Home » যতীন সরকারঃ দ্রোণাচার্যের দর্শন লাভ ।। পর্ব-৩ ।। লীনা দিলরুবা

যতীন সরকারঃ দ্রোণাচার্যের দর্শন লাভ ।। পর্ব-৩ ।। লীনা দিলরুবা

পাঁচ.
এবার জানতে চাইলাম, তাঁর পিতা সম্পর্কে।

পিতার কথা মনে করে এবং তাঁর অসাধারণ পরিবারটির কথা ভেবেই হয়ত স্যারের চোখ আর্দ্র হয়ে উঠল। ছোটবেলা থেকেই বাড়িতে ছিল বইপড়ার চমৎকার পরিবেশ, এ কারণে অল্পবয়সেই তিনি রাজ্যের বই পড়ে ফেলেছিলেন।

তাঁদের বাড়িতে সারাক্ষণই জ্ঞানচর্চা হত। যেমন, হয়ত তাঁর মা শ্বশুরের কাছে খাওয়ার জন্য এক গ্লাস দুধ নিয়ে গেছেন, শ্বশুর বলতেন, বৌমা, কি আনলে?

বাবা, দুধ।
না। হল না।
সঠিকভাবে বলো। অর্থাৎ সংস্কৃতে।
দুগ্ধ।

এমনিভাবে দই নয়, দধি।


বাড়িই যখন পাঠশালা হয়ে যায় তখন তাকে স্বর্গ ভিন্ন আর কী বলব!

স্যারের পিতা শতায়ু পেয়েছেন। আমি বললাম, স্যার আপনিও আপনার বাবার মতো শতায়ু হবেন। স্যার হেসে উঠলেন, হ্যাঁ, হতে পারি, আমার কোনো মরণরোগ নাই।

স্যারের কথাটার তাৎপর্য কল্পনা করে চুপ মেরে গেলাম। কিছুক্ষণ মুখে কথা সরলো না।

এর মধ্যে আমি স্যারের বেশকিছু ছবি তুলে ফেলেছি। ঘরে রাখা বইপত্র, মানপত্র, ক্রেস্ট, ফ্রেমের বাঁধাই করা ছবি মোবাইলে জমা করতে করতে গুছিয়ে নিচ্ছি প্রস্থানের ভাবনা। রাজীব সরকার ‘ওহ, পিসি এসেছেন!’ বলতেই ভাবনা ছুটে গেল, ঘাড় ঘুরিয়ে আবিষ্কার করলাম এক সৌম্যদর্শন নারীকে। রাজীব সরকার পরিচয় করিয়ে দিলেন, ইনি স্যারের একমাত্র বোন, মায়া সরকার।

দেখা না-হলেও শাশ্বত মাতৃমূর্তি এ-ভদ্রমহিলাকে আমি ভালোভাবেই জানি। তাঁর জ্যেষ্ঠপুত্র ডাক্তার অনির্বাণ সরকার আমার এবং আমার অগ্রজের প্রিয়জন, খুব কাছের মানুষ। যতীন সরকারের যোগ্য ভাগ্নে ডাক্তার অনির্বাণের কথা সবিস্তারে বলতে হলে এখন আমাকে একঝুড়ি গল্প হাজির করতে হবে, অর্থাৎ তাঁকে নিয়েই লেখা যায় দীর্ঘ প্রবন্ধ। অনেকবছর ধরেই তিনি আমাদের পারিবারিক বন্ধু হয়ে আছেন। তাঁর লেখাপড়ার পরিধি এবং ব্যক্তিত্ব দুটোই আমাকে মুগ্ধ করে। পিসিকে বললাম সেটি। তিনি স্মিত হাসলেন। আমাকে তাঁদের ঘরে যেতে আহ্বান জানালেন, বললাম, অবশ্যই যাব। স্যারের সঙ্গে কথা শেষ করেই আসছি।

