Home » অমৃতের স্বাদ // বানু মুশতাক, অনুবাদ: আসাদুল লতিফ

অমৃতের স্বাদ // বানু মুশতাক, অনুবাদ: আসাদুল লতিফ

শামীম বানুকে ঠিকমতো বুঝে উঠতে পারে না বাড়ির কেউই। সাদাতের তো মাথায়ই আসে না কীভাবে একটা মানুষ এতো বদলে যেতে পারে। সরকারি হাইস্কুলে উর্দু ভাষা পড়ায় সাদাত, আর তার বাকি সময় কাটে শুধু শামীমের দিকে নজর রেখে, মাঝেমাঝে ভাবে ওর ওপর কি জ্বীনের আসর হয়েছে? এমনিতে বইটই পড়ার খুব একটা অভ্যাস নাই, তবে সেদিন স্টাফ রুমে পড়ে থাকা খবরের কাগজের একটা আর্টিকেলে চোখ আটকে যায় তার, মনে আশা জাগে হয়তো সমস্যা সমাধানে এতোদিনের সব চেষ্টার কোন উপায় হয়তো হতে চলেছে। ঋতু বন্ধ হতে চলেছে স্ত্রীর, এই সময় ওর পাশে দাঁড়ানো উচিত। সেটা ভেবে মনটা একটু শান্ত হয়। বাড়িতে ওর রাগে ফেটে পড়া কিংবা ছোটখাট ব্যাপারে ছেলেমেয়েদের ওপর অহেতুক চেঁচামেচি কীভাবে এড়িয়ে থাকা যায় সেটাও শিখে নেয়। সবকিছুর জন্য একটা সহজ জবাব দাঁড় করায় সাদাত, আরে এটা তো খুবই মামুলি একটা ব্যাপার।

সবচেয়ে বড় ছেলে আজীম। হয়তো প্রথম সন্তান কিংবা ছেলে যে কারণেই হোক ওর প্রতি শামীম বানুর আলাদা একটা টান রয়েছে। এক কথায় যাকে বলে – সাত খুন মাফ! তাই তো ছোট দুই বোন আসীমা আর সানার রোজকার নালিশ, ‘মা ভাইয়ের ব্যাপারে একচোখা!’। তারও এ ব্যাপারে কোন লুকোছাপা নেই। অবশ্য রেগে গেলে তিনজনকেই শয়তানের দল হিসেবে এক পাল্লায় মাপা হতো, তখন আর কোন নিস্তার ছিল না। হাতের কাছে যাকে পাওয়া যায় তাকেই খানিকটা উত্তম-মধ্যম দিলে মাথাটা ঠান্ডা হতো শামীম বানুর।

যথারীতি আজীম খুব কমই ধরা পড়ে। সানা সবচেয়ে ছোট হলেও বেশ চালাক বলে মায়ের মেজাজ মর্জি বুঝে সুযোগ মতো সটকে পড়ে। যার ফলে দোষ করুক আর না করুক, হরহামেশা পিটুনি জুটে আসীমার কপালে। অবশ্য কোনো এক অজানা কারণে নির্বিকারে মায়ের এই সমস্ত রাগের ফলাফল হজম করে সে। রাগ পড়ে গেলে ভীষণ খেদ হয় শামীমার মনে, বিনা দোষে এমন করে ওর বদমেজাজের শিকার হওয়ায় খুব মায়া হয় মেয়েটার জন্য। তখন ওর শখ আহ্লাদ পূরণের জন্য কখনও আসীমাকে নতুন জামা কিংবা চপ্পল কিনে দেয়, মিষ্টি খেতে কিংবা হাত খরচের জন্য দু’টো বাড়তি টাকা গুঁজে দেয়।

তবে মায়ের সামনে বাবার অসীম ধৈর্য্য দেখে ওরা খুব অবাক হয়, ধরেই নেয় বাবাকে একেবারে কব্জা করে রেখেছে মা। সাদাত আর তার বোনেরা মায়ের ব্যাপারে যাই বলুক না কেন, ওরা নিজেদের মতো করে হঠাৎ তার এই বদলে যাওয়ার একটা কারণ খুঁজে নিয়ে একে অপরকে বোঝায়।

দু’চোখে আকাশ সমান স্বপ্ন নিয়ে তিন ছেলে আর তিন মেয়ের এই বাড়িতে বড় বৌ হয়ে এসেছিল শামীমা। মেহেদি রাঙা করতল চন্দনে ডুবিয়ে পশ্চিমের দেওয়ালে হাতের ছাপ দিতে দিতে অবাক হয়ে দেখেছিল আশেপাশে আরো কতগুলো ছোট ছোট হাতের ছাপ পড়েছে। দেবর আর ননদদের দেখাশোনা করতে হতো তাকে, তাদের কাপড়, খাওয়াদাওয়া, খরচাপাতি সবকিছু। সেই সাথে অসুস্থ শাশুড়ির পথ্য, রান্না আর শ্বশুরের রাজ্যের যতো আত্মীয় স্বজন আর বন্ধুবান্ধবের মেহমানদারিও করতে হতো। ক্রমেই তার নিজের স্বপ্ন ম্লান হয়ে যেতে থাকে। প্রথমদিকে ওদের কথা মতো সবকিছু বেশ হাসিমুখেই সামলাতো। কিন্তু যতোই দিন গড়াতে থাকে একের পর এক সন্তানের জন্ম, এতোসব ঝামেলার ভেতর দিয়ে তাদেরকে কোলেপিঠে করে মানুষ করা, স্বামীর বোনদের বিয়ে, তাদের পোয়াতি কাল, বাচ্চাকাচ্চা হওয়া, তার ওপর বাড়ির মুরুব্বিদের অসুখবিসুখ, মারা যাওয়া এই সমস্ত কিছু একসময় ভীষণ খিটখিটে করে তুলে তাকে। তারপরও তার মেজাজ চড়ত না। একটা আশা ছিল অন্য ভাইয়ের বউরা ঘরে এলে হয়তো তার কাজের চাপ কিছুটা কমবে।

অথচ ঘটে ঠিক তার উল্টো। বিয়ের এক বছরের মাথায়ই প্রথম দেবরের বউ বরের সাথে দুবাই পাড়ি জমায়। শামীমের মনটা একেবারে ভেঙে যায়। রোজ রোজ ঘরসংসারের এই ঘানি টানা থেকে মুক্তি মিলবে তার? হয়তো মরণ হলে। এসব নিয়ে আপনমনে গজগজ করতে থাকে সে, কে শুনল না শুনল সেসবের আর তোয়াক্কা করে না। এভাবেই সাদাতের ছোট বোনেরা আর বাড়ির বাকি সবাই ওর থেকে ক্রমেই দূরে সরে থাকে।

