চলচ্চিত্রপ্রেমী মানুষের কাছে নামে তিনি খুব একটা পরিচিত ছিলেন না কখনোই। আবার ছিলেনও। উইকিপিডিয়া খুঁজে দেখলে এই একই নাম উঠে আসে। অথচ তিনি ইনি নন। তিনি বিখ্যাত চিত্রগ্রাহক ও চলচ্চিত্রনির্মাতা নিমাই ঘোষ (‘ছিন্নমূল’ ছবির পরিচালক যিনি বরাবর সত্যজিৎ রায়ের ছবিতে সুদক্ষ কাজ করে গেছেন)। আর আমার বর্তমান আলোচনীয় নিমাই ঘোষ বাংলা মঞ্চাভিনেতা ও বিখ্যাত সব চলচ্চিত্রের চরিত্রাভিনেতা। দর্শকের চোখে যাঁর চেহারার প্রাথমিক প্রতিক্রিয়াই হল রিপালসিভ অর্থাৎ বিতৃষ্ণা উদ্রেককর। অন্তত অকপটে এ কথা স্বীকার করতে আমার কোনও দ্বিধা নেই। ওম পুরি সম্পর্কে বক্তব্য উত্থাপনের সময় তিনি নিজেও এমনটা বলেছিলেন। তিনি জন্মেছিলেন ১০ ফেব্রুয়ারি, ১৯৪২, উত্তর কলকাতার ঈশ্বর মিল লেনের এক সাধারণ পরিবারে। তাঁর কথায় : ‘বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে বাঙালি পরিবারগুলোর মধ্যে ক্ষয়প্রস্তর (ক্ষয়প্রাপ্ত!) যে-সামান্য অংশ তখনও শেকড় আঁকড়ে ছিল, আমরা হলুম তেমনই এক ছোট্ট পরিবার।’ বাবা-মা সহ চার ভাই, এক বোন। আর ছিলেন বাল্যবিধবা দিদা। ডাক-তার বিভাগের কর্মী এই মানুষটির বাল্যবয়সে অন্ত্যমিল করে বাক্য গঠনের দক্ষতা দেখে বাবা তাঁকে আবৃত্তি শেখার পরামর্শ দিয়েছিলেন। কবিতার সঙ্গে পরিচয় এভাবেই। পরবর্তীকালে গণনাট্য সংঘের সদস্য হন। ‘নান্দীকার’এর অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়কে তিনি তাঁর নাট্যশিক্ষার গুরু মানেন। ‘থিয়েটার ওয়ার্কশপ’এরও প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন তিনি। গত শতকের ছয়ের দশকে সিপিআই(এম) দলের কর্মী হিসেবে কাজ করার সময় বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য তাঁকে সরকারের সাংস্কৃতিক বিভাগে যুক্ত করে দেন, নাট্যকর্মীরূপে। সেখানে নাটকের সংলাপ লিখতে লিখতে প্রথম কবিতা লেখার হাতেখড়ি। আর তারই ফসল কবিতার বই “দাঁড়াও পথিকবর”। ২০২৩ সালে এই বইয়ের প্রকাশক ছিল গান্ধার এবং যে বই যথেষ্ট পাঠক-মুগ্ধতা লাভ করেছে এবং তার প্রথম মুদ্রণ শেষ।
মৃণাল সেনের ‘ইচ্ছাপূরণ’ দিয়ে শুরু করে তিনি প্রায় শ’দুয়েক চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন। পরে মৃণালবাবুরই ‘পরশুরাম’, উৎপলেন্দু চক্রবর্তীর ‘চোখ’এ তাঁর দুর্দান্ত অভিনয় দর্শকের নজর বিশেষভাবে কাড়ে। ‘দামু’ ছবিতে রঘুবীর যাদবের সঙ্গেও তিনি সহ অভিনেতা ছিলেন। এ ছাড়াও তিনি বিপ্লব রায়চৌধুরী, সন্দীপ রায়, বাপ্পাদিত্য বন্দ্যোপাধ্যায়, সুমন ঘোষ, শৈবাল মিত্র প্রমুখের ছবিতে কৃতিত্বের সঙ্গে অভিনয় করেন। ২০২১ সালে অভিনন্দন মুখোপাধ্যায়ের ‘মানিকবাবুর মেঘ’ ছবিতে তিনি এক গুরুত্ববহ চরিত্রে অভিনয় করে দর্শকের প্রশংসা অর্জন করেন। তাঁর একটিই আফশোশ, সত্যজিৎ রায়ের ছবিতে তাঁর কাজ করা হয়ে ওঠেনি। আর তাঁর অভিনীত দীর্ঘদিন ধরে চলা বাংলা সিরিয়াল ‘জন্মভূমি’র কথা ধারাবাহিকপ্রেমী দর্শক মাত্রই জানেন যদিও অধুনা সিরিয়াল নিয়ে তাঁর বিবমিষা প্রকট। আবার এই মানুষটিই গোবিন্দ নিহালনির ‘তমস’ সম্পর্কে উচ্ছ্বসিত।
৮৪ বছর বয়সের এই অকৃতদার একাকী মানুষটি উলটোডাঙা স্টেশন সংলগ্ন দারিদ্র্য -লাঞ্ছিত এল আই জির ঘরে বসে আড্ডা স্টেশন গৃহীত সাক্ষাৎকারে যখন বলেন, কিছু পরিচালক কাজ করিয়ে নিয়ে তাঁকে পারিশ্রমিক দেননি, তখন ক্রুরতার সঙ্গে ক্ষোভ, ক্রোধও মিলেমিশে একাকার হয়।
শুধু তাই নয়, তাঁর দুটি প্রকাশিত বইয়ের জন্য প্রকাশকদ্বয়ও তাঁকে রয়্যালটি থেকে বঞ্চিত করেছেন, নানান অজুহাতে। কবিতার বইটির কথা আগেই বলেছি। আপাতত আমার মূল আলোচনীয় বিষয় হল, নিমাই ঘোষের ২০২৪এ প্রকাশিত গল্পের বই “নিমাই ঘোষের গল্প” যার প্রকাশক ব্ল্যাকলেটার্স।
একেবারেই অজানা একটি তথ্য এমনকি এই বইটি হাতে পাওয়ার আগে পর্যন্ত আমিও তাঁর এই প্রয়াসের কথা জানতাম না। অবশ্য শুধু প্রয়াস বললে সবটা বলা হয় না। এ রীতিমতো পোক্ত লেখনীর ছাপ। তা ক্রমশ প্রকাশ্য। যাই হোক, তাঁর দিদাই (বইটি তাঁকেই উৎসর্জিত) তাঁর গল্প বুননের প্রেরণাদাত্রী। আগেকার দিনের অভ্যেসমতো লোককথা, পুরাণকথা শোনার মাঝ দিয়েই তাঁর সুপ্ত ইচ্ছে পরিণত বয়সে এসে চাগাড় দিয়ে ওঠে। আবার মানুষের কাছ থেকে অবহেলিত, বঞ্চিত হলেও সামাজিক মানুষ হিসেবে জরুরি তাগিদ, দায়বদ্ধতা থেকেই তাঁর এই কলমচারিতা ও সৃজন। প্রাত্যহিক চলার পথের চলনদার হিসেবে যে সকল ছোটোবড়ো ঘটনা তাঁকে নাড়া দিয়েছিল সেসবই তিনি শব্দের পরিধিতে বুনে গেছেন। তৈরি হয়েছে তেরোটি আখ্যানমালা যা মোটেই এলোমেলো কোনও বিন্যাস নয়; বেশ পোক্ত কলমের শক্ত বুনন।
মূল আলোচনায় যাওয়ার আগে যেটি বলার তা হল, তাঁর গল্পানুষঙ্গে প্রায়শই জড়িয়ে আছে ভিড়, বর্ষা আর কাক। শুরুর চমকের সঙ্গে সঙ্গে শেষের রহস্যময়তা নিপুণ গল্পের রীতি মেনে হলেও অনেক সময় পাঠককে তা বিভ্রান্ত করে। সঠিক তথ্যবিভ্রান্তিও ঘটে কখনও কখনও।
এই সূত্রেই প্রথম গল্প “প্রবৃত্তি” যা পটলার বুকস্টলের সামনের ভিড় দিয়ে শুরু যাকে ঘিরে গল্পকারের বা গল্পের প্রোটাগনিস্টের মনে একগাদা প্রশ্নের জন্ম হয়। প্রসঙ্গত বলি, এই গল্পটির শেষে লেখা আছে ‘একটি পোস্টম্যানের একদিনের পথ চলার অভিজ্ঞতা।’ পোস্টম্যান নিয়ে তাঁর আরও গল্প আছে যা তাঁর ব্যক্তিক অভিজ্ঞতাজাত কেননা, আগেই বলেছি, তিনি ভারতীয় ডাক-তার বিভাগের কর্মী ছিলেন। যাই হোক, উক্ত গল্পে প্রথমেই প্রশ্ন জাগে কোনও ‘গেজেট- ফেজেট’ বেরুল কি না। দুটি বিখ্যাত কাগজে বর্ষায় জল থইথই কলকাতা আর ট্রেন লাইনে আত্মহত্যার ‘হ্যাকনিড খবর’ ছাড়া কিছুই তো ছিল না। রাজনৈতিক খবরেও কংগ্রেসের অজিত পাঁজা আর সিপিএম’এর প্রমোদ দাশগুপ্তর কূটকচাল। আবার পাঠক হিসেবে যে খবরের সুরাহা করতে পারলাম না তা হল নির্দিষ্ট ১৩ই জুলাই তারিখে কোন মহানায়কের মৃত্যু হয়েছিল! বামফ্রন্ট সরকারের পতন বিষয়ক আশঙ্কাও বর্তমান। তৎকালীন কলকাতার রাস্তায় পাতাল রেলের জন্য খোঁড়াখুঁড়ির ছবিও এই গল্পে বিদ্যমান যা এখনও চলছে। যাই হোক, আমাদের উৎসুক পোস্টম্যান কোনওরকমে ভিড় ঠেলে, হাঁটুর নুনছাল তুলে সামনে দাঁড়াতেই যা তার নজরে গেল তা হল ‘মিডনাইট’, ‘রাত কি কাহানি’ বিষয়ক নগ্ন ছবি সংবলিত বইয়ের ছবির সমাহার। এইবার সে ঘামতে শুরু করে। সেই নগ্ন দৃশ্যপট থেকে নিস্তার পেতে দ্রুত বেরুতে চায়। পাশের বাড়ির ছেলে, পরিচিত মাস্টারমশাই তার ভয়মিশ্রিত বমনেচ্ছা বাড়িয়ে তোলে। এরমধ্যেই এক তরুণ যুগল আমদানি হয় যেখানে ধাড়ি মেয়েটা ‘একটা ছেঁড়া ফ্রক পরে’ আর ‘ছেলেটারও… প্যান্টের পেছনটা ফাটা’। পোশাকের এই উৎকট বিবর্তন গল্পকারের তির্যক দৃষ্টি এড়ায় না। ছেলেটার আবার ওইসব নগ্ন মলাট দেখে ‘জিভ দিয়ে লালা’ গড়াতে থাকে। টানাহেঁচড়ায় পড়ে গিয়ে ছেলেটার রক্তারক্তি কাণ্ড ঘটে। তবুও সে এই লালসাময় ভিড় থেকে নড়বে না। এভাবেই ‘বীভৎস’ দৃশ্যপট থমকে যায়। শেষ হয় গল্প কিংবা আলগা হয় পোশাকি ভদ্রতার আড়ালে মানুষের ভিতরের নগ্নতা।
