[মুম্বাই বিশ্ববিদ্যালয়ের হিন্দী সাহিত্যের অধ্যাপক হূবনাথ পাণ্ডেয় হিন্দী ভাষার সমকালীন কবিদের অন্যতম। সমকালীন জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতি, সাম্প্রদায়িকতা বিষয়ে কবিতা রচনা করে এই কবি জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন। কবিতা ছাড়াও সাংবাদিক রচনা এবং চলচ্চিত্রবিষয়ক রচনায় তিনি সিদ্ধহস্ত। ‘কৌয়ে’, ‘লোঅর পরেল’, ‘মিট্টী’ তাঁর প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ।]
♦♦♦
তুমি আর আমি
তুমি জন্ম নিয়েছিলে
তখন দেশ গোলাম ছিল
আমি জন্ম নিয়েছি
স্বাধীন দেশে
তুমি ছিলে দুর্বল
কিন্তু নিজের দুর্বলতাকে
নিজের শক্তি করে তুলেছ
আমি আমার শক্তিকে
বদলাতে থাকি দুর্বলতায়
তুমি হয়েছো নিরন্তর নির্ভয়
আমি ভয়ের খোঁড়লে
কচ্ছপের মতো
তুমি সত্যকে বন্ধু মনে করেছ
আমি সংকুচিত স্বার্থকে
তুমি জুড়ে যাচ্ছিলে
আমি ভেঙে চলেছি
অহিংসা তোমার ধর্ম
হিংসা আমার স্বভাব
তুমি ক্ষমা করতে
আমি ঘৃণা
তুমি ছিলে অকপট
আমি চঞ্চল
তুমি চোখ বন্ধ করে
বিশ্বাস করেছিলে আমার
শুভবোধকে
আর আমি কেবল
ব্যবহার করেছি
তোমার নীতিকে
তুমি কণায় কণায় নিজেকে বর্ধিত করেছ
আমি তিলে তিলে নিজেকে খর্ব করেছি
তুমি আমাকে বাঁচাবার
সার্থক করবার
পথ খুঁজে বেড়িয়েছো
আমি তোমাকে হত্যা করবার
মূল থেকে উৎপাটিত করবার
কৌশল খুঁজেছি
তুমি সুগন্ধের মত
ছড়িয়ে পড়েছ
সমস্ত দুনিয়ায়
আমি নিজের দুর্গন্ধে
হয়েছি বন্দী
অথচ একবার
তুমিই আমায় করেছিলে স্বাধীন
আমার দুর্বলতা থেকে
আজ তুমি হয়েছো
দেড়শ বছরের
এবং জীবিত রয়েছো
আমি মরছি প্রতিদিন
খুঁজে ফিরছি
জীবনের নানান বাহানা
এবং লজ্জিত
যে চিনতে পারিনি তোমাকে
সময় থাকতে
নইলে হয়তো বাঁচাতে পারতাম
নিজের জীবনও
নিজের লোকেদের জীবনও
এখন তো কেবল
থাকবে আফসোস
যে তোমাকে ছবিতে ছবিতে
জড়ানোর বদলে
যদি হৃদয় হৃদয়ে জড়াতাম
গ্রন্থে গ্রন্থে পাঠ না করে
যদি জনে জনে পাঠ করতাম
তবে কত ভালো হতো
কিন্তু এখন তো দেরি হয়ে গেছে
♦♦♦
উত্তরাধিকার
গান্ধীর মৃত্যুর পর
চশমা পেয়েছে
অন্ধ জনতা
ঘড়ি নিয়ে গেছে ইংরেজ
ধুতি আর নীতি
পুড়ে গেছে চিতার সাথে
গান্ধীবাদীগণ পেয়েছে
রাজঘাট
সংগঠনগুলো পেয়েছে আত্মকথা
আর ডাণ্ডা
হাতিয়ে নিয়েছে নেতারা
এবং হাঁকাচ্ছে
দেশকে
গান্ধীর অনুমতি না নিয়েই
গান্ধীকে ভাগ করে নিয়েছি আমরা
যে যার মতো করে
♦♦♦
নীরবতা
মৃত্যুর ঠিক আগে
সে যদি চিৎকার করে উঠত
তবে হয়তো বাঁচতে পারতো
কেবল বেঁচে থাকবার জন্য
ও জীবনভর নীরব থেকেছে
♦♦♦
উন্নয়ন
পাতার থালা এবং বাটি
পরিবেশকে
