Home » শিশির আজমের একগুচ্ছ কবিতা

শিশির আজমের একগুচ্ছ কবিতা

বিস্ময়কর হলেও সত্যি যে কৃমিকীট ও ইস্পাতের মধ্যে সম্পর্ক থেকেই

আমরা প্রত্যেকে পেয়েছি পাসপোর্ট।

বসের টেবিল অলঙ্ঘনীয় সত্যি —

                     ঐ টেবিলের আয়নায়

                     প্রতি সকালে

                     প্রতিটি প্রাণির জন্য

                     সূচীবদ্ধ হয় অবশ্যকীয় জীবনপ্রণালী,

                     সমস্ত প্রশ্ন থেকেই তাকে রেহাই দেওয়া হয়েছে।

                     কাঠের বদলে প্লাস্টিক

                     প্লাস্টিকের বদলে কাঁচ,

                     এভাবে বিভিন্ন মাধ্যমে প্রদর্শিত হয় তার মুন্ডু

                     এবং মুন্ডুর ভিতরের সুতোগুলো ব্যাস্ত হতে গিয়ে

                     কোনভাবেই যেন জট পাকিয়ে না যায়

                     তার জন্য উদ্বিঘ্ন সবাই,

                     স্বনামধন্য লেখক

                     কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর

                     বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক

                     প্রাক্তন কম্যুনিস্ট নেতা।

বইয়ের কথা হয় তো সত্যি। কিন্তু কোন কোন আকাশ তো অশুদ্ধতা চেয়েছে!

মাটির নিচের একটা ইঁদুর

দেবদূতের মতো আবির্ভূত হয়েছে এক সকালে

আর বানিয়ে বানিয়ে

গল্প শুনিয়েছে আমাদের।

সবকিছুই হয় তো ঠিক।

পৃথিবীর উৎসমুখে ছিল আমার যন্ত্রণা,

আগুন কিংবা সমুদ্র

জানি না কেউ তাকে মুছে ফেলতে পেরেছে কি না।

কিন্তু ঘুণপোকার বিষয়ে যেহেতু কোন বৈজ্ঞানিক থিসিস

আজও লেখা হয়নি

সেজন্য দীর্ঘ জীবন পাওয়া গাছের গুড়ি থেকে তৈরি কাঠ

বিদ্যুৎ চালিত সেবাসামগ্রী

সস্তায় কেনা কোটের বোতাম

এই যে নির্দিষ্ট সব জায়গায় অবস্থান নিয়েছে ঘুণপোকারা,

এরা কোথায় পৌছাতে চায়

কোন্ অতিন্দ্রীয়লোকে?

জেনে রাখা ভাল

রক্ত বা জীবাণু বা মটরশুঁটি

এদের একটাই মানচিত্র।

না হয় আমি কফির ধোঁয়া,

না হয় বিবর্ণ পৃথিবীর ছত্রাক

কামড়ে ধরেছে আমার অসুস্থ আঙুলটাকে!

সেই মুহূর্ত ও সত্ত্বার অভিন্নতায় পেঁচার পাকস্থলি

ভরে গিয়েছিল উগ্র সব পাথরে

                       প্রান্তিক নিরবতা নিজেই নিজের শত্রু হয়ে উঠতে চায়

                       কে জানে কতভাবে দেকা হবে অন্ধত্বকে

                       কল্পনা ও সাহসীকতার মাঝে অবৈধ লালন

                       ধানমাড়াইয়ের নৃত্যাঞ্জলি

আসবাবপত্র আর ভাবনার গ্রন্থিতে পূজো না পাওয়া প্রজনন

স্বাভাবিকতাকে আক্রমণ করে

পেঁচা নির্দ্বিধায় পান করে চিন্তাহীনের খন্ডিত সময়

যা হজমের অনুপযুক্ত

                       পেঁচার নসিবে নেই পায়রার পুচ্ছের অহমিকা

                       পর্বতের নির্জন কোষের কটাক্ষ

                       তবে দরবেশের পায়ে চলা পথে

                       ঈশ্বর কোথাও না কোথাও অপেক্ষা করেন

পেঁচা কি না খায়

প্রাচীন মৃতের চক্র সহোদর পাথরগুলোকে দেখিয়ে দিয়েছিল উজ্জ্বল

আত্মাসমূহের কোলাহল

করোটি-ওড়া ওজন স্তরের দুর্গম কোলাহল পেরিয়ে

আমি এক মুহূর্ত থামি

তোমার ঠোঁটে

উদ্ভাসিত কৃষ্ণগহ্বরে

প্রেমিক আত্মার কী কী খোয়া গেছে

তার তালিকা

তৈরি হয়নি

— তুমি কি শুকপাখি?

— না, আমি আগুন।

— কীভাবে জানলে?

— যেহেতু সমুদ্র আমার মা। যার পূর্বপুরুষ এসেছিলেন মেঘপরী হতে।

— তাহলে তো তুমি আগুন নও।

— ঠিকই বলেছ। সিংহের কেশর আমাকে ঢেকে রেখেছে।

— কিন্তু গণিত তোমার স্বতন্ত্র অস্তিত্ব স্বীকার করেনি। লেখক তোমাকে নিয়ে বিচার-বিশ্লেষণের সময় গণিতের সূত্র অগ্রাহ্য করে। ভুল করে আত্মজীবনী লেখে, অন্ধ বাউলের অসীম ক্ষত্রফল সম্মন্ধে ন্যূনতম ধারণা না নিয়েই।

— আমাকে ওরা আশ্চর্যজনক এই বস্তুজগৎ থেকে আলাদা করতে পারেনি।

— তুমি কি বলতে চাও যে বস্তুর ধর্ম তোমার ভিতরে রয়েছে?

