দম্বি ওয়ারি
বহুযোগ আগে আচিক আসং এর রংদিক* নদীর তীরে এক গ্রামে জরেং নামের এক ব্যাক্তির বসবাস ছিল। তার স্ত্রী ছিলো ভীষণ সুন্দরী, নাম ছিল দম্বি। সে ছিলো আচিকদের ‘রেমা’ গোত্রের মেয়ে। আসলে দম্বি ছিল সে অঞ্চলের সবচেয়ে রূপবতী নারী। জরেং প্রায়শ তার সৌন্দর্য্যে গর্ববোধ করতো এবং বলতো, পৃথিবীতে এমন কোন নারী নেই যে তার প্রিয়তমা স্ত্রীর সৌন্দর্যকে অতিক্রম করবে।
একদিন রংদিক নদীর গভীর খাদের পাশেই গ্রামের কিছু লোকজনের কাছে জরেং চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে নিজ স্ত্রীর প্রশংসা ও গুণাগুণ করছিলো। অধিক আবেগে আপ্লুত হয়ে জরেং মুখ ফসকে বলে ফেললো যে দ্বিতীয় সন্তান জন্মদানের পরও তার স্ত্রীর রূপ লাবণ্য অটুট রয়ে গেছে। খাদের তলদেশেই ছিল মৎসকন্যাদের বাস। এক মৎসকন্যার অবিবাহিত পুত্র জরেং এর সবকথা শুনে ফেললো এবং দম্বিকে সরাসরি দেখার প্রবল বাসনা তৈরি হলো তার। সে প্রায়ই দম্বি কখন জল তুলতে আসবে সেই অপেক্ষায় খাদের অগভীর স্থানে নিজেকে লুকিয়ে রাখতো।
জরেং চলে যাবার কিছুক্ষণের মধ্যেই দম্বি সেই খাদের ধারে আসলো। জলের তলদেশ থেকে দম্বিকে প্রথম দর্শনের সঙ্গে সঙ্গে সেই যুবক মৎসকুমার তার প্রেমে পড়ে যায়। তাই স্নানের জন্য নদীতে নামার সঙ্গে সঙ্গে দম্বিকে সে হরণ করে খাদের তলদেশে নিয়ে যায়। আচিকরা এখনো বিশ্বাস করে যে, জলের তলদেশে থাকা মৎসকুমার কিংবা কুমারী কোনো মানুষকে হরণ করলে নিজেদের বিশেষ শক্তির মাধ্যমে তাদের জলের তলদেশে জীবিত রাখতে পারে।
নদীতে স্নানের সময় দম্বি সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিল তার প্রথম কণ্যা এবং কোলের ছোট্ট শিশুটিকে। মা’কে মৎসকুমার অপহরণের ঘটনাটি সে সরাসরি দেখেছিল কিন্তু বুঝতে পারেনি ঘটনাটা ঠিক কি ঘটেছিল। সে ভেবেছিল তার মা বোধহয় জলে ডুব দিয়েছে। এদিকে দীর্ঘক্ষণ ধরে দম্বি জল থেকে উঠছিলনা কিন্তু তার কোলের শিশুটি ক্ষুধায় কাঁদতে থাকলে কিশোরি মেয়েটি তাই খাদের ধারে পাথরের উপর দাঁড়িয়ে চিৎকার করে তার মা’কে ডাকতে লাগলোÑ
মা, তুমি কোথায়, তারাতারি উঠো ছোট বোন কাঁদছে। ওকে দুধ খাওয়াতে হবে।
