লক্ষ লক্ষ বছর ধরে, আমার মতো কোটি কোটি ক্ষুদ্র প্রাণ সৃষ্টি করে, আমাদের পুণ্যের জন্য স্বর্গ, পাপের জন্য নরক সৃষ্টি করে, হে ঈশ্বর, আপনি বসে আছেন আমাদের অপেক্ষায়। হে ঈশ্বর, আপনি নিশ্চয়ই এখন স্বর্গের বাগিচায় সুবাস উপভোগ করছেন। অথবা সেখানে করজোড়ে দাঁড়িয়ে থাকা নুরানী চেহারার দেবদূতদের প্রতি আদেশ করছেন। আমি হয়ত আপনার আত্মার ক্ষুদ্র একটি কণিকা মাত্র, তবুও, আমি কি পারি না, আপনার কাছে একটি বিনীত অনুরোধ করতে? কারণ…
এটা ছিল এমন এক সময়, যখন আমি ছিলাম অত্যন্ত নাজুক আর অসহায় – বাস্তবে যদিও তখন আমার জীবনে তেমন একটা সংকট ছিল না। চারিদিকে চারটি দেওয়াল আমাকে ঘিরে রাখত সর্বক্ষণ। আর মুক্তি – সে ছিল একটুকরো হাওয়া – নির্মল কল্পনার এক অপূর্ব সৃষ্টি – যেটা আমার মুখে শুধু তখনই স্পর্শ করত, যখন আমি জানালা খুলে দিতাম। শুধু রাতের নিস্তব্ধতায় আমি ছুঁয়ে দিতাম সেই বেলি ফুলের গাছটিকে, যার সুবাসে ভরে যেত বাতাস। সাদা তুলোর মতো মেঘ, যার প্রান্তে সূর্যাস্তের আগুনরঙা কিরণ যেন সূচিশিল্পে অলংকৃত, আর তার ফাঁক দিয়ে— পেছনের উঠোনে দাঁড়ান একমাত্র কারি গাছের ডালপালার ফাঁকে গর্জনরত কালো কালো মেঘের ভেলা চোখে পড়ত, যেন তারা আকাশে উন্মত্ত হাতির মতো ছুটে চলেছে। এসব আমি মাঝখানের ঘরের জানালা দিয়ে দেখতাম। ঝরে পড়া মুক্তোর মালার মতো বৃষ্টির যে তীব্রতা আমি দেখেছিলাম – তা আজও আমার মনে আছে। আমার পা কখনোই সামনের উঠোন ছোঁয়নি, শুধু ঘরের চৌকাঠের ভিতরে, ঘরের মেঝেতেই ছিল তার ছাপ। আমার ঘোমটা একবারও মাথা থেকে খুলে পড়েনি। আমার চোখের পলক লজ্জায় ভরা ছিল। হাসি কখনো আমার ঠোঁট ছোঁয়নি, আর আমার চোখও কখনো মৌমাছির মতো চারদিকে ঘুরে বেড়ায়নি। এ কারণেই আম্মা আমার ওপর কঠোর নজর রাখতেন না। এটা করিস না, ওটা করিস না, এভাবে দাঁড়াবি না, ওরকম দেখিস না—কখনো এধরনের কথা বলার দরকার হয়নি তার। আমারও নানা কিছু চিন্তা করার অভ্যাস ছিল না।
তবুও, আমার একটা ছোট্ট প্রশ্ন আছে! এই সব, অর্থাৎ, এই ঝলমলে, সবুজ রঙের টিকটিকি, এখানে সেখানে ছড়িয়ে থাকা রঙ, ঝকঝকে পাথর, মাটির সুগন্ধ, হাওয়া, এই মিষ্টি গন্ধ, এই গাছপালা, খেত-জঙ্গল, গর্জনরত সাগর, এই বৃষ্টি, বৃষ্টিতে কাগজের নৌকা – এগুলো এমন কিছু নয়, যা আমি স্পর্শ করতে পারি, যার মধ্যে নিজেকে নিমগ্ন রাখতে পারি। আমি এদের গন্ধ নিতে পারি না, দেখতে পারি না, আমার মুখ আমি তুলতে পারি না। আপনি এই সবই দিয়েছেন তার জন্য, আপনার সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টির জন্য, তাই না? আমি যতদূর জানি – এটাই একমাত্র সত্য। তাই আমি বেশি দুষ্টুমি করিনি, কারণ এটা আপনার আদেশ, তাইতো প্রতিভাত হয়। আহা, আম্মা! আপনি আর কি বা করতে পারতেন?
