Home » জন্মান্তরের সুখ // রুখসানা কাজল

জন্মান্তরের সুখ // রুখসানা কাজল

বড় সুটকেসটার উপর চেপে বসে চাবি মেরে দিল রায়হান। নিজের ছোট ব্যাগটাও আরেকবার খুলে দেখলো। নাহ্‌ ভেতরের সব কিছু ঠিকঠাক আছে। নিশ্চিত রায়হান কিছুক্ষণ থম মেরে দাঁড়িয়ে থেকে রোহানের মাথায় হাত রেখে বুকভাঙ্গা একটি গভীর নিঃশ্বাস ফেলে।
দীর্ঘশ্বাসের ভেজা বাতাস ছুঁয়ে যায় ছেলের কপাল, শোন কোন কিছুর জন্যেই তোকে ভাবতে হবে না কখনো। আমি ত আছি তোর সাথে —
রোহান বোঝে ড্যাডার গলা বুজে আসছে।
আমি তো আছি বাবা। ভয় পাবি না । কোন কিছুকেই ভয় পাবি না।
খুব ধীরে দরোজার দিকে হেঁটে যায় রায়হান। রোহান দেখে দেয়ালে ড্যাডার ছায়াটা কেমন ফ্রিজ হয়ে গে্ল। ছায়াটা এবার উলটো ঘুরে চলতে শুরু করে। ওর সামনে এসে থামে, তোর মায়ের উপর রাগ রাখিস না বাবা। কিছুদিন যাক দেখিস আবার তোকে কাছে ডেকে নেবে। কিপ পেশেন্স ওকে !
আঠারো শ স্কয়ার ফিটের এই ফ্ল্যাটে এখন কেবল সে আর রোহান। শেষ মূহুর্তের দায়টা রায়হানের উপর দিয়ে মেয়েকে নিয়ে বিকেলেই বাবার বাড়ি চলে গেছে দিপু। রোহান চলে যাচ্ছে। ওদের প্রথম সন্তান। রায়হান আশা করেছিল ছেলেকে হয়ত একা ছাড়তে চাইবে না। শত হলেও মা। শেষ মুহূর্তে মন নরম হয়ে যাবে! ছেলেকে বিদায় জানাতে মা আসবে না তাই কি হয় !
কিন্তু দিপু আসেনি। একবারের জন্যে ফোন করে ছেলের সাথে কথা বলেনি। খোঁজ নেয়নি।
মা ই তো ? রোহানের আপন মা। নিজের রক্তমাংস দিয়ে তিলতিল করে গড়ে তুলেছে যে রোহানকে !
বারান্দার আলোছায়ায় বসে রায়হান ভাবে, এ কেমন মা তার স্ত্রী! রোহান তোর মা কেমন মা রে? একবার এলো না ছেলেকে বিদায় দিতে!
উত্তরা ক্লাবের জৌলুসে তার স্ত্রীর সুনাম গমগম করে। সমাজসেবায় অদ্বিতীয়া। যে কারো বিপদে প্রাণ দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। রায়হানের উত্থানের পেছনেও এই নারীর অনেক পরিশ্রম। কিন্তু এই ক বছরে দিপুর শরীর মন থেকে মাতৃত্ব মুছে গেছে। খর দৃষ্টিতে তাকায়। লাবণ্যহীন মুখ। ভঙ্গুর শরীর। কর্কশ কথাবার্তা। দিপু যেন মানুষ নয়। কাঁকড়া বিছের বিষাক্ত জঞ্জাল।
রায়হান অনেক বুঝিয়েছে, অনুনয় করেছে কিন্তু দিপু কিছুতেই রাজী নয়। শেষবারের মত বলেছিল, তুমি পারবে দিপু ? রোহান তোমার প্রথম সন্তান। তোমার স্বপ্ন আবেগ ভালবাসা। ওর ভেতর তুমি আমাকে খুঁজে পেয়েছিলে!
