[সোমালিয়ার খ্যাতিমান কথাসাহিত্যিক নুরুদ্দিন ফারাহ রাজনৈতিক সচেতন লেখার জন্য অধিক পরিচিত। একনায়কতন্ত্র, পুরুষতন্ত্র ও ধর্মীয় বিশ্বাসকে অস্ত্র করে পরিবার ও সমাজ ব্যবস্থায় নারীকে অবদমনের নির্মম চিত্র ফুটে উঠেছে তার কিছু উপন্যাসে। From A Crooked Rob – নুরুদ্দিন ফারাহর লেখা প্রথম উপন্যাস।

লেখক উপন্যাসটি লিখেছেন ইংরেজিতে এবং এটি লেখার সময় তিনি ইন্ডিয়াতে ছিলেন ছাত্র হিসেবে। “বাঁকা পাঁজরের মেয়ে” উপন্যাসটি লেখকের From A Crooked Rib উপন্যাসের বাংলা অনুবাদ। বইটির পঞ্চাশ বছর পূর্তি অনুষ্ঠানে একটি কথা অনেকবার শোনা গিয়েছে যে এটি একটি ফেমিনিস্ট উপন্যাস। অর্থাৎ নারীবাদী উপন্যাস। অর্থাৎ যেখানে জীবনকে দেখা হচ্ছে নারীর পক্ষ থেকে সুনজরে। এটি কি একটি ফেমিনিস্ট উপন্যাস? লেখক নুরুদ্দিন ফারাহ কি একজন ফেমিনিস্ট? সাংবাদিকের এমন প্রশ্নের উত্তরে নুরুদ্দিন ফারাহ বলেছেন, তিনি ফেমিনিস্ট নন, বরং যা ন্যায্য তা ন্যায্য বলেই বলেছেন। এবং যা ন্যায্যই তাকে ন্যায্য বলা মানে ফেমিনিস্ট হওয়া নয়।

উপন্যাসের প্রধান চরিত্র ইবলা, ১৭ বছর বয়স। দাদা তার বিয়ে ঠিক করেছেন ৪৮ বছর বয়সী একজন লোকের সাথে, কয়েকটি উটের বিনিময়ে পাকা হয়েছে এই বিয়ের চুক্তি। ইবলার সমগোত্রীয় মেয়েরা যা করার সাহস করেনি কখনো, সে তাই করলো। ইবলা বিয়ে করতে রাজি হয় না। সকালের আলো ফোটার আগেই গ্রাম থেকে পালিয়ে গেলো একদিন। তারপর পাঠক রুদ্ধশ্বাসে পড়তে থাকে ইবলার নতুন জীবনের নানারকম রোমাঞ্চকর ঘটনাগুলো। চমকপ্রদ এই উপন্যাসটি পড়ার সময় আমার মনে হচ্ছিলো, এ তো আমাদের খুব চেনা জানা জীবনেরই গল্প। ভাবলাম, এতো ভালো একটি লেখা বাংলায় অনুবাদ হওয়া খুব দরকার। আশা করছি, উপন্যাসটি যারা পড়বেন, তারাও পরবর্তীতে আমার সাথে একমত হবেন।]
বাঁকা পাঁজরের মেয়ে (পর্ব – এক) // নুরুদ্দিন ফারাহ, অনুবাদ: লুনা রাহনুমা
“ঈশ্বর নারীকে সৃষ্টি করেছেন একটি বাঁকা পাঁজর থেকে;
আর যখন কেউ এটাকে সোজা করার চেষ্টা করে,
সে এটা ভেঙ্গে ফেলে।”
-একটি চিরাচরিত সোমালি প্রবাদ
প্রস্তাবনা
তিনি শুধু অভিশাপ দিতে পারতেন। তিনি শুধু এটুকুই করতে পারতেন। এছাড়া তিনি উপদেশ দিতে পারলেও, এখন অভিশাপ দিলেন।
