জার্মান ভাষার শ্রেষ্ঠতম গীতিকবিদের একজন হিসেবে ব্যাপকভাবে স্বীকৃত রাইনার মারিয়া রিলকে কাব্যভাষার বুনন ও চিত্রকল্পে নতুন ধারার প্রবর্তনের মাধ্যমে কবিতার জগতকে প্রসারিত করার প্রয়াসে এবং নান্দনিক দর্শনের আরাধনায় ছিলেন অনন্য। তাঁর কাছে জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল শিল্প। খ্রিস্টীয় নীতিধারাকে প্রত্যাখ্যান করে তিনি তাঁর কাব্যে সৌন্দর্য ও ক্লিষ্টতা, আনন্দ ও যন্ত্রণা, জীবন ও মৃত্যুর মধ্যে এক অনবদ্য সেতুবন্ধ স্থাপন করতে চেয়েছেন। অন্যরা যেখানে নিজস্ব সত্যান্বেষণে ধর্ম ও নৈতিকতার আশ্রয় খুঁজেছেন, সেখানে রিলকে বস্তু তথা বস্তু-পারের ভাবজগতটিকে গভীর অনুভব ও প্রতীতির অবগাহনের পরিশুদ্ধিতে কবিতায় রূপ দিতে চেয়েছেন; যেমনটি আমরা দেখি রবীন্দ্রনাথের বেলায়। কালের নিরিখেও রিলকে (১৮৭৫ – ১৯২৬) অনেকটা রবীন্দ্রনাথের সমসাময়িক।
রিলকের প্রথম দিকের কবিতা, ছোটগল্প এবং নাটকগুলিকে তাদের রোমান্টিকতার ধারায় চিহ্নিত করা যায়। তাঁর ঐ সময়ের কবিতায় জার্মান লোকগানের ঐতিহ্যের প্রভাব বিদ্যমান যা হেনরিক হাইনের গীতিকবিতার সাথে তুলনীয়।
১৮৯৯ সালে রিলকে রাশিয়ায় প্রথম দুটি গুরুত্বপূর্ণ ভ্রমণ করেন। সে সময় তিনি অনুধাবন করেন যে ভূচিত্র এবং মানুষ উভয় ক্ষেত্রেই রাশিয়াকে তাঁর “আধ্যাত্মিক পিতৃভূমি” বলে অভিহিত করা যায়। সেখানে রিলকে লিও টলস্টয়, এল.ও. পাস্তেরনাক (বরিস পাস্তেরনাকের পিতা) এবং কৃষক কবি স্পিরিডন ড্রোসচিনের সাথে দেখা করেন। ড্রোসচিনের রচনাগুলি রিলকে জার্মান ভাষায় অনুবাদও করেছিলেন। এ ভ্রমণ রিলকে কে কাব্যিক উপাদান এবং অনুপ্রেরণা যুগিয়েছিল যা তাঁর অস্তিত্ববাদী বস্তুবাদ, ধর্ম হিসাবে শিল্পচেতনা বিষয়ক দর্শন তথা শিল্পকে মানবতার একমাত্র মুক্তিদাতা হিসাবে গ্রহণের ধারণা বিকাশে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে। রাশিয়ান জনগণের জীবন কবিকে গভীরভাবে অনুপ্রাণিত করে, যাদেরকে কবি অন্যান্য ইউরোপীয়দের তুলনায় বেশি ভক্তিপূর্ণ আধ্যাত্মিক বলে মনে করতেন।
রিলকে যখনই ঈশ্বর সম্পর্কে লেখেন, তিনি প্রথাগত অর্থে দেবতাকে উল্লেখ করেননি; বরং ঈশ্বর বলতে তিনি জীবনী শক্তি বা প্রকৃতি বা একটি সর্ব-মূর্ত, সর্বৈশ্বরবাদী চেতনা বোঝাতে চেয়েছেন। তবে রিলকে ঈশ্বরের অস্তিত্বকে অস্বীকার করেননি; জীবনের প্রকৃতি সম্পর্কে সমস্ত সম্ভাবনাকে সমান বিবেচনা করার বিষয়ে জোর দিয়েছেন কেবল।
