কিছু বিষয় যতই সহজ-সরল দেখাক, তা মোটেও সেরকম নয়, অন্ততপক্ষে সবসময় তো নয়ই। কোনো দায়িত্ব নিতে হবে বলে ভয় পাওয়া মানুষ অদ্ভুত ও অযৌক্তিক আচরণ করে। আমার এরকম ভাবার কারণ আছে। সাম্প্রতিক এক ঘটনায় যেমন আমার নিজেরই ভ্রান্ত আচরণকে আমি কিছুতেই যে বুঝে উঠতে পারিনি তার প্রকাশ এইরকম একটা উদাহরণে: ঘটনাটি ঘটে যাওয়ার বেশ কিছু বছর পর আমার মাথায় সেটা এল। নিঃসন্দেহে এই সচেতনতা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ক্রমশ প্রবলতর হয়েছে কিন্তু তা সত্ত্বেও সেই ঘটনার নানান দিক মাঝেমধ্যেই আমার স্মৃতির তলদেশ থেকে লাফিয়ে ওঠে, সজোরে এবং কোনো সতর্কবার্তা ছাড়াই।
সেই সময় ওকালতির চাপের সঙ্গে সঙ্গে দুটি মেয়েকে বড়ো করে তোলা, তাদের পড়ালেখা, তাদের চলাফেরার ওপর নজর রাখা, ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদীর দায়দায়িত্ব পালন ও এইরকম আরও অনেক কাজের বোঝা মাথায় নিয়ে আমাকে চলতে হত। অন্যসব কাজের চাইতেও বড়ো কাজ ছিল মেয়েদের যথাযথ ধর্মীয় শিক্ষার ব্যবস্থা করা।
আমার মেয়েদের আব্বার হাতে যথেষ্ট সময় থাকলেও, যেটা আগে থেকেই জানা ছিল, তার পুরো পরিবার তাকে এই দায়দায়িত্ব থেকে রেহাই দিয়ে ফতোয়া জারি করেছিল এই যুক্তি দেখিয়ে যে সন্তানদের যথাযথ লালন – পালনের দায়িত্ব মায়ের অর্থাৎ একমাত্র আমার কর্তব্য। এই সিদ্ধান্ত, বলা যায়, তখনকার সমাজের নিয়মের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ। আমি এই অভিব্যক্তিতে কখনোই অবাক হইনি যে শাড়ি হবে সুতা অনুযায়ী, মেয়ে হবে মায়ের মতো। একমাত্র পার্থক্য ছিল এই যে, যখন আমার স্বামীর আত্মীয়রা এইসব দায়দায়িত্ব আমার ওপর চাপিয়ে চুপ থেকেছে, আমার নিজের পরিবারের লোকজন অন্ততপক্ষে এইসব সামলানোর ব্যাপারে সাহায্য করতে চেষ্টা করেছে।
এই আগ্রহী সহায়তার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে, আমার ছোটো ভাই ইমাদ এসকল কাজের বোঝা আমার মাথায় চাপার এক সপ্তাহ পর আমাকে ফোন করে বলল, ‘ আপা, তোর মেয়েদের জন্য এক আরবি মাস্টার খুঁজে পেয়েছি। কখন বাড়ি থাকবি বল, তাকে সঙ্গে নিয়ে যাব।’
‘ কীভাবে তাকে লাগানোর ব্যাপারে আগেভাগেই ঠিক করে ফেললি? আগে তার ইন্টারভিউ নেবার দরকার ছিল না?’, আমি জিজ্ঞেস করলাম।
‘ইন্টারভিউ! বাপরে, মনে হচ্ছে যেন তাকে কোনো সরকারি চাকরি দিচ্ছিস, আর মাইনে হাজার টাকা!’, বিরক্তির সঙ্গে রেগে গিয়ে সে উত্তর করল যেন তার সাহায্যের চেষ্টাকে আমি নাকচ করছি। ‘ ব্যাপারটা তা নয়। তুই আমাকে ভুল বুঝছিস। আমি তো বাড়ি থাকব না। শুধু মেয়ে দুটিই থাকবে, এ কারণেই বলছিলাম, সব ঠিকঠাক আছে কি না। আর কিছু নয়। সে মাস্টার কি বিবাহিত?’ ইমাদ আরও রেগে গিয়ে বলল, ‘ আমি অত কিছু জানি না। জিজ্ঞেস করিনি। যদি চাস, নিজেই জেনে নিস, নাহলে ছেড়ে দে। তোর মেয়েরা পড়ল কি না পড়ল তাতে আমার কী? আম্মি বাড়িতে স্থির থাকতে দিচ্ছিল না আর এই বিষয়টি দেখার জন্য ঘ্যানঘ্যান করেই যাচ্ছিল’, বোনের সঙ্গে ঝগড়া বাধাতে সে তৈরি হল। পরক্ষণেই সে বলল, ‘তোর আদরের বরকে বল না, আল্লাহর কোনও ফেরেশতাকে ওই মাস্টারের বদলে হাজির করতে’, দুলাভাইয়ের নিস্পৃহতাকে ঠুসে বলতে চাইল সে।