করছিল বরবাদ
তাই
চকমকে
পিতলের থালায়
পরিবেশন করা হলো
বিনামূল্যে ইন্টারনেট ডাটা
এবং সিম কার্ড
ক্ষুধার্ত মানুষ
এখন করতে পারে
গুণগান
পিতলের থালার
কোনো দূরত্ব ছাড়াই
♦♦♦
অর্থ
চুপ থাকবার
হাজার ফায়দা
চুপ করে থাকা মানুষের সাথে
কেউ ঝগড়া করে না
কারো কোনো কষ্ট হয়না
চুপ থাকা মানুষ
কখনো দুঃখ পায়না
কখনো নালিশ করে না
সমালোচনা করে না
চুপ থাকা মানুষকে
সবারই ভালো লাগে
সবার ভালো লাগার জন্য
খুবই জরুরী
চুপ থাকা
দশ হাজার বছর আগে
মানুষ যখন
কথা বলা শিখতে
শুরু করে
তখন সে জানতো না
বলার চেয়ে অনেক ভালো
চুপ থাকা
দশ হাজার বছর পর
ঋষিগণের এই পবিত্র ভূমিতে
এই জ্ঞান প্রাপ্ত হয়
যে চুপ করে থাকা মানুষ
সরকার ফেলে দেবার অভিযোগে
মধ্যরাতে
গ্রেফতার হয় না
ডাক্তারেরা বলেন
জন্ম থেকে শ্রবণশক্তিহীন মানুষ
জন্ম থেকেই বাকশক্তিহীন হয়ে যায়
বাকশক্তিহীন হবার জন্য
শ্রবণশক্তিহীন হওয়া অনিবার্য
জ্ঞানীদের বিশ্বাস
জীবনের যে কোনো বাঁকে
সামান্য প্রয়াসে
শ্রবণশক্তিহীন হয়ে যেতে পারলে
বাকশক্তিহীনতা আপনি থেকেই এসে যায়
শ্রবণশক্তিহীনতার অন্য ফায়দা
একটা সীমা পর্যন্ত
অন্ধত্ব এসে যায়
তুমি তাই দেখতে পাবে
যা রয়েছে চোখের সামনে
এবং প্রতিটি চোখের
একটা সীমা তো থাকেই
আর যদি বলা হয়ে যায়
অত্যন্ত জরুরি
এবং জেলখানায়ও যেতে না চাও
তবে হয়তো উর্দি পয়দা করো
নইলে ভিড় পয়দা করো
নইলে কুরসি পয়দা করো
এরমধ্যে কিছুই যদি পয়দা করতে না পারো
তবে শিখণ্ডী হয়ে
রক্ষা করো
ক্ষমতাসীন অর্জুনকে
যুদ্ধাবসানে
পদ পুরস্কার প্রতিষ্ঠা
কিছুই অসম্ভব নয়
অপ্রাপ্য নয়
অতএব অভিজ্ঞদের কথা মানো
এবং চুপ করে থাকো
আর যদি বলতেই হয়
তবে এমন কিছু বলো
যার কোনো অর্থ হয় না
সমস্যা বলাতে নয়
সমস্যা অর্থে
অর্থ চাও
তো অর্থ থেকে বাঁচো
চুপ থাকো
খুশি থাকো!
♦♦♦
শুভ দীপাবলী
প্রদীপের শরীরে
কানায় কানায় তেল ভরে
সলতেতে বড় সাবধানতার সাথে
আগুন জ্বালাতে জ্বালাতে
ক্ষণিকের জন্যও
অনুভব করি না
তাঁর জ্বলুনীকে
আমাদের তো প্রয়োজন কেবল আলোকের
সলতে ছাই হোক
বা প্রদীপ ঝলসে যাক
আমাদের কী আসে যায়
এমন কি হতে পারে না
কাউকেই
জ্বলতে না হয়
ঝলসে যেতে না হয়
আর আলোকিত হয়ে যায়
সমস্ত ব্রহ্মাণ্ড
কারো আলোর পথে
আসতে না পারে
আমাদের মনের অন্ধকার
আর যদি জ্বলতেই হয়
তবে সবার আগে
আমরা নিজেরা জ্বলি
নিজের দেহকে বানাই প্রদীপ
কামনার তেল
বাসনার সলতেতে
আস্থার অগ্নি জাগিয়ে
ভস্ম করে দিই তমসা
নিজের ভেতরকার
আর জগতের বাইরেকার
আর তখন অকপট হয়ে বলি
নিষ্কাম হয়ে বলি
নির্মল হয়ে বলি
দীপোৎসবের অশেষ শুভকামনা!
