Home » ইচথিস // শৌনক দত্ত

ইচথিস // শৌনক দত্ত

পুব আকাশে তখন সূর্যের আলো ফুঁটতে শুরু করেছে। আড়মোড়া ভেঙে সজাগ হচ্ছে সবুজ প্রকৃতি। চারিদিক থেকে আসছে পাখির কিচিরমিচির শব্দ। ভোরের আলোয় নদী চিকচিক করছে। সেই আলো নদীর গায়ে পড়ে অপরূপ সৌন্দর্য সৃষ্টি হয়েছে। প্রকৃতি যেন ভোরের আলোয় স্নান সেরে উঠেছে। ঢেউ আঁচড়ে পড়ছে ঢেউয়ের বুকে। নদীর উথাল-পাথাল এই ভোর বড় চেনা কেননা পুরাতন ডিঙ্গি নৌকাটাতেই জীবনটা পার করে দিল সত্য। বার বছর বয়সেই সে মাছ ধরার কাজ শুরু করে। গত ত্রিশ বছর ধরে জলের সামান্য নড়াচড়া দেখেই সে বুঝতে পারে মাছেদের গতিবিধি। খরায় মাটির ত্রাহি অবস্থা; বীজগুলোও তাদের কথা রাখছে না। মাছ ধরে ফিরে আসার পর তার স্ত্রী-সন্তানদের শুলদৃষ্টি থেকে নিজেকে বাঁচানোর কোনো উপায় তার জানা নেই। কুকুরের মতো চেয়ে থাকাকে সে ঘৃণা করে কিন্তু সে জানে ক্ষুধা মানুষকে পশু বানিয়ে দেয়। ধীরে ধীরে ডিঙ্গি নৌকা বায় আর নিজের ভবযন্ত্রণার কথা ভাবে। নৌকা বাইতে বাইতে নদীটার সরু অংশে মেহগুনি গাছের নিচে এসে থামে। জিরিয়ে নেয় যাতে দুঃখের ভাবনাগুলোকে তাড়িয়ে দেওয়া যায়। জলের বুকে ডিঙ্গিটাকে স্থির রাখার জন্য সে ধীরে ধীরে বৈঠা দিয়ে জলে মৃদু আঘাত করে। কিন্তু ভাবনাগুলো তার পিছু ছাড়ে না। 

চারদিকে জল আর জল। জল ছাড়া আর কিছু নেই। ডিঙ্গিটা এদিক-ওদিক যত নড়ে তার যাতনা ততো বাড়ে। ‘একদিন দুঃখগুলো আমাকে খেয়ে ফেলবে, নদীই আমাকে গিলে ফেলবে।’

সে কল্পনা করে, তার লাশ ভাসছে নদীর জলে বউ আর ছেলেমেয়ে তাকে কাদা থেকে টেনে হিঁচড়ে তুলে নিয়ে যাচ্ছে যেভাবে জল থেকে কোনো গাছ উপরে উঠালে তার শিকড়-বাকড় ছিঁড়ে যায়, ঠিক সেইভাবে। 

মাথার ওপর সূর্যের প্রখর তাপকে ধরে ফেলছে মেহগুনি গাছটা। কিন্তু সেদিকে সত্যর কোনো নজর নেই। তার চোখ তখন তার আত্মার গভীরে উঁকি দিতে ব্যস্ত। মনে হয় তার চোখও অন্ধ হয়ে গেছে, কারণ বেদনাগুলো ধুলোর মতো তার চোখের আলো নিভিয়ে দিয়েছে। সূর্যটা অনেক উপরে উঠে গেছে, তবুও সে সকালের সুঘ্রান পাচ্ছে।

‘আমি যদি নীল আকাশে মিলিয়ে যেতে পারতাম’, সে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে। 

ত্রিশ বছরের ক্লান্তির বোঝা অনুভব করে সে। তার বাবার মুখের কথাগুলো যা তিনি তাকে সাহস দেয়ার জন্য বলতেন, তা মনে পড়ে। 