‘ দেখ, কথার পর কথা বলে তর্ক জুড়িস না। অনেক মহান ব্যক্তি আছেন; তারা মাদ্রাসায় প্রচুর অর্থ ব্যয় করেন যাতে করে তাদের সন্তানেরা আরবি শিখতে পারে আর ভালো ধর্মীয় শিক্ষা লাভ করে। তুই কেমন শকুনিমামা? আমার মেয়ে দুটো কি তোর কেউ না? তাদের শিক্ষা-দীক্ষার দায়িত্ব কি তোরও নেই?’ আবেগ মিশিয়ে ভাইকে খানিক ব্ল্যাকমেইল করলাম।
সাথে সাথে সে প্রতিবাদ করল। ‘এখানে কোরান শিক্ষাই যখন বড়ো ব্যাপার তখন রামায়ণ, মহাভারত টেনে আমাকে অন্য পথে নিয়ে যাবি না। তখন অন্য কেউ এই আলোচনায় ঢুকে যাবে আর বিষয়টি পুরো বদলে যাবে।‘, পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টায় সে চেঁচিয়ে উঠল। ‘ উফ, এইসব ঘটে যখন তোর মতো পাগল তালগোল পাকিয়ে ফেলে। এটা এমন না যে ওরা দুজন আদৌ কখনোই আরবি শেখেনি। এরমধ্যেই ওরা বার তিনেক কোরান পড়ে ফেলেছে। এখন কোরানের আয়াতগুলি ঠিকভাবে পাঠ করার জন্য তাদের নানান শৈলী ও প্রক্রিয়া শিখতে হবে। তারপর তাদের ব্যাকরণ, শব্দের মানে – ঠিক যেমন ভাষা শিখতে যা যা লাগে, সব শিখতে হবে। আমি এমন একজনকে চাইছিলাম যে এই সব বিষয় ঠিকঠাক শেখাতে পারবে, বুঝতে পারলি? বিকেল পাঁচটায় ওই মাস্টারকে সঙ্গে নিয়ে আয়’, এই বলে কথাবার্তায় ইতি টানলাম।
ইমাদের কথাগুলো সারাদিন আমাকে খুঁচিয়ে মারল। সন্ধ্যায় ঠিক যখন অফিস থেকে বেরুতে যাব, গৌরী ডেকে বলল, ‘ ম্যাডাম, এক্ষুনি একবার আপিল কোর্টে যেতে হবে।‘
‘ কেন, সেখানে আবার কী?’
‘ মুনিস্বামী কেসের শুনানি হবে।’
‘ কেন! সকালে বিবেক যে বলল ওটা স্থগিত হয়ে গেছে।’
‘ হায় ভগবান, ম্যাডাম, আপনি তো জানেন বিবেক কেমন। এমনকি তার সামনে আমাদের কেস উঠলেও সে অন্য জগতে ভেসে বেড়াবে’, ঠান্ডা মেজাজ না হারিয়েও গৌরী খিটখিটে ঢঙে বলে।
‘ সপ্তাহখানেক সময় নাও, তারপর দেখছি।’
‘ আরো সময় নেওয়াটা কঠিন হতে পারে। আমি কি আরগুমেন্ট করে নেব, ম্যাডাম?’
এবারে আমি মেজাজ হারিয়ে ফেললাম। ‘ না,না, আমি নিজেই যাব। আইনের ভিন্ন ভিন্ন পয়েন্টগুলো অবশ্যই বিস্তারিত আলোচনা করতে হবে’, এই বলে আমি কোর্টের দিকে ছুটে গেলাম।
যেতে যেতে আমার স্বামীকে ফোন করে ইমাদের কথাগুলো বললাম, সঙ্গে আরো বললাম ওই মাস্টারকে যাতে লাগানো যায়, তা দেখতে। ও শান্তভাবে বলল, ‘ ওরা দুজনেই মিনিট পনেরো আগে এসেছে। আমরা এখন চা খাচ্ছি। আমি আর কিছু তো জানি না। যদি ওই মাস্টারকে মেয়েদের আরবি শেখাতে নিয়োগ দিই তবে তোমার দিক থেকে যেন কোনো ঝামেলা না হয়। বরং তুমি এসে সিদ্ধান্ত নাও।’
একইরকম সুপ্রিম কোর্টের পূর্বতন একটি কেসের বিষয়ে ভালোভাবে জানা থাকায় আমি আরগুমেন্টের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করে নিয়েছিলাম। আমি প্রাথমিকভাবে বিরক্ত হয়েছিলাম কেননা এই কেস – যা বারবার স্থগিত হয়ে যাচ্ছিল আবার এই কেসের শুনানির ব্যাপারে কোর্ট কোনো সময় দিচ্ছিল না – তা হঠাৎই তড়িঘড়ি উঠে এল। যে মুহূর্তে আমি জজ সাহেবের সামনে সবকিছু হাজির করতে শুরু করলাম, অন্য সব কিছু ভুলে গেলাম। কোর্টের কাজকাম সেরে যখন ঘরে ফিরলাম তখন ঘড়িতে সন্ধ্যে ছটা।
মাগরিবের নামাজ আদায়ের সময় হয়েছে, মাস্টার ছটফট করছে। আমার গায়ের কালো কোট দেখে সে খানিক হতবাক হল। সে বেশ ছোকড়া বয়সী।