বিশ্বময়, দেশময় যখন কুকীর্তি, পাপজর্জরতা এবং তার জন্য ‘কীর্তিমান’দের কোনই আফশোশ নেই ঠিক সেই ঘৃণ্য অবস্থানে দাঁড়িয়ে কানাই, কানাইলালের নিতান্তই নগণ্য একটা কুকাজের জন্য যে মনস্তাপ তাকে ঘিরেই গল্প “স্বপ্নভঙ্গ”। এই মনঃকষ্ট নিয়ে সে সন্ধ্যায় গঙ্গা ঘাটে এসে বসে। কলঙ্কিত চাঁদের নিষ্কলঙ্ক আলোয় জোয়ারের ঢেউ দেখতে দেখতে তার মনের ক্লেদ অনেকটাই কেটে যায়। হঠাৎই জোলো বাতাসের সঙ্গে বয়ে আনা শ্মশানচিতার মড়া-পোড়া কটু গন্ধ তাকে ভয় পাইয়ে দেয়। বুকের যন্ত্রণা নিয়ে সে সুলেখা বোর্ডিং হাউসের আস্তানার দিকে দ্রুত পা চালায়। আবারও কানে আসে হরিসংকীর্তনের আওয়াজ যা তাকে আরও গভীর কষ্টের ভিতর নিয়ে যায়। সে ভাবে, ‘এত সাত্ত্বিকভাবে দিনযাপন করেও এমন পাপে লিপ্ত হতে হল তাকে?’ কেন? এবারে তার পাপের কথাটা বলেই ফেলি। সামান্য মানুষ সে। বড়োবাজারে কাপড়ের দোকানে খাতা লেখার কাজ করে। সারাদিন অক্লান্ত, অবিশ্রাম কাজ করে ফিরে আসে আস্তানায়। সেখানে ‘কোনোরকমে চৌবাচ্ছার তলানি জলে হাত-পা-মুখ ধুয়ে ছুট মারে সামনের ভুজাওয়ালার দোকানের দিকে।’ রোজকার বরাদ্দমতো ‘পঞ্চাশ গ্রাম মুড়ি কিনে চলে যায় ময়রার দোকানে সন্দেশ আনতে।’ এরকম ‘ভারী টিফিন'(!) করে রাতের দিকে শর্মার দোকানের দুধ আর উড়ের দোকান থেকে গোটা চারেক রুটি কিনে ঘরে ফেরে। যোগ-প্রাণায়াম, ইষ্টদেবীকে স্মরণ করে শুয়ে পড়ে। নিতান্তই শাদামাটা জীবন। কিন্তু গোল বাধে সন্দেশের দোকানে যখন তার কাছে এক টাকার কয়েন থাকা সত্ত্বেও সে দুটির জায়গায় একটি সন্দেশ খাবে বলে ঠিক করলেও দোকানি তাকে দুটো দিয়ে দেয়। সে এটাকে ষড়যন্ত্র ভাবে। তার সম্পর্কে গল্পকার বলছেন, ‘এই ফাঁপা দুনিয়ায়, ছিটেফোঁটা দু-একজন নিরেট মানুষ যা চোখে পড়ে এখনও – কানাইলাল তেমনই একটি রত্ন।’ কিন্তু খিদের চোটে সে একটা সন্দেশ ফেরত না দিয়ে দুটোই মুখে পুরে দেয়। এটাই ছিল তার পাপকাজ যার জন্য নিজেকে আক্কেলরহিত ভাবে সে। তার প্রাত্যহিক নিয়মনিষ্ঠায় আঘাত লাগে। এবারে চলতে চলতে সে পালাবার পথ পায় না। ‘শবযাত্রীরা সব পথ আটকে ফেলেছে।’ তাকে যেন উলটোদিকে নিয়ে যাচ্ছে। তা নিয়ে প্রশ্নাকুল হলে সে উত্তর পায়,’ কেউ তোমায় উলটোদিকে নিয়ে যায়নি! বরং উলটোদিকেই চলছিলে তুমি।’ কথার ধন্দ কাটিয়ে সে দেখে, কাছেপিঠে কেউ নেই, শুধু হরিধ্বনি অনেকটা কাছে এসেছে যেন। এরপর শবের দিকে নজর পড়ায় তার গা ছমছমিয়ে ওঠে। সে জোর দৌড়ুতে থাকে ঘরপানে। স্বপ্নাঘোরে কানাই দেখে, যে শবকে দেখে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে সে দৌড়েছিল সে যেন তাকেই হাতছানি দিয়ে ডাকছে ; তার মুখটা অবিকল তারই মুখের মতো। এরপর তার গোঙানির মাঝে ওই দৃশ্য মিলিয়ে গিয়ে কল্পিত ইষ্টদেবীর মূর্তি ভেসে ওঠে যাকে দেখে দাঁতমুখ খিঁচিয়ে সে তেড়ে যায়। অপার দীনতার মাঝে তার যে কৃচ্ছ্রসাধনা তাকে মূলধন করে সে দাবি জানায় :’অত ভজে একটা কড়াপাক দিতে এসেছ আমাকে? যাও, যাও, কেটে পড়ো এখান থেকে। তোমার অমন পুণ্যের ফল দেওয়ার মুখে লাথি মারি আমি।’ এই কৃপায় যে পাপবোধে জর্জরিত হয়েছে সে তার জন্যই এই ক্ষুব্ধ প্রকাশ। এরপর স্বপ্নের লাথিতে সে যখন বাস্তবতই চোট পায় তখন গজরাতে গজরাতে বলে, ‘ দেবদেবীরও দেখছি পারশিয়ালিটি আছে!’ আজকের বাক সর্বস্ব ফাঁপা মানুষের নীতিবোধহীন জগতে এমন কানাইয়ের মাঝ দিয়ে গল্পকার যে দুর্লভ তথা দুর্ভেদ্য পথের সন্ধান দিতে চান তা অবশ্যই অনুকরণীয় ও অনুসরণীয়।
তিনটি অন্বয়ী স্তরে বোনা খুবই ছোট্ট একটি গল্প “পেশাদার দারোগা” যে স্তরীয় পথে পুলিশের নেতিবাচক চরিত্র উন্মোচিত করেন গল্পকার। প্রথম স্তর ‘শব্দ’ যেখানে প্রচণ্ড গরমের রাত্রে ঘুম ভেঙে বর্ণনাকারীর কানে কিছু শব্দ ঢুকে যায় যা পুলিশের বুটের আওয়াজের মতো। মস্তিষ্ক ক্রিয়াশীল হলে সে ‘ধারণা’ করে ‘কে যেন কাকে তাড়া করে…মাথায় ডাণ্ডা মারল’। মার খাওয়া ব্যক্তি কাতরে উঠলে কিছু ‘বাক্য’ ভেসে আসে যার মাঝ দিয়ে ঘুষখোর পুলিশ চরিত্রের আভাস ফুটে ওঠে। বোঝা গেল, যাকে ডাণ্ডা মেরে পুলিশ পাকড়াও করেছে তার কাজের ক্ষেত্র জানা না গেলেও সে যে নিয়মমাফিক পুলিশকে মাসোহারা দেয় তা স্পষ্ট। কিন্তু মুশকিল হল যে তাকে ধরেছে তার পকেটে তা না ঢুকে বড়োবাবু হালদারের পকেটস্থ হয়েছে ; আর তাতেই কেস গুবলেট কেননা হালদারবাবু কদিন আগেই বদলি হয়ে গেছে। তাতে কী? নতুন বড়োবাবু এসেছে। তার হুকুম হয়েছে এ ব্যাটাকে ধরে ‘কেস লেখাতে হবে।’ গল্প শেষ হয়। সমাপ্তি ঘটে না চালু সিস্টেমের যার ফাঁদে পড়ে সাধারণ মানুষ প্রতিনিয়ত জেরবার হয়। জোরদার হয় সেই পুরনো কহাবত – রক্ষকই ভক্ষক।