দম্বি জলের তলদেশ থেকে বড় মেয়ের ডাক শুনে নদীর সেই পারে দ্রুত উঠে আসলো। মৎসকুমারও তার পিছু নিয়ে জাপটে পা ধরে রাখার চেষ্টা করে। কিন্তু দম্বি তার ছোট শিশুকে দুধ খাওয়ানোর প্রবল ইচ্ছা প্রকাশ করলে মৎসকুমার দম্বির পা দুটো শক্ত করে ধরে জলের উপওে কোমড় পর্যন্ত ভাসিয়ে তার শিশুটিকে বুকের দুধ খাওয়ানোর সুযোগ দিল। দুধ খাইয়ে দম্বি তার বড় মেয়েকে বাড়িতে গিয়ে যতœকরে শিশুটিকে রাখতে বললো।
বাড়িতে ফিরতেই জরেং উদ্বিগ্ন হয়ে তার বড় মেয়ের কাছে দম্বির কথা জানতে চাইলো। দম্বি বাবাকে বললো, তার মা জলে ডুব দিয়ে আর উঠেনি। জরেং ভাবলো তার সুন্দরী স্ত্রীর জলে ডুবেই মৃত্যু হয়েছে। একবার ডুব দিয়ে উধাও হয়ে যাওয়ার পর, মেয়ের ডাকে ফিরে এসে ছোট্ট শিশুকে দুধ খাইয়ে যাওয়ার ঘটনা সে কোনোভাবে বিশ্বাস করতে পারলো না।
পরদিন জরেং এর বড় মেয়ে ছোট বোনকে নিয়ে খাদের দিকে গেলো। বোনকে বুকের দুধ খাওয়ানোর জন্য মা’কে আগের মতো ডাকলো। জরেংও তার বড় মেয়ের পথ অনুসরণ করে খাদের পাশে লুকিয়ে রইলো। অবাক হয়ে জরেং লক্ষ্য করলো কিছুক্ষণের মধ্যে জলের তলদেশ থেতে তার সুন্দরী স্ত্রী কোমড় পর্যন্ত ডুবে থেকে তার ছোট মেয়েকে দুধ খাওয়াচ্ছে এবং হঠাৎ করেই যেনো জরেং এ চোখ ফাকি দিয়ে আবার জলের তলে অদৃশ্য হয়ে গেল।
পরদিন জরেং তার স্ত্রীকে ফিরে পাওয়ার জন্য মিলাম (দুই দিক ধারালো ছোরা) এমনভাবে ধার দিয়ে চকচকে করলো যেনো একটি মাছি মিলামের প্রান্তে বসার সঙ্গে সঙ্গেই দ্বিখন্ডিত হয়ে যায়। জরেং তার খাদের ধারে গিয়ে তার মেয়েকে নির্দেশ দিল তার মাকে ডাকার জন্য আর মিলাম হাতে সে পাশে আড়ালে ঝোপের মধ্যে লুকিয়ে রইলো। মেয়ের ডাক শুনে কিছুক্ষনের মধ্যেই দম্বির জলের উপওে ভেসে উঠলো আর নিচে মৎসকুমার শক্তভাবে তার দুই পা আঁকড়ে ধরে রেখেছিলো। স্ত্রীকে দেখামাত্র জরেং ঝোপ থেকে এক লাফে জলে ঝাপিয়ে পড়ে তার স্ত্রীকে শক্তভাবে ধরে রেখে জলের নিচে চকচকে ধারালো মিলাম দিয়ে ঘাই দিয়ে মৎসকুমাড়কে ভয় দেখালো। মিলামের ঘাই খেয়ে আহত মৎসকুমার ভয়ে দম্বিকে ছেড়ে দিল। নিজের সুন্দরী স্ত্রীকে উদ্ধার করে জরেঙের সে কি আনন্দ! কেবল নেচেই বেড়াচ্ছে। এদিকে দম্বিকে হারিয়ে মৎসকুমার খুব দুঃখ পেলো। রাগে ক্ষোভে সে ভয়ংকর প্রতিশোধ নেবার প্রতিজ্ঞা নিলো।
