিখলেন:
পৃথিবীর ভস্মশেষ স্তূপের ওপর,
এবার নামিবে ভোর—নতুন সকাল—
জানি জানি ভোর হবে কাল!
এই ‘ভোর’ একদিকে যেমন সাম্যবাদী জীবনের স্বপ্নসম্ভব বাস্তব রূপ, তেমনি সভ্যতার বহু আকাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন। এমনকী মঙ্গল গ্রহে বসতি স্থাপনের পর্যায়ক্রমিক সফলতাও কবি আকাঙ্ক্ষা করেছিলেন বলেই লিখেছিলেন:
নতুন পৃথিবী অভিযানে,
মঙ্গল গ্রহের অন্তঃপুর—
সেদিন র’বে না বহুদূর!
আজ কি কবির স্বপ্ন পূর্ণ হবার সাধনায় সভ্যতা অগ্রসর হয়নি? হয়েছে বলেই মঙ্গল গ্রহে বসতির জন্য সারাবিশ্ব উন্মুখ হয়ে উঠেছে।
দিনেশ দাস ইতিহাসের নানা ঘটনার সঙ্গে নিজেও সম্পৃক্ত হয়েছেন।১৯৪২-এর ভারত ছাড়ো আন্দোলন,১৯৪৩-এ নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর আজাদ হিন্দ ফৌজের স্বাধীনতা যুদ্ধ,১৩৫০-এর মন্বন্তর, ভুখমিছিল,১৯৪৬-এর দেশভাগ ও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা এবং ১৯৭৪-এর স্বাধীনতা সবই তাঁকে গভীরভাবে বিচলিত করেছে। সেই সব সময়ের দীর্ঘশ্বাস ও কান্না তিনি শুনেছেন। মানুষের হাহাকার আর অসহায়তায় শানিত হয়ে উঠেছে কলম। বজ্রকঠিন প্রতিবাদী হাতিয়ার হিসেবে রুখে দাঁড়িয়েছে। বণিক সভ্যতার শোষণ ও পীড়নে তিনি হুংকার দিয়েছেন। সরাসরি যেন বিদ্রোহ ঘোষণা করেছেন:
নেইকো আর খুদের গুঁড়ো নেইকো কড়ি,
কেমন করে তোমায় রাজা তোয়াজ করি?
না হয় হলেন দিন-ভিখারি
শূন্য হাতে তোমার কাছে আসতে পারি?
এনেছি তাই তোমার ঘরেই তৈরি—নাড়ু নতুনভাবে
মহাপ্রভু, গরম বোমার লাড্ডু খাবে?
‘গরম বোমার লাড্ডু’ খাওয়ানো তো বিপ্লবী দলেরই কাজ। সেই কাজের দায়িত্ব কবিও তুলে নিলেন কাব্যের উচ্চারণে। ‘ডাস্টবিন’ লিখে জানালেন মানুষ আর কুকুরে কোনও তফাত নেই:
আজকে মহাদুর্দিনে
আমরা বৃথা খাদ্য খুঁজি ডাস্টবিনে।
পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে বামপন্থী পথকেই চিনে নিতে বললেন। তবু গান্ধীজীর আদর্শকে ত্যাগ করলেন না, বরং সেসবের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই নিজস্ব চেতনায় অটল রইলেন। পরম শান্তি কামনা করে ‘বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি’র অমরজ্যোতির্লোকে পাড়ি দিলেন। প্রাচীন ভারতবর্ষের ঐতিহ্য আর দীক্ষায় লালিত হলেন। নিজ সত্তার ব্যাপ্তিতে ‘অহল্যা'(১৯৫৪) কাব্যে ভারত আত্মার স্পন্দনকে ঘুমের মতো স্তব্ধতায় লীন থাকতে উপলব্ধি করলেন। আবেগ ও চেতনা তো পাষাণ হৃদয়ের নিরবধি মৃত্যুঘুম-ঘুমানো, কিন্তু এর মাঝেই প্রাণের স্পন্দন লুকানো থাকে। এই কাব্যেই শ্রীমধুসূদনসহ রবীন্দ্রনাথের ব্যাপকতা ও মাধুর্য সর্বগ্রাসী জীবনের প্রাচুর্যে নন্দিত ও বন্দিত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে ‘প্রণমি’ কবিতায় লিখেছেন:
আকাশে বরুণে দূর স্ফটিক ফেনায়
ছড়ানো তোমার প্রিয় নাম,
তোমার পায়ের পাতা সবখানে পাতা—
কোনখানে রাখব প্রণাম!