খানিকটা রূপকের আড়ালে লেখা পত্রগল্প “গর্দভ” যেখানে প্রসন্ন নামের কাউকে প্রোটাগনিস্ট লিখছে তার গাধার সঙ্গে মাখামাখির কথা। একবার স্কুলে তাকে চতুষ্পদ জন্তুর রচনা লিখতে দিলে ‘গাধা’ নিয়ে লিখে সে যে শুধু শিক্ষকের কটাক্ষের শিকার হয়েছিল তাই নয়, তার পিঠে কে যেন ‘গাধা’ শব্দটা লিখে দিয়েছিল। এরপর সে বলছে, ছোটোতে সে প্রায়ই গাধার স্বপ্ন দেখত যা শুনে স্বাভাবিকভাবে সবাই হাসাহাসি করত; আর দিদিমা তাকে জলপড়া খাওয়াতে বা গাজিবাবাকে দিয়ে ঝাড়ফুক করাতে নিদান দিয়েছিল। তার কুসংস্কারমুক্ত বাবা এতে রেগে গিয়ে বলেছিল, ‘আসলে ছেলেটার পেটে বড়ো কৃমি আছে। তাই ও অমন স্বপ্ন দেখে।’ এরপর ধোপাপাড়ার পথ ধরে গেলে তার সেই স্বপ্নের কথা মনে পড়ত। যৌবনের পথ পেরিয়ে তার মনে ‘গর্দভ’ শব্দের বানান আর উচ্চারণ নিয়ে দ্বন্দ্ব তৈরি হয় যা বলতে গেলে ‘গর্ধব’ হয়ে যায় যা থেকে সহজেই ‘গাধা’ শব্দের রূপ ধরা পড়ে। একটু খেয়াল করলে বোঝা যায় এমন ভুল আমরা প্রায় সবাই করে থাকি। এরপর সে গাধার স্বপ্নটা বিবৃত করে যেখানে গাধার মেলায় হরেক কিসিমের প্রচুর গাধার আমদানি। সেখানে গাধারা কেউ গাইছে, কেউ নাচছে, কেউ বা আবার ডিগবাজি খাচ্ছে। ‘ওস্তাদ গাধারা আবার চার পায়ের বদলে দু-পায়ে হাঁটছে।’ একজন ক্রেতা নিলামে ওঠা একটা নাগপুরের গাধা চার হাজার টাকায় কিনলে অন্যরা ক্ষুব্ধ হল। এতে অযথাই গাধার দাম বেড়ে গেল। কেউ কেউ পাল্লা দিয়ে দাম বাড়িয়ে লাটসাহেবি জুড়ে দিল। এক একটা গাধার দাম ছ হাজারে ঠেকলে ফাটকাবাজি শুরু হয়ে গেল। এর ফলে কারবারিরা নতুন নিয়ম ঠিক করল যেখানে গাধার আগত-স্থান ধরে মূল্য নির্ধারিত হবে। ‘নাগপুরের গাধাই সব থেকে ভালো’ – এই ধুয়োতে সবাই খুঁজতে থাকলে বেছে নেওয়া দুষ্কর হল। জোচ্চোরে বাজার ছেয়ে গেল। হৃষ্টপুষ্ট গাধাদের নাগপুরিয়া বলে চালানো হতে লাগল। শীর্ণ গাধারা মার খেতে লাগল। এতে বাজার পড়ে গেলে নতুন ঘোষণা দিতে হল: ‘আজকের বাজারে গাধা যেহেতু সবচেয়ে ভালো পণ্য, তাই গাধা কেনাবেচার ব্যাপারে কোনো ট্রেড চালু করা হবে না। রোগা- মোটা নির্বিশেষে শুধু গর্দভ জলেই চলবে।’ মুহূর্তের মধ্যে মেলার মাঠ ফাঁকা হয়ে গেল। খাঁ খাঁ ময়দানে একাকী নায়ক দাঁড়িয়ে হাতে ললিপপ নিয়ে। গল্পের শরীর থেকে উঠে আসা দু-পেয়ে গাধা, নাগপুরিয়া গাধা, কেনাবেচার বাজার ইত্যাকার ইঙ্গিতময় বিষয়ের ধরতাই, আমি নিশ্চিত, আমাদের দেশের নোংরা রাজনীতিসচেতন, চোখ-কান খোলা পাঠককে ধরে ধরে বোঝাতে হবে না।
এক অস্পষ্ট, অদেখা, অধরা রহস্যময় মানুষের জন্য অপেক্ষমান সুতপার ছোটাছুটির গল্পই “প্রতীক্ষা”। শুরুতেই এস টি ডি বুথের সামনে প্রায় চল্লিশ মিনিট অপেক্ষা করেও যখন তার দেখা পেল না, তখন ভাবল, ‘লোকটা কি তবে তাকে ব্লাফ দিল?’ এইসব ভাবনার মাঝে তার মনে হল, কেউ তার গা ঘেঁষে ঘেঁষে হাঁটছে। আড়চোখে তাকাতেই সেই অচেনা বলে উঠল, ‘ মাপ করবেন, আপনার সঙ্গে সময়টা মেলাব বলেই -‘। আসলে সে বলল না, সুতপার মনে হল, সে বলছে। কিছুক্ষণ বচসার পর সুতপা আর তাকে দেখতে পায় না। এরমধ্যে ঘড়ির কাঁটা ঘন্টা পেরিয়ে যায়। সুতপা দ্বিধান্বিত মনে বাড়ির পথে পা চালায়। হঠাৎই রাস্তা পার হতে গিয়ে দেখে কেউ যেন তাকে দেখছে। আবার ‘চোখাচোখি হওয়ামাত্রই ভিড়ের মধ্যে মিলিয়ে গেল সে।’ এইভাবে চকিতে দেখা দিয়ে চকিতে মিলিয়ে যায়, সে কে? পুরুষ হয়ে তার সামনে আসতে দ্বিধা কীসের তার? অথচ ফোনে কথা বলার সময় তো বেশ গদগদ। এইসব তোলপাড় ভাবনা নিয়ে সে এক অচেনা গলিপথে ঢুকে যায়। সামনের বন্ধ পথে বাধা পেয়ে ফিরতি সময়ে সে অবাক হয়ে লক্ষ করে, নানান জায়গা থেকে অনেকেই তাকে দেখছে, ‘গরাদের ভিতর দাঁড়িয়ে কয়েদিরা যেন মুক্ত আকাশ খুঁজছে।’ ঘোলাটে চোখে তাকিয়ে থাকা এক বৃদ্ধের কাছে সে জানতে চায়, ‘আপনি কি আমাকে কিছু বলছেন?’ অনেকক্ষণ সেখানে ঘুরঘুর করছে কেন জানতে চাইলে সে বৃদ্ধকে বলে, সে বেরুনোর রাস্তা খুঁজছে। বৃদ্ধ জানায়, এটা ব্লাইন্ড লেন, তবে একটা চোরা কুঠুরি আছে যা পেরিয়ে বড়ো রাস্তায় পড়া যায়। অবশ্য সে রাস্তা বিশেষ বিশেষ সময়ে ব্যবহারের জন্য। সুতপা ভাবে, সে যার খপ্পরে পড়েছে, সে ‘হয়তো ওকে চোরা পথ দেখিয়ে জালে ফেলতে চাইছে।’ এরপর গলিপথ থেকে বড়ো রাস্তায় বেরোবার সময় সে টেলিফোনের তারে ঝুলতে থাকা একটা নানা রঙের লেজঝোলা পাখি দেখতে পায়। তৎক্ষণাৎ তার মনে পড়ে, লোকটা বলেছিল, একটা রং দেখে সে তাকে চিনতে পারবে। কিন্তু কী রং, তা বলেনি। জিজ্ঞেস করায় হেঁয়ালিভরা উত্তর পেয়েছিল, ‘তার কোনো দরকার হবে না। রং ঠিক হলে একে অপরকে ঠিকই আকর্ষণ করবে।’ মেন রোডে পড়তেই ফের সেই চঞ্চলতা। অসহ্য উত্তাপে গা জ্বলে যাচ্ছে। সুতপা পুরনো অপেক্ষার জায়গাটা খুঁজে বের করতে চাইলেও আর পায় না। মানুষের ভিড় তাকে মুছে দিয়েছে। আনমনে হাঁটতে হাঁটতে লেভেল ক্রসিঙের ধারে চলে এলে কেউ তাকে সাবধান করে, ‘মত যাইয়ে-‘। সে চমকে দেখে, এক পরিত্যক্ত স্টেশন, চারদিকে কাঁটাতারের বেড়া। এখানে ট্রেন চলাচল করলেও ‘কোনোদিন কোনো ট্রেন থামে না।’ হঠাৎই প্রচণ্ড বেগে একটা ট্রেন চলে যায়। ক্রসিং খুলতেই সুতপা ওপারে এক সুপুরুষকে দেখতে পায় যার ‘শরীর থেকে এমন একটা রঙের আভা বেরোচ্ছে যা টেলিফোনের তারে বসে থাকা পাখিটার রঙের থেকেও বেশি আকর্ষণীয়।’ কিন্তু সে রাস্তা পেরোতে পারল না। লোকটা এক ছুটন্ত বাসের আড়ালে পড়ে গেল আবার মিলিয়েও গেল। আখ্যান ফুরোলে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ যেন সামনে এসে আওড়াতে লাগলেন : ‘ আমার প্রাণের ‘পরে চলে গেল কে/ বসন্তের বাতাসটুকুর মতো।…সে চলে গেল, বলে গেল না – সে কোথায় গেল ফিরে এল না।… মনে হল আঁখির কোণে আমায় যেন ডেকে গেছে সে।’
মৃত বারাঙ্গনা রাধাকে নিয়ে গ্রথিত আখ্যান “রাধা” যেখানে নিতাই আছে, আছে কদম্ববৃক্ষও। এ গল্পেরও শুরু ভিড় দিয়ে যেখানে এক কদমগাছের নিচে এক মুমূর্ষু মেয়েমানুষ পড়ে যেন ‘কারোর ফেলে যাওয়া একটা কাপড়ের পুঁটলি’। সেখানে উঁকিঝুঁকি মারা মানুষের সঙ্গে কাল্লু নামের এক কুকুরও ঢুকে পড়ে তার দেহের ঘ্রাণ নিতে থাকে। তার পরনের কাপড়টাতেও ‘কীসের যেন দাগ’। সে তখনও বেঁচে। কেউ একজন তাকে সকালেই শেতলাতলায় ভিক্ষে করতে দেখেছিল, সঙ্গে কাল্লুও ছিল। সেখান থেকে তাড়া খেয়ে সে নিতাই স্যাকরার দোকানে। এরপর সেই দৃশ্যে জুড়ে যায় পাড়ার গেজেট খেঁকুড়ে ঝি পাঁচির মা। সে এসে শনাক্ত করে ‘ছ-নম্বর বাড়ির রাধা’কে। সে ওই বাড়িরই তেতলায় ‘ল্যাংড়া লোকটাকে নিয়ে থাকত’। তখন অনেকেই বিশ্বাস করে উঠতে পারে না, এ সেই রাধা যার চোখ দুটো ছিল হেমা মালিনীর মতো! পাঁচির মা বুঝিয়ে দেয় বয়স চিরকাল এক জায়গায় থেমে থাকে না। আবার একজন বলে, ‘ ওই যে একজন সন্ধে হলেই খোঁপায় ফুলের মালা দিয়ে কত ঘুরে বেড়িয়েছে, এখন সব খুইয়েছে বলে রাস্তায় মুখ গুঁজরে পড়ে আছে। কুকুরে ওর মুখে মুতছে।’ এরপর জানা যায়, নিতাই-ই নানান চেষ্টায় ওকে দোকানের সামনে থেকে সরাতে না পেরে জমাদার বাবুলালকে বখশিশ দিলে সে রাধাকে এই কদমতলায় ফেলে যায়। শোনা যায়, এই নিতাইয়ের কাছেই রাধা পড়তি অবস্থায় তার গয়নাগাটি, এমনকি সাধের হারমোনিয়ামটিও গচ্ছিত রাখতে বাধ্য হয়। কদিন আগে সেই নিতাই তাকে খেদিয়ে দিলে রাধা গালমন্দ করে বলেছিল,’ শালা, জোচ্চোর, ঠকিয়েছ আমাকে – আমাদের পয়সা হজম করলে তুমি শালা নরকে যাবে’। এরপর দলবেঁধে মন্দ পাড়ার বাসিন্দারা রাধাকে দেখতে আসে, কদর থাকতে গুছিয়ে নেয়নি, শুধু ফষ্টিনষ্টি করেছে বলে গাল পাড়তে থাকে। কেউ আবার মোক্ষম বলে, ‘ এ-লাইনে শরীলটাকে যতদিন সাজিয়ে গুছিয়ে রাখতে পারবে তত দিনই তার দর থাকবে’। এ কথা শুনেই একজন গেয়ে ওঠে : ‘ এমন সোনার অঙ্গ কাষ্ঠ করলি কার লাগি…ওরা যে সব দু-নম্বরি’। তাইতো সেই সঙ্গী খোঁড়াও তাকে ফেলে পালিয়েছে। আবার এই খুনে খোঁড়ার মার খেয়েও রাধা শেতলা মন্দিরে পুজো দিতে এসেছে। প্রশ্ন করলে একগাল হেসে বলেছে,’ আমি যে রাধা রে’। হঠাৎ আকাশে মেঘ। বাজ পড়ে। ঝড় ওঠে। গাছটি থেকে কয়েকটি পাতা ঝরে পড়ে রাধার শরীরের ওপর। বৃষ্টি শুরু হলে বিরক্ত লোকজন কেটে পড়ে। শুধু কাল্লু বসে থাকে ওর মার কাছে। এক বাবু গোছের লোক রাধাকে ‘আপদ’ বলে ঘৃণা ছড়ালে প্রতিবাদে এক নষ্ট মেয়ে বলে, ‘ আহা, বাবুর বড়ো ঘেন্না করছে গো। তা রাতের বেলায় এত ঘেনবা কোথায় থাকে’? এই বৃষ্টির মধ্যে এভাবে পড়ে থাকবে দুশ্চিন্তায় এক মেয়ে কাউন্সিলারবাবুর কাছে যাওয়ার প্রস্তাব দেয়। অমনি অন্যজন বলে ওঠে, ‘… কেউ কিছু করবে না… বেশ্যার কাছে সবাই মজা লুটতে আসে।…এখুনি যদি পক্সি ভোটের দরকার হত তো দেখতে’। চালু রাজনৈতিক সুবিধাবাদের প্রতি মোক্ষম আঘাত। এভাবে সবাইকে চলে যেতে দেখে কাল্লু ঘেউ ঘেউ করে ওঠে। কদম গাছের নিচে তার মায়ের শায়িত দেহ অঝোরে ভিজছে আর সে অস্থির ছোটাছুটি করছে। মনুষ্যেতর জীব হয়েও তার পাশবিকতা, থুড়ি, মানবিকতা আমাদের কি লজ্জা দেবে না? দুর্যোগের মাঝে অসহায় সে কেঁদে ওঠে, তার ভাষায়। সেখানেও কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানুষের ভয়। মাঝরাতে কুকুরের অশুভ কান্না কানে যেতেই তারা সব জানলা বন্ধ করে দেয়। এরমাঝেই হঠাৎ এক পুরুষকণ্ঠের মিনতি ভরা ডাক : ‘ কে কোথায় আছ।… শুনছ! আমায় একটু ওই গাছতলাটায় নিয়ে চল।…আমি খোঁড়া ভালো করে চলতে পারি না, শুনছ’। মতিচ্ছন্ন খোঁড়া রাধাকে হারিয়ে মতি ফিরে পায়। মৃত্যু তাকে সব অপরাধ ভুলিয়ে দেয়, যেমনটি হয় আরকি। সবাই দেখে, ‘এতদিন বাদে এই প্রথম এক থোকা ফুল ফুটেছে ওই গাছটাতে।’ বিচ্ছেদের মাঝে মিলনের গান বেজে ওঠে যেন। পরবর্তী গল্পের নায়কও সেই কদমগাছকেই বলা যায় তবে তা রাধা-কৃষ্ণ অন্বিত নয়; তা পরিবেশরক্ষাবিষয়ক, একটি গাছের উপকারী তাৎপর্যবিষয়ক।
“তবুও কদমের ছায়া” গল্পের তেমাথার মোড়ে খাড়িয়ে থাকা ‘ঝুঁটিসর্বস্ব কদম গাছটা’র কীভাবে নিধন ঘটল তারই করুণ বর্ণনা। পাড়ায় সুবর্ণজয়ন্তী বর্ষের শীতলা- রক্ষাকালী পুজো। মহা ধুমধামে আয়োজিত – যে কারণে কদমগাছটির গা ঘেঁষে উঁচু পাটাতন বাঁধা হয়েছে। সেখানে কার্ডবোর্ডে আঁকা বিশালাকার রাক্ষুসির পায়ে ডায়নামো লাগিয়ে ও তার মুখে পেট্রোল ল্যাম্প জুড়ে হাঁ-মুখ দিয়ে আগুন ছুড়তে ছুড়তে চলাচল করানো হচ্ছে। ফলত বিপুল ধোঁয়া আর কেরোসিনের কটুগন্ধে চারদিক ম ম করছে। আলোকসজ্জার এই কেরামতি উৎসুক মানুষকে আনন্দ দিলেও পরদিন থেকে পাড়ার সব অতিষ্ঠ হয়ে উঠল। প্রতিবাদে এগিয়ে এল মল্লিক বাড়ির ছোটোকর্তা। দুঃস্থ গাছটির মৃত্যু অবধারিত জেনে তিনি আগের মতো প্রতিবাদ করেন। এর আগে পাড়ার একদিনের ফুট টেনিস প্রতিযোগিতার সময় গাছটির ডাল কেটে ফেললে তাকে চ্যাংড়াদের কাছ থেকে অপমানজনক কথা শুনতে হয়। তাদের দাবি বৃক্ষরোপণের অনুষ্ঠানে তারাই তো গাছটাকে সার-জল দিয়ে বড়ো করেছে। তা শুনে বৃদ্ধ শ্লেষাত্মক বলেছিলেন, ‘ বড়ো করেছ বলে কি ছোটো করার দায়িত্বও তোমাদের?’ পাড়ার মাতব্বরগোছের কেউ কেউ গাছটিতে শুঁয়োপোকা হয় বলে ডাল কাটার পক্ষেই রায় দেয়। আবার এমন প্রশ্নও ছুঁড়ে দেয় : ‘ আপনার যদি অতই দরদ, তো নিজের অতখানি জায়গা প্রমোটারকে দিয়ে দিলেন কেন?’ এহেন দুর্বল বাধ্যতার জায়গায় আঘাত পেলেও মল্লিক মোক্ষম কথাটি বলেন, ‘ যতসব বৃক্ষহন্তার দল, বোঝে না গাছ না বাঁচলে মানুষ বাঁচবে না।’ যে গাছে এক সময় ময়ূরীর পেখমের মতো কদমফুল ঝুলত তা আজ শ্রীহীন, কালচে। ডিজেল, পেট্রোলের ধোঁয়া তো আছেই, পাড়ার স্যাকরার দোকানের নাইট্রিক অ্যাসিডের বিষাক্ত ধোঁয়াও গাছটিকে শেষ করে দিয়েছে। তা সত্ত্বেও সে ফুল ফুটিয়ে মানুষকে আনন্দ দেয়। যাই হোক, একটা প্রতিবিধানের জন্য চায়ের দোকানে জটলা তৈরি হয় আবার পুজো উদ্যোক্তাদের আসতে দেখে জটলা চুপসেও যায়। সব প্রতিবাদী পরিকল্পনা উবে যায়। এরপরই চারদিক অন্ধকার হয়ে ঝড় ওঠে। এ ঝড় নেতিবাচক, ধ্বংসাত্মক। সেই ঝড়ের তোড়ে নকল রাক্ষুসিটা মুখ থুবড়ে পড়ে, শুরু হয় শিলাবৃষ্টি। মণ্ডপে শর্টসার্কিট হয়ে আগুন ধরে যায়। এবারে দমকল এসে আগুন নেভানোর সঙ্গে সঙ্গে গাছটিকেও খণ্ড-বিখণ্ড করে শেষ করে দেয়। পরদিন সকালে পরিবর্তিত দৃশ্য দেখে মল্লিককর্তার দুরকম অনুভূতি হয়। গাছের বাধা না থাকায় দৃষ্টি প্রসারিত হয়ে আকাশের উদারতা স্পর্শ করে, আবার ‘ধরাশায়ী মস্ত গাছটার লাশটাকে দেখতে দেখতে মল্লিককর্তার বুকের মধ্যে আবার সেই মোচড়টা পড়ে।’