পরবর্তীতে রিলকে তাঁর কবিতাকে বাস্তবে স্থাপিত করেছেন আরো সুদৃঢ়ভাবে । ক্রমশঃ কবির পদগুলি অধিকতর বস্তুনিষ্ঠ হয়ে ওঠে এবং একটি প্রভাববাদী, ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গি থেকে মুক্ত হয়ে নৈর্ব্যক্তিক প্রতীকবাদের ধারায় প্রতিনিধিত্ব করে। দৈনন্দিন জীবনের মূর্ত পরিপার্শ্ব বর্ণনায় তিনি একটি সহজ শব্দসম্ভার বেছে নিয়েছেন। রিলকে বৌদ্ধিক আভাসের পরিবর্তে মূর্তিমান চিহ্ন দিয়ে নিজেকে প্রকাশ করতে চেষ্টা করেছেন। শেক্সপিয়রের সাথে তুলনা করলে বলা যায় যে, শেক্সপিয়র যখন মানুষের পরিপ্রেক্ষিতে অ-মানবীয় জগতের কথা চিন্তা করেছেন, তখন রিলকে অ-মানবতার পরিসরে মানুষের কথাই ভেবেছেন।
গুটিকয়েক কবিতার মধ্য দিয়ে রিলকের মতো মহান কবিকে তুলে ধরা অসম্ভব। রিলকের কবিতা পাঠের সুযোগ যাঁদের হয়নি তাঁদের জন্য এ এক আভাস মাত্র। উপরন্তু এ কবিতাগুলো মূল জার্মান থেকে ইংরেজী অনুবাদের অনুবাদ। তবে ভাষান্তরকালে কবিতার ছন্দ, অন্তমিল, প্রান্তমিল, ভাব ও সুর এবং শব্দের মেজাজ যথাসম্ভব অনুসরণের চেষ্টা করা হয়েছে। রিলকের আলোকরশ্মির সামান্য আভাসও পাঠকের ভাল লাগার জন্য যথেষ্ট হতে পারে।
জীবনের মানে বুঝতে যেও না তুমি
জীবনের মানে বুঝতে যেও না তুমি,
তবেই জীবন ভরে যাবে উৎসবে ।
বয়ে যেতে দাও তাকে জীবনের মত
যেমন শিশুরা হেঁটে যায় ভুলে ক্ষত
কুড়ায় ফুলের উপহার বৈভবে ।
সে ফুল কখনো করে না সে সঞ্চয়,
কখনো ভাবে না সেসব নিজের ধন।
ঝরে চুল হতে খুলে গেলে বন্ধন,
গেঁথেছিল যেথা কত আনন্দময়,
আর সময়ের তরুণী প্রণয়ী হাত
খোঁজে নতুনের উষ্ণ আলিঙ্গন।
মৃত্যু
মহান মৃত্যু এসে আমাদের সম্মুখে দাঁড়ায়
আমাদের ভাগ্য তার শান্ত হাতে ধরে রাখা নিবিড় বাঁধায়।
সগর্ব আনন্দ নিয়ে যখন ওঠাই আমরা জীবনের গাঢ় লাল সুরা
গভীর পানের তরে উজ্জ্বল পেয়ালাটিকে কুহেলিতে ভরা
এবং আনন্দরাশি নেচে ওঠে আমাদের সত্ত্বার ভিতরে –
মৃত্যু কেঁদে ওঠে আর মাথা নিচু করে ।
শরতের দিন
এইতো সময়, প্রভু । সুদীর্ঘ গ্রীষ্ম হলো গত।
তোমার নিবিড় ছায়া মেলে দাও সূর্য-ঘড়ি পরে
চারণভূমির মাঝে ছোটাও বাতাস অবিরত।
পরিপক্ক করে তোল ফলরাজি কুঞ্জবন মাঝে;
আরো দুটো উষ্ণ দিন ওদেরকে দাও উপহার
যেন তারা পূর্ণ হয় মধুরসে কানায় কানায়
চূড়ান্ত মিষ্টতা ভরা তীব্রতম মদমত্ত ঝাঁঝে।
যার কোন গৃহ নেই, এ বেলায় বাঁধবে না ঘর
যে ছিল একাকী সেতো নিভৃতেই রয়ে যাবে দূরে,
জেগে ওঠা, পুঁথিপাঠ, লিখবে সুদীর্ঘ কোন চিঠি,
ঊষর পথের মাঝে লক্ষ্যহীন যাওয়া আসা শুধু
যখন ঝরানো পাতা উড়ে গিয়ে জাগাবে মর্মর।
হাঁটা
আমার নয়ন ছুঁয়ে ছুঁয়ে যায় রৌদ্রে নিকানো ঐ পর্বতটিকে।
ছাড়িয়ে সে পথে অনেক দূরের যেই পথে আমি করেছি চলার শুরু।
এভাবে আমরা ধরা পড়ে যাই তার কাছে যাকে ধরতে পারি না আজো;
অন্তর্লীন আলো আছে তার, এমনকি এক সুদূর তফাৎ হতে –
প্রদীপ্ত করে আমাদের গেহ, এমনকি যদি নাও যাই তার কাছে,
আরেক আবহে, যেটি, আমাদের বোধের অতীতে প্রায়,
হয়েছি আমরা এরই মাঝে, এক মুদ্রা-ভঙ্গিমা তরঙ্গে নাচায়
আমাদের একান্ততর তরঙ্গের প্রত্যুত্তরে…………….
