আন্দ্রেই প্লাতোনভ : রুশ সাহিত্যের এক নীলকুমার // রুখসানা কাজল

বছর কয়েক আগে একটি নামকরা অন্তর্জাল পত্রিকা রুশ সাহিত্যিকদের বিভিন্ন গল্পবাংলা ভাষায় অনুবাদের কাজ হাতে নেয়। সেই সূত্রে আমাকে অনুবাদ করতে দেওয়া হয় রুশ লেখক আন্দ্রেই প্লাতোনভের একটি দীর্ঘ গল্প। গল্পকার একেবারেই অচেনা। গল্পের নাম, ‘দি কাউ’। গল্পের নাম দেখে কিছুটা ভাবনায় পড়ে যাই। বাংলা অনুবাদে এ গল্পের শিরোনাম গরু নাকি গরুটি লিখব! বারকয়েক পড়লাম গল্পটি। একটি নির্দিষ্ট গরুকে রূপক করে ভাগ্যের ভয়াল পরিণতি নিয়ে লেখা ‘দি কাউ’। শিরোনাম দিই গরুটি। এরপর অগ্রসর হই গল্পের লেখক আন্দ্রেই প্লাতোনভ সম্পর্কে জানতে এবং বুঝতে।

অনুবাদ সাহিত্য পড়ার সূত্রে রুশ লেখকদের নামের সাথে সামান্য পরিচিতি আছে। কিন্তু সে সব লেখকের সাথে আন্দ্রেই প্লাতোনভের নাম আগে কখনো শুনেছি বলে মনে পড়ছে না। মাত্র কয়েক বছর ধরে সহসা তার নাম এবং রচিত সাহিত্য সম্পর্কে জানতে পারছি। সত্যি বলতে, কখনো তার লেখা বইয়ের নাম, সে বইয়ের প্রচ্ছদ এমন কি তার সম্পর্কে উল্লেখযোগ্য তেমন কিছুই জানতাম না। আজ তার গল্প অনুবাদ করতে এসে উন্মোচিত হলো এমন এক সাহিত্যিকের জীবনচিত্র তাতে খুঁজে পেলাম রুশ সাহিত্যের এক নীলকুমারকে।

শিল্প ও সাহিত্যের অন্যতম গুরুতপূর্ণ একটি অঙ্গ হচ্ছে অনুবাদ। সাধারণত যার লেখা অনুবাদ করা হবে তার সম্পর্কে জানা থাকলে অনুবাদকের জন্যে ভাল হয়। মূল লেখককে জানার সাথে সাথে তাঁর পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্রীয় কাঠামো ও নীতি এবং যাপিত সময়, কর্ম, ঘটনা আদর্শকেও জানা যায়। ফলে উপলব্ধ এই অনুভবের আলোকে অনূবাদিত বিষয়টি কিছুটা হলেও অনুবাদকের কাছে প্রাঞ্জল হয়ে ওঠে।