তাই আমি কখনো প্রতিবাদ করিনি, আর আম্মার সব কথা শুনতাম। যেমন — তোমাকে বাধ্য হতে হবে; সে-ই তোমার জন্য ঈশ্বর, সে যা বলবে তাই করতে হবে, তার সেবা নিষ্ঠার সঙ্গে করতে হবে। এই কথাগুলো গভীরভাবে খোদাই হয়ে গিয়েছিল আমার মনে।
আর আব্বা? থাক, তাকে নিয়ে কিছু বলব না। যেদিন আম্মাকে ছেড়ে যেতে হল, মনে হয়েছিল কেউ যেন আমার হৃদয়টা ছিঁড়ে নিয়ে, হাতের তালুতে রেখে জোরে চেপে ধরেছে। আম্মাও কষ্টে পাচ্ছিলেন। তবু কিছু বলছিলেন না। তার ভেতরে যেন একটা করাত পাগলের মতো চলছিল । তবু চোখদুটো ঝলমল করছিল; শুধু কোণাগুলো ছিল ভেজা। হয়তো আপনি বুঝবেন। সবাই বলে যে, আমাদের জন্য আপনার মাঝে শত মায়ের ভালোবাসা বহমান; তাই এক মায়ের হৃদয়ের জ্বলন তো নিশ্চয়ই পৌঁছেছিল আপনার ভিতরের শত হৃদয়ে। কিন্তু আমি আপনাকে কোথাও দেখতে পাইনি। আমি ভীষণ ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। আম্মা আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরেছিলেন, তার শীতল হাত দিয়ে আমার জ্বলন্ত গালগুলো আস্তে আস্তে চাপড়ে দিচ্ছিলেন। কিন্তু ঠিক তখনই সে আমাকে আম্মার কোল থেকে টেনে নিয়ে গেল, নিয়ে চলে গেল দূরে। আমি যেন ছিলাম সোনালি-রূপালি কারুকাজ করা কাপড়ে জড়ানো এক দামী রত্ন।
আমি জানতাম, আম্মা কাঁদছিলেন। যতই দূরে চলে যাই না কেন, আম্মার কান্নার শব্দ আমার কানে ভেসে আসছিল ঠিকই। এইখানেও, একটা ছোট্ট প্রশ্ন: কি হতো যদি সে এসে আমাদের সঙ্গেই গাঁটছড়া বেঁধে থাকত? আপনি যখন এত অবসরে সৃষ্টি করেছিলেন জীবজগৎ, ফুলের ভেতরের সোনালি প্রলেপে মোড়া সূক্ষ্ণ সুতোয় গাঁথা অঙ্গ, এই অপূর্ব পুকুর-ঝিল, নদী-নালা – তখন কি একবারও সময় হয়নি আমার হৃদয়ের ভেতরটা উঁকি দিয়ে দেখার? আমার ভয়, আমার ইচ্ছা, স্বপ্ন আর হতাশাগুলো কি দেখতে পাননি?
আমার নিজের বলে আর কিছুই অবশিষ্ট ছিল না। অন্যের উঠোনেই আমাকে শেকড় গাঁথতে হল, সেখানে নতুন কুঁড়ি ফেলতে হল, সেখানে ফুল ফোটাতে হল। সে আস্তে আস্তে জড়িয়ে পড়ছিল, আর আমার অস্তিত্ব গলে মিলিয়ে যাচ্ছিল। আমার নামটাও হারিয়ে গিয়েছিল। জানেন, আমার নতুন নাম কী হয়েছিল? তার স্ত্রী।
আমার শরীর, আমার মন আমার ছিল না। অবিশ্বাস্য হলেও, সে আমার শরীরকে চাইত, সেটাই আমার কাছে তার ফিরে আসার শক্তি যা আমি নিজেও জানতাম না। সে আমাকে গ্রাস করেছিল। সেই বিশেষ মুহূর্তগুলো ছাড়া, আপনার প্রদত্ত ক্ষমতার শাসনদণ্ড সবসময় ঝলমল করত তার হাতে।
তার সমস্ত ধূর্ততা কোথা থেকে এসেছিল এবং কীভাবে, আমি তো তা জানি না। এক মুহূর্তে, সে আমার হৃদয় ছোট ছোট টুকরো করে ভেঙে দিতে পারত, আর প্রতিটা টুকরো ছড়িয়ে দিতে পারত বিভিন্ন কোণে। আমার শরীর ছিল তার খেলার মাঠ, আমার হৃদয় ছিল তার হাতের একটি খেলনা। এভাবেই আমি মলম লাগাতাম, আমার হৃদয় ঠিক করার চেষ্টা করতাম, তবুও সে ইচ্ছেমতো সেটাকে ভেঙে দিত। প্রভু, আমাকে কেন খেলনা হতে হল? তাকে আমি ঘৃণা করিনি, তাকে আমি আমার খেলনা হিসেবেও চাইনি। আমিতো তার মেরুদণ্ডের মতো সহায় হতে পারতাম, আর সে হতে পারত সেই হাত, যে হাত আমার অশ্রু মুছিয়ে দেবে…
