পাগলামি (Madness) এবং বাগ্মিতা (Rhetoric)—এই দুই ধারণা মানব সভ্যতার প্রান্তরেখা বরাবর বিস্তৃত দুটি অভিব্যক্তি। একদিকে পাগলামি মানসিক, রাজনৈতিক, ও সাংস্কৃতিক ব্যবস্থার ছাপ ফেলে এমন এক অন্তর্বাস্তব অভিজ্ঞতা, যা কখনো দমনযোগ্য বিকার, আবার কখনো বিপ্লবী সম্ভাবনা। অন্যদিকে রেটোরিক্স—ভাষার এমন এক চর্চা, যা যুক্তি, আবেগ ও আস্থা (logos, pathos, ethos) এর মাধ্যমে ক্ষমতার কাঠামো নির্মাণ করে, আবার দেরিদা একে দেখেছেন অন্যভাবে, আরো নানানভাবে চাইলেই আমরা একে দেখতে পারি। তবে নিশ্চিতভাবে,এই দুই সত্তা একে অপরের ছায়া হয়ে ওঠে, কখনো সংঘাতে, কখনো সমান্তরালে। ধারণার দিকে তাকালে দেখা যাবে তা ভাষার অভ্যন্তরীণ দ্ব্যর্থকতা ও অসঙ্গতিগুলোকে উন্মোচন করে। দেরিদা দেখান, কীভাবে ভাষা নিজেই এক ধরনের বিভাজন তৈরি করে—যেখানে প্রতিটি শব্দের মধ্যে এমন কিছু থাকে যা ভাষার নিয়মিত কাঠামোর বাইরের। এইভাবে, ভাষা এবং পাগলামির মধ্যে একটি অমীমাংসিত সম্পর্ক তৈরি হয়। Derrida-এর মতে, পাগলামি একটি “non-language,” যা রেটোরিক্সের মাধ্যমে ধরা যায় না, কিন্তু যা ক্ষমতার বিরুদ্ধে একটি মৌলিক প্রতিবাদ হয়ে ওঠে।
এখানে ভাষাহীন প্রতিবাদ (protest without language) গুরুত্বপূর্ণ। যখন কোনো ব্যক্তি প্রতিষ্ঠিত ভাষার ব্যবস্থায় নিজেকে প্রকাশ করতে অক্ষম হয়, তখন সে এক ধরনের নীরব রেটোরিক্স তৈরি করে—যা সমাজের প্রচলিত মানসিকতা ও শাসনের বিরুদ্ধে এক ধরনের চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেয়। দেরিদা-এর ভাষ্য অনুসারে, পাগলামি ও রেটোরিক্সের সম্পর্ক জটিল—এটি কেবল ক্ষমতার ও ভাষার বিরুদ্ধে এক ধরনের প্রতিরোধ নয়, বরং এরা একে অপরকে নির্ধারণও করে। দেরিদা নিয়ে আরো বিস্তর আলাপ একটু পরেই আসছে।
পাগলামি ও ভাষার দ্বন্দ্বময় সহাবস্থান
প্রাচীন গ্রিসে ‘পাগলামি’ ও ‘ঈশ্বরিক উন্মাদনা’:
সক্রেটিস তাঁর ডায়ালগে পাগলামিকে দৈব অনুপ্রেরণার রূপে ব্যাখ্যা করেন—“divine madness”—যা প্রেম, কাব্য, ভবিষ্যদ্বাণী এবং ধর্মীয় উত্তরণের উৎস। প্লেটোর Phaedrus-এ রেটোরিক্স এবং ম্যাডনেস পাশাপাশি দাঁড়ায়: একদিকে রেটোরিক্স হলো সংগঠিত যুক্তি ও ভাষার শিল্প, অন্যদিকে ম্যাডনেস হলো অভ্যন্তরীণ, নিয়ন্ত্রণহীন ভাষার বিস্ফোরণ, যার মধ্যে এক ধরণের পরাবাস্তব সত্য নিহিত। পাগলামি তাই ভাষার সীমানা ছাড়িয়ে, এক ধরনের রেটোরিক—a rhetoric beyond rhetoric—নির্মাণ করে।
মধ্যযুগের ক্ষমতা ও পাপতত্ত্বে ম্যাডনেস