তার বাড়ি উত্তরপ্রদেশে, সেখানকার এক মাদ্রাসায় মন দিয়ে সম্পূর্ণ কোরান শিখেছে আর এই অল্প বয়সেই হাফিজ-এ–কোরান উপাধি লাভ করেছে। আমার মেয়েদের জন্য এমন একজন মাস্টার চেয়েছিলাম যার বয়স একটু বেশি হবে আর হবে স্থানীয়। কোট ছেড়ে বসার ঘরে ঢুকতেই দেখি আসিয়া আর আমিনা ওদের আব্বার দু’দিকে দুজন বসে। আসিয়ার বয়স তেরো বা চোদ্দ হবে, আমিনার অবশ্যই বারো। মা হিসেবে মেয়েদের বয়স ঠিকঠাক না জানার অজ্ঞতায় বেশ বিব্রত বোধ করলাম। মাস্টার ছোকরাটি বেশ উশখুশ করছে যেন কাঁটার ওপর বসে আছে।
আমি কিছু বলার আগেই ইমাদ জানতে চাইল, ‘ তাহলে কবে নাগাদ আপনি পড়াতে আসছেন?’ যেন সে সবকিছু ঠিকই করে ফেলেছে। মাস্টার পরদিন থেকেই শুরু করতে চাইল। কিন্তু কখন আসবে তা ঠিক করা তার পক্ষে কঠিন হল কারণ যখন ছেলেমেয়েরা স্কুলে থাকে না অর্থাৎ সকাল ছটা থেকে আটটার মধ্যে আর বিকেলে পাঁচটার পর, তার সময়টা চারদিকে ভাগাভাগি করা আছে। আমি প্রস্তাব দিলাম, সবচেয়ে ভালো হয় সে যদি সন্ধ্যে পাঁচটা থেকে ছটার মধ্যে আসতে পারে। ইমাদ এই প্রস্তাব সমর্থন করল। মাস্টারকে মনে হল, পীড়াপীড়ির মধ্যে পড়ে গেল। ‘ সেই সময় তো আমি ফল বিক্রেতা গফফার সাহেবের ছেলেমেয়েদের পড়াতে যাই। আমাকে ক্ষমা করবেন, কারও সম্পর্কে খারাপ কথা বলতে চাই না, কিন্তু ওই বাড়ির ছেলেপুলেরা কোনো কিছু শিখতেই আগ্রহী নয়। সে কারণে ওখানে যাওয়া বন্ধ করে আমি এখানেই আপনাদের মেয়েদের পড়াতে আসব’, ইমাদ আর আমার স্বামীর উদ্দেশে সে এ কথা বলল, উত্তরপ্রদেশের খাঁটি উর্দুতে। সে এমনকি ভুল করেও একটিবার আমার দিকে তাকাল না। এর মতো মাস্টারদের মহিলাদের চোখে চোখ রেখে সরাসরি কথা না বলতে শেখানো হয়; এই হল পুরুষমান্য পর্দাপ্রথা। এইভাবে সে দেওয়ালের দিকে তাকাল, নয় মেঝের দিকে বা কখনও ওপরে সিলিংপানে কিংবা অন্য দুই পুরুষের দিকে যাদের সঙ্গে কথা বলছিল। শেষে ঠিক হল, সে রোজ বিকেল পাঁচটায় আমাদের মেয়ে দুটিকে আরবি শেখাতে আসবে আর প্রতি মাসে পাঁচশো টাকা করে পাবে।
মেয়েদের পড়া শুরু হয়ে গেল। রাঁধুনিকে বলে রাখলাম, মাস্টার এলে তাকে যেন এক কাপ চায়ের সঙ্গে কিছু স্ন্যাকস বা বিস্কিট দেওয়া হয়। সে এই কাজ করে বাড়ি যাবে। মাঝেসাঝে উইক ডে-তে আমি এই ভেবে উদ্বিগ্ন হতাম যে ওই মাস্টার মেয়েদের সঙ্গে ঠিকঠাক আচরণ করছে কি না। মা হিসেবে আমি খানিক বাড়াবাড়ি রকমের রক্ষাকারী হচ্ছিলাম অবশ্যই। অপ্রীতিকর যেন কিছু না ঘটে; আসিয়া ও আমিনার সদ্বুদ্ধির ওপর আমার আস্থা ছিল। তা সত্ত্বেও আমি আমার স্বামীকে সন্ধ্যেয় বাড়িতে থেকে ওদের ক্লাসের ওপর একটু নজর রাখতে বলেছিলাম। কিন্তু সে এমন করুণা আর তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাল যে এ ব্যাপারে তার সঙ্গে আর কথা বলার সাহস পাইনি।
যদিও আমি পাঁচশো টাকা দেব বলে ঠিক করেছিলাম, সেখানেই আটকে থাকিনি। আমি ভালোই জানতাম, আমার মেয়েদের ভবিষ্যতের জন্য ধর্মীয় শিক্ষা কতটা দরকারি। এভাবে আমি ওই মাস্টারকে আরও কিছু টাকা বেশি দিয়ে উৎসাহিত করতে লাগলাম যাতে মেয়েদের পড়ানোয় অতিরিক্ত মনোযোগ দেয়। হয়তো এটিই একজন কর্মরত মায়ের সমাধানসূত্র: ওই অনেকটা সন্তানদের সঙ্গে সময় কাটাতে না পারার অপরাধবোধ থেকে তাদের টাকাপয়সা ও উপহার দিয়ে পুষিয়ে দেওয়ার চেষ্টার মতো। কিন্তু অসম্ভব পরিস্থিতিতে এই অপরাধ বা দোষ এড়িয়ে যাওয়াটাও অসম্ভব, এবং উদ্ভূত অদ্ভুত সম্পর্ক ও সমস্যার ক্ষেত্রেও যা হয়। একমাত্র আল্লাহই আমাদের মতো কর্মরত মায়েদের রক্ষা করতে পারেন!
