Home » সাজ্জাদ জহীরের পাঁচটি কবিতা //মূল উর্দু থেকে অনুবাদ: সফিকুন্নবী সামাদী

সাজ্জাদ জহীরের পাঁচটি কবিতা //মূল উর্দু থেকে অনুবাদ: সফিকুন্নবী সামাদী

কখনো কখনো

কখনো কখনো সীমাহীন ভয় হয়
বন্ধুত্বের সকল রূপালী সম্পর্ক
প্রেমের সমস্ত সোনালী বন্ধন
শুকনো শাখার মত
ফেটে ফেটে ভেঙে না যায়
চোখ খুলবে, বন্ধ হলে দেখব?
কিন্তু কথা বলা ছেড়ে দেব?
হাত কাজ করবে?
আঙুল লিখবে সমস্ত দুনিয়ার লড়াইয়ের কথা?
কিন্তু ফুলের মত শিশুদের
কম্পিত ছোট ছোট পাগুলোকে
সহায়তা করার কথা যাব ভুলে?
আর মনোহর শিশিরভেজা রাতে
যখন আলোকেরা ফুল হয়ে যায়
তারারা আর মুক্তগুলো চামেলীর মত গন্ধ ছড়ায়
প্রেমের রীতি-রেওয়াজ
যায়না করা পালন
হৃদয়ে আবাস গড়ে কঠোরতা
মনের চঞ্চল স্রোত যায় শুকিয়ে
এই মৃত্যু!
তার থেকে
অনেক বেশী নিকৃষ্ট
যার ওপর অশ্রু বর্ষায় সকলে
কফিন ওঠে
চিতা জ্বলে
কবরে দেয়া হয় ফুল
প্রদীপ জ্বলে
কিন্তু এ, এ তো
একাকীত্বের ভয়ানক কবর
শাশ্বত কারাবাস
যার গোলাকার গম্বুজ থেকে
নিজের চিৎকারেরও
প্রতিধ্বনিত আসে না ফিরে
কখনো কখনো সীমাহীন ভয় হয়

ছবি

এক রঙে বাস করে হাজারো রঙ
হালকা, গাঢ়, মধ্যম, স্বচ্ছ
আলোকোজ্জ্বল, চকমকে, ঝলমলে
সুরমাই রেশমী নেকাব-ঢাকা
মিশেল দেয়া
রৌদ্রছায়ার কানামাছি খেলা
অনন্য চিত্র হয়ে ওঠে উড়তে থাকা
অথবা এতটা গম্ভীর
যেন কোনো জাহাজের নোঙর
যার ওপর দিয়ে ঢেউ বয়ে যায়
বেদনায় অশান্ত ঝড়ের মত
আর তারপরও
যার ওপর ছেয়ে থাকে
শান্তির ছায়া
কিন্তু তার তলদেশে
পাহাড়ী ঝর্ণার গতি, চঞ্চলতা
অনুসন্ধানের জ্বলন্ত শিখা
আকাঙ্ক্ষার উন্মত্ত সুগন্ধ
থাকে লুকিয়ে
আর যখন অনেক রঙ
তাদের অগণন তরঙ্গ
নানান রকম ছোট বড়
প্রকাশ্য গোপন তরঙ্গ
মুখোমুখি হয়, ধাক্কা খায় একে অপরের সাথে
তখন নতুন বিস্ময়কর ছায়াকৃতি
অসমাপ্ত, পূর্ণ উথলানো বৃত্ত
কল্পিত রেখা
লা-জবাব চেহারা
আর এমন শরীর যা অন্য কোনো কিছুর মত নয়
কিন্তু যে স্বয়ং নিজের স্বতন্ত্র অনুপম অস্তিত্বে
নববধূর মত
নবজাতক শিশুর মত
ভালো লাগে
ঢুকে যায় অস্তিত্বে
টিমটিমে ছোপের এই শিখা
মানবীয় আঙুল,মনন ও আত্মার এই কারিশমা
ভাষার এই অলঙ্কৃত বিস্ফোরণ
জীবনের গায়ে লাগিয়ে দেয় পাখনা
তাকে উড়িয়ে নিয়ে যায় এমন উঁচুতে
যেখান থেকে এই পৃথিবী
আর তার বাসিন্দাদের
আমরা এমনভাবে দেখি
যেমন করে দেখেছিল তাকে মার্শাল টিটো
আর তার সমস্ত গুণ
সকল সৌন্দর্য
তার সব সুগন্ধ
আনন্দিত অলঙ্করণের প্রতিবিম্ব
পতিত হয় আমাদের আত্মার ওপরও
আমরা বদলে যাই
এমনই এক চিত্র
তুমি জানো না
কোন কোন আসমানী রঙে আঁকা
না জানি অপ্সরাদের কেমন ঐন্দ্রজালিক মুদ্রায় পূর্ণ
স্বর্গের কোন মধুর রাগে বাঁধা
আর চুপি চুপি
মনের উষ্ণ তপ্ত আঙিনায় দেয় রেখে
সহসা জেগে ওঠে হাজারো বসন্ত
বর্ষিত হতে থাকে গোলাপি পাপড়ি
সুগন্ধিত হওয়া থেকে
গড়িয়ে পড়ে মৃদু মৃদু শীতল কোমলতা
আর জীবনের শূন্য সিঁথি
ভরে ওঠে সিঁদুরে!