নিজের পরিবারের ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনা এবং আসন্ন বিপদেও কথা ভেবে জরেং নদী থেকে দূরে একটি বোরাং (গাছের উপরে তৈরি ঘর) তৈরি করার কথা ভাবলো। সে উদ্দেশ্যে একটি বড় অশ্বত্থ গাছের ওপর ঘর তৈরি করার প্রস্তুতি নিলেন।
অবশেষে সুন্দরী স্ত্রী ও মেয়েসন্তানদের নিয়ে জরেং অশ্বত্থ গাছের উপরে তৈরি বোরাং-এ বসবাস করতে শুরু করে। আর কখনোই সে তার স্ত্রীকে কোনো জলাশয়, এমনকি ঝর্না থেকে জল তুলতে যেতে দেয়নি। সংসারের প্রয়োজনীয় যাবতীয় সবকিছই জরেং নিজে সংগ্রহ করে বোরাং-এ তুলে রাখতো। ধীরে ধীওে জরেং তার পরিবারের সঙ্গে ঘটে যাওয়া বিপদের রেশ কাটিয়ে উঠে দুই মেয়ে আর ফিরে পাওয়া সুন্দরী স্ত্রীকে নিয়ে নিরাপদে সুখে শান্তিতে বসবাস করতে লাগলো।
এদিকে মৎসকুমার প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। নিজের কর্মচারীদের সঙ্গে নিয়ে সে দম্বির খোঁজে বেরিয়ে পড়ে। নিজের চাকর আর দাসদের নিয়ে সে যে পথধরে দম্বির খোঁজে বেড়িয়েছিল সেই পদচিহ্ন বর্তমানেও গারো পাহাড়ের আরুয়াকগিরি ও নকাতগিরি গ্রামে ‘দম্বিখো আম্মানি রামা’ অর্থ্যাৎ দম্বিকে খোঁজার পথ নামে পরিচিত। শেষমেষ মৎসকুমার তার ভৃত্যদের সহযোগীতায় দম্বিদের বোরাং খুঁজে পেল আর মাটির তলদেশ দিয়ে অশ্বত্থ গাছের নিচ পর্যন্ত সুড়ঙ্গ দীর্ঘ সুরঙ্গ তৈরির পরিকল্পনা করলো।
আর সেই দীর্ঘ সুরঙ্গ খননের কাজে দৈত্যাকৃতির শংখনি সাপ, বিরাটাকার ইল মাছ, বড় কাঁকড়া, কুমিড়, গুঁইসাপ এবং অসংখ্য রাক্ষুসে বোয়াল ও শিং মাছকে নিযুক্ত করলো। যেনো দ্রুত সুরঙ্গ খনন করে দম্বির বোরাং এর নিচ পর্যন্ত পৌঁছানো যায়।
এক গ্রীষ্মে সারারাত এমন বৃষ্টি হলো যে বন্যায় চারপাশ ডুবে যেতে লাগলো। প্রচন্ড বৃষ্টি এবং ঝড়ো বাতাসে এক জলজ প্রেতাত্মা জরেং কে হুশিয়ার করে বললো, সে যদি দ্রুত বোরাং ছেড়ে দুরা পাহাড়ের দিকে না চলে যায় তাহলে পুরো পরিবারসহ পানিতে ডুবে মরবে। জরেং কিছুতেই সেটি বিশ্বাস করতে পারলো না, যেখানে সে নদী থেকে অনেক দূরে গাছের উপওে বসবাস শুরু করেছে। জরেং কিছুতেই সেই ভূতের কথা পাত্তা দিল না। নিজের পরিবারকে নিয়ে আনন্দে বোরাং-এ ঘুমাতে লাগলো।
পরদিন সকালে গ্রামের লোকজন সেই অশ্বত্থ গাছের নিচে ছুটে গেল। তারা দেখলো সেখানে রয়েছে একটি বিশাল হ্রদ। অবাক হয়ে তারা লক্ষ্য করলো, বিশাল অশ্বত্থ গাছটি বোরাং সহ সেই হ্রদের তলদেশে বিলীন হয়ে গেছে। আর এই হ্রদটি দম্বি-ওয়ারি হ্রদ নামে পরিচিত। বর্তমান গারো পাহাড়ে ইমানগিরি গ্রামে সংরক্ষিত একটি বনের মাঝেই রয়েছে এই হ্রদটি।