এই সকল দ্বিধা, উদ্বেগ সত্ত্বেও আমি অনুভব করলাম, ওই আরবি মাস্টারের পড়ানো ঠিকঠাকই চলছে। এরমধ্যে ছ’মাস কেটে গেছে। একদিন, ফাতিমা মহিলা সংগঠন নবীর জন্মদিন পালন করছিল। আমি যখন সেখানে যাই, দেখি আমিনা, আমাকে দেখে মৃদু হাসল। মেয়েরা কেন আমাকে না বলেই এখানে এসেছে, অবাক হয়ে তা ভাবতে ভাবতেই আমার দুই মেয়েই স্টেজে উঠে নবীর জীবনের সংগ্রামের কাহিনির ওপর একটি গান গাইতে শুরু করল। তাদের উচ্চারণ স্পষ্ট, দাঁড়ানোর ভঙ্গিমায় আত্মবিশ্বাসের ছোঁয়া। পরে জনাকয় মহিলা আমাকে অভিবাদন জানাতে এল আর স্বাভাবিকভাবেই, আমি খুশি হলাম। যখন আমার ননদ তার ঈর্ষা-জড়িত প্রশংসা করল, সত্যিসত্যিই মনে হল, আমার মেয়েরা অনেক উন্নতি করেছে।
সেই গান যখন ওরা ওদের আব্বার সামনে গাইল, তখন তাদের বেহেস্তের হুরিদের মতো লাগছিল।
‘ আম্মি, আমরা তোমাকে একটি সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিলাম, হজরত স্যারের সঙ্গে সেভাবেই আমরা প্ল্যান করেছিলাম।’
‘ আমরা শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত জানতাম না, তুমি সেই অনুষ্ঠানে যাচ্ছ কি যাচ্ছ না’, আমিনা বলল।
ওই মাসে আরবি মাস্টার হজরতের মাইনে আরও পাঁচশো টাকা বাড়িয়ে দিলাম। কিন্তু তখনও আমি কল্পনা করতে পারিনি যে এই মাস্টার খুব শিগগিরই আমাকে আরও বড়ো সারপ্রাইজ দেবে।
আরও তিন মাস অবশ্যই পেরিয়ে গেছে। সেদিনও আমার একটা কেসের শুনানি ছিল, কিন্তু শরীরটা ভালো ঠেকছিল না। আমার মক্কেলের পক্ষে একটি লিখিত আরগুমেন্ট তৈরি করে ফাইলটি গৌরিকে দিলাম যে এমন একটি সুযোগের অপেক্ষায় সবসময় এক পায়ে খাড়া থাকত। ‘ বারকয়েক এটা পড়ে কোর্টে কার্যকরভাবে প্রেজেন্ট করবে। শেষে কোর্টে তা জমা দেবে’, তাকে এমনই নির্দেশ দিয়ে আমি বেরিয়ে এলাম।
‘ মেয়েরা কি স্কুল থেকে ফিরেছে?’ রাঁধুনি দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গে আমি জানতে চাইলাম। তৎক্ষণাৎ শোবার ঘরে গিয়ে গভীর ঘুমে ডুবে গেলাম। যখন ঘুম ভেঙে বিছনা থেকে উঠব উঠব করছি তখনই রান্নাঘরের দিক থেকে বেশ কয়েকটি গলা কানে এল, সবাই একসঙ্গে কথা বলছে। মুহূর্তের মধ্যে আরবি মাস্টারকে ঘিরে আমার যা কিছু সংশয় তা বিশালাকার নিল, আমি দ্রুত সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামলাম, রান্নাঘরে পৌঁছুতে, একবারে দুটো ধাপ মাড়িয়ে আর সেখানে ঢুকে দেখলাম, একটা প্যানে তেল ফুটছে। পাশে একটা পাত্রে ছোট ছোট করে ফুলকপি কাটা। আসিয়া আর আমিনার হাত তেল, মাখা আটা-ময়দা ও অন্যান্য বস্তুতে ভরা। আরবি মাস্টার এক কোণে চেয়ারে বসে। আমাকে দেখে তাদের চেহারা পালটে গেল। মাস্টারের মুখের ভাব এমন পাণ্ডুর হয়ে গেল যেন অজ্ঞান হয়ে পড়বে। সেখানে কী হচ্ছে বুঝতে পারছিলাম না, আর আমাকে বেশ রাগি দেখে, মাস্টার উঠে পড়ে রাস্তা পানে দৌড় দিল।
রান্নাঘরে তখন অন্য এক গল্পের জন্ম হচ্ছিল। ভরপুর কান্নার মাঝে আসিয়া, আমিনা উভয়েই বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিল। সব মিলিয়ে আমি যা বুঝলাম, আরবি মাস্টার ফুলকপির মাঞ্চুরি খাওয়ার ব্যাপারে একদম পাগলা হয়ে গেছে। এই জলখাবার বিষয়ে তার আবেগকে ধন্যবাদ, রোজ এক প্লেট করে কিনে খেয়ে রসনাকে তৃপ্ত করতে সে প্রচুর অর্থ ব্যয় করে, যদিও প্রাণ পুরে খাওয়ার আশ তার মেটে না। সে স্থির করেছে আমাদের রান্নাঘর থেকেই এই পদের অফুরন্ত জোগান মিলতে পারে, আর এই কারণেই সে মেয়েদের নিয়ে এমন একটা প্ল্যান করেছে। রাঁধুনিকে জিজ্ঞেস করে ওরা এর রেসিপি জেনেছে। কিন্তু এই চটজলদি খাবার কীভাবে বানাতে হয়, সে জানে না, অথচ মেয়েদের কথা ঠেলতে না পেরে সে ওদেরকে একটা মনগড়া রেসিপি বলে দেয়। ঠিক যখন তিনজন মিলে সেই রেসিপি অনুযায়ী তাদের পরিকল্পনা রূপ দিচ্ছিল, আমি ঝড়ের বেগে তাদের ওপর আছড়ে পড়ি।
