গাড়ি থেকে নেমে সোজা দোতলায় উঠে দরজায় বড় একটা তালা দেখে চমকে উঠি। পরে দেখি তালার সঙেগ একটা চিরকুট-‘ বন্ধু সাইফ, শুভেচ্ছা নেবে। আমার স্ত্রী গুরুতর অসুস্থ, তাই জরুরি বাসায় যেতে হলো, তোর এখানে থাকতে কোন অসুবিধা হবে না, সনাতন (আসল নাম সাইফুল ইসলাম) তোর দেখভালে ক্রুটি করবে না। তোর যে কয়দিন থাকার ইচ্ছা থাকবি। -ইতি কামরুল।’
চিরকুটটা পেয়ে প্রথমে মন খারাপ হলেও পরে ভাবলাম ঢাকা ছেড়ে এই প্রত্যন্ত অঞ্চলে এসেছি একাকী নিরিবিলি কয়টা দিন কাটানোর জন্য, কামরুল চলে গিয়ে একদিকে ভালোই করেছে। চিরকুটটা মনের অজান্তে নাড়াচাড়া করতে করতে ভাবছি সাইফুল ইসলাম কি করে সনাতন হয় -এমন সময় পঁয়ত্রিশ ছত্রিশ বছরের একটা লোক হাঁপাতে হাঁপাতে এগিয়ে আসছে, হাতে ব্যাগ ভর্তি সদাইপাতি, সালাম দিয়ে বলল, ‘স্যার, আমি সনাতন।’
সুন্দর চিমছাম বাড়ি, সামনে ও পিছনে বিরাট বারান্দা, প্রচুর গাছপালা-প্রথম দেখাই বাড়িটা পছন্দ হয়ে গেল। রাতে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়লাম।
পরদিন ঘুম থেকে উঠে এক কাপ কড়া চা নিয়ে বসেছি, এমন সময় একটা পত্রিকা দিয়ে গেল হকার। চায়ের সঙ্গে পত্রিকা। একসময় চা-এর সঙ্গে পত্রিকা ছাড়া দিনই শুরু হতো না। কিছুটা নেশা কিছুটা পেশাগত কারণে ঘুম থেকে উঠে চার পাঁচটা পত্রিকা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়া হতো সকাল সকাল। নেশাটা এমন পর্যায়ে ছিল যে, একবার এক কাজে বান্দরবানে গিয়ে সপ্তাহখানেক আটকে ছিলাম পরিবহণ ধর্মঘটের কারণে। প্রথম দুই দিন সকাল হতেই পত্রিকা না পেয়ে অস্থির হয়ে গেলাম, পরে যে বাসায ছিলাম সে বাসায় জমানো পুরানো পত্রিকা পড়তে থাকি মনোযোগ দিয়ে, দুদিন যাওয়ার পর দেখি এ এক অন্য রকম নেশা, তখন মনে হতে লাগল পুরানো পত্রিকা পড়ার মজাই আলাদা। এখন পত্রিকার পড়ার সেই ক্রেজও নেই, সেই পেশাগত চাপও নেই। কয়েকজন সাংবাদিক বন্ধু ফেবুতে থাকায় সব নিউজ এসে যায়।
লোকাল হোক জাতীয় হোক চায়ের সঙ্গে পত্রিকা- সেটাই আসল কথা। লোকালয়ে যেহেতু এসেছি লোকাল পত্রিকাই ভালো, স্থানীয় নিউজ বেশি থাকবে; প্রক্সিমিটি বলে একটা কথা আছে জার্নালিজমে। পত্রিকা সামনে মেলে ধরতেই দেখি ছয় কলাম জুড়ে একটা শিরোনাম- ‘ধানের দাম না পেয়ে তিন কৃষকের আত্মহত্যা।’ তার নিচে পাঁচকলাম জুড়ে হাড্ডি চর্মসার তিন কৃষকের লাশের ছবি। তারও নিচে ক্রন্দনরত তিন মহিলার ছবি। বাম দিকে সিঙ্গেল কলাম; ‘রাতে কৃষক সবুর গরুর গোস্ত দিয়ে ভাত খেয়েছিল’ –শিরোনামের নিউজটায় চোখ আটকে যায়। কাগজ আর ছাপার মান ঢাকার কাগজের মতো না হলেও গেটআপ মেকআপটা অনেক ভালো, বলতে গেলে ঢাকার অনেক নামি দাবি কাগজের সমতুল্য। গেটআপ মেকআপ দেখতে দেখতে আমাদের খালেদ ফারুকীর কথা মনে পড়ে যায়, ‘পত্রিকার গেটআপ মেকআপ ভালো করার নামে ভাওতা সাজ দিয়েন না।’ সত্যি এটাতে ভাওতা সাজ নেই মফস্বলের পত্রিকা হলেও। এক নজর চোখ বুলিয়ে, বাডর্স আই যাকে বলে – চায়ে চুমুক দিলাম। মনে হচ্ছে নিউজগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়তে পড়তে আমার অলস সকাল বেলার অনেকটা সময় পার করা যাবে; আমার আবার এক বদ অভ্যাস ইন্টারেস্টিং কোন লেখা পেয়ে গেলে সেটা সট করে পড়ি না, অনেকটা রয়ে সয়ে মাথা ঠাণ্ডা করে কিছুটা সময় নিয়ে আয়েশ করে পড়ি, আমার ধারণা এই অভ্যাস অনেকেরই আছে। আর একবার চায়ে চুমুক দিতে গিয়ে দেখি চা শেষ, সনাতনকে আর এককাপ চা দিতে বলবো কি বলবো না ইতঃস্তত করছি এই সময় সনাতন নিজ থেকেই বলল, আর এক কাপ দিই স্যার?
