Home » মাই ডিভাইন জার্নি : ছয় ।। মূর্শেদূল কাইয়ুম মেরাজ

মাই ডিভাইন জার্নি : ছয় ।। মূর্শেদূল কাইয়ুম মেরাজ

‘সোনার মানুষ ভাসছে রসে’
কথায় কথায় লাশ ফেলে দেয়ার রাজনীতি তখনো শুরু হয়নি। তখন ছিল শক্তি প্রদর্শনের মহড়া। এই যেমন এক মহল্লার ছেলেপেলে আরেক মহল্লায় হামলা করে আসলো। কিছু দোকানপাট ভাংচুর হলো, কারো কারো বাড়ির দরজায় আঘাত করা হলো। হাতের কাছে পেয়ে দুই একজনকে চড়-থাপ্পড়। আর মনে মনে পছন্দের নারীটি যে বাড়িতে থাকে সেই বাড়ির সামনে একটু বাহাদুরি দেখিয়ে আসা। এই পর্যন্তই।

এই ধারা জনপ্রিয় হতে শুরু করলে লাঠিসোঠার সাথে যুক্ত হতে শুরু করলো মারাণাস্ত্র। অবশ্য প্রথমে এসব মারণাস্ত্র শুধু প্রদর্শনের জন্যই রাখা হতো। বিষয়টা এমন ছিল যে, আজ ওরা হামলা করলে কাল এরা হামলা করবে। তারই ধারাবাহিকতায় নিয়মমেনে বিচার বসতো; তারপর মিটমাট। সম্ভবত মাদকের সহজলভ্য হয়নি বলেই সেইসময় মারামারি-কাটাকাটি এক লিটারের কাঁচের বোতলের কোক-সেভেন আপেই মিটে যেত। আর ফান্টা মেরিন্ডা হলে তো কথাই নাই।

সময়টা এমন ছিল যে, অস্ত্রশস্ত্র প্রভাবশালীদের হাত গলে পাড়ার বড়ভাইদের কাছে চলে আসলেও সেগুলো চালানোর মতো সুযোগ তখনো তৈরি হয়নি। অস্ত্র আছে শুনলেই লোকে ভয় পেতো। সেসবের চেহারাও দেখাতে হতো না। যেহেতু ব্যবহার নেই তাই সেগুলো ঠিকঠাক আছে নাকি বিকল হয়ে গেছে তা বোঝারও কোনো উপায় থাকতো না। একটু বড় হবার পর টের পেতে শুরু করলাম বিষয়টা তেমন না। এইসব অস্ত্র চালানোর জন্য সবকিছু ঠিকঠাক আছে কিনা তার পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্যও দিনক্ষণ নির্দিষ্ট আছে। তার মধ্যে ছিল শবেবরাত, সাকরাইন ও ১৫ ডিসেম্বরের রাত। কারণ এই তিন দিনই পুরান ঢাকার পাড়া-মহল্লায় প্রচুর পটকা ফাটাতো উঠতি বয়সীরা। আজকের মতো এতো আতশবাজি না হলেও বড়দের কান ঝালাপালা না হওয়া পর্যন্ত তা থামতো না কিছুতেই।

সাকরাইনের আয়োজনটায় প্রায় সন্ধ্যার পরপরই শেষ হয়ে যেত বলে এই তিনদিনের মধ্যে এর গুরুত্ব একটু কমই ছিল। অন্যদিকে ১৫ ডিসেম্বর আর শবেবরাতের আয়োজন চলতো রাতব্যাপী। বছরে এই কয়টা দিনই আমরা নিজেদের মতো করে বড় হয়ে উঠতে পারতাম। সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত হয়ে এলেও বাড়ির বাইরে থাকার অনুমতি মিলতো। অবশ্য বয়সের উপর নির্ভর করত কে কতটা রাত অবদি বাড়ির বাইরে থাকতে পারবে। সেই এক একটা রাত ছিল এক একটা বিশ্বজয়ের ইতিহাস।

এই বিশেষ দিনগুলোতে পাড়ার লুকিয়ে থাকা অস্ত্রগুলো প্রকাশ্যে চলে আসতো। মহল্লার প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গের বাড়ির ছাদে বা প্রভাবশালী ব্যক্তির দখলকরা ভবনের ছাদে সেইসব অস্ত্র চালানোর মহড়া চলতো। এক মহল্লা টের পেত অন্য মহল্লার কাছে কি কি অস্ত্র আছে। কার শক্তি কতটা তা আকাশের দিকে গুলি ছুঁড়ে শব্দ করে জানান দেয়া হতো। অনেকটা টারজান সিনেমার শিমপাঞ্জীর বুক চাপড়ে জানান দেয়ার মতোই।

