হাজং সাহিত্যের এপিঠ-ওপিঠ // জবা রায়

জীবনকে বিচিত্র আঙ্গিকে দেখার একটি সহজ পথ হল সাহিত্যের মনযোগী পাঠ। সমাজের বিভিন্ন মানুষের দৃষ্টিভঙ্গির সাথে সহজে পরিচিত হওয়া এবং জীবনকে বোঝার সহজতম উপায়ও সাহিত্যের দ্বারস্থ হওয়া। সমাজ-দর্পন নামে সাহিত্যের সুখ্যাতিও এসব গুণাবলীর কারণেই। একটি জনগোষ্ঠী, ভাষাগোষ্ঠী এবং ভৌগোলিক অঞ্চলকে বোঝার জন্য সংশ্লিষ্ট সাহিত্যই দিতে পারে সঠিক পথের সন্ধান। পৃথিবীর সকল ভাষাগোষ্ঠীরই রয়েছে নিজস্ব সাহিত্যের ধারা। বাংলাদেশের হাজং সম্প্রদায়েরও রয়েছে সমৃদ্ধ সাহিত্যের ঐতিহ্য। বাংলাদেশে প্রায় ৪৫ টি সম্প্রদায়ের আদিবাসী বসবাস করে। তাদের মধ্যে হাজং একটি উল্লেখযোগ্য আদিবাসী সম্প্রদায়। এদেশে হাজং জনসংখ্যা প্রায় ২৫ হাজারের মতো। বর্তমানে বাংলাদেশের ময়মনসিংহ জেলার ধোবাউড়া উপজেলা, শেরপুর জেলার নালিতাবাড়ী ও শ্রীবরদী উপজেলা, নেত্রকোণা জেলার সুসং দূর্গাপুর ও কলমাকান্দা উপজেলা এবং সুনামগঞ্জ জেলায় হাজংদের বসবাস। । আত্মসচেতন, স্বাধীনপ্রিয় ও পরিশ্রমী হিসেবেই হাজংরা অধিক পরিচিত। ইতিহাসের পাতায় নানা আন্দোলনে যেমন রয়েছে হাজংদের বীরত্বপূর্ণ অবদান তেমনি হাজংদের রয়েছে ভরপুর জীবনবোধ সম্পন্ন সাহিত্য। হাজংদের নিজস্ব কোনো বর্ণমালা না থাকায় তাদের রচিত সাহিত্য সংরক্ষণের জন্য বাংলা বর্ণমালা ব্যবহার করা হয়। প্রথমদিকের অন্যান্য সাহিত্যের মতই হাজং সাহিত্যও লোকমুখে রচিত ও প্রচলিত হতো। বর্তমানে নিজেদের শিল্প-সংস্কৃতি ধরে রাখার জন্য এসব সাহিত্যের লিখিত রূপ প্রকাশিত হচ্ছে। হাজং সাহিত্য রচিত হয় মূলত তাদের বৈচিত্র্যময় জীবনযাপন, নানা ধরনের উৎসব, ধর্মীয় অনুষ্ঠান ইত্যাদিকে কেন্দ্র করে। সেখানে থাকে তাদের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, খেলাধুলা, প্রেম-বিরহের কথা। হাজং সাহিত্যে গান ও কবিতা বেশি রচিত হলেও এর উল্লেখযোগ্য শাখাগুলো হলো : ছড়া, কবিতা, প্রবাদ, ধাঁধাঁ, গল্প, গান ইত্যাদি।

হাজং ছড়া 

হাজং সাহিত্যে ছড়া সাধারণত শিশুদের জন্য রচিত হয়ে থাকে। এগুলো মূলত শিশুদের ভুলিয়ে ভালিয়ে নানা শিক্ষা বা উপদেশ দেয়ার জন্য রচিত হয়ে থাকে। যেমন :

 হাজং: মাইয়া কয় উথিক এলা

না ঘুমাও আর বারিসে বিলা

উথথে মজন হাতমুখ ধ

একটিপাসা পুড়িবা ব।

বাংলা: মা বলছে উঠো এখন

আর ঘুমিও না বেড়েছে বেলা

উঠে এখন হাতমুখ ধোও

একটু হলেও পড়তে বসো।

হাজং কবিতা

হাজং সাহিত্যের মধ্যে কবিতা একটি বড় অংশ জুড়ে রয়েছে। কবিতাগুলো রচিত হয় সাধারণত নানা উৎসব, সামাজিক অবস্থা, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, প্রণয়ের গাথা এসব বিষয় বস্তু নিয়ে। যেমন :

