Home » জীবনবৃক্ষে ঝুলে আছে “জীবনের আপেল” পাঠপ্রদীপের আলোয় ওমর শামস এর কবিতা // গৌরাঙ্গ হালদার 

জীবনবৃক্ষে ঝুলে আছে “জীবনের আপেল” পাঠপ্রদীপের আলোয় ওমর শামস এর কবিতা // গৌরাঙ্গ হালদার 

সভ্যতার যাত্রাপথে মানুষের সঞ্চয় আছে। আবার সে হারিয়েও ফেলেছে বহুকিছু। মানুষের হাতে ধ্বংস হয়েছে মানুষের আবাস ও আঙিনা। ধ্বংস হয়ে গেছে মানুষের অমূল্য সব সৃষ্টিসম্ভার। কিন্তু আত্মরক্ষার তীব্র তাগিদের সঙ্গে সঙ্গে, মানুষ তার বুকের গভীরে লুকিয়ে এনেছে নতুন সৃষ্টির বীজ। অনাবাদী জমিনে সেই বীজ জন্ম দিয়েছে নতুন সভ্যতার। মানুষ হারিয়ে যেতে দেয়নি তার কথা বলা। সে খোদাই করে রেখেছিল অক্ষর – মাটিতে, পাথরে, লোহায়, কাঠে। হৃদয়ের তন্ত্রীতে করে নিয়ে এসেছিল সঙ্গীত আর কবিতা।

মানুষের সাহিত্য সৃজনের ইতিহাসে কবিতা এতো প্রাচীন অথচ সে আজও অপূর্ব নবরূপা। কবিতার এই নব নব রূপের রহস্য কী? সে কি জীবনের সাথে গোপন অভিসারের জন্য, নাকি রূপরস আস্বাদনে চির-অতৃপ্তির বেদনার বিষে? আর সেই বিষ যে জরা বিনাশী কোনো সুধা নয় তা-ই বা কে জানে।

দুনিয়াজুড়ে মানুষকে যন্ত্র বানাতে পুঁজিতন্ত্র আজ দারুণ সফল। পুঁজির সাফল্যের মানদণ্ডে কবির সাধনা আসলে ব্যর্থতার। সাধনা ব্যর্থতার হলেও একজন কবি যখন “জীবনের আপেল” বলে পাঠককে তার কবিতার আসরে আহ্বান করেন, তখন তাকে প্রত্যাখ্যান করা আসলে খোদ জীবনকে প্রত্যাখ্যান করার শামিল। কেননা জীবনের আপেলেই তো আছে জীবনের স্বাদ, সৌরভ ও বীজ। কিন্তু সেই জীবন-আপেলের স্বাদ নিতে হলে নিজের অন্তরলোকে নিয়ে চিবিয়ে তার রস বের করা চাই।

কবি ওমর শামস তাঁর “জীবনের আপেল” কবিতার প্রথম লাইন “আন্দোলিত” করেছেন “সমুদ্রের উপর সূর্য ডুবে ডুবে সন্ধ্যা এলো” বলে। যে পঙক্তির রঙ অস্তরাগের আবির ছড়ায় তাকে কেন তিনি কবিতার ঊষালগ্নে স্থাপন করলেন? কবি কি সমাপ্তি বিন্দুর আঙ্গুলে সূচনার সুন্দর তিল স্পর্শ করতে চান, নাকি সংসার সমুদ্রের বুকের ওপর ধেয়ে আসা এক প্রস্থ অন্ধকারাচ্ছন্ন যবনিকা দেখছেন? না কি তা ইতিহাসের পর্বান্তরের আভাস?