বাবা-মা মারা যাওয়ার পর ছোট দেবর আরিফকে খুব স্নেহ দিয়ে বড় করেছে শামীম বানু। অথচ বিয়ে করতেই রাতারাতি যেন ওর সৎমা হয়ে যায় সে। তাই একদিন সাদাতকে হতবাক করে দিয়ে আরিফ আর তার নতুন বউকে সংসার থেকে আলাদা হয়ে যেতে বলে দেয়। এই ঘটনায় মনে আঘাত পায় সাদাত। কিন্তু শামীম বানু কি আর ছেড়ে কথা বলে? নতুন পুরনো সব পুরনো ইতিহাস ঘেঁটে তোলা হয়ে গেলে ইচ্ছে মতো সাদাতের ঘাড়েই দোষ চাপায়, কতক্ষণ চিৎকার – কান্নাকাটি করে হৈচৈ বাঁধিয়ে শেষে দড়াম করে ঘরের দরজা বন্ধ করে দেয়। দুর্বিপাকে পড়ে আরিফ আর তার বউ। বেচারা আরিফ! সে জানতেও চায় না কেন নিজের বাবার বাড়ি থেকে তাকে চলে যেতে হবে? দরকার হলে সে-ই চলে যেতে পারে। আরিফ আর সাদাত নিজেদের ভেতরে কীভাবে বোঝাপড়া করে নেয় সেটা আর জানা যায় না। নতুন বউয়ের সামনে এমন অপমান হজম করে তিন দিনের মাথায় একই মহল্লার পরের গলিতে একটা ভাড়া বাসায় উঠে পড়ে আরিফ।

এই ঘটনাটা বাড়ির সবার মনে নাড়া দিয়ে যায় নানানভাবে। তিন ছেলেমেয়ে তাদের মায়ের এমন আচরণ নিয়ে ফিসফাস করে। আরিফ চিক্কাপ্পাকে খুব ভালোবাসত ওরা। কথাটা মনে আসতেই মুখ ফসকে বলে ফেলে সানা, ‘তারমানে বিয়ে করলে তোকেও গাঁট্টিবোচকা বেঁধে বউ নিয়ে বিদেয় হতে হবে’। অদ্ভুত এক ভয় আর ভাবনায় মন ছেয়ে গেলেও মুখে কিছুই বলে না আজীম। এ অবস্থা থেকে বাঁচাতে আসীমা এগিয়ে আসার আগে পর্যন্ত একভাবে সানার দিকে তাকিয়ে থাকে সে।

‘বালাই ষাট, এমন যেন আর কারো সাথে না হয়’, এঁচড়ে পাকাদের মতো করে বলে সে। আজীমও নীরবতা ভেঙে ওদের সাথে ফিসফাস করে। ফুপুরা বলাবলি করে, ‘আহারে বেচারি ভাবী! ব্লাড প্রেশারটা বাড়লেই এমন করে। তবে মনটা ভালো’। ছেলেমেয়েরাও সেরকমই ভাবে, ‘আহারে আম্মি! কত ভালো …’। আর কোন উপায় না পেয়ে ভালো ভালো কথা বলেই বাকিটা শেষ করে তারাও। যদিও এরপর আরিফ চিক্কাপ্পার মুখোমুখি হওয়ার সাহস ছিল না কারোরই, তবু ওরা গৃহ প্রবেশে নিমন্ত্রণ করলে সবাই-ই যায় সেখানে, শুধু শামীম বানু ছাড়া। কোনো কারণ ছাড়াই আরিফ আর তার বউয়ের সাথে কথা বলা বন্ধ করে দেয়, তারপর আবার অনেকদিন পরে সবকিছু এমনভাবে স্বাভাবিক করে নেয় যেন কিছুই হয়নি।

তবে এই সমস্ত ঘটনা সাদাতের কাছে খুব খারাপ লাগে। সব ব্যর্থতার দায়ভার মাথায় নিয়ে আত্মগ্লানিতে ভোগে। মায়া মমতার সম্পর্কগুলো হারানোর পেছনে মেনোপজ, এমন ধারণা আঁকড়ে ধরে বসে থাকার জন্য নিজেকেই গালমন্দ করে। শাক দিয়ে মাছ ঢাকার মতো করে নিজের অক্ষমতা ঢাকার জন্য নিজেকে কাপুরুষ মনে হয় তার। আরিফ আর তার বউয়ের সামনের ঘটনায় গভীর অপমানবোধ হয়। প্রচন্ড আক্ষেপে নিজের হারানো জায়গাটা ফিরিয়ে আনার জন্য জেদ হয় তার, আগের মতো আবারও শামীম বানুকে তার কথা মেনে চলার পথে ফেরাবে বলে ঠিক করে। কিন্তু সেজন্য যা করা দরকার সেই সমস্ত সুযোগ জেনেশুনে হাতছাড়া করে ফেলে, নিজের ওপর আরো বেশি রাগ হয় তার।

যতোদিনে সাদাত বুঝতে পারে শামীমের ব্যবহার আর সহ্য করা সম্ভব না, ততদিনে এটাও বুঝতে পারে যে কোনো এক অজানা ভয় তাকে ওর মুখোমুখি হতে বাধা দিচ্ছে বারবার। অনেক চেষ্টা করেও সেই ভয়ের কারণ বুঝতে না পেরে অবশেষে নিজের চারপাশে গভীর বিষাদের এক দেয়াল তুলে দেয় সে। যেদিন এই দেয়াল ভাঙতে পারবে সেদিন এই সমস্ত যন্ত্রণা থেকে মুক্তি মিলবে তার। জীবনের সব রঙ মুছে যেতে থাকে, ভেতরে ভেতরে পুরোপুরি ভেঙে পড়ে মানুষটা।

সেদিন সন্ধ্যায় মাগরিবের নামাজের জন্য মসজিদে যাওয়ার আগে নিজের টুপি খুঁজছিল সাদাত। এমনিতে সেটা চোখের সামনেই থাকে, হয়তো কোথাও পড়ে গিয়েছে। আজান প্রায় শেষের দিকে। এই মুহূর্তে টুপিটা পেলে কোনোমতে দৌড়ে গিয়ে নামাজের জামাত ধরা যাবে। কিন্তু কোথায় গেল টুপিটা! ‘আমার টুপি কোথায়?’ কাউকে জিজ্ঞাসা করার মতো করে উঁচু গলায় বলে। কিন্তু কে জবাব দিবে? তবুও কারো জবাবের অপেক্ষায় থাকে সাদাত; যদি শামীম এসে বকাঝকা করতে করতে টুপিটা বাড়িয়ে দিত তাহলেই ব্যাপারটা শেষ হতে পারত। অন্য সব ওয়াক্তে আজানের পর নামাজের জন্য আধাঘন্টা সময় পাওয়া গেলেও মাগরিবে সেটা থাকে না। আজান শেষ হওয়ার সাথে সাথেই লোকজন জমায়েত হয়। আদৌ নামাজটা ধরতে পারবে কীনা .. মেজাজ চড়ে যায় তার। শামীম সামনেই আছে, হাত-পা ছড়িয়ে বসে টিভি দেখছে।