বৃদ্ধ লোকটি মাটিতে উবু হয়ে পড়ে আছে। নোংরা মাটিতে তার পালক-ওজনের শরীরটি পড়ে আছে। ষাট পাউন্ডের বেশি হবে না ওজন। হাতে একটা তসবি খুব শক্ত করে আঁকড়ে ধরা। নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করলে যে কেউ মনে করবে, তিনি তসবির সুতোর কাছে আশ্রয় চাইছেন। তার হাত দুটি সামনের দিকে প্রসারিত এবং নিতম্ব গোড়ালি জোড়ার উপর বিশ্রাম নিচ্ছে। পায়ে জুতো নেই। তিনি একজন বৃদ্ধ মানুষ— বয়স আনুমানিক আশি। তবে তিনি নব্বই`র চেয়েও বেশি হতে পারেন, আবার কম হবারও সম্ভাবনা আছে। তিনি যে সময়ে জন্মগ্রহণ করেছিলেন, তখন কেউ সন্তানের জন্ম তারিখ নিয়ে মাথা ঘামাত না। একটি শিশু যদি বসন্তের শেষ দিনে জন্ম নিত, তাহলেও তার বয়স এক বছর বলেই ধরা হতো। তখন শুধু বসন্তই গণনা করার নিয়ম ছিল। বসন্তের তিনটি মাস ছিল সবকিছু: মানুষের জন্য এবং পশুদের জন্য। বিবাহের আয়োজন করা হতো বসন্তে; যুদ্ধ বাধতো ; সাধুদের কাছে আশীর্বাদ চাওয়া হতো; গোত্রীয় লড়াই হয় শুরু নতুবা শেষ হতো। অর্থাৎ, বসন্ত মানেই ছিল সবকিছু। এর অর্থ ছিল সুখ; এর অর্থ ছিল গবাদি পশুর জন্য সবুজ চারণভূমি; এর অর্থ ছিল গবাদি পশু থেকে আসা দুধের পরিমাণ, যা কারো কারো জন্য কৃষি সমৃদ্ধিও বোঝায়। বসন্ত ছিল আধা দেবতা।
বুড়ো লোকটি চোখ পিটপিট করে দেখে তার দিকে কে আসছে। এটা তার নাতি— ইবলার ভাই, যে ইবলা আজ সকালে পালিয়ে গিয়েছে। একা, নাকি কোন পুরুষলোকের সাথে ভেগে গিয়েছে, এই কথা নিশ্চিতভাবে কেউ জানে না এখনো। নাতি ছেলেটি এসে বৃদ্ধের পাশে মাটিতে বসে পড়লো। আধ-বোঁজা চোখে সে দাদাকে দেখছে, নিজের অনাবৃত হাঁটুর উপর হাত ঘষলো বার কয়েক। তারপর খুশকিতে ভরা মাথার কালো, ঢেউ খেলানো, না ধোয়া চুলগুলোর ভেতর আঙ্গুল ঢুকিয়ে দিলো। তার বয়স এখন প্রায় ষোল, কিন্তু সে পরিবারের একমাত্র ছেলে যার মা এবং বাবা দুজনেই অনেক আগে মারা গেছে। মা বাবার শূন্যতা নিয়ে একা বেড়ে উঠতে গিয়ে নির্মম ও কঠোর পরিশ্রম তাকে সময়ের চেয়ে বেশি বয়স্ক বানিয়ে দিয়েছে। নিজের রুক্ষ শরীরটিকে ঢেকে রাখার জন্য ছেলেটির কাছে শুধু একটি কাপড়ের টুকরো আছে। তার শরীরের চামড়া ভীষণ রুক্ষ, কারণ উট পালনের সময় যখন সে ঘন্টার পর ঘন্টা রোদের ভেতর হেঁটে যায়, তখন তার নরম ত্বককে চড়া সূর্যের তাপ আর কাঁটাঝোপ থেকে রক্ষা করার মতো কিছুই থাকে না সেখানে। ‘সে চলে গেছে। খবরটা নিশ্চিত, ’ বৃদ্ধকে উদ্দেশ্য করে ছেলেটি বললো।
বৃদ্ধ চুপ করে আছে: হয়তো সে ধ্যান করছে। ছেলেটা দুঃখী চোখে মাটির দিকে তাকিয়ে থাকে। বৃদ্ধ লোকটি তার তসবি পুঁতি গণনা করছে। ওখানে নিরানব্বইটি পুঁতি আছে, যেগুলো প্রতিটি খোদার একেকটি নামের প্রতিনিধিত্ব করে। তার শরীর শীর্ণ, দুর্বল। এই পৃথিবীতে তার সমবয়সীরা অনেক আগেই খোদার কাছে ফেরত পৌঁছে কৃতকর্মের তালিকা জমা দিয়ে ফেলেছে। এলাকার মানুষজন সন্দেহ করে আদৌ কোনদিন তিনি মারা যাবেন কিনা। তিনি মুখ খুললে, সোমালি যোদ্ধা সাইয়্যেদ মোহাম্মদ আব্দুল