♦♦ সাদা খরগোশ ♦♦
সাগর তীরের পাশেই ছিল এক খরগোশের বাস। দাগহীন ধবধবে সাদা রঙের জন্য সবাই খরগোশটাকে সাদা খরগোশ বলে ডাকতো। বিভিন্ন দেশ ঘুরে বেড়ানোর বেশ ইচ্ছে ছিল খরগোশটার।
একদিন খরগোশটা এক পাখিকে জিজ্ঞেস করল, ‘আচ্ছা পাখি-রানী তুমি কোন দেশ থেকে এখানে এসেছ? সেখানে কি কি দেখেছ?’
পাখিটা বলল, ‘সমূদ্রের ওপারে কেরালা দেশ থেকে এসেছি। সেখানে হরেকরকম জিনিস আছে। অনেক লোক সমাগম। সেখানকার রাজকুমারীও ভীষণ রূপবতী।’
এ কথা শুনে খরগোশের মনে কেরালা দেশ ভ্রমণের প্রবল ইচ্ছা জাগল। সাগরের এক কুমির খরগোশটার বন্ধু ছিল। খরগোশ তার বন্ধুর কাছে কেরালার রাজকুমারীর রূপের গল্প করলো। এবং তা সত্য কিনা জানতে চাইলো।
কুমির বন্ধু বললো, ‘হ্যাঁ, সত্য কথা। আমি নিজেও রাজকুমারীকে দেখেছি। সে পরম সুন্দরী। খুব শীঘ্রই তার বিয়ে হবে।’
খরগোশ তখন খুব উৎসাহ নিয়ে আরও বলল, ‘কিন্তু ভাই, আমার একটা অনুরোধ, তুমি যখন এরপর কেরালা দেশে যাবে অবশ্যই আমাকে সঙ্গে করে নিয়ে যেও।’
কুমির জবাব দিল, ‘না বাবা না, তোমার বাবা-মা আমার উপর রাগ করবে। আমি পারবো না।’
এ কথা শুনে খরগোশের খুব মন খারাপ হয়ে গেল। সে অন্য উপায়ে কেরালা যাওয়ার বুদ্ধি করতে লাগল। পরদিন খরগোশ আবার তার বন্ধু কুমিরের কাছে গিয়ে বললো, ‘তুমি কি জানো আমাদের পরিবার কত বড়? আমাদের পরিবারে সব মিলিয়ে ৮২৫ জন সদস্য । তোমরা কতজন?’
কুমির উত্তর দিল, ‘আমার পরিবারও অনেক বড়, আসলে আমি কখনো গুনে দেখিনি কতজন’ । তারপর খরগোশটি আবার চালাকি করে জিজ্ঞেস করলো, ‘তুমি এখনি তোমার পরিবারের সকল সদস্যদের ডাক, আমি গুনে দেখব।’
খরগোশের কথায় রাজি হয়ে কুমিরটি পানি তলদেশে চলে গেল। কিছুক্ষণ পর দেখা গেল পুরো সমুদ্রের জলে কেবল কুমির আর কুমির ভাসছে। খরগোশ বলল ‘এভাবে চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকলে তো আমি গুনতে পারব না। তুমি বরং সবাইকে বল সারিবদ্ধ হয়ে থাকতে তাহলে আমি সঠিকভাবে গুনতে পারব।’
সাদা খরগোশের কথায় সব কুমির এক সারিবদ্ধ হলো। এইবার খরগোশটি একেকটা কুমিরের পিঠে চড়ে গুনতে শুরু করলো।
এভাবে একটার পর একটা কুমির গুনতে গুনতে সামনে এগুতে লাগলো এবং একসময় সাগর পাড়ি দিয়ে কেরালা দেশে পৌঁছে গেল। তারপর কুমিরের পরিবারের সদস্যদের বললো, আমি এখন কেরালা দেশ ঘুরে যাব, তোমরা দয়া করে আমার বাবা-মাকে বলে দিও।
এরপর সাদা খরগোশ কেরালা দেশ ভ্রমণের উদ্দেশ্যে বিদায় নিয়ে চলে গেল। রাস্তায় তার সঙ্গে দেখতে অসুন্দর, বয়স্ক চার রাজকুমারের দেখা হল। তারাও কেরালার রাজকুমারীকে বিয়ের উদ্দেশ্যে যাচ্ছিল। খরগোশটি তাদের বললো, ‘আমিও তোমাদের সঙ্গে যাব। আমি রাজকুমারীকে দেখতে চাই। তার রূপের অনেক বর্ণনা শুনেছি।’