‘টিভিটা বন্ধ করতে পারছ না? অন্ততঃ আজানের সময় তো সাউন্ডটা একটু কমাতে পারো, নাকি?’, ভাবে সে, কথাগুলো একেবারে ঠোঁটের আগায় চলেই এসেছিল কিন্তু শেষ মুহূর্তে নিজেকে সামলায়। তার দিকে কোনো খেয়ালই নাই শামীমের। টুপি খোঁজাখুঁজি করতে দেখে একবার ওর দিকে তাকিয়ে আবার চোখ ফিরিয়ে নেয় টিভিতে। সাদাতের ইচ্ছে হয় গালমন্দ করে দু’টো চড় লাগিয়ে দিতে। কিন্তু করে না, ভেতর ভেতর একটা অদৃশ্য ভয় গিলে খাচ্ছিল তাকে। হঠাৎ ভীষণভাবে ঘামতে থাকে, মনে হয় এখুনি পড়ে যাবে। জ্ঞান হারানোর আগ মুহূর্তে আশেপাশে একটা চেয়ার কিংবা ধরার মতো কিছু একটা হাতড়াতে থাকে, ঠিক এমন সময় তার সেই অদৃশ্য ভয় চোখের সামনে ভেসে ওঠে, কুঁজো পিঠের সেই নারীর চোখ দুটো জ্বলজ্বল করছে, শুকনো হাত-পা, কুঁচকানো চামড়া আর জটপাকানো এলোমেলো চুল। আবছায়া সন্ধ্যায় ঘরের রূঢ় বাতাসে সাদা শাড়ি আঁচল মাথায় দিয়ে বৃদ্ধ নারীমূর্তি ধীরে ধীরে তার দিকে এসে হাত বাড়িয়ে টুপিটা এগিয়ে দেয়। নিজেকে পরাজিত কোন মানুষ বলে মনে হয় সাদাতের।

হ্যাঁ। শামীম বানুর দেয়া সব অত্যাচার সে মুখ বুজে সয়েছে। ‘হায় খোদ, এ কেমন পরীক্ষা তুমি নিচ্ছ আমার!’।

‘এই নাও তোমার টুপি, তাড়াতাড়ি নামাজে যাও। আমাকেও তো নামাজ পড়তে হবে’। বাম হাতে নিজের মতোই একখানা প্রাগৈতিহাসিক জায়নামাজ ধরে ডান হাতে টুপিটা বাড়িয়ে দিতে দিতে বলেন তিনি।

‘আরে আম্মাজি, আপনি কেন কষ্ট করছেন? আমিই খুঁজে নিতাম’, ধুসর হয়ে ওঠা সাদা টুপিটা চোখের সামনে নিয়ে বলে সাদাত। আদর করে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দোয়া করে ধীরে ধীরে নিজের ঘরের দিকে ফিরে যান তিনি। সাদাতও মসজিদের দিকে দৌড় দেয়।

অনেক বছর আগে তাকে আম্মাজি বলে ডাকত সাদাত। তার ছেলেমেয়েরা সবাই বড় হয়ে বাই-দাদী বলে ডাকা আরম্ভ করে। কোথায় থেকে ওরা এই নাম শিখেছে কে জানে? তারপর থেকে সবাই তাকে বাই-দাদী বলেই ডাকে, এমনকি সাদাতও। বাবার সবচেয়ে ছোটবোন, এই ফুপুর বিয়ে হয়েছিল খুব কম বয়সে। বিয়ের এক মাসের মাথাতেই স্বামী মারা যায়। অনেকে বলেছিল সাপের কামড়ে, যদিও তার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তারও বছর খানেক পর তার প্রথম মাসিক হয়। কোন বাধা না থাকলেও বিধবা বিয়ের কোনো রীতি তার বাপের বাড়িতে ছিল না। আর তাই এভাবেই প্রতি মাসে তার শরীরের একেক পরত ঝরে পড়ে, মিশে যেতে থাকে মাটিতে। না শরীর, না মন, না কোনো স্বপ্ন – কিছুই পূর্ণতা পায় না তার।

বড় ভাইয়ের বাড়িতে ছায়ার মতো নীরবে এক কোণে পড়ে থেকে সবাইকে ছায়া বিলিয়ে যেতে থাকে। ভাইয়ের স্ত্রী মানে সাদাতের মা অসুখে পড়লে মুখ বুঁজে তার সেবা করে, মল-মুত্র সাফ ককরে। একেক সময় সাদাতের মনে হতো মায়ের সেবা করার জন্যই কি বাই-দাদীর জন্ম হয়েছে নাকি ওকে দেখেই মা অসুখে পড়েছে। মায়ের যা দরকার সবকিছু করে দিয়েই সাথে সাথে অন্য কোনো কাজে লেগে পড়তে দেখত আম্মাজিকে। গাদাগাদি করে রাখা ময়লা বাসনকোসন দেখে কখনও বিরক্ত হতো না, সাথে সাথে উবু হয়ে লেগে পড়ত ধুয়ে মুছে সাফ করার জন্য। এই বাড়িটা কখনও পুরোপুরি খালি হতো না, তালা দেওয়ারও দরকার পড়ত না। এই মানুষটাই ছিল সেই তালা। যখনই কড়া নড়ুক না কেন, তার জন্য সবসময় দরজা খুলে দিত আম্মাজি। রমজানের ঈদের নতুন শাড়ি দেওয়া হলে সেটাকে সুন্দর করে ভাঁজ করে নিজের লোহার ট্রাংকে তুলে রাখত। বিয়ের সময় পাওয়া একখানা জায়নামাজ আর নামাজের চাদরটা সবসময় ভাঁজ করে রাখা থাকত ওটার ওপর। সেই চাদরের ভাঁজ থেকে কখনও কখনও বেরিয়ে আসত স্মৃতির জুঁই ফুলের সুবাস।

পোকামাকড় কিংবা ছোটখাট কীটপতঙ্গ মারতে খুব পটু ছিল। কেউ বাই-দাদী বলে চিৎকার করলেই হলো, ব্যাস হাতে ঝাড়ু নিয়ে হাজির হয়ে যাবে। এভাবে ছোটখাট পোকামাকড় মারতে মারতে একদিন চ্যালা কাঠ দিয়ে পিটিয়ে একটা সাপ মেরে ফেলে। রক্তে মাখামাখি হয়ে থেঁতলে পড়ে থাকা দেহটাকে দেখে আঁতকে ওঠে সবাই। কেউ বলে কাল-কেউটে কেউ বলে চন্দ্রবোড়া। পাগলের মতো আরো কয়েকবার মরা সাপটাকে মেরে চিৎকার করে ওঠে, ‘কেন কামড়াবি? মানুষকে মেরে কী লাভ তোদের?’। এসময় আশেপাশে দাঁড়ানো অনেকেই তার চোখে জল দেখতে পেয়েছিল।