হাসানের সাথে ব্রিটিশদের যুদ্ধের কাহিনীটি কয়েক মিনিটে বিশদভাবে বর্ণনা করতে পারতেন। ঘটনাটি এমনভাবে বলতেন যেন সেটি সাইয়্যেদের ব্যক্তিগত সমস্যা ছিল (শুধু সাইয়্যেদ, খেয়াল করবেন) এবং ব্রিটিশ। সাইয়্যেদ এটা করেছেন। সাইয়্যেদ ওটা করেছেন। সাইয়্যেদ করফিল্ডকে হত্যা করেছেন। সাইয়্যেদ এমন একটি গোত্রের সাথে আলাপ আলোচনা করেছেন যারা চরম বিদ্রোহী ছিল। পরে সাইয়্যেদ বিদ্রোহীদেরকে নির্মূল করেছেন। সাইয়্যেদের প্রায় সব কবিতাই তিনি মুখস্ত বলতে পারেন। সাইয়্যেদ হচ্ছে একটিমাত্র নাম— যা বৃদ্ধের অতীত জীবনের হারিয়ে যাওয়া উদ্দীপনাকে পুনরুজ্জীবিত করতে পারে। এছাড়া, তার অন্য কোন অনুভূতি নেই। কোন মানুষকে বা কোন বস্তুকেই সে আর ঘৃণা করতে পারে না, ভালোও বাসতে পারে না। বৃদ্ধের একমাত্র পুত্র— ইবলা এবং এই অল্প বয়সী ছেলেটির পিতা— মারা যাবার আগেই বৃদ্ধ তার সমস্ত গৌরববোধ হারিয়ে ফেলেছেন। জীবনের মহিমাকে তিনি নীরবতার সাথে বিনিময় করেছেন— কিংবা বলা যায় বাক-সংযমের সাথে বদলাবদলি করেছেন।
কিন্তু এখন আর চুপ করে থাকতে পারলেন না। তিনি একজন বৃদ্ধ মানুষ। তার প্রধান দায়িত্ব হচ্ছে উপদেশ দেওয়া। কম বয়সীদের কাছে তাদের জন্মের আগের সময়ের কথা উল্লেখ করা। আসন্ন বর্ষাকাল সম্পর্কে সবাইকে জানান দেয়া। দুনিয়ায় একজন মানুষের কী করা উচিত এবং কী বলা উচিত নয়, তা বলা। সর্বশক্তিমান খোদার ইবাদত করা নিয়ে বক্তৃতা দেয়া। সেই সৃষ্টিকর্তার গুনগান করেন তিনি, যার কাছে বর্তমানের এই অতি-বৃদ্ধ মানুষটি, অনেক বছর আগেই নিজের জীবনকে উৎসর্গ করে দিয়েছেন। যদিও তার ভাবনাকে গ্রামের কেউ বিশেষ পাত্তা দেয়নি কখনো, তবুও বৃদ্ধ লোকটির অনেক কিছু বলার ছিল, মধ্যবয়সী এবং যুবকদের কাছে। এখনকার দিনের লোকজন আগের দিনের মানুষদের মতো তার কথার প্রতি মনোযোগী নয়, হয়তো তাদের শরীরের তরুণ রক্ত তাদেরকে তেজস্বী এবং অবাধ্য করে তুলেছে।
ইবলার এমন হঠাৎ করে নাই হয়ে যাওয়ার ঘটনাটি মুহূর্তের ভেতর বৃদ্ধের মনের অনেক কিছুকে মেরে ফেলেছে। যদিও তিনি জানেন না কেন। ইবলার বয়সী অনেক মেয়েকে তিনি নিজের পরিবার থেকে পালিয়ে অন্য পুরুষের বুকে চলে যেতে দেখেছেন, বিয়ে করতে। এমন অনেক ঘটনাই দেখেছেন। তিনি নিজেও করেছেন এই কাজ। অথবা বলা যায় তার স্ত্রী করেছিল তার জন্য। কিন্তু যে চিন্তাটি বৃদ্ধকে বেশি আতঙ্কগ্রস্ত করে তোলে, তা হলো তাকে দেখাশোনা করার জন্য কেউ রইল না আর। যখন ভালোবাসার ক্ষমতা ছিল তখন তিনি অন্য সবার চেয়ে ইবলাকে বেশি ভালোবাসতেন— নিজের চোখগুলোকে যতটা ভালোবাসতেন, তিনি তার চাইতেও বেশি ভালোবাসতেন ইবলাকে। ‘ইবলা যদি আমার আগে মারা যায়, খোদা যেন আমাকেও নিয়ে যান,’ আগেও এই কথা একাধিকবার বলেছেন তিনি গোপনে এবং প্রকাশ্যে। এবং তিনি মন থেকেই বলতেন কথাটি। ইবলার ভাই তার ব্যাপারে উদাসীন। ‘কিন্তু সে অল্প বয়সী ছেলে, নিশ্চয়ই বড়ো হলে বুঝবে দাদা মানে কী।’