সেই বিশেষ ছাদগুলো ঘিরে কয়েকদিন ধরেই নানাগল্প ছড়িয়ে পরতো তরুণদের মাঝে। কি কি অস্ত্র আসছে, কার কাছে কি কি অস্ত্র আছে, কার মামাবাড়ির মহল্লায়-দাদাবাড়ির মহল্লায় কি অস্ত্র দেখেছে সেসব গালগল্প ঘুরতো মুখে মুখে। পাড়ার গুলবাজরা নানান গল্প ফেঁদে নতুনদের চোখমুখে জ্বলজ্বলে ভাব নিয়ে আসতো। তারপর সেই মাহেন্দ্রক্ষণ উপস্থিত হলে সকলে পাটভাঙ্গা পোষাক পরে যে যার ভাব নিয়ে চলে আসতো এক এক করে। বড় ভাইরা গোঁফে তা দিয়ে ঘুরে বেড়াত যার যার সীমানায়।

সেই বিশেষ বাড়ির ছাদে সকলের প্রবেশাধিকার ছিল না। পাড়ার ক্ষমতাধরেরা সেই বাড়ির নিচে আড্ডা জমাতো। তাদের গরম চোখের তরল আড্ডাকে টপকে যারা সেখানে যাওয়ার হিম্মত রাখতো তারাই পরবর্তী দিনগুলোতে বুক ফুলিয়ে পাড়ায় ঘুরে বেড়াতে পারতো। যথেষ্ট পরিমাণ হিম্মত লাগতো এই কাজ করতে তা বলতে বাঁধা নেই। কারণ যারা চেয়ার লাগিয়ে বসে থাকতো তাদেরকে অবজ্ঞা করার কোনো সুযোগ নেই। হয়তো সেই লোকগুলোর সাথেই বাবা-ভাই-মামা-চাচার বন্ধুত্ব রয়েছে অথবা বাবা-ভাই-মামা-চাচারাই সেখানে বসে আছে।

এতোসব বাঁধা পেরিয়ে রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে সেই ছাদে যারা যেতে পারতো তাদেরকে অকুতভয় বীর বলেই ধরে নেয়া হতো। গোধুলী মিশে যাওয়ার আগেই শুরু হতো অস্ত্র চালানো, তবে বেশিভাগই ব্যবহার না করার কারণে ত্রুটি থাকতো। এরজন অবশ্য বুড়িগঙ্গা নদীর ওপার থেকে কারিগর ভাড়া করে আনা হতো। আজব স্ট্যাইলের পোষাক পরে তালাচাবিওয়ালার মতো যন্ত্রপাতি নিয়ে সেই সব কারিগরেরা আসতো। হিন্দি সিনেমার খলনায়কদের মতো চুল কাটা উদ্ভট রঙের পোষাক পরা এইসব কারিগরেরা অস্ত্রপাতিতে ত্রুটি দেখা দিলেই তৎক্ষণাৎ ঠিকঠাক করতে বসে যেত।

বড় ভাইয়েরা যাদের হাতে অস্ত্র তুলে দিতো তাদের আনন্দের সীমা থাকতো না। মাটিতে পা পরতো না। তাদের সালাম না দিলে মাথায় নির্ঘাৎ চাটি খেতে হতো সেই রেশ না কাটা পর্যন্ত। পাড়ায় যারা একটু বড় হয়ে উঠছে বা বড়ভাইদের সাথে যাদের সম্পর্ক ভালো তাদের সুযোগ দেয়া হতো। ফলে প্রতিবারই নতুনরা নাম লেখাতো এই অলিখিত খাতায়। সকল বাঁধা পেরিয়ে যারা সফলভাবে গুলি চালিয়ে নিজেকে প্রমাণ করতে পারতো তারা ঘটনা ঘটে যাওয়ার মাসখানেক পরেও মাটিতে পা দিতো না। বুক ফুলিয়ে শূন্যের মাঝেই থাকতো। এই সকল আনুষ্ঠানিকতা ঘটে যেতো রাত নয়টা-দশটার মধ্যেই। এরপরে আর সেই ছাদে নতুনরা যেতে পারতো না; সেটা হয়ে যেত সংরক্ষিত। কেবল বড়দের জন্য। যাক সে কথা।

