Home » গালিবের দরবারে : ফাতিমা জাহান  

গালিবের দরবারে : ফাতিমা জাহান  

‘ভালোবাসা’ শব্দটির সাথে পরিচয় তার রেখে যাওয়া বর্ণমালা দিয়ে। ভালোবাসি না বলেও যে ভালোবাসা যায় হাজার বার ফিরে ফিরে, তিনি কেন শেখালেন! আমি সেই আয়াত জপি দিবানিদ্রায়, আমার ঘোরে বা বেঘোরে।

তাকে ভালোবাসার বয়সকাল লেখা আছে প্রবীণ বৃক্ষের খুব কাছে যে শাখাটিতে নতুন পাতা ধরেছে তার রেখায় রেখায়। বিভোর হবার আগেই আপনি এসে পড়েন আরেকবার অন্য কোন ইটের দালানের নীচে হারিয়ে যাবার আগে বা পরে। আপনি কি তবে জানতেন আমি আছি জেগে, তখন থেকে যখন জগতের প্রথম প্রাণ বলতে শিখেছে, গুনগুন করতে শিখেছে আমাদের গযল!

আপনার শহরে কোন মন্ত্রবলে এসেছি জানতে চান? আমি তো গিয়েছিলাম আপনার খোঁজে খুব ভোরে কোন এক দরবেশের দেশে যেখানে আপনার কালাম শেখানো হয়, যেখানে মেঘ শোনা কথা হয়ে সোনা রঙে ঝুরঝুর করে আহ্লাদে ঝরে পড়ে।

আমি বলবো না কত মাশুক এই পথের মুশকিল ফেরে নিতে নিতে আপনার কাছে ভিড়তে পারেনি, আমিও কি তবে সে হতভাগা!

বিরহ যখন ফুলপাত্রে কানায় কানায় আবদ্ধ হয়ে ছুটে প্লাবন হয়ে বইতে চায় তখন আপনি কাউকে কি ভাবেন ঐ ফুলজীবনের ক্ষণস্থায়ী ইশারায়!

এরকম শুকনো খটখটে নিরস নগরীতে আপনি ভালোবাসা ফোটান। কীভাবে ফুটে ওঠে উদাসীনতায় এক জীবন্ত ভালোবাসা, আপনার কলমের কালি হয়ে জানতে ইচ্ছে করে খুব। পরের জন্ম থাকলে আমি জন্ম নেব আপনার বাগানের গালিচা হয়ে, গন্ধ নেব যখন হেঁটে বেড়াবেন, বা হব কোন পানপাত্রের মাধ্হোশ পেয়ালা।

তবে কি আপনি আমাকেই বলেছিলেন,

‘এই নিস্পাপ আকুলতায় কে না বা মরতে বসে,

হায় খোদা

লড়াই করে যাচ্ছি আর হাতে অস্ত্রটিও নেই। ‘

ইশক বিকোয় না বাজারে, তবু এর মূল্য দিতে হয় চড়া, এক অস্থির রূহ জানে বিচ্ছেদের রূপ কত ঝলমলে হয়।

ইট পাথরের আবাসে মেলেনি তাঁর সন্ধান। তাঁর লেখার খাতা দেখে দেখে পার করে দিয়েছি আমার প্রেমের কয়েক শত পক্ষ। তার পোশাক পেয়ে আরো কাছে যেতে ইচ্ছে করেছে।  কিন্তু পরক্ষণেই ভুল ভাঙলো আমার, পোশাকী ভালোবাসায় কি তাঁর সন্ধান মেলে!

ব্যথায় মুর্ছা  যাওয়া সড়ক তাঁকে না পেয়ে কাঁদে আর বলে, এদিন দেখতে চাইনি যদি প্রিয় কাছে না থাকে।

নেই তাঁর ঘরে, নেই সদরে, নেই বাজারে।

ততক্ষণে আমি ভিখিরি, সবার চেয়ে কাঙাল।

তবে কি মসজিদে পাবো তারে!