“পাখি” একটি রূপকল্পিত গল্প যা শুরু হয় ফাল্গুনী সকালে কোকিলের ডাক আর শুভজিতের মোবাইলে তিনবার রিংটোন দিয়ে। মিসড কল। বিরক্ত মা স্বর্ণময়ী রান্নাঘর থেকে ‘সোরু-অ-সোরু’ বলে হাঁক পাড়েন। সোরু অর্থাৎ সৌরভি শুভজিতের দিদি। সে এসে বলে, এই রিংটোন ভায়ের মোবাইলের, তার নয়। স্বর্ণময়ী পুরনো দিনে ফিরে বলেন যে আগে এ সব ঝামেলা ছিল না। তখন এক ফোনের এক শব্দ, এমন নানা ফোনের নানা রংঢং ছিল না। যাই হোক, ফোনটা ধরে সোরু জানতে পারে, বন্ধু পায়েলের ফোন, কিন্তু চাইছে শুভজিৎকে। কোকিলের ডাকের ঘটা মাকে অবাক করলে মেয়ে বলে, ‘ কোকিল কি এমনি এমনি ডাকছে? আজকের দিনটা কী দেখতে হবে তো’! সোরুর মুখে ‘ভ্যালেনটাইন ডে’ শুনে মা অবাকপানা জানতে চায়। সোরু বলে, ‘এই দিন পাখিরা নিজের নিজের সঙ্গী নির্বাচন করে’। আসলে পায়েলের ফোনে শুভজিৎ ততটা আগ্রহী নয়। সে স্রেফ তার গার্লফ্রেন্ড কিন্তু দিদি বলে সে ভায়ের ‘ইন্সপিরেশন’। এরপর ভাই-বোনে খানিক কচাল চলে। শুভজিৎ চিত্রশিল্পী। সামনেই তার একজিবিশন, রাত জেগে আঁকা-আঁকি করে। বাস্তবের মা সামান্য উইডো পেনশনে সংসার চালাতে হিমসিম খায়। সোরু এক দুটি টিউশন করলেও ছেলে ছবি বিক্রি করে প্রচুর কামাবে বলে আপাতত উপার্জনের কোনও চেষ্টা করে না। মা ‘ছেঁড়া কাঁথায় শুয়ে লাখ টাকের স্বপ্ন’জাতীয় শখের দোহাই দিলে ছেলে আপত্তি জানিয়ে বলে, শখ নয়, ভবিষ্যতে এটাই তার প্রফেশন হবে। এইসব চাপান-উতোরের মাঝেই দরজা-ঘণ্টি বাজলে সৌরভি ‘পায়েল এসেছে’ অনুমান করে ও সে কথা ভাইকে বলতেই সে ঝেড়ে বলে, পায়েলের সঙ্গে তার যে কোনও সম্পর্ক নেই, তা সে আগেই জানিয়ে দিয়েছে। পায়েলের সঙ্গে তার আদর্শগত মতবিরোধ আছে; তবুও দিদি নাছোড় হয়ে বান্ধবীর পক্ষ নেয়। এরমধ্যেই দ্বিতীয়বার কলিং বেল। দরজা খুলতেই দেখে এক অপরিচিতা সুন্দরী, ‘অনেকটা ক্যালেন্ডারে আঁকা দেবীর ছবির মতো’ নিখুঁত। সে সৌরভিকে চাইছে। এক দুটি টিউশন পেতে চায়। কথায় কথায় জানা যায়, উলটোদিকের ফ্ল্যাটে থাকে, ভাই আর পিসির সঙ্গে। বাবা কর্মসূত্রে বাইরে, মা প্রয়াত। এবারে শুভজিৎ উৎসুক হয়। সে উল্লিখিত ফ্ল্যাট থেকে যে গান সাধার শব্দ পায় তা কার জানতে চায়। মেয়েটি রহস্য জিইয়ে রেখে যখন শুভজিতের কথা থেকে বিভিন্ন সময়োচিত রাগ-রাগিনীর কথা শোনে তখন বুঝতে পারে সেচসুরের সমঝদার। আবার ছবি আঁকে জেনে সে দেখতে আগ্রহী হয়। একটি ক্যানভাস দেখে তার চেনা ঠেকে, প্রখ্যাত শিল্পী ভ্যান গগের কথা মনে হয়। সে এই তথ্যও দেয় যে জীবিতাবস্থায় গগের একটিমাত্র ছবিই বিক্রি হয়েছিল – ক্রোজ অফ দ হুইট ফিল্ড। শুভজিৎ মুগ্ধ হয়ে শোনে। মেয়েটি অনুরাধা। তার আঁকা ছবিটি কপি মনে হচ্ছে কি না, জানতে চাইলে, অনুরাধা বলে, ঠিক তা না হলেও, প্রভাব আছে, বোঝা যায়। প্রশ্ন করলে অনুরাধা বলে, এই ছবিটি আঁকার সময় ভ্যান গগের ভয়ংকর অপরাধবোধ কাজ করেছিল যার প্রতিফলন এই ছবিতে – যেখানে একজন ফসল কাটিয়ের চরিত্র ছিল। শুভজিৎ বলে, তার ছবিতে তো তেমন কোনও চরিত্র বা কাক নেই। অনুরাধা বুঝিয়ে দেয়, ‘… তা নেই। তবে ধানখেতের ওপর ছড়িয়ে পড়া উজ্জ্বল আলোয় কালো রঙের একটা চিলের এগিয়ে আসা’-। শুভজিতের মুগ্ধতা আরও বেড়ে যায়। সে এবার বুঝে ফেলে কানে আসা সুরের আলাপন অনুরাধারই। তাই শিল্পীর মহত্ত্ব বিবেচনা করে সে বলে, ‘ তুমি একজন জাত শিল্পী হয়ে শিল্পচর্চা ছেড়ে টিউশনি করতে চাইছ কেন’? এ-ও বুঝিয়ে দেয়, বাড়ির বিরুদ্ধতা থাকলেও সে কিন্তু তার গোঁ ছাড়েনি। এরমধ্যে শুভজিতের ফোনে আবার রিংটোন। অকাম্য দেখে সে সুইচ অফ করে দেয়। উলটে অনুরাধার নম্বরটি চেয়ে নেয়। অনুরাধা তা দিয়েই ঘর থেকে বেরিয়ে যায় আর তক্ষুনি ‘ দুটো চড়াই ফুরুৎ করে উড়ে পালায় ‘। সৌরভি মাকে বলে, ‘ দেখছ মা,…ও দুটো কেমন উড়ে গেল’। শুভজিৎ-অনুরাধা, দুজনেরই আদর্শগত মিলনের ইঙ্গিত দিয়ে আখ্যানের ইতি ঘটল। যে কোনও আখ্যান নির্মাণে লেখকের জৈবনিক সংশ্লেষ কোনও না কোনও ভাবে থেকেই যায়। তবুও এবারের আলোচনীয় গল্পের শেষে গল্পকার ‘সত্য ঘটনা অবলম্বনে’ কথাটি লিখে দিয়েছেন কেননা যাঁকে নিয়ে এই আখ্যান তিনি বাংলা সংস্কৃতিজগতের এক বিশিষ্ট ব্যক্তি ছিলেন।
“ভিখিরি” গল্পের শুরুই হচ্ছে পেশাদার জ্যোতিষী শশাঙ্ক ভট্টাচার্যের শ্রাদ্ধানুষ্ঠান দিয়ে যেখানে উপস্থিত ব্যক্তিবর্গের মাঝে শশাঙ্কর গণনা নিয়ে নানান ‘জটলা-কটলা’ চলছে। তার অব্য্র্থ গণনা বিষয়ে বেশ কিছু তথ্যও পেশ করছেন কেউ কেউ, অলৌকিক ঘটনার মিশেল সহ। এমন তুঙ্গ আলোচনাকালে হঠাৎই আধময়লা পোশাকে এক মহিলাকে সেখানে দেখে একজন বলে ওঠে, ‘ এই ভিখিরিটা আবার এখানে এসেও জুটেছে’। মৃতর এক নাতনি তার আপ্যায়নে নজর দিলে অনেকেই অবাক হয়ে মহিলাকে নিয়ে ‘কেত্তন শুরু করকরে দিলে’। সেখানে ব্রাহ্মণ নিমন্ত্রিতগণ এককাঠি এগিয়ে বলে, ‘ ব্রাহ্মণ আর কাঙালি এক পংক্তিতে বসবে!’ মুড়ি -মিছরি একাকার হওয়ার আশঙ্কায় তারা বিড়ম্বিত হয়। পরিবারের অকল্যাণ হবে বলেও বিধান দেয়। কিছুক্ষণ পর সবাই দেখে মহিলা যে চেয়ারে বসেছিল, সে সেখানে নেই। কথায় কথায় নাতনির মুখে জানা গেল, মহিলা এক সময় তার দাদুর মক্কেল ছিলেন। নাম উমা, এক কালের প্রখ্যাত অভিনেত্রী উমাশশী। তাঁর রোজগারের রমরমা সময়ে সব না উড়িয়ে তা রক্ষা করতে শশাঙ্ক তাঁকে একটি সিলোনি গোমেদ ধারণ করতে বলেছিলেন, যে কথা না শোনায় তাঁর বিপর্যয় নেমে আসে। বহুদিন বাদে তাঁকে পেয়েও দেখা হল না বলে ভাইপোরা আফশোশ করে ওঠে। নাকউঁচু অতিথিরা তাঁর পরিচয় জানতে চাইলে তারা বলে, ‘ সেকি আপনারা উমাশশীর নাম শোনেননি? ডি এল রায়ের “সাযাহান” নাটকে সরযূবালার পর অত ভালো জাহানারা আর হয়নি।’ সিনেমা, সিরিয়ালে অভিনয় করা ছাড়াও ‘নিমাই-সন্ন্যাসে শচীমাতার পার্ট করে বেশ নামডাক হয়েছে। আজকালকার অভিনেত্রীদের মতো গ্লিসারিন দিয়ে কান্না নয় – একেবারে সত্যি সত্যি কান্না।’ (এখানে গল্পকারের বক্তব্য বিষয়ে তথ্যগত ত্রুটি পরিলক্ষিত হয়, অন্তত গুগল সার্চ করে যা পাওয়া যায় তা হল, উমাশশী জাহানারার ভূমিকায় অভিনয় করেননি, অবশ্যই সরযূবালা করেছিলেন আর শচীমাতার ভূমিকাতেও তিনি অভিনয় করেননি) যাই হোক, এমন একজন শিল্পীকে ভিখিরি বানানোয় ভাইপোরা খুবই ক্ষুব্ধ হল। এরপর সবাই খেতে গেলে দেখা গেল, ‘সমস্ত খালি চেয়ারের মাঝে একটি চেয়ারের ওপর ধূপের একটা প্যাকেট পড়ে আছে।’ এক নীরব শ্রদ্ধার্ঘ্যের অমল ছবিসহ গল্পের ইতি ঘটে।