ঝাঁ ঝকঝকে আনন্দপ্রীতি মজা নিয়ে অনুষ্ঠানপর্ব শুরু হলেও শেষপর্যন্ত তা টিকে থাকতো না। শেষটা প্রায় প্রতিবছরই মারামারি-হামলা-দৌঁড়াদৌঁড়ি বা কোনো অনাকাঙ্খিত ঘটনা দিয়েই শেষ হতো। অস্ত্র হাতে হঠাৎ করে একরাতে যতটা বড় হয়ে যাওয়া যায়, তার গরমটা ধরে রাখা চাট্টিখানা কথা নয়। অবশ্য এসব কিছুই অপরিকল্পিত বা ছেলেমানুষি ছিল না। এর পেছনে ছিল রাজনীতির গোপন চাবিকাঠি। একসময় সয়ম্বর সভা আয়োজন করে যেমন রাজকন্যা তার বর পছন্দ করতো। এই রাতগুলোতেও সেইভাবেই ভবিষ্যত সন্ত্রাসী চিহ্নিত করা হতো সকলের অগোচরে। অদৃশ্য সুতাটা টুঁটিতে লাগামের মতো পরিয়ে দেয়া হতো। বেশিভাগই আর সেই সুতা কেটে বেরুতে পারতো না।

এভাবেই বিজয় দিবস আসার আগেই পরাধীনতার অন্ধকারে ঢাকা পরে যেতে তরুণ প্রজন্মের স্বপ্ন। এখন অবশ্য সেই সব হয় কিনা জানি না। এখন তো পাশাপাশি ফ্ল্যাটের খবরই রাখা হয় না। এতো গভীরে কি করে ডুব দিবো। সেই সব চলে যাওয়া দিন যে স্বর্ণালী সময় ছিল, এমন তো নয়। কিন্তু একটা অদ্ভূত নষ্টালজিয়া কাজ করে সেই সব ভাবলে। মানুষগুলো কি করে ব্যক্তিগত জীবনে ঢুকে পরতো। অথচ সেটাকে অসভ্যতার মধ্যে ফেলা কঠিন কারণ একটা পারস্পরিক বোঝাপরা ছিল কোথাও। সবাই সবাইকে চেনে জানে। যে ফেরিওয়ালাটা ফেরি করে পাড়ায় পাড়ায় এটা-সেটা বিক্রি করতো সেও আমাদের শাসন করার ক্ষমতা রাখতো। পাড়ার মুচিকেও মুরব্বি বলে সকলে সমীহ করতো। সন্ধ্যার যে আড্ডাটা বসতো পাড়ার লন্ড্রিটার সামনে সেখানে কেটলিতে করে যে চা আনা হতো, সেটার ভাগ সেখানে আড্ডা দেয়া ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব যেমন পেতেন। ঠিক পাশে বসা ফুটপাথের দোকানিটাও পেতেন। এমনকি সকালে যে ছেলেটা হকারি করে পত্রিকা দিতো সেও পেত। যে হিজড়েরা দুই হাত বাজিয়ে তালি দিয়ে বিরক্ত করে টাকা তুলতো তারাও ঠিক বন্ধুর মতোই সেই আড্ডায় বসে সুখ-দু:খের কথা বলতো।

অভাব ছিল অসুস্থ্যতাও ছিল কিন্তু সেসব নিয়ে সর্বক্ষণ কেউ ব্যস্ত থাকতো না। এখনকার মতো তাড়াহুড়ো ছিল না মোটেই। একজন পত্রিকা পড়লে সকলে গোল হয়ে বসে শুনতো। বিবিসিতে কি খবর বলেছে তা নিয়ে ম্যারাথন আড্ডা চলতো। সকলেই সময় করে দুপুরে বাংলা সিনেমার বিজ্ঞাপন শুনতো রেডিওতে। অফিস শেষে বা দোকান বন্ধ করে বাড়ি ফিরে যাওয়ার সময় সুখ-দু:খ বিনিময় করতো। হুট করে বাড়ি ঢুকে নিজের সংসার নিয়েই ব্যস্ত হয় পরতো না। পাড়ার দোকানে কার কত বাকি পরেছে সেটাও সকলে জানতো। খুব গোপনে কেউ কারো বিরাট উপকার করে বসতো। কে যে কার বিপদে পাশে দাঁড়াচ্ছে সেটা কেউ জানতো না। হুট করে একদিন দোকানে গিয়ে হয়তো জানতে পারলো তার বাকির খাতার টাকাটা মিটিয়ে দেয়া হয়েছে। অথচ এই টাকা জোগার করতে পরেনি বলে হয়তো ভদ্রলোক বহুদিন ঘুরে ঘুরে অন্য পথ ধরে বাড়ি ফিরেছে। কিন্তু হঠাৎ করেই কেমন যেন দৃশ্যপট পাল্টে গেলো। সকলে দৌঁড়াতে শুরু করলো। সেই দৌঁড় আর থামছে না কিছুতেই। সকলের দেখাদেখি আমরাও ছুটছি। কিন্তু কিসের পিছনে যে ছুটছি তা ঠিক কেউ বুঝে উঠতে পারছি না।