তেমনই এক অনুভব নিয়ে লেখক আন্দ্রেই প্লাতোনভ সম্পর্কে জানতে উইকিপিডিয়াসহ গার্ডিয়ান পত্রিকায় মূল রুশ থেকে যিনি প্লাতোনভকে ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন সেই রবার্ট চ্যান্ডালারের সাক্ষাৎকারটি পড়ে নিলাম। একই সাথে প্লাতোনভের অন্যান্য বইয়ের মুখবন্ধ পড়তে শুরু করি। এক আগ্রাসী আগ্রহ পেয়ে বসে। মনন রাজ্যে আবার শুরু হয়ে যায় পুরনো সেই ভাঙ্গনের প্রতিধ্বনি। আদর্শিক সংঘাত। সংশয় আর অবিশ্বাস। কথিত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় আধা সামন্তবাদী মন নিয়ে কমিউনিজমের স্বপ্ন দেখেছিলাম উদ্দাম তারুণ্যে। দ্রুতই তা ভেসে গিয়েছিল গ্লাসনস্ত আর পেরেস্ত্রয়কার মহাপ্লাবনে। দীর্ঘ সাঁতারের পর সবে তীর খুঁজে পেয়েছি। আর তখনই হাতে এলো আন্দ্রেই প্লাতোনভ। মানসিক ভাঙ্গনে চূর্ণ-বিচূর্ণ এক রক্তাক্ত হৃদয়ের লেখক তিনি। আরোপিত বস্তুবাদের সাথে তিনি কিছুতেই মেলাতে পারেননি মানবিক সম্পর্কের চিরকালীন প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তিকে। তাই একজন কম্যুনিস্ট হয়েও বারবার তিনি সংশয়বাদী পরিচিতি পেয়েছেন। সম্মুুখসভায় হজম করেছেন সোভিয়েত লৌহ সরকার স্ট্যালিনের প্রকাশ্য ব্যঙ্গ, ঠাট্টা এবং অবহেলা। স্ট্যালিনের নানা কাজে সমালোচনামূলক সংশয় প্রকাশ করেছিলেন বলে কঠিন শাস্তির কোপে পড়েছিল তার সন্তান। শ্রমশিবিরে সশ্রম অন্তরীণ থেকে ক্ষয়রোগে আক্রান্ত হয়ে অবশেষে মুক্তি পেলেও মারা গিয়েছিলেন তার একমাত্র পুত্র প্লাতোভ। পুত্রের ব্যাধি বুকে নিয়ে অসুস্থ, ত্যাজ্য নির্বাসিত এক অতি সাধারণের মত ধুঁকে ধুঁকে মারা গিয়েছিলেন লেখক আন্দ্রেই প্লাতোনভ। তাঁর মৃত্যুর সময়টুকুও অজানা। আরোপিত অবহেলায় নির্বাসিতের মানদণ্ডে হারিয়ে যেতে বসেছিলেন রাশিয়ার অন্যতম কথাশিল্পী, যুগশ্রেষ্ঠ গদ্যকার।

অথচ বর্তমান রাশিয়ার শ্রেষ্ঠ ঔপন্যাসিক এবং গল্পকার হিসেবে ̄স্বীকৄতির আলোকে আন্দ্রেই প্লাতোনভ এখন উজ্জ্বলতম। প্রতি বছর প্লাতোনভের জন্ম শহরে তাঁর সম্মানে আয়োজিত হয় সাহিত্যসভা। সেই সভায় দর্শক শ্রোতাদের পাঠ করে শোনানো হয় তাঁর লেখা বিভিন্ন গল্প উপন্যাসের অংশ বিশেষ। নানাভাবে আলোচিত হন তিনি। দর্শক শ্রোতারা জানতে পারে, এই সেই সাহিত্যিক, স্ট্যালিন যাকে অভিধা দিয়েছিলেন, স্ক্যাম (Scum) বলে।

প্রথম দিকে প্লাতোনভের সাহিত্য সৃষ্টি নিয়ে বিভিন্ন রুশ সাহিত্যিক – যেমন শলোকভ, পাস্তারনাক, ম্যাক্সিম গোর্কি, বুলগাকভরা-স্নেহসিক্ত মনে ভেবেছিলেন – সাহিত্যজগতের সদ্য পাখনা গজানো একজন মৌমাছি-বালক। কিন্তু সবাইকে অবাক করে এই বালক মৌমাছির রচিত সৃষ্টিকর্ম অচিরেই অপার শক্তিশালী গুঞ্জনে পরিণত হয়ে শতধা রূপ নিয়েছিল। এমনটি যে হবে, ভাবতেই পারেননি তারা। এটা ছিল তাঁদের ভাবনার বাইরের সুখকর পরিণতি।