খরগোশের কথা শুনে চার রাজকুমার হেসে ফেললো। এক রাজকুমার বললো, ‘যদি রাজকুমারীর সঙ্গে দেখা করতে চাও তাহলে নদীতে স্নান করে, মাটিতে গড়াগড়ি খেয়ে আসতে হবে।’ এই কথা বলে তারা সামনে এগিয়ে গেল। খরগোশটি ঝট করেই পাশে নদীতে স্নান করে মাটিতে গড়াগড়ি করে প্রস্তুত হলো। কিন্তু একি কাণ্ড তার গায়ের রঙ নোংরা হয়ে কুৎসিত দেখাচ্ছে। খরগোশটি জোরে জোরে বিলাপ করে কাঁদতে লাগলো।
সে পথ ধরেই যাচ্ছিল সুদর্শন আর বয়স কম এক ছোট রাজকুমার। খরগোশটিকে কাঁদতে দেখে তার দয়া হল। সে বিস্তারিত জানতে চাইলে খরগোশটি তাকে সব কথা খুলে বলল।
ছোট রাজকুমার খরগোশটিকে নদীর কাছে নিয়ে গেল। তাকে ভাল করে স্নান করিয়ে আগের রূপে ফিরিয়ে আনল। তারপর সেটিকে সঙ্গে নিয়ে রাজকুমারীর সঙ্গে দেখা করার উদ্দেশ্যে রওনা হল।
রাজকুমারী বাগানে বসে ছিল। সাদা খরগোশটা রাজকুমারীকে এক পলক দেখতে পেয়ে ভীষণ আনন্দিত হল। ফেরার পথে ছোট রাজকুমারের দয়ার কথা খরগোশটি রাজকুমারীকে জানাল। এতে করে রাজকুমারী সেই ছোট রাজকুমারকে পছন্দ করে ফেলল এবং তাদের মধ্যে খুব ধুমধাম করে বিয়ে হল। আর সাদা খরগোশটি তাদের কাছে কেরালার রাজপ্রসাদে থেকে গেল।
(কৃতজ্ঞতা- ডক্টর মধু পন্ত, গীতা গৌতম)
♦♦ মহাবলী ♦♦
কেরালার প্রসিদ্ধ উৎসব অনাম(১) সম্পর্কে সবারই কম বেশি জানা আছে। শ্রাবণ মাসের এই উৎসবকে কেন্দ্র করে কেরালাবাসীর আনন্দের সীমা থাকে না। কেরালা রাজ্য পুরো চার দিন ধরে এই উৎসবে মেতে থাকে। এই উৎসবকে কেন্দ্র করে একটি গল্প এমন-
বলা হয়ে থাকে প্রাচীন রাজ্য কেরালা মূলত মহাবলী অশুরের রাজ্য ছিল। পুরো রাজ্য সমৃদ্ধি আর খুশিতে ভরপুর ছিল। মহাবলী তাঁর প্রজাদের ভীষণ ভালবাসতেন। কিন্তু দেবতারা মহাবলীর এত জনপ্রিয়তা এবং প্রজাদের ভালবাসা দেখে চিন্তিত হয়ে পড়েছিলেন। তারা কেউ চায়নি অশুরদের এই শাসন ব্যবস্থার বিস্তার ঘটুক।
মহাবলী তপস্যার বলে, নিজের যোগ্যতায় তিনলোকে জনপ্রিয়তা অর্জন করে ফেলেছিলেন এবং নিজের অধিকারে নিয়ে নিয়েছিলেন। তখন দেবরাজ ইন্দ্র সিংহাসন চ্যুত হয়ে বিষ্ণুর শরণাপন্ন হল। মহাবিষ্ণু দেবরাজ ইন্দ্রকে আশ্বস্থ করে বলল, ‘চিন্তা করোনা, আমি পৃথিবীতে বামন অবতারে গিয়ে মহাবলীর রাজ্য কেড়ে নেব।’
কথামতো মহাবিষ্ণু এক ব্রাহ্মণ রূপ ধারণ করে মহাবলীর রাজমহলে প্রবেশ করল। মহাবলী ব্রাহ্মণ অতিথিদের বেশ আপ্যায়ন এবং শ্রদ্ধা করতেন। মহাবলী ব্রাহ্মণরূপধারী মহাবিষ্ণুর চরণ ধুয়ে স্বাগত জানিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
‘আমি আপনার কি সেবা করতে পারি রাজন?’
