ইসাবেল আয়েন্দের দুটি সাক্ষাৎকার এবং অন্যান্য// ভাষান্তর: নাহার তৃণা

১৯৮২ সালে ইসাবেল আয়েন্দের প্রথম বই The House of the Spirits প্রকাশিত হওয়ার পর, এটি ব্যাপক আন্তর্জাতিক সুখ্যাতি কুড়িয়েছিল। ১৯৪২ সালে পেরুতে জন্মগ্রহণকারী আয়েন্দে সে বছরের সেরা লেখক হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিলেন জার্মানি, চিলি, সুইজারল্যান্ড এবং মেক্সিকোতে। তিনি বেটস কলেজ, ডমিনিকান কলেজ, নিউইয়র্ক স্টেট বিশ্ববিদ্যালয় এবং কলম্বিয়া কলেজ থেকে সম্মানসূচক ডক্টরেটস পেয়েছেন। ফ্রান্সের শেভালিয়ার ড্যানস অর্ড্রে ডেস আর্টস এট দেস লেট্রেস এবং ১৯৯৪ সালে ফেমিনিস্ট মেজরিটি ফাউন্ডেশন কর্তৃক বর্ষসেরা নারীবাদী লেখক নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি । প্রায় প্রতি বছর আয়েন্দে তাঁর কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ বহুসংখ্যাক সম্মানে ভূষিত হন। যা এখন প্রায় নিয়মে দাঁড়িয়ে গেছে। বলাই বাহুল্য সেগুলো তাঁর কব্জির জোরেই অর্জিত। ২০১৪ সালে প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা তাঁকে প্রেসিডেন্টসিয়াল মেডেল অফ ফ্রিডমে ভূষিত করেন।

আন্তর্জাতিকভাবে সুখ্যাতি প্রাপ্ত এই লেখক খ্যাতিমান রাজনৈতিক এবং সাংবাদিক পরিবারের সদস্য। তিনি চিলির প্রেসিডেন্ট সালভাদর আয়েন্দের ভাতিজি যিনি ১৯৭৩ সালের সামরিক অভ্যূত্থানের সময় নিজের অস্ত্রে আত্মঘাতী হয়েছিলেন। তবে সালভাদর আয়েন্দের সমর্থকদের ধারণা তাঁকে হত্যা করা হয়েছিল।

সেই সময় তিনি সাংবাদিকতা পেশায় যুক্ত ছিলেন। ওই ঘটনার পর তাঁর পক্ষে চুপচাপ বসে থাকা সম্ভব ছিল না। তিনি অনেক বেশি কিছু দেখে ফেলেছিলেন। ফলে তাঁকে জীবনের হুমকি মাথায় নিয়ে ২৪ ঘন্টার মধ্যে সরে পড়তে হয়েছিল। তিনি তখন ভেবেছিলেন কয়েক মাসের জন্য চিলি থেকে ভেনিজুয়েলা গিয়ে সাময়িক নির্বাসন গ্রহন করবেন এবং কয়েক মাস পর তিনি নিঃশব্দে ফিরে আসবেন। কিন্তু সেটা সম্ভব ছিল না। তাঁর ভাষায় – ‘যখন আপনি সেরকম একটা তালিকায় থাকবেন যারা আপনাকে ধরার জন্য বসে আছে, তখন  আপনার পক্ষে সেই দেশে লুকিয়ে থাকা অসম্ভব। ফলে শেষমেষ আমার স্বামী সন্তানকেও দেশ ছাড়তে হয় এবং তারা ভেনিজুয়েলায় এসে আমাদের সাথে মিলিত হয়। আমরা কখনোই ভাবিনি যে আমরা ভেনিজুয়েলাতে ১৩টি বছর কাটিয়ে দেবো। আমরা সবসময় ভেবেছি চিলির মতো গণতান্ত্রিক দেশে স্বৈরশাসন এত দীর্ঘ সময় টিকে থাকতে পারে না। কিন্তু দেখা গেল সেটা প্রায় ১৭ বছর টিকে গেছে ’।

দ্বিতীয় স্বামী উইলি গর্ডনের সাথে

এ সময়ে ইসাবেল আয়েন্দে, যাঁর তেইশটিরও বেশি বেস্টসেলার বই এবং জীবিত লেখকদের মধ্যে সবচে’ প্রশংসিত, পঠিতদের একজন। তাঁর বই  পঁয়ত্রিশের অধিক ভাষায় অনূদিত হয়েছে এবং  সত্তর লক্ষের বেশি বিক্রি হয়েছে। তাঁর বহুল প্রচারিত “দ্য হাউজ অফ দ্য স্পিরিটস” সহ অন্যান প্রশংসিত বইগুলো হচ্ছে “সিটি অফ দ্য বিস্টস”, “ইভা লুনা”, “ডটার অফ ফরচুন”, “পোর্ট্রেট অফ সোফিয়া”, “পলা”,”মায়াস নোটবুক”, “অ্যা লং পেটাল অফ দ্য সী” ইত্যাদি। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা, ঐতিহাসিক ঘটনাবলী, এবং নারীদের জীবনের প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপনের ভিত্তিতে রচিত কাহিনিগুলোতে কল্পনা ও বাস্তব ঘটনার মিশেলে তিনি তাঁর বইগুলো রচনা করেন।

আয়েন্দে রচিত “দ্য হাউজ অফ দ্য স্পিরিটস”, “আফ্রোডাইটি”, “ইভা লুনা”, এবং “গিফ্ট ফর এ সুইটহার্ট” উপন্যাসসহ তাঁর আরো কয়েকটি বইয়ের উপর ভিত্তি করে চলচ্চিত্রায়ন হয়েছে। খ্যাতনামা অভিনয় শিল্পী যেমন মেরিল স্ট্রিপ, জেরেমি আইরনস, অ্যান্টোনিও ব্যান্দেরাস, গ্লেন ক্লোজ এবং উইনোনা রাইডার প্রমুখেরা তাতে অভিনয় করেন।

