চারপাশ আন্দোলিত করে গভীর রাতের মধ্য দিয়ে আমাদের বাস এগিয়ে চলেছে। এগিয়ে যাচ্ছে শুধু সামনের দিকে। দূর দূরান্তে বাসের হেডলাইটের আলোকে অস্বীকার করে বিস্তৃত হয়ে পড়া অন্ধকার ছাড়া অন্য কিছু দেখা যায় না। এই অন্ধকার শীতল পরিবেশটাতে কিছু একটা আমেজ যেন ছড়িয়ে পড়েছে। হ্যাঁ বাইরে এক ফোঁটা দু ফোঁটা বৃষ্টি পড়ছে। জানালার কাছে লেগে রয়েছে বৃষ্টির ছাপ। স্যাতসেঁতে মাটির ফুরফুরে একটা গন্ধ বাসটার ভেতরে ভেসে আসে। আমাদের নাট্য দলটি এর আগের প্রতিযোগিতাটিতে ভাবামতো সফলতা লাভ করতে পারেনি। হয়তো আমাদের অভ্যাসের সময়টা কম ছিল। প্রশিক্ষক স্যার আমাদের সে কথাই বলেছিল। তবে সৌভাগ্যের পথ মুক্ত হল অন্যদিকে। বগলস রোডের মেপ’লউড অ্যাক্টিং আকাডেমি অনুষ্ঠিত রাষ্ট্রীয় নাট্য মহোৎসবে আমাদের দলটি নিমন্ত্রিত হয়েছিল। সেই মর্মে আজ অক্টোবর ২৮ তারিখ নির্জনে এগিয়ে যাওয়া বাসটির সঙ্গে আমরাও যাচ্ছি।
আমার পাশে আমিনা ঘুমোচ্ছে। বিপরীত সিটে বসা পাপড়ির দৃষ্টি একটি ইংরেজি বইয়ে। বাসের ভেতরে জ্বলতে থাকা বাল্বের ক্ষীণ আলোতে কীভাবে সে বই পড়ছে সেটা সেই জানে। আমি পুনরায় আমিনার দিকে তাকালাম। তার চোখ দুটি বন্ধ। মজা করে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী হে আজ ঘুম ভাঙবে না নাকি?’ আড়মোড়া ভেঙ্গে আমিনা বলল, ‘এই খুব বিরক্ত লাগছে। কখন যে পৌঁছাব। ঘরের কথা মনে পড়ছে।’
‘ইস এরকম গম্ভীর পরিবেশে বাড়ির কথা মনে পড়বে না তো কীসের কথা মনে পড়বে? নাকি বল পাপড়ি?’
একান্ত মনে বই পড়তে থাকা পাপড়িকে কিছুটা বিরক্ত করার জন্যই আমি একটু জোরে কথাটা বললাম যাতে পাপড়ির কানে কথাটা গিয়ে পড়ে। কিন্তু পাপড়ি আমার কথায় কোনো গুরুত্ব দিল না। সে একান্ত মনে বই পড়তে থাকল। এই সময় বাসটির সামনে থেকে গায়ত্রী উঠে এল এবং আমাদের তিনজনের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘এই বইয়ের পোকা এবং বাড়ির কথা মনে পড়া তোদের আর কোনো কাজ নেই। আজেবাজে কথা বলে সময় নষ্ট করছিস। গিটারটা এমনিতেই এনেছি নাকি? কেউ একজন গানটা তো গাইতে পারিস। বাসের সামনের দিকে যারা বসেছিল উঠে এসে একেবারে পেছনে চলে এল। এলোমেলো হয়ে থাকা চুলগুলি একটু ঠিক করে নিয়ে অনিন্দিতা বলল, ‘প্রনামিকার কণ্ঠস্বরটা ভালো তুই গা।’