বড্ড তাড়াহুড়োর একটা জীবন চলে এসেছে যেন। এক দন্ড দাঁড়িয়ে সময় নিয়ে কিছু দেখবার কারো সময় নেই। যে মানুষগুলোকে প্রতিদিনই দেখি কিন্তু একটু সময়ের অভাবে মিস করে যাই। এমনি চট করে মিস হয়ে যাওয়া মানুষের মধ্য থেকেই আবিস্কার করি এক তরুণ কিন্তু দুর্দান্ত গায় এমন এক বাউল শিল্পীকে। সেই মেধাবী অথচ দরিদ্র শিল্পী এই শহরে রিকসাচালায়। আলাপচারিতার একটা পর্যায় তার সাথে একটা বন্ধুত্ব মতো তৈরি হলো। সে নিজেকে পরিচয় দিতো পাগলা বলে। পাগলা যেদিন রিকসা চালাতো না সেইসব দিনে ওকে নিয়ে শহর ছেড়ে কাছেপীঠে চলে যেতাম। আড্ডা গান শোনা তারপর আবার নাগরিক জীবনে ফিরে আসা। কতদিন ওর সাথে আড্ডা দিয়েছে অথচ আমি ওর এই নামটুকুন ছাড়া আর কিছুই জানি না। সে আমার কাছে পাগলা নামেই থেকে গেছে অন্য অনেকের মতোই। এই রকমই একদিন খাড়া দুপুরে গরম গরম তেলে ভাজা বিশাল সাইজের ইলিশ, ইলিশের ডিম, মুচমুচে ভাজা শুকনো মরিচ, বেগুন ভাজা সাথে ধোঁয়া উঠা ভাত খেয়ে মাওয়া ঘাটের একটা বিকল ফেরির নিভৃত কোনে বসেছি। পাগলা ফেলে রাখা বিশাল একটা নোঙ্গরে ঢেলান দিয়ে তার মন্দিরাটা বাজিয়ে গেয়ে চলেছে-

সহজ মানুষ ভজে দেখনারে মন দিব্যজ্ঞানে
পাবিরে অমূল্য নিধি বর্তমানে।।

ভজ মানুষের চরণ দু’টি
নিত্য বস্তু হবে খাঁটি।
মরিলে সব হবে মাটি
ত্বরায় এই ভেদ লও জেনে।।

শুনি ম’লে পাবো বেহেস্তখানা
তা শুনে তো মন মানে না।
বাকির লোভে নগদ পাওনা
কে ছাড়ে এই ভুবনে।।

আসসালাতুল মেরাজুল মোমেনিনা
জানতে হয় নামাজের বেনা।
বিশ্বাসীদের দেখাশোনা
লালন কয় এই জীবনে।।