খ্রিস্টান মধ্যযুগে পাগলামি ছিল শয়তানী শক্তির প্রভাবে আকৃষ্ট বিকার। চার্চের চোখে পাগল ব্যক্তি ছিল ঈশ্বরবিচ্যুত, ধর্মচ্যুত। Exorcism, penitence, এবং isolation ছিল ক্ষমতা চর্চার রূপ। এ সময়ের রেটোরিক্সও ধর্মীয়; যাজকের ভাষা ঈশ্বরের ভাষা—আর যারা সেই ভাষার বাইরের, তাদের বাক্যকেই ধ্বংস বা দমন করতে হয়েছে।
ফুকোর পাঠ: জ্ঞান, প্রতিষ্ঠান ও পাগলামির রাজনীতি
মিশেল ফুকো তাঁর Madness and Civilization-এ দেখান, কীভাবে আধুনিক রাষ্ট্র পাগলামিকে চিকিৎসাশাস্ত্রের ভেতর দিয়ে নিয়ন্ত্রণের উপযোগী করে তোলে।

দারিদা (১৯৩০-২০০৪)
এখানে মনোরোগবিদ্যা (psychiatry) একটি disciplinary regime হিসেবে কাজ করে। হাসপাতাল, আদালত, বিদ্যালয়—সবখানেই নির্দিষ্ট রেটোরিক্সের মাধ্যমে ‘স্বাভাবিক’ ভাষা এবং ‘পাগলের’ ভাষাকে আলাদা করা হয়। ফুকোর মতে, পাগলদের কণ্ঠরোধ করা হয়নি কেবল, বরং তাদের অভিজ্ঞতাকে “unreason” হিসেবে ছুঁড়ে ফেলা হয়েছে ইতিহাসের গহ্বরে। ফুকোর মতে, আধুনিক রাষ্ট্র পাগলামিকে যেভাবে মনোরোগ চিকিৎসার মধ্য দিয়ে দমন করে, তা একধরনের রেটোরিক্যাল ক্ষমতা প্রয়োগ। “Discursive exclusion” নামক কৌশলের মাধ্যমে পাগলদের ভাষাহীন করে তোলা হয়—তাদের অভিজ্ঞতা ও বোধকে “অযৌক্তিক” আখ্যা দিয়ে সমাজচ্যুত করা হয়। এখানে পাগলামি আর নিছক ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা নয়—এটি একটি রাজনৈতিক শ্রেণিবিন্যাস, যেখানে ভাষা, চিকিৎসা ও রাষ্ট্র একযোগে কাজ করে। রাষ্ট্র যখন কাউকে “পাগল” বলে চিহ্নিত করে, তখন সে ব্যক্তি একই সঙ্গে সমাজের গণ্ডি থেকে বেরিয়ে আসে এবং নিজেকে একটি নতুন শাসক চক্রের সামনে আবিষ্কার করে। এটি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার রেটোরিক্সের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক—যেখানে পাগলামি শাসনকারী শক্তির কাছে ‘অনিয়ম’ হিসেবে পরিচিত, কিন্তু ঐতিহাসিকভাবে একে রাজনৈতিক অবিচারের প্রতিবাদ হিসাবে ব্যবহার করা হয়েছে।

মিশেল ফুকো (১৯২৬-৮৪)
রেটোরিক্স: ভাষার শাসন ও প্রতিরোধ
রেটোরিক্স প্রাচীনকাল থেকেই ক্ষমতার ভাষা। অ্যারিস্টটলের মতে, এটি একটি শিল্প, যা যুক্তিকে প্রয়োগ করে শ্রোতাকে প্রভাবিত করে। কিন্তু আধুনিক চিন্তায় রেটোরিক্স কেবল আর ভাষার কৌশল নয়; এটি হলো ক্ষমতার ভাষিক অস্ত্র। হিটলারের ভাষণ, গিবেলসের প্রচার, বা ট্রাম্পের পপুলিস্ট বক্তব্য—সবই রেটোরিক্সের মাধ্যমে সত্য নির্মাণের দৃষ্টান্ত।
তবে রেটোরিক্স শুধু রাষ্ট্রের নয়; প্রতিরোধেরও। নাগরিক অধিকার আন্দোলন, ঔপনিবেশিক বিদ্রোহ, নারীবাদী ভাষ্য—all used rhetoric to break language from within.