মসজিদের পথে পথে খুঁজি সন্তপর্ণে, নিবিড়ে।

বিস্তৃত  উঠোনে খুঁজে বেড়াই খোলা পায়ে। তপ্ত রোদে পুড়ে যায় পা, পোড়ে আমার আত্মা। নেই,  তিনি কোথাও নেই। মিনারে নেই, মিম্বারে নেই,  সমস্বরে প্রার্থনায় নেই, গোলাপি খাঁজের শায়েরীতে নেই ।

আপনি কি তবে আমার ফুরকাত লিখছিলেন এ বেলার তাম্রযুগে!

আমি জানি কেন বলেন,

‘ভালোবাসায় বাঁচি, ভালোবেসে মরে যাওয়া যায়

তার মুখপানে চেয়ে বেঁচে থাকি,

যে হৃদয়হীনের জন্য প্রাণ ওষ্ঠাগত রয়। ‘

কেন পোড়ান, কেন পিপাসা বাড়ান, কেন ঘুরিয়ে মারেন এই হন্তারক অলিগলিতে!

পায়ে ক্ষত হৃদয়ে মলিনতা, দীনতা নিয়ে শহরময় খুঁজি আপনার পদচিহ্ন।

একজন সুরেলা কন্ঠ বলেছিল আপনি আছেন সুদূরে, কোন এক তীব্র পিয়াসায়।

আপনার ঠিকানা পাবার সাথে সাথে ঝমঝম করে বেজে উঠল অসময়ে আসমানে জলতরঙ্গ। তুষ্ট হল নহরের ফেরেশতারা। আর আধুনিক নগর অসময়ের বরিষণে আমায় ভিজিয়ে চলে গেল। ভেজার কথা তো ছিল আপনার সুরে সুরে।

শুরু হয় পথচলা, শুরু হয় প্রতীক্ষা। মুসাফিরের আনন্দ পথে। কিন্তু আমি মুসাফির নই। আমি খুঁজে বেড়াই আপনাকে। যার জন্য পথে পথে আমি খুঁজি আপন সান্নিধ্য।

ধিক্কার তাদের যারা আমাকে মুসাফির বলে করুণা করে।

ভালোবাসা থাকে গোপন কুঠুরীতে, সে থাকে তাকদীরের মতো অজানা কিন্তু অচেনা নয়। তাঁকে কি আমি লোকের সামনে আনতে পারি! ভালোবাসলেই কি তবে মুসাফির হতে হয়!

কাছে এত সহজে যাওয়া যায় না।  আপনি থাকেন বাদশাহী মহলে। রোদে, জলে, পথ ভোলা আমি। সওয়াল জবাব চলে দ্বারে দ্বারে।  আমি অস্থির, আকুলিবিকুলি করে প্রতিটি নিঃশ্বাস। কেন বোঝেন না কত বরফ গলিয়ে, কত জলাধার পার হয়ে আর কত লোকের চোখ ফাঁকি দিয়ে আসতে হয় আপনার কাছে! আমার তাহরাতের হিসাব আপনি, আমার দিওয়ানাপান আপনার রুবাইয়ের সুর।

আপনার অনুজকে জিজ্ঞেস করি, ‘ভালোবাসার কাছে কি পর্দা করে যেতে হয়? ‘

তিনি বললেন, ‘প্রেমের মাঝে কি কখনো পর্দা পড়ে যায়? ‘

প্রেমের মাঝে পর্দা আসে না, প্রেম অবিনশ্বর, প্রেমের লাবযের মতই তার সিলসিলা।

আপনার কোলাহলময় সফেদ নগরীতে গিয়ে দেখি আপনি খুব একা। এত ভীড়ের মাঝেও মলিন বেশে একা। আপনি জৌলুশময় শাহেনশাহ, আপনি তো ঝলসে ওঠার।  আপনার এ একাকীত্ব আমার সহ্য হয় না। আপনি যে সবুজে জাফরানিতে নুয়ে আছেন তার পায়ের কাছে নত মস্তকে বসে থাকি আমি বিহবল। শিয়রের কাছে বসার অওকাত কোথায়!