সে আমাকে এক সপ্তাহেরও কম সময় ব্যবহার করেছিল; তারপর হঠাৎ পাগলের মতো চিৎকার করতে লাগল। আমি কে? আমার মর্যাদা কী? আমাকে লাখ টাকা দেওয়ার লোক আছে, আর আমি শেষ পর্যন্ত তোমার মতো এক ভিখারিকে বাড়ি নিয়ে এলাম!আমি কী উত্তর দিতাম? আম্মার উপদেশ মতো, আমি চুপ করে থাকলাম। সে আদেশ দিল, ‘তোমাকে এক্ষুনি তোমার মা-বাবার বাড়ি থেকে পঞ্চাশ হাজার টাকা নিয়ে আসতে হবে। না আনলে, আর কখনও এখানে পা ফেলতে পারবে না।’ আমি ফিরে এলাম আম্মার কাছে, ময়লা কাপড়ে মোড়া গহনার মতো।
আমাকে দেখে আম্মার মুখ আলোকিত হয়ে উঠল। তার চোখে যেন এক মুহূর্তে হাজার হাজার চাঁদ-সূর্য ঝলমল করে উঠল। কিন্তু আমার সাথে সে আসেনি দেখে চোখগুলো সঙ্গে সঙ্গেই ম্লান হয়ে গেল। আম্মা আমাকে কোমলভাবে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। কিন্তু পঞ্চাশ হাজার টাকার দাবি, আমার আনন্দে বাঁধা হয়ে উঠল। সেই রাতে যখন আম্মার পাশে শুয়েছিলাম, তখন বেশ শান্তি পেয়েছিলাম। কিন্তু কিছুক্ষণ পরই তার কথা মনে পড়ে গেল। আর আম্মার ভালোবাসায় গড়া হৃদয়ের দুর্গে যেন এক ক্ষত সৃষ্টি হল। সে এসেছিল অনেকটা চুপিসারে। এখানে তিন দিন থেকেছিল, তখন আমি ভয়ে ভয়ে অপেক্ষা করছিলাম। শেষপর্যন্ত সে জিজ্ঞেস করল, আমি টাকা পেয়েছি কি না। আমার বিবর্ণ মুখ দেখে বলল, ‘এখানে এবারই আমাদের শেষ আসা। এখানে তুমি আর ফিরে আসতে পারবে না; তোমার মা-বাবাও আর আমাদের বাড়িতে যেতে পারবে না।’
আম্মা আমাকে পেটভরে খাইয়ে দিলেন। তারপর সমস্ত হৃদয় দিয়ে যেন আশীর্বাদ করলেন, চুলের সব জট ছাড়িয়ে, যত্ন করে বেণি বেঁধে দিলেন – মনে হল যেন তার সমস্ত স্নেহভরা চুম্বন গেঁথে দিচ্ছেন তাতে। তিনি আমার চুলে যে গাঁদা ফুলের মালা বেঁধে দিলেন, সেটা তার মতোই সুবাসময়। গন্ধরাজ আর কণকচাঁপা যেন লুকোচুরি খেলছিল একে অপরের মাঝে। প্রতি সেকেন্ডে পিছন ফিরে আম্মার দিকে তাকিয়ে, অনিচ্ছুকভাবে, মাটি থেকে পা তুলে তুলে তার পিছনে হেঁটে যাচ্ছিলাম।
সে এমন না যে নিজের কথা ফিরিয়ে নেবে। তার অহংকারের কি একটুও সীমা থাকা উচিত ছিল না? তার সাথে, ওর বাড়িতে ফিরে যাওয়ার পর, তিন দিন পর্যন্ত আমি বেণি খুলিনি। ভয় হচ্ছিল, যদি আম্মার ভালোবাসার আদরগুলো হারিয়ে যায়। আমার মন ছিল আম্মার সঙ্গে বাঁধা, আর তার মন ছিল তার কথাই যেন শেষ কথা হয় – সেই জেদে বাঁধা। এরপর আম্মার সঙ্গে আমার আর কখনো দেখা হয়নি। এগুলো আপনাকে মনে করিয়ে দেওয়ারও প্রয়োজন নেই। আপনি তো সর্বজ্ঞ — আপনার হিসাবরক্ষকেরা প্রতিদিন এমন কোটি কোটি রিপোর্ট নিয়ে আসে – কিন্তু সেগুলো সব কলম দিয়ে লেখা। আর আমার এই রিপোর্টটা এসেছে হৃদয় থেকে, একজন নারীর হৃদয় থেকে লেখা চিঠি, লেখা হয়েছে হৃদয়ের ধারালো নিব আর রক্তের লাল কালি দিয়ে। সম্ভবত এ পর্যন্ত এমন কোনো অনুরোধ আপনার কাছে এসে পৌঁছায়নি, কারণ আপনার কোনো হিসাবরক্ষকেরই হয়তো আমার মতো হৃদয় নেই।
