নদীর প্রতি
১.
সারা দুপুর
তোমার কিনারে ঘুরে বেড়াই।
জানি না, কোথা থেকে আসছো তুমি,
কোন্ মিলনমুখে এই বয়ে-যাওয়া, জানি না ;
কতখানি গভীরতা তোমার, জানি না তাও ।
তোমার বুক থেকে উদ্গত এই ঢেউ
আন্দোলিত করে আমায় ,
ভালো লাগে মাছের চঞ্চল মুদ্রার মত এই উচ্ছলতা।
অঞ্জলিতে ভ’রে নিলে জল
সে ঢেউ কোথায় অদৃশ্য হয়
ভেবে কৌতূহল জাগে !
সারা দুপুর
বসে থাকি তোমার উষ্ণ বালুতটে।
ওপর থেকে তার সরালে একটি স্তর
উঠে আসে শীতল স্পর্শ,
যে শীতলতা তুমি বিছিয়ে রাখো ঢেউয়ে ঢেউয়ে …
সারা দুপুর
বালিতে পড়ে-থাকা ঝিনুক নিয়ে খেলতে থাকি।
যতবারই লিখে দিই বালির বুকে নাম
গভীর গভীরতর
অবাক হয়ে দেখি কী নিপুণতায়
আমার সমস্ত রচনা ধীরে ধীরে মুছে যায় !
সন্ধ্যা নামে চুপিসারে
তোমার কিনারে কেউ ঘুরে বেড়িয়েছিল,
বসেছিল উষ্ণ বালুতটে,
খেলায় মত্ত ছিল ঝিনুকের সাথে কিংবা
দেখেছে সে নিজস্ব রচনার অবাক মুছে-যাওয়া
তুমি কি জানো এই এইসব —
না জেনেই আজ ফিরে যাই।
২.
অঞ্জলিতে ভ’রতে পারি যতটুকু জল
হে নদী, আমার কাছে তুমি ততটুকুই।
সেটুকুতেই শান্ত করি আমার তৃষ্ণাকে,
আমার ভিতরে প্রতিদিন যে-সূর্যোদয়
সেটুকুতেই অর্পণ করি অর্ঘ্য আমার।
আর প্রতিবারই এই নিবেদিত অঞ্জলি
স্পর্শ করলে চোখে, মাথায়
অনুভব করি তোমায় —
আমার ভিতরে তুমি
অবিরাম বহে যাচ্ছো।
৩.
এই একান্তে
নগ্ন হয়ে
তোমার কল্লোলিত জলে
ঝাঁপ দেবো।
নির্মল দেহ
হয়ে উঠবে আরও নির্মল।
তারপর আমরা দুজন
একে অপরকে ছেড়ে চলে যাবো, দূরে।
ধূলো
১.
তুমি ধূলো —
পায়ের পাতায় লেপ্টেথাকা ধূলো।
ওঠো, এই অস্থির হাওয়ার সাথে ওঠো
আঁধি হয়ে যাও
তার চোখে গিয়ে পড়ো,
যার পায়ে লেপ্টে আছো তুমি।
এমন কোনো জায়গাই নেই
যেখানে তুমি পৌঁছতে পারো না,
তোমাকে আটকে দেয়
নেই এমনও কেউ।
তুমি ধূলো
পায়ের পাতায় লেপ্টেথাকা ধূলো
তুমি ধূলোয় মিশে যাও।
২.
তুমি ধূলো
জীবনের এই আদ্রতায়
স্যাঁতসেতে আবহে তুমি
উই হয়ে যাও।
রাতারাতি
শতাব্দীপ্রাচীন
বন্ধ এই দেওয়ালের
দরজায়
জানলায়
এমনকি ঘুলঘুলিতেও
ছড়িয়ে যাও।
তুমি ধূলো
জীবনের এই আদ্রতায় জন্ম নাও
উই হও, ছড়িয়ে পড়ো।
একবার রাস্তা চিনে গেলে
তোমাকে শেষ করতে পারবে না কেউ !
আমি চাই না
পচা ফলের ঝুড়ির মত
বাজারে ভিড়ের মধ্যে মরার চেয়ে
কোনো নিঃসঙ্গ গাছের নিচে একান্তে
ঝরে শুকিয়ে যাওয়া ঢের ভালো।
আমি চাই না আমাকে
ঝেড়েমুছে সাজানো হোক দোকানে,
সারাদিন মাপার পর
আবার রেখে দিক ঝুড়িতে ;
আর, এক ক্রেতা থেকে
আরেক ক্রেতার প্রতীক্ষায় থেকে থেকে
এ জীবন অর্থহীন হয়ে যাক।
পিছিয়ে থাকা লোক
সবাই যখন বলত
সে চুপ করে থাকত,
সবাই চলত যখন
পিছিয়ে পড়ত সে,
খাবার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ত যখন সবাই
পৃথক বসে সে খুঁটে খুঁটে খেত।
সবাই ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ত যখন
শূন্যে অপলক তাকিয়ে থাকত সে।
অথচ, গুলি যখন চলল
সব্বার আগে
সে-ই মারা গেল !
পোস্টমর্টেম রিপোর্ট
গুলি খেয়ে
একজনের মুখ থেকে বেরল
‘রাম’
দ্বিতীয় জনের মুখ থেকে
‘মাও’
কিন্তু তৃতীয় জনের
‘আলু’
পোস্টমর্টেমের রিপোর্ট :
প্রথম দু’জনের পেট
ভরা ছিল।
অবশেষে
কিছু আর বলতে চাই না,
যদি কোথাও থাকে
একটি সত্য সুন্দর শব্দ
আমি তা-ই শুনতে চাই।
নতুবা
এর আগে
আমার বলা যত কথা
যত মন্থন
যত অভিব্যক্তি
শূন্য হতে আবার ফিরে আসুক,
সেই অনন্ত স্তব্ধতায় আমি ডুবে যেতে চাই
যা কেবলই মৃত্যু।
‘মৃত্যুর আগে সে
কিছু বলতে চেয়েছিল
যা কেউই শোনেনি’
তা বলার চেয়েও
অনেক বেশি গৌরবের
‘কিছু না বলেই সে চলে গেল।’
[উত্তর প্রদেশের বস্তী জেলার এক গ্রামে জন্ম আধুনিক হিন্দি কবিতার অতি পরিচিত কবি সর্বেশ্বরদয়াল সাক্সেনা-র, ১৯২৭ সালের ১৫ই সেপ্টেম্বর। ‘কাঠ কী ঘন্টিয়া’, ‘বাঁস কা পুল’, ‘এক সুনী নাও’, ‘গর্ম হবায়েঁ”, ‘কুয়ানো নদী’ প্রভৃতি তাঁর উল্লেখযোগ্য কয়েকটি কাব্যগ্রন্থ।’খুঁটিয়ো পর টঙ্গে লোগ’ কাব্যগ্রন্থের জন্য কবি সর্বেশ্বরদয়াল সাক্সেনা-কে ১৯৮৩ সালে সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কারে সম্মানিত করা হয়। কবিতা ছাড়াও আলোচনা এবং নাটক রচনাও করেছেন। প্রকৃতি এবং মানবিক সম্পর্কের গলিঘুঁজি ছিল তাঁর কবিতার উপাদান। ১৯৮৩ সালের ২৩শে সেপ্টেম্বর কবি সর্বেশ্বরদয়াল সাক্সেনা প্রয়াত হন। ]