— হ্যা, বস্তুর চেয়ে বেশি।

— বেশিটা কী, বুঝিয়ে বলবে?

— বস্তর ধর্ম আছে, আবার অধর্মও আছে। সে কারণে রাসায়নিক বিক্রিয়ায় অংশ নিতে বিচ্ছিন্ন বস্তুরাশিকে সমন্বিত করি, উদ্বুদ্ধ করি, নিজে অংশ নিই।

— অর্থাৎ তুমি ঘুমিয়ে সময় নষ্ট করো না। বিক্ষুব্ধ দাঁতের চতুর্মুখী বিস্তারের সমস্যা বিভিন্ন স্তরে যেন আশীর্বাদ নিয়ে এসেছে।

— আমি যখন ঘুমাই, তখনও আমি জেগে থাকি। নভেরার গল্প শোনার পর হতেই ক্রিমিকীটগুলো সংখ্যায় বাড়ছিল, জমাট উপত্যকায় ফাটলের ঘন্টা।

— তাহলে মানুষের সঙ্গে তোমার সম্পর্ক কী?

— ভারি পাথরগুলো পাহাড় থেকে লোকালয়ে আছড়ে পড়ে; অন্যান্য ফাটাচেরা মুন্ডুসমগ্রের ভিতর আমারটাও পাওয়া যাবে হয় তো। আমার গান সবার চেনা। তবে সামর্থ্যের কথা বললে ক্ষমা ব্যাপারটা বিবেচনায় আসতে পারে, আর মার্কসকেও অনর্থক দোষী করতে হয় না।

— অর্থাৎ ব্যাপারটা এই দাঁড়াচ্ছে যে তুমি মানুষ।

— হ্যা, মানুষ ও বস্তুপৃথিবী। ঈগলু সাময়িক। আমি আদৌ কোন এস্কিমো নই।

— আচ্ছা বস্তুপৃথিবী ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলো তো।

— অবশ্যই। শুকপাখি তো জটিল কোন চর্চার বিষয় না।

দূর থেকে

               প্রথমে মনে হয়েছিল বাগানের নিষ্কলঙ্ক গোলাপ

               কমনীয় কোমল গোলাপ

               দু’টি

               পাশাপাশি

               সমান্তরাল

               তারপর মনে হল শালিখ

               উড়তে উন্মুখ জোড়া শালিখ

               তারও পর মেধাবী পর্বতচূড়া

               জোড়া পর্বতচূড়া যেন সূর্যের দিকে ধাবমান

কাছে এসে

               অনুভব করছি দু’টি সত্যিকার সূর্য

               অমায়িক

               আমাকে ভষ্ম করে

               আমাকে

               দ্বিতীয় জন্ম দেবে

কাছে

হ্যা, এই যে তুমি

এতো কাছে।

তোমার দরজা, নতুন-পুরনো

সমস্ত দরজা

খোলা। কোন্ দিকে

যাবো? নক্ষত্রের

গুঞ্জন ওদিকে। পাশে

পোড়ো দেয়ালের

শেওলা। এদিকে নেকড়ের ক্ষুধা,

শেষ নেই।

কেন নেই? যদি

নিজেকে নিঃশেষ করে দিতে

পারতাম, যদি

সত্যি

তোমাকে পেতাম! আরো বেশি,

সম্পূর্ণ। কীভাবে?

দূরে

তুমি। কেন দূরে?

প্রকৃতির এ এক অন্যায়।

প্রতিটি নিঃশ্বাস, রক্তকণা

তোমাকে ডাকছে।

কেবল যন্ত্রণা। তবু

দূরে থেকে একটাই স্বস্তি —

আমার বুকের

এইখানে, শুধুমাত্র এ-জায়গাটায়,

যেখানে রয়েছে

হৃদয় — তোমাকে

পাই,

পরিশুদ্ধতায়।

শিশির আজম

জন্ম : ২৭ অক্টোবর, ১৯৭৮, এলাংগী, কোটচাঁদপুর, ঝিনাইদহ, বাংলাদেশ

বাংলা কবিতায় Tea Poetry Movement এর উশকানিদাতা

কাব্যগ্রন্থসমূহ : ছাই (২০০৫), দেয়ালে লেখা কবিতা (২০০৮), রাস্তার জোনাকি (২০১৩), ইবলিস (২০১৭), চুপ (২০১৭), মারাঠা মুনমুন আগরবাতি (২০১৮), মাতাহারি (২০২০), টি পোয়েট্রি (২০২০), সরকারি কবিতা (২০২১), হংকঙের মেয়েরা (২০২২), আগুন (২০২৪), চা কফি আর জেনারেল কানেকটিভিটি (২০২৪), সন্ধ্যায় তিমিমাছ (২০২৫)

প্রবন্ধ : কবির কুয়াশা (২০২৫)

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ভাষা
Scroll to Top