পুজো-আচ্চা নিয়ে মানুষের ভণ্ডামির এক প্রকৃষ্ট উদাহরণ “বিবস্ত্র” গল্পের পরতে পরতে। ষষ্ঠীতলার রামকৃষ্ণ বেদান্ত মঠে গেরুয়াধারীদের আয়োজনে ভোগ রাগের আয়োজন চলছে। হঠাৎই সন্ধ্যারতির সময়ে গেটের বাইরে থেকে এক বিটকেল গন্ধ নাকে লেগে ভক্তদের অস্থির করে তুলল। সেই কটুবাসের তালাশ করতে গিয়ে দেখা গেল একটা নোংরা পোশাকের লোক গেটের সামনে ‘থ্যাপান মেরে বসে আছে’। তার কুশ্রী চেহারার মাঝেও কোটরস্থ চোখদুটো ‘জ্বলছে সর্পিণীর মতো’। যার গায়ের ময়লা চিমটি দিলে উঠে আসে আর গা চুলকোলে রক্ত বেরোয় তার ‘ভয়ংকর দৃষ্টি সকলের ওপর দিয়েই ঘুরছে’। মাতৃবন্দনা শেষ হয়ে ভোগরাগের তোড়জোড় শুরু হয়। ঠাকুরঘরের দরজা বন্ধ হলে ভক্তদের মধ্যে ‘আধ্যাত্মিক ভাবটা কেটে গিয়ে জাগতিক জীবনের সমস্যা ও সফলতা মাথা চাড়া’ দেয়। এরপর দরজা খুলে গেলে প্রসাদ বিতরণের পালা অথচ সবাই দূরে দাঁড়িয়ে। বিতরণকারী মহারাজকে এর কারণ দেখিয়ে দিলে তিনি সেই লোকটাকে ধমকাতে থাকেন। সে নির্বিকারচিত্তে গা চুলকোতে থাকে। মহারাজ আলগোছে তাকে কয়েকটি নকুলদানা ছুঁড়ে দিয়ে চলে যেতে বলে কেননা ভক্তবৃন্দ সব প্রণাম করতে আসবে। সে অস্পষ্ট ঢঙে কিছু বললে মহারাজ তা বুঝতে পারেন না। তিনি ফাঁড়ির পুলিশকে এই আপদ দূর করতে বলেন। পুলিশ ডাণ্ডা উঁচিয়ে ধরলে মহারাজ পুজোর আবহে মারধর করতে নিষেধ করেন। শাস্তিস্বরূপ তার গায়ে এক বালতি জল ঢেলে দেয়। এইবার লোকটা বলে ওঠে, ‘ তোমরা মানুষেরে এত ঘেন্না করো? আবার প্রার্থনা – প্রার্থনা করি চেল্লাচ্ছ!’ জীবসেবাই যে শিবসেবা, তাও স্পষ্ট করে সে বুঝিয়ে দেয়। আর যে মোক্ষম কথাটি সে বলে তা হল : ‘ আমি একজন বিবস্ত্র। কিন্তু তোমরা সব ধোপদুরস্ত কাপড়চোপড় পরেও একেবারে ল্যাংটো’। এই বলে সে চলে গেলে হঠাৎ ‘মহারাজের হাত থেকে প্রসাদ এবং আশীর্বাদী ফুলসমেত পাত্রটা পড়ে যায়।’ প্রতীকী ঢঙে শেষ হয় গল্প, দেবভক্তির ভণ্ডামির প্রতি এক থাপ্পড় কষিয়ে। ‘পাঁচুগোপালের যখন ঘোর কাটল, তখন আর পালাবার পথ নেই, মাছ একেবারে বর্শাতে গেঁথে গেছে।’
পরবর্তী গল্প “পালক-খসা কাক”, এক পুঁজিপতির ঘরজামাই পাঁচুগোপালকে নিয়ে। শুরুতেই পশ্চিমি ঢঙে লেখা এক দীর্ঘ বাক্য যেখানে বড়তলা থানা থেকে আসা ভোরবেলার এক ফোনডাক পাঁচুর শাশুড়ি মহামায়াকে ধচমচিয়ে মারে কিন্তু লাইন কেটে যাওয়ায় খবর অসম্পূর্ণ থেকে যায়। এমন সময় এক অনামুখো কাকের ডাকে তার মেজাজ সপ্তমে চড়ে যায়। এর ওপর আবার পাঁচুগোপাল হাই তুলতে তুলতে যখন শাশুড়িকে জিজ্ঞেস করে, ‘ ওসি কিছু হদিস দিতে পারলে?’, তখন এক চোখ দেখাচ্ছে বলে তার ওপরেও তিতিবিরক্ত মহিলা ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। সংকেত সব অশুভ। অপমানিত পাঁচু ভাবে, দোষ তারই। কাঁচা বয়সের আবেগকে প্রশ্রয় দিয়েই আজ তার এই হাল। বহুবার চলে যেতে চেয়েও পারেনি, স্ত্রী রূপার জন্য। তাই ‘হ্যাংলার মতো ঘর-জামাই হয়ে পড়ে পড়ে দু-বেলা এই লাঞ্ছনা -গঞ্জনা সহ্য করছে সে’। রূপার যুক্তি, বর্তমান স্ট্যাটাস থেকে ‘নামব বললেই চট করে নামা যায় না’। কলেজে থাকতেই এই বড়োলোকি অহংকারের ফাঁদে পড়ে যায় সে। আর পাঁচটা মেয়ের নজর থেকে ছোঁ মেরে তাকে কবজা করে রূপা, ‘পুরুষকে আকর্ষণ করার মেয়েলি পদ্ধতি ‘ খাটিয়ে। শরীরী মোহিনীশক্তিকেও কাজে লাগাতে ছাড়েনি সে। তবুও কলেজ সোশ্যালে শাড়িপরা, এলোচুলের রূপাকে দেখে পাঁচুর মনে হয়েছিল এই হল ‘আত্মত্যাগে উৎসর্গিত ভারতীয় নারীর আসল চেহারা’ আর তাতেই সে কুপোকাত। এর ওপর রূপার পয়সায় রয়্যাল কিংবা সাবিরের মোগলাই বাপ-মা মরা পেটুক ব্রাহ্মণসন্তানকে টোপ গিলতে সাহায্য করেছিল। সে-ও টিউশনির পয়সা বাঁচিয়ে রূপাকে অ্যাকাডেমিতে নাটক বা মেট্রোতে আর্ট ফিল্ম দেখাতে নিয়ে যেত, তার রুচির বদল আনতে। ওদিকে ছাত্র-নেতা পাঁচুগোপালের পুঁজিপতির মেয়ের সঙ্গে মেলামেশা দলের সবাই ‘মস্ত বিচ্যুতি’ বলে মনে করেছিল। তাকে হিপোক্রিট, অপারচুনিস্ট বলে আওয়াজ দিয়েছিল। তাই সাহারা রূপার দিকেই ঝুঁকেছিল সে কিন্তু অচিরেই বুঝেছিল, সে ফাঁদে পড়ে গেছে। প্রথমে গাঁইগুঁই করলেও আগের দুই জামাই কলা দেখানোয় আর কোনও পুত্রসন্তান না থাকায় রূপার বাবা এই বিয়ে মেনে নিয়েছিল, ঘরজামাই হওয়ার শর্তে। এ সব কাসুন্দি ঘাঁটার মাঝে পাঁচু কাকটাকে তাড়াতে গিয়ে ঘরের একপাশে পড়ে থাকা আয়নায় নিজের ছায়া দেখে শিউরে ওঠে। কিছু পরিচিত মরা মানুষের মুখ ভেসে ওঠে আর ‘সেইসব মুখেদের মাঝে সে তার ছায়াকে হারিয়ে ফেলে’। যে ‘দেবভিলা’য় এখন তার অবস্থান তার ইট দেখে সে আন্দাজ করে বাড়িটা উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে তৈরি, বাবু কালচারের নিদর্শন। আসলে ‘এক শ্রেণির সম্পত্তিকে মর্টগেজে আত্মসাৎ করে আর এক শ্রেণির ভিত্তি স্থাপন হচ্ছে’। এরমধ্যেই থানার লোক আসে। ব্যাপার হল, বাড়ির মালিক নিখোঁজ। বড়োজামাই, মেজোজামাই, দুজনেরই গা- ছাড়া ভাব। একজন হাসপাতালে খোঁজ নিতে বলে তো অপরজন সম্পত্তির লোভে গুমখুনের তত্ত্ব আওড়ায়। পাঁচুগোপালের দায়িত্বের দিকে আঙুল তোলে। হঠাৎই বড়তলা থানার ওসি দাসবাবু ফোনে তাকে চায়। এক সময় ঘৃণার পাত্র হলেও পুলিশ এখন তার পেয়ারের লোক। দাসবাবু জানায়, ‘ কাল বিকেলে কয়লাঘাটার কাছে একটা ডেড বডি পাওয়া গেছে’। বাম ঊরুতে একটা জরুল। ওরা বুঝে যায়, হয় নিশ্চিত। ওসি তাড়াতাড়ি পিজিতে যেতে বলে, নইলে শব মর্গে চলে যাবে। তড়িঘড়ি দাঁত মাজতে মাজতে পাঁচু দেখে একটা বিশ্রী কালো বিড়াল নর্দমায় বসে মাখন চাটছে। এ-ও এক অশুভ সংকেত। মুখ ধুতে গিয়ে তার চোঁয়া ঢেকুর ওঠে। রাত্রে নিয়মিত মদ্যপানের অভ্যেস করেছে সে আর তাতেই আয়নায় মেদভরা মুখ দেখে সে পুরনো নিজেকে মেলাতে পারে না। ওদিকে ভীতসন্ত্রস্ত সবাই তার অপেক্ষায় আছে দেখে সে খানিকটা স্বস্তি পায়। সে লাল মারুতি চেপে বেরিয়ে যায়। বর্তমানে একজন সম্ভ্রান্ত মানুষ হওয়ায় পারমিশন পেতে তাকে বেগ পেতে হয় না। ডোমকে সঙ্গে করে মর্গে ঢুকতেই মেঝেতে পড়ে থাকা উলঙ্গ লাশের দিকে তার চোখ চলে যায়। পাশাপাশি দুই তরুণ -তরুণী। মেয়েটিকে তার চেনা মনে হয়। চকিতে তরুণটির দিকে চোখ যেতেই তার মনে হয় সে যেন ‘নিজের দেহকেই প্রত্যক্ষ করছে’। পনেরো ষোলো বছর আগের সে যেন। ডোম জানতে চায়, সে তার চেনাজানা কি না। সে উত্তর দেয় না বরং এগিয়ে গিয়েই শ্বশুর ‘গোলকপতির লম্বা দেহটা তার চোখে পড়ে ‘। জরুল মিলে যায়। এবারে মরদেহের চারপাশের মাছির ঝাঁক পাঁচুকে ঘিরে ধরে। তার গা গুলিয়ে ওঠে। সে লাশের গায়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। কোনওমতে নিজেকে সামলে সে ছুটে বেরিয়ে যায়। ‘লাশকা ক্যা হোগা’, ডোমের এই প্রশ্নেও সে ঘুরে দাঁড়ায় না। পাঁচু যে এই লাশের মাঝে নিজেকেই প্রত্যক্ষ করে ফেলেছে। একটা আগত ভয়ের আবহে আখ্যনের ইতি ঘটে।
