রাত যিতনিহী সঙ্গিন হোগি
সুবহা উতনিহী রঙ্গিন হোগি।
[রাত যতই গহীন-অন্ধকার হবে, ততই ঝলমলে হবে প্রভাত]
হিন্দি গানের খ্যাতিমান গীতিকার সাহির লুধিয়ানভি (১৯২১-১৯৮০)-কে নিয়ে অল্প পরিসরে লিখতে চাওয়া ধৃষ্টতা। অসম্ভবও। অনুকূল অবকাশে হয়তো এই মহান গানের কবিকে নিয়ে বড় পরিসরে লিখব। আপাতত তাঁর কিছু বিখ্যাত গানের লাইন স্মরণ করা যাক। তু হিন্দু বনেগা না মুসলমান বনেগা [ধূল কা ফুল ১৯৫৯], চল উড়্ যারে পাঞ্ছি [ভাবি ১৯৫৭], আভি না যাও ছোড়্ কার [হাম দোনো ১৯৬১], মেরে মেহবুব কাহি ঔর মিলা কর মুঝসে [গজল ১৯৬৪] এমনি আরও কত। একেবারে শেষ দিকের রচনা কাভি কাভি (১৯৭৬) ছবির সেই শিরোনাম-গান ‘কাভি কাভি মেরে দিলমে খয়াল আতা হ্যায়’ তো ক্লাসিকের পর্যায়ে উন্নীত। এক-একটি গান নিয়ে স্বতন্ত্র রচনা হতে পারে। কোন্ খ্যাতিমান শিল্পী তাঁর বাণী কণ্ঠে ধারণ করেননি! আজ শুধু মহম্মদ রফি কথাই হোক। রফির কণ্ঠে তাঁর কিছু গান কালের সীমা অতিক্রম করে মহাকালের দিকে ধাবমান। ‘ধূল কা ফুল’ ছবির ‘তু হিন্দু বনেগা না মুসলমান বনেগা’-এর মতো বিশ্বমানবতার গান নিয়ে আলাপ সংক্ষিপ্ত হবে কী করে? কিংবা ‘হাম দোনো’ ছবিতে সহশিল্পী আশা ভোসলের সঙ্গে গাওয়া ‘আভি না যাও ছোড়্ কর’? হাওয়া জারা মেহেক তো লে নজর জারা বেহেক তো লে ইয়ে শাম ঢল তো লে জারা এই দিল সমহালতো লে জারা ম্যায় থোরি দূর জি তো লুঁ নাশেকে ঘুঁট পি তো লু আভি তো কুছ কাহা নেহি আভি কুছ সুনা নেহি আভি না যাও ছোড়্ কর কে দিল আভি ভারা নেহি।… প্রথম অন্তরায় [নাকি মুখড়াতেই?] প্রায় এক নিশ্বাসে এতোগুলো কথা বলার পরও অতৃপ্ত নায়ক বলছে: ‘এখনো তো কিছু বলা হয়নি, কিছুই শোনা হয়নি!’ এই অফুরান গল্প অল্প কথায় শেষ করা সম্ভব? মহম্মদ রফিকে ভালোবেসে তাঁরই কণ্ঠ ও গায়কী অনুকরণ-অনুসরণ করে গাইতেন মহেন্দ্র কাপুর। মহেন্দ্র কাপুরের জীবনের জীবনের সেরা গানের কথা বলতে গেলে যে-গানটি অনিবার্যভাবে প্রথমে আসে, তা অবশ্যই ‘চলো ইকবার ফিরসে আজনবি বনযায়ে হাম দোনো’। এবং এর রচয়িতাও সাহির। আবু সয়ীদ আইয়ুব ‘গালিবের গজল থেকে’ বইয়ের শেষাংশে কথাপ্রসঙ্গে সাহিরের কবিতার অংশবিশেষ অর্থসহ উদ্ধৃত করলেও কবির নাম উল্লেখ করার তাগিদ অনুভব করেননি। শুধু বলেছেন ‘একজন উর্দু কবি’।