বান

নদীর ঢেউ
স্রোতে স্রোতে
যেন হঠাৎ ওঠে জেগে
আর ঝাপটে পড়ে
এই ভেজা ভেজা
মাটি বালু কাঁকর
পাথর আর সিমেন্টের
বাঁধের ওপর
যা দিয়ে তাকে বেঁধে
আটকে রেখেছিল সকলে
লাফিয়ে লাফিয়ে
নেচে নেচে
উল্লসিত উচ্চস্বরে
চারিদিকে
পাড়ায় পাড়ায় গলিতে গলিতে
ঘরে আঙিনায় কামরায় বাগিচায়
কোণে কোণে সে
ঢুকে পড়ে
ঝটপট
গ্রাস করে ফেলে
কোনো বস্তু পায়না ছাড়া তার হাত থেকে
বাসন-কোসন
অলঙ্কার কাপড়চোপড়
চেয়ার-টেবিল
বই-পুস্তক
ভুলে যাওয়া
চিঠিপত্তর
ছবি
দলিল-দস্তাবেজ
লেখাজোখা
পড়ে থাকা অকেজো জিনিস
খেয়াল ছিল না যেগুলো আছে
ঢেউ তাদের ঘিরে ফেলে
নিজের আঁচলের ভেতর
পুরে নেয়
কাদায় মাটিতে মাখামাখি করে ফেলে
আর সব কিছু নিয়ে ডুবে যায়!
তারপর যেমন করে হঠাৎ এসেছিল,
তেমনি হর হর করে
উথলাতে উথলাতে, ঠসক দেখাতে দেখাতে,
চলে যায়

২.

আহা যদি, হৃদয়ে আত্মায়
এমন এক চঞ্চল বান আসত
নিষ্ফল ভয়ের স্তুপের ওপর
সাহসের ঢেউ করত প্রসারিত
স্বার্থপরতার সিন্দুককে
এক ঝটকা মেরে উল্টে দিত
ছিন্ন করে ফেলত লালসার পেটরা
অবজ্ঞার আর নিষ্ঠুরতার জালকে
আর জুলুমের নোংরা কীটকে
কুসংস্কারের গাঢ় মসৃণ অন্ধকারকে
বিধ্বস্ত করত অদৃশ্য করত
এমনি করে আর্দ্র করে দিত হৃদয়ের চাষবাস

ঢেউয়ে ঢেউয়ে উঠে আসত আকাঙ্ক্ষারা
প্রেমের ডালিমফুলের কলিরা
লুটিয়ে পড়ত শুকনো প্রাণের ওপর

আহা যদি, হৃদয়ে আত্মায়
এমন এক চঞ্চল বান আসত

প্রেমের মৃত্যু

তুমি প্রেমকে মরে যেতে দেখেছ?
চকচকে হাস্যোজ্জ্বল চোখ পাথর হয়ে যায়
হৃদয়ের বারান্দায় পেরেশান গরম হাওয়া ঝড় বয়ে যায়

গোলাপি অনুভবের বহমান শুষ্কতা
আর মনে হয় যেন
কোনো সবুজ ফসলের মাঠে হয়েছে তুষারপাত!