এক খ্যাতকীর্তি অভিনেতা হিসেবে পথচলতি বারবনিতার জামিনদার হওয়ার আত্মজৈবনিক আখ্যান “জামিন”। মেয়েটা নানান বাহানায় একটা চায়ের দোকানে বসে দোকানির সঙ্গে কথা-কাটাকাটি করে সময় কাটায়। তারপর ‘ব্লাউজের ভেতর থেকে দশ টাকার ময়লা নোট বার করে’ দোকানিকে দেয়। জনসমক্ষে এই অশালীন আচরণ তাকেই হয়তো মানায়। তারপরই বেপাত্তা হয়। আবার কখনও কোনও ছোকরা বা বুড়ো কেরানিবাবুর সঙ্গেও তাকে দেখা যায়। এমনই রোজনামচায় সে আলাপ জমায় অভিনেতা -গল্পকারের সঙ্গে। সরাসরি ‘তুমি’ সম্বোধনে। অভিনেতা থতমত খেলে সে বলে, ‘ আর্টিস্ট বলে তোমার খুব গুমোর হয়েছে ‘? আবার বুঝিয়েও দেয়, অমন আর্টিস্ট সে অনেক পার করে দিয়েছে। এই সামান্য আলাপচারিতার পথ ধরে তারা সম্পর্কিত হয়ে পড়ে। ‘মাদার ইন্ডিয়া ‘, নার্গিসের দুর্দান্ত অভিনয় নিয়ে কথা-টথা হয়। এক দুবার খিদে পেয়েছে বলে টাকা চাইলে দিতেও হয়। এরমধ্যেই এক বৃষ্টি – লাঞ্ছিত রাত্রে অভিনেতা তাকে রাস্তায় আবিষ্কার করে। বুঝতে পারে না, বৃষ্টিতে আটকে নাকি ‘রাতদুপুরে শিকার খুঁজতে বেরিয়েছে’? হঠাৎই সে ‘কী যাবেন না কি’? বলে ডাক দিলে অভিনেতার বুকটা ধড়াস করে ওঠে। মেয়েটা তার কাছে জানতে চায়, ‘ তুমি এত রাতে এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কী করছ’? এই অদ্ভুত প্রশ্নে অভিনেতা বিরক্ত হয়। এমন সময় পুলিশভ্যানের আওয়াজ পেয়ে উভয়েই ঝামেলায় পড়ে যাবে এই আশঙ্কায় মেয়েটা তাকে টেনে একটা বস্তির ভিতর নিয়ে যায়। ওঠে এক মাসির ঘরে। মাসি স্বাভাবিক খ্যানখেনে হলায় বলে, ‘ আজও তাহলে জুটিয়েছিস কাউকে ‘! শুনে মেয়াটা খিকখিকিয়ে বলে, ‘হ্যাঁ দেখলেই মালুম পাবে একেবারে ফোতো কাপ্তেন ‘। লজ্জাতুর অভিনেতা ভাবে, শেষ অবধি একটা বাজারি মেয়ের কাছে তাকে হেনস্তা হতে হল! দৌড়ে পালাতে গিয়ে পা পিছলে পড়ল, এল কাঁপুনি দিয়ে জ্বর। সম্বিত ফিরলে সে দেখে, মেয়েটির কোলে মাথা রেখে শুয়ে আর সে মমতা মাখা দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে। জোর করে উঠতে গিয়ে সে দেখে, মেয়েটির বাঁ হাতের কবজির নিচে উল্কিতে লেখা ‘নার্গিস’। সে তাকে জোর করে শুইয়ে রেখে বলে, ‘মাসি ওষুধ আনতে গেছে’। কান্নাকাটি জুড়ে দিলে মেয়েটি তাকে আস্বস্ত করে। মেয়েটা কাপড়ের আঁচলের জলপটি কপালে দিতে লাগলে ও যেন ছোটোবেলার মায়ের হাতের স্পর্শ অনুভব করে। মেয়েটি সম্পর্কে তার ধারণা পরিবর্তিত হতে থাকে। সেখানে রাতভর থেকে সকাল হলে, অভুক্ত আছে বলে মেয়েটি তাকে দোকান থেকে ভালো জিলিপি এনে খাওয়ায়। তার আগে তার ‘হাত-মুখটা ধুইয়ে দিয়ে আঁচল দিয়ে মুখ মুছিয়ে দিল’। এবারে যেতে হবে। পুনরায় স্থান- মাহাত্ম্যের কথা ভেবে সে লজ্জিত হয়। বাইরে ফের বৃষ্টি, তবুও মেয়েটির মিনতি উপেক্ষা করেই ‘গুঁতো খাওয়া জানোয়ারের মতো’ বড়ো রাস্তার দিকে হেঁটে চলে যায়। এরপর একদিন মাসির ঘরের দিকে যেতে নিলে তার কানে যায়, মাসির সঙ্গে টাকাপয়সা নিয়ে মেয়েটির বচসা চলছে। সে এবারে উলটো পথে হাঁটা ধরল। অস্তায়মান সূর্যের মায়াবী আলো তাকে ঈশ্বরমুখী করে। কানে আসে মন্দিরের সন্ধ্যারতির কাঁসর -ঘন্টার সুরেলা ধ্বনি। এরপর গল্পকার – রূপী অভিনেতা সিনেমা, সিরিয়ালের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। তবুও বাড়ির কাজের নতুন মেয়েটা বেপাত্তা হওয়ায় তাকে থানায় যেতে হয়। সেলিব্রিটি হওয়াতে সে সব কিছু ম্যানেজ করতে পারবে, এই জোরে তাকেই যেতে হয়। ওসি তাকে দেখে খুব উল্লসিত হয়। কনস্টেবল তাঁকে চিনতে পারে না দেখে সে বড়োবাবুর বকাও খায়। হারিয়ে যাওয়া মেয়েটির ছবি না থাকায় ডায়েরি নেওয়া না গেলেও ওসি মিসিং রিপোর্ট লিখিয়ে নেয়। আচমকা তার কানে কানে চেনা চিৎকার। ‘গায়ে হাত দেবে না বলছি’, ‘সতীপনা’, এইসব পুলিশি শব্দ তার কানে আসে। সে অস্বস্তি বোধ করলে ওসি বুঝে নিয়ে বলে, ‘ ওকে চেনেন, আপনাদের লাইনের কেউ বুঝি’! ওকে কোত্থেকে ধরে এনেছে, ওসি জানতে চাইলে জানা গেল, এই মক্ষিরানি পার্কে ব্যাবসা চালাচ্ছিল। ওসি জানতে চাইলে মেয়েটা বলল, ‘পেট তো চালাতে হবে ‘! ওসি এরপর ধমক-টমক দিয়ে ওকে বেরিয়ে যেতে বলে। ও বেরিয়ে গেলে ওসি হেসে বলে, ‘ শুধু আপনার মুখ চেয়ে এবারের মতো ছেড়ে দিলাম ওকে, বলতে পারেন আপনিই ওর জামিন হলেন ‘। ঘটনাচক্রে হতভম্ব হলেও কোথাও যেন স্বস্তি পায় অভিনেতা।
বইয়ের শেষ গল্প “অরুন্ধতীর আত্মহত্যা ” – ইন্দ্রভিলার অরুন্ধতী ও ও পোস্টম্যান তারাপদ বাঁড়ুজ্যের আখ্যান। সকালের ভিড় ঠেলে একটা কালো ভ্যান ইন্দ্রভিলার সামনে এসে দাঁড়ায়। চকিতে সকলের কানে যায়, ‘ শেষপর্যন্ত কী ঘটল আবার? এর আগেও তো শুনেছি অ্যাটেম্পট করেছিল দু-দুবার ‘। সকলেই ঘুরে তাকিয়ে দেখে, পিয়োন তারাপদ। ওর কাছে সত্যিটা জানতে চায়। বাড়ির লোকজন আত্মহত্যা মানতে রাজি নয়, ঘুমের ওষুধের ডোজ মাত্রাছাড়া হওয়ায় নাকি এমন কাণ্ড ঘটেছে। তারাপদ অন্যমনস্ক হলে নাছোড় পাবলিক তাকে খোঁচাতে থাকে, আগের দুবার অ্যাটেম্পটের বিষয়ে জানতে চায়। তারাপদ জানায়, প্রথমবার ওড়নার ফাঁস আলগা হওয়ায় ব্যর্থ হয়েছিল আর দ্বিতীয়বার দেহে ইলেকট্রিক হিটারের তার জড়াতে চেয়েও পারেনি। এটা তৃতীয়বার। অরুন্ধতী একটু খুঁড়িয়ে হাঁটে, ছোটোতে ফুল পাড়তে গিয়ে পড়ে গিয়েছিল। এইসব বলে -টলে তারাপদ ডিউটি সারতে যাবে বললে সকলে বুঝিয়ে দেয়, এই যে ইন্দ্রভিলার হাঁড়ির খবর সে দিল, সেটাই তো বড়ো ডিউটি। কোনও কাগজ বা মিডিয়া এ সব ভাঙবে না। এরপর একটা পুলিশের গাড়ি এলে সেখান থেকে মুখ-ঢাকা একজনকে নামানো হয়। মুখের ঢাকা সরে গেলে সবাই অবাক হয়ে দেখে যে এই সেই ব্যক্তি যার সঙ্গে অরুন্ধতী গা ঘেঁষাঘেঁষি করে পথ হেঁটেছিল। তারাপদও বুঝতে পারে, এরই সঙ্গে অরুন্ধতী বহুবার পোস্ট অফিসে এসেছে ‘একটা নীল খামওয়ালা চিঠির খোঁজে ‘। মেয়েটিকে ধরে ধরে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে নিয়ে যেতে দেখে তারাপদ একদিন বলেই ফেলেছিল,’ ওদেরকে মনে হচ্ছে ডানা ভাঙা কোনো পাখিকে পিঠে নিয়ে অন্য কোনো পাখি আকাশে উড়ছে’। শুনে অরুন্ধতী হেসে বলেছিল, ‘ মাটিতে নয়,আকাশে’? তারাপদর তাৎক্ষণিক উত্তর ছিল, ‘ নক্ষত্ররা তো আকাশেই থাকে, সপ্তর্ষিমণ্ডলের সবচেয়ে ক্ষীণ নক্ষত্রের নাম অরুন্ধতী ‘। শুনে মেয়েটি বলেছিল, ‘ আপনি অনেক কিছু জানেন ‘। এরপর সুযোগ বুঝে ‘চিঠি আছে’ বলে পুলিশকে ফাঁকি দিয়ে সে বাড়ির ভিতরে ঢুকে যায়। ‘চিঠি কার নামে ‘ প্রশ্ন করলে সে মেজাজে বলে, ‘ যার চিঠি সে ছাড়া আর কাউকে বলা নিষেধ আছে ‘। ভিতর থেকে নারীকণ্ঠের কান্না শুনে তার চেনা লাগে। সন্তর্পণে ঢুকে সে অনুভব করে ‘নারীরূপী এক ছায়া পা -পা করে এগিয়ে আসছে ওর দিকে।