‘ওই যে শিকারির দিকে তাকিয়ে দেখ। ও কী করছে? যে মুহূর্তে সে একটা হরিণকে দেখে, ঠিক সেই মুহূর্তেই সে তার বর্শা তাক করে। কিন্তু জেলে তো জলের মধ্যে মাছ দেখে না। একজন জেলে নিজে যা দেখে না তা বিশ্বাস করে।’

ওটাই ছিল তার ধরা-বাঁধা জীবনের শিক্ষা। এখন সে ওই জ্ঞানগর্ভ কথাগুলো স্মরণ করছে। 

দেরি হয়ে যাচ্ছিল। ক্ষুধাও তাকে জানান দিচ্ছিল যে, তার ঘরে ফেরার সময় হয়ে গেছে। চোখে মুখে জল দেবার জন্য সে দুহাতে নদী থেকে জল তুললো আর জলের সাথে করতলে উঠে এলো ছোট্ট একটা মাছ। মাছটি দেখতে অভিজাত, আর জৌলুসেও আত্মম্ভরী। ছোট্ট মাছটি সত্যর নজর কাড়লো। এক ধরনের রহস্যময় উদ্বিগ্নতা তার ওপর ভর করলো। মাছটি করুণ স্বরে বললো, দোহাই এই নদীর জলে আমাকে ত্যাগ কর না। এখানে কেউ আমাকে বাঁচিয়ে রাখবে না। খেয়ে সাবাড় করে দেবে। ছোট্ট একটি মাছকে কথা বলতে দেখে সত্য অত্যন্ত বিস্মিত হলো।

মাছটা নড়লো না। সত্য এবার অবাক হতে শুরু করলো, ওটা তো মাছ নয়। এটা ঈশ্বরের নিদর্শন। ঈশ্বরের সাবধান বাণী তার সব সুখ-শান্তি নষ্ট করে দিলো। 

মাছটাকে সঙ্গে নিয়ে সে গ্রামে ফিরলো। তার বউ তাকে ফিরে আসতে দেখে তো মহাখুশি: 

‘নাও, দুপুরেই মাছটাকে খেয়ে ফেলি।’ আল্লাদে গদগদ হয়ে সে তার ছেলেমেয়েদের ডাকলো। ‘কইরে তোরা দেখবি আয় তোদের বাবা, কি মাছ এনেছে দেখে যা।’ 


কোনো প্রত্তুত্তোর না করে সত্য মাছটাকে মাটির ঘটিতে রেখে বসে গেল মাছটার জন্য জলাশয় বানানোর কাজে। এত বড় করে ড্রাম কেটে জলাশয় বানালো, যার মধ্যে আস্ত একজন মানুষও সাঁতার কাটতে পারবে। মাছটাকে সেখানে ছেড়ে দিল সে। 

বউ তো হতভম্ব হয়ে বলতে লাগলো: লোকটা পাগল হয়ে গেছে। সময় যত গড়িয়ে যেতে থাকলো, সত্য লক্ষ্য করলো মাছটা বিস্ময়করভাবে বড় হচ্ছে রোজ। 

মাছটাকে দেখিয়ে সত্যর বউ জিজ্ঞাস করে– 

‘খিদা আমরারে কিভায় জ্বালাইতাছে হেইডা দেইখ্খাও কি তুমি মাছটারে মারতা না? সত্য হাত উঁচিয়ে জোর দিয়ে বলে, ‘কখনোই না! মাছটাকে যে স্পর্শ করবে সে ঈশ্বরের তরফ থেকে শাস্তি পাবে। সারা জীবনের জন্য অভিশপ্ত হবে।’ 