বুড়ো ঠোঁট চেপে ঘাবড়ে গেল। প্রচণ্ড গরমের মধ্যেও সে ঠকঠক করে কাঁপছে এবং তার নরম মাংস থরথর করে দুলছে যেন শক্তিশালী বাতাস তাকে মারছে। তসবির পুঁতিগুলো শক্ত করে চেপে ধরলেন হাতের আঙুলে। ‘আলহামদুলিল্লাহ। ইস্তাগফুরুল্লাহ। সুবহানাল্লাহ,’ দোয়া পড়তে থাকেন। শব্দগুলো পুনরাবৃত্তি করলেন। আবার পুনরাবৃত্তি করলেন। এবং আবারো পুনরাবৃত্তি করলেন। এই শব্দগুলো তারই সাথে সাথে বেড়ে উঠেছে, পরিপক্ক হয়েছে, বৃদ্ধ হয়েছে। এই শব্দগুলো তিনি কম করে হলেও শতকোটি বারেরও বেশি বলেছেন এই জীবনে। কিন্তু আজ এই শব্দেরা তার জিহ্বার ডগায় এসেও কোন আওয়াজ তুললো না। বৃদ্ধের ভারী কণ্ঠস্বর এবং শ্বাস-প্রশ্বাসের কম্পন ছাড়া অজস্রবার উচ্চারিত এই শব্দগুলো আজ ভিন্ন কোন বার্তাই দিলো না কাউকে। ইবলা চলে গেছে, কথাটি শোনার পর থেকে তিনি ভাবছিলেন; মেয়েটিকে কি তিনি অভিশাপ দেবেন, নাকি দেবেন না? প্রাণপণে তসবির পুঁতিগুলোকে চেপে ধরলেন। বৃদ্ধের দুর্বল আঙ্গুলের নীচে জপমালার অশক্ত সুতো ছিঁড়ে গেল আলগোছে। নিরানব্বইটি পুঁতি চতুর্দিকে দৌঁড়ে ছিটিয়ে পড়েছে— ঝাঁ ঝাঁ উত্তপ্ত বালিতে বিক্ষিপ্তভাবে।
ছেলেটি দাদার তসবির পুঁতিগুলো তুলে আনতে বালির উপর ঝুঁকে পড়তে যাচ্ছিলো। কিন্তু বৃদ্ধ নীরবে মাথা নাড়েন। নাতিকে চলে যেতে ইশারা করলেন।
ভীষণ মৃদুস্বরে, ফিসফিসিয়ে বৃদ্ধ অভিশাপ দেয়, ‘খোদা তোমার পরিকল্পনা ধ্বংস করুন, ইবলা। তিনি তোমাকে অনেকগুলো জারজ সন্তানের মা বানাক। আর পুরস্কার হিসেবে তিনি যেন তোমাকে এই দুনিয়ায় জাহান্নাম নাজেল করেন।’
ছেলেটি দৌড়ে চলে গেল। গ্রামের আরও দুইজন বৃদ্ধ লোককে তার দাদার সংবাদ দিলো। সবাই যখন এসে পৌঁছালো সেখানে, তারা বৃদ্ধকে মাটিতে উপুড় হয়ে পড়ে থাকতে দেখে। হয়তো মরে গেছে, হয়তো বেঁচে আছে; কিন্তু তারা কেউ কাছে গেল না।
তিনি একজন বৃদ্ধ মানুষ, কোন সন্দেহ নেই। এবং দুটোর যে কোনটিই হওয়া সম্ভব।
১
একটি বাসস্থান। আশেপাশের অন্যান্য বাসস্থানের মতোই এটি একটি আবাসস্থল। আদর্শ আবাস না হলেও অন্তত খুব আলাদা কিছু নয়। আবাসের ছাউনির ভেতর মানুষের সংখ্যা গবাদি পশুর তুলনায় দশগুণ কম। এটি একটা নির্দিষ্ট জেসের বাসস্থান (জেস- একসাথে বসবাসকারী কয়েকটি পরিবারের একটি ইউনিট)। ছাউনিটিকে অতুলনীয় বলে মনে করে এখানে বসবাসকারী মানুষেরা। এক অর্থে এটি অতুলনীয়ই বটে। প্রতিটি জায়গার কিছু নিজস্ব বৈশিষ্ট্য থাকে। এই জায়গাটির আছে একাধিক বৈশিষ্ট্য।