‘হ্যাঁ হ্যাঁ,ঠিকই বলেছ’ বলে আব্দুলও অনিন্দিতার কথাটায় জোর দিল। প্রত্যেকেই আমার দিকে এভাবে তাকাতে লাগল যে অবশেষে আমি গাইতে বাধ্য হলাম।
এক হাত দিয়ে গিটারটা ধরে আমি বিহান্নার ‘ডায়মন্ড’ গানটা গুণগুণ করতে লাগলাম–
Shine bright like a diamond…
ঘনঘোর নীরব অরণ্যের মধ্য দিয়ে এই যাত্রায় আমাদের নাচ গান চলতে থাকল। বাসের একেবারে সামনের আসনে বসা প্রশিক্ষক তথা পরিচালক প্রমোদ স্যার বাসের চালকের দিকে তাকিয়ে কিছুটা উত্তেজিত হয়ে বলল, ‘রৌশন আমরা পথ ভুল করিনি তো? এতটা দেরি হল। বগলস রোডটা কোথায় তুমি ভালো করে জান কি?’ মাথাটা স্যারের দিকে ফিরিয়ে, জোরালো মোচটাতে তা দিয়ে রৌশন বলল, ‘হুজুর, টেনশন মত লিজিয়ে। হম সহী জগহপেহি পহুচনেবালা হুঁ।’
অনুচ্চ সুরে প্রমোদ স্যার বললেন, ‘তুমিই আমাদের ভরসা।’
অধীর অপেক্ষার শেষে, ঘন অরণ্যের নীরবতাকে অগ্রাহ্য করে বাসটা আমাদের গন্তব্যস্থলে উপস্থিত হল। এখান থেকে প্রায় আধা ফার্ল়়ং দূরে রয়েছে আমাদের প্রতিযোগিতার স্থান।
বাস থেকে নামার সঙ্গে সঙ্গে এক ঝাঁক ঠান্ডা বাতাস আমাদের ছুঁয়ে গেল। আমাদের চোখ আপনা থেকেই বুজে এল। যেন ঘোড়ার মতো আমরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই শুয়ে পড়ব, এতটাই ক্লান্ত আমরা। আঁকাবাঁকা পদক্ষেপে আমরা একটা কোয়ার্টারের সামনে পৌঁছালাম। আমাদের অভ্যর্থনা জানানোর জন্য আয়োজক সমিতির তিনজন অপেক্ষা করছিলেন। তারই মধ্যে কিছুটা বয়স্ক বলে মনে হওয়া একজন এগিয়ে এলেন, ‘প্রমোদ, আমাকে চিনতে পেরেছ নিশ্চয়। আগেও একবার দেখা হয়েছিল। আমি সুভাষ দত্ত, আয়োজক সমিতির সভাপতি।’
‘Nice to meet you.’, প্রমোদ স্যার নমস্কার জানিয়ে বলল।
‘Nice to meet you too. এটা বোধ হয় তোমার টিম তাই না?’ সুভাষ দত্ত প্রত্যুত্তর জানিয়ে জিজ্ঞেস করল।
‘হ্যাঁ। আমাদের দলে মোট দশজন ছেলেমেয়ে আছে।’-প্রমোদ স্যার বললেন।
‘আচ্ছা, তোমাদের খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থাটুকু এই মেলারাম করবে। মেলারাম এদিকে আয়।’
সুভাষ দত্ত এভাবে ডাকায় ফ্যাকাসে রঙের পোশাক পরা ক্ষীণদেহের মেলারাম এগিয়ে এল। তিনি সুভাষ দত্তের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন।