সবকিছু শুনে আমি স্বস্তির নিশ্বাস ফেলি, যাক বাবা, অপ্রীতিকর কিছু ঘটেনি। আমি না হয়ে যদি আত্মীয়রা কেউ দেখে ফেলত তাহলে বিশাল ঝঞ্ঝাট পেকে যেত। এই ঘটনার পাখা গজিয়ে অদ্ভুত সব ঢঙে ছড়িয়ে পড়ত যা নির্ভর করত গপ্পোবাজদের উর্বর কল্পনাশক্তির ওপর। আল্লাহকে শুকরিয়া, আমরা বেঁচে গিয়েছি আর সেই সূত্রে আমি ফের একটা স্বস্তি-শ্বাস ফেললাম। আমার অনুমানই ঠিক হল: ওই আরবি মাস্টার আর এ বাড়ির পথ মাড়াল না।
যদিও তার বিষয়ে খবর পাচ্ছিলাম। আমার কিছু মক্কেলের বাড়িতে সে পাত্রীর সন্ধানে গিয়েছিল, কিন্তু অদ্ভুত কিছু কারণে কোনও প্রস্তাবই বাস্তবায়িত হয়নি। আমার এক পুরনো মক্কেল, আবদুল সোবহান প্রায়ই অফিস বন্ধ করার আগে তার কেসের বিষয়ে আলোচনা করতে আসতেন, আর সেখানে ব্যক্তিগত বিষয়েও কথা-টথা বলতেন। এক সন্ধ্যেয় দরজার মুখে দাঁড়িয়ে তিনি বললেন, ‘ ম্যাডাম, আমার ছোটো মেয়ের জন্য না এক সাদির প্রস্তাব এসেছে। ছেলেটি আমাদের আজিম মসজিদের মৌলবি। কিন্তু সে আমাদের রাজ্যের নয়, উত্তরের কোথাও তার বাড়ি। আমি এখানে কোনো চোরের গলায় মেয়েকে ঝুলিয়ে দেব কিন্তু বহিরাগত কাউকে বিশ্বাস করা যায় না।‘
‘ তা ঠিক। তারপর কী হল?’
‘ সে আপনার নাম বলল, যে কারণে আমি প্রাথমিকভাবে ভাবলাম, একটি বাড়ি ভাড়া নিই, আমি নিজেই ভাড়ার আগাম দিয়ে দেব, তাদের যা যা সামগ্রী লাগে কিনে দিই এবং তারা আমার কাছাকাছি বাস করুক। কিন্তু তারপর মনে হল, এক দুটো সন্তানের জন্ম দিয়ে জামাইবাবা যদি বেপাত্তা হয় তাহলে তাকে খুঁজব কোথায়? তারপর আমার মেয়ে আর তার সন্তানদের দেখভাল করবে কে? সে সব ভেবে ঠিক করলাম, এ সব ঝক্কির দরকার নেই আর সেখানেই বিষয়টা শেষ করলাম, ম্যাডাম’, তিনি বললেন।
আমার মনে হল, তিনি ঠিক কাজই করেছেন। এরপর আরও দু তিন মাস কাটল। সালিমা জান নামে এক রাঁধুনি যে আমাদের বাড়িতে কাজ করত আর ভগ্ন স্বাস্থ্যের কারণে কাজ ছেড়ে দিয়েছিল, এক রোববারের সন্ধ্যেয় আমার খোঁজে এসে হাজির। সে জানত কখন আমার কাজের চাপ থাকে আর কখন আমি ফাঁকা থাকি। সুযোগমতো সে এটা-ওটা নিয়ে গল্প জুড়ে দিল।
‘ আপা, আমার বোনের মেয়ের জন্য একটি বিয়ের প্রস্তাব এসেছে। আমি তো আপনাকে না জিজ্ঞেস করে কিছু করি না, তাই এলাম। মেয়েটি বিএ পাশ দিয়ে একটা ‘করমেন্ট’ স্কুলে মাস্টারি করে।’ এলাকার অন্যদের মতো সালিমাও কনভেন্ট ও গভর্নমেন্ট স্কুল উচ্চারণ করতে গিয়ে শব্দ গুলিয়ে ফেলে। যাই হোক, সে বলে চলল। ‘ মেয়েটি বাপ-মায়ের একমাত্র সন্তান আবার ছেলেটিরও বড়ো মুখ করে বলার মতো পরিবার নয়। বোনেরা ভেবেছে, সাদির পর জামাইকে তাদের সঙ্গেই থাকতে দেবে।’ কিছু কারণে, যে মুহূর্তে আমি এই প্রাথমিক পরিচিতির কথা শুনলাম, বুঝলাম আমাদের হিরোই এখানে মূল ভূমিকায়। যাই হোক, কৌতূহলে লাগাম দিয়ে আমি স্বাভাবিকভাবেই জানতে চাইলাম, ‘ছেলেটা কে?’