প্রবল মাথা নেড়ে পাগলের মত দিপু বলেছিল, পারব পারব খুব পারব। মনে করব রোহান মরে গেছে। আমার রোহান নেই।
ব্যথাভরা হাহাকারে রায়হান বলেছিল, তোমার সংসারের এক কোণে ছেলেটাকে থাকতে দিলে না দিপু। তুমি মা নও কেবলই মানুষ। মাতৃত্বহীন নারী তুমি। তোমাকে ভয় লাগছে দিপু।
লাগুক। তুমি ওকে বিদায় করবে কি না বল ! বিদায় করো। এখুনি বিদায় কর। যেখানে খুশি পাঠিয়ে দাও। যা খুশি কর শুধু বাংলাদেশে রেখো না। ওরা জানতে পারলে ওকে নিয়ে যাবে। রাস্তায় রাস্তায় ভিক্ষে করাবে। আমি সহ্য করতে পারব না। কিছুতেই পারব না। মরে যাব। আমি মরে যাব রায়হান — পাগল পাগল চোখে রায়হানের হাত ছাড়িয়ে ছুটে বেরিয়ে গেছিল দিপু।
রোহান তাদের প্রথম সন্তান। নামী ইংলিশ ইশকুলের ছাত্র। ভাল রেজাল্ট। ডিবেট, ছবি আঁকা, আবৃত্তিতে ছোটবেলা থেকেই পুরস্কার পায়। অহঙ্কার আর সম্ভ্রমের নীল পালক গুঁজে দিপু ঘুরে বেড়ায়। ইশকুল, বাসা, আত্মীয় স্বজন, বন্ধু পরিচিত মহলে রোহানের গর্বিত মা। ইশকুল গেটে ছেলের সাফল্যে অন্য ভাবীদের প্রশংসার বন্যা বয়ে যায়। গর্বে মন মাথা ভরপুর থাকে। গ্রীবা বাঁকিয়ে রাজহংসীর মত চলে দিপু। এই গর্ব, আনন্দ, সুখ ধরে রাখতে সংসারের টাকা বাঁচিয়ে রোহানের জন্য আরো ভাল টিউটর রাখে । আরো ভাল খাবার। ভাল জামা। ভাল আর্ট টিচার। অংক, কেমেস্ট্রী, ফিজিক্সের কোচিংএ ছেলেকে নিয়ে দিনরাত ছুটেছে। বেশিটা সময় এমন হয়েছে, রোহান পড়ছে, দিপু ছেলেকে খাইয়ে দিচ্ছে।
গোলটি বাঁধলো রোহানের পনেরতম জন্মদিনে।
অন্য ছেলেদের যখন গোঁফ গজাচ্ছে তখনো রোহনের মুখে পেলব স্নিগ্ধতা। বারো তেরো বছর বয়সেই ছেলেদের গোঁফের রেখা দেখা দেয়। কিন্তু রোহানের পরিস্কার ঝকঝকে মুখ। গোঁফ গজানোর কোন নাম নেই । বরং অদ্ভুত সুন্দরতার শ্রী ছড়িয়ে পড়েছে ওর দেহে। কচি হরিণের মত সবুজ মায়াবী রঙ। একটু যেন নব কিশোরি মেয়েদের মত।
মায়ের প্রাণ। কেঁপে উঠেছিল দিপু। পুরুষ হতে এত দেরি হচ্ছে কেনো রোহানের ? ইশকুল গেটে পরিচিত একজন ডাক্তার ভাবির সাথে কথাও বলেছে। ভাবি বলেছে চিন্তার কিছু নাই। কোন কোন ছেলের দাঁড়ি গোঁফ গজাতে সমবয়সিদের চেয়ে সামান্য দেরি হয়।
রায়হানকে মিষ্টি করে খোঁচাও মেরেছে দিপু, কি গো তুমিও কি লেট খেয়ে পুরুষ হয়েছিলে ?
