Home » উনিশশো তিয়াত্তরের একটি সকাল // আহমদ বশীর

উনিশশো তিয়াত্তরের একটি সকাল // আহমদ বশীর

কোলকাতার থিয়েটার রোডের সেই দৃশ্য মনে আছে? আমার মনে হয় থিয়েটার রোড থেকেই যেন দেশের ভবিষ্যতটা রচনা হয়ে গিয়েছিলো। হঠাৎ এই কথাটা মনে এলো কেন? মাথার ভেতরে যেন শত-সহস্র মৌমাছি গুনগুন শব্দ করতে থাকে। দুই বছর হলো দেশটা স্বাধীন হয়েছে। বিভক্তি. . ভাংগা-গড়া থাকতেই পারে, কিন্তু এরকম রক্তারক্তি?…জয়ন্তর মনে হলো চিৎকার দিয়ে বলে, আমার আর রক্ত দেখতে ইচ্ছা করে না, প্লিজ..
কালকের সকালটা খুব ভয়াবহ। জয়ন্ত বললো।
ওরা কি আজকে এ্যাটাক করতে পারে? আমার বিশ্বাস হয় না। জামিল প্রায় আতঙ্কিত স্বরে বলে ওঠে।
বিশ্বাস না করে উপায় আছে? শামসু ভাইয়ের কাছে খবর এসেছে ওরা নাকি ফতুল্লা থেকে লোক ভাড়া করে আনবে। শোন পার্টির সবাইতো এখনো শত্রু হয়নি। ওদের সাথে চলে আবার আমাদের কাছে খবরাখবর দেয়, এরকম ব›ধুওতো আছে। ওরাই সংবাদ দিয়েছে।
তাহলেও, কেন জানি আমার বিশ্বাস হয় না। আমরা একসাথে ছিলাম। কত দিন, কত রাত ..একই পার্টির ছায়াতলে। আর এখন ওরা আমাদের ওপর হাত তুলবে ! আমার বিশ্বাস হয় না।
বিভক্তি! সেপারেশন। থিয়েটার রোডের সেই দৃশ্য মনে আছে? আমার মনে হয় থিয়েটার রোড থেকেই যেন দেশের ভবিষ্যতটা রচনা হয়ে গিয়েছিলো।
থিয়েটার রোডে ?
মনে নাই? শরণার্থী সরকারের সেই অফিস। ১৯৭১-এ থিয়েটার রোডে সেদিন দুই দিকে দুই নেতৃত্ব, মাঝখানে কর্নেল…সত্যি করে বল? সেদিন কর্নেল কি পেরেছিলো দুই শক্তিকে একত্রিত করতে?
একটা মীমাংসার মতো ..

দোতলা থেকে ডাকলে নিচে খুব তাড়াতাড়ি শব্দ পৌঁছয় না। তাই জামিল খুব উচ্চস্বরে ডাকলো, আবদুল! আবদুল। আবদুল নিচে থেকে উত্তর দেয়, জি জ্যার।
কেউ আইলে উরফে পাঠায়া দিয়। বুজ্ছস।
হ’
বিশাল বাড়িটা গমগম প্রতিধ্বনি শোনে। বাইরে বসন্ত রাত্রির ঠা-া হাওয়া পাতাবাহারকে কাঁপিয়ে দেয়, তখন সহসাই বন্দুকের শব্দ, বারুদের ঘ্রাণ আর দূরাগত স্লোগানের স্বর যেন সমস্ত ঢাকা শহরের অস্থির হৃদয়টাকে নিয়ে নেড়েচেড়ে খেলতে থাকে।
চারমিনার সিগারেটের প্যাকেটটাই ইজ দ্য মেইন ফ্যাক্টর। বুঝলি! সময় ঠিক থাকলে রেজুলিউশনের বারোটা বাজাতে পারতো না কেউ। জামিল সিগারেট জ্বালিয়ে ধোয়ার মধ্যে আত্মপ্রতিকৃতি খোঁজে। ঢাকা শহরে বসে চারমিনার সিগারেট খাওয়া, সিক্সটিনাইনে তুই কল্পনা করতে পারতিস জয়ন্ত? ইন্ডিয়ান জিনিসপত্র এখন… অর্থনীতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে…।
জয়ন্ত, চশমাপরা লোকটা, যেন দীর্ঘশ্বাস ফেললো। তুই যাই বলিস। সিক্সটিনাইনের গণ-অভ্যূত্থান নিয়ে কিন্তু আমি একটা থিসিস লিখবো দোস্ত।’
থিসিস!জামিল হেসে ফেলে। ‘ওসব থিসিস লিখ্যা কিছু হবে না দোস্ত। অহন দরকার অন্য কিছু।
তার মানে? তুই কি বলতে চাস, ইতিহাসের বিশ্লেষণটা একেবারেই অপ্রয়োজনীয়?