সহজ মানুষ ভজে দেখনারে গানটি শুনতে ক্লিক করুন 

পদ্মার ফুরফুরে বাতাসে তন্ময় হয়ে গান শুনছি। এমন সময় ছোটখাটো ভিড়টা ঠেলে প্রায় ছয় ফুটের বিশালদেহী পায়জামা-পাঞ্জাবী পরা বেশ উগ্র চেহারার মৌলবাদী টাইপের এক লোক গনগন করে এগিয়ে এলেন। এসেই খেঁকিয়ে উঠলেন- ‘কি হইতেছে এইসব? গান গাওয়া চলতাছে? লালন ফকিরের গান?’ সেই সময়টাতে দেশে মৌলবাদীদের সবচেয়ে আগ্রাসী সময় চলছিল। প্রায় প্রতিদিনই সম্প্রচার মাধ্যমে সেই সব কলঙ্কিত সংবাদগুলো নিয়মিত প্রচার হচ্ছিল। পাঞ্জাবী-দাঁড়ি-টুপি দেখলেই ভেতরটা কেঁপে উঠতো। সেই সময়টাতে এমন একটা দৃশ্য দেখে গুটিকয়েক যে মানুষ ভিড় করেছিল তারা একটু দূরে গিয়ে নিরাপদ অবস্থান নিয়ে গলা বাড়িয়ে দেখতে লাগলো। পাগলা তো চোখ খুলে এই দৃশ্য দেখে তব্দা খেয়ে গেছে। গানের শেষাংশ না গেয়েই থেমে গেল। তার অবস্থা এমন যে কোনো ফাঁকফোকড় পেলেই ভো দৌঁড় দিবে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস আমরা যদি ফেরির কিনারার দিকটায় বসতাম তাহলে পাগলা নির্ঘাৎ নদীতে ঝাঁপ দিতো। আমার অবস্থাও করুণ। কারণ ভদ্রলোক দুই পা ফাঁকা করে নায়ক জসিমের মতো দুই হাত কোমড়ে রেখে যে ভঙ্গিতে দাঁড়িয়েছেন। তাতে ভয় না পাওয়ার কোনো কারণ নেই। পুরো ফেরি কাঁপিয়ে তিনি বলতে লাগলেন, ‘এইসব কি গান? গান গাওয়া হইতেছে?’ আমি ফ্যাকাশে মুখে কি বলবো কিছুই বুঝতে পারছি না। আরো পরিস্কার করে বলতে গেলে গলা দিয়ে কথা বেরুচ্ছিল না কিছুতেই। তার আগ্রাসী মনোভাব আর নিশপিশ করা হাত দুখানা দেখে মনে হচ্ছিল এইমাত্র ভদ্রলোক চাপাতিখানা বের করে মাথায় কোপ বসিয়ে দিবেন। তারপরও নিজের সমস্ত শক্তি জড়ো করে বললাম, আপনার কি সমস্যা?
এতোক্ষণ ভদ্রলোক চোখ দিয়ে আমাদের দুইজনকে দেখার চেষ্টা করছিলেন। আমার ক্ষীণ গলার কণ্ঠস্বর শুনে এইবার পূর্ণ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে সমগ্র অগ্নি ঝড়িয়ে বললেন, এইসব আপনেরা কি শুরু করছেন? পাইছেন কি আপনেরা? যেখানে সেখানে গান বাজনা শুরু কইরা দিছেন? এইখানে কি মেলা লাগছে? রঙ্গ করেন?
আমি ঠিক কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলাম না। দূরে যারা দাঁড়িয়ে ছিল তারাও পালাতে শুরু করেছে। নিজেকে একটু সামলে নিয়ে মোটামুটি দৃঢ়তার সাথেই বললাম, আপনি কি বলতে চাইছেন?
উনি আমার মুখের কাছে মুখ এনে হুংকার দিয়ে বললো, গান এমনে গায় নাকি মিঞা?
আমি চোখে চোখ রেখে কিছুটা হুংকার দিয়েই বলে ফেললাম, কেমনে গায়?
উনি আরো কঠোর হয়ে উঠলেন। দাঁতে দাঁত পেষার শব্দ পর্যন্ত পেতে লাগলাম। টুপিটা খুলে পকেটে রাখলেন। এইবার সত্যি সত্যি মনে হচ্ছিলাম আমি কিছুক্ষণের মধ্যেই মারা যাচ্ছি। আমার দিকে তাকিয়েই উনি ঘারের লাল সাদা ডোরাকাটা কাপড়টা মাথায় বেঁধে। পাগলার হাত থেকে মন্দিরাটা প্রায় ছিনিয়ে নিয়ে বাজাতে বাজাতে গাইতে শুরু কর দিলেন-

খাঁচার ভিতর অচিন পাখি
কেমনে আসে যায়।
ধরতে পারলে মনবেড়ি
দিতাম পাখির পায়।।

আট কুঠুরী নয় দরজা আঁটা
মধ্যে মধ্যে ঝরকা কাঁটা।
তার উপরে সদর কোঠা
আয়নামহল তায়।।

কপালের ফ্যার নইলে কি আর
পাখিটির এমন ব্যবহার।
খাঁচা ভেঙ্গে পাখি আমার
কোন বনে পালায়।।

মন তুই রইলি খাঁচার আশে
খাঁচা যে তোর কাঁচা বাঁশে।
কোন দিন খাঁচা পড়বে খসে
ফকির লালন কেঁদে কয়।।