১৯৯৬ সালের ৯ ডিসেম্বরে আয়েন্দে তাঁর মেয়ে পলা ফ্রায়েস অ্যায়েন্দের স্মরণে ইসাবেল আয়েন্দে ফাউন্ডেশন চালু করেন। তাঁর মেয়ে পলা ১৯৯২ সালে ২৮ বছর বয়সে মৃত্যু বরণ করেন। পলার স্মরণে প্রতিষ্ঠিত ফাউন্ডেশনটি নারী ও শিশুদের মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ ও প্রচার, এবং নারীর ক্ষমতায়নে কাজ করে থাকে।

বিয়ের ২৭ বছর পর ২০১৫ সালে, ইসাবেল আয়েন্দে তাঁর দ্বিতীয় স্বামী উইলি গর্ডনের সাথে বিচ্ছেদ ঘটিয়ে আলাদা হয়ে যান, এবং ছোট্ট একটি বাড়িতে নিজের পোষা কুকুরটিকে নিয়ে বসবাস শুরু করেন। ২০১৬’র অক্টোবরে নিউইর্য়কের এক আইনজীবী রজার কুকর‍্যাস’এর সাথে তাঁর পরিচয় হয়। তিনি তার প্রেমে পড়েন এবং ২০১৯ সালে তাঁরা বিয়ের বাঁধনে জড়ান।

২০২০ এর জানুয়ারিতে প্রকাশিত হওয়া তাঁর উপন্যাস, ‘ অ্যা লং পেট্ল অফ দ্য সী’। যেটি এক বিধবা গর্ভবতী তরুণী এবং সেনাবাহিনীর এক ডাক্তার যে স্প্যানিশ গৃহযুদ্ধ থেকে পালিয়ে এসে মাথা গোঁজার জন্য একটি বাড়ির খোঁজে মরিয়া হয়ে বিয়ে করতে বাধ্য হয়, এমন আখ্যানে রচিত। জোডি পিকলসহ সাহিত্য সমালোচক এবং লেখকসমাজ উপন্যাসটির প্রশংসা করেছেন। “কাইট রানার” খ্যাত লেখক খালেদ হোসাইনি তাঁকে ‘বিশ্বসাহিত্যের প্রতিমা’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। আয়েন্দের “অ্যা লং পেটল অফ দ্য সী” উপন্যাসটি ২০২০ জানুয়ারির ২১ তারিখে বাজারে এসেছে। The Sum of Our Days ২০২০’এর ১৯ মে প্রকাশিত এখন পর্যন্ত তাঁর সর্বশেষ বই।

সাক্ষাৎকার : এক

 বছরের শুরুতেই আপনার সহকারীর সাথে যোগাযোগ হয়েছিল। তখন তার কাছ থেকে জানতে পারি আপনি পুনর্লিখনে মগ্ন, যেটির সমাপ্তি কাকতলীয় ভাবে অতি অবশ্যই জানুয়ারির ৮ তারিখে ঘটবে- ওই তারিখে আপনি নতুন বই শুরু করেন। জানুয়ারির ৮ তারিখে আপনার জীবনে কি ঘটেছিল সেটি বলবেন কি?

আমি তখন আরেকটা বইয়ের কাজ নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম। ভেবেছিলাম ডিসেম্বরের মধ্যে শেষ হবে, কিন্তু হয়নি। আমাকে পুরো জিনিসটা আবারো লিখতে হয়েছিল। সেই কাজটা মাত্র শেষ করলাম। বইটির নাম Invincible Summer এটা আমেরিকার ব্রুকলিনের প্রেক্ষাপটে লিখিত একটি উপন্যাস। এটা জুন মাসে স্পেনিশ ভাষায় প্রকাশিত হবে এবং বছরের শেষ নাগাদ ইংরেজিতে। আমার বুলগেরিয়ান প্রকাশক খুব চমৎকার। তারাই আমার প্রায় সব বই প্রকাশ করেছে। তাই আমার মনে হয় কিছুকাল পর এটা বুলগেরিয়ান ভাষাতেও প্রকাশিত হবে। তবে সেটা কখন তা এখনই বলতে পারছি না।

আপনার দ্বিতীয় স্বামী উইলির কাছ থেকে আলাদা হয়ে গিয়েছেন, যাঁর সাথে বিবাহবন্ধনের কয়েক বছর পেরিয়েছে, সেই ২০১৫। এক সাক্ষাতকারে আলাদা হওয়ার সময়টা সম্পর্কে আপনি উল্লেখ করেছিলেন ওরকম সময় আপনার জন্য ভালোবাসা আবিষ্কারের: কিভাবে সেটি টিকে, ফুরিয়ে যাওয়ার কারণটাই বা কি, জীবনের যেকোনো মুহূর্তে জীবনের প্রতি প্রেম থাকে। প্রেম সম্পর্কে আপনি কি শিখেছেন?