পাগলামি: প্রতিবাদের অবচেতনে রেটোরিক্স
নিটশে বলেছিলেন, “যে সত্য সমাজ গ্রহণ করতে পারে না, তাকেই উন্মাদ বলে।”
এই উক্তি আমাদের জানায়—পাগলামি কোনো বাস্তবিক ‘বিকার’ নয় বরং একটি ভাষাবহ নিপীড়নের ফাঁদ। যারা প্রতিষ্ঠিত রেটোরিক্সে অংশ নিতে অস্বীকৃতি জানায়, তারাই সমাজে ‘পাগল’ বলে চিহ্নিত হয়।
সিলভিয়া প্লাথ, আন্তনাঁ আর্তো, বা জ্যঁ জেনে’র মতো লেখকদের ভাষা ছিল এক ধরনের mad utterance, যা প্রচলিত ভাষার কাঠামো ভেঙে একটি নতুন বাক্যতন্ত্র তৈরি করে।
শিল্প ও ম্যাডনেস: ভ্যান গঘ থেকে সিলভিয়া প্লাথ
ইতিহাসে বহু শিল্পী ও কবি পাগলামির মধ্যে দিয়ে সৃষ্টিশীলতার চরম শিখরে পৌঁছেছেন। ভিনসেন্ট ভ্যান গঘ-এর চিত্রকলা বা সিলভিয়া প্লাথ-এর কবিতা, পাগলামিকে এক ধরনের সৃষ্টিশীল ভাঙনের রূপ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে। এদের সৃষ্টিকর্মের ভাষা ছিল এমন এক রেটোরিক্স, যা প্রচলিত যুক্তিবোধকে অস্বীকার করে, নতুন অভিজ্ঞতার দরজা খুলে দেয়। এ প্রসঙ্গে Nietszche-এর উক্তি প্রাসঙ্গিক: “One must still have chaos in oneself to be able to give birth to a dancing star.”
লুডভিগ উইটজেনস্টাইন প্রায়ই তাঁর ভাষাতত্ত্বে পাগলামির ধারণাকে ছুঁয়েছেন—”যা বলা যায় না, তা নিয়ে নীরব থাকা উচিত”—এই বিখ্যাত উক্তি আমাদের শেখায় যে ভাষার সীমা মানে বোধের সীমা, আর সে সীমা ভাঙতে গেলে যে ভাষা উৎপন্ন হয়, তা-ও পাগলামির মতো শোনায়।
অন্যদিকে, অঁতোয়ান আরতো তাঁর “Theatre of Cruelty” তত্ত্বে পাগলামিকে একধরনের পারফর্মেটিভ মুক্তি হিসেবে দেখেছেন। তিনি মনে করতেন, দর্শকদের “বিপন্ন” না করলে সত্যের মুখোমুখি আনা যায় না।
আধুনিক কবিতায় পাগলামির রূপ বিশেষভাবে স্পষ্ট। অ্যালেন গিন্সবার্গের Howl একটি পাগল চিৎকারের মতো, যা আমেরিকার ভণ্ড সভ্যতাকে ছিঁড়ে ফেলে।
আমরা দেখেছি পাগল চরিত্রগুলো গভীর রাজনৈতিক ও নৈতিক সত্য উচ্চারণ করে, যা সাধারণ ভাষার মধ্যে ধরা পড়ে না। পাগলামি এখানে এক ধরনের “critical distance” তৈরি করে—যেখান থেকে সমাজকে নতুন করে দেখা যায়। এদের ভাষা অগোছালো হলেও, তার মধ্যে থাকে এক অন্যরকম স্পষ্টতা—যা রেটোরিক্সের অলিখিত নীতি ভেঙে দেয়।

সিলভিয়া প্লাথ (১৯৩২-৬৩)
পাগলামি ও ভাষার অসামঞ্জস্য: Derrida ও ভাষাহীন প্রতিবাদ
দার্শনিক জ্যাঁ দেরিদা তাঁর ‘Writing and Difference’ গ্রন্থে যুক্তি দেন যে, পাগলামি হলো এমন এক অবস্থা, যা ভাষা দ্বারা সম্পূর্ণরূপে প্রকাশযোগ্য নয়। এটি এক ধরনের “অবচেতন রেটোরিক্স”—যেখানে চিৎকার, নীরবতা, অস্বাভাবিক আচরণ নিজেই একটি ভাষা হয়ে ওঠে। Derrida-এর মতে, ফুকো পাগলামিকে ইতিহাসের নির্দিষ্ট কাঠামোর মধ্যে ধরতে চেয়েছেন, কিন্তু পাগলামির প্রকৃত অভিব্যক্তি ধরা পড়ে না কোনো ঐতিহাসিক রেটোরিক্সে। এই আলোচনা আমাদের সামনে প্রশ্ন তোলে: রেটোরিক্স কি কেবল বাক্যগঠন? নাকি ভাষাহীনতার মধ্যেও একটি গভীর প্রতিবাদ লুকানো থাকে? জ্যাঁ দেরিদার (Jacques Derrida) ধারণায় “অবচেতন রেটোরিক” (অথবা ভাষার বাইরের যে রেটোরিক) একটি গভীর দার্শনিক প্রস্তাব, যা ভাষা, অর্থ, এবং ক্ষমতার প্রচলিত কাঠামোকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। এটি বুঝতে হলে প্রথমে দেরিদার ডিকনস্ট্রাকশন (Deconstruction) এবং লোগোসেন্ট্রিজম (Logocentrism)-এর সমালোচনা বুঝতে হবে।
ডিকনস্ট্রাকশন ও ভাষার সীমা
দেরিদার মতে, পাশ্চাত্য দর্শন “লোগোসেন্ট্রিক”—অর্থাৎ, এটি ভাষাকে যুক্তি (Logos), স্বচ্ছতা, এবং স্থিতিশীল অর্থের মাধ্যম হিসেবে দেখে। কিন্তু দেরিদা বলেন, ভাষা কখনোই সম্পূর্ণ স্বচ্ছ বা স্থির নয়; এটি অস্থিরতা (Différance), অনুল্লেখ্যতা (Trace), এবং দ্বন্দ্বে পরিপূর্ণ। পাগলামির ভাষা এই লোগোসেন্ট্রিক কাঠামোকে ভেঙে দেয়, কারণ এটি যুক্তির বাইরে গিয়ে অবচেতনের (unconscious), অযৌক্তিকের, বা অভিব্যক্তির জগতে প্রবেশ করে। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে, একজন পাগলের কথায় হয়তো প্রচলিত ব্যাকরণ বা যুক্তি নেই, কিন্তু তা একটি “অন্য রেটোরিক” তৈরি করে—যা দেরিদার মতে, “লিখন (Writing)” -এর একটি রূপ (যেখানে ভাষা স্থির নয়, বরং অনির্দিষ্ট ও বহুমুখী)।
অবচেতন রেটোরিক কী?
দেরিদার জন্য, “অবচেতন রেটোরিক” হলো সেই ভাষিক ক্রিয়া যা:
যুক্তি-বহির্ভূত: প্রচলিত রেটোরিক্স (যুক্তি, আবেগ, নৈতিকতা—Aristotle-এর Logos, Pathos, Ethos) থেকে সরে গিয়ে কাজ করে।
অস্পষ্টতা ও অনুল্লেখ্যতা (Trace): পাগলামির ভাষায় অর্থ সম্পূর্ণ ধরা দেয় না, বরং তা অস্তিত্বহীন (Absent) এবং খণ্ডিত।
প্রতিষ্ঠান-বিরোধী: এটি রাষ্ট্র, চিকিৎসাবিজ্ঞান, বা ধর্মের মতো প্রতিষ্ঠানের “ডিসকোর্সিভ কন্ট্রোল”-কে অমান্য করে।
উদাহরণ যদি দেই, আন্তোনাঁ আর্তো (Antonin Artaud)-এর “থিয়েটার অফ ক্রুয়েলটি”-তে শব্দ, চিৎকার, এবং দৈহিক অভিব্যক্তি প্রচলিত নাট্যরীতিকে ভেঙে দেয়। এটি একটি “অবচেতন রেটোরিক”, যেখানে ভাষার বাইরের শব্দও অর্থ বহন করে। সিলভিয়া প্লাথ-এর কবিতায় আত্মধ্বংসের ইমেজগুলো প্রচলিত যুক্তিকে অতিক্রম করে একটি “অন্য সত্য” প্রকাশ করে।
ফুকো বনাম দেরিদা
ফুকো বলেন, পাগলামিকে ইতিহাসের নির্দিষ্ট কাঠামোয় “ডিসকোর্স” দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে (যেমন: মধ্যযুগে ধর্ম, আধুনিক যুগে মনোরোগবিদ্যা)। দেরিদা এটিকে আরও গভীরে নিয়ে যান: তিনি বলেন, পাগলামির ভাষা ডিসকোর্সের বাইরে থাকে, কারণ তা “লিখন”-এর একটি রূপ যা প্রতিষ্ঠানের ভাষায় ধরা দেয় না। অর্থাৎ, ফুকোর বিশ্লেষণে পাগলামি একটি “ডিসকোর্সিভ এক্সক্লুশন” (বর্জনের ভাষা), কিন্তু দেরিদার মতে এটি “ডিসকোর্সেরই অভ্যন্তরীণ বিপ্লব”—যেখানে ভাষা নিজেই নিজেকে ধ্বংস করে।