খালসান সাংমা রংমুথু / গ্রাম: ইমানগিরি, গারো পাহাড়
* রংদিক নদী: গারো পাহাড়ের সিমসাং নদীর একটি শাখা নদী। এর উৎপত্তি তুরা অঞ্চলের মেমিনরাম পাহাড়ের দক্ষিণ-পূর্ব দিক থেকে।
আসি ও মালজার অপমৃত্যু
গারোদের আরেকটি লোকগল্প অনুসারে ধারণা করা হয় দিগং বানগং এর মাধ্যমে ওয়ানগালা উৎসবের শুরু। দিগং বানগং এর দুই সন্তান আসি ও মালজা বিয়ে করে অন্য গ্রামে বসবাস শুরু করে ফলে বাবা-মায়ের সঙ্গে তাদের ওয়ানগালা উৎসব পালন করা হয় না। একদিন আসি ও মালজা সিদ্ধান্ত নিল তারা বাবা মায়ের সঙ্গে ওয়ানগালা উৎসব পালন করবে। উৎসবের জন্য তারা কাঁকড়া, কলাপাতা, কচু এবং আদা জোগাড় করতে লাগলো। জুম ক্ষেত থেকে কচু ও আদা তুলে সেগুলোর স্বাদ বোঝার জন্য মুখে তুলতেই দানবের মত একটি বড় পতঙ্গ তাদের সামনে প্রকট হলো। পতঙ্গটি তাদের উদ্দেশ্যে কি যেনো বলছিল তারা বুঝতে পারেনি। যাবতীয় জিনিসপত্র জোগাড় করে আসি ও মালজা ওয়ানগালা উৎসবের উদ্দেশ্যে রওনা হলো। পথের মধ্যে আসিকে বাঘে খেয়ে ফেলল এবং মালজাকে মৎসকণ্যা নিয়ে গেল। ওয়ানগালার জন্য সংগ্রহ করা যাবতীয় উপকরণ নষ্ট হয়ে গেল।
এদিকে ওয়ানগালা উৎসবের সব আয়োজন শেষ করে বাবা মা আসি ও মালজার জন্য অপেক্ষা করছে। কিন্তু কারো কোনো সন্ধান পাওয়া গেল না। দিন শেষে একটি টিয়ে পাখি এসে সংবাদ দিয়ে গেল আসি ও মালজা বেঁচে নেই। এ খবর পাওয়ার পর পর গ্রামবাসী একজোট হয়ে যে জায়গাটিতে আসি ও মালজার অপমৃত্যু হয়েছে সেই জায়গাটিতে মৃত আত্মার উদ্দেশ্যে প্রার্থণা কাজ সম্পন্ন করল এবং এরকম পাপ যেন গ্রামে না প্রবেশ করতে পারে সেজন্য আসি ও মালজার পরিবারের সবাইকে গ্রাম থেকে বের করে দিল। গ্রামবাসীদের ধারণা ঈশ্বরকে উদ্দেশ্যে উৎসর্গ না করে আদা খাওয়ার কারণেই তাদের এই পরিণতি হয়েছিল। সেই থেকে আচিকদের মধ্যে এই ধারণা প্রচলিত হয় যে, সৃষ্টিকর্তাকে উৎসর্গ না করে ওয়ানগালা উৎসবের আগে কোনো ফসলাদিই খাওয়া যায় না। একারণে গারোরা জুম চাষের যাবতীয় সব ফসলাদিই সূর্য দেবতা মিসি সালজং কে উৎসর্গ করে ওয়ানগালা উৎসব পালন করে থাকে।
সংগৃহীত