♦♦♦
সোমালিয়া
এ সোমালিয়া নয়
যে লুট করে নেয়
জাহাজের পর জাহাজ
সমুদ্রের ভয়ানক বুকে
সোমালিয়া এও নয়
যেখানে উৎপাদিত হয় বন্দুক-মিসাইল
সেইসব জমিনে
যেখানে একদা অঙ্কুরিত হত জোয়ার-ভুট্টার
লকলকে সবুজ ফসল
সোমালিয়া এও নয়
যেখানে যায় জাতিসংঘের
শান্তিরক্ষী বাহিনী
এবং ঘরে ফেরে
শান্তিরক্ষী বাহিনীর জানবাজ সিপাহীরা
ডলার এবং এইডস নিয়ে
সোমালিয়া এও নয়
যার জন্য চিন্তান্বিত
সমস্ত দুনিয়া
কি জানি কেন
সোমালিয়া এও নয়
যেখানে শতকরা চল্লিশ জন শিশু
এক বছরের দীর্ঘ বয়সে
পৌঁছবার আগেই
কেবল এক গ্লাস পরিষ্কার জল
এক চিমটি লবণ এবং
চিনির অভাবে
মরে যায়
সোমালিয়া এও নয়
যেখানে বড় বড় দেশের
দেশের চেয়ে বড় বড় কোম্পানি
ক্রয় করে নিচ্ছে উর্বর জমিন
কড়ির মূল্যে
যেখানে জন্মাবে লকলকে ফসল
বন্দুকের ছায়ায়
সমস্ত দুনিয়ার বাজারের জন্য
তবে কোথায় সেই সোমালিয়া
সোমালিয়া শিশুর লাশের নিচে
দাবানো ঘাসের পাতার সবুজের মাঝে
সময়ের আগে বুড়ো হয়ে যাওয়া
হাড্ডির বোনমেরুতে রয়েছে সোমালিয়া
এইডস ছড়ানো নারীর শরীরের
কোনো কোণে লুকিয়ে রয়েছে সোমালিয়া
বিষাক্ত হাওয়ায় ছড়িয়ে পড়া বাষ্পকণার
মাঝে লুকিয়ে রয়েছে সোমালিয়া এবং
সংগঠিত হয়ে বর্ষাণোর
অপেক্ষা করছে সোমালিয়া
আফ্রিকা মহাদেশের এক দেশ নয়
আমাদের নিজের দেশেও
হতে পারে এক সোমালিয়া
বরবাদ হয়ে যাওয়া জমিনকে
ঝরঝরে এবং উর্বর করে তুলতে ব্যস্ত
কেঁচোর পেটের ভেতর
লুকিয়ে রয়েছে সোমালিয়া।
♦♦♦
তার ইচ্ছায়
তার ইচ্ছা ছাড়া একটি পাতাও দোলে না
কেননা তার রাজত্ব পাতার ওপরই চলে
তার ইচ্ছায় জন্ম নেয় মানুষ
মরে যায় কিংবা নিহত হয়
তার ইচ্ছায় বানানো হয় বোমা
আর মানুষ ফেটে খানখান হয় ধুলোর মতো
তার ইচ্ছায় বেরিয়ে আসে শিশু
ষাট ফুট গভীর গর্ত থেকে
আর ষাট বছরে মরে ষাট কোটি শিশু
ক্ষুধা এবং অপপালনে
তারই ইচ্ছায় বণ্টিত হয় খয়রাত
নির্মিত হয় বিলাসবহুল ইমারত তাদের জন্য
তিনি যাদের দান করেছেন অসীম দৌলত
তিনি তাদেরকে দান করেন তার ইচ্ছায়
তার ইচ্ছায়
মৃত্যুর মুখ থেকে বেঁচে যায় পাপিষ্ঠ
এবং নিহত হয় নিষ্পাপ
তার ইচ্ছায় নিষ্পাপ শিশু
শিকার হয় লালসার
ভিক্ষা করে
সেবন করে ড্রাগ
আর মরে যায় যুবক হবার আগেই
তার ইচ্ছায় আশির পরেও
নবযুবককে পরাজিত করে ধনপশু
তার ইচ্ছায় বেশ্যারা বিক্রয় করে শরীর
পতিব্রতা সহ্য করে লম্পট স্বামীকে
তার ইচ্ছাতেই তারই দালান পড়ে ভেঙে
নিহত হয় অগণন নিষ্পাপ মানুষ
তারই ইচ্ছা চলে জমিন, আসমান, তারাদের ওপর
চলে না কেবল পাপীদের ওপর
যারা শতাব্দীর পর শতাব্দী