অবচেতন রেটোরিকের রাজনীতি এর রাজনৈতিক তাৎপর্য হলো প্রতিবাদের ভাষা। যখন প্রতিষ্ঠিত রেটোরিক্স (যেমন: রাষ্ট্রের ভাষা, মিডিয়া) সত্যকে নিয়ন্ত্রণ করে, তখন পাগলামির মতো “অযৌক্তিক” ভাষাই হয়ে ওঠে প্রতিরোধের হাতিয়ার।
– উদাহরণ: ফ্রানৎস ফানোঁন-এর The Wretched of the Earth-এ ঔপনিবেশিকদের কাছে আদিবাসীদের প্রতিবাদ “অসভ্য” বা “পাগলামি” বলে চিহ্নিত হয়েছিল।
শিল্পে বিপ্লব ও এর আরেকটি তাৎপর্য,শিল্পীরা যখন প্রচলিত শৈলী ভাঙেন (যেমন: জেমস জয়েস-এর ফিনিগ্যানস ওয়েক), তখন তা একটি “অবচেতন রেটোরিক” তৈরি করে, যা পাঠককে নতুনভাবে চিন্তা করতে বাধ্য করে।
দেরিদার তত্ত্বে ভাষার অর্থ কখনোই স্থির নয়, তাই “অবচেতন রেটোরিক”-কেও নির্দিষ্ট সংজ্ঞায় বাঁধা যায় না। যদি পাগলামির ভাষা সম্পূর্ণই “অবচেতন” হয়, তাহলে তা কীভাবে সামাজিক পরিবর্তন আনতে পারে? ফুকো বলবেন, পাগলামিও একটি ডিসকোর্সের অংশ, কিন্তু দেরিদা এটিকে ডিসকোর্সের বাইরের কিছু বলে দেখেন।
দেরিদার “অবচেতন রেটোরিক” হলো ভাষার সেই রূপ যা যুক্তি, প্রতিষ্ঠান, এবং অর্থের প্রচলিত কাঠামোকে ভেঙে দেয়। এটি শুধু “পাগলামি” নয়, বরং সকল প্রান্তিক কণ্ঠস্বরের একটি দার্শনিক হাতিয়ার—যেখানে নীরবতা, চিৎকার, বা কবিতার পংক্তি ও সমাজের কাছে একটি নতুন সত্য উন্মোচন করে। এটি ডিকনস্ট্রাকশনের চূড়ান্ত প্রকাশ: “যা বলা যায় না, তা-ই বলার চেষ্টা।”
উপনিবেশ, পাগলামি এবং প্রতিরোধের রূপক
ঔপনিবেশিক শাসকের চোখে, প্রতিবাদকারীর ভাষা ছিল বিকৃত, ‘অযৌক্তিক’। ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনে অনেক বিপ্লবীকে উন্মাদ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল। বাঘা যতীন থেকে সূর্য সেন—তাদের মৃত্যু, বন্দিত্ব ও বিচারের ভাষা ছিল রেটোরিক্যাল নির্মাণ। এবং সেই নির্মাণের মধ্যেই গোপনে জেগে থাকত ম্যাডনেসের প্রতিকথন—স্বাধীনতার ভাষা, যা বুলেট নয়, শব্দে বিদ্রোহ করত।
ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকরা ভারতীয় বিদ্রোহীদের প্রায়ই ‘fanatic’, ‘mad’, কিংবা ‘irrational’ বলে আখ্যায়িত করত। এ ছিল একটি সচেতন রেটোরিক্স—যার মাধ্যমে তারা ভারতীয়দের রাজনৈতিক প্রতিবাদকে অমান্যযোগ্য করে তুলবার অভিপ্রায় করতো।ঔপনিবেশিক শাসকরা বিপ্লবীদের, বিশেষ করে বিপ্লবী নেতাদের “পাগল” বলে চিহ্নিত করেছে। বিশেষত, সুভাষ চন্দ্র বোস, চিত্তরঞ্জন দাশ এবং অন্যান্য নেতাদের প্রতি ঔপনিবেশিক প্রশাসন পাগলামির রেটোরিক ব্যবহার করেছিল।
এই ধারণা ছিল যে, যারা ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন করত, তারা ‘সামাজিকভাবে অস্থির’ এবং তাদের কাজ ছিল ‘অবিশ্বস্ত’। যেহেতু পাগলামি এক ধরনের সামাজিক বিচ্ছিন্নতা এবং শাসনকারীদের নিয়মাবলী থেকে বিরতি, এটি ব্যবহৃত হতো জনগণের মনস্তাত্ত্বিক নিয়ন্ত্রণের জন্য, যাতে জনগণ প্রতিবাদকারীদের ‘পাগল’ হিসেবে গ্রহণ করে এবং তাদের আন্দোলনকে ব্যর্থ হিসেবে দেখার চেষ্টা করা হয়।