আসলে প্রথম যে ব্যাপারটি আমি শিখেছি তা হল কোনো কিছুই স্থির সিদ্ধ বা নিশ্চিত নয়। সবকিছুই সময়ের সাথে পরিবর্তিত হয়। বহু বছর আগে যখন উইলির সাথে আমার প্রথম দেখা হয় আমি সাথে সাথে প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম এবং বহু বছর ধরে আমি তার প্রেমে মুগ্ধ ছিলাম। যে সময় আমার কন্যার মৃত্যু হয় তাঁর দুটি সন্তানও মারা যায় সে খুব অসুস্থ হয়ে পড়ে। এরকম নানা দুর্ঘটনা আমাদের জীবনে ঘটতে থাকে সে খুব মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে তারপর আমাদের সম্পর্কটা বদলে যেতে থাকে।

আমি এটাও শিখেছিলাম যে তোমাকে সবসময় একটা সম্পর্ককে টিকিয়ে রাখার জন্য কাজ করতে হয় এবং দুজনকে মিলেই কাজটা করতে হয়। যখন শুধুমাত্র একজন এটা নিয়ে কাজ করে তখন তার কোনো ফল পাওয়া যায় না। এক সময় আমরা ক্লান্ত হয়ে পড়ি। এক পর্যায়ে সে আর চেষ্টা করতে রাজি ছিল না; তারপর, তারপর আমরা আলাদা হয়ে যাই।

আমি ভেবেছিলাম নিঃসঙ্গ জীবনে আমি সুখী হবো, হতে পারতাম হয়তো। আমি ছোটো একটা বাড়িতে চলে যাই। ওখানে খুব ঠাসাঠাসি অবস্থা ছিল। সাথে আমার কুকুরটা ছিল। আমি নতুন জীবন শুরু করি নতুন এলাকায় নতুন পরিবেশে। শুধু একটা জিনিসই আগের মতো ছিল তা হলো আমার পরিবার এবং আমার অফিস, অফিসের লোকজন। কিন্তু বাকি সব কিছুই বদলে যায়। আমি ভাবতাম আমি খুব ভালো আছি, আমি আর কখনো প্রেমে পড়বো না। তবু গতবছর নিউইয়র্কের একজন আমাকে রেডিওতে কথা বলতে শোনে। সে বোস্টনে ছুটে আসে এবং সেই প্রোগ্রামটা আবার শোনে। শুনে এত বেশি মুগ্ধ হয়েছিল যে আমার অফিসে ইমেইল করেছিল। আমি এরকম শত শত মেইল পাই কিন্তু কেন জানিনা আমি তাকে জবাব দিয়েছিলাম। তারপর থেকে আমরা প্রতিদিন মেইল পাঠাতে থাকি পাঁচ কিংবা ছমাস ধরে। অবশেষে আমরা দেখা করলাম অক্টোবর মাসে, তারপর আমরা প্রেমে পড়ে গেলাম এবং খুব ঘনিষ্ঠ একটা সম্পর্কে জড়িয়ে পড়লাম। এটা ঠিক যে সে আছে নিউ ইয়র্কে আর আমি আছি ক্যালিফোর্নিয়াতে কিন্তু আমাদের দুজনের পরিকল্পনা হলো একত্রিত হওয়া। আমি কখনো ভাবি নি যে এরকম কিছু আমার জীবনে আবার ঘটতে পারে। কিন্তু তুমি নিশ্চয়ই আমাকে দেখে বুঝতে পারছো ৭৪ বছর বয়সেও মানুষ প্রেমে পড়তে পারে।

ব্যাপারটি চমৎকারবেশ আশা জাগানিয়া

(হাসতে হাসতে) কেন, ইরিনা, কেন বললে আশাজাগানিয়া? আসলে কি জানো, আশাটা থাকেই কোথাও না কোথাও। প্রেমে পড়ার সময়টা সত্যি খুব উপভোগ্য, নিজেকে খুব সুখী মনে হয় ওই সময়টায়।  যদিও আমি ভেবেছিলাম একাকিত্ব নিয়েও সুখী- সত্যিই সুখী হতে পারি কিন্তু। তবে এটা তার চাইতে অনেক ভাল। মনের মতো একজনকে পাশে নিয়ে জীবন কাটাতে পারলে বেশি সুখী হওয়া যায়।

আপনি আপনার কন্যা এবং প্রাক্তন স্বামীর সন্তানদের হারানোর কথা উল্লেখ করেছিলেন, এটি অবশ্যই আপনার জীবনের সবচেয়ে কঠিন সময় ছিল। জীবনের এমন ক্ষত ও হারিয়ে ফেলা বিষয়ে আপনার দৃষ্টিভঙ্গি কী?

আমি অনেক কষ্ট করে সেটা শিখেছি। ১৯৯২ সালে যখন আমি ৫০ বছর ছুঁয়েছি, আমার মেয়ে পলা খুব অসুস্থ হয়ে কোমায় চলে যায়। তার এক বছর পর সে মারা গিয়েছিল। সেই একটি বছর আমি তার দেখাশোনা করেছিলাম এবং দিনের পর দিন আমি সবকিছু ছেড়ে দিয়ে তার পাশেই ছিলাম। ভেবেছিলাম আমি পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি। ভেবেছিলাম আমি তাকে ভালো করে তুলতে পারবো। ভেবেছিলাম আমি তাকে অনেক স্বস্তি দিতে পারব। কিন্তু আসলে আমি খুব কমই করতে পেরেছিলাম। এক সময় সব কিছু নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গিয়েছিল আমার। বাস্তবতার কাছে আমাকে আত্মসমর্পণ করতে হয়েছিল এবং আমার মেয়েটিকে মরতে হয়েছিল। এবং সে চলে যাবার পর আমি তার সব জিনিসপত্র ফেলে দিয়েছিলাম। তার চেতনা এবং স্মৃতি ছাড়া আমার কাছে আর কিছুই ছিল না। ওটা ছিল আমার জীবনের কঠিনতম শিক্ষা কিন্তু ওটাকেই আমি বারবার ব্যবহার করতে সক্ষম হয়েছিলাম। যখন আমি উইলির কাছ থেকে আলাদা হয়ে যাই, তখন উইলি এবং তার বিশাল বাড়ি, ফার্নিচার, পেইন্টিং, বন্ধু-বান্ধব, সবকিছুর মায়া ছেড়ে দেয়া খুব সহজ ছিল আমার জন্য। আমি নিজেকে মুক্ত বলে ভাবতে পেরেছিলাম। আমার মনে হয়েছিল আমি জাগতিক সব বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে গেছি।

আপনার TEDx আলোচনায় উল্লেখ করেন যে আপনি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন প্রচণ্ডভাবে বাঁচবার আনন্দে বাঁচবেন। এই যে ইচ্ছাবোধ, এটিকে আপনি কীভাবে সজীব রাখেন, এক্ষেত্রে ইচ্ছা এবং আসক্তির মাঝে সূক্ষ্ণ কোনো একটি রেখা থাকে কি?