ঘরের কাজকর্ম সব বাই-দাদীর কাছ থেকেই শিখেছে শামীম বানু, প্রথমদিকে তাকে বেশ সমীহ করেই চলত। কিন্তু যতোই দিন যায় তাকেও আর অপমান করতে ছাড়ে না। সেখান থেকেই সাদাতের ভয়টা শুরু। যে বাই-দাদী সারাটা জীবন তাদের পিছনে ব্যয় করে গেল, শামীম কি আরিফের মতো তাকেও একদিন তাড়িয়ে দিবে? তাড়িয়ে দিলে মানুষটা যাবেই বা কোথায়? আরিফের অন্ততঃ একটা চাকরি ছিল, সাথে বউ ছিল। সাদাতকে ছাড়া বাই-দাদীর আর কে আছে? শামীম যদি এমন কিছু করে … সেটা ভেবেও তার গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। ‘আল্লাহ্ নিশ্চয় রহম করবে’ বলে নিজেকে অভয় দিলেও মনটা অশান্ত হয়ে ওঠে।

একদিন বাইরে থেকে চিৎকার করে বোনকে ডাকে আজীম, ‘অ্যাই সানা, সানাআআআ! কোথায় তুই?’

‘আসছি, আসছি। কী হয়েছে?’

‘কিছু হয়নি, তোকে লাগবে না। শুধু একটা পুরনো কাপড় দিয়ে যা, বাইকটা মোছার জন্য’।

‘এক মিনিট’, এক দৌড়ে ভেতরে গিয়ে কোথায় থেকে যেন একটা পুরনো কাপড় এনে ভাইয়ের হাতে দিয়েই উধাও হয়ে যায় সানা। কী কাপড় দিল সেটা খেয়াল করেনি আজীম। এমনিতেও তাড়াহুড়ো ছিল, তারপর এসব নিয়ে একেবারেই মাথা ঘামায় না সে, তাই তাড়াতাড়ি বাইকটা মুছে বেরিয়ে পড়ে, যাওয়ার সময় কাপড়টা ছুঁড়ে ফেলে যায় দরজার কাছে।

বিকেলে বাড়ি ফিরে বুঝতে পারে যে ভয়ংকর বিপর্যয় এখানে নেমে এসেছে তার জন্য একমাত্র সে-ই দায়ী। বাই-দাদী আর আম্মি উঠোনে দাঁড়িয়ে আছে। যে মানুষটাকে কেউ কখনও কাঁদতে দেখেনি সেই বাই-দাদী’র চোখ ফুলে উঠেছে কাঁদতে কাঁদতে। যে পুরনো কাপড়টা আজীম ফেলে গিয়েছিল সেটাই ধরে আছে বাই-দাদী, ক্ষীণ দুই হাতে ঘষে ঘষে গ্রিজের দাগগুলো তোলার নিষ্ফল চেষ্টা করে যাচ্ছে। বিব্রত শামীম বানু হাতে একটা নতুন সিল্কের জায়নামাজ নিয়ে পাশে দাঁড়িয়ে ওকে বুঝানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে।

‘এই যে, একদম নতুন জায়নামাজ বাই-দাদী। এইটা নেন’, চোখের জল মুছে সাথে সাথে আবারও কান্নায় ভেঙে পড়ে বাই-দাদী, ‘লাগবে না এটা। আমি ঘাটের মরা এটা নিয়ে কী করব?’।

‘বালাই ষাট, মরুক আপনার দুশমন। যেমন তেমন জায়নামাজ না। বড় আপা এটা হজ্ব থেকে আমার জন্য নিয়ে এসেছিল। জমজমের পানিও ছিটানো আছে। মিনতি করছি, নিয়ে নেন … এটাতে নামাজ পড়বেন’।

নিজের ভুল বুঝতে পারে আজীম। নিজেকে মনে হচ্ছে চুরির দায়ে হাতেনাতে ধরা পড়েছে। জায়নামাজের গায়ে লেগে থাকা তেলের দাগগুলোই সব পরিষ্কার বলে দিচ্ছে।

ওদের দুইজনের মাঝখানে এসে কোনোমতে কথা বলার চেষ্টা করে সে, ‘আম্মি’। কিন্তু মায়ের রাগী চোখের চাহনিতে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে চুপ হয়ে যায়। সানার খোঁজে এদিক ওদিক তাকিয়ে বুঝতে পারে যথারীতি বিপদের আভাস পেয়েই হাওয়া হয়ে গেছে মেয়েটা। আসীমা ওর দিকে তাকিয়ে ইশারায় বোঝায় দোষটা মাথা পেতে নিতে রাজী আছে, তাতে আরো দিশেহারা হয়ে পড়ে আজীম।

‘লাগবে না … বললাম না লাগবে না এটা আমার? তোমার বোন দিয়েছে, তুমিই রাখো। আমাকে দিচ্ছো কেন? আমার এই জায়নামাজেই চলবে’।

হঠাৎ করে অদ্ভুত এক শান্তভাব আজ শামীম বানুর মাঝে। ‘আমি বা আপনি কেউ একজন নামাজ পড়লেই তো হল। জানিনা এটা কার কাজ। মনে হয় ছেলেমেয়েরা কেউ না বুঝে করে ফেলেছে। তাছাড়া জিনিসটাও তো অনেক পুরনো হল’।

‘কি? এটা পুরনো? আমিও তো অনেক পুরনো, তাই না?’, একগুঁয়ের মতো তর্ক জুড়ে দেয় বাই দাদী। আগে কখনও কারো সাথে ঝগড়া করেনি সে। যখন এই বাড়িটা আত্মীয়স্বজনে গমগম করত, তখন অনেক সময় একাই তিন-চারটা মুরগী কেটেকুটে রান্না করে ফেলত, সারু’র গন্ধে ম-ম করত সেই তরকারি, অথচ দিন শেষে এক টুকরো মাংস না পেলেও কখনও অভিযোগ করেনি। পাতিল ভর্তি পায়েস রান্না করে নিজের জন্য এক চামচ না পেয়েও কখনও মন খারাপ হয়নি তার। বাড়িতে বিয়েশাদির সময় সারি সারি জারাতারি সিল্কের শাড়ি মেলা থাকলেও সেখান থেকে কখনও একটা চায়নি সে। অথচ আজ এই জরাজীর্ণ জায়নামাজের জন্য তাকে এমন হাপুস নয়নে কাঁদতে দেখে যারপরনাই হতবাক শামীম বানু।

‘না, বাই-দাদী, কাঁদবেন না। আজীম বুঝতে পারেনি এটা আপনার জায়নামাজ। ছেলেটা তো খারাপ না, ওকে মাফ করে দেন। এই জায়নামাজটা নেন’। যতোই অনুনয় করে, বাই-দাদীর কষ্ট যেন ততই বাড়তে থাকে।

একটা সময় ধৈর্য্য হারায় শামীম বানু, ‘আরে! এ কী মুসিবত। সামান্য জায়নামাজ! পুরনো একটা জায়নামাজের জন্য এমন ছেলেমানুষের মতো জেদ করছেন? আপনার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে?’