আউরঙ্গজেবের সময়কার বহু ‘বিপ্লবীকে’ তাদের “ধর্মীয় উন্মাদনা”র দোহাই দিয়ে পরিহাস করা হয়েছে। এই রেটোরিক্স ছিল পশ্চিমা যুক্তিবাদের মাধ্যমে উপনিবেশ টিকিয়ে রাখার কৌশল। কলম্বাস এর ‘নতুন দুনিয়া আবিষ্কার’ ব্যাপারটিতেও এই প্রবণতা আছে। অন্তত ঔপনিবেশিকতার জন্ম আর সহিংসতা এর ক্ষেত্র হিসেবে প্রবল। লাখ লাখ আদিবাসীকে হত্যা, এটা কি আবিষ্কার? না দখলদারি? ওদের সভ্যতা ধ্বংস, এটা কি শোষণের শুরু নয়? কলম্বাস এর চোখে আদিবাসীরা অসভ্য, অপূর্ন , অথচ নিজেদের জ্ঞান, সভ্যতা নিয়ে তো তাঁরা সম্পুর্ন ছিল। তাহলে কাদের সভ্যতা বৈধ আর কাদেরটা অবৈধ, এই সিদ্ধান্ত কে নেয়?
নারীবাদী পাঠ: HYSTERIA ও নারী পাগলামির রাজনীতি
ঐতিহাসিকভাবে ‘hysteria’ শব্দটি নারীদের পাগলামি বোঝাতে ব্যবহৃত হয়েছে, যার মূল শিকড় গ্রিক শব্দ ‘hystera’ বা গর্ভাশয়। ফ্রয়েডের সময়ে নারীদের আবেগপ্রবণতা ও যৌন আকাঙ্ক্ষাকে ‘hysterical neurosis’ হিসেবে চিকিৎসা করা হতো। এই দৃষ্টিভঙ্গি নারীকে ‘অযুক্তিক’, ‘অসংযমী’, এবং ‘ভাষাহীন’ করে তোলে। অথচ, ফরাসি নারীবাদী লেখিকা Hélène Cixous এই ‘hysteria’-কেই নারীর একটি রাজনৈতিক ভাষা হিসেবে দেখিয়েছেন—যেখানে নারীর দেহ ও আবেগ একধরনের বিপ্লবী রেটোরিক্স হয়ে ওঠে। এবং কী করে সেটি তিনি দেখিয়েছেন এই আলাপ করতে গেলে, আমাদের অন্য বিষয়ে চলে যেতে হবে, সে আরেকদিন হবে।
মার্গারেট থ্যাচারের আমলে পাগলামির রেটোরিক্স
মার্গারেট থ্যাচারের শাসনকালে (১৯৭৯-১৯৯০), যুক্তরাজ্যের সমাজে নব্য-লিবারাল দর্শনের প্রভাব প্রবল হয়ে ওঠে। থ্যাচার একাধারে সামাজিক পদ্ধতির সংস্কারকারী এবং কঠোর শাসক হিসেবে পরিচিত। তাঁর শাসনকালে সরকার কর্তৃক জনসমাজের চাহিদাগুলোর প্রতি নির্দয় মনোভাব প্রকাশ পেয়েছিল, বিশেষ করে শ্রমিক আন্দোলন এবং প্রতিবাদীরা তার বিরুদ্ধে ছিলেন। এ সময় পাগলামির রেটোরিক্স একটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশল হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
থ্যাচার তাঁর রাজনৈতিক বিরোধীদের ‘অবৈধ’, ‘অসামাজিক’ এবং ‘পাগল’ বলে চিহ্নিত করতেন। যখন শ্রমিকরা পেট্রল স্টেশনগুলোতে ধর্মঘট এবং প্রতিবাদ করত, তখন ‘নির্দেশনা’ হিসেবে তাদের পাগল বলা হতো। এই ভাষাগত কৌশল পাগলামির ধারণাকে একটি রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করত, যা বিরোধীদের নৈতিকভাবে দুর্বল করে এবং তাদের আন্দোলনকে সমাজের বিরুদ্ধ শক্তি হিসেবে উপস্থাপন করত। থ্যাচারের নেতৃত্বে ‘পাগলামি’ ছিল শুধুমাত্র মানসিক অবস্থা নয়, বরং একটি রাষ্ট্রীয় বা রাজনৈতিক বৈধতা হারানোর চিহ্নও।
আধুনিক রাজনৈতিক ভাষ্য: পাগল, বিপ্লবী না দেশদ্রোহী?