এরমধ্যে রোহানের গলার স্বর ভেঙ্গে গেছে তাই আর টেনশন করেনি ওরা । তবে মাঝে মাঝে খারাপ লাগত রোহানের বড়সড় বন্ধুদের দেখে। ওদের পাশে রোহানকে লাগত কোমল কচি স্বাস্থ্য উজ্জ্বল কিশোরের মত।
রোহান যে তাদের সামনে জামা গেঞ্জি খোলে না, কখনো খালি গায়ে থাকেনা এটাও ওরা কখনো পাত্তা দেয়নি। এতকিছু খেয়ালেই আসেনি ওদের। অনেক ছেলেরই ব্রেস্ট উন্নত থাকে। রোহান বরাবর একটু মোটুও ছিল। তাছাড়া আজকাল বাবা মায়ের সময় কোথায় প্রতিটি বিষয় নিয়ে নজরদারি করার। ছেলেমেয়েদের সাথে দেখা বা কথাই ত হয় কম। আর রোহন বরাবরই খুব সপ্রতিভ। স্মার্ট বয়। ওর জন্যে আলাদা কেয়ার নেওয়ার কথা ওরা তাই ভাবেনি কখনো।
পনেরতম জন্মদিন। রোহনের প্রিয় ক্যালিফোর্নিয়ার ব্লাকফরেস্ট কেক নিয়ে ওর মা যখন রাত বারোটায় উইশ করতে যায় হাত থেকে পড়ে যায় কেক। এক মর্মভেদী চীৎকার দিয়ে ছুটে আসে। ছোট অবন্তি হতভম্ব। সেচ প্রকল্পের বাজেট নিয়ে ব্যস্ত রায়হান বিরক্ত হয়ে গলা চড়ায়, কি হলো দিপু ? রাতদুপুরে কি হচ্ছে এসব ?
দিপালি সর্বহারার মত চেয়ে থাকে। পরমূহুর্তে খাটের সাথে মাথা ঠুকে কেঁদে উঠে, সব শেষ। আমার সব শেষ হয়ে গেল। ধ্বংস হয়ে গেল। ও আল্লাহ তুমি কি নিষ্ঠুর। কি নিষ্ঠুর তুমি !
রায়হান গলা তুলে রোহানকে ডাকে – রাহি- এই রাহি !
দিপু লাফ দিয়ে ওঠে, না না ওকে ডেকো না। ডেকো না প্লিজ। আমি মরে যাবো। ও আল্লাহ আমার একি করলে, কি পাপে তুমি এই শাস্তি দিলে গো !
ছেলের জন্মদিন বলে সারাদিন রান্নাবান্না করে সন্ধ্যায় মা মেয়ে কেক এনে লুকিয়ে রেখেছে রোহানকে সারপ্রাইজ দেবে বলে। কিন্তু রাতদুপুরে একি ভড়কামি ! মনের কোণে অজানা এক ভয়ও খেলে যায়। এই বয়সের ছেলেরা আজকাল খুব নেশা করছে। অনেকেই ইংলিশ মিডিয়ামের ছেলেমেয়েদের দোষ দেয়। রোহান কি তেমন কিছু করে বসল নাকি !
দিপু খুব শক্ত মনের মহিলা। অনেক উচ্চাশা ওর। ধরেই রেখেছে রোহান ইঞ্জিনীয়ার না হয় আর্কিটেক্ট আর অবন্তিকে ডাক্তার হতেই হবে। সহজে ঘাবড়ানোর মহিলা নয়। তবে? রায়হান মুখ তুলে দেখে দিপুর পাশে অবুঝের মত বসে অবন্তি ডাকছে, মা মা ওঠো।
এবার রায়হান উঠে আসে, কিরে তোর আবার কি হল? হেডডাউন রোহানের দিকে বিরক্ত হয়ে প্রশ্ন করে রায়হান। পনের বয়েস হলেও কোমল শরীর। মাঝে মাঝে মনে হয় ছোট চুলের বেশ মিষ্টি এক কিশোরি যেন।
ছেলের পিঠে হাত দিতেই চমক লাগে! কি ব্যাপার হাতে যেন হুক লাগল। মনে হল রোহানও কেঁপে উঠল। রায়হান এবার সচেতনভাবে রোহানের পিঠে ওর প্রশস্ত হাত রাখে। হ্যা কনফার্ম। রোহন ব্রা পরেছে। কিন্তু কেন ? একি খেয়াল তার ছেলের !