সব সময় আমার অবস্থা এমন যেন আমি একটি দরজা-জানালা বন্ধ আত্মার মধ্যে বন্দী হয়ে আছি। আমি আর কখনও আম্মা, আব্বা বা ছোট ভাইকে দেখিনি। একটা ক্ষীণ আশা ছিল, আম্মা নিশ্চুপ বসে থাকবেন না। আমি জানি, অনেকবার তিনি আমাকে দেখার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু সে এমন এক শক্ত দুর্গ গড়ে তুলেছিল যে আম্মার সব চেষ্টাই বৃথা গিয়েছিল। তার টাকার লোভ আমাদের সব বন্ধন, ভালোবাসা আর স্নেহকে গ্রাস করে নিয়েছিল। সে অন্ধ ছিল, কিন্তু নিজের অবস্থানে ছিল দৃঢ়।
অনেক প্রতিবেশী আমাকে উপদেশ দিত —সে যেমনটা চায়, আমি যেন তেমনটাই হই। আপনিও তো সেই একই কথা প্রচার করেছেন, যে সে-ই আমার ঈশ্বর, তার আদেশ মানাই আমার ধর্ম, এই পৃথিবীতে সে যে কোনো সময়, যে কোনো জায়গায়, যার সাথে খুশি দেখা করতে পারে। কিন্তু আমি? আপনিই তো বলেছেন— মাও ঈশ্বরের সমান, তার পায়ের নিচে স্বর্গ। তবু আমি তাঁকে আর একবারও দেখতে পাইনি। আপনি যদি ভাবেন, এই ছোট ছোট সমস্যাগুলো আমার চিন্তার সীমাবদ্ধতা, আপনি যদি মনে করেন আমার পুরো জীবনটা তিন ঘণ্টার একটি নাটক, আর আমি একজন অভিনেত্রী মাত্র – তবে একটি কথা মনে রাখবেন: আমার সুখ-দুঃখ কিন্তু ধার করা নয়। এগুলো অভিনয় করার জন্য নয়, অনুভব করার জন্য। আপনি যেন কেবল একজন নির্লিপ্ত পরিচালক। আপনারই সৃষ্ট একটি চরিত্র যখন আমার মনকে আঘাত করে, তখন কি আপনার কোনো দায়িত্ব থাকে না? কমপক্ষে একটিবার সান্ত্বনা দিন। বলুনতো, এসব কিছুর মধ্যে আমার দোষটা কোথায়?
সে কখনও জানতে চায়নি, আমি খেয়েছি কিনা বা পানি পান করেছি কিনা। কিন্তু সে চাষ করেছিল, বীজ বপন করেছিল। ভাঙা মন, আর ক্লান্ত আত্মা সত্ত্বেও শরীর প্রস্তুত ছিল, গর্ভ প্রস্তুত ছিল – আর তার ক্ষুধাও ছিল প্রবল। আমি নিজেই মা হওয়ার পথে ছিলাম, কিন্তু এক কোণে দাঁড়িয়ে সারাক্ষণ ফিরে তাকাতাম, আমার মা-বাবার বাড়ির পথের দিকে। দিগন্ত পর্যন্ত চোখ মেলে তাকালেও কোনো চেনা মুখ, কোনো চেনা আকার দেখতে পেতাম না। শুধু কিছু সবুজ স্মৃতির গাছ চোখে পড়ত, যেগুলো পাতা ঝরিয়ে ধীরে ধীরে খালি হয়ে যাচ্ছিল।
পরে জেনেছিলাম, আম্মা কোনোভাবে আব্বাকে রাজি করিয়ে, বাড়ির সব কিছু বিক্রি করে, বিশ হাজার টাকার মোড়ক নিয়ে আমাদের বাড়িতে আসার জন্য রওনা দিয়েছিলেন। সেদিন কাক ডাকছিল, ডান চোখ কাঁপছিল, উনুনে গুনগুন শব্দ হচ্ছিল। হয়তো আম্মা আসতেন। আম্মা রওনাও দিয়েছিলেন – কিন্তু পৌঁছালেন না। কোথাও একটা দুর্ঘটনা ঘটেছিল। এতেই সব শেষ হয়ে গেল। সে আমাকে যেতে দেয়নি, আম্মার দেহ দেখতে দেয়নি। বরং নিশ্চিত করেছিল যাতে, যা কিছু ঘটেছে, আমি যেন সেটা জানতে না পারি।
