“এখন নির্দয় শীতকাল, ঠাণ্ডা নামছে হিম…”
“ … হিম নামে যেন শব্দ করে, বাতাস আসে শিরশির, খড়মড় করে উড়ে যায় বাদাম খোলা…।”
বলে, তিনি আমাদের ছাপোষা সংসারের কৃত্রিম ঢাকনাটা দমকা বাতাসে সরিয়ে দিলেন। শুরু হলো নির্দয় শীতের মতই লক্ষ্যভেদী, হিম শিরশির, কর্কশ এক আখ্যান। সেখানে পরাজিত, পলাতক, ভ্রষ্টচারী আর কীটদুষ্ট সমাজ পলে পলে উঁকি দেয়, কথা কয়। পথের বাঁকে চোখ পাকিয়ে থাকে ক্লেদজ কুসুম। একটুও আশার আলো নেই তাতে। সেখানে গায়ের নির্জন হিমরাতে শঙ্খচূড়ের মত পথের দু’পাশে জড় বা চেতন অস্তিত্বের পারিপার্শিক। সকলই কেমন ঘোরলাগা- পরাবাস্তব মনে হয়। হিম ঝকঝক করা রাহাত খানের টিনের চাল, কুঁড়েঘরের পৈঠা, মুরগিশিকারী শিয়াল, খঞ্জনির ঝনঝনানি, খাদের আসশ্যাওড়ার পাতা থেকে চলকে ওঠা আলো। এমন রাতে ট্রানজিস্টারে কণিকার সুর বেমানান লাগে- “খারাপ লাগতিছে গানডা”। ইনামের অনুরোধে কণিকার গলা টিপে দেয় ফেকু। বরং, অন্ধকার পথে সুহাস ফেকু আর ইনামের কাটা কাটা শ্লেষমাখা আলাপচারিতা চলতে থাকে। ফেকুর বিতিকিচ্ছি মুখ, ঘোড়ার মত ঝুলে পড়া কালো ঠোঁট- বিড়ির ঘন ধোঁয়া। বই বগলে তারাপদ মাস্টার শালাও জোকার একটা! সুহাসের কয়েক কাঠি বাড়িয়ে বলা গল্প উদগ্র অবচেতনার রসে মাখামখি হয়। ইনামের একেবারে অসহ্য লাগলে মনে মনে বিরক্ত হয়- “নাপিত বিটা কমিয়ে কতি পারে না?”
চারপাশের সব কিছু কেমন খটখটে, খেলো বা ম্যাড়ম্যাড়ে, বিতিচ্ছিরি- কেউ স্বপ্নভুক হতেও চায় না যেন। ঋজু মেদহীন উপমা তাই এগিয়ে চলে এই পর্যন্ত যে, “লেহাপড়ার মুহি পেচ্ছাপ…”। এইভাবে নাতিদীর্ঘ এক পঙ্কিল জীবনচক্র মন্থন করে শেষমেষ তিনি দেখালেন, করবী ফুলের হৃদয়ে জহরের যে অনু তা হিমঠাণ্ডায় দানা বাঁধছে আমাদের হৃদয়ে…
জীবনের ভাঙচুর চলছে- সম্বলহীন পলাতক জীবনের ভাঙচুর। সাতচল্লিশে দেশান্তরিত বৃদ্ধের পরিবার। ঘোর গায়ে বসতি কিন্তু শুকনো দেশের লোক বলে অন্ন জোটানোর এখানকার কায়দা জানেন না। ফলে বুড়ো শ্লেষ্মা ওঠা গলায় গালাগালি করে অন্ধকারকে ফাঁড়েন…চুপ, চুপ, মাগী চুপ কর, কুত্তী- এবং সমস্ত চুপ করে যায়। এভাবেই শ্লেষ্মার উদগীরণের মধ্যেই বুড়ো উঠোনে করবী ফুলের গাছ লাগানোর ইতিবৃত্ত জানান- “আমি একটা করবী গাছ লাগাই বুঝেছ…ফুলের জন্যে নয়… বিচির জন্যে… চমৎকার বিষ হয় করবী ফুলের বিচিতে…”
এইভাবে হাসান কিরীচের মত ধারালো আলোয় দেখিয়ে দিলেন প্রকৃত বাস্তুসংসার। ভাঙা আয়নার মত ব্রাত্য জীবনের অবিন্যস্ত টুকরো থেকে উৎকট বিশ্রী প্রতিরূপ কিভাবে দাপিয়ে বেরোয় চারপাশে। কোনোকিছুই আড়াল করার চেষ্টা করেন না তিনি। তখন বোঝা যায়, চিনির প্রলেপ দেয়া উপরিকাঠামোর তলে কি বিস্বাদ, তেতো অন্তরাত্মা লুকিয়ে! সেই ষাটের দশকে মাত্র ২৮ বছর বয়সের যুবক হাসানের কলম থেকে যখন আত্মজা ও একটি করবী গাছ-এর মত তোলপাড় করা একটি গল্প রচিত হয় তখন তাঁকে বাংলা ছোটগল্পের বরপুত্র ছাড়া আর কি বলা যায়!
