১.
মিষ্টি আর তিক্তের সমুদ্র একত্রে বয়ে যায়
তবু মাঝে তার দেখ ব্যবধানের চিহ্ন রয়ে যায়
২.
যদিও আলাদা তবু তার উৎস অভিন্ন
দুইই এক হয় সেই উৎসে ফিরে গেলে
৩.
পরখ করার শক্তি যার আছে
সে বিশ্বাস থেকে সন্দেহ পৃথক রাখে
৪.
পূর্ণ মানুষ সত্যের রহস্য জানে
মত্ত, আত্মহারা আপাদমস্তক বিস্ময়ে মগ্ন
৫.
এক মুখ সর্বদা ফিরে আছে প্রিয়র দিকে
এক চেহারা নিজেই হয়েছে প্রিয়র মুখ
৬.
আউলিয়ার সাথে কাটানো এক মুহূর্ত
নিষ্ঠাহীন শত বছরের উপাসনার চেয়ে ভালো
৭.
হৃদয়বানের কাছেই হৃদয় প্রশান্তি পায়
সৌভাগ্যবানের কাছেই সৌভাগ্য পাওয়া যায়
৮.
যখন ইচ্ছে বেদনাকে আনন্দ করে দাও
পায়ের শেকল মুক্তির বার্তা শোনায়
৯.
মানব বুদ্ধি যেন অস্থির সমুদ্র
যে ডুবল সে হলো সফল
১০.
বুদ্ধি আবৃত আর জগত উন্মুক্ত
আমরা যেন সমুদ্রের বহমান স্রোত
১১.
যে নজরে এলো তারই হয়ে গেলাম
নিজের মগ্নতা থেকে সরে হারিয়ে গেলাম
১২.
জীবনকে বেদনার সাথে পরিচিত করাও
যেন রক্তিম, সবুজ আর ধূসর চিনতে পারো
১৩.
কী করে চিনবে একেকটা রঙ আলাদা করে
যতক্ষণ তুমি খোদ আলোকেই না দেখছ
১৪.
চন্দ্র নক্ষত্রে এই জগত আলোয় আলো
আর গোপন যে সে সত্যের আলোয় তুর পাহাড়ের ঈর্ষা
১৫.
দেখার চোখ হৃদয়ের আলোর প্রকাশ
হৃদয়ের আলোতেই তোমার দৃষ্টির আলো
১৬.
সত্য যদি আমাদের দুঃখ বেদনা না দিতো
কী করে জানতাম আনন্দ কাকে বলে
১৭.
সত্যের আলো দেখার ধৈর্য শক্তি আছে কার
তুর আর মুসার গল্প পড়ে নাও
১৮.
বুদ্ধি থেকে যখন ভাবের স্রোত ওঠে
সে তখন মিশে যায় কথা আর শব্দে
১৯.
যখনই অরূপ থেকে এক রূপ জন্ম নিলো
তার দিকে নিবেদিত হওয়ার ছিল, তাই হলো
২০.
তোমার বিরহে নিরন্তর ঝরে অশ্রুধারা
নিরন্তর দীর্ঘশ্বাস প্রাণ ওষ্ঠাগত
২১.
আমরা বীণা তুমি তার মিজরাব
এ অঝোর বর্ষণ আমার নয়, কাঁদছ তুমি
২২.
তুমিই তো অনস্তিত্ত্বকে অস্তিত্ত্ব দিয়েছ
তারপর নিজে তাকে তোমার পাগল করেছ
২৩.
তুমি সব ছিনিয়ে নিলে অভিযোগ কেন হবে?
চিত্র তো চিত্রকরের সামনে কাঙাল হবেই
২৪.
সেই সৃষ্টি করে কখনো শয়তান কখনো মানুষ
সেই কখনো করে দুঃখী কখনো প্রফুল্ল
২৫.
মোম আর সলতে আগুনে নিজেকে বিলিয়ে
অনুজ্জ্বল ছিলো, হলো সর্বাংগ আলোকময়
২৬.
যে অনস্তিত্ত্ব হতে ক্ষণিকে নিঃসন্দেহ হতে পারে
সে তেমন শত জগত তৈরি করতে পারে
২৭.
এক দৃষ্টিতেই শত জগত নজরে পড়ে
দেখবার চোখ তাকে যখন কদর দেয়
২৮.