এখানে, আমাদের শহরের বড় হাসপাতালে, তারা মনে হয় আম্মার মৃতদেহ কেটে দেখেছিল। তারা হয়তো আম্মার হৃদয়টা কাটেনি। তবে কাটলে, তারা জমাট রক্ত পেত না, তার বদলে পেত একটা জমাট আত্মা, অসংখ্য অভেদ্য লক্ষ্মণ রেখা, আর কয়েক ডজন অগ্নিপরীক্ষার দাগ। তবে এটা সত্য – বেঁচে থাকতেই যদি আম্মার শরীর টুকরো টুকরো হয়ে গিয়েও থাকে, মারা যাওয়ার পর তার হৃদয়ে কেউ হাত দেয়নি। তার আত্মাকেও নয়। তার চোখ খোলা ছিল। আমি ভাবি, কাকে দেখার আশায় তিনি চেয়েছিলেন? অপেক্ষায় থাকা সেই দুর্ভাগা চোখ দুটি মনে হয় কারো আগমনের প্রতীক্ষায় খোলা রয়ে গিয়েছিল।
এখান থেকে, ওখান থেকে, জানালা দিয়ে, ভেন্টিলেটরের ফাঁক দিয়ে – শুনেছি যে, সে সবকিছু দেখার জন্য গিয়েছিল, কিন্তু তার জেদ রয়ে গেল। শুনেছি, আব্বা, আম্মার মৃতদেহের পাশে বসে, আম্মার কোমরে বেঁধে রাখা বিশ হাজার টাকার মোড়ক খুলে নিয়ে তার হাতে ধরিয়ে দিয়েছিলেন। শুনেছি আব্বা আকুতি করেছিলেন, ‘অন্তত এখন ওকে এখানে নিয়ে আসো।’ সে আমাকে এসব কিছুই জানায়নি, আমাকে সেখানে নিয়েও যায়নি।
একটি কন্যা সন্তানের জন্ম হল, তার মুখটা ঠিক আম্মার মতো, তার চোখ গভীর পুকুরের মতো। আম্মার মতোই আমি তাকে কোলে নেই, জড়িয়ে ধরি, আর খেলা করি। আমার চোখ থেকে অশ্রু ঝরে না অথবা চোখের জলে কোনো পুকুর কিংবা নদী গড়ে উঠে না। বরং, সেই জল, আমার চোখের প্রান্তে কুয়াশার মতো ঝলমল করে। আপনার বিস্ময়কর উপহারের জন্য ধন্যবাদ; আপনি আমাকে ভুলে যাওয়ার শক্তি আর দৃঢ়তা দিয়েছিলেন। পুরনো স্মৃতির শীতল বাতাস, জীবনের মরুভূমিতে যেন এক শান্তির পরশ এনে দিয়েছিল। আমি তখনো বুকের দুধ খাওয়াতাম, সেই সময় আবার গর্ভবতী হয়ে পড়লাম। মেয়ে যখন কোলে, তখন আরেকটি কোমল পায়ের লাথি আর ছোট্ট হৃদয়ের স্পন্দন আমার অন্তরে গেঁথে গিয়েছিল।
আমি ভীষণ অস্থির হয়ে পড়েছিলাম। সে গোঁফে তা দিয়ে বলল, ‘ওদের তো আমি মানুষ করছি, তোমার জন্ম দিতে কী অসুবিধে?’ বেচারা, যা বলছে, কথাটা তার দিক থেকে ভুল নয়। কিন্তু আপনি যদি একবারও তাকে সন্তানের জন্ম দেওয়ার কষ্টের কথা বলতেন, হয়তো এই কথাগুলো তার মুখ থেকে বের হতো না। যেমন সহজে কেউ গলা খাঁকারি দেয়, যেমন সহজে কেউ প্রস্রাব করে চাপ কমায়, তেমন সহজেই আপনি এক সরল প্রাণী সৃষ্টি করেছেন – অহংকারী এবং সুখী; আর আপনি এখন নির্লিপ্ত।তাকে কি রক্ত-মাংসের যে যন্ত্রণা তার মধ্যে ফেলে দেওয়া উচিত? তার হাড়ের লবণ কি গুঁড়ো করে গর্ভকে খাওয়ানো উচিত? কেবল রক্ত-মাংসের মাঝখানে নয়, এমন এক যন্ত্রণার অভিজ্ঞতাও কি তাকে দেওয়া উচিত, যাতে তার পাঁজর ভেঙে দেওয়ার মতো ব্যথা হয়? যদি অন্তত একবার তার নিজের এই অভিজ্ঞতা হতো! না, আমি এই প্রশ্নগুলি করার সুযোগ পাই না, কারণ আপনি সৃষ্টিকর্তা, আর সে আপনার প্রিয় সৃষ্টি। তাহলে আমি কি আপনার প্রেমহীন, অবহেলিত এক সৃষ্টি?