ভোরের আলো ফুটে উঠার আগে এই ঝাপসা অন্ধকারে কুঁড়েঘরগুলোকে কমবেশি পিঁপড়ার-পাহাড়ের মতো দেখাচ্ছে। হয়তো পিঁপড়া-ঘরের বৃহৎ আকার বলা যায় এদেরকে। কুঁড়েঘরগুলোর বেড়া কঞ্চি দিয়ে তৈরি, উপরে একটি ঢেউ খেলানো মাদুর মত জিনিস দিয়ে আচ্ছাদিত। ঘরগুলো কয়েকটি লাঠির উপর ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে যে লাঠিগুলো স্তম্ভ হিসাবে কাজ করছে। প্রত্যেকটিতে একটি করে দরজা- সবগুলো দরজা চার ফুট উঁচু। এই বাড়িটি বহনযোগ্য। বেঁচে থাকার সুবিধার্থে যখন তাদের আরো উপরে বা নিচে, পূর্ব অথবা পশ্চিমে, কোন পশু-সমৃদ্ধ এলাকায় চলে যাওয়ার সময় আসবে, তখন এই ঘরগুলোকে উটের কুঁজের পিঠে বসিয়ে যাত্রা শুরু করা হবে। এই ঘরগুলো সচল কুঁড়েঘর। শহরের পাথুরে বাড়ি বা মাটির ঘর থেকে আলাদা।
এখানকার মানুষদের জীবন নির্ভর করে তাদের পশুপালের উপর। পশুপালের জীবন নির্ভর করে সবুজ ঘাসের প্রাচুর্য বা তার সহজলভ্যতার উপর। কিন্তু এই কথা বলা কি ঠিক হবে যে এইসব মানুষ এবং পশু, দুটোরই অস্তিত্ব নির্ভর করে সবুজ চারণভূমির উপর— প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে? হ্যাঁ: এদের সবারই জীবন নির্ভর করে সবুজ সতেজ চারণভূমির উপর।
ইবলা এই জেসের সদস্য। জন্মের সময় থেকেই সে তাদের সাথে আছে। খুব ছোটবেলায় তার বাবা – মা দুজনেই মারা যান। আসলে, তাদের কথা ইবলা স্পষ্ট করে মনেও করতে পারে না এখন আর। দাদার সেবা যত্ন করার জন্য তাকে উপযুক্ত মনে করা হয়েছে, সবসময়। ইবলার দাদা নিজে অচল, যদিও অতটা খারাপ না। তিনি সবসময় মানুষজনের মাঝে থেকেছেন এবং সবার কাছে সম্মান পেয়েছেন। পরিচিত গন্ডিতে তার কথা মান্য করা হয়।
মেয়ে হিসেবে ইবলা বেশ লম্বা। তবে এটি এখানে বিশেষ কোন ব্যতিক্রম নয়। সে ছয় ফুট লম্বা। তাকে সুন্দরী বলা যেত যদি তার শরীরে কিছু অসামঞ্জস্যতা না থাকত। ইবলা নিজের নাম লিখতে বা পড়তে পারে না। সে শুধু কিছু সূরা জানে, যা তার ইবাদতের সময় পড়তে হয়। এগুলো সে বিভিন্ন মানুষের কাছে অসংখ্যবার শুনে শুনে মুখস্ত করেছে। ইবলা নিজের মতো করে বস্তু এবং মানুষ সম্পর্কে চিন্তা করে, কিন্তু বৃদ্ধ এবং মৃত ব্যক্তিকে সে সবসময়ই সম্মান করে। তার কাছে মা ও বাবা আর সবার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তবে দাদা ছাড়া। দাদা- যিনি ইবলাকে লালন-পালনের দায়িত্বে আছেন।