এই দুনিয়াতে তোমার শরীর ও প্রাণ কয়েদ হয়ে আছে
যেদিকে করুণা আছে বলে দাবী সেদিকে চলো
২৯.
অগণিত ফেরাউনের বর্শা মাথা নোয়ায়
এক মুসার যষ্ঠির সামনে
৩০.
প্রাণ আরশের দিকে নিয়ে যেতে পারে
তুমি কি না গিয়ে পড়লে মৃত্তিকার সংকীর্ণতায়
৩১.
যে তুমি আরশে ফেরেশতাদের ঈর্ষার পাত্র ছিলে
সংকীর্ণতার মাঝে সংকীর্ণতর হয়ে গেলে
৩২.
আমার পথই আমার চলার পাথেয় লুটে নিল
আমার শরীর আমার প্রাণ হরণ করতে চায়
৩৩.
প্রাণের দুশমনের সাথে যখন কারবার
ভরসা যদি থাকে সে তোমার করুণা
৩৪.
অশুভের হাত থেকে জীবন যদি রক্ষাও পায়
তোমার বাসনা না থাকলে সে জীবন বৃথা
৩৫.
প্রিয়র মিলন না হলে প্রাণ সে প্রাণহীন
আলো সে অন্ধকারতম উজ্জ্বল মুখের আলো ছাড়া
৩৬.
নারগিসের চোখ বন্ধ ছিলো তাকে খুলে দিলে
বীণা থেকে সুর কেড়ে আবার সুর ভরে দিলে
৩৭.
সেই মদিরা, সাকি সে, সেই মদিরাসেবী
আমি নিজে যখন নেই, সব তখন এক
৩৮.
যদি নমরুদ হও তবে আগুনে ঝাঁপ দিও না
ইব্রাহিম হয়েই সামনে এগোও
৩৯.
যে শব্দ একবার জিভ থেকে বের হয়ে গেল
ধনুকের থেকে তীরের মতই সে ছুটে গেল
৪০.
পিপাসার্ত যদি করে জলের সন্ধান
জলও খুঁজে ফেরে পিপাসার্তকে
৪১.
সে যদি হয় প্রেমিক তবে নীরব থাকো
শ্রবণ পেয়েছ যদি কান পেতে থাকো
৪২.
মৃত্যুতেই পাবে তুমি জীবন
হৃদয় বিলিয়েই পাবে হৃদয়
৪৩.
দুই জগতে কেন একে প্রকাশ করবো?
এই রহস্য পর্দার আড়ালে থাকাই ভালো
৪৪.
কেন সেই মহিমার তরে রক্তঅশ্রু বইয়ে
প্রেমিকের দলে শামিল হবো না আমি?
৪৫.
দিনও আমার রাতের মতো অন্ধকার হবে না কেন
যতক্ষণ না দেখি দিনকে আলো দেয়া সেই মুখ
৪৬.
কাঁদবো না কেন? সে যে কান্নায় খুশি হয়
সে জগতের অশ্রুবর্ষণে খুশি হয়
৪৭.
প্রিয়র অবিশ্বস্ততায় খুশি আমার হৃদয়
সেই হৃদয়ব্যাধির জন্য উৎসর্গ করবো প্রাণ
৪৮.
বেদনার ধুলো চোখের সুর্মা বানাও হে দৃষ্টিবান
চোখের সমুদ্র তাহলে মুক্তোতে পূর্ণ হবে
৪৯.
তাকে চেয়ে ঝরে চোখ বেয়ে যে অশ্রুধারা
অশ্রু নয় সে তো অমূল্য মুক্তো
৫০.
প্রাণের প্রাণ ! তোমার কাছে আমার যত অনুযোগ
সে তো আমার হৃদয়ের হাল শোনানোর বাহানা
৫১.
যখন আমি আর তুমি এক প্রাণ হয়ে যাবে
হে চিরপ্রিয় ! সবাই যে যাবে হারিয়ে
৫২.
দুঃখ আর প্রশান্তিতে যে হৃদয় অধীর হয়ে যায়
সে আর কবে তার দর্শনের যোগ্য হয়েছিল
৫৩.