ব্রাহ্মণরূপধারী মহাবিষ্ণু বলল, ‘আমি শুধু তিন কদম মাটি চাই।’
মহাবলী আশ্চর্য হয়ে বলল, ‘মাত্র তিন কদম মাটি দিয়ে আপনি কি করবেন?’
ব্রাহ্মণ উত্তর দিল, ‘আমি কেবল সেখানে তপস্যা করবো।’
ব্রাহ্মণ কুমারের উত্তর শুনে মহাবলী খুব প্রসন্ন হয়ে তিন কদম মাটি দান করার প্রতিজ্ঞা করলেন।
অশুরদের গুরু শুক্রাচার্য বামন রূপধারী মহাবিষ্ণুকে চিনে ফেলেছিলেন। তিনি মহাবলীর সঙ্গে একান্ত সাক্ষাত করে বললেন,’তোমার প্রতীজ্ঞা ফিরিয়ে নাও। এই ব্রাহ্মণ কোনো না কোনোভাবে তোমার ক্ষতি করবে।’
মহাবলী কখনোই তার প্রতীজ্ঞা ভঙ্গ করেনি। প্রতি উত্তরে শুক্রাচার্যকে বললেন,’আমি প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করতে পারব না। যাই ঘটুক অদূর ভবিষ্যতে, সেটাই মেনে নেব।’
পরদিন রাজসভা বসেছিল। মহাবলী তার সিংহাসনে বিরাজমান ছিলেন। ব্রাহ্মণ কুমার মহাবলীকে আবার জিজ্ঞেস করলেন, ‘আচ্ছা আমি তাহলে আমার তিনকদম ভূমি নিয়ে নেব?’ মহাবলী বলল, ‘হ্যাঁ, অবশ্যই নেবেন যেখানে আপনার ভাল লাগে।’
দেখতে দেখতে ব্রাহ্মণরূপধারী বিষ্ণু তাঁর আসল রূপে আবর্তিত হলেন। তার শরীর এত বিশাল আকার ধারণ করলো যে, দুই কদমে তিনলোক দখল করে ফেললেন। তিনি হাসতে হাসতে মহাবলীকে জিজ্ঞেস করলেন,’এখন আমি তৃতীয় কদম কোথায় রাখবো?’
মহাবলী তার মস্তক নত করলেন। মহাবিষ্ণু তাঁর তৃতীয় কদম মহাবলীর মাথার উপর রাখলেন। তারপর মহাবলী পাতাললোকে চলে গেলেন।
যাওয়ার আগে তিনি বিষ্ণুর নিকট বর চাইলেন- বছরে একবার তিনি তাঁর প্রিয় রাজ্য দেখতে আসতে পারবেন কিনা?