খাঁচার ভিতর অচিন পাখি গানটি শুনতে ক্লিক করুন

দৈর্ঘ্য-প্রস্থ-উচ্চতায় পর্বতপ্রতীম মানুষটা বাউলদের ঢঙ্গে নেচে নেচে গাইতে শুরু করবেন সেটা আমার ভাবনাতেও ছিল না। যে মানুষটির আকার ও আচরণে ভয়ের রেশ শিরদাড়া বেয়ে নামছিল মুর্হুতেই সবটা পাল্টে গেল। আহ্! কি যে সেই জাদুকরি সুরের মায়া। সত্যি বলছি এই যে লিখছি আমি এখনো যেন শুনতে পাচ্ছি সেই সুরেলা কণ্ঠের গান। চারপাশে ভিড় বাড়তেই লাগলো। পাগলাকে কেউ একজন একটা সিলভারের কলস এনে দিয়েছে কোনো এক ফাঁকে। সে সেটা একটানা বাজিয়ে চলছে। আশপাশের টোকাই ছেলেপেলেগুলো গোল হয়ে বসে পরেছে। বড়রা ভিড় করে আছে আমাদের সকলকে ঘিরে। গানটা তিনি টানা বিশ থেকে পঁচিশ মিনিট গেয়ে যখন থামলেন। ততক্ষণে ঘেমে নেয়ে গেছেন। চারপাশ থেকে আরেকটা আরেকটা বলে গাইবার জন্য তুমুল জোয়ারের শব্দ ভেসে আসছে। আমি নিজেকে পুরোপুরি গুলিয়ে ফেলেছি। গানটা গাওয়ার আগের মানুষটা আর গানটা গাইতে গাইতে মানুষটা যে রূপে আমার সামনে প্রকাশিত হলো এই বিশাল বা বলতে গেলে অনন্ত ফারাকটা আমি তখনো হজম কর উঠতে পারিনি। তার উপর লালন ফকিরের এই পদটা শুনলে প্রতিবারই আমি এর প্রতিটি শব্দের ভেতরে যে অনন্তের খোঁজ পাই তা থেকে বের হতেও আমার এমনিতেই অনেকটা সময় লাগে।

অলস দুপুর গড়িয়ে গড়িয়ে বিকেলের দিকে যাত্রা করতে শুরু করেছে ততক্ষণে। হঠাৎ পাল্টে যাওয়া মৌলবাদী টু বাউল, অসুর থেকে সুর, চারপাশের মানুষের উচ্ছাস, পাগলার একনিষ্ঠ কলস পিটিয়ে যাওয়া, পদ্মার থেমে না যাওয়া ঢেউয়ের শব্দ, মৃদুমন্দ বাতাস আর আমার উপলব্ধি সব মিলিয়ে আমি বারবার গুলিয়ে যাচ্ছিলাম। এর মধ্যেই ভদ্রলোক এক হাতে আমাকে আরেক হাতে পাগলাকে টানতে টানতে ভিড় ভেঙ্গে এগিয়ে নিয়ে যেতে লাগলেন। যতটা আসার পর পেছনে পেছনে আসা মানুষগুলো থেমে গেলো ততটা পথে এসে থামলেন। বললেন ঐপারে আমার বাড়ি চলেন বাড়িতে আজ রাতে আমার সাথে চারটা ডাল-ভাত খাবেন।

শাহবাগ আন্দোলনের পরপর সময়টা এমন ছিল যে পরিচিত মানুষজনকেও চট করে বিশ্বাস করা কঠিন হয়ে গিয়েছিল। আর একজন পুরোপুরি অপরিচিত মানুষের সাথে কথা না বলাও একটা অঘোষিত নিয়মের মধ্যেই ছিল তখন। এতো কিছুর পরও ঠিক সেই মুর্হূতে আমার মনে হচ্ছিল এই ভদ্রলোক যদি আমাকে এই সময় কুপিয়ে মেরে ফেলে আমার ততটা কষ্ট হবে না। সত্যি বলছি এমন একটা হৃদয় নিংড়ানো গান শোনার পর মরে যাওয়া যায় নির্দিধায়। সেই মুর্হূতে কোনো আকুতি অবশিষ্ট থাকেনা বেঁচে থাকবার জন্য।
অনেক টানাটানি করার পরও যখন বুঝাতে সক্ষম হলাম আমাকে ফিরতেই হবে তখন একটা মিষ্টির দোকানে নিয়ে গেলেন ভদ্রলোক। সেখানে দই মিষ্টি খেতে খেতে জানলাম। ভদ্রলোক মাদারিপুরের একটা মাদ্রাসার সহকারি প্রিন্সিপাল। নাম খোকন খন্দকার। তারপর থেকেই তিনি হয়ে উঠলেন আমার খোকন ভাই। আর উনি আমাকে বলতেন মিঞা ভাই। খোকন ভাই যতদিন বেঁচে ছিলেন এমন হয়নি আমি পদ্মা পাড়ে যাচ্ছি শুনে উনি নদী পার হয়ে আসেন নি। কথায় কথায় জেনেছিলাম শৈশব থেকেই খোকন ভাইয়ের গান গাওয়ার খুব শখ। বাড়ি থেকে পালিয়েও ছিলেন বাউল হবেন বলে। কিন্তু পারিবারিক কঠিন অনুশানের ফলে তাকে বারবার ধরে নিয়ে আসা হয়েছে। এবং দাদার মৃত্যুর সময় হাতে হাত দিয়ে কথা দিয়েছিলেন উনি আর গান গাইবেন না। সেই থেকে তিনি পুরোপুরি পরিবারের আর দশজন মৌলবাদীর মতোই গানকে ঘৃণা করতে শিখতে শুরু করেছিলেন। গ্রাম ও আশেপাশে কিছু ওয়াজও করেছেন এর বিরুদ্ধে। কিন্তু মনের কোথাও একটা জায়গায় গানটা ছিল। সময় সুযোগ হলে বিশেষ করে বছরের লম্বা ছুটিতে যখন মাদ্রাসা বন্ধ থাকতো। সবাই মাদ্রাসা ছেড়ে যেত তখন নাকি তিনি সব ঘরের দরজা-জানালা বন্ধ করে গান গাইতেন। তার এই রূপ তার পরিবার ও বন্ধু-বান্ধাব, পাড়া-প্রতিবেশিকে কোনোদিন জানতে দেননি। এমনকি এ কথা যদি কাউকে বলা হয় তাহলেও কেউ বিশ্বাস করবে না।