প্রেমের কুঞ্জে যার আবাস চিরস্থায়ী
এর ফল দুঃখ আনন্দের বাইরে অন্য কিছু
৫৪.
আমার অবস্থা সত্যের ফাঁসিকাঠে সন্দেহহীন
পৃথিবীর মদিরায় সেই নেশা কোথায়?
৫৫.
তোমার হৃদয়কুঞ্জও হবে বসন্তে রঙ্গীন
পত্রপুষ্পে ধরবে লাবণ্য
৫৬.
দেখো ! পাতায় লুকিয়ে পড়েছে শাখা
ফুলের প্রাচু্র্যের আড়ালে লুকিয়ে গেছে মরু
৫৭.
এই ফুল না হলে কোথা হতে আসে ফুলের গন্ধ
মদিরার নেশা আসে কোন মদিরা ছাড়াই
৫৮.
এই সুগন্ধই তোমাকে দেখাবে পথ
স্বর্গের দ্বার পর্যন্ত হবে তোমার পথদর্শী
৫৯.
এই সুগন্ধ অসুখী দৃষ্টির ওষুধ
ইয়াকুবের দৃষ্টির নিদান
৬০.
তুমি ইউসুফ না হলে ইয়াকুব হও
অশ্রু বর্ষণ করো দুঃখ সও ক্ষ্যাপা হও
৬১.
শিরিঁ না হলে ফরহাদ হও
লায়লা না যদি তবে কায়েস হও
৬২.
যার বুকের দরজা খোলা
ধুলোকণায় সে সূর্যের জ্যোতি দেখে
৬৩.
সত্যের স্বরূপ সবার মাঝে আলোকিত হয়ে আছে
নক্ষত্রদের মাঝে যেমন করে চন্দ্র বিরাজ করে
৬৪.
চোখের ওপর আঙুল রেখে সত্যি বলো তো
এই দুনিয়া কি আর নজরে পড়ে কিছু?
৬৫.
তুমি নেই বলে কি দুনিয়া নেই হয়ে গেল?
না কি ইন্দ্রিয়ের অন্ধকারে আড়াল হয়ে গেল?
৬৬.
হুশিয়ার দৃষ্টি ছাড়া আমরা আর কি
দেখা মানে সে কেবল প্রিয়র দেখা পাওয়া
৬৭.
হৃদয়ের ডাক শোন! ফুলের সুগন্ধের মতো
হাসো! মদিরার মতো আনন্দ বিলিয়ে যাও
৬৮.
এসো! আমাকে আমার কাছ থেকে কিনে নাও
আমি তোমার না হয়ে বদনাম হতে চাই না
৬৯.
শোন! নিজেই এসেছি চলে তোমার কাছে
আমার চাইতেও তো তুমি আমার নিকটে আছ
৭০.
এতো কাছে থেকেও দূরে আছি
আলোকহীন আমি, আলোর প্রকাশ দাও
৭১.
প্রার্থনার শক্তি তো তুমিও দিয়েছ
নইলে হাঁপড়ের জন্য কি ফুলবাগানের দরজা খোলে?
৭২.
এই যে চোখ থেকেও আলোর স্রোত
ক্ষণে ক্ষণে ছুঁয়ে যাচ্ছে আকাশ
৭৩.
এক টুকরো মাংসপিণ্ড এই যে জিভ
তার থেকে বয় প্রজ্ঞা দর্শনের স্রোত
৭৪.
শ্রবণ সেই নিয়ামত যে প্রাণের জন্য
বিদ্যা আর জ্ঞানের উপহার পাঠিয়ে যায়
৭৫.
তুমি বেদনা হলে, বেদনার নিদানও তুমি
ভাবনা হলে সে ভাবনার উপকরণও তুমি
৭৬.
তৃষ্ণার্ত থাকো, জলের অন্বেষণ বাদ দাও
তবে জল নিজেই তোমাকে খুঁজে নেবে
৭৭.
দোষের স্বভাব দূর করো দৃষ্টি থেকে
দেখতে পাবে অদৃশ্যের বসন্ত
৭৮.
শরীরের বন্ধন থেকে প্রাণকে রেহাই দাও
সে যেন ঐ বাগানে নৃত্য করতে পারে
৭৯.
যে ডাক মৃত্তিকা থেকে ওপরে নিয়ে যায়
নিঃসন্দেহে সেই ডাক আরশ থেকে এসেছে
৮০.