তবে লেখক হিসেবে সেই সময়ের সোভিয়েত রাশিয়ার শাসক, লৌহমানব বলে খ্যাত জোসেফ স্ট্যালিনের মোটেও পছন্দের ব্যক্তি ছিলেন না আন্দ্রেই প্লাতোনভ। তাঁর সম্পর্কে স্ট্যালিন খোলাখুলি দ্বিচারি মনোভাব পোষণ করতেন। কোন এক সাহিত্যসভায় প্লাতোনভের সাহিত্যকর্মকে কমিউনিস্ট বিরোধী হিসেবে বিদ্ধ করে তিনি বলেছিলেন, প্লাতোনভ বোকা, নির্বোধ এবং বজ্জাত। ওই একই সভায় একই সাথে তিনি আবার প্রশংসার চাটুও ধরেছিলেন এভাবে, প্লাতোনভ হচ্ছেন ‘একজন ভাববাদী এবং ভবিষ̈ৎদ্রষ্টা’।

আগেই উল্লেখ করেছি, আন্দ্রেই প্লাতোনভকে মূলত ‘স্ক্যাম’ হিসেবে মনে করতেন স্ট্যালিন। স্ক্যাম শব্দের যে বাংলা অর্থ পেয়েছি তা হলো, বিষ্ঠা, গাদ বাকলঙ্ক।

অর্থাৎ কিনা কমিউনিজম সম্পর্কে নিরঙ্কুশ চিন্তা-চেতনাধারী না হয়ে লেখক প্লাতোনভ ছিলেন সংশয়ের ডুবোজলে ভাসমান নোংরা পলল, গাদ বা বিষ্ঠা। কলঙ্কও বটে! আরও গভীরভাবে ̄স্ক্যাম শব্দটির বিশ্লেষণ করলে পরিষ্কার বোঝা যায়, স্ট্যালিনের দৃষ্টিতে প্লাতোনভ ছিলেন বর্জ্যবিশেষ। কেন না তার লেখা যথেষ্ট পরিমাণে সোভিয়েতপন্থী নয়, বরং সে সময় গৃহীত রুশ সরকারের সমষ্টিকরণ নীতিসহ নানা নীতির প্রতি তাঁর লেখায় প্রশ্নহীন আনুগত্য, বিশ্বাস বা আস্থার বিপরীতে সমালোচনার সুর পরিলক্ষিত হচ্ছিল। মোট কথা, স্ট্যালিনবাদে তিনি ছিলেন যথেষ্ট সংশয়ভাবাপন্ন। প্রশ্নমুখর। আর কে না জানে, স্ট্যালিন বিরোধী মতবাদীদের সাথে কেমন ব্যবহার করতেন! তাছাড়া নানা ঘটনায় জানা যায়, ব্যক্তিগত পর্যায়ে প্লাতোনভও স্ট্যালিনকে সযত্নে এড়িয়ে চলতেন।

প্লাতোনভের বিপক্ষে মানসিক দৃঢ়তার অভাব ছিল বলে ̄স্বয়ং স্ট্যালিন এবং স্ট্যালিনপন্থীরা বিশ্বাস করতেন। এর কারণও ছিল। একবার তিনি নিজেই কম্যুনিস্ট পার্টিতে যুক্ত হয়ে কিছুদিন পার্টির ক্লাস করতে শুরু করেছিলেন। কিন্তু অল্প দিনের ভেতর তিনি ক্লাস করা বন্ধ করে দেন এবং পার্টি ত্যাগ করে চলে যান। নিয়ম অনুযায়ী সে সময় তাৎক্ষণিক প্লাতোনভ পার্টিকে কোন প্রকার ব্যাখ্যা প্রদান করেননি। যদিও পরবর্তীকালে তিনি এর ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন।

ফলে তাকে এবং তার কিছু কিছু সাহিত্য সৃষ্টিকে দেগে দেওয়া হয়েছিল, ‘ভবিষ্যতে ব্যবহারের জন্য’ ‘আমাদের শত্রুদের এজেন্ট এর একটি গল্প’ হিসেবে।