সহসা মনে পড়ে যায়, এবার বৈশাখে বর্ষবরণের ভোরে খুব অস্পষ্ট রঙধনু রঙের একটি মিছিল বেরিয়েছিল। সাধারণ কেউ সহজে বুঝতে পারেনি। এমন কি অনেক সাংবাদিকও প্রথমে বোঝেনি। পরে জেনেছে মিছিলটি ছিল থার্ড জেন্ডার আর সমকামীদের। পত্রপত্রিকায় এদের নিয়ে প্রচুর লেখা পড়েছে রায়হান। তারপর ফেলে দিয়েছেন মাথা থেকে।
তবে কখনও একবার ভেবেছিল রোহানের বয়েসটা এখন যেমন ওকে নিয়ে একটু আলাদা করে বসলে ভাল হয়। এই বয়সে নারীদের মত পুরুষদেরও শারিরীক পরিবর্তন হয়। যদিও দাড়িগোঁফ ছাড়া অন্যান্য পরিবর্তন নারীদের মত স্পষ্ট নয়। এসব কিছু কিছু ব্যাপার ওকে এখন বুঝিয়ে দেওয়া দরকার। কিন্তু কাজের চাপে ভুলে গেছে সবকিছু । তাছাড়া ও নিজেও তো পুরুষকালের এই সময় একা একা পার করে এসেছে। তাকে তো কেউ শিখিয়ে পড়িয়ে পুরুষ বানায়নি। সম অসম বন্ধুরাই যথেষ্ট ছিল এসব বিষয়ে জ্ঞান দিতে।
রায়হান ভাবে, রোহান কি গার্ল ফ্লেভারে আসক্ত হল! একটু শক্ত সুরে তিনি বলেন, কি হয়েছে তোর মায়ের? কি করেছিস তুই?
কাঁপতে কাঁপতে মুখ তোলে রোহান। অপুর্ব সুন্দর কিশোরী মুখ। চোখে কাজল ঠোঁটে লিপস্টিক। কপালে ছোট্ট টিপ।
কে এ ? রোহানই তো! কিন্তু তারপর?
ধপাস করে বসে পড়ে রায়হান। পৃথিবী ভেঙ্গে পড়ছে মাথায়। হাঁটু কাঁপছে। ঘর দুলছে। পিঙ্ক কালারের ক্যালেন্ডারে আরো ডিপ পিঙ্ক গোলাপগুলো রুমটিকে মেখে দিচ্ছে অনিন্দিত সুন্দরতায়। গোলাপি শার্ট পরেছে রোহান। দিপুর ওড়না ঝুলছে কাঁধের পাশে। কিশোরি উদ্ধত পায়রা বুক। একরাশ মেয়েলি কুন্ঠা নিয়ে মাথা নিচু করে ফ্লোর দেখছে। কোন রকমে নিজেকে গুছিয়ে উঠে দাঁড়ায় রায়হান, তুই এরকম সেজেছিস কেন মেয়েদের মত? ছি! যা মুখ ধুয়ে আয়।
শেষ কথাটি একটু কড়া করে বলে রায়হান। ইচ্ছে নেই এমন ভঙ্গীতে গা মুচড়ে উঠে যায় রোহান। অই মুহুর্তটুকুতে বালিশ তোশকের নিচে আর টেবিলের ড্রয়ার হাতড়ায় রায়হান। পরিপাটি গোছানো ড্রয়ার। আলমারি খুলে দেখে সুন্দর করে গোছানো সব পোশাক। হ্যাঙ্গারে ঝোলানো শার্টপ্যান্ট দেখে একটু আশ্বস্ত হয়ে কবাট লাগানোর আগে কি মনে করে শার্টগুলো সরিয়ে চমকে ওঠে। মেয়েলি জামা কাপড়ে ঠাসা কয়েকটি হ্যাংগার। রঙিন ব্রা,প্যান্টি, ট্যাংটপ, ল্যাসে, স্কার্ট, লিপস্টিক, পাউডার আরো কত কি! মাথায় আগুন জ্বলে ওঠে। আলমারী বন্ধ না করেই অপেক্ষা করে। নাহ্‌ দেরী করছে। অতিরিক্ত সময় নিচ্ছে রোহান। অস্থিরভাবে দরোজায় নক করেই রায়হান বুঝে যায়, ছেলে ওকে অতিরিক্ত এই সময়টুকু দিয়েছে সত্যিটা জানার আর নিজেকে সামলে নেওয়ার জন্যে।
রঙ ধোয়া ভেজা মুখে বেরিয়ে আসে রোহান। বুকের উপর তখনো ঝুলিয়ে রেখেছে ওড়না। হ্যাচকা টানে বিছানায় বসিয়ে দেয় রায়হান, এগুলো কি পরেছিস তুই? কেন পরেছিস? জানিস কারা পরে এসব?