আমার মনে হয় না প্যাশন এবং নেশা এক জিনিস। প্যাশন হলো শক্তি। যে শক্তি আমাদের কল্পনাকে উজ্জীবিত করে জীবনের নানান ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা যায়। কাজের প্রতি আমাদের প্যাশন থাকতে পারে, দেশের প্রতি থাকতে পারে, যেসব বিষয়ে আমার আগ্রহ আছে সেসব বিষয়ে প্যাশন থাকতে পারে যেমন নারীবাদ, যেমন নারীবাদী কোন ইস্যু, যেমন বিচার। যেসব বিষয় আমার জীবনের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ সেগুলোর মধ্যে আমি প্যাশন যোগ করে কাজ করি। একই বিষয় প্রেম এবং সম্পর্কের ব্যাপারেও খাটাই আমি। আমি কেবল পরিচিত হওয়াতে আগ্রহী নই, আমি বন্ধুতা চাই। আমি আত্মীয়স্বজন চাই না, আমি চাই সত্যিকারের ঘনিষ্ট মানুষ যাদের আমি অন্ধভাবে বিশ্বাস করতে পারি, যাদের জন্য আমি যে কোন কিছু বিসর্জন দিতে পারি। আমি শুধু সেরকম সম্পর্কের প্রতিই আগ্রহী। অন্য কোন রকম সম্পর্কের জন্য আমার সময় নেই।

আমার কাজের ক্ষেত্রে, বইয়ের কাজ নিয়ে আমার নিগূঢ় আসক্তি আছে। যখনই বইয়ের কাজটা শেষ হয়ে যায়, ওটা আর আমার কাছে থাকে না, তখন আমি অন্য একটা বইয়ের প্রতি আসক্ত হতে পারি, অন্য বিষয় নিয়ে, ভিন্ন অধ্যায়ের ভিন্ন গবেষণায়।

এভাবেই জীবনকে নিয়ে ভাবি আমি। এবং সৌভাগ্যক্রমে আমার জীবনে স্বতঃস্ফুর্ততার জন্য বয়স কখনো বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। তাই আমি যখন টেড টকে কথা বলেছিলাম, তখন স্বতঃস্ফূর্তভাবে আনন্দময় জীবন সম্পর্কে বলতে পেরেছিলাম। এটা শুধু প্রেমের বিষয়ে নয়, জীবনের সর্বক্ষেত্রে আমি বলতে পারি। সত্যি বলতে কী আমি যে আবারো প্রেমে পড়তে পেরেছি তার মানে হলো আমার একটি খোলামেলা হৃদয় আছে এবং আমার দৈনন্দিন জীবনেও সেই আনন্দটা জড়িয়ে আছে।

দৈনন্দিন জীবনে আবেগকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য আপনার কোনো ব্যবহারিক কৌশল রয়েছে কি?

এখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো সুস্থ থাকা। যখন আপনি অসুস্থ কিংবা শারীরিক কোন অসুবিধায় আছেন অথবা খুব ক্লান্তি ঘিরে আছে তখন এই প্যাশনটা তেমন কাজ করবে না। হয়তো সম্ভব কিন্তু খুব কঠিন। তাই যদি আপনার সুস্বাস্থ্য থাকে তাহলে আমার একমাত্র পরামর্শ হলো – বেরিয়ে পড়ুন। নিজের থেকে বেরিয়ে পড়ুন। নিজের ছোট্ট জীবনের গণ্ডী ছেড়ে বেরিয়ে পড়ুন এবং বাইরের জগতের সাথে জড়িয়ে পড়ুন। বেরিয়ে পড়ুন যে কোনো কাজে, সমাজের সাথে কাজ করুন, জীবনের নানান কাজের সাথে জড়িয়ে পড়ুন, খবর নিন আপনার প্রতিবেশির, বন্ধুবান্ধব, পরিবারের কে কেমন আছে। আমার মনে হয় লোকজন নিজের গণ্ডীতে আটকে থাকতে থাকতে অলস হয়ে পড়ে এবং কোনো কাজে যুক্ত হতে পারে না। এভাবেই তারা হতাশাগ্রস্থ হয়ে পড়ে এবং বুড়িয়ে যায় দ্রুত।

আমি ওলগা মুরে নামের ৯২ বছর বয়স্ক এক নারীকে চিনতাম। তিনি হলেন আমার দেখা সবচেয়ে স্বতঃস্ফূর্ত মানুষ। তাঁর একটি প্রতিষ্ঠান ছিল নেপালে যেটা এতিম শিশুদের নিয়ে কাজ করে। তিনি প্রতি বছর একবার নেপালে গিয়ে প্রতিষ্ঠানটি দেখাশোনা করেন। তিনি হাজারো শিশুদের সাহায্য করেন। এভাবেই তিনি ৯২ বছর বয়সেও স্বতঃস্ফূর্ততার সাথে বেঁচে আছেন। এর কোন বয়সসীমা নেই।

আপনি বলেছেন নারীবাদী শব্দটি আবিষ্কারের বহু আগে থেকেই আপনি এই ধারণার সাথে পরিচিত ছিলেন এবং নির্যাতিতা  নারীদের সান্নিধ্যে যাবার পর তারা যে কতটা অসুখী তার সাক্ষী হয়েছেন। শব্দটি এখন নারীদের পক্ষে। আপনি কি মনে করেন তারা আগের চেয়ে এখন বেশিমাত্রায় সুখী?