আন্দ্রেই প্লাতোনভ ক্লিমেনতভের জন্ম হয়েছিল ১৮৯৯ সালের ২৪ আগস্ট, মধ্যরাশিয়ার চেরনোজেম অঞ্চলের ভেরোনোজ শহরের কাছাকাছি একটি গ্রামে। দারিদ্র্যের অভিশাপে জর্জরিত নয় ভাইবোনের এক বিশাল সংসারের বড় ছেলে ছিলেন তিনি। বাবা ছিলেন একজন সাধারণ মেটাল ফিটার। নানা রকম জিনিস উদ্ভাবন করতে পারদর্শী হলেও আদতে তিনি ছিলেন একজন অপেশাদার যন্ত্রকৌশলী বা মিস্ত্রি। বিভিন্ন ওয়ার্কশপে কাজ করতেন। প্লাতোনভের মা ছিলেন একজন নিরাপত্তা রক্ষীর মেয়ে। ̄স্থানীয় প্যারিস স্কুলে কিছুদিন পড়াশুনা করলেও তের বছর বয়সে কিশোর প্লাতোনভকে জীবিকার জন্যে নেমে পড়তে হয় কাজে। অফিসের কেরানি থেকে পাইপ কারখানারকর্মী, মেশিনম্যান, ̧গুদাম অফিসসহ রেলওয়ের বিভিন্ন পেশায় কাজ করেছেন। ১৯১৭ সালে বিপ্লবের পর তিনি ভোরোনজ পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে বৈদ্যুতিক প্রযুক্তি অধ্যয়ন করেন। সেই সাথে কবিতা লেখাও চলছিল তাঁর। এর মধ্যে শুরু হয়ে যায় গৃহযুদ্ধ। সে সময় সৈন্যবাহিনীর ট্রেন চলাচলের সুবিধার জন্যে রেলপথ এবং তুষার সাফ করার কাজে সাহায্য করতে প্লাতোনভ চলে গিয়েছিলেন বাবার কাছে।

১৯২০ সালে তিনি কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দিয়েছেন। কিন্তু অতি অল্প সময়ের মধ্যে অর্থাৎ ১৯২১ সালেই তিনি পার্টি ছেড়ে দেন। এ কারণে প্লাতোনভকে সারা জীবন তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের পাত্র হতে হয়েছে। কিন্তু, একজন প্রতিশ্রুতিশীল প্রতিভাবান তরুণ কবি এবং কর্মী কেন এত অল্প সময়ে পাটি ছেড়ে চলে গেলেন?

কেউ কেউ তার মনের কিশোরসুলভ অগভীর অপরিপক্কতার কথা বলেছেন। আবার এও জানা যায় যে, তিনি সে সময় গৃহীত রাশিয়ার নিউ ইকোনমি পলিসি নিয়ে হতাশ হয়ে পড়েছিলেন। তাছাড়া ১৯২১ সালে সংঘটিত ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের সময় ̄স্থানীয় কমিউনিস্টদের আচরণ (এবং সুযোগ-সুবিধা) সম্পর্কে তিনি সমালোচনাও করেছিলেন। আবার এমন কিছু প্রমাণও রয়েছে, প্রতি শনিবার বাধ্যতামূলক সাব-বোটনিক (কমিউনিস্ট কাজ বলে খ্যাত) চলাকালীন অন্যের আবর্জনা পরিষ্কার করতে তিনি অস্বীকার করেছিলেন। যার কারণে পার্টি তাকে বহিষ্কার করে। অর্থাৎ পার্টি বানেতাদের বিচ্যুতির বিরুদ্ধে ভিন্নমতের হলেই প্রচণ্ডড শোরগোল তুলে তাকে আজীবনের জন্যে দেগে দেওয়া হত। কারণগুলি তলিয়ে দেখার প্রয়োজনবোধ করতো না কেউ। এক কথায় কমিউনিজম একনায়কতন্ত্রের শিকার হয়েছিলেন প্লাতোনভ।