ইবলা জীবনের উপর হতাশ হয়েছে অনেকবার— মানুষের কারণে হয়েছে এক ডজনেরও বেশিবার। কিন্তু এসব তেমন গুরুতর কিছু মনে হয়নি কখনো: সামান্য ঘটনা ছিল মাত্র। অন্তত ইবলা সেগুলোকে গ্রহণ করেছে নগন্য ঘটনা হিসেবেই। তার কাছে প্রত্যাখ্যান কোন ব্যাপার বলে মনে হয়নি কখনো। তাকে খুশি করার জন্য নির্দিষ্ট কিছু নেই। কিন্তু আত্মীয়স্বজন এবং হবু স্বামীদের কাছে নিজের মতামতটুকু গ্রহণযোগ্যতা পেলে, ইবলা খুশি হতো। ইবলা এমন অনেক কিছু ভাবে যা তার সমান অবস্থানে থাকা একটি মেয়ে কখনই ভাবে না। অর্থ করলে, ইবলা নামের মোটামুটি একটা মানে হচ্ছে, ‘ক্ষমাশীল’ এবং সে চেষ্টা করে তার কাজকে নামের সাথে মিলযুক্ত রাখতে।
বেশ কিছুদিন ধরে বাড়ি থেকে পালিয়ে যাবার ভাবনাটি নিয়ে খেলছিল ইবলা। যদিও সে ঠিক নিশ্চিত ছিল না এই পালিয়ে যাওয়াটা সাময়িক জায়গা পরিবর্তন হবে কিনা— কোন এক শহরে— নাকি হবে গ্রাম থেকে তার স্থায়ী প্রস্থান। ইবলা তার দাদাকে ভালোবাসে, কিন্তু সে হয়তো সহানুভূতিকে ভালোবাসার সাথে ভুলভাল মিশিয়ে ফেলেছে। তবে এসব কথা ইবলার মনে হচ্ছিল শুধু তখনই, যখন সে তার দাদার কথা ভাবছিলো। দাদাকে ছেড়ে চলে না যাবার জন্য হৃদয়ের ভেতর প্রবল টান অনুভব করছিল বারবার।
ইবলা কুঁড়েঘরের ভেতর একটা মাদুরে শুয়ে আছে। মনে মনে ভাবছে, সব সমস্যা মানুষের তৈরি। কিন্তু সমাধান ছাড়া কোনো সমস্যা নেই। হয়তো আমার এখানে থাকা উচিত দাদার যত্ন নেওয়ার জন্য। খুব ভালো হয় যদি আমি এখানে থাকি তার পাশে। তাহলে তিনি অন্তত শান্তিতে মারা যেতে পারবেন। আর সময় হলে আমি তার কবরে সমাহিত হওয়াটিও দেখতে পারবো। কিন্তু আমার কি এমন একজনের কথা ভাবা উচিত যে আমার জন্য ভাবে না? তিনিই আমাকে একটি বুড়ো লোকের হাতে তুলে দিয়েছেন। তিনি আমাকে কয়েকটি উটের সাথে বিনিময় করেছেন নিজের স্বার্থে।
যে মাদুরে সারারাত জেগে শুয়েছিল, সেখানে হাত স্পর্শ করে ইবলা। এটি সেই মাদুর যার উপর বসে ইবলা তার অসংখ্য অভিযোগকারীর সাথে কথা বলে, অন্ধকারে। এই একই কুঁড়েঘরে—অথবা অন্য একটিতে: হয়তো ভিন্ন এলাকায়, বিশ বা ত্রিশ মাইল উপরে বা নীচে, এই দিকে বা অন্য দিকে। কিছু লোক তাকে কী বলেছে তাই নিয়ে সে চাপা হেসেছে রাতের আঁধারে। মানুষের সাথে কথা বলতে পছন্দ করে ইবলা। কিন্তু তাদের কেউই জিউমালেহের মতো বৃদ্ধ ছিল না, ভাগ্য তাকে যার হাতে তুলে দিতে চায় স্ত্রী হিসেবে। ঘটনাটি ঘটেছে গতকাল সকালে, যখন তার দাদা জিউমালেহের প্রস্তাব গ্রহণ করেছে। জিউমালেহ আটচল্লিশ বছরের এক বৃদ্ধ: ইবলার বাবা হবার উপযুক্ত। যার দুই ছেলে পর্যায়ক্রমে ইবলাকে প্রেমের প্রস্তাব দিয়েছিল। তবে ছোট ছেলেটিই বেশি