মানুষ আর মানবতাকে করছে পদদলিত
শুয়োর তেমন পদদলিত করে পবিত্র বস্তুকে
তার বানানো দুনিয়াতে থাকতে যদি হয়
তবে তার জাঁকজমকে মাথা নোয়াতে হবে
করা যাবেনা কোনো প্রশ্ন
তাকে প্রশ্ন করা অনুচিত
তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে
একটি পাতাও নড়ে না
যদিও পুরো গাছ উপড়ে যেতে পারে
♦♦♦
এই শহরে
এখন
এই শহরে কেউ
অভুক্ত ঘুমাবে না
সকলেই পাবে
দুই বেলার রুটি
মাথার ওপর ছাদ
হাতের রোজগার
চোখের স্বপ্ন
সাফ সাফাই রাস্তায়
হাওয়ার সাথে কথা বলবে গাড়ি
ফ্লাইওভার যুক্ত করবে
শহরের এক প্রান্তকে আরেক প্রান্তের সাথে
জমিনে, আসমানে, জলে চলবে গাড়ি
মিনিটে পৌঁছে যাবে
এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায়
হাসপাতাল হবে সুসজ্জিত, সুবিধাসম্পন্ন
স্কুল নাদুসনুদুস স্বাস্থ্যবান শিশুতে ভরপুর
বাগান ফুলে ফুলে সুশোভিত
পুকুর পদ্মফুলে পরিপূর্ণ
ফুটপাত ভিখারিশূন্য
রেলওয়ে স্টেশন চকচকে
বাসস্ট্যান্ড ঝলমলে
সুন্দরীরা বাজারে ঠমকদার
বালিকারা রেম্পে খলবলে
গলি গাভী-কুকুরমুক্ত
মসজিদ-মন্দির ভক্তে ভরপুর
ভক্ত ভক্তিতে ভরপুর
ব্যাংক অর্থে ভরপুর
সেনসেক্স সংখ্যায় ভরপুর
অভব্যতা, নোংরামি, বিপন্নতার
নামগন্ধ নেই
এ বিশ শতকের পচা-গলা শহর নয়
একুশ শতকের
গ্লোবালাইজড শহর
এখন
এই শহরে
কেউ অভুক্ত
ঘুমোবে না
কেননা ক্ষুধার্তদের জন্য
এই শহরের বাইরে
অন্য এক শহর
বসানো হচ্ছে
এমনিতেও
ক্ষুধার্তদের ঘুম পায় কোথায়
♦♦♦
শুভ নববর্ষ
নতুন বছর শুভ হোক
তাদের জন্যও
যাদের ক্ষেত-খামারের ওপর
তৈরি হবে উন্নয়নের ভব্য মহল
নদী পুকুর হবে, হবে রিসোর্ট, ওয়াটার পার্ক
যাদের বাচ্চারা নিজেরই জমির ওপর
নির্মিত হোটেলে
করবে ঝাড়পোঁছ
মেয়েরা বিক্রয় হবে উচ্চমূল্যে
জিডিপি স্পর্শ করবে আকাশ
নতুন বছর শুভ হোক
তাদের জন্যও
যারা থার্টিফার্স্টের রাতে
কুঞ্চিত হয়ে বিক্রয় করে মনোবেদনা
কুড়ায় বিয়ারের বোতল
আর রামের টিন
নর্দমার ধারে
কুচলে যায় ইমপোর্টেড গাড়ির চাপায়
সড়কের ওপর শুয়ে থাকা
বেঁচে যাওয়া লোক
পায় ক্ষতিপূরণ
নতুন বছর শুভ হোক
তাদের জন্যও
যাদের সন্তান মারা গেছে
বলাৎকারের পর
যাদের চোখ পাথর হয়ে গেছে
বিচারের অপেক্ষায়
যাদের জীবন পার হয়ে গেছে
এক দীর্ঘ জ্বরে
ষাট বছর ধরে আটকে রয়েছে
থার্টি ফার্স্ট যাদের সংসারে
নতুন বছর শুভ হোক
তাদের জন্যও
যারা দাঙ্গার অপেক্ষা করতে করতে
বন্যায় মারা গেছে
রোজগারের খোঁজে যাদের
ভিনদেশী বোধ মরে গেছে
বিস্ফোরণ থেকে বেঁচে গিয়েও
ভিড়ের চাপে মরে গেছে
মৃত্যুর আগে
এবং মৃত্যুর পরেও
তাদের
নতুন বছর শুভ হোক।