ফলে মৃত্যুর আগ (১৯৩৭-১৯৫১) পর্যন্ত আন্দ্রেই প্লাতোনভের আট খণ্ডের কল্পকাহিনী এবং প্রবন্ধ প্রকাশ করা হয়নি। স্ট্যালিনের নির্দেশে তা ছিল অপ্রকাশিত, বদ্ধ, রুদ্ধ, নির্বাসিত অর্থাৎ নিষিদ্ধ। কিন্তু প্লাতোনোভ ছিলেন সত্যিকারের একজন কম্যুনিস্ট। জীবিত অবস্থায় নিদারুণ দুঃখ-কষ্ট সহ্য করেও তিনি কমিউনিস্ট পন্থা ত্যাগ করেননি। কিম্বা স্বপক্ষ ত্যাগ করে অন্যকোন দেশের আশ্রয় প্রার্থনা করেননি। এমনকি একমাত্র পুত্রের অকাল মৃত্যুও তার সোভিয়েত আনুগত্যে চিড় ধরাতে পারেনি। ধ্রুব সত্য হলো যে, তিনি স্ট্যালিনের বিরোধী। কিন্তু কম্যুনিজমের বিরুদ্ধবাদী ছিলেন না।

জীবদ্দশায় যথাযথ সম্মান তাকে দেওয়া হয়নি। ছিলেন অবহেলিত। কোন একবিশ্ববিদ্যালয়ে আশ্রিত থেকে তিনি যক্ষা আক্রান্ত জীবনকে কোন রকমে টেনে নিয়ে চলেছিলেন মৃত্যুর ঠিকানায়। তবু কর্মে ক্লান্তি ছিল না তার। অনেক সময় গাছের ঝরাপাতা কুড়িয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখতেন। শিক্ষার্থীরা জানত না তিনি কে বা জানলেও সেভাবে ̧গুরুত্বের সাথে তাকে সম্মানিত করা হতো না। সোভিয়েত শিল্প, সাহিত্যে গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধের যে কোন আলোচনায় আন্দ্রেই প্লাতোনভ ছিলেন উপেক্ষিত, তুচ্ছ, ত্যাজ্য এবং বর্জনীয়। মাত্র একান্ন বছরের জীবনে অপরিসীম বেদনা বয়ে গেছেন প্লাতোনভ। তার মতো সংবেদনশীল একজন লেখক রোগে ভুগে নিতান্ত অখ্যাতর মত একাকী অনাদরে শত অবহেলায় ধুঁকে ধুঁকে কখন যে মৃত্যুকে বরণ করে নিয়েছিলেন তা কেউ জানে না।

গেল দু’বছর ধরে প্লাতোনভ পাঠ করতে গিয়ে বারবার মনে হয়েছে, স্ট্যালিন সত্যিই প্লাতোনভকে বুঝতে পেরেছিলেন। তাই তিনি প্লাতোনভের মত একজন সৃজনশীল সাহিত্যিকের লেখার ̄স্বাধীনতা ও প্রচারকে রুদ্ধ করে রেখেছিলেন। শুধু কি তাই! ১৯৩৭ সালে স্ট্যালিনের নির্দেশে লেখক আন্দ্রেই প্লাতোনভের একমাত্র সন্তান পনেরো বছরের কিশোর প্লাতনকে সন্ত্রাসী এবং ̧গুপ্তচর সাব্যস্ত করে তৎকালীন সোভিয়েত রাষ্ট্রের মিহিন নির্যাতনের কুখ্যাত ̄স্থান শ্রমশিবিরে নির্বাসিত করা হয়। শেষ পর্যন্ত বন্ধু-বান্ধবদের অক্লান্ত প্রচেষ্টায় দুই বছরের মাথায় ছেলে প্লাতনকে ছাড়িয়ে আনতে পারলেও বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব হয়নি। শ্রমশিবিরে ছেলেটি যক্ষারোগে আক্রান্ত হয়ে পড়েছিল এবং তার জন্যে কোন রকমের চিকিৎসার ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। ১৯৪৩ সালের শুরুতে মারা যায় প্লাতন। ছেলের সেবাযত্ন করতে গিয়ে লেখকের নিজের শরীরেও ছড়িয়ে পড়ে দুরারোগ্য যক্ষার বীজ। অবসান হয় রাশিয়ার ভিন্নমতের লেখক আন্দ্রেই প্লাতোনভের জীবন।