‘ ওই মৌলবি হজরত। ওই মাস্টার যে আপনার মেয়েদের পড়াতে আসত, ও-ই।’ আমি সন্দেহ করতে শুরু করলাম, কোথাও একটা ভুল বোঝাবুঝি হচ্ছে, কীভাবে আমার নামটা এসবের মধ্যে টেনে আনা হচ্ছে।
‘ হুম, তা বিয়ের প্রস্তাব কি কাজে দিল? সাদি কবে?’, জিজ্ঞেস করলাম।
‘ কীভাবে হবে? যখন মেয়েটা করমেন্ট ইস্কুলে কাজে যায়, বোরখা পরে থাকে। মাস্টার বেচারা তাকে অন্তত একটিবারের জন্যও দেখা করার কথা বলতে পারে না। সাদিতে আমরা কী দেব বা নেব, তাও সে জিজ্ঞেস করতে পারে না। মেয়েটি কখন বাড়ি থেকে বেরুবে তার জন্য সে অপেক্ষা করে, মাঝ রাস্তায় তাকে থামিয়ে জিজ্ঞেস করে, সে ফুলকপির মাঞ্চুরি বানাতে পারে কি না, জিনিসটা যাই হোক না কেন! মাস্টার কী ধরনের লোক?!’ নিজেকেই এই প্রশ্ন করে কিছুক্ষণের জন্য থেমে যায় সে।
তারপর সে চোখ – কান দিয়ে গোটা ঘরটা জরিপ করে বুঝে নিতে চায়, ঘরের মালিক বা মেয়েদের কোনও চিহ্ন আছে কি না। আশপাশে কেউ নেই বুঝে নিয়ে সে স্বস্তি বোধ করে। এমনকি আমার খুব কাছাকাছি এলেও বোরখা বেশি করে নামিয়ে দেয় নিশ্চিত হতে যে কেউ তার ঠোঁটের নড়াচড়াও দেখতে পাবে না ও তারপর বলে, ‘ আপা দেখো, এই মাস্টারের চলাফেরা ঠিক পুরুষ মানুষের মতো নয়। সাদির ব্যাপারে কথা বলার জন্য তার সঙ্গে বড়োরা কেউ থাকে না। তাহলেও ছেলেটা পড়ালেখা জানে এবং দিনরাত মসজিদেই কাটায়। মুখে সবসময় আল্লাহর নাম। আবার নানা জনকে পরামর্শ দেয় আবার তাদের সমস্যাও মেটায়। সাদির পর যদি সে আমাদের মেয়েটিকে ছেড়ে দেশের বাড়ি পালিয়েও যায়, মেয়েটি নিজের দেখভাল করতে পারবে। আমরা ভাবলাম, দরকার পড়লে সে নিজেরটা কোনোমতে চালিয়ে নিতে পারবে, কিন্তু সত্যি কথাটা হল, আদৌ ছেলেটার সাদি বা মেয়েটির ব্যাপারে চিন্তাভাবনা নেই। সে চায় আমরা তার জন্য সাদির খাওয়াদাওয়ার ফুলকপির তরকারি বা ওইরকম কিছু পদ রাখি। সেই কারণেই আপনার কাছে তার সম্পর্কে জানতে এলাম। আপনি তো এমন খ্যাপাটে লোক অনেক দেখেছেন ,তাই আমাকে বলেন, আমরা এখন কী করব?’