যখন ছেলের জন্ম হলো, তার আনন্দের সীমা রইল না। যদিও আমি খুশি হইনি, তবু চিন্তা করে একটু শান্তি পেয়েছিলাম যে, আমার মধ্য দিয়ে, আমার মতন আর এক দুর্বল, অসহায় জীবন-বন্দীর জন্ম হয়নি। এমন একজন মানুষ আসেনি যাকে আমার মতো করুণভাবে, অনিশ্চয়তার ভিতর দিয়ে বাঁচতে হবে – বরং এসেছে একজন ছেলে, যে পৌরুষের দম্ভে এগিয়ে যেতে পারবে!
মেয়ের ওপর আমি আরও বেশি ভালোবাসা ঢেলে দিলাম।
ছেলেমেয়ে দুজনেই বড় হতে লাগল। আর তার অবস্থান, তার শ্রেষ্ঠত্ববোধ, অহংকার – সবকিছু যেন ডিম পেড়ে বংশবৃদ্ধি করতে থাকল। আমি ধীরে ধীরে পরিণত হলাম এক আজ্ঞাবহ দাসীতে; ওটাই ছিল আমার একমাত্র পথ। দুনিয়াকে কিছু না দিয়ে, দুনিয়া থেকে কিছু না পেয়ে, সামাজিক সম্পর্কের কোনো চেতনা ছাড়াই, নামহীন, ব্যক্তিত্বহীন এক সত্তা হয়ে, আমি ছিলাম শুধুই ‘তার স্ত্রী’ অর্থাৎ, বিনামূল্যের একজন শ্রমিক। তার সুরক্ষা বলয় ছাড়া থাকলে আমার কী হতে পারে, রাতে সেটা কল্পনা করে আমার শরীর কাঁপতে শুরু করত। সে ছাড়া আমি কিছুই নই – এই নির্মম সত্য আমার চোখের সামনে সবসময় ভেসে উঠত। আমি ছিলাম কেবল একটি ছায়া। শুরুতে এই বাস্তবতাকে মেনে নিতে পারিনি। আমার ভেতরে নীরবে চলত অনেক দ্বন্দ্ব। তাকে ছাড়া ভবিষ্যতের বিন্দুমাত্র কল্পনায় আমি আতঙ্কিত হয়ে পড়তাম। এই অবস্থাটা কল্পনা করতেও ভয় লাগত। আমি ছিলাম এক দাসী – শ্রমের বিনিময়ে যে আমাকে খাবার, পানি আর আশ্রয় দিয়েছে, তাকে আমার মনে হতো যেন এক মহাত্মা।
এভাবেই হয়তো চলতে পারত, শেষ পর্যন্ত আমি হয়তো ছেলেমেয়েদের বিয়ে দিয়ে, তারপর আম্মার মতোই একদিন মারা যেতাম। কিন্তু একদিন, সে আমাকে হাসপাতালে ভর্তি করাল। আমার পেটে নাকি একটা টিউমার বড় হচ্ছে। ডাক্তাররা অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করলেন, বললেন অপারেশন করতে হবে। তার মুখটা এমনভাবে কুঁচকে গেল, যেন আমার ওপর রাগ হয়েছে। তবে ডাক্তারদের সামনে সে কিছুই বলল না। অপারেশন শেষ হওয়ার পর, সে ফিরে এসে কেবল দাঁড়িয়ে রইল। তারপর আদেশ দিল, ‘তোমার গলার চেইনটা দাও।’ এই চেইনটা নিয়ে দু-একটা কথা বলা দরকার। আম্মা এটা বানিয়ে দিয়েছিলেন, আমার বিয়ের সময় – দুই সুতোর এক চেইন। এই চেইনটা আম্মা নিজের বিয়ের সময় তার মায়ের দেওয়া সোনা গলিয়ে বানিয়ে দিয়েছিলেন। আম্মার কথা মনে করে আমি এটা সব সময় পরে থাকতাম। এই কারণেই মন চাইছিল না চেইনটা তাকে দিয়ে দিই।আমি তোতলাতে তোতলাতে জিজ্ঞেস করলাম, ‘এখন কেন চাইছো?’ আমার জীবনে সম্ভবত এটাই ছিল প্রথমবার, যখন আমি তাকে কোনো প্রশ্ন করেছিলাম। একটুও দয়া বা দ্বিধা না করে, একেবারে নির্লিপ্তভাবে সে উত্তর দিল, ‘আমি আবার বিয়ে করতে যাচ্ছি। নতুন মেয়েটিকে দিতে চাই এটা।’ অন্ধকার আমাকে ঘিরে ধরল। গ্লুকোজের বোতলগুলো ছুঁড়ে ফেলে পালিয়ে যাবো কি? কোথায় যাবো? তাকে কি থাপ্পড় মারবো? ছিঃ সেটা তো অসম্ভব। ছেলেমেয়েদের কী হবে? আমার নিজের ঘরের চার দেওয়ালও যদি আমাকে বন্ধ করে দেয় – এই ভয় চোখের সামনে বাস্তব হয়ে দাঁড়াল, আমি ভেঙে পড়লাম।