‘তুই এদের কোয়ার্টারে নিয়ে যা। তোর কাছে চাবি আছে তো?’ -মেলারাম মাথা নাড়ল। সুভাষ দত্ত পুনরায় প্রমোদ স্যারের দিকে তাকিয়ে বলতে লাগল, ‘প্রমোদ, তুমি কোনো চিন্তা কর না। কোয়ার্টারের অবস্থা এত ভালো নয় যদিও তোমরা আরামেই রাতটা কাটাতে পারবে। আচ্ছা তোমরা ক্লান্ত হয়ে পড়েছ, একটু বিশ্রাম নিয়ে নাও। আমি তাহলে আজকের মতো বিদায় নিচ্ছি। শুভ রাত্রি।’
চুপচাপ মেলারাম দাদার পেছন পেছন আমরা যেতে লাগলাম। একটা বিশাল চৌহদের সামনে দাঁড়িয়েছিল অনেক পুরোনো, মরচে পড়া লোহার গেটটা। মেলারাম দাদার হাতে থাকা ল্যাম্পের আলোতে অস্পষ্টভাবে দেখতে পেলাম কিছু বন্যলতা গেটটাকে ঘিরে রেখেছে। গেটটার ফলকে থাকা কোয়ার্টারের নামটির যেন এখন কোনো অস্তিত্বই নেই। সেটা কেবল মাংস পচে খসে পড়া এক টুকরো হাড়ের মতো জ্বলজ্বল করছিল।
গেটটার কিছু দূরে দাঁড়িয়ে থাকা অসম আদলের বিশাল বাংলোটার দিকে আমরা এগিয়ে গেলাম। বাংলোটার বেশ কিছু জানালার আয়না আধভাঙ্গা। শুকনো পাতার স্তূপ, ছিন্নভিন্ন চিমনি, দুটোর মতো হুইল চেয়ার বাংলোটাকে এক অদ্ভুত রূপদান করেছে। মেঝের এখানে সেখানে লেগে আছে তেলের দাগ। হয়তো কেউ ল্যাম্প জ্বালানোর সময় তেল পড়ে গিয়েছিল। দীর্ঘ বারান্দার খুঁটিগুলি উইপোকায় খাওয়া। এটাই কোয়ার্টারের বাহ্যিক রূপ। কোয়ার্টারের সামনের দীর্ঘ লম্বা ফলকটাতে বড়ো করে ক্রস চিহ্ন আঁকা যার রঙ লাল।
মেলারাম দাদা আমাদের সঠিক জায়গায় নিয়ে এসেছে কি? -না, বিশেষ কিছু ভাবার মতো আমাদের হাতে সময় ছিল না।যেখানে রাত সেখানে কাত ভেবে আমরা কোয়ার্টারের ভেতরে প্রবেশ করলাম। জিনিসপত্র ঠিক ঠাক করলাম। ঘরটাও অল্প পরিষ্কার করলাম। ঘরের অবস্থাও একেবারে তথৈবচ। দরজার নামে কিছু একটা ঝুলতে থাকা দুটো কাঠের পাল্লা। মেঝেটাও নোংরা এবং ধুলোয় পরিপূর্ণ। শোবার জন্য খাট বা পালং কিছুই নেই। মাটিতেই বিছানা করতে হবে। আমরা সঙ্গে আনা হোল্ডল খুলে মাটিতেই তোষক পেতে নিলাম। ছেলেরাও নিজেদের অংশ পরিষ্কার করে নিল। প্রশিক্ষক স্যারের বিছানাও ওরাই পেতে দিল।
আমরা যাত্রা আরম্ভ করার আগ মুহূর্তে রাতের আহার করেছিলাম। এখন কেবল ঘুমিয়ে পড়ার অপেক্ষা। মেলারামদা ইতোমধ্যে আমাদের রেখে বিদায় নিয়েছিল। তিনি আমাদের ঘরে ল্যাম্পটা রেখে গিয়েছিলেন। ছেলেদের দিকে এক প্যাকেট মোম আর দিয়াশলাই এগিয়ে দিয়েছিলেন। আমাদের চোখ বন্ধ হয়ে আসছিল। কিন্তু ছেলেরা পুনরায় আড্ডা আরম্ভ করেছিল। আমাদের ঘরেই আড্ডা দিচ্ছিল। ‘এই ধরনের জঘন্য ঘরে থাকতে হবে বলে জানলে আমি আসতাম না।’–আব্দুল বিরক্তির সঙ্গে বলে উঠল। বসন্ত বলল– ‘ঠিকই বলেছিস, আমিও আসতাম না। হরর সিনেমার মতো মনে হচ্ছে না তোদের? এই ভয় লাগা কোয়ার্টারটাতে রাতটা যে কীভাবে কাটাব ভাবতেই ভয় হচ্ছে।’