আমার মনে হয় আমরা অনেক অগ্রসর হয়েছি। আমার জন্ম হয়েছিল চল্লিশের দশকের চিলিতে যেটা ছিল সামাজিকভাবে খুব রক্ষণশীল এবং ধর্মীয় গোঁড়ামিতে পরিপূর্ণ। তখনকার নারীদের অবস্থা বর্তমানের চেয়ে অনেক খারাপ ছিল। এখন আমাদের একজন নারী প্রেসিডেন্ট আছেন। এতে বোঝা যায়, আমরা কতদূর এগিয়েছি এবং অধিকাংশ দেশেই নারীদের অবস্থার অনেক উন্নতি ঘটেছে। তা সত্ত্বেও, এখনো নারীরা নিগ্রহের শিকার। নারীরা এখনো ধর্ষিত হচ্ছে, সামাজিকভাবে বঞ্চনার শিকার হচ্ছে, নানা ভাবে নানা দেশে নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। কোনো কোনো অঞ্চলে নারীদেরকে গৃহপালিত পশুদের মতো দেখা হয়, সমাজে যাদের বিন্দুমাত্র সম্মান নেই। তাই এখনো আমাদের কাজ করে যেতে হবে তাদের জন্য। ইতিমধ্যে বেশ কিছু কাজ হয়েছে এবং সেটার কৃতিত্ব দিতে হয় নারীবাদীদের। আমার মনে হয় নারীদের নিজেদের অধিকারের জন্য নিজেকেই লড়তে হবে, কেউ তা আপনা আপনি এনে দেবে না, আদায় করে নিতে হবে।

আমার মনে হয় নারীদের নিজেদের অধিকারের জন্য নিজেকেই লড়তে হবে, কেউ তা আপনা আপনি এনে দেবে না, আদায় করে নিতে হবে।

আজকের তরুণীরা যদি মনে করে তাদের আর কিছু করার নেই, তারা সব পেয়ে গেছে, তাদের সংগ্রামের অবসান ঘটেছে, তাহলে সেটা ভুল হবে। যুক্তরাষ্ট্রে ট্রাম্পের মতো নারীবিদ্বেষী প্রেসিডেন্ট আছে এখন। একজন ভয়ংকর মানুষ। ওখানে প্রচুর নারী আন্দোলন করছে প্রতিটি শহরে এবং এসবের সাথে তাদের যুক্ত হওয়া খুব জরুরি।

আজকের ভেনেজুয়েলার রাজনৈতিক পরিস্থিতির শিকার যুবক-যুবতীদের প্রতি আপনার বার্তা কি জানতে চাইলে আপনি বলেছিলেন, সরকারগুলো নিদির্ষ্ট মেয়াদে ক্ষমতা হারায়, কিন্তু জনগণের অবস্থান বদলায় না। দেশের সুখ-সমৃদ্ধির ক্ষেত্রে সরকারগুলোর কতটা প্রভাব থাকে বলে মনে করেন?

এটা নিয়ে আরো অনেক কাজ করার আছে। সরকার আসে সরকার যায়, কিন্তু মানুষের অবস্থার পরিবর্তন হয় না। চিলিতে আমাদের একই অভিজ্ঞতা হয়েছে। আমাদের দীর্ঘ ১৭ বছর একনায়কের শাসন ছিল, এখন সেটা বদলেছে এবং আমাদের এখন গণতন্ত্র আছে। এক নায়কের শাসনকালে আমাদের কারো স্বাধীনতা ছিল না, কোনো মুক্ত সংবাদপত্র ছিল না, কোনো তথ্য ছিল না, কোনো প্রগতিশীল কাজকর্ম ছিল না, আপনি যে কোনো সময় গ্রেফতার হতে পারেন, যখন তখন গুম খুন হতে পারেন এটা এত স্বাভাবিক হয়ে গিয়েছিল যে কেউ এটা নিয়ে মাথা ঘামাতো না। ফলে আমাদের মধ্যে সব সময় এমন ভীতি কাজ করতো যে কেউ সুখী জীবনযাপনের কথা ভাবতে পারতো না। কেউ কেউ ব্যক্তিগতভাবে সুখী জীবনযাপন হয়তো করতো, কিন্তু রাষ্ট্রীয়ভাবে কেউ সুখী ছিল না।

আমরা আমেরিকাতে এমন একটা পরিস্থিতিতে আছি যেখানে অন্তত অর্ধেক দেশ, কমপক্ষে অর্ধেক দেশ, বেশিও হতে পারে – খুব উদ্বেগের মধ্যে আছে। দেশটা কোথায় যাচ্ছে সেটা নিয়ে মানুষ খুব ভয়ে আছে, এই যে প্রেসিডেন্ট একটা বদ্ধ উন্মাদ তিনি দেশকে কোথায় নিয়ে যাবেন সেটা নিয়ে আমরা সবাই আতঙ্কিত। আমেরিকাতে যা ঘটছে তা নিয়ে আমি খুব শঙ্কিত। তবে আমার আশা আছে এই দেশের প্রতিষ্ঠানগুলো খুব শক্তিশালী, তারা চাইলে এসব পাগলামির হাত থেকে দেশটাকে রক্ষা করতে পারে। যদি তারা না পারে তাহলে দেশটা কোন অন্ধকারে তলিয়ে যাবে কেউ সেটা জানে না। সুতরাং এটা খুব সত্যি যে রাজনৈতিক পরিস্থিতি দেশকে ক্ষতিকর পরিণতির দিকে ঠেলে দিতে পারে। সিরিয়ার কথা ধরুন, যেখানে লাখ লাখ মানুষ উদ্বাস্তু জীবনযাপন করছে, লাখ লাখ মানুষ গত ষাট বছর ধরে হিমশিম খাচ্ছে বেঁচে থাকার জন্য।