চায়ের অপেক্ষা না করেই পত্রিকাটা আবার টেবিলে মেলে ধরলাম। কাগজের মান ভালো না হলেও তিন জনেরই পাঁজরের রিটগুলো স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, পেট খাদের মতো পড়ে আছে, মাথায় এলোমেলো চুল, হাঁটু অবধি ময়লা লুঙ্গি গুটানো, এক জনের মুখ হা করে আছে, গভীর কোটরের নিচে মুদিত শান্ত একজোড়া চোখ; চির নিদ্রা, তবু মনে হচ্ছে এখুনি জেগে উঠবে। আর একজনের একটা পা বেরিয়ে আছে, পায়ের পাতা গোড়ালির অবস্থা চৈত্রমাসে ফেটে চৌঁচির মাঠের মতো। ছবির প্রথম মহিলা আকিমুন্নেসা, সবুরের স্ত্রী; বয়স ত্রিশ পঁয়ত্রিশ হতে পারে, আরো কমও হতে পারে; পরিশ্রমী শরীর বয়স বোঝা কঠিন; কোন আহাজারি নেই, ফরিয়াদ নেই, শান্ত দুচোখে কেবলই শূণ্যতা। বাকী দুটো ছবিতে মুখভঙ্গিটা অতো পরিষ্কার আসেনি। একটা বিষয় খেয়াল করলাম ঢাকার অনেক নামীদামী পত্রিকাও এসব ক্ষেত্রে যা করে থাকে নিকট আত্মীয়দের ক্রন্দনরত ছবি ছাপিয়ে নিচে গৎবাঁধা ক্যাপশন লিখে দেয় ‘স্বজনদের আহাজারি’। এই স্বজনরা মৃত ব্যক্তির স্ত্রী, বোন না অন্য কোন আত্মীয় তা পাঠকের অজানাই থেকে যায়। কাগজের নিউজএডিটরের তারিফ না করে পারা যায় না।
ঢাকায় হলে এইসব নিউজে কোন আগ্রহই তৈরি হতো না। প্রতিদিন নারী শিশু ধর্ষণ, গণধর্ষণ, গায়ে আগুন লাগিয়ে মাদ্রাসার ছাত্রীকে পুড়িয়ে মারা, চাকরি না পেয়ে যুবকের আত্মহত্যা, ভিটেবাড়ি থেকে উচ্ছেদ, দেশত্যাগ, ক্রসফায়ার, বুড়িগঙ্গায় ভেসে উঠা লাশ, খুন গুমের মতো খবরের মধ্যে কোন প্রত্যন্ত অঞ্চলের তিন কৃষকের আত্মহত্যার নিউজভ্যালু কাগজওয়ালাদের কাছে কি থাকতে পারে? তাছাড়া, ঢাকায় থাকা লোকজনেরই বা এতো সময় কোথায়? এই এক আজব শহর; সবাই আছে দৌঁড়ের মধ্যে, অর্ধেক কর্মক্ষমতা চলে যায় রাস্তায়।
এখানে আমার হাতে অনেক সময়। সনাতন চা দিয়ে চলে যায় না, দাঁড়িয়ে আছে কি যেন বলতে চায় হয়তো সাহস পাচ্ছে না। আমি ঘাড় তুলে চোখের ইশারায় কিছু বলবে কিনা জানতে চাইলে সে লুফে নেয়, ‘পেপারে সত্য ঘটনা লিখেছে স্যার। আমি নিজের চোখে দেখে এসেছি; আমাদের পাশের গেরামের ঘটনা। আপনি আমার সঙ্গে গেলে সব দেখতে পাবেন স্যার, দেখবেন সব অক্ষরে অক্ষরে মিলে গেছে।’
সনাতন কথাটা যেভাবে বলল তাতে আমি কিছুটা ধাক্কা খেলাম। মনে মনে ভাবলাম, পত্রিকা বা মিডিয়ার কাজই সত্য খবর প্রকাশ করা। তার কথা শুনে মনে হলো মিডিয়া সত্যটা কালেভদ্রে প্রকাশ করে, সবসময় করে না। মিডিয়া সম্পর্কে সনাতনের বা সনাতনদের মনোভাব কী যাচাই করার জন্য বললাম,‘তুমি যেভাবে বলছো তাতে মনে হচ্ছে মিডিয়া সত্য কথা বলে না।’