বুক ভেতরে চেপে কাঁধ ঝুকিয়ে মেয়েলি সঙ্কোচে লাজুকভাবে ওড়না খুটে রোহান। আরো ক্ষেপে যায় রায়হান, এই সোজা হয়ে বোস্‌। কে দিয়েছে এসব তোকে?
ছেনাল একটি হাসি খেলে যায়, আমি কিনেছি। আমার ভাল লাগে ।
নিজেকে সামলাতে পারে না রায়হান। এক থাপ্পড়ে রোহানের গাল ফাটিয়ে দেয়, শয়তান ছেলে, ফাজলামো হচ্ছে।
অবাক হয়ে দেখে গালে হাত রেখে স্বাভাবিক চোখেই ওর দিকে তাকিয়ে আছে রোহন। আশ্চর্য স্বাভাবিক দৃষ্টি। যেন ও জানতই এমন হবে। রায়হানের শরীর জুড়ে রাগ আর বিস্ময়ের ঘোড়া দাবড়ে বেড়ায়। নিষ্ঠুর রাগী গলায় বলে, রাহি বল কেন পরেছিস এই সব মেয়েদের জামা কাপড়? তুই না ছেলে। তবে?
সমস্ত রাগ, বিস্ময়কে উড়িয়ে দিয়ে ঠান্ডা গলায় ছেলে জানায়, নো ড্যাডা নাউ আই এম এ গার্ল। ইন ফ্যাক্ট, আই এম, আন্ড আই এম আ হ্যাপি গার্ল।
রায়হানের সমস্ত রাগ এবার ঝুলে পড়ে। তবু স্বাভাবিক হওয়ার ব্যর্থ চেষ্টায় ভাঙ্গা গলায় বলে, তুই কি করে বুঝলি ?
আই নো ইটস। মাই বডি ইজ চেঞ্জিং এন্ড গোয়িং টু বি লাইক দ্যা গার্ল। গোলাপি পাথরের একটি আংটি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে খুব নরম সুরে উত্তর দেয় রোহান।
ড্যাডার খুলে যাওয়া মুখ দেখে কষ্ট পায়। কেমন ভেঙ্গে পড়েছে। কিন্তু দিনের পর দিন ওর শরীরে যে পরিবর্তনগুলো হচ্ছিল রোহান প্রথমে বুঝতে পারেনি। একদিকের বুক চুলকাচ্ছিল, একটু ব্যথা, টাচ্‌ লাগলে অদ্ভুত আরামের শিহরন স্পার্ক করছিল শরীরজুড়ে। এক সময় ফুলেও উঠল কিছুটা। হাত লাগলে কি যে অন্যরকম ভাল লাগত তা বলে বোঝানোর নয়। কিছুদিন পরে অন্য বুকেও একই রকম অনুভূতি টের পেল সে। ছেলেদের পাশে গেলে শরীর কেমন যেন শিরশির করে ওঠে। কেন যেন মনে হয় ওরা ওকে আদর করুক। কেউ হাত দিয়ে ধরে দেখুক ওর নতুন পাওয়া বুক দুটোকে।
সাদমানকে বলেছিল, তোর হয় দোস্ত ?
বাস্কেটবল গ্রাউন্ডে ড্রিবলিং করতে করতে সাদমান জানিয়েছিল, সিওর। বাট আই লাইক গার্ল। গার্লস ব্রেস্ট এন্ড বিউটিফুল পিঙ্ক কান্ট।
সাদমান খুব বিএফ দেখে। রোহানও দেখে তবে মাকে লুকিয়ে। ওর পেনিস ছোট হয়ে যাচ্ছে। মরা চামড়ার মত ঝুলে থাকে আজকাল। বলবে সাদমানকে?
এক সময় কোচিং ক্লাশের ফাঁকে সিগ্রেট খেতে গিয়ে মামুর দোকানে বসে বলে ফেলে, দোস্ত ইট উইল হ্যাপেন। মাই ব্রেস্ট ইজ বিগার বাট পেনিস বিকামিং স্মলার। আই এম দা গার্ল?
