হাসান রোবায়েতের কবিতাবলী

ভোর

খুব ভোর। আমাদের ঘুম ভাঙে। পাথরের উপর আমরা শুয়ে পড়ি আবার। পোকাদের অনন্ত গুঞ্জনের ভেতর জড়ো হয় সমুদ্রের একাকীত্ব আর ঢেউয়ের নীল নীল সব আওয়াজ। শরীর ক্লান্ত হলে দূরে দোকানী মেয়েটার দিকে তাকিয়ে কুড়ানো নুড়ির থেকে কিছু ছুড়ে দিই সমুদ্রে—একজন সাইকেল আরোহী ক্যারিয়ারে ধোপাদের পরিচ্ছন্ন কাপড় উড়িয়ে দিচ্ছে সূর্যাস্তের তরমুজ খেতে—আমরা হাই তুলি—

বৎসরের সমস্ত কুয়াশা জমা হতে থাকে পরিত্যক্ত এক ট্রাকের কাচে, পাশেই ধানবীথিকার খাঁড়ি, সমুদ্রের গভীরে ডুবতে ডুবতে একটা খরগোশের মনে হয়—ধর্ষিতা মেয়েটার হেমন্তও ফাঁকা প্ল্যাটফর্মের মতো বিষণ্নমান—

বাতাসের কথোপকথনের মধ্যে কারা যেন লুকিয়ে রাখছে সমুদ্রে নামার পোশাক—

সন্ধ্যা

আমাদের কেউই ছিল না কোনোদিন—ঝিনুক কুড়ানো ছোট মেয়েরা ঘুমিয়ে পড়ছে বালির বিস্রস্ত ঢালে, জিপসিদের স্তনকল্পনায়, টাকায় কেনা মেয়েদের কোমরের নিচে হে নারিকেলবীথি হেসপারাসের চিরআলোটুকু তাদেরকে দিও—

সন্ধ্যায় পশুরা অরণ্যের থেকে ফিরতেছে বাড়ি, সমুদ্র, মেয়েটার দুঃখিনী বালাটির সাথেও কথা বলে গোল হয়ে আজানু বসে তার পাশে—

ঘুম ভেঙে গেলে, নুড়ি কুড়াতে কুড়াতে একটা সন্ধ্যা বিষণ্ন হয়ে উঠছে হাতিদের মাহুতের ভেতর—

দিনের মধ্যে

একটা দিনের মধ্যে ঢুকে আমরা দেখি—বসন্ত গুটিয়ে নিচ্ছে হার্পুন, ছোট দোকানের পাশে জেলেদের দরদাম, আবহাওয়ার খবরের মতো মাছের ফ্যাকাশে চোখ, কোথাও মেয়েদের ঠান্ডা মোজা জোয়ার ও ভাঁটায় দুলে উঠছে তারে—এখানে অরণ্য নাই—মৃত প্রবালের দিকে তাকিয়ে মনে হবে, ঘড়িগুলো হেমন্তকে ঠিক সময়েই জানিয়ে দিচ্ছে খয়েরি রঙের বিষণ্ন মালহার ধীরে ধীরে ডুবে যাবে নীলের কেন্দ্রস্থলে—

ভাষার বাইরেও একটা মেয়েকে বলার থাকতে পারে—‘বৃষ্টি তার পথ হারানোর উৎকণ্ঠা নিয়ে ঝরে যাচ্ছে জেটির উপর, যেখানে গ্রীষ্মকালকে ধর্ষিতার মনে হয়েছিল: সব ঋতুরই থাকে নিজস্ব শোকের পোশাক।বিস্মরণের যারা আগেই হাজির হয় তুঁতফল পাকার মৌসুমে—

হোটেলের নষ্ট বেসিনের উপর আমরা লিখে রাখি:—

—বেলাভূমির লাল কাঁকড়াগুলোই মনে হয় এপ্রিল মাস

—সমুদ্রশিসের পরে মদ একটা ফুলকাটা অর্কিডের খেত

—মেয়েটার বিয়ে হতে পারতো এমন সব সিগারেটের ধোঁয়ার সাথে যারা বাজাতে পারে দীর্ঘ ক্যানেস্তারা

—টমেটো ফুলের সঙ্গে কথা বলতেই মূলত জোয়ার ফুলে ওঠে সমুদ্রে

কাকাতুয়া পাখিরা ফিরে এলে আমাদের নীরবতায় শুরু হয় সমুদ্রের গর্জন। একটা ছোট মেশিন জেটির হাওয়ার দূরে জ্বালাতে পারে আলো। আর, আমরা দাঁড়িয়ে থাকি পরস্পর গাদা গাদা নৈঃসঙ্গ্যের ভেতর—