গত দেড় বছর ধরে আমি সুখ বিষয়ে বিভিন্ন মানুষের সাক্ষাতকার নিয়ে আসছি। তাঁদের অধিকাংশই বিজ্ঞানী, যাঁরা এ বিষয়ে গবেষণায় নিয়োজিত আছেন। আমার কিন্তু মনে হয়েছে বিজ্ঞান সুখ সম্পর্কে বুঝতে এবং সেটিকে পরিমাপ করতে ব্যর্থ হয়েছে। আপনি সুখ শব্দটিকে ঠিক কিভাবে আখ্যায়িত করেন এবং আপনি কি মনে করেন সুখ বিজ্ঞানের চেয়ে শিল্পের বেশি নৈকট্যে অবস্হান করে?

আমার মনে হয় না বিজ্ঞান দিয়ে তুমি সুখ-শান্তিকে ব্যাখ্যা করতে পারবে। সুখ হলো একটা অনুভব। আমি মনে করি না সুখ স্থায়ী কোন বিষয়, এটি একটি সাময়িক ব্যাপার। তুমিই এক মুহুর্তে সুখী হতে পারো আবার পরের মুহুর্তে অসুখী হতে পারো। যদি কেউ মনে করে যে আমরা কোনো রকম অসুবিধা ছাড়া নিরবচ্ছিন্নভাবে সুখী হতে পারবো, সেটা একটা পাগলামী ধারণা। ওটা সেভাবে ঘটে না। আমার কাছে সুখ হলো তোমার যা আছে তাই নিয়ে স্বচ্ছন্দে থাকা। তার মানে এটা নয় যে, তোমার কোন স্বপ্ন থাকবে না, কোনো চাওয়া থাকবে না। কিন্তু মূল ব্যাপার হলো, তোমার যতটুকু আছে ততটুকু নিয়ে বিদ্যমান পরিস্থিতির মধ্যে সুখী হবার চেষ্টা করা। কখনোই বেশি বেশি পেতে চাইবে না। কারণ যত বেশিই তুমি পাও, তারপরেও তোমার চাওয়া থেকে যাবে, এটা এক অনিঃশেষ যুদ্ধ। তুমি কখনোই সবকিছু এমনভাবে পেয়ে যাবে না যা তোমাকে চিরসুখী করতে পারে।

সুখ হলো এমন একটা ব্যাপার যা তোমার হৃদয়ের ভেতরে বাস করে, তোমার আত্মার সাথে সম্পৃক্ত, এর সাথে তোমার বাইরের পৃথিবীর কোনো সম্পর্ক নেই। এটা পুরোপুরি তোমার উপর নির্ভর করছে, বিজ্ঞানের কিছু করার নেই এখানে। হ্যাঁ, মাঝে মাঝে এটা হরমোনের ব্যাপার যে তুমি কি রকম মানুষ। পৃথিবীতে অনেক মানুষ দুঃসহ জীবনযাপন করছে, ভয়ানক দুঃস্বপ্নের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, একই সাথে তারা আবার সুখী হবার মতো যোগ্যতা রাখে। আবার কোনো কোনো মানুষের সবকিছু আছে, টাকাপয়সা, রূপ যৌবন সব আছে, তারা যা পেতে চায় সবকিছুই আছে, তবু তারা বিষন্ন, অসুখী, হতাশ। এর মানে হলো সবকিছু নির্ভর করে ব্যক্তিমানুষের উপর।

আলোচনার প্রেক্ষিতে এই প্রশ্নটি এসেই যাচ্ছে- কোন সময়টিতে আপনি সবচে’ কর্মক্ষম থাকেন যখন বিমর্ষ হন তখন নাকি যখন আনন্দে থাকেন?

এসবের সাথে আমার কাজের কোনো সম্পর্ক নেই। লেখালেখি আমার কাজ। তুমি যখন চাকরি করো প্রতিদিন অফিসে যেতে হয়, এমনকি তুমি অসুখী হলেও যেতে হয়। আমি প্রতিদিন সকাল ছটার সময় ঘুম থেকে উঠি। প্রথমে আমি আমার ইমেইলগুলোর জবাব দেই। তারপর আমি কাজ করতে শুরু করি এবং আমার কাজই হলো লেখালেখি। এটা কোনো ব্যাপার নয় যে আমি সুখ অনুভব করছি কি না, আমার মাথাধরা আছে কি না। আমার যেটা বিবেচনা সেটা হলো আমাকে এই বইটি লেখে শেষ করতে হবে এবং আমি সেটাই করি। ওটার সাথে আমার সুখের কোনো পর্যায়ের কোনো সম্পর্কে নেই।

‘জাদুবাস্তবতা’ সংজ্ঞার্থে আপনার বইগুলোর সাথে যেন ধরাধরি করে চলে। এভাবে বিশেষায়িত হতে আপনার কেমন লাগে এবং আজও কি আমাদের জীবনে জাদু এবং বাস্তবতার আলাদা করে কোনো জায়গা বাকি রয়েছে ভাবেন?