সে গম্ভীর হয়ে বলল,‘কিছু মনে করবেন না স্যার, মিডিয়ারে আর বিশ্বাস করা যায় না। পেপার-পত্রিকা কয়জন পড়ে, টিভির খবর কয়জন দেখে? সবাই দেখে ইন্ডিয়ার সিরিয়াল।’
সনাতনের বক্তব্য শুনে মতিঝিলে হঠাৎ সাক্ষাৎ পাওয়া এক সময়ের এক সহকর্মী সাজেদুলের কথা মনে পড়ল। ‘ভাই আপনি মিডিয়া ছেড়ে দিয়ে ভালো করেছেন, মিডিয়ার কথা লোকজন আর বিশ্বাস করে না; সব নিউজ সেকশন থেকে ছাঁটাই হচ্ছে।’
সাজেদুলের বিষন্ন মুখটা হারিয়ে গেলে মনে মনে ভাবি সনাতনের প্রস্তাবটা মন্দ না, সরেজমিনে এলাকা দেখাও হবে আবার একটু হাঁটাও হবে। আমি মাথা নেড়ে সনাতনকে বললাম যাব, বিকেলে তোমার গ্রামে যাব। তুমি এখন আমার জন্য এক প্যাকেট সিগারেট নিয়ে এসো। সনাতন খুশি মনে সিগারেট আনতে গেলে আমি নিউজটার আদ্যপান্ত পড়ি। ঘটনার চুম্বক কথা হচ্ছে: আরো অনেকের মতো কৃষক সবুর, খায়ের ও বেচু এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে ধান চাষ করে, কথা ছিল ধান বেচে শোধ করে দেবে। ধানের দাম এত কম যে সব ধান বিক্রি করে ঋণ শোধ হবে না, তাই ভয়ে আতঙ্কে ধানের পোকা মারার ঔষুধ খেয়ে তারা আত্মহত্যা করে।
রাস্তার দুপাশে সারিসারি বাড়ি, তার পরে বিস্তীর্ণ ধান ক্ষেত; মাঠজুড়ে কাচাপাকা ধান চোখ জুড়িয়ে যায়। স্থানে স্থানে খড় বিছানো, খড় থেকে কেমন যেন ঝাঝালো সোঁদা সোঁদা একটা গন্ধ এসে নাকে লাগে, ধীরে ধীরে গন্ধটা ভালো লাগতে থাকে। কিছুটা পথ হাঁটার পর কয়েকটা দোকান; ছোটখাট বাজারের মতো, সেখান থেকে দশ পনের মিনিট হাঁটলে উদয়পুর গ্রাম। সনাতনকে নিয়ে যখন ঘটনাস্থলে যাই তখন এপ্রিলের সূর্য পশ্চিম আকাশে ডুবুডুবু, তবে আলো এবং তাপ দুটোরই দাপট কমেনি। প্রথমে সবুরের বাড়ি, তার লাগোয়া বাড়িটা খায়েরের, একটু সামান্য অগ্রসর হলে রাস্তার ডান পাশের বাড়িটা বেচু মিঞার; এরা তিনজনই আত্মঘাতি। বেচুর মিঞার বাড়ির পিছনে বাঁশঝাড়ের ঝিরঝির ছায়ার নিচে পরপর তিনটা তরতাজা কবর। কবরগুলোর এক প্রান্তে মানে মাথার দিকে খেঁজুরগাছের ডগা দাঁড় করানো আছে, পাশে লোবানের বোতল পড়ে আছে এলোমেলোভাবে। চারদিকে কাঁচামাটি, কাঁচা বাঁশ আর লোবানের গন্ধে মাখামাখি। বাদআছর জানাজা শেষে কবর দেয়া হয়েছে। দলেদলে লোক আসছে আর যাচ্ছে।