না, না। আমি ঠিক সেরকম মিন করিনি। আমি বিশ্বাস করি কালেকটিভ কনশাসনেসে। গোলাপী শেড দেওয়া টেবিল ল্যাম্পের আলো জয়ন্তর কণ্ঠস্বর প্রত্যাখ্যান করে না, জয়ন্ত তার বিশ্বাসকে মেলে ধরে। আমি আসলে বলতে চাইÑ আমাদের এখন দরকার একটা যৌথ সিদ্ধান্ত…।
পিপল কি আসলেই কনশাস? জামিলের মাথার মধ্যে ঘূর্ণিচক্রের মতো নাচতে থাকে ভাবনা: সে জানে ওরা আসলে পা বাড়ানোর জন্য যুক্তি যুক্তি খাড়া করছে। কথাটা সে বহুদিন ধরে ভেবে রেখেছিলো আজ বললো, আসলে আমি বলতে চাই, আমাদের একটা সিদ্ধান্ত দরকার। দিস্ আর দ্যাট আমাদের দরকার…’
জয়ন্ত হাত নেড়ে থামিয়ে দেয়। ‘আহ হা। শামসু ভাই এলে তোকে সব কথা বুঝিয়ে বলবে। পুরানো পার্টির সঙ্গে থাকলে আমাদের সামনে হতাশা ছাড়া আর কিছু থাকবে না। শামসু ভাই বলেছেন, গণতন্ত্রে ক্ষমতা জিনিসটাই বাই-রোটেশনে আসে, শামসু ভাইকে আসতে দে।’ হাতঘড়ির দিকে তাকালো জয়ন্ত। আর ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই উনি চলে আসবে।
থিয়েটার রোডেই তো সেই ডিভিশনটা দেখলাম। তারপর থেকেই তো এই সেদিন থিয়েটার রোডে।
………..আমি টের পেয়েছি। আমাকেও ভাবতে হচ্ছে।
শামসু ভাই চলে এলেই সব সমস্যার সমাধান। শামসু ভাই, দি গ্রেট লিডার। জামিল ঘরের কড়িকাঠ গুণলো। কি বিশাল দরজা জানালা। দেশ স্বাধীন হয়েছে, রাজনীতি নতুন মোড় নিচ্ছে। বর্তমান পার্টি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে মাসলাইনে চলে আসতে হবে.. পুরানো খোলস ফেলে নতুন মোড়ক। সাপের মতোন। তখন শামসু ভাইয়ের ইস্পাতের চোখ দুটো নড়ে উঠবে একটু। ক্ষমতা কি বাই রোটেশনে ভাগাভাগি করতে হয়?
তখন ঘরের মধ্যে স্তূপীকৃত পোস্টার আর হ্যান্ডবিল থেকে চোখ সরিয়ে এনে দেওয়ালে ঝুলন্ত নেতার ছবির দিকে রাখলো জামিল। টেবিলের ওপর একটা এস, এল, আর পানির জগ। রেডিও, সিগারেটের প্যাকেট। এগুলো থেকে সম্পর্কহীন হতে চেয়ে সে বললো, একটা ব্যাপার আমি বুঝি না জয়ন্ত। শামসু ভাই একুশে ফেব্রুয়ারির দিনটাকেই ঠিক করলো কেন?
জয়ন্ত একটু হাসে। আগামীকাল সকালেই একুশে ফেব্রুয়ারি। মহান ভাষা আন্দোলনের দিন। এদিনই জেগে উঠেছিল সমগ্র বাঙালি জাতি। জয়ন্ত শুধু বক্তৃতা দিতে ভালোবাসে, প্রতিটি শব্দের ওপর ঝোক পড়ে তার কিন্তু আজকের বক্তৃতাটি শেষ করতে পারে না সে। তার আগেই সদর দরজায় কড়া নাড়ারধ্বনি ওঠে এবং জামিলের চিৎকার এ্যাই আবদুল, চাবকাইয়া পিঠের ছাল তুইলা নিমু কইলাম। ক্যাডায় আইছে, দেখবার পারস না? তখন জামিল বাইরে আসে, দোতলার সিঁড়ির কাছে, আলো জ্বালায় আর পুরোনো বাড়িটার ইঁটগুলো চমকে ওঠে সেই আলোতে।
আবদুল মানেই তো কাজের ছেলে। তার লুঙ্গি পরা শীতার্ত শরীর একুশে ফেব্রুয়ারির ঠান্ডা বাতাসে কেঁপে উঠছিল। তবু সে সঙ্গে করে নিয়ে এলো দুজন মানুষের পদধ্বনি। দুইহাতে দুই বান্ডিল বই নিয়ে ঘরে ঢুকলো শফিক আর কামাল।
কি ব্যাপার এতো রাত হলো? জামিল প্রশ্ন করে।
আর রাত হবে না তো কি? সাত দিনে সংকলন বের করতে বলেন আপনারা? প্রেসের অভিজ্ঞতা তো আপনাদের নেই। থাকলে বুঝতেন বুক প্রোডাকশন কাকে বলে। শফিক কৃতিত্বের হাসি ঠোঁটে ঝুলিয়ে রেখে বলে।