উক্ত কথাটি বাংলার কবিতা পাঠকের কোনওদিনই বিস্মৃত হবার কথা নয়। একসময় আধুনিক পথের দিশারি সকলের কাছেই এটি প্রবাদবাক্য হয়ে উঠেছিল। আজও কি রবীন্দ্রনাথকে এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব? এই ‘অহল্যা’ কাব্যেই ‘শিক্ষক আন্দোলন:১৯৫৪’, ‘মে-দিন’ প্রভৃতি কবিতায় সময়ের স্পষ্ট ছাপগুলি দেখতে পাই। আন্দোলন ও জীবনের নানা ক্লান্তিকর অভিজ্ঞতা থেকেই কবিতাগুলির জন্ম। তবু নতুন যুগ আসবে এই আশাবাদের জয়ধ্বনি রেখেই বস্তুবাদী চেতনায় কবি ফিরে গেছেন।
স্পষ্টভাবে সরাসরি কবিতায় ভাব প্রকাশ ঘটলেও দিনেশ দাস শেষের দিকে বেশকিছু কাব্যে কবিতার ধারা পরিবর্তন করেছেন। প্রতীকী এবং রূপকের মধ্যে দিয়ে অতিবাস্তবের নিরিখে প্রাণের রহস্যকে স্পর্শ করতে চেয়েছেন। অধুনান্তিকতা বা জাদুবাস্তবতারও প্রয়োগ ঘটেছে কোথাও। বিমূর্ত চেতনায় কবি কখনো দার্শনিকও হয়ে উঠেছেন। মূল্যবোধের অবক্ষয়, আত্মতত্ত্ব, নিঃসঙ্গতা, ভাঙনের করাল ছায়া সমস্তই যুগপ্রভাবের ফল। ‘অহল্যা’ ছাড়াও ‘কাচের মানুষ'(১৯৬৪), ‘অসংগতি'(১৯৭২), ‘রাম গেছে বনবাসে'(১৯৮১) এবং ‘গদ্য সনেট’ প্রভৃতি কাব্যের কবিতায় ব্যাপক ভাঙচুর ঘটেছে। একদিকে বিচ্ছিন্নতাবোধ যেমন তাড়িত করেছে, তেমনি অতলান্ত এক দুর্যোগ বা বিনাশের গ্রাসে কবি সতত নিমজ্জিত হয়েছেন। ‘অসুখে’ কবিতায় লিখেছেন:
অদৃশ্য জলের শাখা হতে জল ঝরে
জীবনের সোনার নির্ঝরে,
মানুষ জীবন্মৃত বিবর্ণ মৃন্ময়
আকাশের উপরে আকাশ, সময়ের উপর সময়।
বিমূর্ত চেতনায় কবি এখানে দার্শনিক হয়ে গেছেন। আমাদের অন্তর্গত জীবনের প্রচ্ছায়াকেই কবি দেখতে চেয়েছেন। তেমনি প্রতীকের গভীরে অন্য এক ধ্বংসছবির মুখোমুখি হয়ে ‘হায়না’ কবিতায় লিখেছেন:
বটের ঝুরির মত অন্ধকার নামে
বরফের মতো চন্দ্রোদয়
হে হৃদয়
হয়েছি অবাক,
কোথাও অরণ্য নেই—তবু শুনি হায়নার ডাক!