সবুরের উঠানে পা দিয়ে দেখি বেশ লম্বা একটা মাটির ঘর, চওড়া বারান্দা। পাশে রান্নাঘর, গোয়ালঘর, উঠানও বেশ বড়। উঠানের একপাশে খড়বিচালির স্তূপ; বোঝাই যায় বড় কৃষক। বেলা পড়ে এলেও নারীপুরুষের জটলা কমেনি, বারান্দায় মাটিতে পা মেলে খুঁটিতে হেলান দিয়ে সবুরের কিশোরী দুই মেয়ে বুকে পাথরচাপা কষ্ট নিয়ে বসে আছে; এদের চোখের জল সব শুকিয়ে গেছে। মেয়েদুটার মুখের দিকে তাকিয়ে দ্রুত চোখ নামিয়ে নিই; সদ্য পিতৃহীন দুই কিশোরীর চোখের দিকে তাকানো দুনিয়ার কঠিন কাজগুলোর একটি।
সনাতন বললো, ‘চলেন স্যার, খায়ের আর বেচুর বাড়িটা ঘুরে আসি, বেচুর বোনগুলোর কান্না থামছে না; পিঠাপিঠি ভাইবোন তো। অবুঝ দুইটা বাচ্চা নিয়ে বউটাও মুখের ভাষা হারিয়ে ফেলেছে।’
বেচুর বাড়ির দরজা পর্যন্ত গিয়ে যখন থমকে দাঁড়াই তখন পুরোপুরি অন্ধকার নেমে গেছে। গাছগাছালিতে ঘেরা বেচুর বাড়ি থেকে থেমে থেমে মিহি কান্নার সুর ভেসে আসছে, সঙ্গে বিলাপও।
এরকম রূঢ় পরিস্থিতির মুখোমুখী হওয়ার সাহস শক্তি কোনটাই আমার নেই; সেখান থেকে কোনরকমে পালিয়ে আসতে পারলে বাঁচি। সনাতনকে বললাম কান্নাকাটি আর সহ্য হচ্ছে না, চলো ফিরে যাই। বাজারটাতে এসে চা খাওয়ার জন্য থামলাম। প্রতিটা টি-স্টলে মানুষের জটলা- বিষয় একটাই। একটা টি স্টলে ঢুকতেই দেখি বসার একটা আসনও খালি নেই, মাতব্বর গোছের একজন ধমক দিয়ে এক বয়ষ্ক লোককে উঠিয়ে আমার বসার ব্যবস্থা করে। আমি মুরুব্বির আসনে বসতে ইতস্তত করায় কমবয়সী একজন স্বেচ্ছায় উঠে জায়গা দিলে সেখানেই বসি; সনাতন দাঁড়িয়ে থাকে আমার পাশে, তার তপ্ত নিঃশ্বাস আমার ঘাড়ে এসে লাগছে। বাইরের লোক আমি, সাংবাদিক ভেবে এরা বেশ খাতির আর উৎসাহ দেখাচ্ছে; সব ঘটনা অনুপুঙ্খ বলার একটা ব্যাকুলতা অনেকের মধ্যে। আমি সিগারেট ধরিয়ে চায়ে চুমুক দিচ্ছি, আর তাদের কথা শুনছি মনযোগ দিয়ে। চা-সিগারেট দুটোই কেমন যেন বিস্বাদ লাগছে।
প্রত্যক্ষদর্শী একজন বললো, ‘আমার সঙ্গে সবুরের দেখা ধানের হাটে, পাশাপাশি দুজনে ধান নিয়ে দাঁড়ালাম; আমি আগে বিক্রি করলাম, না বিক্রি করে কি করবো পেট তো কিছু মানে না। সবুর আর ধান বিক্রি করে না, বলে মিঞাভাই এই দামে ধান বেচলে বাঁচতে পারমু? সে আবার আমাকে দেখলেই মিঞাভাই ছাড়া কথা বলে না। আমি বললাম, না বেইচা কি কইরবা? পেট কি কারো কথা শুনে? কিছুক্ষণ দম বন্ধ করে থেকে এক ব্যাপারিকে ডাকল হাতের ইশারায়, ধান দিয়ে দিলো। আমার কথায় কাজ হইছে; ওই যে বললাম আমার কথা ফেলতে পারে না, শ্রদ্ধা ভক্তি করে।’