… যাকে দেখতে অবিকল অরুন্ধতীর মতো ‘। কায়ারূপী ছায়া দেখে সে ঘামতে থাকে। মৃত কীভাবে হেঁটে আসছে! তারাপদ অবাক হয়ে দেখে, যে মেয়েটির গায়ের রং ছিল কাঁচা সোনার মতো, সে ‘কেমন সাদা সাদা শ্বেতপাথরের মতো গ্লেজ মারছে’। এরপর সে আত্মা নিয়ে পুরনো জ্ঞানে ভাবিত হয়। তার ধারণা হয়, আত্মা হল দেহ-বহির্ভূত সূক্ষ্মশরীর। তার সঙ্গে রক্তমাংসে গড়া দেহের মিল হতে পারে না। এই প্রসঙ্গে তার বিভূতিভূষণের ‘দেবযান’এর কথাও স্মরণে আসে। হঠাৎই তার মনে হয়, শরীর ছেড়ে গেলেও অরুন্ধতীর আত্মা ‘ইন্দ্রভিলার মমত্ব ত্যাগ করতে পারেনি’। আবারও সে দেহ, আত্মা,এইসব নিয়ে ভাবিত হয়। ‘দেহ পরিগ্রহই আত্মার দুঃখের কারণ ; নিবৃত্তি ঘটলেই তার ভোগ শেষ হয়। তারাপদর মনে হয়, সে কারণেই হয়তো অরুন্ধতী বারবার দেহকে বিনাশ করতে চেয়েছে ‘কেননা ভালোবাসা আত্মায় নয়, শরীরের মধ্যে’ – এটা সে মেনে নিতে পারেনি( আসলে নক্ষত্র অরুন্ধতী হল হিন্দু রীতিমাফিক সতীত্ব, ঐতিহ্য আর সংস্কৃতির প্রতীক। তার মেলামেশায় কোনওভাবে কি তার এই বৈশিষ্ট্যে আঘাত লেগেছিল?)। তারাপদ কি হ্যালুসিনেশনে মজে আছে! ছায়ারূপী কায়াকে খুঁজতে গিয়ে তার চোখ যায় ‘সিঁড়ির এক পাশে পড়ে থাকা একটি পাথরের নারীমূর্তির দিকে’। বাগানের নানাবিধ ফুলগাছের মাঝে এই মূর্তিটিও ছিল আয়লার ঝড়ে পড়ে যার একটা পা ভেঙে যায়। এমন সব অতীত ঘুরপাক খাওয়ার সময় অরুন্ধতীর মা ওকে দেখতে পেয়ে ডাক দেয়। তারাপদ নীরবতা কাটিয়ে যেন বলে,’ চিঠি আছে’। ‘কার নামে’? এ কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে আরও কয়েকজন পুরুষকে যেন দেখতে পায় তারাপদ। একজন বলে ওঠে, ‘ এ তো সেই পিওনটা, যার কাছে অরুন্ধতী আমাকে সঙ্গে নিয়ে যেত মাঝে মাঝে, ওর কী একটা চিঠির খোঁজে ‘। এই গলা চিনতে পারে সে। ওর সব কিছু ভৌতিক ঠেকে। চিঠি না দিয়েই চলে যেতে নিলে সবাই জানতে চায় আর সে বলে, ‘ মরা মানুষের চিঠি ডেলিভারি করা যায় না। তাই ইনটিমেশন দিয়ে চলে যাচ্ছি’। তা সত্ত্বেও অরুন্ধতীর মা যখন বলে, ‘ আমি ওর অথরাইজড পার্সন, আমাকে দেবে না’?, তখন তারাপদ শ্লেষ মিশিয়ে বলে, ‘ হুঁ! মড়ার আবার অথরাইজড পার্সন ‘। বেরিয়ে আসতেই পুলিশে ধরবে ভয়ে তারাপদ ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুট লাগিয়ে এক পাঁচিলের ওপর উঠে পড়ে। গাছে থাকা দুপুরের কাক কা কা রবে ডেকে ওঠে। এরপর সে পাঁচিলের পিছনে ঝিলের জলে লাফ দেয়। পিস্তল চালানোর শব্দ পায় যেন। সে চোখ বন্ধ করে। কিছুক্ষণ পর চোখ খুলে দেখে, ‘তার শরীরটা আটকে গেছে একটা গাছের শেকড়ে’। সেই গাছের ডালে বাদুড়ের পাল ঝুলছে। সে বিড়বিড়িয়ে বলে, ‘ এ এক অদ্ভুত জীব,… ডানা আছে, তবু আকাশে না উড়ে ঝুলে থাকে গাছের ডালে। নীচের দিকে মুখ করে ‘। সেচেক আচ্ছন্নতার মধ্যে হাঁটতে থাকে। ট্রেনের ডাক শোনে। ভাবে, কামরায় যারা বসে, তারা ওর আপন কি না! হঠাৎই ওর মনে হয়, ও যেন শূন্যে ভাসছে, উড়ে যাচ্ছে। চারপাশে ওর পেঁজা তুলোর মতো মেঘ ভাসছে। ভয়ংকর এক নীল আভার মাঝে দেখে ‘অপরূপ এক সুন্দরী হাতছানি দিয়ে ডাকছে ওকে ‘। বলছে,’ চিনতে পারছ না আমাকে ‘? তারাপদ নিচে তাকালে সুন্দরী বলে, ‘আবার নীচের দিকে কী দেখছ, বলেছিলে না, নক্ষত্ররা আকাশেই থাকে, তুমিও তো তারা, তাই তো এসেছ এখানে ‘। এতক্ষণে ঘোরে থাকা তারাপদর হুঁশ ফেরে। সে দেখে, ইন্দ্রভিলার গেট দিয়ে অরুন্ধতীর লাশ বেরুচ্ছে। উৎসুকজনেদের মাঝে ঠেলাঠেলি শুরু হয়। লাশ নির্গত হলে সে বাড়ির দরজাঘন্টি বাজায়। দারোয়ান তেওয়ারি চিঠির জন্য হাত বাড়ায়। তারাপদ বলে, ‘ আজ চিঠি হাম নেহি দে সাকতা, তুম জলদি তোমারা মালকিন কো অফিস ভেজনা, নহি তো চিঠি ওয়াপাস চলা যায়গা’। গল্প শেষ হয়। পাঠকের মনে নীল খামওয়ালা চিঠির রহস্যময়তার উন্মোচন ঘটে কিংবা ঘটে না।
নিমাই ঘোষের গল্প এক অনুসন্ধানী উন্মোচন। বইটিতে বানানগত বেশ কিছু ভুল তথা তথ্যগত ত্রুটি থাকা সত্ত্বেও, আমি বলব, পাঠক, তাঁর গল্পাবলি পড়ুন। অবশ্যই নব আবিষ্কারে বিমোহিত হবেন।
বিপ্লব বিশ্বাস
বিপ্লব বিশ্বাসের জন্ম: ১৭.০১.৫৪ পশ্চিমবঙ্গে। তিনি মৌলিক ও ভাষান্তরিত গল্প-আঙিনায় দীর্ঘ অভিজ্ঞতাপুষ্ট। ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র ও অবসৃত প্রধানশিক্ষক। তিনি ভারতের কেন্দ্রীয় সাহিত্য অকাদেমির নথিভুক্ত অনুবাদক। তাঁর প্রথম লিখিত গল্প 'সমতট' আয়োজিত সারা বাংলা গল্প প্রতিযোগিতায় দ্বিতীয় স্থান লাভ করেছিল। এ রাজ্য, ভিনরাজ্য তথা ভিনদেশের ছোট, বড়ো সাময়িক ও দৈনিক পত্র-পত্রিকাতে তাঁর গল্প, প্রবন্ধ সসম্মানে প্রকাশিত। নানাবিধ টানাপোড়েনে তাঁর কলমচারিতা নিয়মিত হতে পারেনি। ২০২৪ সালে তিনি ভাষা সংসদ ও অনুবাদ পত্রিকা কর্তৃক জীবনকৃতি সারস্বত সম্মানে ভূষিত হয়েছেন। প্রকাশিত বইপত্র : এবং গণ্ডারের শোক (গল্পগ্রন্থ), ক্ষোভ বিক্ষোভের গল্প (গল্পগ্রন্থ), ইচ্ছেখাম (গল্পগ্রন্থ), বাছাই ছাব্বিশ (গল্পগ্রন্থ), দক্ষিণ ভারতীয় ছোটগল্প (অনুবাদ), পড়শি ভাষার গল্প (অনুবাদ), বিদেশি গল্প সংকলন (অনুবাদ), ভারতীয় ইংরেজি গল্প (অনুবাদ), সামরিক সারমেয় কথা (অনূদিত উপন্যাস), সাহিত্যে নোবেল বক্তৃতা (অনুবাদ), আহারের আড়কথায় শ্রীরামকৃষ্ণ (প্রবন্ধগ্রন্থ) ও জীবনানন্দের গল্পজগৎ ( প্রবন্ধগ্রন্থ)।