মানব সভ্যতার ‘হায়না’ যে মানুষই, মানুষের অন্তর যে লোভ রিরংসায় ভরে গেছে, শোষক নাশক প্রতিহিংসায় বিস্ফোরক হয়ে উঠেছে একথা বলাই বাহুল্য। বোধের ব্যঞ্জনাগামী বৈপরীত্যে প্রকৃত রূপও কীভাবে পাল্টে গেছে তারই ‘চিত্রকল্প’ ‘ছায়া’ কবিতায়:
সহসা আকাশে সাদা চাঁদের প্রদীপ
টিপ টিপ
তারার জোনাকি ওড়ে
সময় মোমের মত পোড়ে
আকাশ সবুজ,
তোমাকে দেখায় যেন আলো-আলো সবুজ-সবুজ
ছায়া-কায়া হয়, প্রলাপ-আলাপ,
কাদার দেহেতে ফোটে রক্তগোলাপ,
উন্মুখ
শরীরে বাঁকা চাঁদের ধনুক!
অতিবাস্তবতার ভেতর সবই সম্ভব, সম্ভব বলেই এই প্রবহমান প্রতীকগুলি এক পীড়িত সময়ের সাংকেতিক ভাষা হয়ে উঠেছে। আধুনিক মননের মেধাবী অনুভবে প্রতীকগুলির ব্যবহার কৌশলে দিনেশ দাস অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। আজ যে পোস্টমডার্ন ভাবনা নিয়ে এতো হৈচৈ হচ্ছে তা দিনেশ দাস সেদিন এই পথে পা বাড়িয়েছিলেন বলেই তাঁর ভাবনায় এক আনুভূমিক টান লক্ষ করা যায়। শব্দ ব্যবহার, ইমেজ প্রক্ষেপণ এবং আদিসত্তার বিনির্মাণ ক্রিয়া সংযোগে পোস্টমডার্ন ধারাটি অনুধ্যেয় হয়ে ওঠে:
একটি করুণ ক্রুশ পৃথিবীর!
জনতার ভিড়
সোরগোল।
আহ্নিক গতির ঊর্ধ্বে নিটোল নির্গোল
একটি তারার আলো জ্বলে ঝিকিমিকি,
সে আলো তুমি কি?
দিকজোড়া মাঠ
কাঠ ফাটে:
পৈতৃক লাঙল নিয়ে প্রাগৈতিহাসিক চাষী
ভূমিদেবতার জমি চষে, বীজ বোনে,
আর দিন গোনে।
হঠাৎ কখন তারা
দেখেছে তোমার আলো—একটি নতুন সন্ধ্যাতারা।
ভারতীয় অতীত সংস্কৃতির সঙ্গে জীবনের গতিসঞ্চার, আলাপ-প্রলাপে আদিপ্রবৃত্তির জাগরণে এবং তাৎক্ষণিকতায় কবিতায় নতুন রূপের আমদানি করেছেন। ‘ভাঙা গাছ’ কবিতায় লিখেছেন:
মিশকালো ঝড়ে
একটি সোনার গাছ ভাঙল দু’খান হয়ে:
লক্ষ লক্ষ ঝরাপাতা উড়ে এসে পড়ে
মূক সমারোহে:
স্মৃতির করুণ ঢেউ ছোট-বড় ভাঙে শত শত;
গাছ যদি আমাদের স্বয়ংক্রিয় অস্তিত্বের মর্মরূপ হয়, তবে ঝড়ও বর্ণবাদী সময়ের আস্ফালন। পরিবেশ তখন ভয়ঙ্কর অবচেতনের ক্রিয়ায় ধরা দেয়। সেই যাপনকাল প্রতীকতায় গভীর তাৎপর্য নিয়ে এসেছে। চর্যাপদে শরীরকে গাছ হিসেবেই দেখিয়েছেন লুইপাদ। তিনি লিখেছেন:
কাআ তরুবর পঞ্চবি ডাল।
চঞ্চল চিএ পইঠো কাল।।
অর্থাৎ শরীরটি গাছ, তার পাঁচটি ডাল। চঞ্চল চিত্তে কাল প্রবেশ করল। ‘গাছ’ মিথের মধ্যেই কবির ‘সোনার’
বিশেষণটি প্রযুক্ত হওয়ায় এক অতীন্দ্রিয় চেতনার যোগ ঘটেছে। আর তারপরেই কার্যকারণে উড়ে আসা পাতাদের ‘মূক সমারোহ’ এবং ‘স্মৃতির করুণ ঢেউ’ রূপকের আড়ালে ইন্দ্রিয়াতীত ‘কাল’-এরই প্রবেশ। D.G.Rosseti একটা রূপকাত্মক আত্মসমীক্ষায় উল্লেখ করেছেন:
We too will lie i’ the shadow of
That living mystic tree.