সাহিরের নাম কোনোভাবেই গালিবের কাতারে উচ্চারিত হওয়ার কথা নয়। আবু সয়ীদ আইয়ুব যে-অংশটুকু উদ্ধৃত করেছেন, তা বিশেষ কারণে উল্লেখযোগ্য : ‘ইক শাহেনশাহনে দৌলৎ-কা সাহারা লেকর হাম গরিবোঁ-কী মুহব্বত-কা উড়ায়া হৈ মজাক।’ [এক শাহেনশাহ অঢেল ধনভাণ্ডারের সুযোগ নিয়ে আমাদের মতো সামান্য লোকের প্রেমকে পরিহাস করেছেন।] সেই প্রথম, শাহজাহানের অমরকীর্তি তাজমহলকে নিয়ে এন্টি-রোমান্টিক কবিতা লিখলেন কেউ! গজল (১৯৬৪) ছবিতে এই গানের (প্রথম পঙক্তি : ‘মেরি মেহবুব কাহি ঔর মিলাকর মুঝসে’) সঙ্গে ঠোঁট মিলিয়েছেন সে সময়ের প্রখ্যাত নায়ক সুনীল দত্ত। শের-শায়েরীতে মোড়া এ ছবির নায়িকা ছিলেন ‘ট্র্যাজেডি কুইন’ মীনা কুমারী। সাহির লুধিয়ানভির এইসব মাস্টারপিস নিয়ে খুচরো আলাপ ধৃষ্টতা নয় তো কী! কিন্তু সুপরিসর আলোচনার অনুকূল অবকাশ যদি আর আদৌ কখনো না আসে! অতএব সামান্য অর্ঘ্য রেখে যাওয়াই উচিত। মূলত সিনেমার প্রয়োজনেই প্রযোজক-পরিচালকের চাহিদা মোতাবেক গান লিখেছেন সাহির। স্বাভাবিকভাবেই সেসব গানে প্রেম মূখ্য। আছে বিরহ। দ্রোহও আছে তাঁর গানে। দার্শনিকতার ছোঁয়ালাগা আশাবাদও আছে। হতাশায় ভরা এই অস্থির সময়ে সাহির লুধিয়ানভির লেখা ‘মোটিভেশনাল’ একটি গানের প্রসঙ্গ দিয়ে আলোচনার ইতি টানা যেতে পারে। খুবই অল্পশ্রুত এই গানটি সোনে কা চিড়িয়া [১৯৫৮] ছবির জন্য লিখেছিলেন সাহির। সঙ্গীত পরিচালক ওপি নাইয়ার। কণ্ঠশিল্পী মহম্মদ রফি। গানের দৃশ্যে দেখা যাচ্ছে, জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণ হয়ে গভীর রাতে নায়িকা নূতন আত্মহত্যা করতে যাচ্ছে। অথৈ পানিতে ঝাঁপ দেওয়ার ঠিক আগ মুহূর্তে দূর থেকে তার কানে আসে একটি উদাত্ত কণ্ঠ। কিছুক্ষণের জন্য থমকে যায় নূতন। কেউ একজন গাইছে : মউত কাভিভি মিল সকতে হ্যায় লেকিন জীবন কাল না মিলেগা… [গানটির ভাবানুবাদ:] মৃত্যুকে যেকোনো সময় আলিঙ্গন করা যাবে চাইলে এখনই, কিন্তু জীবনকে আর পাবে না তুমি! জীবনবিমুখ হে মৃত্যুপথযাত্রী, একটু থামো একটু ভাবো এখনই এই সময়টুকু আর ফেরত পাবে না তুমি। অন্ধকার তো রাতের ঘরে আসা ক্ষণিকের অতিথি [ক্ষণস্থায়ী সে, চলে যাবে!] ভোরকে রুখবার সাধ্য কার রাত যতই গহীন-অন্ধকার হবে ততই ঝলমলে হবে প্রভাত। ঠোঁটে অভিযোগ আসতে দিও না অশ্রু গড়িয়ে পড়তে দিও না, শুষে নাও! যেভাবে পারো টিকে থাকো বেঁচে থাকো আরও কিছুক্ষণ দুঃখের আস্তানা উড়িয়ে দেবার লগ্ন ওই সমাগত! এসো, বাঁচার তদবির-কৌশল খুঁজি একসাথে সুখস্বপ্নের অর্থ খুঁজি খাবনামায় যে-দুঃখ তোমার, সে তো আমারও।।