পিসি বা মায়া সরকার এক ঐতিহাসিক চরিত্র বটে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় যতীন সরকার পরিবারের অধিকাংশ সদস্যদের নিয়ে প্রাণের ভয়ে ভারতের মেঘালয়ের ‘বাঘমারা শরণার্থী শিবিরে’ আশ্রয় নিয়েছিলেন। মায়া সরকার তখন বাংলা অনার্সের ছাত্রী। ডিসেম্বরের ছয় তারিখে যখন ভারত সরকার স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি জানালো মেঘালয়ের শরণার্থীরা এ-নিয়ে রীতিমত উত্তেজিত। ভারত আর ভুটানের স্বীকৃতির সংবাদ প্রচারিত হলে বাঘমারায় শরণার্থীদের এক বিরাট মিছিল বের হয়। সেখানে প্রচুর মহিলাও যোগ দেন। মিছিলের অগ্রবর্তী দলের একজন সদস্য ছিলেন মায়া পিসি।

আবার স্যারের মুখোমুখি বসলাম।

যতীন সরকারের লেখার সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিচরিত্রের অন্বয় ঘটিয়ে যে-চিত্রটি ফুটে ওঠে তা যেন আজ পূর্ণতা পেল।

‘কবিরে পাবে না তার জীবন চরিতে’- রবি ঠাকুরের এই অমোঘ বাণীর যথার্থতা যেন আজ আর মেনে নিতে পারলাম না। যে যতীন সরকারকে এতদিন কেবল কল্পনা করেছি, আজকে তাঁর মতামত, অভিব্যক্তি, তর্ক-যুক্তি ইত্যাদি প্রকাশে প্রতি পদক্ষেপে একই ছাঁচ আবিষ্কার করে আমার মন আনন্দে নেচে উঠল।

তাঁর পুত্র-কন্যাদের সম্পর্কে জানতে চাইলাম। তিনি রাজীব সরকারকে তাঁদের পারিবারিক ছবিটি দেখাবার অনুরোধ করলেন। স্যার দুই পুত্র-কন্যা সন্তানের জনক। ছেলে সুমন সরকার সপরিবারে দেশের বাইরে থাকেন, কন্যা সুদীপ্তা সরকার যুগ্ম জেলা জজ। সুদীপ্তা গান করেন, আবৃত্তিও করেন। তবে তিনি যে খুব ভালো রাঁধেনও সেটি একটু পরেই আবিষ্কার করা গেল।

কথা ছিল দ্বিপ্রাহরিক ভোজ সংক্ষিপ্ত হবে। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল ভিন্ন চিত্র। খাবারের আয়োজন তো নয় যেন এলাহি কারবার। স্যার, আম খেয়ে নাকি উদর পূর্ণ করে ফেলেছেন, তাই খাবারের টেবিলে তিনি আমাদের সঙ্গে যোগ দিলেন না। অনেক অনুরোধে স্যারের কন্যাকেও বসানো গেল না, বরং খাবার পরিবেশনেই তাঁকে অধিক আগ্রহী মনে হল। খেতে খেতে গল্প করছিলাম স্যারের গুণী কন্যাটির সঙ্গে।

পিসতুতো ভাই অনির্বাণের প্রসঙ্গ উঠলে সুদীপ্তাকে জানালাম, অনির্বাণকে আমি ভালো মত চিনি এবং জানি। সুদীপ্তা এতে আনন্দ পেলেন। আলাপের ফাঁকে জানালেন, এই ভাইটিকে তিনি ‘পাখি’ বলে ডাকেন। দুজনের বয়সের ব্যবধান মাত্র আটঘণ্টার। সুদীপ্তা খুব মজা করেই বললেন, তাঁর মা এবং পিসির যখন সন্তন হল তখন বাড়ির একমাত্র আঁতুড় ঘরে বৌদি-ননদ দুই নারীকে একইসঙ্গে রাখা হয়েছিল। সুদীপ্তা আরো বললেন, অনির্বাণ এবং তাঁর নিজের বিয়ে খুব কাছাকাছি সময়ে হয়েছে, সন্তান জন্মের দিন-তারিখেও তাদের দুজনের বেশ মিল আছে। সেদিনের সুদীপ্তার রান্নার ইলিশ মাছটা চমৎকার ছিল। মুগ দিয়ে তৈরি করা লাউডালও রসনা তৃপ্ত করেছিল। খাবারের পর দই খেয়ে আমার যখন নড়াচড়াই কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে, মনে মনে ভাবছিলাম, কী খেলাম, দই না দধি?