আমি বুঝতে পারলাম, মাস্টার যে বলেছে সাদির আয়োজনে তার প্রিয় ফুলকপির স্ন্যাক রাখতে হবে, সেটাই সালিমার মাথাব্যথার কারণ হয়েছে, ছোকরার এই কিম্ভূত আচরণে সে বেশ উৎকণ্ঠিত। আমিও খানিক সহানুভূতিশীল হলাম। ফুলকপির মাঞ্চুরি নিয়ে মাস্টারের যে নাছোড় বাতিক তা কে ছাড়াবে সে ব্যাপারে অবাক হয়ে আমি বললাম, ‘ আমি তার বিষয়ে বেশি কিছু জানি না; তাকে দেখে ভালোমানুষই মনে হয়। কিছুদিনের জন্য সে আমার মেয়েদের আরবি পড়াতে এসেছিল। চাইলে তোমরা ওদের সাদি দিতে পারো; আরও কয়েকজনের কাছ থেকে খোঁজখবর নিয়ে একটা সিদ্ধান্ত নাও।’ এটা এক ধরনের অস্পষ্ট “এটাও বললাম, ওটাও বললাম” জাতীয় উত্তর, আর সেও আমাকে সহজে ছেড়ে দেবার পাত্রী নয়।
এবার সে আমার ওপর ঝুঁকে পড়ে ফিসফিসিয়ে বলল, ‘ আমরা কীভাবে বুঝব সে পুরো পুরুষ কিনা?’ আমার হয়রানি বাড়তে লাগল। আমি যে রেগে যাচ্ছি, সে মনে হয় বুঝতে পেরেছে। ‘ না ঠিক তা নয়, আপা, আমাকে ভুল বুঝবেন না। আপনার কাছে জানতে চাইছি এই কারণেই যে আপনি তো একজন উকিল, ওইটুকু আর কি। সে খ্যাপাটে কি না বুঝব কী করে? ওপর ওপর দেখলে তো ঠিকই আছে, সে আরবি, উর্দু শিখেছে। কিন্তু আমাদের মেয়েটিকে রাস্তার মাঝে থামিয়ে সে যদি জিজ্ঞেস করে, ফুলকপির তরকারি রাঁধতে জানে কি না তাহলে আমরা কী করব? মসজিদের একজন মাস্টার হয়ে…’, ছেলেটা যা করেছে তার জন্য নিন্দা ও প্রশংসা দুইই মিশিয়ে সে বলল।
আমি ভাবতে শুরু করলাম, এটা বাস্তবিকই ওই মাস্টারের একটা পাগলামি। হয়তো যদি সে বিরিয়ানি, কোর্মা সুখা, পোলাও কিংবা এজাতীয় কোনো পদ খেতে চাইত তাহলে মেয়েটির পরিবার আনন্দের সঙ্গেই সে আবদার মেনে নিত। কিন্তু এই নিরামিষ খাবার, একে যাই বলা হোক না কেন, এই বিদঘুটে খাবার, ফুলকপির মাঞ্চুরি… আমি অবাক হয়ে ভাবলাম ইমাদকে ডেকে বলি, ওই আরবি মাস্টারের মাথায় কিছু বুদ্ধিশুদ্ধি ঢুকিয়ে দিতে। কিন্তু পরক্ষণেই মনে হল, আমার পক্ষে ছেলেটার সম্পর্কে এমন আগ্রহ দেখানো ঠিক হবে না। এরপর সেই মাস্টারের বিষয়ে ভাবনাচিন্তা সব চড়ুইপাখির মতো উড়ে গেল, আমার অশেষ দায়িত্বের সামনে পড়ে আর আমি ফের আমার পেশার জগতে ডুবে গেলাম।
আরও ছয় মাস কেটে গেছে। একদিন যখন কোর্টের উদ্দেশে বেরুনোর জন্য তৈরি হচ্ছি, ইমাদ নিজে থেকেই আমাকে খবরটা দিতে এল। সঙ্গে নিয়ে এল দু বাক্স খেজুর, অ্যালমন্ড ও মিছরি। আসিয়া আর আমিনাকে ডেকে বলল, ‘ তোদের মাস্টারের নিকাহ হয়ে গেছে। আমি সোজা মসজিদ থেকে আসছি। সাদির নানান ঝুট-ঝামেলার মাঝেও মাস্টার তোদের দুজনকেই মনে রেখেছে আর এই সব শুকনো ফল-টল পাঠিয়ে দিয়েছে’, এই বলে দুজনকেই একটি করে বাক্স দিল। তা হাতে পেয়ে দুজনেই উবে গেল। আমার সেদিনের সেই রান্নাঘরের দৃশ্যটা মনে পড়ে গেল আর মনে মনেই হাসলাম। শেষ পর্যন্ত আরবি মাস্টারের সাদি হয়ে গেছে জেনে মনটা খানিক হালকা বোধ হল। সে এবার শান্তিতে বাস করবে এই আশা করে, মুখ জুড়ে ছোট্ট হাসিটি ভাসিয়ে কাজে বেরিয়ে পড়লাম।
যাই হোক, ঠিক যখন ভাবছিলাম যে উৎপাত এই বাড়ি ছাড়া হয়েছে তখনই সে পিছন দরজা দিয়ে ফের ঢুকে পড়েছে এবং তার সঙ্গে সঙ্গে সেই আরবি মাস্টারও আমার জীবনে ফিরে এল। পৃথিবীটা যে সত্যিসত্যিই ছোটো আর গোলাকার তা প্রমাণ করতে আমি পুনরায় তার খবরাখবর পেতে শুরু করলাম। তার একটা হিল্লে হয়েছে জেনে যখন খুশি ছিলাম, তখন আমার কৌতূহলও হচ্ছিল এই ভেবে, কারা তাদের মেয়েকে তার হাতে তুলে দিয়েছে। মনে মনে ভাবলাম যদি আমার জানাশোনা কেউ হত তাহলে নিশ্চয়ই সাদির নিমন্ত্রণ পেতাম বা নিদেনপক্ষে খবরটা তো পেতাম।