আর একজন তাকে থামিয়ে দিয়ে কয়েকবার গলা খাকারি দিয়ে ধীরে ধীরে বলেতে থাকে,‘ধান বেইচা সবুর মিঞা সোজা চলে গেল গরুর গোস্ত কিনতে, আমি কইলাম সবুর কই যাও? বলল, দুইমণ ধান বেচলাম এখন দুই কেজি গোস্ত কিনে বাড়িত যাই, রাতে পেট ভইরা খামু। কতোদিন গরুর গোস্ত দিয়ে ভাত খাই না। এই খাওন যে শেষ খাওন কে জানতো।’
দাড়িতে হাত বুলাতে মাঝ বয়সী একজন পিছন থেকে সামনে এসে দাঁড়িয়ে ভাষণের মতো করে বলে, ‘ধানের বস্তার মুখ খুইলা মাথা তুইলা দাঁড়াইতে এক ব্যাপারি আইসা ধান নাড়াচাড়া কইরা এমন দাম কইলো সঙ্গে সঙ্গে মাথায় গেল রক্ত উঠে, বেপারিকে গাইল দিয়ে ঘাড় ঘুরাইতে দেখি খায়ের আর বেচু ধান নিয়া দাঁড়াই আছে। ঘরে আমার মেয়ের বিমারি, আপনি বলেন দামের দিকে চাইয়া থাকলে চলবে? আমি বেচে দিলাম। কতো কইলাম খায়ের আর বেচু বেচে না, কয় দরকার হইলে রাস্তায় ফালাই দিমু, তবু এই দামে বেচুম না। একমণ ধান বেচলাম, কতো আর টাকা, টাকাগুলো গুনে পকেটে রেখে তাকিয়ে দেখি সত্যি সত্যি খায়ের আর বেচু রাস্তায় দুই মণ ধান ফেলে দিলো।’
আমি অনুচ্ছস্বরে বললাম, ‘এবার ধানের বাম্ফার ফলন হয়েছে।’
একজন বললো, ‘হইছে, সেটাই হইছে এখন আমাদের মরণের কারণ। ধানের ফলন বেশি করলেও কৃষক মইরবে, কম করলেও কৃষক মরইবে।’
পিছন থেকে একজন বলে উঠে,‘এই দেশে কৃষকের দাম নাই, ধানেরও দাম নাই।’
‘কৃষক কেন বলতেছ, বল গরিবের কোন দাম নাই; গরিবের দিকে খোদাও চাইয়া দেখে না, সরকারও দেখে না। আগে ভোটের সময় দাম দিত এখন হেইটাও নাই।’ – ভিড়ের মধ্যে কেউ একজন কথাটা বলে মুখ লুকিয়ে ফেলে। সামনের সারিতে বসা কয়েকজনকে এসময় খানিকটা উদ্বিগ্ন দেখা যায়।
এ সময় কে যেন হঠাৎ টিভি ছাড়লে ব্যাপক ফাইটিংয়ের তীব্র শব্দ এসে কানে লাগে; চোখ তুলে দেখি মিঠুনের একটা বাংলা ছবি চলছে, বস্তির গরিব মানুষের পক্ষ হয়ে মিঠুন ব্যাপক ফাইট করে চলেছে।
পিছন থেকে মাঝবয়সী একজন উঠে ‘ওই সিদ্দিক টিভি বন্ধ কর’ হাঁক দিয়ে আমার দিকে এগিয়ে এসে বলে, ‘আপনি একটা কাগজ কলম নেন, ‘ওই কালু স্যারেরে একটা কাগজ কলম দে’, স্যার হিসাব করে দেখুক আমাগো বাঁচার উপায় আছে কি?
মুহুর্তে বহুজাতিক এক কোম্পানির একটা প্যাড আর কলম এগিয়ে দেয় কালু।
সনাতন বলে, ‘স্যার লেখেন, লেখেন স্যার।’
আমি পাতার উপরে লিখলাম- একবিঘা জমিতে ধান চাষের খরচ’
কাগজ-কলম নিয়ে প্রস্তুত আমি, একজন বলল আর আমি লিখে চলছি।
১. জমি প্রস্তুত করতে – ২০০০/
২. চাষ – ১০০০/
৩. বীজ ও বীজতলা তৈরি – ১০০০/
৪. চারা রোপন – ২২০০/
৫. নিড়ানি – ১৫০০/
৬. সার – ১৫০০/
৭. কীটনাশক – ৩০০/
৮. সেচ – ২৫০০/
৯. ধান কাটা – ৪০০০/
‘এবার বলেন স্যার, কতো খরচ হইল?’