সমসাময়িক রাজনীতিতে ‘পাগল’ একটি কৌশলগত গালি। কোনো নেতার ভিন্নমতকে ‘রাষ্ট্রদ্রোহ’, কোনো শিল্পীর শব্দকে ‘অসামাজিক’, বা কোনো কর্মীর স্লোগানকে ‘উন্মাদনা’ হিসেবে দাঁড় করানো হয়। এইভাবে পাগলামির ধারণা পরিণত হয়েছে একটি নেতিবাচক রেটোরিক্সে—যা শাসকের ভাষার অভ্যন্তরে প্রতিরোধের শব্দ খতম করতে চায়। উদাহরণস্বরূপ, জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ, এডওয়ার্ড স্নোডেন বা গাজায় নিরীহ বিক্ষোভকারীদের আচরণ প্রায়শই “irrational” বা “mad” বলে রাষ্ট্র ও গণমাধ্যম উপস্থাপন করে। এই রেটোরিক্স ব্যবহারের মাধ্যমে বিরুদ্ধ কণ্ঠস্বরকে ‘ভয়ংকর’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়, এবং তাই তাদের নির্যাতন সমাজে ন্যায়সঙ্গত বলে মেনে নেওয়া হয়।জাতিগত সংখ্যালঘু বা নিম্নবর্গের মানুষদের কণ্ঠ যখন প্রচলিত বয়ানের বাইরে যায়, তখন তাদের “irrational” বা “aggressive” বলে দাগিয়ে দেওয়া হয়। যুক্তরাষ্ট্রে কালো অধিকারকর্মীদের ভাষাকে একসময় “angry black rhetoric” বলে ছুঁড়ে ফেলা হয়েছে। এই রাজনৈতিক রেটোরিক্স ‘পাগল’ বা ‘অসামঞ্জসিকতা’কে একটি শ্রেণিগত ও বর্ণগত নিয়ন্ত্রণের হাতিয়ার বানায়।
মানসিক স্বাস্থ্য, ভাষা, এবং সমাজতাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব
ম্যাডনেস এখনো একটি সামাজিক কলঙ্ক। আধুনিক থেরাপি বা কাউন্সেলিং যেখানে ব্যাক্তির পুনর্প্রতিষ্ঠা করে, সেখানে সমাজ তার ভাষার সীমাবদ্ধতাকে চেপে ধরে। একজন মানসিকভাবে ভিন্নতর অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ব্যক্তি যখন সমাজের সংজ্ঞায়িত ভাষায় কথা বলতে পারে না, তখন তাকে একধরনের speechless existence-এ ফেলে দেওয়া হয়।আজকের অনেক মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ও বুদ্ধিজীবীরা প্রশ্ন তুলছেন—যেসব আচরণকে আমরা মানসিক রোগ বলে দেখি, তার কি সবসময় চিকিৎসার প্রয়োজন? নাকি এটি সামাজিক বিচ্ছিন্নতা, নিপীড়ন, কিংবা প্রতিরোধের প্রতিফলন? Critical Psychiatry Movement দেখায়, পাগলামি মানে সবসময় অসুস্থতা নয়, বরং একধরনের বিকল্প জীবনদর্শন, যাকে সমাজ সহজে মেনে নিতে পারে না।
আধুনিক নগর সভ্যতায় মানসিক স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে একদিকে যতটা বৈজ্ঞানিক বলা হয়, অন্যদিকে তা বুর্জোয়া শৃঙ্খলার অবিচ্ছেদ্য অংশ। শহরের চাপে, প্রযুক্তি নির্ভর বিচ্ছিন্নতায়, বা কর্পোরেট উৎপীড়নে যে মানসিক অবসাদ জন্ম নিচ্ছে, তা অনেক সময় সমাজ পাগলামি বলে চিহ্নিত করছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে—এই পাগলামি কি আসলে অসুস্থতা, নাকি সমাজের নিষ্ঠুরতার প্রতি এক নীরব প্রতিবাদ?