অন্ধকার যদি না হবে তাহলে অমন বুক চেরা চিৎকারে একটি মাত্র “কে?” শব্দে কবিতার এক পঙক্তি হয় কী করে? অন্ধকারে কোথাও যদি কেউ না থাকে তাহলে এই “কে” প্রশ্নের উত্তর কে দেবে? একজন মহৎ হৃদয় কবি একজন সংবেদনশীল মানুষ। তাই তো তিনি নিজেই এই প্রশ্নের উত্তর নিয়ে আসেন। তিনি বলেন, সে “তোমার জীবন।”

হ্যাঁ, আমাদের জীবনই তো আমাদের সমস্ত প্রশ্নের উৎসভূমি এবং সে নিজেই তার উত্তর সন্ধান করে। এখানে লক্ষণীয় হবে, জীবন নিয়ে শামস তাঁর দার্শনিক উপলব্ধি প্রকাশে, কবিতার বন্ধনে রীতিমাফিক কোনও ফর্মের দিকে যান নাই। ‘নিজের সাথে নিজের কথা’র পাশে বসিয়ে দিয়েছেন “বংশলতিকা” অথবা “আনন্দ” “কান্না”র মতো কেবল অতিচেনা কয়েকটি শব্দ। কয়েকটি সংখ্যা। কিন্তু কয়েকটি ছোট মসৃণ পাথরের মতো পাশাপাশি সাজানো কিছু শব্দ ও রঙহীন সংখ্যাও যে প্রয়োগে কাব্য সুষমার বর্ণিল রত্নে রূপান্তরিত হয়ে যেতে পারে, শামসের এই কবিতাটিতে তার প্রকৃষ্ট নিদর্শন মওজুদ আছে।

এখানে উল্লেখ করা দরকার,  সাহিত্যে বলার ধরণের নিজস্বতার জন্যই তো আমরা কবিতাকে গল্প, উপন্যাস বা প্রবন্ধ থেকে স্বতন্ত্র করি। এই হিসেবে কবিতা রূপহীন (Formless) হতে পারে না। কিন্তু কবিতার চলন বলন এমন যে, সে ঐতিহ্য বিচ্যুত না হয়েও এক রূপের নদীতে দ্বিতীয়বার অবগাহন করে না। আবার ‘যে রূপে বলা হল’ এবং ‘যা বলা হল’ তা-ও যেন কবিতায় সঙ্গত ও সঙ্গীতের সঙ্গমের মতো। আর ঠিক এই সূত্রেই শামস তাঁর কবিতায় গতিশীলভাবে শব্দ ও সংলাপের পায়ে পায়ে এই বলে অগ্রসর হন,  “কতো দূর যাবে!” । কত দূরে যাবে বলে কবি এখানে আসলে ইতিহাস চেতনার ভেতর দিয়ে, মানুষের সীমা ও সম্ভাবনার কথা বলে পাঠককে নতুন ভাবনার পথে ঠেলে দেন।

কিন্তু মহাকালের পটে ধৃত সম্ভাবনাময় ব্যক্তি-মানুষের জীবনের খোঁজে, ইতিহাসের অলিগলি ঘুরে আত্মপরিচয়ের হদিসে কবি নিজেও এসে পড়েন তাঁর জন্ম-মাটিতে। সেখানে এসে দেখেন, বিশ্বজুড়ে মানব চলাচলের তিনি এক স্থানিক ফল। যে ফল তার নিজের ভেতরে ধারণ করে বীজ। বাতাস আবার সেই বীজকে উড়িয়ে নেয় অন্য কোথাও। সুতরাং বিশ্বময় মানব চলাচলের তিনিও একজন। কিন্তু স্থানিক সংকটের ভীমরুল তাঁর পিছু ছাড়ে না। কবি অস্থির হয়ে বলে ওঠেন – “ জীবন? তোমাকে পাই না – বর্তমানে, মুহূর্তে, এই দুটো তেপ্পান্ন মিনিটে। ” – বর্তমানে থেকেও এই “বর্তমান”কে না পাওয়া কি জীবনের ‘এলিয়েনেশন’? এমনও তো হতে পারে, কবি বহুদিন ধরে যাকে আপন বলে জানতেন, এই মাত্র জানলেন যে তাঁর জানা ভুল ছিল। নিজের ভুল পরখ করতে কবি নিজেকেই যখন আবার প্রশ্ন করেন –  “ আমিই কি পথ ভুল করি, না পথ নিজে নিজে বেঁকে ঝুরে যায়? ” তখন সঙ্গতভাবে মানুষের সামনে এই প্রশ্নও হাজির হয়, মানুষের সৃষ্টি কি খোদ মানুষকেই বদলে দেয়?