আমি বললাম, ‘সাড়ে তের হাজার টাকা।’
‘এক বিঘায় ধান হয় ১০ থেকে ১৩ মণ। ধানের দাম ৫৫০ টাকা মণ হলে এক বিঘায় উৎপাদিত ধানের দাম হয় ৭১৫০ টাকা। ’
আমি লোকগুলোর দিকে মুখ তুলে তাকালাম।
‘তাহলে আপনি বলেন, আমাদের লোকসান কতো হলো?’
আমি বললাম, ‘সাড়ে ছয় হাজার টাকা, প্রতিমণে লোকসান পাঁচশ টাকা।’
একজন বলে, ‘নিজের বউ,ছেলে মেয়ের শ্রমের দাম ধরবেন না? না, থাক বাদ দেন।’
কে যেন ক্ষিপ্ত হয়ে বলে উঠল, ‘রাখো নিজের বউ ছেলে- মেয়ের শ্রমের দাম। সমিতির থেকে ঋণ করে যে কামলা খাটাইছি সেই দামই পাই না, ওনি আছেন বউ-বাচ্চার হিসাব নিয়ে।’
‘তা হলে বলেন স্যার সবুর, খায়ের আর বেচুর আর কী উপায় ছিল আত্মহত্যা ছাড়া। সবুর, খায়ের আর বেচুর সাহস আছে তারা একবারে মরে গেল, আমাদের সাহস নেই আমরা বউ বাচ্চা নিয়ে প্রতিদিন ধুঁকে ধুঁকে মরছি। লাভ হবে না জানি, আবারও আমরা ধানের চাষ করবো এবং তিলে তিলে মরে যাবো বউ বাচ্চা নিয়ে।’
আর একজন বলল, ‘কামলার মজুরি বেশি, মাঠ থেকে ধান আনবো কি করে? কামলার টাকা দিতে গেলে আরো খরচ আরো লোকসান। আমাদের এই জীবন-মরণ সমস্যা দেখার কেউ নেই।’
সনাতনের পীড়াপীড়িতে বাসার উদ্দেশে রওয়ানা দিলাম। চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার, সংকীর্ণ ধূলাময় রাস্তায় দুজন হেঁটে চলেছি, সনাতন আগে আগে আমি তাকে অনুসরণ করছি। আমার মাথার ঘিলুর মধ্যে এদের কথাগুলো ঘাই মেরে চলেছে। কি অদ্ভূত ব্যাপার যারা রক্তমাংস এক করে, তিলে তিলে নিজেদের নিঃশেষ করে ধানের বাম্পার ফলন ফলাচ্ছে, খাদ্যে দেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ করে তুলছে, সমগ্র দেশের মানুষের মুখের গ্রাস যোগাচ্ছে তাদের কথা ভাববার কারো সময় নেই, তাদের সহজ অঙ্কটা সমাধানে কেউ এগিয়ে আসছে না।
রাতে খাওয়ার টেবিলে দেখি অনেক আয়োজন – দেশি মুরগির মাংসের ঝোল, গরুর গোস্তের ভুনা, ডাল, সবজি। সাদা ভাত আর গরুর ভুনা হলে আমি কোন কিছুর দিকে তাকাই না।
‘এতো আয়োজন কে করতে বলেছে তোমাকে?’
ঘাড় কাত করে ঠোঁটে হাসি ঝুলিয়ে রেখে সনাতন বলে, ‘আমার স্যার বলেছেন আপনি গরুর গোস্তের ভুনা খুব পছন্দ করেন। রান্না ভালো হয়েছে, খেলেই বুঝতে পারবেন। আমি জানি আপনিও গরুর গোস্ত ভালো রান্না করতে পারেন।’
‘কে বলেছে, তোমার স্যার?’
সনাতন মাথা নাড়ে।
‘আপনি অনেক দিন পত্রিকায় কাজ করেছেন মানে সাংবাদিক ছিলেন, এখন বই লেখেন।’
‘তুমি দেখছি অনেক বিষয় জানো।’
সন্ধ্যা থেকে সবুর, খায়ের, বেচু, সবুরের দুই মেয়ের মুখচ্ছবি, কৃষকদের কথাবার্তা মাথার মধ্যে ঘুরছে। ক্ষুধা, তৃষ্ণা নেই বললে চলে। লম্বা করে নিঃশ্বাস টেনে গরুর গোস্তের ঘ্রাণ নিয়ে প্লেটে ভাত নাড়াচাড়া করছি। সনাতন বলল, এক কেজি গরুর গোস্ত কিনেছি স্যার। আমি মনে মনে বললাম এক কেজি! মানে এক মণ ধান। পত্রিকায় দেখা সবুরের ছবিটা, তার দুইটা মেয়ে বউ এর ছবি চোখের সামনে ভেসে উঠল। সবুরও গরুর গোস্ত পছন্দ করতো, সে আত্মহত্যার আগে সবাইকে নিয়ে গরুর গোস্ত দিয়ে পেট ভরে ভাত খেয়েছিল, তার মানে না খেয়ে সে মরেনি। আনেকক্ষণ ভাত নিয়ে বসে আছি, সনাতন বিরক্ত হচ্ছে বুঝতে পারছি।
‘স্যার ভাত তরকারি ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে, গরুর গোস্ত ঠাণ্ডা হলে টেস্ট কমে যায়।’
একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বললাম,‘আমার প্লেটে যে ভাতগুলো আছে এগুলো কোন কৃষক ফলিয়েছে তুমি চেন?’