শিশুরা সমাজের কাঠামো শেখার আগে যে ভাষা ব্যবহার করে—তা অনেকটাই পাগলদের ভাষার মতো: অসংলগ্ন, আবেগভিত্তিক, এবং উচ্চারিত যুক্তির বাইরে। জ্যাক লাঁকাঁর মনোবিশ্লেষণে দেখা যায়, এই প্রাথমিক “mirror stage” মানবজীবনের প্রথম রেটোরিক্যাল পরিণতি গঠন করে। ফলে পাগলামি আর শিশুবোধ—দুইই সামাজিক ভাষার আগে ও বাইরে একধরনের বিকল্প চেতনা।
‘পাগল’ হয়ে যাওয়া এক আত্মরক্ষা: বহিরাগত হওয়ার সাহস। অনেক দার্শনিক ও লেখক পাগল হওয়াকে বেছে নিয়েছেন সমাজ থেকে বাঁচার উপায় হিসেবে। আলবের কামুর ‘The Outsider’-এ যেমন মার্সোর আচরণ সমাজের চোখে পাগলামি, কিন্তু বাস্তবে সে এক নির্মোহ, অবিচল চেতনায় পরিচালিত। তাই অনেক সময় পাগলামি হচ্ছে নিজেকে রক্ষা করার সবচেয়ে যুক্তিযুক্ত উপায়।

আলবেয়ার কামু (১৯১৩-৬০)
ম্যাডনেস ও রেটোরিক্স—এই দুই অভিব্যক্তি একে অপরের ছায়ায় দাঁড়িয়ে আছে। পাগল যখন কথা বলে, সে প্রথাগত ভাষাকে চ্যালেঞ্জ করে। আর রেটোরিক্স যখন দমন করে, সে পাগলকে নিরব করে দেয়।
তবে, এই সংঘর্ষের মধ্যেই জেগে থাকে বিপ্লবের সম্ভাবনা। পাগলরা সমাজের অন্তঃসারশূন্যতাকে নগ্ন করে তোলে, আর বাগ্মিতা—চাই তা শাসকের হোক বা প্রতিবাদকারীর—আমাদের শেখায় ভাষার রাজনীতিকে পড়তে। এই দ্বৈত সম্পর্ক না বুঝলে আমরা মানবসমাজের নৈতিক কাঠামো, রাজনীতি ও জ্ঞানের প্রকৃত রূপ কখনোই উপলব্ধি করতে পারব না।
পাগলামি ও রেটোরিক্সের এই দ্বৈত বিন্যাস আমাদেরকে মনে করিয়ে দেয় যে, মানব অভিজ্ঞতা কখনো সরল নয়। পাগলামি ভাষার সীমানার বাইরে দাঁড়িয়ে থেকেও একধরনের ভাষা সৃষ্টি করে, যা প্রতিষ্ঠিত রেটোরিক্সের কাঠামোকে অস্বীকার করে, প্রশ্নবিদ্ধ করে। অন্যদিকে, রেটোরিক্স ভাষার এমন একটি শিল্প, যা ক্ষমতার গঠনকে তৈরি ও প্রতিষ্ঠিত করে, কিন্তু তার মধ্যেই থাকে এর ভাঙনের সম্ভাবনা। এই আলোচনায় আমাদের দেখতে হয়, কীভাবে পাগলামি এবং রেটোরিক্স একে অপরকে নির্ধারণ করে, সংঘাতে আসে, এবং কখনো কখনো একে অপরের মধ্যে হারিয়ে যায়।

রিমেল সরকার
একজন উদীয়মান ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতশিল্পী (গোয়ালিয়র-জয়পুর-আগ্রা ঘরানা), নিরীক্ষাধর্মী লেখক ও কবি , যিনি রাজনীতি, নন্দনতত্ত্ব ও অস্তিত্ববাদী চিন্তার সংযোগস্থলে অবস্থান করে কাজ করে চলেছেন। তিনি প্রাচ্যনির্ভর দ্বন্দ্ব, ঔপনিবেশিক ও উপনিবেশ-উত্তর রাষ্ট্রতত্ত্ব, সাংস্কৃতিক রাজনীতি এবং সাংস্কৃতিক মূলধনের বে-রাজনৈতিককরণ নিয়ে এক নিবিষ্ট বৌদ্ধিক চর্চায় নিয়োজিত।
এই শাস্ত্রীয় কণ্ঠশিল্পী তালিম নিচ্ছেন সঙ্গীত আচার্য ড. আলি রেজোয়ানের কাছে। তাঁর সংগীতচর্চা কেবল পরিবেশনে সীমাবদ্ধ নয়—তিনি রাগকে দেখেন অস্তিত্ববাদী সময়, ক্ষমতা, যুক্তি, রুচি ও প্রতিরোধের এক দার্শনিক উচ্চারণ হিসেবে।