যেমন করে পাথর অমূল্য রত্ন হয়ে ওঠে
যখন সে সুরের গুণ ধারণ করে
৮১.
যদি সে নিজ গুণকে ভালবাসে
সে তো আসলে সূর্যকেই ভালবাসা
৮২.
আমিই সত্য বলে ফেরাউনের পতন হলো
সেই আমিই সত্যতে কোথাও মনসুর মত্ত
৮৩.
বন্ধুর দরজায় কড়া নাড়লো বন্ধু
কে? চাইলো জানতে বিরক্ত বন্ধু
৮৪.
বিরহ উত্তাপে মেলে নতুন জীবন
সে আগুনে কাঁচাও পুড়ে খাঁটি হয়
৮৫.
কালের মাঝে যখন সত্যের বাঞ্ছিত হবে তুমি
অংশের মতো সমগ্রের সাথে যাবে মিশে
৮৬.
আমারও হৃদয় আছে দাবী তোমার
আরশে থেকে কী কাজ মৃত্তিকার জগতে
৮৭.
কালো আবর্জনাতেও থাকে জল
সে জলে ওজু তো হয় নিষ্ফল
৮৮.
আমিও আবর্জনাতে থাকা জল
কৃপার সমুদ্র নিজের মাঝে আত্মস্থ করি
৮৯.
জ্যোতির সমুদ্র না হলো যদি হৃদয় কিসের?
সত্যের আলোয় সেই দৃষ্টি হয় না আলোকিত
৯০.
হৃদয়বানকে খুঁজে তাকে হৃদয় দাও
ধুলির কণা হৃদয় তোমার পর্বত হবে সে
৯১.
হৃদয়বানের হৃদয় অধীর সমুদ্র
পুরষ্কারের ঢেউ বয়ে যায় তাতে অবিরাম
৯২.
হৃদয়ের অসুখ বাসনার চিহ্ন
হৃদয়ের অসুখের মতো অসুখ নেই
৯৩.
প্রেমের কারণ কি করে বয়ান করা যায়
প্রেমে যে প্রতি পদক্ষেপেই পরীক্ষা
৯৪.
যদি ব্যাখ্যা করো তাও মন্দ নয়
তবে জেনো ভাষাহীনতাই প্রেমের ভাষা
৯৫.
বুদ্ধি কী বুঝবে প্রেমের রহস্য
প্রেমই পারে প্রেমের ব্যাখ্যা করতে
৯৬.
সত্যের স্মরণে আশ্রয় করে থাকে ভাবনা তার
প্রিয়র স্মরণেই থাকে প্রিয়র মিলন
৯৭.
শুধু নামের কখনো কি কোন অর্থ হয়?
ফুল না থাকলে ফুল লেখার অক্ষর অর্থহীন
৯৮.
এক জায়গায় যদি দশটা প্রদীপও জ্বলে
তবুও তাদের আলাদা করে চেনা যায়
৯৯.
বাইরের এই অহংমগ্নতা নিজ শক্তিতে মেটাও
তবে পাবে একত্বের অপার অমূল্য সম্পদ
১০০.
তোমাকে পেলে পাওয়া হয় সকল গন্তব্য
না বলেই সমাধান হয়ে যায় সব মুশকিল
১০১.
এক ঝাপটা সুগন্ধ এলো, এসে চলে গেলো
যাকে চায় দান করে প্রাণ চলে গেলো
জাভেদ হুসেন
জাভেদ হুসেনের জন্ম ১লা আগস্ট ১৯৭৬, কুমিল্লায়। সোভিয়েত পরবর্তীত সক্রিয় মার্কসীয় রাজনীতিতে হাতেখড়ি। মার্ক্সের লেখা এবং মার্ক্সীয় দর্শন বিষয়ে উল্লেখযোগ্য বেশ কয়েকটি গ্রন্থ রয়েছে। এছাড়াও তিনি একজন গালিব গবেষক। উর্দু-ফার্সি সাহিত্য বিষয়ে রয়েছে তাঁর বিস্তৃত জানাশোনা। মূল উর্দু ও ফার্সি থেকে অনূদিত বেশ কয়েকটি বই প্রকাশিত হয়েছে।