মহাবিষ্ণু তখন সম্মতি দিয়ে বললেন, ‘হ্যাঁ তুমি প্রতি বছর শ্রাবণ মাসে তোমার প্রজাদের অবস্থা দেখার জন্য কেরালা রাজ্যে আসতে পারবে।’
সেই থেকে প্রতি বছর শ্রাবণ মাসের শ্রাবণ নক্ষত্রে মহাবলী তার নিজের রাজ্য কেরালা ভ্রমণে আসতেন। নিজের রাজ্যে প্রজাদের দেখতে আসার দিনটিকেই কেরালাবাসী মহাসমারোহে স্মরণ করে এবং উৎসবমুখর করে তুলে। যেন তাদের রাজা বুঝতে পারে যে, তার প্রজারা বেশ আনন্দে এবং ভালভাবে আছে।
♦♦ ইচা-পুচা ♦♦
মালায়ালাম অঞ্চলে মাছিকে ‘ইচা’ এবং বিড়ালকে ‘পুচা’ বলে। এটা এক মাছি আর বিড়ালের গল্প। দুজনে খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলো এবং একদিন তারা কাঞ্জি(২) রস বানিয়েছিলো। কিন্তু সেটা পান করার জন্য দুজনের নিকট কোনো চামচ ছিল না। ইচা বলল, ‘পুচা তুমি কাঞ্জিটা দেখে রাখ, আমি এখনি কাঁঠালের পাতা নিয়ে আসছি।’ এই বলে সে উড়ে চলে গেল। এদিকে কাঞ্জি দেখে রাখতে রাখতে পুচার খুব খিদে পেয়ে গেল। আর সে অমনি পুরো কাঞ্জি পান করে ফেলল। এতে করে পুচার পেট ফেঁপে ফুলে গেল।
পুচার পেট এতটাই ফেঁপে-ফুলে গেল যে, সে ঠিক মতো হাঁটতে পর্যন্ত পারছিল না। পেট ফাঁপা দূর করার জন্য পুচা আশপাশের অনেককেই সেটির উপায় জিজ্ঞেস করতে লাগল। সবার প্রথমে সে গোয়ালে বাঁধা এক গাইকে জিজ্ঞেস করলে গাই বলল, ‘আমাকে যে দেখাশুনা করে সেই গৃহস্থকে জিজ্ঞেস কর।’ তারপর সেই সেই গৃহস্থের নিকট গেল। গৃহস্থ বললো, ‘আমি সঠিক জানি না, আমার মেয়েকে জিজ্ঞেস কর।’ মেয়ে জিজ্ঞেস করলে সে বললো, ‘আমিও জানি না তুমি গাছকে জিজ্ঞেস কর।’ গাছকে জিজ্ঞেস করলে সেও বলে, ‘আমি জানি না তুমি পাখিকে জিজ্ঞেস কর।’ পাখি জিজ্ঞেস করলে সেও বলে, ‘আমি জানি না, তুমি শিকারিকে জিজ্ঞেস কর।’ শিকারিকে জিজ্ঞেস করলে সে বলে, ‘আমি জানি না, তুমি আমার ছুড়িকে জিজ্ঞেস কর।’ ছুড়িকে জিজ্ঞেস করলে সে রেগে গিয়ে বলতে লাগলো, ‘এক্ষনি বলছি কিভাবে ঠিক তোর পেট ঠিক হবে।’ আর তক্ষনি পুচা দৌঁড়ে পালাতে লাগল। পালিয়ে যাওয়ার পথে দেখলো ইচা একটা কাঁঠাল পাতা শুড়ে করে নিয়ে যাচ্ছে। দেখা গেল পেট ফাঁপার উপায় খুঁজতে গিয়ে পুচা যে দৌড়ঝাঁপ দিয়েছিলো বিভিন্ন জনের কাছে তাতেই তার পেট ফাঁপা ভাল হয়ে গেল।
(কৃতজ্ঞতা- কমলেশ চন্দ্র যোশী)
—————————
পাদটীকা:
(১) অনাম-ভারতের মালায়ালাম ও কেরালা অঞ্চলের হিন্দুদের তিনটি বাৎসরিক এবং ধর্মীয় উৎসবের মধ্যে অন্যতম একটি উৎসব। এটি প্রাচীন ভারতে কেরালা রাজ্যের একটি ফসল উত্তোলন উৎসব। মূলত কেরালা রাজ্যের অধিপতি মহাবলী পাতাললোক থেকে নিজ রাজ্যে ফিরে আসাকে কেন্দ্র করে প্রজারা ফসল উত্তোলন করে তার উদ্দেশ্যে নিবেদন করেন। বর্তমানে নৌকা বাইচ, বাঘ-নৃত্য এবং ফুল দিয়ে তৈরি আলপনা আঁকার মধ্য দিয়ে এই উৎসবটি পালন করে থাকে ভারতের কেরালাবাসীরা।
(২) পান্থা ভাতের জল।
——————-
সূত্র- ভারতীয় লোকগল্পের একটি অনলাইন আর্কাইভ থেকে।