এ বিষয়ে যেটুকু স্বস্তি পেয়েছিলাম তা বেশিদিন টিকল না। আমার বরাতে যে শান্তি ক্ষণস্থায়ী তা নিশ্চিত করতে একদিন আমার অফিসে এক যুবক ও বোরখা পরা একটি মেয়ের উদয় হল। আমি তাদের চিনতাম না। মেয়েটি বোরখা মুখ থেকে খানিকটা সরাল। তার নাকের ওপর একটা আঁচড়ের দাগ মনে হল, আর দুই হাতেও তেমনই দাগ, কাচের চুড়ি ভেঙে গিয়ে চামড়ায় ক্ষত তৈরি করেছে।
ক্ষতস্থানগুলো দেখানোর সময় মেয়েটির চোখের জল উথলে উঠছিল।
উত্তেজিত অবস্থায় যুবক বলল, ‘ ম্যাডাম, এ আমার ছোট বোন। মাস ছয়েক হল ওর সাদি হয়েছে। ছেলেটা এক মৌলবি। সেই মৌলবির মর্যাদা রক্ষা করতে গিয়ে, যাই হোক, এ অনেক কিছু সহ্য করেছে, তবুও তার অত্যাচার থামেনি। সাদির দিন থেকেই আমার বোনটিকে সে মারধর করে আসছে। আমরাও অতিষ্ঠ হয়ে গেছি। এরমধ্যেই মসজিদে তিনবার পঞ্চায়েত বসিয়েছি। সেখানকার মোতাওয়াল্লি ও অন্যান্য কমিটি সদস্য তাকে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করেছে। কিন্তু সে কারোর কথা শোনার পাত্র নয়। শেষ পর্যন্ত তাকে মসজিদের কাজ থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে। তারপরেও আমার বোনের ওপর তার অত্যাচার বিন্দুমাত্র কমেনি। দয়া করে, আমাদের হয়ে পুলিশে একটা অভিযোগপত্র লিখে দিন।’
ফুলকপির মাঞ্চুরি নিয়ে ওই আরবি মাস্টারের নাছোড় বাতিকের কারণেই যে এই করুণ কাহিনির জন্ম তা ভেবে আমার কষ্ট হল খুব। ওই যুবকের কাছ থেকে এ ব্যাপারে পুঙ্খানুপুঙ্খ জানতে চাইলাম না, কিন্তু সে, এতটাই ক্রুদ্ধ যে আপনা থেকেই আমাকে আরও বলে যেতে থাকল। ‘ জানেন ম্যাডাম, ওই ছেলেটা বোনকে কিছু একটা রাঁধতে বলে। কী চাইছে, বোন বুঝতে পারে না আর ছেলেটাও বোনের রান্নার কোনও স্বাদ পায় না। সে পাগলের মতো বোনকে পিটতে থাকে। আমাদের তা আর সহ্য হচ্ছে না। প্লিজ, ওকে জেলে পাঠানোর ব্যবস্থা করুন, ম্যাডাম’, সে বলল। নিঃসন্দেহে এই অপরাধে জেল হওয়াটাই সমীচীন। কিন্তু নিঃসন্দেহে এটাও ঠিক, যে মুহূর্তে ওর বিরুদ্ধে ক্রিমিনাল কেস ফাইল করা হবে, সে উধাও হয়ে যাবে। তারপর মেয়েটির কী হবে? আমি ঠিক করলাম, যেভাবেই হোক চেষ্টা করে ওই মাস্টারকে এই ঝামেলা থেকে উদ্ধার করতে হবে। তারচেয়েও বড়ো কথা, আমি ভাবলাম, এই মেয়েটির জীবনও আমাকে বাঁচাতে হবে এবং তার বিবাহিত জীবনকেও। তাই আমি এক ফোনে ফুলকপি মাঞ্চুরির রেসিপি খুঁজতে লাগলাম, আর অন্য ফোনে ভাই ইমাদকে আসতে বললাম।
দীপা ভাসতির ইংরেজি অনুবাদ থেকে বাংলা অনুবাদ

বিপ্লব বিশ্বাস
বিপ্লব বিশ্বাসের জন্ম: ১৭.০১.৫৪ পশ্চিমবঙ্গে। তিনি মৌলিক ও ভাষান্তরিত গল্প-আঙিনায় দীর্ঘ অভিজ্ঞতাপুষ্ট। ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র ও অবসৃত প্রধানশিক্ষক। তিনি ভারতের কেন্দ্রীয় সাহিত্য অকাদেমির নথিভুক্ত অনুবাদক। তাঁর প্রথম লিখিত গল্প 'সমতট' আয়োজিত সারা বাংলা গল্প প্রতিযোগিতায় দ্বিতীয় স্থান লাভ করেছিল। এ রাজ্য, ভিনরাজ্য তথা ভিনদেশের ছোট, বড়ো সাময়িক ও দৈনিক পত্র-পত্রিকাতে তাঁর গল্প, প্রবন্ধ সসম্মানে প্রকাশিত। নানাবিধ টানাপোড়েনে তাঁর কলমচারিতা নিয়মিত হতে পারেনি। ২০২৪ সালে তিনি ভাষা সংসদ ও অনুবাদ পত্রিকা কর্তৃক জীবনকৃতি সারস্বত সম্মানে ভূষিত হয়েছেন। প্রকাশিত বইপত্র : এবং গণ্ডারের শোক (গল্পগ্রন্থ), ক্ষোভ বিক্ষোভের গল্প (গল্পগ্রন্থ), ইচ্ছেখাম (গল্পগ্রন্থ), বাছাই ছাব্বিশ (গল্পগ্রন্থ), দক্ষিণ ভারতীয় ছোটগল্প (অনুবাদ), পড়শি ভাষার গল্প (অনুবাদ), বিদেশি গল্প সংকলন (অনুবাদ), ভারতীয় ইংরেজি গল্প (অনুবাদ), সামরিক সারমেয় কথা (অনূদিত উপন্যাস), সাহিত্যে নোবেল বক্তৃতা (অনুবাদ), আহারের আড়কথায় শ্রীরামকৃষ্ণ (প্রবন্ধগ্রন্থ) ও জীবনানন্দের গল্পজগৎ ( প্রবন্ধগ্রন্থ)।