দিন যায়, রাত যায়। জেলে ঈশ্বরের তরফ থেকে নতুন কোনো নির্দেশনা আসার অপেক্ষায় থাকে। আর্দ্র দুপুরের ভীষণ রোদে সে নদীর ধারে বসে থাকে। সূর্য অস্ত গেলে মাছটাকে দেখতে যায়। মাছটা ধীরে ধীরে ফুলে–ফেঁপে উঠছে। সে লক্ষ্য করলো যে মাছটা ধীরে ধীরে বিষন্ন হয়ে পড়ছে। কেন এমন হচ্ছে সে বুঝতে পারলো না, সে ভাবে আর ভাবে। ওই যে নিদর্শন, সাদা পালকের মতো বিদ্যুতের ঝলকানি নির্দেশ করছে যে, ঈশ্বরের মেজাজ-মর্জির পরিবর্তন হতে চলেছে। মানুষ যদি ঈশ্বরের বার্তা বাহকদের প্রতি করুণা বর্ষণ করে, তাহলে খরার সমাপ্তি ঘটবে এবং বর্ষা মৌসুমের সুত্রপাত হবে। তার মতো একজন জেলের কাঁধে ঈশ্বরের প্রতিনিধির মেহমানদারী করার দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে। তার দায়িত্ব হলো এটি প্রমাণ করা যে, মানুষ এখনো ভালো কাজ করতে পারে। এই সত্যিকারের ভালত্ব প্রদর্শন করা যায় তখনই, যখন ক্ষুধা শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে খেমটা নৃত্য নাচে। যখন প্রাচুর্য থাকে, তখন নয়। একটি আওয়াজ তার চিন্তায় বাগড়া দিল। তার হঠাৎ মনে হলো মাছটি তার নাম ধরে ডাকছে। মনের ভুল ভেবে যখনই সে আবার চিন্তায় ডুব দেবে আবার সেই ডাক সত্য,ও সত্য…


সত্য বিস্ময়ে তাকালে মাছটি ফিসফিস করে বলে আজ থেকে ছদিন পরে অর্থাৎ সাতদিনের মাথায় সমুদ্রে প্রলয় শুরু হবে। জলে ভেসে যাবে চারদিক। সব জলের তলায় চলে যাবে। সত্য সবাইকে প্রলয়ের কথা বলে বেড়াতে লাগলো, এবং তাকে এই কথা যে মাছটি বলেছে সে কথাও বলতে লাগলো। খরায় মাটি ফেটে চৌচির নদী নালা সব শুকিয়ে গেছে এমন দিনে প্রলয়ের কথা যে শোনে সেই হাসে। আবহাওয়া দপ্তর গত সপ্তাহেই জানিয়ে দিয়েছে আগামী একমাসে কোথাও কোন বৃষ্টির সম্ভাবনা নেই।

গ্রামে গুজব রটে গেল সত্য পুরোপুরি পাগল হয়ে গেছে। অনেক হুমকি-ধামকির পর তার বউও বাচ্চা-কাচ্চাদের নিয়ে বাড়ি ছেড়েছে। সত্য যেন তার পরিবারের অনুপস্থিতি উপলব্ধিই করে না। সে মাছ রক্ষণাবেক্ষণে আরো বেশি সতর্ক ও মনোযোগী হয়ে উঠলো। সে তার চারপাশে ঈর্ষার গন্ধ পায়। প্রতিহিংসাও গজে উঠছে। ঈশ্বর তাকে এ কাজের জন্য বেছে নিয়েছেন– এটা কি তার অপরাধ? লোকজন বলাবলি করে, ও পাগল হয়ে গেছে। তবে যাকে ঈশ্বর মনোনীত করেন, সে তার নিত্যদিনের স্বাভাবিক কর্মকান্ড থেকে সরে যায়। 