কিন্তু ইয়া রব
আকাঙ্ক্ষার এসকল মলিন শুষ্ক ফুল
এইসব হারিয়ে যাওয়া স্বর্গ থেকে
কেমন চন্দনের
চিত্তাকর্ষক
সুগন্ধ আসে!

অনন্য রাত

কালো, ঝলমলে, অনন্য রাত
রসে ভরপুর, মদিরামত্ত রাত
রাতের রাণী সুগন্ধে ভরপুর
তারাদের মধ্যম আলোকোজ্জ্বল ছায়ায়
মৃদু শীতল রাত
বৈশাখী হাওয়া
‘সারেঙ্গীর দীর্ঘ অলস ফোঁপানী’
প্রেমের গোপন কথায় ভারী
কাহিনীময় রাতেরা
কোথায় হারিয়ে গেল রে খোদা?
হারিয়ে গেছে
তো ফের হারিয়ে যাক
কিন্তু ওইসব মনোমোহন মুহূর্ত
রক্তের মাঝে যেন গেছে দ্রবীভূত হয়ে
সেই কম্পিত, অর্ধ-উচ্চারিত, অসমাপ্ত বাক্য
এখনো শোনা যায় পরিষ্কার
চোখের ভ্রু, চোখের পাতা, কপালের ভাজের
বাঁকা তেরছা মুহূর্তে মুহূর্তে বদলাতে থাকা কোণ
যা বলেছে কত কত কথা
দেখা যায়
সেই নিত্যনতুন অনন্য অশেষ খুশী
রয়েছে এখনও, রয়েছে জীবিত
কিন্তু দুঃখ-বেদনার ঢেউ হয়ে
ছড়িয়ে পড়েছে হৃদয়ের কোণে কোণে
শুনেছি, গরল কখনো অমৃত হয়ে যায়
কিন্তু এখন অমৃত স্বয়ং হয়েছে গরল
এইভাবে কি আর বেঁচে থাকা যায়?

[সাজ্জাদ জহীর ভারতবর্ষের প্রগতি লেখক সংঘ (Progressive Writers’ Association)-এর নেতা। ১৯৩৪ সালের ২৪শে নভেম্বর লন্ডনের নানকিং রেস্তোরাঁয় ভারতের কয়েকজন তরুণ বুদ্ধিজীবী তাঁর আহ্বানে এক সভায় বসেন। সে সভায় সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় প্রগতি লেখক সংঘ প্রতিষ্ঠার। সাজ্জাদ জহীর ফিরে আসেন ভারতে। উর্দু সাহিত্যে শুরু হয় এই আন্দোলনের যাত্রা। তারপর এর কার্যক্রম ছড়িয়ে পড়ে বঙ্গদেশসহ ভারতবর্ষের অন্যান্য প্রদেশের সাহিত্যে। সাজ্জাদ জহীর লেখক হিসেবে যতটা পরিচিত তার চেয়ে বেশি পরিচিত সংগঠক হিসেবে। প্রবন্ধ লিখেছেন বেশি, গল্প লিখেছে অল্পবিস্তর, কবিতা লিখেছেন আরো কম। অনূদিত পাঁচটি কবিতার পাঠ ‘রেখতা’র ওয়েবসাইট (www.rekhta.org) থেকে গৃহীত। প্রকাশিত গ্রন্থ: লন্ডন কি এক রাত, রোশনী, জিকর-ই-হাফিজ, পিখলা নিলম, উর্দুতে অনুবাদ: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গোরা, শেক্সপিয়ারের ওথেলো, খাহলীল জীবরানের দি প্রোফেট]

Ajit Dash

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ভাষা
Scroll to Top