‘না, স্যার। তা কি কখনো চেনা যায়?’
‘সবুর খায়ের আর বেচু যে ধান ফলিয়ে গেল সেই ধানের ভাত যাদের প্লেটে যাবে তারা কি বুঝবে এরা কেউ বেঁচে নেই, বেশি ফসল ফলিয়েও দাম না পেয়ে তারা রাগে অভিমানে আত্মহত্যা করেছে?’
সনাতন একাগ্র দৃষ্টিতে আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে, আমিও তার দিকে তাকিয়ে থাকি; সনাতনের চোখের কোণে জল। সহসা নিজেকে সামলে নিয়ে আস্তে আস্তে বলে, ‘এভাবে কখনো ভাবিনি স্যার।’
মনে মনে বললাম এই এক আজব দেশ, যে কৃষক পুরো জাতির মুখে খাদ্য তুলে দিচ্ছে সেই বিপুল উৎপাদক গোষ্ঠীকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার এমন আয়োজন দুনিয়ার আর কোন দেশে পাওয়া যাবে কি না জানি না।
পরদিন অন্য দিনের তুলনায় একটু আগে আগে ঘুম ভেঙে গেল, কি কারণে জানি না সনাতনও আজ আগে আগে এসে গেছে। তবে পত্রিকা আসতে আরো অনেক দেরি করে। পত্রিকার অপেক্ষায় থাকতে থাকতে এর মধ্যে এক কাপ চা শেষ করেছি, আর এক কাপ চায়ের শেষ চুমুক দেব এসময় হকার পত্রিকা নিয়ে হাজির। ঘটনার বিবরণ আমার আগে থেকে জানা, তাই নিউজ স্টোরি নিয়ে আমার আগ্রহ তেমন নেই, আমার আগ্রহের বিষয় অন্য খানে, মনে মনে যা অনুমান করেছিলাম তাই হয়েছে। নিউজটা ভাঁজের নিচে চলে গেছে, তিন কলামের শিরোনাম, তাতেও সমস্যা নেই ফলোআপ নিউজ ভাঁজের নিচে তিন কলাম হতেই পারে। তবে শিরোনাম দেখে নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছি না: ‘হতাশা থেকে তিন কৃষক আত্মঘাতী, ধানের দামের জন্য নয়।’ নিউজের চুম্বক কথা : পারিবারিক অশান্তি কিংবা অন্য কোন কারণে ব্যক্তিগত হতাশা থেকে তিন কৃষক পোকা দমনের ঔষধ খেয়ে আত্মঘাতী হয়েছে, ধানের দামের সঙ্গে তাদের মৃত্যুর কোন সংশ্লিষ্টতা নেই। বেচু মিঞা আর সবুর মিয়া দুই বছর আগেও একবার আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিল, স্থানীয় সরকার দলীয় নেতারা এলাকার লোকজনকে বিশেষত কৃষকদের বিভ্রান্ত না হওয়ার জন্য আহ্বান জানিয়েছেন, তারা বলেছেন, দেশ যখন খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ, পরপর বাম্পার ফলন হয়ে চলেছে সে সময় কেউ কেউ ঈর্ষান্বিত হয়ে বিভ্রান্ত ছড়াচ্ছে।’ একদিনের ব্যবধানে পত্রিকাটা এভাবে একশ আশি ডিগ্রি বিপরীতে অবস্থান নেবে ভাবতেও পারছি না।
নিউজটা পড়ার পর আমি গম্ভীর হয়ে বসে আছি। এসময় সিগারেট ধরাই নিজেকে হালকা করার জন্য। সনাতনের কোন খবর নাই। দুই ঘন্টা পরে সনাতন এসে হাঁপাচ্ছে, উত্তেজনায় কথা বলতে পারছে না। আমি পত্রিকাটা দেখিয়ে বললাম, ‘দেখেছ কি লিখেছে?’