তারপর পঞ্চমদিন বিকেলে যখন সে নদীতে তার কাজ শেষ করে এনেছে, তখন এক অজানা আশঙ্কা তার ওপর ভর করলো : মাছটার কী যে হলো! সে ছুটলো বাড়ির দিকে। কাছাকাছি যেতেই দেখল ঘর বাড়ি চারপাশের গাছগুলোর ডুবে যাচ্ছে। সে দ্রুত ডিঙ্গি চালাতে লাগলো। তীরের কাছাকাছি পৌঁছেই লাফিয়ে পড়লো। নৌকাটা বাঁধলোও না। দেখলো গোটা গ্রাম ধীরে ধীরে ডুবে যাচ্ছে।

সত্য ভয়ে পিছু হটলো। স্ত্রী-সন্তানদের উদ্দেশে চিৎকার করলো। কিন্তু যখন দেখল কেউ কোত্থাও নেই, তখন সে রাগে-দুঃখে কাঁদতে শুরু করলো। 

পরের দিন গ্রামের সবাই সত্যকে নদীর স্রোতের মধ্যে পড়ে থাকতে দেখল। সকালের শিশিরে সে শক্ত হয়ে গেছে। যখন তারা তাকে তোলার চেষ্টা করলো, দেখল, সে খুবই ভারী এবং জল থেকে তাকে কেউ আলাদাই করতে পারল না। সবচেয়ে শক্তিশালী লোকটাকেও এ কাজে লাগানো হলো। কিন্তু ওদের সব চেষ্টা ব্যর্থ হলো। 

শরীরটা নদীর জলের সঙ্গে যেন আটকে গেছে। এক অদ্ভুত আতঙ্ক উপস্থিত সবাইকে পেয়ে বসলো। ভয় লুকানোর জন্য কেউ একজন বলে উঠলো : 

‘যাও যাও, সত্যর বউকে খবর দাও। অন্যান্যদের বলো, পাগলটা মরে গেছে।’ 

একে একে সবাই কেটে পড়লো। ওরা যখন তীর বেয়ে উপরে উঠছিল তখন মেঘ গর্জন করে উঠলো। আকাশটা যেন বিষন্নভাবে কাঁশি দিলো, মনে হলো যেন ও অসুস্থ। অন্য পরিস্থিতিতে ওরা বৃষ্টির আগমনকে উদযাপন করতো। তবে এখন না। এই প্রথমবারের মতো সবাই বিশ্বাস করলো যে, বৃষ্টি হবে না। 

নির্বিকারভাবেই দূরে নদীটা মানুষের অজ্ঞতা দেখে কলহাস্যে বয়ে চললো। সত্য নদীর ঢেউয়ের মধ্যে আলতোভাবে ঘুমিয়ে পড়েছে। নদীটা তাকে ভাটির দিকে বয়ে নিয়ে যেতে লাগলো। যে অজানা পথগুলো সত্যর স্বপ্নের মধ্যে হাতছানি দিত, সেই পথে সে ভেসে চললো।

মধ্যরাত

৩ জানুয়ারি,২০২৪

শৌনক দত্ত

কবি ও কথাসাহিত্যিক। জন্ম ৭ আগস্ট, উত্তরবঙ্গের কোচবিহারে। স্কুল জীবন থেকেই লেখালেখির সূত্রপাত। সম্পাদনা করেছেন বেশ কয়েকটি সাহিত্য পত্রিকা এবং ওয়েবজিন। বর্তমানে ইরাবতী ডেইলি ওয়েবজিনের সাথে যুক্ত। প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ : জল ভাঙে জলের ভেতর [২০১১], ঠোঁটে দাও জ্যোৎস্নার বিষ [২০১২], ডুব সাঁতার [২০১৭, নিরুদ্দেশ গাছে সন্ন্যাসীর মুখ [২০১৭]। গল্পগ্রন্থ : কারুময় খামে অচেনা প্রেম [২০১২]। শখ বইপড়া, লেখালেখি, ছবিতোলা, গান শোনা ও ভ্রমণ। বেশ কিছু গানও লিখেছেন তিনি।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ভাষা
Scroll to Top