আহা হা। তুমি হলে সাংবাদিক সাহিত্যিক। লিটারেচার বিষয়টাই তোমার। প্রিন্টিং পাবলিশিং…
আর বলতে হবে না। নেন এবার সব খুলে দেখেন। এবারের বেস্ট সংকলন হবে এটা। প্রোডাকশন ভালো না হলে ট্যাকা ফেরত।’
জামিল একটা সংকলন হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করে। ওহ্! ওয়ান্ডারফুল প্রোডাকশন। রক্তশপথ। কাইয়ুম চৌধুরীর প্রচ্ছদ।
ইয়েস! কাইয়ুম ভাইয়ের মতো লোক এক কথায় প্রচ্ছদটা একে দিলো। শফিকের উদ্ভাসিত মুখে আনন্দ।
জয়ন্ত, চশমাপরা লোকটা তখন এক কপি সংকলন নিয়ে টেবিল ল্যাম্পের দিকে তির্যকভাবে দেখে। চশমার ভিতর তার নিরীক্ষাপ্রবণ দৃষ্টি যেন সহসাই বিষ্ফারিত হলো। ওহ্ ওয়ান্ডারফুল। উৎসর্গটা তো ভারি সুন্দর। আবহমান বাঙলা, বাঙালি। কোথায় জানি, পড়েছিলাম… কিন্তু একি। আমাদের পার্টির মেনিফেস্টো কই? মেনিফেস্টো! সে যেন তড়িতাহত এমনিভাবে লাফিয়ে উঠলো।
ফলত: শফিকের মুখভঙ্গি, সে দুহাত তুলে চার্লি চ্যাপলিনের মতে ফেস্টো কেন? একুশের সাহিত্য মানেইতো জাগরণের সাহিত্য। দ্যাট ইজ এনাফ।
জয়ন্ত চোখ থেকে চশমা নামিয়ে প্রশ্নার্ত হয়: এটা কি খেয়ালখুশি নাকি? এ্যা? আমাদের উবর্ন পার্টির মেনিফেস্টো ছাপানো অত্যন্ত জরুরি।
নো। নো। সাহিত্য হলো সাহিত্য। লিটারেচার ইজ লিটারেটার। লিটারেটারে স্লোগান থাকতে পারে না।’
একুশ মানে কি? জয়ন্ত চিৎকার দিলো। তার বিবেচনা শুকনো ধারালো গলার উচ্চগ্রামে ছিন্নবিছিন্ন হয়ে যায়: আমাদের মেনিফেস্টো। শামসু ভাই বলেন…’
তখন কামাল বাগড়া বাধায়। আহ থোন ফালায় আপনাগো পলিটিক্স। আমি অহন হিসি দিমু। জামিল ভাই আপনাগো লেট্রিন কো?’ কামাল যে খুব ফুর্তিবাজ ছেলে -সেটা দেখলেই বোঝা যায়। পার্টির কালচারাল দিকটা বুঝি সে-ই দেখবে। তার লম্বা এলোমেলো চুল, জুলফি আর গলার হাড় স্পষ্ট চোখে পড়ে, আর সে জামিলের হাত ধরে টানতে টানতে বাইরে নিয়ে আসে। তখন বিশাল প্রাসাদ নিশ্চুপ, আবছা অন্ধকারে তার আয়তন শুধু টের পাওয়া যায়। দুতিনটা ঘর অতিক্রম করে ওরা লেট্রিনের কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। কামাল বুঝি একটা হিন্দী গান গুণগুণ থামিয়ে বলে, বিল্ডিংটা ভাই দারুণ বানাইছেন উস্তাদ। কুন শালা হারামি বানাইছিলো।
আর দারুণ হবে না কেন? বায়োজিদ ভাইদের নাম হোনেন নি? এই দালান তো তাগোই। মোট রুম কয়টা জানেন? গোণাগুনতি বাইশটা। জামিল হাসতে হাসতে বললো।
এতো রুম দিয়া আপনে কি করেন? ভাড়া দিবার পারেন না?
দিমু, দিমু। কেবল তো দখল করছি। পার্টি থাকলে আরো কত হইবো। শামসু ভাই কয় খালি দখল করলে চলবো না। কামও করতে হইব।
আপনে পারেনও উস্তাদ! কামাল গম্ভীর স্বরে বলে, রাশিয়ার বিপ্লবের পর শীত প্রাসাদ…
সহসা থ্রি নট থ্রি গর্জে উঠলো কাছে কোথাও। রণদামামা নেই, শুধু বিস্ফোরণের শব্দ খুব কাছে। দ্রিমি দ্রিমি বারুদের শব্দে, কা-কা করে উঠলো এক ঝাঁক কাক। বাথরুমের দরজা ধরে চেঁচিয়ে উঠলো জামিল, কুন হালায় আবার কাউঠ্যামি লাগাইলো এ্যা!