এরপর তিনি একে একে জীবন ঘষে সব আগুন জ্বালালেন। সমুদ্রের স্বপ্ন শীতের অরণ্য (১৯৬৪), আত্মজা ও একটি করবী গাছ (১৯৬৭), জীবন ঘষে আগুন (১৯৭৩), নামহীন গোত্রহীন (১৯৭৫), পাতালে হাসপাতালে (১৯৮১), মা-মেয়ের সংসার (১৯৯৭), রাঢ়বঙ্গের গল্প (১৯৯১) – এরকম একের পর এক ছোটগল্পের ঝুড়ি। প্রবন্ধগ্রন্থ আছে, উপন্যাস আছে- আত্মজীবনীও আছে।
গতরাতে আমাদের প্রিয় হাসানের গল্পের হাত চিরতরে থেমে গেছে। জীবনের নশ্বরতা তো অনিবার্য। তবে সৃষ্টির অমরত্বও অনিবার্য বটে। সেই অমরত্বের প্রাসাদে তাঁকে আমাদের খুঁজে নিতে হবে। হাসান আজিজুল হক আমাদের কথাসাহিতের এক অনুপম বাঁক সৃষ্টির কথাশিল্পী। ষাট থেকে নব্বই- কি দাপুটে সব কাহিনির কালাকার তিনি! তাঁর শারীরিক মৃত্যুতে বাংলা ছোটগল্পের একটি সুবর্ণযুগের পরিসমাপ্তি ঘটল।
… এখন নারকেল গাছের মাথায় চাঁদ ফুটে আছে কিনা জানিনা। হয়ত আছে- চকচকে হিমশাদা চৌদ্দআনা চাঁদ, নয়ত নেই। বা আশপাশে কলার পাতাও নেই যা একবার বুক দেখাবে আর একবার পিঠ… তবে তাঁর গল্পের মতন নিরালম্ব জীবন নিত্যই চারপাশে গিজগিজ করে। আজ তার দেখা মিললো।
… একজন ছিল পাশের বাড়িতে, অভাবী ঘরের মাঝবয়েসী বউ- বিয়েবাড়িতে বড় জৌলুসের গীত গাইতো। নেচে নেচে। হলুদের প্রায় খালি জীর্ণ ডালা গামছায় আড়াল করে মাথায় নিয়ে নাচতো। তখন উঠোনটা খিল খিল করে হাসতো। গীতটাই ছিল জৌলুসের; বাকি সব জোড়াতালি, বিবর্ণ। তাই ওর কদর। এখন হাসপাতালে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে। হাসপাতালে চিকিৎসা চলে, ফেলো কড়ি মাখো তেল এই নীতিতে। ঔষধ নেই, পরীক্ষা নেই! সরকারী হাসপাতালেও ওদের সয় না, সকাল-বিকাল খরচা লাগে। এ ক’দিনেই দেনা হয়ে গেছে বেশ! তাই সে মরে যাবেও বলে ঠিক করে রেখেছে পরিবারের লোকজনে। পড়শীরাও। বাড়ি ফিরিয়ে এনে কিছু ভালোমন্দ খাওয়িয়ে বিদেয় দিতে চাইছে। বৌটি নিজেও জানে সে মরবে। সকালে আমিও জানতে পেলাম।
এখন অগ্রহায়ণের এই শুরুতে রংপুর কি রাজশাহীতে হিমঠান্ডা নামি নামি করছে। গতরাত থেকে মনটা ভারী হয়ে আছে। এখন এইসব নির্দয়, হিম, ফ্যাকাশে কথা ছাড়া আর কি বলা যায়! যদিও কীর্তিমানের মৃত্যু তো থেমে যাওয়া বা বিলুপ্ত হওয়া না। তিনি বাংলা সাহিত্যে সগৌরবে টিকে রইবেন। হাসান আজিজুল হক। আমাদের কালের মহান এক কথা-কালাকার। বাংলা কথাসাহিত্যে অর্ধশতকেরও বেশি সময় ধরে কালজয়ী সব সৃষ্টি। করবী ফুলের হৃদয় ছিল তাঁর, জহরের ওম লাগা। সাতচল্লিশের দেশভাগে খণ্ডিত শৈশব। কৈশোরে সেই রাঢ়বঙ্গ থেকে পূর্ববঙ্গে ঠাঁই-খুলনার ফুলতলায়। জন্মভিটের স্মৃৃতি বয়ে বেড়ালেন সারাজীবন। বাইরের স্বরূপটা হাসিখুশি, অনেক সফলতা তাঁর জীবনে। বিস্তর অভিজ্ঞতাবাদী জ্ঞান ভাণ্ডার। কথায় আলাপে প্রাণবন্ত। কিন্তু কলম ধরতে গেলেই অতল থেকে উঠে আসে অমসৃণ আর বঙ্কিম সব আকর- প্রায়শই সাধারণ্যের জীবনের মূল আদলটা যেমন থাকে। জীবন নিড়াংনো করবী ফুলের নির্যাস। সেটাই যত্নে ফুটিয়ে তোলেন। কৃত্রিম অবয়ব তৈরি করে নিজেকে খেলো করার চেষ্টা করেননি কখনো।
হাসানের গল্পের ক্লেদাক্ত সমাজ, ক্ষমতাহীনের অসহায়ত্ব চোখের সামনে ভেসে উঠছে। যান্ত্রিকভাবে ব্রাত্যজীবনের শুধু বঞ্চনার চিত্র নয়, ব্যক্তিক বা সামজিক অবিমৃষ্যকারিতার আদলটিও কি পরম যত্নেই না তিনি মাটি খুঁড়ে বের করে দেখালেন! এইখানেই তাঁর স্বাতন্ত্র্যতা।