‘বন্ধ কর এইসব।’–আদিত্য গর্জন করে উঠল। লজ্জা করে না তোদের? এতটাই স্বার্থপর হলি, সব কাজ নিজে নিজে করতে পারিস, অথচ এই সাধারণ কোয়ার্টারটাতে একটা রাত থাকতে তোদের ভয় হয়। আয়োজক কমিটি যে আমাদের থাকার জন্য একটু জায়গা বের করে দিয়েছে, তাতেই তোদের কৃতজ্ঞ থাকা উচিত। না হলে এই জঙ্গলের মধ্যেই রাত কাটাতে হত। তোরা যে কী, ভূতের বাইরে কথা বলার মতো আর কিছুই পেলি না।’
‘তোর যে এই হুংকারে ভূত পেত্নী যদি কোথাও আছে পালানোর পথ পাবে না’–মৃন্ময়ের মজার কথায় আমাদের মধ্যে হাসির আলোড়ন উঠল।
দূর থেকে রেলের হুইসেল ভেসে এল। সেটা যেন কোনো ক্রন্দনরত নারীর কণ্ঠস্বর। হঠাৎ আসা দমকা হাওয়া জানালার একটা পাল্লা খুলে দিল। ভেতরটা মুহূর্তের মধ্যে ঠান্ডা হয়ে পড়ল। কিছুক্ষণ সবাই মৌন হয়ে রইল। কারও মুখে যেন কথা নেই।
তখনই এগনেস উঠে গিয়ে জানালাটা বন্ধ করে দিল।–I have heard many gossips। এগনেস ধীরে ধীরে বলল। ‘আমি যেন কোথায় এই কোয়ার্টারের কথা শুনেছি।’
‘ইস বড়ো গসিপ শোনার লোক এসেছে’–আদিত্য বিড়বিড় করে উঠল।
‘আমি মিথ্যা কথা বলছি না আদিত্য। কোয়াটারের রেডক্রসের চিহ্নটা তুই লক্ষ্য করেছিস? কোয়াটারটা বোধহয় রেডক্রসের অধীনে ছিল। এখানে এক সময় বিভিন্ন দেশের নার্স এবং চিকিৎসকরা থাকত। আমি আমাদের গির্জার নান দিদিদের মুখে শুনেছি যে অন্ধকার রাতে এই ধরনের পরিত্যক্ত কোয়াটারেে করিডোরে মৃত লোকদের আত্মা নিজের অতীতের দুঃখের কাহিনি মনে করে ঘুরে বেড়ায়। তাই এখন আমি যিশুর কাছে প্রার্থনা করছি যে এরকম কোনো ঘটনা যেন না ঘটে।’ ‘May god bless us’–এগনেস বুকে ক্রসে এঁকে শংকিতভাবে কথাটা বলল। আমরা গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেললাম।
‘আচ্ছা এখন ভূতের গল্প করে আগামীকাল হতে চলা প্রতিযোগিতাটার কথা কেউ ভুলে না গেলেই হয়। কাল আমাদের সবাইকে তাড়াতাড়ি উঠতে হবে। চল চল সবাই ঘরে গিয়ে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়।’–বলতে বলতে মৃন্ময় ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। বাকি ছেলেরাও মৃন্ময়কে অনুসরণ করল।