ধীরে, খুব ধীরে বলে উঠলেন সেই আপ্তবাক্য,

‘ মনপ্রাণ উৎসর্গ করেছি

কোন মন্ত্র পড়লে তোমায় পাবো তাও জানা নেই।’

কয়েক কদম পেরোলেই ভীড়ের ভাষা, আপনি থাকেন নীরবে। আমার হৃদয়কে খণ্ড বিখণ্ড করে পাঠ করে যান মার্সিয়া।  আমি শুনি পিছু হটতে হটতে। আমি জুড়িয়ে যাই, ফুরিয়ে যেতে যেতে, আপনার আওয়াজ ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হতে হতে।

আমাদের বিরহ আমাদের প্রেম

আমাদের অপ্রাপ্তি আমাদের সত্যতা

আমাদের অশ্রু বলে দেবে নিখাদ আবেগ

আর ধ্রুব সত্য আমাদের বিচ্ছেদ।

তিনি আমার প্রথম প্রেম,  মির্জা গালিব ।

(মির্জা আসাদুল্লাহ বেগ খান বা আমাদের শায়ের মির্জা গালিবের জন্ম ২৭ ডিসেম্বর, ১৭৯৭ খ্রিস্টাব্দে ভারতের আগ্রায়। তাঁর পূর্বপুরুষ এসেছিলেন তুরস্ক থেকে। পিতা মির্জা আব্দুল্লাহ বেগ বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন কাশ্মিরের সম্ভ্রান্ত ঘরানার কন্যা ইজ্জানুননিসা বেগমের সাথে। মাত্র পাঁচ বছর বয়সে গালিব পিতৃহারা হন। সে সময় চাচা মির্জা নাসরুল্লাহ বেগ খান তাঁর দায়িত্ব নেন। ভাষা শিক্ষাগ্রহণ শুরু হয় নিজ হাভেলি বা বাড়িতেই। অনর্গল বলতে পারতেন ফারসি, উর্দু এবং আরবী ভাষা। কবিতা বা শের শায়েরি লেখা শুরু করেন এগারো বছর বয়স থেকে।

তেরো বছর বয়সে বিবাহিতের তকমা লাগে, নবাব ইলাহি বকশ এর কন্যা উমরাও বেগম এর কারণে। আগ্রা থেকে দিল্লী চলে আসেন বিবিকে নিয়ে। চলতে থাকে তাঁর কলম, রচিত হতে থাকে সুরের ফল্গুধারা । দিল্লী, লক্ষনৌ, ফাইজাবাদ, লাহোর, বেনারস, কলকাতা, হায়দারাবাদে ছড়িয়ে পড়ে তাঁর কবিতা, গযল, রুবাই, কাসিদা,  মর্সিয়ার শান শওকত।

নিজের জীবনকে ভাবতেন প্রথম কয়েদখানা আর দ্বিতীয় কয়েদখানা ছিল তাঁর বিবাহ। একে একে সাত সন্তানের জনক হয়েছিলেন কিন্তু কেউই বেশিদিন দুনিয়ার শোহরত দেখবার খুশ নসিবী নিয়ে আসেননি। শোকে কাতর বিবি উমরাও বেগম হয়ে গেলেন খানিক দিকভ্রান্ত। আর মির্জা সাহেব সব ভুলতে কিছু সময় ঝুঁকলেন শরাবে বা কিছু সময় জুয়া খেলায়। বাকি যা ছিল সে অফুরন্ত সময় ঢেলে দিয়েছিলেন তাঁর বেমিসাল লেখায়।

‘আমি জানি বিলম্ব করবে না আসতে,

তবে অঙ্গারে অঙ্গারে শেষ হব,

হৃদয়ের কথা

তোমার কাছে পৌঁছা অবধি। ‘

নিজেকে আধা মুসলমান হিসেবে প্রচার করতেন অকুতোভয় মির্জা গালিব। সেকারণেই লিখেছিলেন,

‘পান করতে দাও আমায় মসজিদে বসে

বা এমন জায়গার সন্ধান দাও যেখানে খোদা নেই। ‘

প্রথাগত ধর্মপালনের বাইরে গিয়ে তিনি খুঁজেছিলেন নিজ খুদাকে। আবার এমনও নয় যে তিনি ধর্মকে অস্বীকার করেছেন। তিনি অসংখ্য নাত-এ-রাসুল লিখে গেছেন এবং তাঁর লেখায় খুদার কাছে বশ্যতাও স্বীকার করেছেন। তাঁর অনন্যসাধারণ জীবনদর্শনবোধ তাঁর সৃষ্টিকে করে তুলেছে আরো সুখপাঠ্য।