জামিল দেওয়াল ধরে দাঁড়িয়ে যায়: একুশে ফেব্রুয়ারি রাইততো, একটু হাঙ্গামা হইতাছে।
পোলাপানের কাছে বন্দুক। সময় নাই অসময় নাই, খালি ফট ফট।
যুদ্ধের পর সব দেশেই এমুন হয়। অস্ত্র কি এত তাড়াতাড়ি ফেরত নেওয়া যাবে মনে করেন? সবে তো একটা বছর গেলো।
বাইরে আবার গোলাগুলির শব্দ। জামিল চিৎকার দিয়ে বলে, অই আবদুল দরজাটা কইলাম ভালো কইরা লাগায়া রাখবি।
নিচের তলা থেকে আবদুল উত্তর দেয়, হ সাব, বন্ধ কইরা রাখছি।
ওরা দৌড়ে চলে এলো ঘরে। ঘরের মধ্যে তখন প্রচ- উত্তেজনা। জয়ন্ত একটা সংকলন হাতে বক্তৃতা দিচ্ছে: সামনে যে নতুন দিন, সেখানে সর্বহারা মানুষের ন্যায্য অধিকার আমাদের আদায় করতেই হবে। গণতান্ত্রিক অধিকার আদায় করতে হলে বুর্জোয়া ভাব-বিলাস ত্যাগ না করে উপায় নেই। তারপর ইতিহাস প্রসঙ্গ, তারপর উজ্জ্বল যুক্তি আর জয়ন্তর চশমার কাছে প্রতিবিম্বিত হলো দৃশ্যপট। জামিলের মনে হলো, ঊনসত্তরের দিনগুলো যেন এখুনি জানালার পর্দায় ভেসে উঠবে। ইকবাল হলের রাত, স্লোগানের স্বর, আপোষ না সংগ্রাম সংগ্রাম, সংগ্রাম । চলচ্ছবিগুলো থেকে দৃষ্টি ফেরানো যায় না।
তারপর আবার ইন্ডিয়া কিং সিগারেট, তীব্র তামাকের গন্ধ এখন বিচ্ছিন্নতায় ভুগছে। জয়ন্ত উচ্চস্বরে বোঝতে চায়, কিন্তু আমি বিশ্বাস করি মওলানা যদি ডাক দেয়, মানুষ আবারও সংগঠিত হতে পারে।
শফিক হাত নেড়ে উত্তর দেয়, কিন্তু কথা মনে রাখা দরকার। বামপন্থীদের নিয়ে কোন ক্লিয়ার কনসেপশনে পৌঁছানো যায় না।
অসুবিধা তো এখানেই। বামপন্থীর ভবিষ্যৎ হয়তো এভাবেই….। এতবড় মুক্তিযুদ্ধের সময়ই ওদের কোন ঐক্য হলো না। জয়ন্তর তরুণ মুখে লাল আভা এসে লাগে। এ দেশের মানচিত্র নিয়ে সে ভয়ংকর চিন্তিত।
অথচ জামিল এসব কিছুই শুনছিলো না। সে ভাবছিলো, মার্চের প্রথম সপ্তাহেই গ্রামের বাড়ি থেকে বাবা আর মাকে নিয়ে আসবে। বাবা যদি দেখে এই দোতলা দালান। ইলেকট্রিকের আলো। সাদা আলমারী মানে রেফ্রিজারেটর।
শফিকের কণ্ঠস্বর তখন জামিলের স্বপ্নময় চতুর্ভূজটাকে ভেঙে ফেললো। শফিক চিৎকার দেয় ধুস শালা, ওইসব কচকচানি রাখ। আগে মাল বাইর করো। এক সিপ মাইরা দেই।
জয়ন্ত তেতে ওঠে। তোমরা খালি ফাইজলামি আর মাতলামি কইরা যাইবা। আইজকা একটা ইমপরটেন্ট দিনেও কি তোমরা সিরিয়াস হইতো পারো না?
আহ্হা। সিরিয়াস তো আমরা সবাই। আজকে রাতেই আমাদের ঘোষণা দেয়া হবে, উই আর নো লংগার উইথ দ্য ইমপেরিয়ালিস্ট পার্টি। বলতে বলতে শফিক বোতল বের করে। বেটে সাইজের সোনালী মাথার বোতল দেখেই চুক চুক করে উঠলো জামিল। আশ্চর্য! শফিক একটা কাজের ছেলে বটে! কোথ্ থেকে যে কি জোগাড় করবে ভাবাই যায় না। তো বোতলটার রূপালী বর্ণনা চলে, এই কাড়াআক্রার বাজারে দাম কমসেকম তিন চারশ টাকা। তাহোক, লোকটার হার্ট আছে বলতে হয়। তবু সে উত্তেজনাহীন কণ্ঠ বজায় রেখে বলে, একুশে ফেব্রুয়ারির চার্মই অন্যরকম। বিদ্রোহ আর বিপ্লবের দিন।

ছিন্নবিচ্ছিন্ন কথাবার্তার মধ্যে আবদুল একজগ পানি দিয়ে গেলো। সংগে চোনাচুর আর পিঁয়াজ। জামিল ভাবলো, কোবাদ আলী মালিতার কথা। মাথাল মাথায় সিড়িঙ্গাপারা লোকটা মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। লোকটা আজ এখানে থাকলে, বিশ্বাসই করতে চাইতো না যে, তার পুত্র একুশে ফেব্রুয়ারি পালন করবে। একুশে ফেব্রুয়ারি কি বুঝতে পারবে লোকটা! বাবার প্রতি ঘৃণা হলো তার। বুড়ো হামড়া বাংলাদেশের বিপ্লবকে পিছিয়ে দিচ্ছে হাজার বছর। মনে হয়, শুধু দুকোটি মানুষ খুন হলেই এদেশে বিপ্লব ঘটে যাবে। কোবাদ আলী মালিতার মত ভূমিহীন কৃষকদের বেঁচে থেকে কি লাভ!

শফিক জ্যাকেটের বুকের চেইন নামিয়ে দেয়। তারপর গেলাস হাতে নাচতে থাকে। একটি ফুলকে বাচাবো বলে যুদ্ধি করি। জয়ন্ত হো হো হাসে। একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি। শফিকের বুকের লোম দেখা যায় । তার গুণগুণ সুরধ্বণি ঘরের বদ্ধ হাওয়ায় ঝুলতে থাকে। জয়ন্ত বললো, সংগ্রামের সময় আপনি গান লিখতেন না! আই মিন আপনি গীতিকার ছিলেন?