ব্যাপারটা নির্ভর করে জাদুবাস্তবতার আজকের সংজ্ঞার উপর। আমার কাছে বাস্তবতার মধ্যেও নানান রহস্যময় মাত্রা ধরা পড়ে, এমন কিছু ব্যাপার আছে যা তুমি সমাধান করতে পারছো না, নিয়ন্ত্রণ করতে পারছো না। সেই রহস্যময় মাত্রার জগতটা এবং আমি বলছি না এটা আধিভৌতিক কোনো ব্যাপার, কিন্তু আমি মনে করি যাদের আমি ভালোবাসি তারা জীবিত হোক কিংবা মৃত হোক কিংবা দূরে থাকুক সেটা ব্যাপার না, তারা সব সময় আমার সাথে থাকে। আমি তাদেরকে আমার জীবনে জড়িয়ে রাখি। আর সব রকমের রহস্য, কাকতাল, স্বপ্ন, এমনকি সেটা অলৌকিক নির্দেশজাত স্বপ্ন হলেও – সেগুলো আমার জীবনের অংশ। খুব কঠিনভাবেই আমার সাথে সম্পৃক্ত। আমি তাদেরকেই আমার বইতে রাখি। ওটাই আমার কাছে জাদুবাস্তবতা। আমার মনে হয় সব মানুষের জীবনে এরকম জাদুবাস্তবতার অবকাশ থাকে।

সাক্ষাৎকারটি ইরিনা অ্যাটানসোভা’য় (irinaatanasova.com) প্রকাশিত

সাক্ষাৎকার : দুই

 [এ সাক্ষাৎকারটি ইসাবেল আয়েন্দের বহুল প্রশংসিত “অ্যা লং পেটল অফ দ্য সী” উপন্যাসটিকে কেন্দ্র করে মূলত নেয়া। এখানে বইটি সম্পর্কে আয়েন্দে নানা প্রশ্নের উত্তর দেবার পাশাপাশি নিজের লেখাজোকা, ব্যক্তিগত অনুভূতি নিয়েও কথা বলেছেন।]

অ্যা লং পেট্ল অফ দ্য সী”র আখ্যান শুরু হয়েছে স্প্যানিশ গৃহযুদ্ধের পর, সে যুদ্ধের কারণে কয়েক হাজার মানুষ স্পেন থেকে পালিয়ে যায়। এই উপন্যাসটি লেখার পেছনে আপনাকে কোন বিষয়টি অনুপ্রাণিত করেছিল?

আমি সেইসব স্প্যানিয়ার্ডদের গল্পটি জানতাম যাঁরা স্পেনের গৃহযুদ্ধ থেকে পালিয়ে এসে কয়েক দশক ধরে চিলিতে আশ্রয় নিচ্ছিলেন। তাঁদের মধ্যে ভিক্টর পেই নামের একজন আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয়েছিলেন।  দুর্ভাগ্যক্রমে আমি তাঁকে উৎসর্গীকৃত পান্ডুলিপিটি পাঠানোর এক সপ্তাহ আগেই তিনি মারা যান। গল্পটি অনেক আগে লিখতে পারতাম আমি।  তবে এখন সারা পৃথিবীতে লক্ষ লক্ষ শরণার্থীর যে সমষ্টিগত যন্ত্রণা দেখছি তাতে কাজটি আমার করতেই হলো। আমার শেষ তিনটি বই, জাপানি প্রেমিক, দ্য মিডস্ট অফ উইন্টার এবং এ লং পেটাল অফ দ্য সী, লাখ লাখ মানুষের স্থানচ্যুতি, অভিবাসী এবং শরণার্থী বিষয়কে কেন্দ্র করে রচিত হয়েছে।

 আপনার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা এবং পারিবারিক অবস্থা কতটা প্রভাবিত করেছে যখন আপনি “অ্যা লং পেটাল অব দ্য সী” লিখেছেন?

 স্থানচ্যুতি, শেকড় থেকে উপড়ে যাওয়া এবং চিরকালের প্রবাসী হয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা আমি নিজে খুব ভালো বুঝি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কারণে। চিলিতে ১৯৭৩ সালের সামরিক অভ্যুত্থানের পরে, আমার পরিবার একনায়কতন্ত্রের দ্বারা নির্যাতিত হয়েছিল। কেউ মারা গেছে, কেউ গ্রেফতার হয়েছে আর বাকীরা বেশিরভাগ দেশ ছেড়ে চলে গিয়েছিলাম নির্বাসনে। ১৯৩৯ সালে যারা স্পেন থেকে পালিয়ে এসেছিল তাদের ট্র্যাজেডিকে আমি তাই খুব ভাল করেই বুঝতে পারি। তারাও নিষ্ঠুর এক নায়কের অত্যাচারের হাত থেকে পালিয়ে এসেছিল।

অ্যা লং পেটাল অব দ্য সী উপন্যাসে আপনি পাবলো নেরুদাকে খুব বড় করে এঁকেছেন, যিনি একটি জাহাজ ভাড়া করে চিলির প্রধান চরিত্রগুলোকে তুলে নিয়েছেন এবং শিরোনামটাও খুব প্রেরণাদায়ক। তাঁকে এত বড় করে আঁকার জন্য কোন বিষয়টি আপনাকে সবচেয়ে বেশি অনুপ্রাণিত করেছিল?