রাত দুপুর। দূরের কোথা থেকে একটা বাজার ঘন্টার ধ্বনি ভেসে আসছিল। আমরাও বিছানায় শুয়ে পড়লাম।
বোধহয় ঘন্টাখানেক ঘুমিয়েছি। হঠাৎ আমার ঘুম ভেঙ্গে গেল। সিলিং দিয়ে কিছু একটা বেয়ে পার হয়ে গেল। হয়তো ইঁদুর দৌড়ে গেছে। দূরের কোথাও থেকে কুকুরের ঘেউ ঘেউ ভেসে এল। বাইরে তখন ঝিঁঝি পোকার অবিশ্রান্ত কলরব। আমি ছাড়া প্রত্যেকেই গভীর নিদ্রায়। আমার কেন ঘুম ভেঙ্গে গেল বুঝতে পারছি না। মনে কিছু অদ্ভুত চিন্তা দেখা দিল। হঠাৎ একটা ধড়মড় আওয়াজ শুনলাম। কীসের শব্দ বুঝতে পারলাম না। কিছুক্ষণ এভাবেই পার হয়ে গেল।
‘ডঃ গ্রেসইন’–হঠাৎ শোনা একটি কণ্ঠস্বরে আমি চমকে উঠলাম। কেউ যেন অত্যন্ত কাতর কণ্ঠে কাউকে ডাকছে। আমি এদিক ওদিক তাকিয়ে কাউকে দেখতে পেলাম না। জানালার ফাক দিয়ে চাঁদের ক্ষীণ আলো প্রবেশ করেছিল। ঘরের বাইরে কারও পায়ের শব্দ শুনতে পেলাম।
‘মিস্টার গ্রেইসন ‘–ওইযে পুনরায় সে কণ্ঠস্বর ভেসে এল। আমি আর স্থির হয়ে থাকতে পারলাম না। দরজাটা খোলার জন্য একপ্রকার দৌড়ে গেলাম। দরজার খিলটা এত শক্ত করে লাগানো ছিল যে সেটা খোলা আমার পক্ষে সহজসাধ্য ছিল না। এদিকে দরজার ওপাশে কাতরোক্তির মতো শব্দটা ক্রমশ বেড়ে চলছিল।
হঠাৎ দুম করে দরজাটা খুলে গেল।
বাইরে হাতে ল্যাম্প নিয়ে থাকা, দীর্ঘ স্কার্ট পরিহিতা একজন মহিলাকে দেখতে পেলাম। তার শুভ্র সাজ পোশাক দেখে বুঝতে পারলাম তিনি একজন নার্স। তাঁর দীর্ঘ লম্বা স্কার্টটা অনেক পুরোনো, মলিন তথা এখানে সেখানে সেলাই করা। অনুপ জল আলোর ল্যাম্পটা নিভু নিভু করে জ্বলছে। নৌকায় সেই নার্সটির মুখ আমি অন্ধকারের জন্য স্পষ্ট করে দেখতে পেলাম না।
নার্সটির কণ্ঠস্বর পুনরায় আমাকে চমকে তুলল–I have been waiting for you for a long time…হিঃ হিঃ হিঃ’তার কুটিল হাসির শব্দে ঘরটা যেন কেঁপে উঠল। তাঁর কিছু অস্পষ্ট পুরোনো ইংরেজি শুনে কী বলতে হয়, ভেবে না পেয়ে শুধু তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম।
‘What happened my dear?Do you not offended?…হিঃহিঃহিঃ…বলতে বলতে নার্সটি আমার অনেকটা কাছে চলে এল। ‘আমার কি দোষ ছিল যে মিস্টার গ্ৰেসইন আমাকে পরিত্যাগ করল, পা দিয়ে মাড়িয়ে গেল।’–তাঁর কণ্ঠস্বর আবেগে রুদ্ধ হয়ে এল।
জিজ্ঞেস করব কী করব না করে তাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘মিঃ গ্রেসইন কে? আপনারই বা কী পরিচয়?’