চেইনটা যেন আমার জীবন, এমন ভাবে বাঁ হাতে চেইনটা ধরে বললাম, ‘এটা তোমাকে দেবো না।’ সে অবাক হয়ে গেল, এটা সে প্রত্যাশা করেনি। ঘৃণার চোখে সে আমার দিকে তাকাল। আমার অস্বীকৃতি, তার জন্য চেইন না পাওয়ার চেয়েও বেশি অপমানজনক ছিল। সে জ্বলে উঠল, প্রতিশোধ নিতে চাইল। চেঁচিয়ে বলল ‘ও! তুমি ভাবছ চেইনটা না দিলে আমি বিয়ে করতে পারব না, না?!’ ভীত স্বরে আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘এখন কেন আবার বিয়ে করতে চাও?’ ‘তোমাকে ব্যাখ্যা দিতে হবে নাকি? শোনো তাহলে। আমি আর আমার জীবন তোমার মতো এক ভিখারির সঙ্গে থেকে নষ্ট করতে চাই না। অসুস্থ মানুষের কোনো মূল্য নেই। আমি ভালো একটি পরিবারের, ভালো একটি মেয়েকে বিয়ে করছি।’ আপনি আমাকে, অনেক কষ্ট সহ্য করার শক্তি দিয়েছেন। তাই বলে তাকে আপনার এত নিষ্ঠুরতা দেওয়া উচিত হয়নি, যাতে সে এত কষ্ট দিতে পারে। সহ্যের তো একটা সীমা থাকা উচিত, তাই না? ধৈর্যই ছিল আমার জীবনের মন্ত্র, তবুও আমি অসহায়ের মত ভেঙে পড়লাম।
আমি কিছু বলার আগেই সে বলে উঠল, ‘আরও শুনতে চাও? তোমার থেকে আমি কী সুখ পেয়েছি? যখনই তোমাকে ছুঁয়েছি, তুমি যেন এক মৃতদেহের মতো পড়ে থেকেছ। তাই আমি আবার বিয়ে করছি।’
সহজ করে ভাবার ক্ষমতা আমি হারিয়ে ফেলেছিলাম। আমার শব্দগুলো নিঃশব্দতায় রূপ নিয়েছিল। চোখের পাতার আড়ালে কুয়াশার মতো জল জমেছিল। আমাকে যেন আবর্জনার মতো রাস্তায় ছুঁড়ে ফেলা হচ্ছিল, আর আমার ভেতরটা রাগে ফেটে পড়ছিল। আমি বিছানা থেকে উঠে দাঁড়াতে চাইছিলাম, কিন্তু পারছিলাম না।
ধীরে ধীরে ভাবতে শুরু করলাম। আমি কি আদৌ ওকে থামাতে পারতাম? এতদিন তার বিশ্বস্ত দাসীর মতো কাটিয়ে দিয়েছি, আর এই পুরো সময়ে আমি হয়তো মাত্র তিন-চারটা সাধারণ প্রশ্ন করেছি। আর সেই প্রশ্নগুলোর জবাবে আমি পেয়েছি হাজারো তীব্র প্রতিক্রিয়া।
‘ শোনো, তুমি তো অসুস্থ। ও যদি আবার বিয়ে করতে চায়, করতে দাও।’ আরেকজন বলেছে, ‘আরে, এসব স্বাভাবিক, ও তো পুরুষ—শুধু একটা না, চারটা বিয়ে করলেও কিছু বলার নেই তোমার।’ আর কিছু লোক মুখের নিচে গোঁফ চেপে ধরে কৃত্রিম সহানুভূতিতে বলেছে, ‘এই যে আপা, ওর যদি বিয়ে করতে মন চায়, করতে দাও। তুমি বরং একটা কেস ফাইল করো—মাসে মাসে যেন তোমার জন্য কিছু টাকা দেয়। মামলার রায় আসতে তো চার-পাঁচ বছর লেগে যাবে। ততদিন কিছু কাজকর্ম বা দিন মজুরির কাজ যোগাড় করে নাও।’ তার মানে ও যেটা করছে সমাজ সেটা মেনে নিয়েছে। তারা এমনকি আমাকে তার কাজে সহায়তাও করতে বলছে! আপনারই নাম করে সে সব করে, কারণ আমি আপনার এক অপূর্ণ সৃষ্টি, হে ঈশ্বর! আপনি কি শুনছেন আমার অভিযোগ? আমার কান্নার আওয়াজ কি পৌঁছাচ্ছে আপনার কাছে? আমি কী করব . . . আমি কী করব . . .