ভয়ঙ্কর খবরটা হলো খোকন ভাই পাগলাকে গান গাইতে দেখে তিনি সত্যি সত্যি একটা বিশৃঙ্খলা করতেই এসেছিলেন। কিন্তু কোন এক অজ্ঞাত কারণে তার বাইরের হিংস্রতাটা বদলে গিয়ে ভেতরের বাউলটা বের হয়ে এসেছিল। একবার আমাকে অবাক করে দিয়ে খোকন ভাই আমার পা ছুয়ে সালাম করে ফেল্লেন। আমি ছিটকে গিয়ে বিস্মিত হয়ে জিহ্বায় কামড় দিয়ে বলেছিলাম, খোকন ভাই এটা কি করলেন? বাবার বয়সী একজন মানুষ চোখের জল আড়াল না করেই বলেছিলেন, মিঞা ভাই আপনার সাথে পরিচয় না হইলে আমি যে গাইতে পারি সেটা কেউ জানতোই না। গোপনে আপনারে দুইটা গান শুনাই পরানটা ঠান্ডা হইয়া যায়। আগের জন্মের কোনো হিসাব কিতাব আপনার সাথে আমার ছিল সেইটা আমার মনে হয়। নাইলে আপনের সাথে আমার দেখাই বা হইবো কেন? পাথরের মতোন মানুষ আমি; একবার যা বলছি তো বলছিই; কথার লড়চড় হয় না। আমার মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল পর্যন্ত আমারে ডরায়। এত্তো বছর সব্বাইর কাছে যেটা লুকায়া রাখছিলাম। আপনার সাথে তা পারলাম কই? আমার ভেতরে যে একটা ফকিরি আছিলো সেটা তো আপনিই বাইরে আনছেন। আপনি আমার ছোট ভাই না আপনে আমার বাপ। আবেগে খোকন ভাই একটু বারাবারি করতো সব সময়ই। খাওয়া দাওয়াতেও তেমনি।
খোকন ভাই যখন হাসতেন বা কাঁদতে শুরু করে দিতেন তখন তার বিশাল ভূড়িখানাসহ সমস্ত শরীর কেঁপে কেঁপে উঠতো। আর আমি ঠিক তক্ষুণি বুঝতাম আরেকটা গান হতে চলেছে। লালন গাইলেও খোকন ভাইয়ের কণ্ঠে বিজয় সরকারের গান ছিল অনবদ্য। এখন খুব আপসোস লাগে খোকন ভাই এর কোনো গান আমার রেকর্ড করা হয়নি। আসলে খোকন ভাইয়ের মতো মানুষজন যারা বাইরের দিকে এতোটাই কঠিন আর ভেতরটা এতোটাই কোমল। তারা নিজেদেরকে সবার কাছে প্রকাশ করতে পারে না। এরা আসলে যেমন মানুষ তার সম্পূর্ণ বিপরীত একটা জীবন যাপন করে যায়। আগের জন্মে খোকন ভাইয়ের সাথে কোনো হিসেব নিকেষ আদৌ ছিল কিনা, এই জীবনে তার ধারাবাহিকতা থাকলো, নাকি পরবর্তী জীবনে নতুন কোনো সমীকরণ তৈরি হবে এসব নিয়ে আপাতত ভাবছি না। হুট করে খোকন ভাই চলে যাওয়ার পর পদ্মা পাড়ে যাওয়াটা কমে গেছে। গেলে একটা অদ্ভুত শূন্যতা কাজ করে। এই মুর্হুতে খোকন ভাইকে মনে করে তাকে উদ্দেশ্যে করে ফকির লালনের একটা পদ খুবই মনে পরছে-

মহা ভাবের মানুষ হয় যে জনা
তারে দেখলে যায় রে চেনা।
তার আঁখি দুটি ছলছল
মৃদু হাসি বদন খানা।।

ফলের আশা করে না যে
ফুলের মধু পান করে সে
সেই তো রসিক জনা।
তার কাম নদীতে চর পড়েছে
প্রেম নদীতে জল ধরেনা।।