শামীম যখন বাই-দাদীর ওপর চিৎকার করছিল ঠিক তখনই সদর দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকে সাদাত, সামনের দৃশ্য দেখে হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসে তার। তাহলে কি এতো দিনের শঙ্কাই আজ সত্যি হতে চলেছে? আর কিছু বুঝে ওঠার আগেই হঠাৎ ফ্যাকাসে হয়ে মেঝেতে ঢলে পড়ে বাই-দাদী। জীর্ণ জায়নামাজটা খসে পড়ে হাত থেকে। এক দৌড়ে গিয়ে তাকে বুকে আঁকড়ে ধরে সাদাত, সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য কোন কথা খুঁজে পায় না সে। এক গ্লাস পানি নিয়ে আসে আজীম। দুই-এক চুমুক পানি মুখে নিয়েই অস্থির ভঙ্গিতে সাদাতের দিকে খড়কুটো আঁকড়ে ধরার মতো করে বলে, ‘তুমি তো জানো এটা কোন জায়নামাজ, তাই না?’।

আসলে সাদাতের এটা জানা ছিল না। বাই-দাদী শ্বশুরবাড়ি থেকে ফিরে আসারও দশ বছর পর তারা বাবা-মায়ের বিয়ে হয়েছিল, আর ভাইবোনের মধ্যে তার স্থান ছয় নম্বরে। অতএব এইসব বিয়েশাদীর ব্যাপারে কীভাবে জানবে সে? তবুও নিছকই মাথা দোলায়। ‘আব্বা এটা গুজরাট থেকে নিয়ে এসেছিল আমার বিয়ের জন্য। শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে প্রথম নামাজ পড়েছিলাম এটাতে, আর তারপর, তারপর -’ একটু থেমে আবারও বলে বাই-দাদী, ‘সেদিন মাগরিবের নামাজ পড়ার জন্য জানালার পাশে জায়নামাজটা বিছিয়ে রেখেছিলাম, এমন সময় কে যেন জানালার বাইরে থেকে একমুঠো জুঁই ফুল ছুঁড়ে দেয় ওখানে। আমি তো ভয়ই পেয়ে গিয়েছিলাম। তখনকার দিনে আমাদের ঘরে শুধু কাঁচের চিমনিওয়ালা হারিকেন ছিল। কী করব ভেবে না পেয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখি মানুষটা ওখান দাঁড়িয়ে হাসছে’। কথাগুলো বলতে বলতে যেন অন্য কোনো জগতে ভেসে বেড়াতে থাকে বাই-দাদী, এই দুনিয়া সাথে তার কোনো সংযোগ নাই। তার একান্ত নিজের গল্প। হায় খোদা! গলার কাছে দলা পাকিয়ে আসে সাদাতের। কোন কথা বলতে পারে না সে। যদিও বুকের ভেতর থেকে কেউ সাবধান করছে, তবুও সেই নিষেধ উপেক্ষা করে অভিযোগের চোখে স্ত্রীর দিকে তাকায়। স্থির দাঁড়িয়ে থাকে শামীমও, যেন কোন কিছুই চোখে দেখেনি।

মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকে পুরো পরিবার, সবাই যার যার ভাবনায় মগ্ন। বিবেকের আদালতে দোষী সাব্যস্ত প্রত্যেকে। আচমকা এমন একটা ঘটনা পুরো পরিবারে বিষাদ ডেকে আনে। সবাই নিজের কাছে জবাবদিহি করতে থাকে। জুঁই ফুলের সুবাস যেন হারিয়ে না যায় তাই খুব যত্ন করে ধুয়ে জায়নামাজটা শুকানোর জন্য তারে মেলে দেওয়াই কি ভুল ছিল বাই-দাদীর? নাকি আজীমের ডাক শুনে তাড়াহুড়ো করে মেলে রাখা কাপড়টাকেই বাইক মোছার জন্য পুরনো কাপড় ভেবে নেওয়াটা ভুল ছিল সানার? পুরনো কাপড়গুলোতো এমনই দেখায়। দোষটা বেচারা আজীমেরও না। বহু বছরের পুরনো জায়নামাজটা নষ্ট করার জন্য বুড়ি না আবার তার ছেলেমেয়েদের অভিশাপ দেয়, এমন ভাবনা থেকেই মেজাজ হারায় শামীম বানুর ভেতরের এক ব্যাকুল মা। অতএব, কেউ কাউকে দোষারোপ না করে এই ঘটনায় সবাই স্তব্ধ হয়ে থাকে।

এইসব বিশদ বর্ণনার ধারেকাছে না গিয়ে স্ত্রীর ব্যাপারে নিজের ভাবনাটাই ধরে বসে থাকে সাদাত। এতোদিন যা নিয়ে ভয় পেয়ে এসেছে সেটাই ঘটতে চলেছে ভেবে আবারও বাই-দাদীর সামনের দিনগুলো নিয়ে দুর্ভাবনায় পড়ে। কোনোমতে ওকে একটু সান্ত্বনা দিয়ে ধীর পায়ে ওই ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। বিছানায় শুয়ে পড়ার পরও অনেকটা সময় তার হাতটা ধরে ছিল। জায়নামাজটাকে নিয়ে কী করবে ভেবে না পেয়ে দাগ তোলার জন্য আরো বার কয়েক ধুয়ে শুকানোর জন্য দড়িতে মেলে দিয়ে ভেতরে চলে যায় শামীম বানু।

এই ঘটনা যে খুব সহসাই মিটমাট হয়ে যাবে তার কোন লক্ষণ নাই। বরং ক্রমেই সেটা অদ্ভুত দিকে মোড় নেয়। এর পর পুরোপুরি বদলে যায় বাই-দাদীর রোজকার রুটিন। বাইরের দড়িতে মেলে দেওয়া জায়নামাজটা আর ছুঁয়েও দেখে না। আপনমনে সেখানেই রোদে শুকোতে থাকে ওটা। আগে কখনও এক রাকাত নামাজ ক্বাজা না করলেও, পরের কয়েকদিন নামাজও পড়ে না। নামাজের ওয়াক্ত হলে আশেপাশে কোথাও একটা বাড়তি জায়নামাজ বিছিয়ে রাখে শামীম, কিন্তু সেদিকে ফিরেও তাকায় না বাই-দাদী।