সে গত তিন দিন ধরে হাসপাতালে আসেনি। হাসপাতালে দেওয়া খাবার, আমার সন্তানরা আর আমি ভাগাভাগি করে খেয়েছি। এখন ডাক্তাররা আমাকে ছেড়ে দেওয়ার পর সেটাও নেই। আমি বাচ্চাদের নিয়ে অনেক কষ্ট করে বাড়ির দিকে রওনা দিলাম। সামনের দরজায় একটা মোটা তালা ঝুলছে। ঘরের সামনে নারকেল পাতার সবুজ ছাউনিতে শব্দ হচ্ছে। বাড়িতে কেউ নেই। প্রতিবেশিরা একটু উঁকি দিয়ে দেখে অদৃশ্য হয়ে গেছে। বাচ্চারা আমার কোলের কাছে গুটিয়ে বসেছে। দিন চলে গেছে, রাত নেমে এসেছে, অথচ আমরা বাড়ির সামনে বসে রইলাম।
মনের আর বাড়ির দরজাগুলো বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। অন্ধকার আরও গভীর হচ্ছিল। আমার অসহায় অবস্থা দেখে, বাচ্চারা ক্ষুধার কথা বলছিল না। আমার পা জড় হয়ে যাওয়ায়, আমি পা ছড়িয়ে দিলাম। শিশুরা আমার কাছে গুটিয়ে শুয়ে পড়ল। আমি আধা ঘুমেই ছিলাম, সময় কতটা হয়েছে বুঝতে পারছিলাম না। হঠাৎ আমার হৃদয়কে জ্বালিয়ে দেওয়ার মতো একটি চিৎকার শুনতে পেলাম, তখন চোখ খুলতেই দেখি, আমার ছেলে, যে আমার পাশেই ঘুমিয়ে ছিল, খালের মধ্যে পড়ে গেছে। এক লাফে, ঝাঁপ দিয়ে আমি তার কাদায় লেপা শরীরটিকে জড়িয়ে ধরলাম। ঠিক তখনই শুনলাম ছাউনির নিচে একটি টেম্পোর থেমে যাওয়ার শব্দ, মানুষের আওয়াজ, উৎসবের উচ্ছ্বাস আর কোলাহল। সে নেমে এল। টেম্পোর পেছনের দরজা থেকে তার অতিরিক্ত শক্তিশালী হাতে সে একটি লাল পোশাক পরা নারীকে তুলে নিল, সোনার কাজ করা সোনালি কাপড়ে মোড়ানো এক মূল্যবান রত্নের মতো। সে সোজা, দৃঢ় পায়ের ছাপ ফেলে এগিয়ে চলছিল। ঘরের সামনের দরজা খুলে গেল। সবাই তার সঙ্গে ছিল। আমার ছেলে কাঁপতে লাগল এবং আমাকে জড়িয়ে ধরল। আমি বিস্মিত চোখে সব দেখছিলাম।
হৃদয়ের রক্তমাখা আমার কলমের নিব ভেঙে গেছে। আমার মুখ আর কথা বলতে পারে না। লেখার জন্য আর কোনো অক্ষর আমার নেই। ধৈর্যের মানে আমি জানি না। যদি আপনি আবার পৃথিবী সৃষ্টি করেন, পুরুষ এবং নারী আবার গড়েন, তাহলে অভিজ্ঞতাহীন কুমোরের মত বানিয়েন না। ঈশ্বর, এই পৃথিবীতে একজন নারী হয়ে আসবেন!
একবার নারী হও, হে ঈশ্বর!
গল্পটি দীপা ভাস্তি অনূদিত ইংরেজি থেকে অনুবাদ করা
খোদেজা সুলতানা লোপা
একটি আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থায় কর্মরত। তাঁর পেশাগত আগ্রহের বিষয় জেন্ডার সমতা, মানবাধিকার এবং জলবায়ু ন্যায়বিচার। কাজের বাইরে তিনি ভ্রমণ ও ফটোগ্রাফি করতে ভালোবাসেন, যা তাঁকে পৃথিবীকে নতুন দৃষ্টিতে দেখার ও জানার সুযোগ করে দেয়।