অফকোর্স! কত গান লিখেছি। ফর দ্য সেক অব মাই মাদারল্যান্ড। শফিক গ্লাসে একটা তরঙ্গ তুললো।
জামিল ভাবলো তার বাবার কথা। লোকটা কি সম্পূর্ণ প্রতিক্রিয়াশীল? গ্রাম থেকে এবার আসার সময় জামিলকে বলেছিলো বাজান তুই গেরামে থাইক্যা যা। তগো পলিটিক্স কি গেরামে হয় না?
এনিওয়ে। আমার মনে হয়, আমরা মূল প্রসঙ্গ ফিরে আসতে পারি। জয়ন্ত দৃঢ়স্বরে বলে। শামসু ভাই এলে সবকিছুু গুছিয়ে বলতে পারবেন। কথা হচ্ছে আজকের এই শহীদ দিবসটাকে আমরা বেছে নিলাম কেন? তাই না?
জামিল এক লহমায় বাস্তবে ফিরে আসে, একুশে ফেব্রুয়ারি হচ্ছে প্রতিবাদের দিন। জাগরণের দিন। আজকের এই মহতি দিনে আমরা সোজাসুজি জনতাকে জানিয়ে দেব যে, পুরোনো পচা পলিটিক্যাল পার্টির সঙ্গে আমাদের আর কোন সম্পর্ক নেই। আমরা নতুন পলিটিক্যাল বেইস তৈরি করতে চাই। এ নিউ জেনারেশন।
কামাল এতোক্ষণ কিছু বলেনি। সে জামিলের বক্তৃতা শুনে মুখ খোলে, কিন্তু একটা কথা আপনারা ভাবছেন না কেন? ওরা কি আমাদের ছাড়বে ভেবেছেন। শহীদ মিনার কিংবা যেখানেই আমরা মিটিং করি না কেন ওরা কি প্রবেলম সৃষ্টি করবে না।
ওরা করা? আমাদের পুরোনো সংগঠনের লোকজন? প্রবেলম সৃষ্টি করলে আমরাও তার যথাযথ উত্তর দিমু। জয়ন্তর কপালের পাশে দুটো নীল শিরা জেগে ওঠে। সম্প্রসারণবাদের বিরুদ্ধে লড়াই কি করে করতে হয় আমাদের জানা আছে… এন এস এফের বিরুদ্ধে আমরা কিভাবে লড়েছিলাম, মনে নেই? একাত্তরের বারুদভরা দিনগুলো কি এমনি এসেছিলো? জয়ন্ত চশমা খুলে রুমাল দিয়ে কাঁচ পরিষ্কার করে, আর ধোঁয়াশার মতো চারদিকে দ্রুত দৃশ্যপট বদলাতে থাকে, তখন যেন একটুক্ষণের জন্য পিন-পতন নিস্তব্ধতায় মানুষের মুখশ্রী দেখা যায় ভয়ানক চিন্তিত এবং ক্রোধময়।
বাইরে রাস্তা দিয়ে তখন ট্রাক মিছিল চলে যাচ্ছে। এ্যামপ্লিফায়ারে বেজে উঠলো সংগীত আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি আমি কি ভুলিতে পারি? ফেব্রুয়ারির বসন্তবাতাস এইসব টেনে আনে নগরীর সকল স্বপ্নকে জাগরিত করে দেয়- আর এই ঘরের মধ্যে কাল মার্কসের বই, ফ্রান্সে গৃহযুদ্ধ, আন্তর্জাতিকতাবাদ প্রসঙ্গে, পুঁজির বিকাশ আর রজনী পাম দত্তের মূল্যবোধ নিরাকার ভাসমান হয়ে যায়। দ্রিমি দ্রিমি ব্রাশ ফায়ারের লক্ষহীন শব্দ তখন রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারির সঙ্গে তাল মেলালো।
জয়ন্ত বোতল রেখে দৌড়ে যায় জানালার দিকে, বাঙালিরা দেখাইতেও পারে, বাঙালিরা দেখাইতেও পারে। ফাস ক্লাস! ফাস ক্লাস।… এই সময় বিশ্রী আর্তনাদ করে দরজাটা খুলে যায় এবং শামসু ভাইয়ের দাড়িওয়ালা গম্ভীর মুখ মাথাভর্তি বাবড়িচুল দুলে ওঠে। লিডার লিডার! সবাই সন্ত্রস্ত হয়ে তাকিয়ে দেখে, আরে এটি লিডারের সঙ্গে যে নারীমুর্তি কানিজ ফাতেমা না! ঊনসত্তরে ছাত্রী হলের ভি, পি ছিলো এখন বুঝি কোন নারী আন্দোলনের সভানেত্রী। জামিলের ভেতরে ভয়ংকর বিস্ময় কতদিন পরে দেখা! কানিজ চিনতে পারছো? এই বিস্ময় তার বুকের কপাট ধরে নাড়া দেয়। কিন্তু কানিজ ফাতেমার অভিব্যক্তিহীন মুখ কোন স্বাচ্ছন্দ্য আনে না। কানিজ ফাতেমা একজন নেত্রী এখন।
তোমাদের সব খবর ভালো তো? সবাই এসে গেছো দেখছি। শামসু ভাই মৃদু হেসে শুরু করলেন। তাহলে সভার কাজ শুরু করা যাক। তার আগে কানিজ ফাতিমার সঙ্গে তোমাদের পরিচয় করিয়ে দেই। এই বলে শামসু ভাই কানিজকে দেখলেন। ওর নাম কানিজ ফাতেমা, ও আমাদের সংগঠনকে সাপোর্ট করছে।
কানিজ গায়ের চাদরটাকে ভালোভাবে জড়িয়ে সবাইকে হাত তুলে সালাম জানায়। শফিক টেবিলের ওপর থেকে স্টিললাইফ সরাতে গিয়ে হোঁচট খায়। জয়ন্ত তখন একটা সিগারেট ধরিয়াছে। শামসু ভাইয়ের চোখ দুটো যেন ইস্পাত দিয়ে তৈরি, অনড় অচল হয়ে সবকিছু পর্যবেক্ষণ করছে তোমাদের সবকিছু ঠিক আছে তো?