সাদমানের চোখ গোল হয়ে যায়।
সেই সন্ধ্যায় সাদমানের বাসায় ওরা গুগল সার্চ দিয়ে জেনে নেয় কেন এরকম হচ্ছে। মন খারাপ হয়ে যায় রোহানের। লজ্জায় কেঁদে ফেলে। ভেঙ্গে পড়ে ওর মন। সে কি তবে হিজড়া হলো? কিন্তু সাদমান সাহস দেয়, ইটস ন্যাচারাল। এখন এটা কোন প্রবলেম নয় বেব্‌স। অনেকে ত এমনি এমনিই হয়ে যাচ্ছে। ছোট্ট একটি অপারেশন। তুই মেয়ে হয়ে যাবি। আজকের সম্পুর্ণা। দেন উই উইল মেক লাভ ডার্লিং।
সাদমানের আদর খেতে খেতে রোহানের মনে হয়েছিল ইয়েস আই উড বি এ কমপ্লিট উওম্যান। কিন্তু ড্যাড্যা মাম? স্পেশালি মা?
মাকে বুঝাতে তাই এই জন্মদিনকে বেছে নিয়েছিল। তাছাড়া সাদমানও বলেছিল, দোস্ত কুইক একশন ইজ একটিভ একশন। আন্টি যত আগে জানবে দুঃখ তত কমে আসবে।
রোহানের পাশে বসে রায়হান বিমূঢ় ভাবনায় সেদিন রাত পার করে দিয়েছিল চূড়ান্ত হতাশায়, স্বপ্নভঙ্গের বেদনায়।
পরদিন সকালে রোহানের মেল পেয়ে সাহস ফিরে পেয়েছিল রায়হান। রোহান যদি ভেঙ্গে না পড়ে তবে সে কেন ভঙ্গুর হবে!
গেলো দুটো বছর কেবল ডাক্তারদের সাথে কথা বলে গেছে। সন্তানকে ত আর ভাসিয়ে দেওয়া যায় না! রায়হান এক প্রবল পুরুষ। রোহানকে সে একটি স্তম্ভ দিয়েই ছাড়বে। আজ সেই দিন। রোহান চলে যাচ্ছে।
কলবেল বেজে ওঠে। শেষপর্যন্ত সন্তানের টানে দিপু বুঝি ফিরে এলো! যাক মনের ভার কিছুটা কমানো যাবে। দুটো বছর রোহানের সাথে কথা বলেনি দিপু। আজ মা ছেলের কথা হলে সব ঠিক হয়ে যাবে। রোহানও কম কষ্ট পায়নি। মুখ ফুটে কিছু বলেনি মাকে। নিজেকে দূরে সরিয়ে রেখেছিল। এবার রোহানেরও ভাল লাগবে।
দরোজা খুলে অবাক হয়ে যায় রায়হান। সাদমান এসেছে। রোহানের বন্ধু। সাথে ওর ডাক্তার বাবা মা।
সালাম আঙ্কল। আমরাও যাচ্ছি রোহানের সাথে।
মানে ?
রায়হানের সমস্ত দুশ্চিন্তাকে উড়িয়ে দিয়ে সাদমানের বাবা মা জানায় ওরা সব জানে। অনেক আগেই জানে। সময় হলে জানাবে বলেই এসেছে। তাছাড়া এভাবে তো ছেলেটাকে একা ছাড়া যায় না। রোহান সাদমানের যত প্রিয় ওদেরও ঠিক ততটাই। তাই ঠিক করেছে হাসপাতালে ওরা রোহানকে এটেন্ড করবে। রোহানও জানে ওরা যাচ্ছে। এরকমই কথা হয়ে আছে ওদের মধ্যে। তাছাড়া সাদমানের বাবা মার ইচ্ছা সিঙ্গাপুরে রোহানের সাথে হায়ার স্টাডিটা একসাথেই শেষ করুক সাদমান।
বিহ্বল রায়হানকে আস্থা দিতে হাত বাড়িয়ে দেয় সাদমান, হে বাডি বি ব্রেভ ম্যান। আমরা ত আছি ডিয়ার সিনিয়র।

রুখসানা কাজল

রুখসানা কাজল পেশায় অধ্যাপক। পড়াশোনা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ থেকে। দেশ ও দেশের বাইরের পত্র পত্রিকায় গল্প ও নিবন্ধ লেখেন। এ পর্যন্ত দুইটি উপন্যাস, গল্পগ্রন্থ এবং অনুগল্পের বই প্রকাশিত হয়েছে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ভাষা
Scroll to Top