পাবলো নেরুদা ছাড়া আশার জাহাজ হিসেবে চিহ্নিত উইনিপেগের ব্যবস্থা করা কখনোই সম্ভব হতো না। তিনি স্পেনকে ভালোবাসতেন এবং স্পেনের গৃহযুদ্ধ নিয়ে তিনি খুব হতাশ ছিলেন। তিনি চিলির প্রেসিডেন্টকে বুঝিয়ে বেশ কিছু শরণার্থীকে  আশ্রয় দেবার ব্যবস্থা করেন ক্যাথলিক চার্চের বিরোধিতা সত্ত্বেও।  তিনি বিশেষ দুত হিসেবে প্যারিস গিয়ে চাঁদা তুলে উইনিপেগ নামের কার্গো জাহাজ কিনেন এই শর্তে যে ওটাকে দুটো মহাসাগর অতিক্রম করে ২২০০ যাত্রীকে চিলিতে পৌছে দিতে হবে নিরাপদে। তিনি তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন যে লোকে তাঁর কবিতা ভুলে গেলেও উইনিপেগ জাহাজকে কখনো ভুলবে না। আমি আমার সব লেখালেখির কাজে পাবলো নেরুদার উপস্থিতি অনুভব করি। তাই এটা বলতে দ্বিধা নেই যে এই বইটি তাঁকে উৎসর্গ করে লেখা।

আপনি কিভাবে “আ লং পেটাল অব দ্য সী” নিয়ে গবেষণা (অর্থাৎ তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ) করেছিলেন?

এটা নিয়ে গবেষণা করার কাজটা সহজ ছিল কারণ এটা সাম্প্রতিক ইতিহাস এবং এটা নিয়ে প্রচুর কাজ হয়েছে যথেষ্ট তথ্য প্রমাণ আছে চিলি এবং স্পেনে।  তবে আমাকে সবচেয়ে বেশি যেটা সাহায্য করেছে সেটা হলো ওই ঘটনার সময় যারা জীবিত ছিল, বিশেষ করে আমার বন্ধু ভিক্টর পেই, যিনি ছিলেন সেই উইনিপেগের একজন যাত্রী, যাঁর কাছ থেকে আমি ওই যুদ্ধের সকল তথ্য, ফ্রান্সের কনসেনট্রেশন ক্যাম্প এবং চিলির অভ্যুত্থানের আগে ও পরের সময়ে ঘটনার বিষয়ে তাঁর প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা আমার খুব কাজে লেগেছিল। দুর্ভাগ্যজনকভাবে তিনি পাণ্ডুলিপি পাঠাবার এক সপ্তাহ আগে মারা গেলেন। তাঁর ১০৩ বছর বয়স হয়েছিল তবু তিনি দৃঢ় এবং অনমনীয় ছিলেন।

আপনি আপনার লেখালেখির জীবনে বিশটির অধিক বই লিখেছেন। সময়ের সাথে আপনার লেখালেখির প্রক্রিয়া কিভাবে বিবর্তিত হয়েছে?

 আমি এখন অনেক চাপমুক্ত কারণ আমি শিখেছি যে যদি আমার যথেষ্ট সময়, নীরবতা এবং নিঃসঙ্গতা থাকে আমি যে কোনো বিষয়ে লিখতে পারি। প্রেরণা গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু শৃঙ্খলা হলো অতিশয় অপরিহার্য। আমি এখনো আমার সব বই একই দিনে শুরু করি এবং আমি দিনের বহু ঘন্টা লিখি কিন্তু আমি তাতে মোহগ্রস্থ নই আর। আমি আমার জীবনকে উপভোগ করতে চেষ্টা করছি। আমি সবেমাত্র বিয়ে করেছি ৭৭ বছর বয়স আমার, আমি আমার জীবনের অন্যান্য বিষয়গুলো উপভোগ করতে চাই, শুধু লেখালেখি নয়।

হুলু (আমেরিকান সাবস্ক্রিপশন ভিডিও অন ডিমান্ড সার্ভিস) দ্য হাউস অব স্পিরিটসকে ধারাবাহিক করতে চাইছে। এটা ১৯৯০ দশকেও একবার চলচ্চিত্রে রূপান্তরিত করা হয়েছিল।  আপনার বইকে যখন চলচ্চিত্রে রূপ দেয়া হয় তখন আপনার কেমন লাগে?

অন্য নির্মাতারা আমার সৃষ্টিকে কিভাবে দেখছেন সেটি নিয়ে আমি আসলে সবসময় কৌতূহলী। কিভাবে তাঁরা এটা নিয়ে কাজ করছেন। তবে আমি তাঁদের কাজে কখনো নাক গলাই না। আমি কখনো চাই না কোনো কিছু লেখার সময় আমার কাঁধের উপর কেউ দাঁড়িয়ে থাকুক, তাই আমিও অন্যদের বেলায় সেটা করি না। তবে আমি এই ব্যাপারে ভাগ্যবান। আমার বই নিয়ে শুধু সিনেমা বা টিভি সিরিজ হয়নি, ব্যালে, অপেরা থিয়েটার ইত্যাদিতেও কাজ হয়েছে। ব্যাপার যাই ঘটুক সবদিকেই আমার কাজের অ্যাডাপটেশান আমার জন্য উইন উইন সিচ্যুয়েশান। যদি সেটা সফল হয় আমার বইও জনপ্রিয়তা পায়। আর যদি ব্যর্থ হয় তখন লোকে বলে ওটার চেয়ে বইটা অনেক ভালো ছিল।

সময়টা জানুয়ারি ৮ তারিখের কাছাকাছি যেদিন থেকে আপনি আপনার পরবর্তী বইয়ের কাজ শুরু করেন। আপনি কী বলবেন আপনি এরপর কোন বইটি লিখবেন?

আপাতত আমার মাথায় কোন গল্প নেই, কিন্তু তাই বলে আমি আমার প্রিয়তম দিনটিতে কোনো কিছু না লিখে থাকতে পারি না। আ্মি একটা ননফিকশন বই লেখার পরিকল্পনা করেছি নারী এবং নারীবাদী হিসেবে আমার অভিজ্ঞতা নিয়ে।

সাক্ষাৎকারটির সঞ্চালনায় ছিলেন মেলিসা ফ্লান্ডারউ এবং ফ্রান্সিস বোগান।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ভাষা
Scroll to Top