ছয়.
কথা ছিল খাওয়া-দাওয়া সেরে আমরা স্যারের ভাইবোনদের বাড়িতে ঘুরে আসব, ততক্ষণে নান্নু লাঞ্চ সেরে নেবে। রাজীব সরকার নান্নুকে খাওয়ার টেবিলে যত্ন করে বসিয়ে দিয়ে আমাকে নিয়ে ‘বানপ্রস্থে’র আরেক ঘরে স্যারের অনুজ মতীন্দ্র সরকারের কাছে রওনা করলেন।

বানপ্রস্থের তিনটি ঘরের মধ্যখানে ছায়াঢাকা মসৃণ পথ। রোদের তীব্রচ্ছটা চারদিকে ভিন্ন এক কুহকী পরিবেশ তৈরি করেছে। বেশ গরম পড়েছে, বাড়িটিতে এত গাছপালা তবু গরমবাবাজি কেবল শূন্যের কুহকে নেচে বেড়াচ্ছে, কমছে না।

মতীন্দ্র সরকার অগ্রজের চেয়ে কোনো অংশে কম নন। তিনি আরেক সাম্রাজ্য নিয়ে বসে আছেন। রাজীব সরকার আমার পরিচয় দিতেই তিনি একগাল হাসলেন। যতীন স্যারের মতোই তাঁর হাসিও সরল। বসার ঘরের চারদিকে রবীন্দ্রনাথের ছবি। তিনি স্থানটিকে নাম দিয়েছেন ‘রবীন্দ্র চর্চা কেন্দ্র’। জানা গেল, এই ঘরে ‘রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তী’তে অনুষ্ঠানাদি হয়। রবীন্দ্রনাথের ছবির একপাশে গৌতম বুদ্ধের একটি ছবিও লক্ষ করলাম।

ঘুরে ঘুরে সবকিছু দেখে অনুভব করলাম, আজ বোধহয় ভুল করে কোনো তীর্থস্থানে এসে পড়েছি। একটি পরিবারের সব মানুষ কীভাবে সত্য আর সুন্দরের চর্চা করেন এটা রীতিমতো গবেষণার বিষয়।

মতীন্দ্র সরকারের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে এবার যাওয়া হল অধ্যাপক উপেন্দ্র কুমার সরকারের অর্থাৎ মায়া পিসির ঘরে। দুই ভাইয়ের ঘর একতলা, এটি দোতলা। নিচতলাটা ফাঁকা, দোতলায় সিঁড়ির মুখে জুতো রেখে আমরা উপরে উঠলাম। পবিত্রতার চিহ্নবাহী ঘরটা কেবল পরিচ্ছন্নই নয়, চারদিকে সবুজ বৃক্ষের মধ্যে ঘরটি যেন সাদা গোলাপের মত ফুটে আছে।

পিসির সঙ্গে পরিচয়পর্ব আগেই শেষ হয়েছে। পিসেমশাইকে দেখলাম এবার। যতীন স্যারের সহধর্মিণী যেমন বেশ অসুস্থ, স্যারের ভগ্নিপতি উপেন্দ্র্র স্যারের অবস্থাও তেমন। হলে কী হবে, মুখে হাসির কমতি নেই। জানা গেল, তিনি দীর্ঘকাল ঢাকার হলিক্রস কলেজে অধ্যাপনা করেছেন। তাঁদের আদি বাড়ি সুনামগঞ্জ। আগেই রাজীব সরকার জানিয়েছিলেন, সুনামগঞ্জের সঙ্গে নেত্রকোনার যোগাযোগের ঐতিহ্য রয়েছে। দুটো জেলার সীমানা লাগোয়া।