এখন তো আমরা জানতে পারছি, কেবল তো আন্দ্রেই প্লাতোনভের ছেলে নয়, সেসময় সোভিয়েত সাহিত্যের অনেক লেখক-লেখিকাকেই – যারা স্ট্যালিনের সাথে সামান্য মতভেদ পোষণ করেছেন তাদের এই তীব্র মানসিক যন্ত্রণা সহ্য করতে হয়েছে। কেন না তারা স্ট্যালিনের অনেক কাজেরই সমালোচনা করেছিলেন। ১৯২১ সালের দুর্ভিক্ষের সময় প্লাতোনভ ̄স্থানীয় কমিউনিস্ট কমিটির কাজের প্রকাশ ̈সমালোচনা করায় তার উপর আরও বৈরি হয়ে উঠেছিলেন স্ট্যালিন এবং তার অনুগ্রাহী কমরেডরা।

বহুবার থমকে গেছি প্লাতোনভের জীবনী পড়তে পড়তে। স্ট্যালিন হয়ত উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন, সেই সময়ের সোভিয়েত রাশিয়ায় কমিউনিজম প্রতিষ্ঠা করতে এমন কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে যা এক সময় ভুল হিসেবে প্রমাণিত হবে। মিখাইল গর্বাচেভের হাত ধরে প্রায় সত্তর বছর পরে গ্লাসন্ত বা পেরেস্ত্রইকার মত রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সংস্কার নীতির এক মহাঝড় এসে উন্মোচিত করে দিবে সেই ভুলগুলোকে! সেই সাথে লৌহকঠিন নিষেধাজ্ঞার শেকল থেকে মুক্তি পাবে প্লাতোনভের অমর সৃষ্টিকর্মসমূহ!

ঠিক এমন ঘটনাই ঘটেছে নব্বই দশকে। অভাব, দারিদ্র্য আর অস্বীকৃতির দুর্দশায় মৃত আন্দ্রেই প্লাতোনভ বিংশ শতাব্দীর সাহিত্য অঙ্গনে একজন শ্রেষ্ঠ রুশ গদ্য লেখক হিসেবে খেতাব অর্জন করে নিয়েছেন। প্লাতোনভের লেখা ‘দ্যা ফাউন্ডেশন পিট’ উপন্যাসের ইংলিশ অনুবাদক রবার্ট চ্যান্ডলার এতটাই মুগ্ধ হয়ে গিয়েছেন যে, তিনি ১৯৯৪ সালের পর দ্বিতীয়বার এই বইটি অনুবাদ করেন। কী ছিল এই উপন্যাসের বিষয়বস্তু? ‘দ্যা ফাউন্ডেশন পিট’ কী করে এতটা মন কেড়ে নিয়েছে অনুবাদকসহ বিশ্বের অগুনতি পাঠকদের!

উপন্যাসটি ছিল শিল্পকরণ এবং সংগৃহীতকরণের জন্যে রাশান কৃষকদের নিজ গৃহ, গ্রাম, খেত, ফসল আত্মীয়-পরিজন থেকে মূলোৎপাটন করার মর্মান্তিক এবং বেদনাদায়ক কষ্টের ইতিহাস নিয়ে লেখা। রাজনৈতিক আদর্শকে বাস্তবায়ন করতে গিয়ে মানবিক সম্পর্ককে সে সময় লুণ্ঠন করা হয়েছিল। ছিঁড়ে ফেলা হয়েছিল নাড়ির বাঁধনকে। প্লাতোনভের মনে এটি গভীর ছাপ ফেলেছিল। স্ট্যালিনবাদের অতিরিক্ত কড়াকড়িকে মন থেকে মেনে নিতে পারেননি। ফলে তার রাজনৈতিক লেখাগুলো ছিল সর্বগ্রাসী বিরুদ্ধ নীতিতে আক্রান্ত, অথচ মায়াময়। খুব সহজেই তাই রাষ্ট্রনায়কের মনকে বিরূপ করে তুলেছিল। প্লাতোনভ হয়ে পড়েছিলেন একা। নির্বাসিত। অনুল্লেখিত। ত্যাজ্য এবং নিষিদ্ধ। ‘দ্যা ফাউন্ডেশন পিট’ উন্মোচিত করে দিয়েছিল স্ট্যালিনীয় জোর-জবরদস্তিকে। রবার্ট চ্যান্ডলার হার্ভিল প্রেসের জন্যে জেফ্রি স্মিথের সাথে প্রথম ‘দ্যা ফাউন্ডেশন পিট’ অনুবাদ করেন। এরপর ২০০৯ সালে তিনি তার ̄স্ত্রী এলিজাবেথ এবং মার্কিন ̄স্কলার ওলগা মেরসনকে সাথী করে দ্বিতীয়বারের জন্যে এনওয়াইআরবি ক্ল্যাসিকের জন্যে অনুবাদ করেন ‘দ্যা ফাউন্ডেশন পিট’।