অথচ যা কিছু করি অনুভব সে এক সমীর মাত্র আমাদের মুখের উপরে।
এপ্রিলে
বনভূমি সুবাসিত হয়েছে আবার, চাতক পাখিটি তার
উড্ডীন ডানায় তুলে ধরে সেই স্বর্গ ধূসরতা
যা ছিল ঝুলন্ত সব বৃক্ষের চূড়ায়, অবগুণ্ঠিত আর অন্ধকার,
যেখানে নগ্ন শাখা উন্মোচিত করেছিল দিনের শূন্যতা।
সুদীর্ঘ বৃষ্টিঝরা বিকেলের পরে আসে একটি সময়
তার সোনালী আলোর ফলা সাথে নিয়ে আর দেয় ছুঁড়ে
তাদেরকে জানালাগুলোর দিকে প্রদীপ্ত ঝরনায়,
এবং বৃষ্টির ফোঁটা অস্থির পাখার মতো শার্সির উপর ভেঙ্গে পড়ে ।
তারপর শান্ত সবই। শিলাগুলো ঘুমে পড়ে ঢলে
বৃষ্টির মৃদুল শব্দে ধীরে ধীরে যারা মরে যায়;
আর প্রতিটি উজ্জ্বল কুঁড়ি মাঝে গভীর গোপনে, দুলে দুলে
শাখার দোলনায়, এক ঘুমপাড়ানিয়া নীরবতা শুয়ে রয়।
কনে
আমাকে ডাকো, হে প্রিয়! ডাক দাও মোরে উচ্চস্বরে!
নববধূ জানালায় জেগে আছে দুচোখ বিছিয়ে;
আঁধারে মিলায় সন্ধ্যা, নিষ্প্রভতা হামাগুড়ি দিয়ে
নেমে আসে পুরোনো প্লেইন-গাছের রিক্ত গলি ঘিরে।
আহা! কন্ঠ তব ঘিরুক আমাকে ঘন নিবিড় বাঁধনে,
অথবা দূরের এই গৃহ থেকে,একাকী আঁধার,
গভীর সুনীল সব বাগানের মাঝ দিয়ে ভাসে যেথা ছায়ারা ধূসর
ঢেলে দেবো প্রাণ মোর মেলে ধরা দু’হাতের সনে …
নির্জনতা
নির্জনতা যেন এক বৃষ্টির মতোন
গোধুলি বেলায় ওঠা শুরু করে সমুদ্রের থেকে;
ভেসে যায় ওই দূরে পেরিয়ে দূরের সমাঙ্গন
নিজস্ব আবাসে তার ঊর্ধ্বপানে, আকাশের দিকে,
পুনরায় শহরের ’পরে ধীরে নেমে এসে ঘনায় তখন।
বৃষ্টির মতই মৃদু ঝরে সেই আবছা প্রহরে
যখন ভূতুড়ে গলি বাঁক নেয় ছায়াময় সকালের দিকে
যখন শরীরগুলো মাপা হয় পরিতৃপ্ত আবেগের জোরে
দুঃখভরা, মনঃক্ষুন্ন একে অপরের পক্ষ থেকে;
যখন মানুষ গুলো পোড়ে খুব নিথর ঘৃণায়
একসাথে নিদ্রা যেতে হবে ঐ একই বিছানায় —
প্রভাতের প্রেতময় ধূসররাভ ছায়ার ভেতরে
চেয়ে দেখ! নির্জনতা ভেসে যায় নদীর তিমিরে….