আমি যেন জিজ্ঞেস না করার মতো কোনো কথা জিজ্ঞেস করে ফেলেছি। তিনি ক্রোধে জ্বলে উঠলেন এবং রুদ্রমূর্তি ধারণ করে বলতে লাগলেন, ‘আমার পরিচয় জিজ্ঞেস করতে এসেছিস? আমি কে এখনো চিনতে পারছিস না? এক মুহূর্তের মধ্যে চিনতে পেরে যাবি।’
আমি কিছু একটা বলতে পারার আগেই মহিলাটি আমার দিকে এগিয়ে গেলেন এবং ল্যাম্পটা মাটিতে রেখে তার হাতটা আমার দিকে এগিয়ে দিলেন। সূঁচলো নখগুলি একটা তরবারির মতো দেখাচ্ছিল। আমি ভয়ে দুই পা পিছিয়ে এলাম। কিন্তু শেষ রক্ষা হল না। তাঁর সেই হাতটা দিয়ে আমার গলা চেপে ধরলেন। আমি নিঃশ্বাস নিতে পারছি না। আমার মুখ দিয়ে অস্ফুট গোঙ্গানি বের হতে লাগল। তুফানে ছিটকে পড়া একটা গাছের মতো আমি মেঝেতে গড়িয়ে পড়লাম। তারপরে আমার আর কিছু মনে নেই।
যখন জ্ঞান ফিরে এল, আমি প্রথমেই চোখ খুলতে পারলাম না। জানালা দিয়ে প্রবেশ করা আলো আমার চোখ ধাঁধিয়ে দিল। তথাপি চোখ মেলার চেষ্টা করলাম। সামনে দেখতে পেলাম একজন অপরিচিত বৃদ্ধ মানুষ।
‘আর ইউ ওকে প্রণামিকা?’–তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন। তাঁর সাজ-পোশাক কিছুটা ইউরোপীয় ধরনের। তিনি আমার দিকে তাকিয়ে ছিলেন এবং ঘনঘন আমার হাতে নাড়ি পরীক্ষা করেছিলেন। তাঁর কাঁধ থেকে ঝূলে থাকা স্টেথোস্কোপটা দেখে আমি তাকে একজন চিকিৎসক বলে অনুমান করলাম। প্রমোদ স্যারও কিছুক্ষণ পরে তাই বললেন. ‘তোমাকে অচেতন হয়ে পড়ে থাকতে দেখে আমি তখনই একজন ডাক্তারের সন্ধান করেছিলাম। ইনি নিজেই এসে উপকার করলেন।’
আমি চিকিৎসকের দিকে কৃতজ্ঞতার দৃষ্টিতে তাকালাম এবং তাঁর প্রশ্নের উত্তরে মাথা নেড়ে বললাম, ‘হ্যাঁ, এখন আমি ভালো আছি।’
আমিনা, বসন্ত, পাপড়ি , আব্দুল, আদিত্য, মৃন্ময়, গায়ত্রী, অনিন্দিতা–প্রত্যেকেই আমাকে ঘিরে ছিল। আমার হঠাৎ কী হল তা জানার জন্য অধীর হয়ে উঠেছিল। রাতের কথাগুলো মনে পড়ায় আমি পুনরায় একবার কেঁপে উঠলাম এবং কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে সমস্ত কিছু বলে ফেললাম। সেই অপরিচিত নার্সটির কথা শুনে সবাই বজ্রাহত কপৌর মতো হয়ে পড়ল। এমনকি ভূতের ভয় না করা আদিত্য হঠাৎ জিজ্ঞেস করল, ‘কে হতে পারে সে?’