প্লাতোনভের সাহিত্যের ভাষা খুব মর্মস্পর্শী হলেও শব্দ প্রয়োগের ক্ষেত্রে কিছুটা দূরত্ব জ্ঞাপক। কিন্তু পড়তে গেলে তেমন কঠিন বলে মনে হয় না। অনুবাদক রবার্ট চ্যান্ডলার গার্ডিয়ান পত্রিকায় এক সাক্ষাৎকারে জানান, প্লাতোনভের লেখার নানা ̄স্তর রয়েছে। তাঁর ভাষা অত্যন্ত ঘন সম্পর্কযুক্ত হলেও কিছুটা অদ্ভুত বিচ্ছিন্নতাপূর্ণ। অনুবাদ কঠিন। তবে সুখের বিষয় চ্যান্ডলারের অনুবাদের মাধ্যমে এখন বিশ্বের নানা দেশের প্রচুর সাহিত্যমোদি পাঠক প্লাতোনভ পাঠ করছে। চ্যান্ডলারের মতে, অনুবাদে চেখভও কম কঠিন নয়। তিনি চেখভকেও খুব পছন্দ করেন। চেখভের সাহিত্য তাকে মুগ্ধ করেছে। প্লাতোনভ অনুবাদের সময় তিনি রাশান অনুভবকে ঠিক রেখে ইংরেজি অনুবাদের নিয়মে অনুবাদ করেছেন। তাঁর মতে, অনুবাদ সাহিত্য হিসেবে পাস্তারনাক এবং সোলঝেনিতসিনের সাহিত্যকর্মের চাইতে গ্রসম্যান, প্লাতোনভ এবং শালোমভ পাঠকদের কাছে বড় লেখক হিসেবে বেশি সমাদৃত হয়েছেন।

প্রতি বছর ভোরনেজে অনুষ্ঠিত হয় প্লাতোনভের সাহিত্যের প্রদর্শনী। শ্রোতারা মুগ্ধ হয়ে শোনে রুশ সাহিত্যেের নীলকুমার প্লাতোনভের রচনা। এভাবেই বর্তমান রাশিয়ার শ্রেষ্ঠ লেখক হয়ে উঠেছেন আন্দ্রেই প্লাতোনভ। সম্মান, মর্যাদায়, আদরে হয়ে উঠেছেন বিভূষিত, পুরস্কৃত।

প্লাতোনভের উল্লেখযোগ্য কয়েকটি উপন্যাস হচ্ছে, The Foundation Pit, Chevengur, Happy Moscow, The Fierce and Beautiful World, Soul।

[কৃতজ্ঞতাঃ লেখাটি তৈরি করতে নানাভাবে সাহায্য নিয়েছি ̧গুগল এর। গার্ডিয়ান পত্রিকা এবং প্লাতোনভের গল্প অনুবাদের জন্যে পাঠানো বিভিন্ন সূত্র থেকেও সহায়তা নেয়া হয়েছে। ]

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ভাষা
Scroll to Top