এখানে ‘Mystic tree’ যে ‘ভাঙা গাছের’-ই কিংবা ‘সোনার গাছের’-ই নামান্তর তা বলাই বাহুল্য। সংকেতবহ রূপকাত্মক জীবনের অন্তর্বিন্যাসে আত্মিক যোগের নিগূঢ় সন্ধিক্ষণ যা অতীন্দ্রিয় সত্যের উপলব্ধিতে প্রজ্ঞাকে জাগরিত করে। কবি সেই পথেই নিয়ে গেছেন মরমি পাঠককে। কবিতায় শেষ অংশে ‘অদৃশ্য শাখায় আশার শিশির’ ঝরার কথা উল্লেখ করায় এই প্রজ্ঞার পরমার্থ আরও বিস্তৃত হয়ে ওঠে। কবিচেতনার শেকড়ে পরাবাস্তবতার যেমন যোগ রয়েছে, তেমনি জাদুবাস্তবতারও যোগ রয়েছে। ‘সাদা-অন্ধকার’ কবিতায় তাই লিখেছেন:
অন্ধকার-ডুবজলে
একা আমি ডুবে যাই নিবিড় অতলে।
হঠাৎ নিষুতি-রাতে শুনি যেন কার হাহাকার?
মুখ আছে জিভ নেই, চোখ আছে পাতা নেই তার!
অন্ধকার-ডুবজল, মুখ আছে জিভ নেই, চোখ আছে পাতা নেই—সমূহ চিত্রকল্পেই জাদুবাস্তবতার নিপুণ প্রয়োগ ঘটেছে। কবি চেতনায় stream of consciousness-এর দ্বারা জীবনের বহুমুখী পর্যটন সম্ভব হয়েছে।
দিনেশ দাস যে সময় কবিতা রচনা করেছেন, বাংলা সাহিত্য নানা ফুল-ফলের প্রাচুর্যে ভরে উঠতে শুরু করেছে। জীবনানন্দ দাশ, সমর সেন, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, প্রেমেন্দ্র মিত্র, বুদ্ধদেব বসু কে নেই? সকলেই নিজ নিজ ক্ষেত্রে স্বমহিমায় বিরাজ করেছেন। তাঁদের ভিড়েই নিজের জায়গাটি করে নিতে পেরেছেন। একীভূত মানবসত্তায় মিশে গিয়ে তাঁর ‘রাম গেছে বনবাসে’ লিখে হৃদয়ের স্পর্ধা দেখিয়েছেন। প্রত্যেকেই আমরা অপত্যস্নেহে ন্যুব্জ হই। সহ্যের সীমানায় গাছ হয়ে দাঁড়াতে চাই। ছায়া দিয়ে রক্ষা করতে চাই। সেই কথাই লিখেছেন চিরন্তন হৃদয়ের দাবি থেকে। দুধের ধারার মতন পথ খুঁজে মানবের স্বপ্নের দরজায় উপনীত হতে চেয়েছেন। তাই আলো, সকাল, গাছ আর শিশিরের সঙ্গে ‘রাম’ পৌরাণিক মিথের মধ্যে জীবনের প্রশ্রয় দেখেছেন। বিষণ্ণতার অন্ধকার ভেদ করেও এগিয়ে এসেছেন। সাম্প্রতিক বাংলা কবিতায় এত রূপ-রূপান্তরের ইতিহাসে দিনেশ দাস যে জীবনানন্দ দাশের পরেই উজ্জ্বল হয়ে থাকবেন সে কথা না বললেও চলে। আমাদের মধ্যবিত্ত জীবনের আলো-ছায়ায়, রহস্য ও সৌন্দর্যে আত্ম-অন্বেষণের বৃত্তে বারবার তাঁকে মনে পড়বে। ভোরের আলোয় ঝলমল করবে মানবসভ্যতা। কবির স্বপ্নের সঙ্গে আমরাও স্বপ্ন দেখব। পাল্টে যাওয়া দিনকাল হয়তো এভাবেই আমাদের সমূহ বিষণ্ণতা দূর করে দেবে।