ইয়েস। ইয়েস। এভরিথিং ইজ রেডি। এই যে হ্যান্ড বিল, পোস্টার, ব্যানার, সংকলন….
কই ব্যানার দেখি? শামসু ভাইয়ের দৃঢ় কন্ঠস্বর শোনা গেলো।
লাল কাপড়ের ব্যানার খুলে দেখলো সবাই।
ও কে। সাড়ে চারটার মধ্যেই আমরা শহীদ মিনারে পৌঁছাবো। তারপর ওখান থেকে সভামঞ্চ… সাংবাদিক সম্মেলন… ঘোষণাটা পড়বে তুমি জামিল। একথা বলে শামসু ভাই জামিলের দিকে ইঙ্গিত করলেন।
জামিল অনিমিখ তাকিয়ে থাকে। ঘোষণাটা তাহলে তাকেই পড়তে হবে। বুকের মধ্যে ঝংকার উঠলো, বিচ্ছিন্নতা মানে কি তবে নতুন উদ্বোধন? সেই রহস্যময় স্বর যা তাকে রূপকথা থেকে ফিরিয়ে আনে এখন এক আশ্চর্য জিঙ্গাসা হয়ে ঝুলছে।
কি ব্যাপার জামিল? এনিথিং রং? তুমি এতো বিষন্ন হয়ে গেলে? শামসু ভাইয়ের গম্ভীর মুখ নড়ে উঠলো। তখন জয়ন্ত মুখ খোলে। শামসু ভাই, এখানে মনে হয় একটা কমুনিকেশন গ্যাপ রয়েগেছে। জামিল মনে হয় ব্যাপারটাকে সহজ-ভাবে নিতে পারছে না?
তোমাকে ফ্রাস্টট্রেটেড মনে হচ্ছে জামিল। প্রগতিশীল সংগ্রামে তোমার দ্বিধা…। শামসু ভাইয়ের উদাত্ত আহ্বান জামিলের স্বপ্নহীন বিষাদের রাজ্যে পালতোলা নৌকার মতো উজানে যায়: এটা কি রকম রাজনীতি আমি বুঝতে পারছি না, এটা একটা বিশ্রী মর্মবেদনা, সে বলতে চাইলো, আমরা ভেঙ্গে যাচ্ছি কেন। কিন্তু তখন জয়ন্ত স্বাভাবিক, কামালের হাত থেকে সিগারেট যায় শফিকের কাছে। কানিজ ফাতেমার নরোম ঠোঁটে রাঙাহাসি এই বিদঘুটে রাত্রিকে ঝাঁকুনি দিয়ে যায়।

ফ্রাস্টট্রেশন আসতে পারে। আমি বিশ্বাস করি। মাত্র দুইবছর আগে যুদ্ধ করে আমরা দেশ স্বাধীন করেছি। কিন্তু এখনো জনগণের মৌলিক মুক্তি অর্জন সম্ভব হয়নি।… ফ্রাসট্রেশন তো স্বাভাবিক।’ শামসু ভাই দৃঢ়স্বরে কথা বলে, অতিমানবের মতো মনে হয় তাকে, যেন ইতিহাস তার দুই আঙ্গুলে সুতার মতোন জট পাকাচ্ছে। তখন বাইরে ঠা-ঠা বন্দুকের শব্দ, পুনরায় বিস্ফোরণ, তাই শুনে শামসু ভাই ভেঙে ভেঙে বললেন দেখ ছোকরারা অস্ত্র নিয়ে ঘুরছে ওদের ঘরে ফেরাতে হবে না? কি বলো জয়ন্ত?
জয়ন্ত মাথা নাড়ে। কানিজ ফাতেমা তখন কথা বলে, আমার মনে হয় শামসু ভাই, জামিল ভাই এখনো তার রাজনৈতিক বিশ্বাস খুঁজে পাননি?’
জামিলের ঠোঁট কেঁপে উঠলো তখন আমার একটা প্রশ্ন ছিলো শামসু ভাই। শুকনো গলায় সে বলতে থাকে, আমরা নতুন সংগঠন গড়তে চাচ্ছি কেন? পুরনো সংগঠনের আদর্শ থেকে আমাদের পার্থক্য কোথায়?
কঠিন উদ্ধত চোখ বার বার ঘুরে আসে। আসলে গণতন্ত্রের বিষয়টা বুঝি এখনো খোলাসা করে বলা হয়নি। শামসু ভাই তার দাড়িতে হাত বুলিয়ে চাদরটাকে শরীরের সঙ্গে অটোসাটো করে বললো পার্থক্য অনেক। পুরানো সংগঠনের ভিতরে নেতৃত্বের ব্যারাম হয়েছে, তুমি তো ভালো করেই জানো। ওখানে থাকা আর সম্ভব নয় আমাদের। আমরা তাই নতুন পথ খুঁজছি।
কিন্তু আদর্শবাদ…..? পার্টির মেনিফেস্টো?