শান্ত দুপুর

দুপুর। এপ্রিলে কোথাও পাকছে বেতফল—অপরাহ্ণ তার নিঃসঙ্গতার ভেতর পোকাদের ঝিম মারা ডাক ঘুমিয়ে আছে বুনো ঝোপের পাশে—সমুদ্র তার পাথরের মর্মভেদী গোলকধাঁধায় আমাদেরকে টেনে নিয়ে যায় নারিকেল জিঞ্জিরার শেষে যেখানে জীবনভর শান্ত তরমুজখেত, সমস্ত ঢেউ ঝাঁক ঝাঁক ভাউচারের মতো উড়ে যাচ্ছে প্রুশিয়ান ব্লুর দিকে—

একটা মেয়ে, বেনী ঠিক করতে করতে দেখে নেয় কেউ একজন ডিসেম্বরের বনে গুনগুন করছে ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর ধুন, সিগারেটের দোকান ক্রমশ ধীর হয়ে উড়ে যাচ্ছে ঘাসের উপর—

ঘুম আমাদেরকে এগিয়ে দেয় সমুদ্রের ঘননীলের মধ্যে—আমাদের চিঠি নাই, ঠিকানা নাই—ভাগনারের জুতার মধ্যে পা রেখে অন্তহীন ভাসছে হেমন্ত, জেলেদের হারপুন লটকে আছে মগজের ভেতর—

মেয়েরা তাদের বিক্রির টাকায় লিখে রাখছে একটা পঙক্তি—‘সমুদ্র আমাদের ঠিক করে দেয় মেয়েদের চোখের রঙ কেন দূরের তুষারের মতো বর্ণনাহীন ধূসর’—

ছোট রাত

একটা ছোট রাত। আমরা জেগে উঠি বিকালের ঘুম থেকে। হেঁটে যেতে যেতে অরণ্যের শব্দে বুঝতে পারি পকেটভর্তি কুড়ানো পাথর আমরা ছুড়ে দিতে পারি মাইল-মাইল নারিকেলবীথির দিকে—

বাতাসে পেকে উঠছে দীর্ঘ ডিসেম্বর। ছড়ানো কেয়াফল আর পর্যটকদের প্রবালে কাটা মুহুল পা আমরা ফেলে আসি বিস্রস্ত জেটির থেকে দূরে। রাতের অন্ধকারে আমাদের গান পৌঁছে যায় দূরের ফসফরাস জ্বলা সাম্পান নৌকার কাছে। স্বচ্ছ নিস্তব্ধতার ভেতর মেয়েটা ভাবতে পারে: ঘুমিয়ে পড়া প্রতিটা মুখ নিয়ে আসছে অজস্র কোলাহল—

এখন অন্ধকার—সমুদ্রের নীরবতার ভেতর ডুবে যাচ্ছে নৌকা আবাবিলের শিসের মতন—

ঝাউগাছ

ভোর—ছোট ছোট নুড়ি আর ঝিনুকের গায়ে লেগে থাকা বালু কারা যেন পরিস্কার করছে কুয়াশায়। শীত তার ধীরগতির নিস্তব্ধতার ভেতর একটা পাখিকে গাইতে দেয় সারেঙ্গীর সুর আর একজন সাইকেলঅলা জেটির উপর দিয়ে সোজা চলে যেতে থাকে মিশনারিদের ঘড়ির মধ্যে দিয়ে সদ্য কেটে ফেলা ঝাউগাছ, ভাড়ায় চালিত হেমন্তের দিকে—

পুরানা সাম্পান দুলছে—প্রুশিয়ান ব্লুর ক্রমাগত ঢেউয়ে মেয়েটার চুল উড়ে যাচ্ছে অস্পষ্ট ক্যাথিড্রালে যেন ফাঁকা একটা স্টেশনে দুনিয়ার সমস্ত বিরহতা নিয়ে একজন ট্রেন চালক অপেক্ষা করছে নৈঃসঙ্গ্যের হুইসেল—

ভোর। আমরা বের হই হোটেলের রুক্ষতা, হিম জংলি ফুলের বেলাভূমি পার হয়ে ভাটায় জেগে ওঠা পাথরের আমর্ম কেন্দ্রস্থলে—গত রাতের কিনে নেওয়া মেয়েগুলো ঈশার মুখ আঁকতে আঁকতে ছুড়ে দিচ্ছে কয়েন আকাশের স্যাংকচুয়ারিতে

তারাধূলিপথ

জীবন কাউকেই দেয় না কিছু কেবল উত্তরের মাঠে ধানপারুলের ছাঁচে কখনো ফুটে ওঠে কখনো নিঃশব্দ ঝরার ছলনায় ডাক দেয় দূর থেকে, সে এক বিপুল কুহক: জমাট নিয়রের ভেতর থেকে আচমকাই উড়িয়ে দেয় পাখি—মানুষ ভেবে নেয়, কামরাঙা ফুলটার পাশে অজস্র শিশির গোলক, তার মধ্যেই জীবন তার প্রভূত স্নান নিয়ে লুকিয়ে রয়েছে থির—সে সফর ফুরায় না কোনোদিন , শুধু সরাইখানাই চলে যায় দূরে—

তুমি কি তাদেরও ওপার—!

যেখানে মরণ পাতার শিশির হয়ে সুগোল করছে হাওয়া—

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ভাষা
Scroll to Top