দেখলাম রাজীব সরকারকে পিসি বেশ স্নেহ করেন। কথা প্রসঙ্গে পিসি এমনও বললেন, রাজীব যতীন সরকারের যোগ্য জামাতা। পেশায় সরকারের একজন ডেপুটি সেক্রেটারি, রাজীব সরকার লেখালেখি করেন। তাঁর লেখা বেশ কিছু গ্রন্থ আছে। এর আগেই স্যারের বাসায় অবস্থানকালে তাঁর লেখা দুটো গ্রন্থ তিনি আমাকে উপহার দিয়েছিলেন।

পিসি এবং পিসেমশাইয়ের সঙ্গে আমরা অনির্বাণকে নিয়েও আলাপ করলাম। পিসির কাছে জানতে চাইলাম তাঁর পুত্রটি শান্ত কিনা। পিসি হাসলেন, হ্যাঁ, শান্ত। আগেও কি এমন শান্ত ছিল? আমার এমন প্রশ্নে পিসি হাজির করলেন অনির্বাণের দুষ্টুমির নানা গল্প। ছোটবেলায় তিনি নাকি পলিথিনের মধ্যে পানি নিয়ে সেটি ফুটো করে ঘরের মধ্যে ঘুরে বেড়াতেন। আমরা সবাই কথাটা শুনে হেসে উঠলাম। আরেকটি গল্প বললেন পিসি, ছোটবেলায় কোথাও বেড়াতে যাবার আগে পিসি পুত্রকে সাবধান করে দিতেন, কোনো দুষ্টুমি করবে না, কেমন? অনির্বাণ নাকি তখন উত্তর দিতেন, ‘আগে তো যাই!’ আবার একরাশ হাসির হররা উঠল।

সময় গড়িয়ে যাচ্ছে। আমাকে ফিরতে হবে। অবশ্য তখনো যতীন স্যারের সঙ্গে বিদায়ের বিষয় বাকি। পিসির বাসা থেকে ফের স্যারের ঘরে এলাম।

অসাম্প্রদায়িক চেতনার প্রতিভূ যতীন সরকারের চরিত্রে দেখেছি আধুনিক সমাজমনস্কতার সম্মিলন। তিনি এই-প্রত্যয়ে জীবন অতিবাহিত করেন, ‘সত্য কখনো একমাত্রিক নয়, ভিন্ন ভিন্ন মাত্রাগুলোর দিকে দৃষ্টি না দিলে সত্য খ-িত হয়ে যায়, আর খ-িত সত্য তো মিথ্যারই সহোদর।’

যতীন সরকারের ওপর এ-পর্যন্ত তিনজন ব্যক্তি পিএইচডি করেছেন। যার একটি মোছা. আমিনা খাতুনের।

আমিনা খাতুন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের একজন শিক্ষিকা। তাঁর ‘যতীন সরকারের প্রবন্ধ : সমাজ, রাজনীতি ও সাহিত্য’ নামের অভিসন্দর্ভটি যখন স্যার আমাকে দেখালেন, সত্যিকার অর্থে গর্বে বুক ভরে গেল। মনে পড়ে গেল সক্রেটিসের কথা। সক্রেটিস সম্পর্কে বলা হয়, তিনি এমন এক দার্শনিক চিন্তাধারার জন্ম দিয়েছিলেন যা পাশ্চাত্য সংস্কৃতি এবং সভ্যতাকে বিপুলভাবে প্রভাাবিত করেছিল। মার্কসবাদে বিশ্বাসী, আমাদের দেশের এই বিশিষ্ট চিন্তাবিদের নাম ইতিহাসের কোন পরিসরে দেখা যাবে এ-প্রশ্নটি ভবিষ্যতের কাছেই জমা রাখা গেল। আপাতত তাঁর লেখা গ্রন্থপাঠ করে যথাসম্ভব শিক্ষা গ্রহণ করার মানসে নিজেকে একলব্য কল্পনা করে আমার দ্রোণাচার্যের কাছ থেকে বিদায় নিলাম।

—– সমাপ্ত——–

পর্ব-২: http://www.uthon.com/%E0%A6%86%E0%A6%B0%E0%A7%8D%E0%A6%95%E0%A6%BE%E0%A6%87%E0%A6%AD/80

Ajit Dash

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ভাষা
Scroll to Top