আদর্শবাদ-টাদর্শবাদ পরে হবে। আগে একটা সেপারেট প্ল্যাটফর্ম গড়ে নিতে দাও তো, ইনফ্যাকট আমাদের সামনে এখন বহুপথ খোলা রয়েছে জামিল। এটা ঊনসত্তর নয়, এটা উনিশ শ তিয়াত্তর। রিমেম্বার। আমাদেরকে একটা পথ বেছে নিতেই হবে।
শফিক এতোক্ষণ নিশ্চুপ হয়ে শুনছিলো। সহসা সে বলে, কিন্তু নতুন সংগঠন করতে হলে তো প্রচুর টাকা পয়সা দরকার। তারপর পার্টির একটা কনস্টিটিউশন। মানে একটা সিদ্ধান্ত।…
শামসু ভাই প্রায় হুঙ্কার দিয়ে উঠলেন, আহ সব কিছুই হবে। তার ভুরু কুঁচকে উঠলো, টাকা পয়সার জন্য তোমরা চিন্তা করো না। টাকা পয়সা আটনাআপনি এসে যাবে। ওটা কি একটা ফ্যাকটর? ও বিষয়টা আমিই দেখবো। তোমরা সাংগঠনিক ব্যাপারে চিন্তা করো….।

নিঃসহায় মুহূর্তগুলো কেটে যায়, স্বপ্নতাড়িত আর রহস্যময় সেই স্বর, ইস্পাতের তৈরি নিথর চোখ গভীর আবেগে এগিয়ে আসে। আমি তোমার প্রশ্নগুলো বুঝতে পারছি জামিল। রাজনীতি এ বিগ এন্ড এন্ডলেস গেম… তার কাঁধে হাত রাখলো সে, রাজনীতির ভাঙ্গা গড়ার মাঝখানেই আমাদের এগিয়ে যাওয়া, কার্ল মার্কস তো বলেছেন, দর্শণের ব্যাখ্যা পৃথিবীর প্রয়োজন নয়, পৃথিবীর প্রয়োজন পরিবর্তন । নিঃশ্বাসরুদ্ধ এসব শোনে জামিল, তখন কোবাদ আলী মালিতার ম্লান মুখ উকি দেয় না দূরে অবসন্ন কোকিল ডেকে উঠছে বেলি রোডের গাছের শাখায়, আর সে অনুভব করে: মাথার মধ্যে ভারি কিছু জমে আছে, যা সে কোনদিন সরাতে পারবে না।
জয়ন্ত হাসতে হাসতে বললো ও একটু সেন্টিমেন্টাল। পুরানো পার্টির মোহ ছাড়তে পারে না। যাই হোক এবার আমরা কর্মক্ষেত্রে ঝাপ দেবো। সব দ্বিধা ঝেড়ে ফেলে দাও…।
শহীদ মিনারের কাছে মিছিল পৌঁছতেই ওরা দেখলো চারদিকে ঝলমল আলোর ঝর্ণাধারা। মিছিলের হাজার হাজার মানুষ জমায়েত হয়েছে আর মিনারের শরীর বেয়ে উপচে পড়ছে ফুলের সমারোহ। প্ল্যাকার্ড আর স্মৃতিমগ্ন মানুষের মহামিলন। অমর একুশে মহান ৮ই ফাল্গুন স্মরণে আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো তারপর জয় আমাদের সুনিশ্চিত দেখতে দেখতে জামিলের কানের কাছে স্লোগান ওঠে: সামনে লড়াই কমরেড, গড়ে তোল বেরিকেড।
জামিলের মনে হলো : এখান থেকে একটা জাতীয়তাবাদ শুরু হচ্ছে নাকি? এতো মানুষ একসঙ্গে জমজমাট মৌচাক হয়ে শুধু স্মৃতির রাজ্য খুঁজে ফেরে। ব্যানারের একদিকে জামিল, অন্যদিকে জয়ন্ত। ওরা হেঁটে যায়। মাঝখানে কয়েকজন কর্মীর সঙ্গে শামসু ভাই, কানিজ ফাতেমা। শামসু ভাই চাদরটাকে বুকের ওপর দু’ভাগ করে রেখেছে। জ্বলজ্বল আলোর তীব্রতায় শামসু ভাইকে অসীম ক্ষমতাবান মহাপুরুষ মনে হলো। লোকটার জুলফির কাছে শাদা চুল, উদ্ধত গোঁফ, আর দাড়িওয়ালা চোয়ালের গর্তে নিষ্ঠুর ভঙ্গিমা। তার পাশে হাত তুলে কানিজ ফাতেমা চিৎকার দিলো: মারকিন সাম্রাজ্যবাদ, নিপাত যাক, নিপাত যাক।
তখন ঠান্ডা বাতাসে মাথা রেখে জামিল একটুখানি ভেবে নেয়, কানিজ কি সত্যি সত্যি আমাকে চিনতে পারেনি। বিশ্ববিদ্যালয়ের দিনগুলো? পোস্টার আর মিছিল?