‘সিস্টার এমিলিয়া’–আমার পাশে থাকা চিকিৎসকটি বলল। আমি প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাঁর দিকে তাকালাম। তিনি বললেন ‘কাল রাতে তোমার কাছে আসা নার্সটি ছিল এবং তিনি বলা সেই গ্ৰেইসন নামের মানুষটা হলেন আমার পিতা ডঃ ফ্রেডেরিক গ্রেইসন।’
ঘরে থাকা প্রত্যেকেই উৎসুক হয়ে উঠল। প্রত্যেকের দৃষ্টি চিকিৎসকের মুখে নিবদ্ধ।
‘হ্যাঁ, আমি সেই ডক্টর ফ্রেডেরিক গ্ৰেইসনের পুত্র অলিভার গ্রেইসন। ঘটনাক্রমে আমিও চিকিৎসক।’–বৃদ্ধ চিকিৎসক বলতে লাগলেন, ‘তোমার অবস্থার কোথায় জানতে পেরে আমি এখানে দৌড়ে এসেছি, কেননা এই বাড়িটার ইতিহাস আমি জানি।’ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে তিনি পুনরায় বললেন, ‘বলতে গেলে এই ঘটনাটির সূত্রপাত হয়েছে অতীতের এক সাংঘাতিক ভুল থেকে।’ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে তিনি পুনরায় আরম্ভ করলেন সেই কাহিনি, ‘সিস্টার এমিলিয়া এবং আমার পিতা ফ্রেডেরিক গ্রেসনের পরিচয় এই হাসপাতালেই। হ্যাঁ, এই বাড়ির পাশে একসময় রেডক্রসের একটি হাসপাতাল ছিল। এবং প্রেমের বাঁধনে বাধা পড়েছিল। কিন্তু বাবাকে হঠাৎ লন্ডনে প্রত্যাবর্তন করতে হওয়ায় এমিলিয়া এখানে থেকে যায়। আমার পিতা এমিলিয়াকে দ্রুত ফিরে আসার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল।
এমিলিয়াও গভীর প্রেম এবং বিশ্বাসের সঙ্গে মিস্টার গ্রেইসনের জন্য অপেক্ষা করছিল। কিন্তু গ্রেইসন আর কোনোদিনই ফিরে এলেন না। ঘর সংসার করে তিনি ইংল্যান্ডেই থেকে গেলেন। আমার জন্মও ইংলন্ডেই। জীবনের মাঝ বয়সে আমি এখানে এসেছি।’
‘এমিলিয়ার শেষ পর্যন্ত কী হল?’– আদিত্য জিজ্ঞেস করল।
অলিভার গ্রেইসন দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে বললেন, ‘ হতাশায় ভেঙ্গে পড়েছিল এমিলিয়া। ফ্রেডেরিক গ্রেইসনের বিয়ের খবর পেয়ে তিনি আর স্থির থাকতে পারলেন না। আত্মহত্যা করে এই পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেন। ততদিনে বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়েছে। তাই সমস্ত নার্স ডাক্তার স্বদেশে ফিরে গিয়েছিল। কিন্তু ফিরে যায়নি সিস্টার এমিলিয়ার অতৃপ্ত আত্মা। হয়তো চিরদিনের জন্য অপেক্ষারত হয়ে এখানে থেকে গেলেন তিনি। এই কোয়ার্টারে। অনেক রাতে আমি আর্তনাদ শুনেছি। এই কোয়ার্টারে কাউকে হৃদয় ভাঙ্গা আর্তনাদ করতেও শুনেছি। হয়তো দুর্ভাগ্যবশত তুমিও তাকে দেখতে পেলে। নাট্য সমিতিকে আমি বারবার মনে করিয়ে দিয়েছিলাম যাতে এখানে কাউকে রাখা না হয়। কিন্তু তারা আমার কথা শুনল না।’
কিছুক্ষণ আমরা সবাই স্তব্ধ হয়ে রইলাম। তখনই আমিনা জিজ্ঞেস করল, ‘আচ্ছা স্যার, আপনার পিতা এমিলিয়ার শেষ খবরটা পেয়েছিল কি?’