‘রাখেন খবরের কাগজ, স্যার পরিস্থিতি খারাপ। দলে দলে কৃষক জড়ো হয়ে বিক্ষোভ করছে ধানের ন্যায্য দামের দাবিতে। তারা খুব উত্তেজিত; ‘সবুর, খায়ের, বেচু মরল কেন জবাব চাই’-শ্লোগানও দিচ্ছে। এদিকে শতশত কৃষক সড়ক অবরোধ করে রাস্তায় ধান ফেলে বিক্ষোভ করছে।’
সনাতনের কথা শুনে আমার শিরা-উপশিরায় রক্ত প্রবাহ দ্রুত বেড়ে চলছে, উত্তেজনায় আমার শরীর কাঁপছে,।
‘আর কি দেখেছ সনাতন?’
‘ঘরের মহিলারাও রাস্তায় নেমে এসেছে, দলে দলে কৃষক সবুর, খায়ের আর বেচুর কবরের কাছে গিয়ে শপথ নিচ্ছে আর বিক্ষোভ করছে। এবার কিছু একটা হবে স্যার, দেইখেন কিছু একটা ঘটবে।’
আমি চুপ করে আছি, সনাতন চাইছে আমি কিছু একটা বলি তার কথার প্রতি উত্তরে। আমার মৌনতা তাকে বিচলিত করে।
‘আপনি চান না স্যার কিছু একটা হোক?’
আমি ভাবি এটা স্ফুলিঙ্গ, অসংগঠিত বিক্ষোভ; কতো দূর আর যাবে, যারা এসব স্ফুলিঙ্গকে দাবানলে পরিণত করবে তারা আজ নানা মতপথে বিভক্ত ও বিভ্রান্ত। দুএকদিনের মধ্যে সব চুপসে যাবে, চুপসে দেয়া হবে।
আমি মাথা নেড়ে বললাম ‘চাই, আমিও চাই কিছু হোক, আর কিছু না হোক কৃষক অন্তত ধানের ন্যায্য দাম পাক।’
পরদিন সকাল সকাল বাক্সপ্যাটরা গুছিয়ে তৈরি হচ্ছি, যদিও বাক্সপ্যাটরা বলতে তেমন কিছু নেই। এক্ষুণি বেরিয়ে যাবো। এই কয়দিনে সনাতনের প্রতি মায়া পড়ে গেছে, সনাতনেরও একই অবস্থা মনে হচ্ছে। সনাতন সামনে দাঁড়িয়ে আছে, মনে হচ্ছে কিছু একটা বলবে।
চোখ তুলে তাকাতেই সে বলল,‘পরিস্থিতি খারাপ স্যার। পুলিশ রাতে বাড়ি বাড়ি গিয়ে ধড়পাকড় করছে, তিন কবরের পাশে পাহারা বসিয়েছে, পুলিশের সঙ্গে গুণ্ডারাও মারধইর করছে। কিছু আর হলো না স্যার।’ বলতে বলতে সনাতন কান্নায় ভেঙে পড়ল।
আমি গাড়িতে উঠতে উঠতে তাকে শান্তনা দেয়ার জন্য বললাম, ‘কিছু হয়নি কি বলছ, একটা স্ফুলিঙ্গ জ্বলে উঠে আবার নিবে গেছে, অন্ধকারের বুক চিরে এক ঝলক আলো তো জ্বলে উঠেছে- এটা কম কথা নয়।’
প্রথম দিন যে পেপারটা অতি আগ্রহ নিয়ে পড়েছি সেটি বারান্দায় পড়ে আছে, সনাতন একবার কেবল তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে তাকালো।
আমি বললাম ‘পত্রিকাটা দাও সনাতন।’
সনাতন তেমন একটা আগ্রহ দেখায় না, পত্রিকা নিয়ে তার মনোভাব আমার জানা। তাকে কাছে ডেকে বললাম, ‘গত দশ বছরে পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি বড়লোক হয়েছে কোন দেশে? আমাদের এই বাংলাদেশে। এই খবরটাও এসেছে মিডিয়ায়। অতএব মিডিয়ার ওপর রাগ করে কি লাভ?’
গাড়ি ধীর গতিতে এগুচ্ছে, সনাতন দৌঁড়ে আসে। আমি গ্লাস নামিয়ে মাথা বের করি।
‘কৃষকদের বাঁচানোর কোন পথ কি নাই স্যার?’
আমি বললাম, ‘আছে, নিশ্চয় আছে।’ গাড়ির গতি আরো বাড়ল, কথাটা পুরোপুরি তার কানে গেল কি না জানি না।