আগ্রহী ছিল ইবলার প্রতি। সম্ভবত বড় ভাই এখনো বিয়ে করেনি বলে সে নিজের মুখে প্রস্তাব জানায়নি। অন্তত, এমনটাই ইঙ্গিত দিয়েছিল— ব্যক্তিগতভাবে ইবলার কাছে নয়, ওর বন্ধুদের কাছে। কানাঘুষা বাতাসে ঘুরে বেড়ায় তীরের গতিতে: মেয়েরা অনেক কথা শোনে এবং অনেক কথা বলে এবং অনেক মিথ্যা বলে। কিন্তু ইবলা এসবের একটিও বিশ্বাস করে না। অনেকে তাকে একগুঁয়ে বলবে, হয়তো তারা ইবলার নামের উপর জেদি শব্দটিকে হাতুড়ি পেটা করে গেঁথে দিয়েছে বলে এটি ইবলাকে সত্যি ওভাবেই তৈরি করেছে। হয়তো সে একরকম একগুঁয়েই আছে।
ইবলা চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণের জন্য গিউমালেহের সাথে নিজেকে এক বিছানায় কল্পনা করে। ভয়ঙ্কর সে অনুভূতি। পাগল না হলে নিজেকে ওভাবে কল্পনা করতে পারে না। দুঃস্বপ্নের মতো লেগেছে বিষয়টি। ব্যাপারটি এমন যে, একজন আরেকজনের ক্ষতি করেছে কিনা তা নিয়ে কেউ চিন্তা করে না। সবাই শুধু নিজের কথা ভাবে। কারো কাজ অন্যের জন্য অসুবিধাজনক হলো কিনা তা নিয়ে একেবারেই ভ্রূক্ষেপ নেই। প্রতিটি মানুষ মায়ের গর্ভ থেকে বেরিয়ে আসে একা। নিজের সমস্যাও সে নিজেই সমাধান করার চেষ্টা করে। যখন সে মারা যায় তখন সে একা মারা যায়। তার কোন সঙ্গী থাকে না। তাকে কবরের মাটিতে নামিয়ে দিয়ে, ফেলে রেখে আসা হয় মাটির নিচে। মৃতদেহ কবরে রেখে সবাই যখন শোক করতে করতে বাড়ির দিকে রওনা হয়, বলা হয়েছে যে তখন মৃতব্যক্তিটি মানুষের আওয়াজ শুনতে পায়। এমনকি তাদের পায়ের শব্দও শুনতে পায়। মহানবী এবং মহান সাহাবিরা বলেছেন এই কথা।
মৃদু উষ্ণ বাতাস কুঁড়েঘরের দরজাটিকে এপাশ ওপাশ কাঁপিয়ে দিল: বেশ আরামদায়ক বাতাস। ইবলা মনে মনে বলে, ‘এমন বাতাস মানুষের শরীর জুড়িয়ে দেয়। এই হাওয়া এইভাবে সবকিছু উড়িয়ে নিয়ে যায়।’ কুঁড়েঘরে দরজা হিসাবে যা আছে, আসলে তা হচ্ছে ছাদের উপর থেকে ঝুলন্ত এক টুকরো কাপড়। কাপড়টি ব্যবহৃত হয় শুধু ভিতরের জিনিসগুলিকে আড়াল করার জন্য। নিজেকে আড়াল করার জন্য একটা কিছু না থাকলে এই কুঁড়েঘরের ভিতর থাকতে খুব অসুবিধা হতো মানুষের।
ইবলা এবার উঠে দাঁড়িয়ে গায়ের কাপড় থেকে ধুলো ঝাড়ে। অনেক বড় একটা আলখাল্লা পেঁচানো আছে তার শরীরে। আলখাল্লার একটি টুকরা পিঠের উপর ঝুলছে। এই টুকরো কাপড়টি অনেক কাজে ব্যবহৃত হয়। যেমন ছোট বাচ্চা থাকলে তাকে বহন করা যায় । কিংবা কিছু রাখার পাত্র হিসাবে ব্যবহার করা যায়। আবার কাপড়টিকে কাঁধের একটি আচ্ছাদনও বলা যায়। এমন অন্যান্য অগণিত ব্যবহার আছে পিঠের এই টুকরো কাপড়টির।