সবসময় হাসিখুশি থাকা মানুষটা ক্রমাগত কাঁদতে থাকে। সেই দুঃখের না আছে কোনো মাত্রা, না কোনো সময়। না আছে কোনো হিসাব-নিকাশ। অবশ্য রোজকার এই কান্নাকাটিতে ছেলেমেয়েদের খুব একটা কিছু যায় আসে না, তবে ভীষণভাবে বিচলিত হয় শামীম বানু আর সাদাত। বাই-দাদীর এই কষ্টের একমাত্র কারণ শামীম বানু সেটা ধরে নিয়ে সেই কষ্ট উপশমে কিছু করতে না পারার যন্ত্রণায় আবারো ভুগতে থাকে সাদাত। ভয়ংকর রকমের এক মৌনতা বেছে নেয়, আর নিজের ভুলের মাশুল হিসেবে সব মনযোগ দেয় বাই-দাদীর দিকে।

বাই-দাদীর এই কান্নাকাটিতে খুব বিরক্ত শামীম বানু। সংসারে এমন উনিশ-বিশ তো হয়েই থাকে, তাই বলে এভাবে তিলকে তাল করার কোন কারণ খুঁজে পায় না সে। একটা নতুন জায়নামাজ তো দিয়েছিল কিন্তু জেদের বশে সেটাও নেয়নি বাই-দাদী। সাদাত যে বাই-দাদীর জেদকে আরো আশকারা দিচ্ছে বুঝতে পেরে ওর সাথে কথা বলা বন্ধ করে দেয় শামীম। কোন জায়নামাজ তাতে কী এসে যায়? নামাজ পড়াটাই আসল কথা। বুড়ো মানুষটার নামাজ পড়াই বন্ধ করে দেওয়ায় ভেতর ভেতর রাগে ফুঁসতে থাকে শামীম বানু, একই সাথে ছেলেমেয়েদের কোন অভিশাপ দেয় কীনা সেই ভয়ও হয় তার। তাই প্রতি ওয়াক্তে ঠিকমতো নামাজ পড়ে ছেলের জন্য দোয়া করতে থাকে। রোজ ফজরের নামাজ শেষে সুরা ইয়াসীন পড়ে আধা কাপ পানিতে ফুঁ দিয়ে খাওয়ায় ছেলেটাকে। গরিব দুঃখী আত্মীয়স্বজনকে চাল, গম, ডাল, ডিম এগুলো বিলি করে। বদনজর থেকে বাঁচানোর জন্য একটা কালো মুরগী কিনে এনে আজীমের অজান্তে ওর মাথার চারপাশে ঘুরিয়ে ওটাকে উড়িয়ে দেওয়া হয়। তারপরও মনে শান্তি আসে না, ছেলের হিতসাধনে পরপর তিনদিন রোজা রাখে।

এসবে কিছুই যায় আসে না বাই-দাদীর, সে কেবল এক নাগাড়ে কাঁদতেই থাকে। কে জানে কতদিন ধরে বয়ে বেড়ানো বেদনাগুলো জমে পাথর হয়ে তাকে এমন বিমুখ করে তুলেছে? ইদানীং প্রায়ই একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সরাসরি খোদার কাছে নিজেকে সঁপে দেয়, ‘আল্লাহ্, আল্লাহ্, তুমি আমাকে রহম করো আল্লাহ’। আর এটা দেখেই ধৈর্যের শেষ বিন্দুটা হারায় শামীম বানু।

ছেলেমেয়েরা শত চেষ্টা করেও বাই-দাদীর মনের ব্যথা দুর করতে পারে না। বোনদের সাথে শলাপরামর্শ করে জায়নামাজটা ড্রাই ক্লিনিংয়ে নিয়ে যায় আজীম। তাতে সব দাগ উঠে গেলেও সেটা আরো জীর্ণ হয়ে পড়ে। ভয় পেয়ে আবারো আগের জায়গায় টাঙিয়ে দিয়ে চলে আসে, এটা নিয়ে আর নতুন কোন বিপদে পড়তে চায় না সে।

এভাবে প্রায় পনের থেকে বিশ দিন এই জায়নামাজের ঘূর্ণিপাকে ঘুরতে থাকে সাদাতের সংসার। তারপর একদিন আসীমা একটা প্লেটে খাবার আর এক গ্লাস পানি বাই-দাদীর সামনে রেখে বারবার তাকে খাওয়ার জন্য জোর করতে থাকে। বাই-দাদী তখন তার নিজের জগতে বিভোর। আসীমা এক লোকমা নিয়ে তার মুখে তুলে দিলে থু-থু করে থালায় থুথু ফেলে বাই-দাদী চিৎকার করে ওঠে, ‘আল্লাহ্, আল্লাহ্, তুমি রহম করো আল্লাহ’। রান্নাঘর থেকে এসব শুনে মাথায় রাগ চড়ে যায় শামীম বানুর। দৌড়ে এসে এক হাতে বাই-দাদীর ট্রাংকটা নিয়ে অন্য হাতে ওকে ধরে হিড়হিড় করে সদর দরজার কাছে টেনে নিয়ে যায়। আসীমা ওদের দুজনের মাঝখানে এসে মিনতি করে, ‘আম্মি, আম্মি। না, এমন করো না’। শামীম বানু রাস্তা থেকে একটা অটোরিকশা ডাকে, ট্রাংকসহ বাই-দাদীকে জোর করে ওটাতে তুলে দিয়ে ড্রাইভারের হাতে কয়েকটা টাকা গুঁজে দিয়ে আরিফের বাড়িতে পৌঁছে দিতে বলে। তারপর ঝড়ের বেগে বাড়ির ভেতরে ফিরে আসে।

অটো ড্রাইভারটা চেনাজানা, শামীমের অগ্নিমতি চেহারার দিকে একবার তাকিয়েই আর কোন কথা না বলে সোজা আরিফের বাড়ির দিকে রওনা হয়। বাই-দাদীকে দেবরের বাড়িতে চালান করে দিলেও শান্তি জোটে না শামীমের কপালে। যখন তখন কোনো কারণ ছাড়াই ছেলেমেয়েদের বকাঝকা করে। ইচ্ছে করেই নিজের রাগের জ্বালা বয়ে বেড়ায় শামীম, তবে এখন আর আগের মতো আর কোন অনুতাপ হয় না তার। আগের চেয়ে আরো কড়া শাসনের মুখোমুখি হলে এর একটা বিহিত করবে বলে ঠিক করে ছেলেমেয়েরা। সময় সুযোগ পেলেই আরিফের বাড়িতে গিয়ে বাই-দাদীর সাথে কথা বলার চেষ্টা করে তারা। বুঝতে পারে বাই-দাদী ওখানে একটু ভালো আছে। এখন সে খাওয়াদাওয়া করছে আর আবার আগের মতোই ওয়াক্ত ধরে ধরে নামাজও পড়ছে।