ফেস্টুন, ব্যানার, মিনার, সম্মেলন, গণজমায়েত। কি গম্ভীর আয়োজন। মাইকে গান হচ্ছে: ও আমার দেশের মাটি, তোমার পরে ঠেকাই মাথা। মিছিল এগিয়ে যায়। মাথায় লালকাপড় বাধা যুবকের দল হৈ চৈ করে। জামিল ফিশ ফিশ করে বললো, শফিক, আমাদের পার্টির পুরানো বন্ধুরা কি আমাদের ভুলে যাবে? পলিটিক্স কি এতোই কঠিন?
ধ্যাৎ। শ্রেণী সংগ্রামের ক্ষেত্রে বন্ধুত্বের স্থান নাই। একথা বলেই শফিক স্লোগানের সঙ্গে স্বর মেলায়: নিপাত যাক, নিপাত যাক।
ক্যামেরাম্যানের ফ্লাশগান চমকে ওঠে। পলকে আলোকিত হয় রাত। আলোকিত হয় মানুষের মুখ। শামসু ভাইয়ের মুখ। শহীদ মিনার থেকে অনেকটা দূরে এক সভামঞ্চের ওপর শামসু ভাই মাইকের সামনে এসে দাঁড়ালেন। হাজারো মানুষের ভিড়ে তখন একটা উত্তাল স্বর বেজে ওঠে। জামিল ঝাপসাভাবে একটা ছবি দেখলো তখন মুক্তিযুদ্ধের সময় আগরতলার শরণার্থী শিবিরে শামসু ভাই একদিন বলেছিলো জামিলকে জামিল তুমি আমার লগে লগে থাইকো, পার্টি পলিটিকস কইলাম নতুন মোড় লইতাছে। আমরা মাস লাইনের দিকে যামু। এই তাহলে মাস লাইন। নতুন মোড় নিচ্ছে বাংলাদেশ? শামসু ভাই মাইকের সামনে হাত তুলে দাঁড়ালো এখন। ভাইসব প্রতিটি একুশে ফেব্রুয়ারি আমাদের জন্য নতুন সংবাদ বয়ে আনে। আমরা পুরানো রাজনীতিতে আর বিশ্বাস করি না। প্রতিক্রিয়াশীলতার দুর্গ ভেঙে ফেলুন…।
সহসা আবার গুলির শব্দ। একটা প্রবল বিস্ফোরণ যেন এই আলোকিত রাতকে ছারখান করে দেয়। নীলক্ষেতের ইউক্যালিপটাস, কৃষ্ণচূড়া কেপে ওঠে। বসন্ত বাতাসে বারুদের নির্যাস আর জনমানুষের হল্লা। জামিল ভাবলো, প্রতিক্রিয়াশীল কোথায়? কেউ যেন বললো পালাও, ওই আসছে। ট্রাক মিছিলে দেশাত্ববোধক গান হচ্ছিলো, তবু রণদামামার হঙ্কার শুনলো সবাই। তখন বিচ্ছিন্ন প্রতিপক্ষের লালচোখ আর মানুষের স্রোত-সবাই ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়াতে থাকে শহীদ মিনার থেকে মেডিক্যাল কলেজের দিকে বাঙলা একাডেমির দিকে। কারো কণ্ঠস্বর শুধু পালাও। পালাও। ওই ওরা আসছে। জামিল শুধু আতশ-বাজি দেখলো মোমবাতির শিখার মতো দুলে দুলে উঠছে শহীদ মিনারে তার আলো আর ফুলের সমারোহ। শামসু ভাই কোথায়? শামসু ভাই? কানিজ ফাতেমা! জয়ন্ত শফিক? হাটুতে আর কনুইতে হামাগুড়ি দিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে কেউ। সম্পূর্ণ অস্বাভাবিক স্বচ্ছতায় সব কিছু দৃশ্যমান হয়, আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখলো জামিল, প্রথম ভোরের আলো স্পর্শ করছে পৃথিবীকে আর ঠান্ডা হাওয়ার মধ্যে ভেসে যাচ্ছে। থিয়েটার রোডের সেই দৃশ্য মনে আছে? আমার মনে হয় কোলকাতার থিয়েটার রোড থেকেই যেন দেশের ভবিষ্যতটা রচনা হয়ে গিয়েছিলো। হঠাৎ এই কথাটা মনে এলো কেন? মাথার ভেতরে যেন শত সহস্র মৌমাছি গুনগুন শব্দ করতে থাকে। দুই বছর হলো দেশটা স্বাধীন হয়েছে। বিভক্তি. . ভাংগা-গড়া থাকতেই পারে, কিন্তু এরকম রক্তারক্তি?…জয়ন্তর মনে হলো চিৎকার দিয়ে বলে, আমার আর রক্ত দেখতে ইচ্ছা করে না, প্লিজ..
ব্যানার ফেলে দিয়ে সে প্রাণপণে দৌড়াতে থাকে, গভীর স্বপ্নের মতো এলোমেলো মনে হয় সব কিছু আর মাথার মধ্যে ঘোলাজল, ঘোলাজল, ঘোলাজল শুধু ঘোলাজল।….
[এই কাহিনির চরিত্র ও ঘটনা-বর্ণনা সম্পূর্ণ কাল্পনিক। বাস্তব জীবনের সঙ্গে এর কোনো মিল নেই। ]

Ajit Dash

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ভাষা
Scroll to Top