‘হংওরানি’

পুষ মাসলা শেষ আজি

চাংনি নুয়া ধান

গিরিলা মুখনি টাংকে আহি

মননিও রংলা গান।

নুয়া ধানলা পুইল্যা পিঠা

গুড়ায় গরে গরে

হুটু দাংঅর লগরগুতা

বাখার পিঠাই নাড়ে।

বর রাতিনি পাড়ালা হাপাল

গাংবাই কিলিং কালাং,

গাদ-টাট দুয়্যে পালেকন

খালি পিঠা খাং খাং।

নুয়া ধানলা নুয়া পিঠা

হুবালা গরনি,

রংয়ে রং হুবালা মন

আহিয়ে হংঅরানি।

বাংলা অনুবাদ :

 ‘সংক্রান্তি’

পৌষ মাস শেষ আজকে

গোলাঘরে নতুন ধান

গেরোস্তের মুখে অনেক হাসি

মনেও রঙিন গান,

নতুন ধানের প্রথম পিঠা

তৈরি করে ঘরে ঘরে

ছোট বড় গোল গোল

নানান পিঠাই করে।

ভোর রাতে পাড়ার ছেলেরা

নদীতে করে লাফালাফি

স্নান সেরে তারা সবাই

শুধু পিঠাই খেতে চায়

নতুন ধানের নতুন পিঠা

সবার ঘরেতে,

রঙে রঙ সবার মন

আসলে সংক্রান্তি।

হাজং প্রবাদ 

একটি সমাজের হাজার বছরের সঞ্চিত জ্ঞানের প্রকাশ হয় প্রবাদ-প্রবচনের মাধ্যমে। প্রবাদের সাধারণ ধর্মানুসারে হাজংদের প্রবাদগুলো রচিত হয়েছে মুখে মুখে, এবং প্রচলিত হয়েছে পুরো জাতিগোষ্ঠির সর্বত্র। এসব প্রবাদে থাকে নানা উপদেশ, শিক্ষনীয় বিষয় অথবা ব্যঙ্গসূচক কথা। অন্যান্য ভাষায় প্রবাদের যেমন বিচিত্র ব্যবহার তেমনি রয়েছে হাজং সাহিত্যেও। যেমন :

হাজং:

যালা আতে নিখায় অয় রান্দুনি

যাগে নিদেখে অয় সুন্দুরি

বাংলা :

যার হাতে কখনো খাইনি সে রাঁধুনী

যাকে দেখিনি সে সুন্দরী

এই প্রবাদটি দ্বারা বুঝানো হয়েছে যে আমরা অনেক সময় না দেখে, না জেনে, না বুঝে নানা বিষয়ের সিদ্ধান্তে পৌঁছাই যেটি মোটেও সঠিক নয়।

হাজং :

দাঁতলা ভরে অত

অতলা ভরে দাঁত

বাংলা :

দাঁতের ভরে ঠোঁট

ঠোঁটের ভরেই দাঁত

অর্থাৎ এখানে পরস্পরের সহযোগিতা ছাড়া কেউ চলতে পারে না এটাই বুঝানো হয়েছে।

হাজং সাহিত্যে ধাঁধাঁ 

হাজং সাহিত্যে রয়েছে অসংখ্য ধাঁধাঁ । অনেক সময় নিজেদের স্মৃতি শক্তি ঝালিয়ে নেয়ার জন্য তারা একে অপরকে ধাঁধাঁ জিজ্ঞেস করে থাকে। যেমন :

মামা-মামী ঢিকিনি ধান বানে

মগে দিইখ্যা দর বন্দ করে

উত্তর : হামুক

বাংলা : মামা-মামী ঢেকিতে ধান ভানে

আমাকে দেখে দরজা বন্ধ করে।

উত্তর : শামুক

হাজং : হুটু বুলা পিনি পাথিন

দাংঅর বুলা না পিনি

ক ত ই শিলুকরৗ

কৗই পায় তাড়াতাড়ি

উত্তর : বাঁশ

বাংলা:

ছোট সময় পোশাক পড়ে

বড় সময় পড়ে না

বল দেখি এই ধাঁধাঁ

কে পারবে তাড়াতাড়ি।

উত্তর: বাঁশ

হাজং: দাহালা একরা গাসনি রুসে ভুতা নাওয়া ফল

বারবাই অয় দুলা বিতুরনি ইল্দা টলমল।

উত্তর : ডিমৗ

বাংলা: পাহাড়ের একটি গাছে হয়েছে ভোতাহীন ফল

বাইরে সে সাদা ভিতরে হলুদ টলমল।

উত্তর : ডিম।

হাজং গল্প 

হাজং গল্পগুলো রচিত হয় প্রাত্যহিক নানা ঘটনা, জীবজন্তু, রোমাঞ্চকর ঘটনাকে কেন্দ্র করে। জীবনকে দেখার নানা আঙ্গিক ও অভিজ্ঞতার সংমিশ্রণে রচিত হয়েছে হাজং গল্পের ভাণ্ডার। এছাড়াও রূপকথা, যাদুশক্তির কথা, হাসির গল্পও অনেক রয়েছে হাজং সাহিত্যে।

হাজং গান 

হাজং সাহিত্যে গান একটি বিশাল জায়গা দখল করে আছে। হাজং ভাষায় অসংখ্য গান রচিত হয়েছে। হাজং গানের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট হলো এর কর্মমুখী উদ্দীপনার জোয়ার। কর্মঠ জাতিগোষ্ঠী হিসেবে তাদের গানেরও অধিকাংশই কর্মসম্পৃক্ত। কাজকে আরো গতিশীল, আনন্দময় করে তুলতে হাজং ভাষায় রচিত হয়েছে অজস্র গান। তাছাড়া ধর্মীয় উৎসব, নানানরকম মেলা-পার্বন ও আনন্দ-বিনোদনের প্রয়োজনেও রচিত হয়েছে সাঙ্গীতিক আবহের গীতি, কবিতা ও গান। হাজং সাহিত্যের এ শাখায় প্রচলিত গান গুলোর মধ্যে রয়েছে রোয়া লাগা গান, জাখামারা গান, গীতলুগীত, চোরমাগা গান, লিওয়াটানা গান,বানাই গীত, বানাগড়া গান, গোপিনীগীত, টেংলা গান, রসিগান, নৌকা ভাঙার গান, নামকীর্তন, সংকীর্তন, পদকীর্তন, নিকনী গান, বারোমাসি গান প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।

১. রোয়া লাগা গান: এ গান গুলো ধান চাষ শুরু হলে প্রথম রোয়া লাগানোর সময় মহিলারা গেয়ে থাকে। যেমন :

পাড়া পুশি রঙ্গরুপি

হুবাই মিইল্যা যাবো

মড়লগুলা পুইল্যা রুয়া পেগ খিলাবো।

বাংলা :

পাড়া পড়শী রঙ্গরুপি

সবাই মিলে যাবো

মোড়লদের প্রথম রোয়া কাদা খেলবো।

২. জাখামারা গান: এ গানটি হাজংরা মাছ ধরার সময় গেয়ে থাকে। এসব গানে হাজং মহিলারা প্রতিবেশিদের মাছ ধরতে যাওয়ার কথা বলে। যেমন :

বিল জুড়িয়্যা কুড়া চিলা

উইড়া পুররে বুগা

আয় বুইনি খাল্যাই নিইয়া

আয় জাখা মারংগা।

বাংলা: বিল জুড়ে চিল

উড়ে পড়ে বক

আয় বোন খালাই নিয়ে

আয় জাখা দিয়ে মাছ ধরতে যাই।

৩. রসিগান: এটি মূলত বিরহের গান। এ গানে আপনজনকে কাছে পাওয়ার আকুতি, বিরহজনিত অনুভূতি, মনের ব্যাকুলতা প্রকাশের জন্য গেয়ে থাকে। যেমন-

 হাজং: অগ্রাণ মাস

সাধুরে, অগ্রাণ মাসনি, সাধুরে ক্ষেতভরা ধান,

কাইয়ূ কাটে, কাইয়ূ মারড়্যায়, কাইয়ূ করে নবান।

নবান করিয়্যা সাধুরে মহানন্দে খায়,

ও- বেল্যাই মুলা সাধু বাণিজ্যি বায় যায়।।

সাধুরে, বাণিজ্যি বায় যাইয়্যা সাধুরে মগে রলে ভুলে।

বাংলা : সাধুরে, আগুন মাস গো সাধু ক্ষেত ভরা ধান।

কেউ কাটে, কেউ মাড়ায়, কেউ করে নবান।।

নবান করে সাধুরে মহানন্দে খায়।

ও বেলায় আমার সাধু বাণিজ্যেতে যায়।।

সাধুরে বাণিজ্যতে গিয়ে সাধু আমায় রইলো ভুলে।

৪. দেশাত্মবোধক: এছাড়াও হাজংদের রয়েছে দেশাত্মবোধক গান। যেমন :