আরো দিন পনের পরে বাই-দাদীকে অটো রিকশায় করে বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে আসে আজীম। চেয়ে চেয়ে দেখলেও মুখ ফুটে কিছুই বলে না শামীম। মায়ের চেহারায় একটা শান্ত ভাব দেখে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে আজীম, হয়তো রাগটা কমে এসেছে। ট্রাংক সহকারে বাই-দাদীকে ভেতরের দিকের একটা ঘরে নিয়ে গিয়ে তুলে সে। কিন্তু হায় রে কপাল! আবারও বাই-দাদীর আচার আচরণ বদলে যেতে থাকে। দেখা যায় ফজরের নামাজ পড়তে বসে দুপুর অব্দি ওখানেই ঠাঁয় বসে আছে, পাঁচ ওয়াক্তের কোন নামাজ পড়বে কিংবা কোন সুরা তেলাওয়াত করবে কিছুই মনে নাই তার। অনেক সময় খেয়ে উঠেই খোদার কাছে বিলাপ করতে শুরু করে, ‘আল্লাহ, ওরা আমাকে খেতেও দিল না! তুমি রহম করো আল্লাহ …’। আবারও সমস্যা বাড়তে থাকে।

এভাবে হাত পা গুটিয়ে বসে থাকার কোন মানে নেই, এর একটা সুরাহা করতে হবে, ভাবে আজীম। শামীম বানু তখন বাইরে ছিল। আর সাদাতও যথারীতি বাইরে। দুই বোনকে নিয়ে মিটিংয়ে বসে আজীম। স্বভাবসুলভ দুষ্টুমিতে মেতে ওঠে সানা। খাওয়াদাওয়া ছাড়া আবার মিটিং হয় নাকি? ভাইকে হুমকি দেয়, রাস্তার মোড় থেকে পানিপুরি এনে দিলেই কেবল মিটিংয়ে বসবে, আর না দিলে সবকিছু মায়ের কাছে গিয়ে বলে দিবে। অতএব মিটিং শুরুর আগেই মুলতুবি করে বাইরে থেকে চিকেন কাবাব আর পেপসি নিয়ে আসে আজীম। এবার সানা খুশি। কাবাবের প্লেটটা ভাইবোনদেরকে এগিয়ে দিয়ে আসীম চিকেনটা মুখে দিবে ঠিক এমন সময় ওই ঘরে এসে ঢোকে বাই-দাদী। আজীম মজা করে বলে, ‘আরে, সভাপতিকে ছাড়া মিটিং হবে কীভাবে?’ তারপর একটুখানি সরে গিয়ে নিজের পাশে তাকে বসার জায়গা করে দেয়। বাই-দাদীকে চিকেন দিবে কীনা সেই ভাবনায় বোনদের দিকে তাকায়। ওদের এই চোখচাওয়াচাওয়ি দেখে কোনো কিছু না বলেই তার দিকে এক গ্লাস কোল্ড ড্রিংক এগিয়ে দিয়ে খাওয়ার জন্য জোরাজুরি করতে থাকে সানা। বাই-দাদী গ্লাসে চুমুক দিলে অবাক হয়ে সবাই সেদিকে তাকিয়ে থাকে এক দৃষ্টিতে। এক ঢোঁকে পুরোটা খেয়ে ফেলে সে।

জীভ দিয়ে ঠোঁট মুছে আজীমের গ্লাসের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করে, ‘কী এইটা?’। আজীম জবাব দেওয়ার আগেই সানা দুষ্টুমি করে বলে, ‘মাথায় চড়ে গেছে তাহলে! এটা আব-এ-কাওসার’, তারপর হাসিতে ফেটে পড়ে। অবশ্য অন্য দু’জনের এমন তামাশা একেবারেই ভালো লাগেনি। বাই-দাদীর চোখ চকচক করে ওঠে, ‘আব-এ-কাওসার? আসলেই? ওটা নাকি শুধু বেহেশতেই পাওয়া যায়?’।

‘হ্যাঁ, হ্যাঁ এটাই সেই বেহেশতের পানি। সবার কপালে জোটে না। তুমি এখন বেহেশতে। আর আমরা তোমার সেবাদাসী হুর’। নাটকীয় গলায় সানা এসব কথা বললে দ্বিধায় পড়ে যায় বাই-দাদী।

‘আমি যদি বেহেশতে থাকি, তাহলে সেই মানুষটা কোথায়?’। দুষ্টুমি থামে না সানার। নিজের চুলে বাঁধা কয়েকটা জুঁই ফুল খুলে বাই-দাদীর পেছন থেকে তার কোলে ছুঁড়ে দিয়ে বলে, ‘তোমার পেছনেই আছে, এই দেখ তোমার দিকে জুঁই ফুল ছুঁড়ে দিচ্ছে। পেছন ফিরে তাকানো যাবে না কিন্তু’। মন ভরে যায় বাই-দাদীর। পেছনে না তাকিয়েই ইতস্ততঃ করে কোলের জুঁইফুলগুলো ছুঁয়ে দেখে। একটু থেমে আবার বলে, ‘আব-এ-কাওসার চাই’। এসব কথাবার্তা শুনে যদিও সানাকে মানা করেনা আজীম, আবার রাগও হয় না। বুঝে উঠতে পারে না, এই যে বাই-দাদীকে এমন খুশিখুশি দেখাচ্ছে সেটা কি আসল নাকি সে-ও সানার মতোই দুষ্টুমি করছে। কী আনন্দের সাথে গ্লাসে চুমুক দিচ্ছে এখন।

ঠিক এমন সময় দরজার কলিংবেল বাজে। প্লেট আর গ্লাসগুলো নিয়ে এক দৌড়ে রান্নাঘরে চলে যায় আসীমা। হাত-মুখ মুছে চুপচাপ বসে থাকে সবাই। এমনকি আজীমও ভয়ে ভয়ে দরজার দিকে তাকায়। শামীম বানু বাড়ি ফিরে আসলে তাদের সব নাটকের অবসান ঘটে।

তবে ‘আব-এ-কাওসার’ খেয়ে বাই-দাদীর অনেক সমস্যা উধাও হয়ে যায়। একজন বেহেশতবাসীর আর কীই বা সমস্যা থাকতে পারে? স্বামীকে দেখতে পেয়েছে, তাকে অনুভব করতে পেরেছে, ঘরে বসেই বেহেস্তি শান্তি খুঁজে পেয়েছে। সেই ড্রিংক খাওয়ার পর থেকে স্বর্গের দুনিয়া থেকে আর বাস্তবে ফিরেনি সে। সানা বুঝে উঠতে পারে না, কোনো রকম অ্যালকোহল না থাকলেও কীভাবে কারো এমন নেশা হতে পারে? এরপর থেকে বাই-দাদী প্রায়ই ‘আমার হুরগুলো কোথায়?’ বলতে বলতে চারপাশে তাকায়, শামীম বানু কিছুতেই বুঝে উঠতে পারে না কাকে খুঁজছে মানুষটা। তবে সে কোনো কারণে বাইরে গেলেই সানা আবারও হুর সাজে। সেজন্য অবশ্য তাকে জরি-চুমকি খচিত কোনো ঝলমলে শাড়ি গায়ে জড়াতে হয়, কারণ বাই-দাদীর কল্পনায় বেহেশতের হুররা যে এমনই। এভাবে না সাজলে বাই-দাদীর ভালো লাগে না, উল্টো রেগে যায়।

