১৪
যদি জিজ্ঞেস করা হয় যে ইসলামের ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা কী, আমি কোনো দ্বিধা ছাড়াই বলবো, ‘পারস্য বিজয়।’ নেহওয়ান্দের যুদ্ধ আরবদের একটা সুন্দর দেশের সঙ্গে প্রাচীন এক সভ্যতা উপহার দিলো। আরও যুথার্থভাবে বললে আরবরা পেলো এমন এক জনগোষ্ঠী যারা সেমিটিক আর আর্য উপাদান দিয়ে নতুন এক সভ্যতা তৈরি করতে পারে। আমাদের মুসলিম সভ্যতা সেমিটিক আর আর্য ভাবনার শংকর। এই শিশু তার আর্য মায়ের কোমলতা আর পরিশুদ্ধতা এবং সেমিটিক বাবার চমৎকার চরিত্র উত্তরাধিকারে পেয়েছে। পারস্য বিজয় না হলে ইসলামের সভ্যতা একপেশে হয়ে যেতো। পারস্য বিজয় আমরা তাই পেয়েছি রোমানরা যা পেয়েছিল গ্রীস জয় করে
১৫
যতদুর দেখি, ফারসি কবি মির্জা গালিব সম্ভবত সাধারন মুসলিম সাহিত্যে আমাদের ভারতীয়দের করা সবচেয়ে বড় অবদান। আদতেই তিনি সেই সব কবিদের একজন যার কল্পনা আর মেধা তাঁকে ধর্ম আর জাতীয়তার সংকীর্ণ সীমাবদ্ধতার ওপরে স্থান করে দিয়েছে। তাঁর উপযুক্ত মূল্যায়ণ এখনো হয়নি।
১৬
ঘরোয়া নীতিগল্পের আদলে জীবনের গভীরতম সত্য ব্যাখ্যা করতে অসধারন প্রতিভাশালী হতে হয়। শেক্সপীয়র, মওলানা রুমি আর যিশু খ্রিষ্ট সম্ভবত সেরকম দুর্লভ প্রতিভার একমাত্র উদাহরণ।
১৭
মাৎসিনির আসল জায়গা রাজনীতি নয় বরং কাব্য। তিনি রাজনীতিতে নিজেকে উৎসর্গ করায় ইতালির যতটা লাভ হয়েছে পৃথিবীর ততোটাই লোকসান হয়েছে।
১৮
ব্যক্তি আর জাতি মারা যায়; কিন্তু তাঁদের সন্তান, মানে ভাবনাগুলো কখনো মরে না।
১৯
একবার এক ইংরেজ ভদ্রলোক আমাকে বললেন যে তিনি ইহুদিদের ঘৃণা করেন, কারণ তারা নিজেদের ঈশ্বরের নির্বাচিত মানুষ বলে মনে করে। তার মতে এ এমন এক বিশ্বাস যা অন্যান্য জাতিকে ঘৃণা করতে উদ্ধুত, এমন কী সেই ঘৃণা ন্যায্য বলে ভাবতে শেখায়। তিনি ভুলে গিয়েছিলেন যে সাদা মানুষের বোঝা নামের ধারণাও অন্য পোশাকে একই রকমের ইহুদি বিশ্বাস।
২০
অস্কার ওয়াইল্ডের আত্মা যতটা ইংরেজ, তারচেয়ে বেশি পারস্য।
২১
মানুষের স্মৃতি সাধারনত খারাপ, আশেপাশের মানুষদের কাছ হতে পাওয়া অপমান ছাড়া।
২২
জগতে নিয়তি মূলত নির্ধারণ করে অল্প সংখ্যক লোকেরা। ইউরোপের ইতিহাসে এই ধারনার সত্যতার যথেষ্ট সাক্ষ্য দেয়। আমার মনে হয়, মানব্জাতির ইতিহাসে এই অল্প সংখ্যক লোকেরা এতো শক্তিশালী উপাদান হয় এর একটা মনোবৈজ্ঞানিক কারণ আছে। চরিত্র হচ্ছে সেই অদৃশ্য শক্তি যা জাতির নিয়তি নির্ধারণ করে দেয়। আর শক্তিশালী চরিত্র সংখ্যাগুরুর মাঝে সম্ভব নয়। এই শক্তি যত বেশি জনের মাঝে ছড়ানো হয় ততই তা দুর্বল হয়ে যায়।
২৩
এমনকিছু লোক আছে যারা সন্দেহবাদী কিন্তু তবু মনে ধার্মিক ঝোঁক আছে। ফরাসি প্রাচ্যবিদ রেনাঁ নিজের সন্দেহবাদ সত্ত্বেও নিজ মনের অপরিহার্য ধার্মিক চরিত্রের কথা বলেছেন। কারোর চিন্তার স্বভাব হতে সেই মানুষের চরিত্র নিয়ে মতামত গঠনের ব্যাপারে আমাদের অবশ্যই সতর্ক হওয়া উচিৎ।
২৪
প্লেটো বলেন, ‘বিস্ময় হচ্ছে সকল বিজ্ঞানের মাতা।’
বেদিল (মির্জা আব্দুল কাদির) বিস্ময়ের এই অনুভূতিকে ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখেন তিনি বলেন,
‘বিস্ময়ের এই আরশিনগরে ভঙ্গুরতাই ধর্ম
চোখের পলক ফেললেও হয়তো আসর শেষ হয়ে যাবে’
(নাযাকত হা আসত দর আগোশ মিনা খানায়ে হ্যায়রত
মশরহ বরহম মযান তা নশকনি রঙ্গে তামাশা রা)
প্লেটোর কাছে বিস্ময় মূল্যবাণ কারণ তা প্রকৃতিকে আমাদের জেরার মুখে ফেলে। বেদিলের কাছে বৌদ্ধিক ফলের নিরপেক্ষ হয়ে এই বিস্ময়ের নিজেরই এক মূল্য আছে। বেদিলের চাইতে সুন্দরভাবে এই ভাব উপস্থাপন করা অসম্ভব।
জাভেদ হুসেন
জাভেদ হুসেনের জন্ম ১লা আগস্ট ১৯৭৬, কুমিল্লায়। সোভিয়েত পরবর্তীত সক্রিয় মার্কসীয় রাজনীতিতে হাতেখড়ি। মার্ক্সের লেখা এবং মার্ক্সীয় দর্শন বিষয়ে উল্লেখযোগ্য বেশ কয়েকটি গ্রন্থ রয়েছে। এছাড়াও তিনি একজন গালিব গবেষক। উর্দু-ফার্সি সাহিত্য বিষয়ে রয়েছে তাঁর বিস্তৃত জানাশোনা। মূল উর্দু ও ফার্সি থেকে অনূদিত বেশ কয়েকটি বই প্রকাশিত হয়েছে।