‘ হ্যাঁ পেয়েছিল। পিতার মৃত্যুর পরে মা আমার হাতে বাবার কয়েকটি ডায়েরি তুলে দিয়েছিল। বাবা লিখে যাওয়া সেই ডাইরি কয়েকটি পড়েই আমি সমস্ত কথা জানতে পেরেছিলাম। সেই তখনই এখানে আসার জন্য উৎসুক হয়ে উঠেছিলাম। সিস্টার এমিলিয়া বাবাকে লেখা একটা চিঠির কথাও বাবা ডায়েরিতে উল্লেখ করেছিলেন। কিন্তু চিঠিটা আর খুঁজে পাওয়া যায়নি।’
‘ বর্তমানে আপনি কোথায় থাকেন?’ গায়ত্রী ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করল।
পাশেই তেরাস্তার ডানদিকে থাকা বাংলোটাতে আমি থাকি। মায়ের মৃত্যুর পরে লন্ডন থেকে আমি চলে এসেছিলাম। এখানেই চেম্বার খুলে প্র্যাকটিস আরম্ভ করলাম। রোগিদের মধ্যে বেশিরভাগ সময় অতিবাহিত করি।
‘তবে ডাক্তার সাহেব, আমাদের রোগি আজ নাটক করতে পারবে কি? অবশ্য একটা সাংঘাতিক নাটক সে ইতিমধ্যে দেখিয়ে ফেলেছে।’– আদিত্য আমাকে ঠাট্টা সুরে বলে কথাটা শুনে আমি আশ্চর্য হলাম। এত কিছুর পরেও সে কথাটা বিশ্বাস করেনি?
ডক্টর অলিভার গ্রেইসন হো হো করে হেসে উঠলেন এবং বললেন, ‘এখন ও সম্পূর্ণ সুস্থ। ও সুন্দর নাটক করতে পারবে। কেবল মাঝেমধ্যে ওআরএস খেলেই হল। আমার শুভেচ্ছা রইল। নাটক দেখতে আমিও আসব।’–এই বলে ডক্টর অলিভার গ্রেইসন ঘর থেকে প্রস্থান করলেন। আমরা তাকে আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানালাম। প্রমোদ স্যার দিতে চাওয়া ফিস তিনি নিলেন না। উল্টে ওআরএসের দুটো প্যাকেট রেখে গেলেন।
হঠাৎ আমার কিছু যেন মনে পড়ল। আমি আমাদের শোবার ঘরের সামনের করিডরটার দিকে দৌড়ে গেলাম। আমাকে এভাবে দৌড়াতে দেখে সবাই আমার পেছন পেছন এল। করিডরটার পাশে জিনিসটা তখনও জ্বলছিল ।
হ্যাঁ, ঠিকই। হাজার বছরের পুরোনো অসংখ্য দাগ তথা সকলের ভরা সিস্টার এমিলিয়ার ল্যাম্পটা তখনও টিমটিম করে জ্বলছিল, কখনও মুছে না যাওয়া একটা অপ্রিয় ঘটনার অস্তিত্ব হয়ে।

লেখক পরিচিতিঃ গল্পকার গহনা চক্রবর্তীর জন্ম ২০১০ সনে। শৈশব থেকেই লেখালিখিতে আগ্রহী। গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। ভারত সরকারের সাংস্কৃতিক মন্ত্রালয়ের অধীনে সিসিআরটি করা অনুষ্ঠানে ২০২২-২৩ বর্ষের রাষ্ট্রীয় প্রতিভাসন্ধানী পরীক্ষায় সৃজনীমূলক সাহিত্য বিষয়ে বৃত্তি লাভ করেছে। গহনা গুয়াহাটির শিলপুখুরীর নিবাসী মনোজ চক্রবর্তী এবং মণিকা দেবীর কন্যা। পিতা মনোজ চক্রবর্তী একজন প্রখ্যাত শিল্পী এবং মণিকা দেবী অসমিয়া সাহিত্যের একজন প্রতিষ্ঠিত গল্পকার।
বাসুদেব দাস
১৯৫৮ সনে অসমের নগাঁও জেলার যমুনামুখে বাসুদেব দাসের জন্ম হয়।শৈশব কেটেছে গুয়াহাটি শহরে। ১৯৮২ সনে গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্য ও ভাষা তত্ত্বে এম এ করেন। আজ পর্যন্ত অসমিয়া অনূদিত গল্পের সংখ্যা তিনশো ষাটের ও বেশি।সম্প্রতি NEINAD এর পক্ষ থেকে অসমিয়া ভাষা-সংস্কৃতির প্রচার ও প্রসারের জন্য Distinguished Life Membership এর দ্বারা সম্মানিত করা হয়।