শামস তাঁর কবিতার শেষ স্তবকে এসে তিনটে গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট উত্থাপন করেছেন। তিনি যখন জীবনের দীর্ঘ সংগ্রামের অভিজ্ঞতার জমিনে দাঁড়িয়ে বলেন – “ ওসব চেরাগ নিবিয়ে দাও। গোল্লাছুট, ঘরপালানো, পাস, চাকরি, উল্লাস, বিষাদ, চুলো। হাঁড়ি, ব্লেড, দেয়ালের ছবি –সব ঝেটিয়ে দাও চোকির তলে। ” – পাঠক তখন টের পেয়ে যাবেন যে, তার জীবন এখন অভূতপূর্ব এক লড়াইয়ের ময়দানে নিক্ষিপ্ত। এই ময়দানে পুরানো দিনের মূল্যবোধ তার চোখে কেবলই ধুলো ছিটিয়ে দেয়।

এর পরের পয়েন্টে তিনি যখন বলছেন – “ হ্যাঁ, দরিয়ারপাড়-রাঙ্গুনিয়ার যে স্মৃতিটুকু তুমি বললে, সে তোমার আঁশ, সুতো, ফ্যাব্রিক। মানে গ্রাভিটেশন যেমন স্থান-কালের চাটাই বুনেছে তেমনি। কিন্তু তুমি হচ্ছো সেই ময়দানে কালে, ক্রান্তিতে লাফিয়ে ওঠা কোয়ান্টা। ” – তখন পৃথিবীর সমগ্র ইতিহাসের ভেতরে আমরা নিজেরাই নিজেদের স্রষ্টা হওয়ার স্পন্দন অনুভব করি। আর এই অনুভবের ভিত্তি হলো – যে মানুষের ভেতরে আমার জন্ম আর যে প্রকৃতিতে শ্বাস নিই তার সাথে আমার সম্পর্কের ইতিহাসে।

তৃতীয় পয়েন্টটিতে শামসের “ জীবনের আপেল ” পেকে উঠেছে একটিমাত্র শব্দে। সেটি হচ্ছে “বিনিময়”। প্রাজ্ঞের মতো তিনি যখন উচ্চারণ করেন, “তোমার জীবন হচ্ছে বিনিময়” – তখন তিনি জীবনের  নিউক্লিক বিশ্বরূপ দর্শন করান। কোনও সন্দেহ নেই,  ওমর শামস এখানে মার্কসীয় বিশ্ববীক্ষার গভীরতর উপলব্ধি প্রয়োগ করেছেন অত্যন্ত নিপুণভাবে।

“ জীবন দরিয়াপাড়ের চেয়ে আরেকটু বড়, বিমূর্তভাবে বড় ” এবং “ আর শুধু জ্যোতি আর গতিটুকুই তুমি” বলে  সবশেষ লাইনে উপসংহার টেনে তিনি একই সাথে দু’টি গুরুত্বপূর্ণ ইশারা করেছেন। ইশারাটি হলো, বিজ্ঞান ও  কবিতায় আসলে ভেদ নেই। জীবন মহাবিশ্বের এক বিস্ময়। মানুষ নিজে এই বিশ্বের চোখ। জীবনকে অনুভব করার সে এক মহাপ্রাণ।

পাঠকের সুবিধার জন্য কবিতাটি নিচে দেয়া হলো:

জীবনের আপেল // ওমর শামস

আন্দোলিত সমুদ্রের উপর সূর্য ডুবে ডুবে সন্ধ্যা এলো।

– কে?
– তোমার জীবন।

– মানে?
– মানে তোমার স্মৃতি, আঁতুড়ঘর, বংশলতিকা, শুপারিগাছ, পুঁইমাচা, গাংশালিখ, দরিয়াপাড়, নৌকা ……তোমার কান্না, সংশয়, আনন্দ, উল্লাস, চীৎকার …… ১৯৪৩, ১৮৭১, ১৬৫৬, ১১৩৩ ……কতো দূর যাবে!

সিগারেটের কুণ্ডলির মধ্যে, কুণ্ডলি ঘুর পাক খেয়ে ওঠে।

–  জীবন? তোমাকে তো পাই না -বর্তমানে, মুহূর্তে, এই দুটো তেপ্পান্ন মিনিটে। শোনো, আমার বাবা -দরিয়াপাড়ে জন্ম নেয়া এক ভবঘুরে যুবক, একদিন রাঙ্গুনিয়ার পাহাড়ি গ্রামে গিয়ে বিয়েকরা থিরহওয়া -বাবার কাছে প্রশ্ন করবার,বাবার জীবনকে জানবার আগেই,সে প্রশ্ন করার সাহস অর্জনের আগেই বাবা মারা গিয়েছেন। দাদুকে দেখিনি,বাবাও দেখেন নি। যিনি কিছু বলেছিলেন, -আমার চাচা বলে যাকে জানতাম -বড়ো হয়ে শুনি তিনি আমার চাচা নন। পথ ভুল হয়ে যায়। আমিই কি পথ ভুল করি,না পথই নিজে নিজে বেঁকে ঝুরে যায়? আর বাবার শোকে কেঁদে কেঁদে বেয়াল্লিশ দিনের মাথায় বংশের শেষ মানুষ দাদীও চলে গেলেন সমুদ্রের কাছে শ্বাস নিতে গিয়ে,রাঙ্গুনিয়া ছেড়ে নিজের জন্মস্থান দ্বীপে গিয়ে পুত্রশোক ভুলতে,ভুলতে ভুলতে সংশয়াক্রান্ত হতে হতে ……মায়ের গল্প কোনোদিন শুনতে পারি নি। কেননা মা সে সুযোগ পান নি বলার। আর আমি হয়ে ওঠার আগেই মা ওপারে। যেখানেই যাই কায়া তো যায়!কিন্তু জীবন

–  ওসব চেরাগ নিবিয়ে দাও। গোল্লাছুট, ঘরপালানো, পাস, চাকরি, উল্লাস, বিষাদ, চুলো। হাঁড়ি, ব্লেড, দেয়ালের ছবি- সব ঝেঁটিয়ে দাও চোকির তলে। হ্যাঁ, দরিয়াপাড়-রাঙ্গুনিয়ার যে স্মৃতিটুকু বললে,সে তোমার আঁশ, সুতো, ফ্যাব্রিক। মানে গ্রাভিটেশন যেমন স্থান-কালের চাটাই বুনেছে তেমনি। কিন্তু তুমি হচ্ছো সেই ময়দানে কালে,ক্রান্তিতে লাফিয়ে ওঠা কোয়ান্টা। তোমার জীবন হচ্ছে বিনিময় – চিন্তার, সংযোগের, সংস্পর্শের, একাকীত্বের -বিনিময়ের মধ্যে থেকে বিচ্ছুরণের। হাড়, গোড়, রগ সব সমাবৃত কর। জীবন দরিয়াপড়ের চেয়ে আরেকটু বড়, বিমূর্তভাবে বড়।

আর শুধু জ্যোতি আর গতিটুকুই তুমি।

Ajit Dash

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ভাষা
Scroll to Top