এই বেহেস্তি সুরা আর ব্যক্তিগত হুর দর্শনের ভেতর দিয়ে পার্থিব দুনিয়ার সাথে সব সংযোগ হারিয়ে ফেলে বাই-দাদী, স্বামীর সান্নিধ্যে প্রশান্তিতে দিন যাপন করতে থাকে। বাই-দাদীকে এমন আপনমনে কথা বলতে, হাসতে দেখে বিরক্তই হয় শামীম বানু, তবে অন্য ঝামেলাগুলো নেই বলে বরং হাঁফ ছেড়ে বেচেছে। আর কখনও তাকে আরিফের বাড়িতে ফেরত পাঠানোর চেষ্টাও করেনি। শামীম যে বাই-দাদীকে আর কখনও বাড়ি থেকে বের করে দিবে না সেটা বুঝতে পেরে সাদাতের মনটাও স্থির হয়ে ওঠে।

সমস্যা এখন কেবল আজীমের। কোনো রকম ভাবনা-চিন্তা ছাড়াই বেহেশতের যে কাহিনী শুরু হয়েছিল সেটা টেনে নিয়ে যেতে হয় তাকে। আর কোন রাগ, কান্না কিংবা জেদ নাই বাই-দাদীর। তবে খাবার খায় না। ‘আব-এ-কাওসার’ ছাড়া যেন আর কোনো কিছু দরকার নাই। এদিকে ‘আব-এ-কাওসার’ এর যোগান দিতে দিতে হয়রান হয়ে যায় আজীম। যখন খুশি তখন এই ‘বেহেশতি অমৃতরস’ চেয়ে বসে বাই-দাদী। ডাবের পানি, জুস কিংবা অন্য যে কোনো ড্রিংক দিলে সোজা ছুঁড়ে ফেলে দেয়। তার এই জীভের স্বাদ আর মনের শান্তি জোগাতে গিয়ে আজীমের হাতখরচের সব টাকা উজাড় হয়ে যাচ্ছে। সারাক্ষণ এক নাগাড়ে ‘আব-এ-কাওসার’ এর কথা বলতে থাকে, এমনকি শামীম বানু আর সাদাতের সামনেও। তাতে ওরা ধরেই নেয় বাই-দাদীর মাথাটা খারাপ হয়ে গেছে।

টানাটানিতে পড়ে বন্ধুদের কাছ থেকেও টাকা ধার করে আজীম। এমনকি মুদির দোকানে সংসারের খরচের খাতায় কিছু এদিক-সেদিকও করতে হয় তাকে। তারপরও আর কোনো উপায় না পেয়ে একদিন আরিফের কাছে গিয়ে সমস্ত ঘটনা খুলে বলে। সব শুনে হাসিতে ফেটে পড়ে চাচা, মিছেমিছি রাগে কয়েকবার ওর পিঠে চাপড় দিলেও রোজ এক বোতল করে কোল্ড ড্রিংকের বন্দোবস্ত করে দেয়। আর সেই বেহেস্তি পানির কারণে গোটা বাড়ি জুড়ে শান্তি নেমে আসে।

আজীমের ভয় হয়, কোনো খাবার না খেয়ে শুধু কোল্ড ড্রিংক খাওয়ার কারণে যদি মারা যায় বাই-দাদী? অবশ্য ওর ভয়কে মিথ্যে করে দিয়ে বাই-দাদী এভাবেই বেঁচে আছে গত ছয়মাস ধরে। শামীম বানু বিস্ময়ে হতবাক। বুঝে উঠতে পারে না কীভাবে এই বুড়ো মানুষটা কোনো খাবার না খেয়ে বেঁচে আছে শুধু পানি খেয়ে? জায়নামাজের ঘটনা ভুলে গিয়ে স্ত্রীর কথা ভেবে নিজের মনকে বুঝানোর চেষ্টা করে সাদাত, ‘বেচারি শামীম, মেয়েটা ভালো। তবে ওই মেনোপজের জ্বীন সওয়ার হলেই উল্টোপাল্টা কাজকর্ম করে’। শুধু আজীম আর আরিফ মাঝেমধ্যে বাই-দাদীর মৃত্যুর কথা ভাবে, অবশ্য সেটা যেন খাবারের অভাব থেকে না হয়। তার স্বাভাবিক মৃত্যু না হলে খুনের দায় এড়াতে পারবে না ওরা। তবে বাই-দাদী তার এই হঠাৎ পাওয়া নন্দনকাননে পরম প্রশান্তিতে বাস করতে থাকে কালস্রোতে হারিয়ে যাওয়া প্রাণের মানুষটার সাথে।

নোট:

চিক্কাপ্পা: কন্নড় ভাষায় চাচা (বাবার ছোটভাই), খালু ইত্যাদি সম্বোধন

বাই-দাদী: পিতামহী বা দাদীকে বাই যুক্ত করে সম্মানসূচক সম্বোধন, উত্তর কর্ণাটক এবং কন্নড়ী ভাষাভাষীদের মধ্যে প্রচলিত

সারু: বিভিন্ন সব্জির সাথে ডাল বা নারিকেল দিয়ে তৈরি হয় সাম্বার, কন্নড় ভাষায় সাম্বারকে সারু বলা হয়

জারাতারি: হাতে বোনা রেশম সুতোর শাড়ি

আসাদুল লতিফ

লেখক ও অনুবাদক।
প্রকাশিত অনূদিত উপন্যাস: হান ক্যাং-এর “দ্য হোয়াইট বুক” (২০২৫); আব্দুলরাজাক গুরনাহ’র “মেমোরি অব ডিপারচার” (২০২৪); সাতোশি ইয়াগিসাওয়া’র “মোর ডেইজ অ্যাট দ্য মরিসাকি বুকশপ” (২০২৪)। ছোটগল্প: হারুকি মুরাকামি’র “শেহেরজানের অসমাপ্ত গল্প” (২০২৩); বিভিন্ন লেখকের “কিছু বিষাদ উপাখ্যান” (২০২১)। কবিতা: “আরাধ্য সময়” (২০২০)। জন্ম ১৯৭৯ রাজশাহীতে। ঢাকায় কাজ করছেন বেসরকারি ব্যাংকে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ভাষা
Scroll to Top