ই মাটিনি জনম মুলা

ই মাটিনি জনম তুলা

ভুলিবা নাপাবো আমরা ভুলিবা নাপাবো।

বাংলা : এ মাটিতে জন্ম আমার

এ মাটিতে জন্ম তোমার

ভুলতে পারবোনা আমরা ভুলতে পারবো না।

৫. ভক্তিমূলক গান: এ গানগুলো বিভিন্ন পূজা পার্বণের সময় হাজংরা গেয়ে থাকে। যেমন :

হাজং : আমলা হিংয়া নেও বাস্তু ঠাকুর

পূজা পানি দিবো আমরা প্রতি বছর।

ফুল পানি দিয়া পূজা দিবো যত আর,

চাল কুলা আমরা দিবো ভারে ভার

মিঠাই দুত চিনিরা দিবো তো বাখার।।

বাংলা অনুবাদ : মোদের ভক্তি নাও বাস্তু ঠাকুর

পূজা করবো আমরা প্রত্যেক বছর।

ফুল পানি দিয়ে পূজা দেবো যত আর,

চাল কলা আমরা দিবো ভারে ভার

গুড় দুধ চিনি দেবো আরও অনেক।।

৬. বাওয়া মারা গান: বাওয়া দেওয়ার সময় যে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কথোপকথন হয় সেটাই বাওয়া মারা গান হিসেবে পরিচিত। যেমন-

হাজং:

মরদ: চৈটি মাও! চৈটি মাও

শিঘ্রী ভাত দি

বাওয়া মারা যাবো আজি

গেলসেং দাঙ্গারনি।

তিমাদ: ভাত হুছে হাক নাইতে

এলা উপায় কি

কি দিয়া খাওয়াবো ভাত

হাকা দাকানি

বাংলা অনুবাদ :

পুরুষ: চৈতির মা! চৈতির মা

শিঘ্রী ভাত দাও

বাওয়া মারতে যাবো আজ

বড় বিলেতে।

স্ত্রী: ভাত আছে তারকারি নাই

এখন উপায় কি

কি দিয়ে খাওয়াবো ভাত

এমন তাড়াহুড়োয়?

৭. টেংলা গান: মূলত এটি বিদ্রোহের গান। আন্দোলনের সময় শাসকদের বিরুদ্ধে গাওয়া হয়। বর্তমানে এই গান একেবারেই হারিয়ে গেছে।

হাজং-সাহিত্য সুপ্রাচীন কাল থেকেই রচিত হয়ে আসছে এবং এখনো নিজস্ব ভঙ্গিমায় চলমান রয়েছে। হাজং জনগোষ্ঠীর সাহিত্য সমৃদ্ধির মূল্যায়ন হওয়া জরুরি। কেননা এই জনগোষ্ঠীর মানুষের আনন্দ-বিনোদন, কর্মকুশলতা, উদার মানসিক কাঠামো, স্বাধীন চিন্তা পদ্ধতির বিশ্লেষণে হাজং সাহিত্যই হতে পারে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য অঞ্চল। হাজং সাহিত্যের ভেতরেই লুকিয়ে রয়েছে হাজংদের প্রতিদিনের সংগ্রামী জীবনের কাহিনী, ঐতিহ্য, সদাচার, নীতিবোধ ও বিরহের কথা। পারিপার্শিকতার চাপে এ সাহিত্য বর্তমানে হারিয়ে যাওয়ার পথে, তাই এর যথাযথ সংরক্ষণ, বিচার বিশ্লেষণ ও মূল্যায়নের মাধ্যমে তার গতি ফিরিয়ে আনা এই স্থানিকতার নতুন যুগে হতে পারে একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ। এর শব্দ, ভঙ্গি ও চিন্তা ভাণ্ডারকে টিকিয়ে রাখা এবং বিকশিত হবার পরিবেশ সৃষ্টি করা সমকালীন সচেতন মানুষের একটি নৈতিক দায়িত্ব।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ভাষা
Scroll to Top