আসাদ শব্দের অর্থ সিংহ,  আর গালিব ছিল তাঁর কবিতায় ব্যবহার করা নাম, অর্থ প্রভাবশালী বা সর্বোৎকৃষ্ট।

মুঘল রক্ত ছিল গালিবের শরীরে তাই কখনোই নিজেকে কারো গুলাম মনে করতেননা, করেননি কারো সামনে মাথা নত। সে কারণে কারো দেয়া চাকরিতেও ছিল না মন। পিতার সম্পত্তির জায়গিরদারি ছিল। তবে ইংরেজ সরকার সে সম্পত্তি অধিগ্রহণ করে নিলে বেশ অর্থকষ্টের ভেতর দিয়ে দিন গুজার করতে হয়। বেশ কয়েকবার ফিরিঙ্গি সাহেবদের দরবারে আর্জি জানিয়েও হারানো সম্পত্তি থেকে কোনরকম ক্ষতিপূরণ জোগাড় করতে পারেননি আমাদের প্রিয় শায়ের।

শুভাকাঙ্ক্ষীর অভাব ছিল না, সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফর (২) তাঁর ঘনিষ্ঠজন ছিলেন। সম্রাটের দরবারের অন্যতম উজ্জ্বল নক্ষত্র ছিলেন গালিব সাহেব। কিছুদিন খোদ  সম্রাটের এবং পরে পুত্র ফখরুদ্দিন মির্জার শায়েরি শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন। আর কিছুদিন ছিলেন মুঘল রাজ্যের ইতিহাসবিদ হিসেবে।

অন্যান্য রাজ্যের রাজা, নবাবগণও মির্জা গালিব সাহেবের ভক্ত ও পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তাঁদের সহায়তায় চলতো তাঁর সংসার।

যেমন বেশুমার ছিল গালিব সাহেবের ভক্ত তেমনি ঈর্ষান্বিত প্রাণও ছিল অঢেল। তার প্রতিভার ভারে ঈর্ষান্বিত হয়ে বহু রেখতায় তাঁকে আক্রমণ করা হয়েছিল। কিন্তু যার হৃদয়ে আছে শব্দের জাদু আর প্রাণে আছে জান্নাতের ছায়া তাকে কেউ কি হারাতে পারে!

সিপাহী বিদ্রোহের পর সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফর (২) কে অবরুদ্ধ করে নির্বাসন দেয়া হল রেঙ্গুনে। এদিকে অন্যান্য নবাবরাও হলেন কোনঠাসা ইংরেজদের হাতে।

ভগ্নহৃদয়, একা গালিব রচনা করতেন তখনও অমর রুবাই, নাযম,  তাঁর গযলের সুরের ঝংকারে মোহিত হত পুরানি দিল্লীর অলিগলি বা জামা মসজিদের মিহি কারুকাজ।

স্থানীয় বাসিন্দারা বলে থাকেন বাল্লিমারান, গলি কাসিম জানের নিজস্ব মসজিদ এবং কাছের দিল্লী জামা মসজিদে নামাজ পড়তে যেতেন এই বিন্দাস দিল শায়ের এবং মাঝে মাঝে সেখানে বসেই রচনা করতেন শায়েরী।

১৫ ফেব্রুয়ারী, ১৮৬৯ খ্রিস্টাব্দে এই অমর কবির রূহ দেহরূপী কয়েদখানা থেকে মুক্ত হয়। ওফাত হয় পুরনো দিল্লীর বাল্লিমারানের ভাড়া বাড়িতে।

আজও সেই বাড়িটিতে রয়েছে তাঁর পদচিহ্ন, তাঁর ব্যবহৃত পোশাক,  ভুবনজয়ী তাঁর সৃষ্টিকর্ম, তাঁর লেখার খাতা।

সমাহিত হন দিল্লীর তাজ হযরত নিজামুদ্দিন আউলিয়ার দরগাহের খুব কাছেই।

সাদা মর্মর পাথরের ঘর এখন তাঁর মোকাম, তাঁর নিরালা আজীজ।)

Ajit Dash

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ভাষা
Scroll to Top