কুঁড়েঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে ঠান্ডা বাতাসে শীতল হয়েও ইবলার মনে খুব চিন্তা হচ্ছে। নিজের জন্য নয়, দাদার জন্য। শুধু কাঁধ ঝাঁকিয়ে ভাবনাটাকে উড়িয়ে দিতে পারছে না। তেমন মেয়ে সে নয়। সে একজন নারী, আঠারো বছরের দায়িত্বশীল তরুণী, উনিশের দিকে আগাচ্ছে এখন।
মূলত ইবলা দুর্বল মনের মেয়ে নয়। অন্যের জন্য ক্ষতির কারণ হতে পারে বলে জীবনে কখনো সে কোন কাজ থেকে বিরত থাকেনি। কিন্তু এখনকার এই বিষয়টি আলাদা। এই বিষয়টি তার জন্য খুব বেশি হয়ে যাচ্ছে। অনেক অনেক বেশি। জিউমালেহের্ সাথে বিয়ে হবার অপেক্ষায় থাকার চিন্তাটাকেও সে একদম সহ্য করতে পারছে না। কোন কাজটি ঠিক, অস্থিরতার মধ্যে থাকা— নাকি সবাইকে, বিশেষ করে দাদাকে কষ্ট দেয়া? ইবলা ভাবে, সে যদি এখানে থেকে যায়, তাহলে সারাজীবন সে মনমরা হয়ে থাকবে। আর যদি চলে যায়, তাহলে কী হবে?
হ্যাঁ। যদি সে চলে যায়?
ইবলার মনে কিছু একটা বেজে উঠলো শব্দ করে। কিন্তু সে কোথায় যাবে? কার কাছে? কার সাথে?
কুঁড়েঘরের ভেতর ইবলার পাশে, তার বন্ধু, তার নিজের বয়সী একটি মেয়ে, ঘুমের মধ্যে নাক ডাকছে। মেয়েটিকে সম্পূর্ণ মৃত দেখাচ্ছে। ইবলা উঠে দাঁড়ালো। তার বাম হাতটি অসাড় হয়ে আছে। ডান হাত দিয়ে সেটিকে মালিশ করে সজাগ করার চেষ্টা করে কিছুক্ষণ। গায়ের পোশাকটির পায়ের দিকে লম্বা অংশটুকু ঘুমন্ত বান্ধবীর হাঁটুর নীচে আটকে আছে। তাকে না জাগিয়ে কাপড়টিকে বের করার জন্য ইবলা একটা হেঁচকা টান মারে। প্রথমে মনে হলো বান্ধবীটি জেগে গিয়েছে। একটু থমকে থাকে ইবলা, খানিক নিশ্চলতা। কিন্তু বান্ধবীটি ইবলার পোশাকের লেজটিকে আরো বেশি করে নিজের শরীরের নিচে টেনে নিলো ঘুমের ভেতর। ইবলা মাথা ঠান্ডা করে শান্তভাবে (যা থাকে কপালে, মনে মনে বলে) পোশাকটিকে আবার টান মারলো। খোদাকে ধন্যবাদ! আলখাল্লাটা বেরিয়ে এসেছে। আর বান্ধবীটি এখনো ঘুমাচ্ছে, নির্বিঘ্নে।
রাত শেষ হতে কয়েক ঘন্টা বাকি আছে এখন। ইবলা সামনের দীর্ঘ সময়টুকুকে ভয় পাচ্ছে, যেন তার জন্য ওঁৎ পেতে অপেক্ষা করছে কোন অতর্কিত আক্রমণ: একটি শত্রু, এক ভয়ংকর দর্শন অচেনা শত্রু, যে তার দিকে কড়া চোখ রেখে তাকিয়ে আছে কটমট করে। তাতানো গরম রাতের ফিকে হয়ে আসা গুমোট অন্ধকারে কুঁড়েঘরের বাইরে বেরিয়ে এলো ইবলা। সম্পূর্ণ পরিকল্পনাটি নিয়ে আরো ভালো করে ভাবতে হবে। বারবার ভাবছে, সে যদি মেয়ে না হতো! কিন্তু পুরুষ হলে কি তার অবস্থা আরেকটু ভালো হতো? তাহলে সে আশ্চর্যই হবে। ‘আচ্ছা মাথার চিন্তাগুলোকে গুছিয়ে একটা পরিকল্পনা করতে হবে এবার; দেখা যাক কী করা যায় এরপর,’ নিজের মনে ভাবে ইবলা।
(চলবে)