সদাই থাকে শান্ত রতি
নির্জনে তার গতাগতি
করে জগৎপতির সাধনা।
তার হেতুর সঙ্গে নাই সম্বন্ধ
নিহেতু তে বেচাকেনা।।

সদাই থাকে নিগুম ঘরে
ডাকে গুরুর রূপ নিহারে।
সে জন অন্য রূপ বুঝেনা।
দরবেশ সিরাজ সাঁই কয় অবোধ লালন
তোমার গুরুতে বিশ্বাস হলোনা।।

আরেকটু পরিস্কার করে বলতে চাইলে বলা যায়। এই সভ্য সমাজে যাদের সাথে সময় কাটাচ্ছিলাম, আড্ডা দিচ্ছিলাম, ঘুরছিলাম। যারা আমারি মতো বা আমার চেয়ে আরো অনেকটা ভালোভাবে ভাবতে পারে। ক্রমাগত তাদের সাথে মিশতে মিশতে বুঝতে পারছিলাম আমি মানুষের মনুষ্যত্বকে চিনতে শেখার বদলে একটা মেকি-মুখোশ পরা সমাজের কাছাকাছি চলে যাচ্ছিলাম। যেখানে সকলে পান থেকে চুন খোসলেই পাল্টে যায়। আশপাশের এই মানুষগুলো কোনোভাবেই আমাকে আর টেনে ধরে রাখতে পারছিল না। এই বিষয়টা আমার জীবনে একবার নয় বহুবার এসেছে। বহুবার আমি আমার চারপাশের মানুষগুলোকে পাল্টে ফেলেছি। খুব সচেতনভাবেই তা করেছি। সচেতনভাবেই হারিয়েছি বহুবার। হয়তো ভবিষ্যতেও হারাবো। বিশাল মাপের মানুষগুলোর খুব কাছাকাছি যেয়ে অভিজ্ঞতা হয়েছে তাতে মানুষের উপর বিশ্বাসই চলে যেতে শুরু করেছিল। এতে আমি কাউকে দোষারোপ করছি না। স্বীকার করে নিচ্ছি আমি তাদের কাছ থেকে ভালোটা না শিখে খারাপটাই শিখতে শুরু করেছিলাম নিজ স্বভাবদোষে।

‘মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি’ বিষয়টা তখনো কেবলই একটা গানের লাইন ছিলই আমার কাছে। নিজেকে সভ্য সমাজের কাছ থেকে গুটিয়ে নিতে নিতে ভেবছিলাম শহুরে সম্পর্কের রাজনীতির বাইরে গিয়ে গ্রামের সাধারণ মানুষের মাঝে মিশে গেলে কেমন হয়। তাদের কাছাকাছি গিয়ে ধাক্কাটা আরো বেশি লাগলো। এর একটা বড় কারণ হতে পারে আমি যে সময়টায় গ্রামকে চিনতে শুরু করতে চাচ্ছিলাম ততদিনে অজো পাড়াগাঁয়ের ছোট্ট মুদিখানায়ও এনার্জি ড্রিংক, প্যাকেটে বড় কোম্পানির চিপস, মিনারেল ওয়াটারের বোতল, প্যারাসিটামল, নাপা পৌঁছে গেছে। এতো সব বিশ্বসংস্কৃতি নিয়ে গ্রামের সহজ মানুষগুলো আর তাদের সহজতা ধরে রাখতে পারছিল না। ততদিনে তাদের ভেতরের জটিলতাটা অন্য স্তরে পৌঁছেছে। আগে যেটা অন্যকে মামলায় ফাঁসানোতে শেষ ছিল। এখন কুটিলতা শহরের মানুষকেও অনেকক্ষেত্রে হার মানায়। অবিশ্বাসটা যেনো পুরো জাতির শিরায় উপশিরায় পৌঁছে গেছে। তাহলে সোনার মানুষ কোথায়? কোথায় তাদের বাস? তবে কি সোনার মানুষ খুঁজতে যেতে হবে সুনীলের দিকশূন্যপুরে? নাকি লালনের আরশিনগরে?

দিকশূন্যপুর… নিশ্চিন্তপুর… থেকে আরশিনগর যাওয়ার রাস্তাটা আমার কাছে সহজ মনে হয়েছিল। কারণ এই পথটা আমার সামনে তৈরি হচ্ছিল বহুদিন ধরেই। আর আরশিনগরের পথে যেতে যেতেই শিখতে শুরু করি, বুঝতে শুরু করি, জানতে শুরু করি। সোনার মানুষ সর্বত্রই আছে। বাইরে খুঁজলে তার তল পাওয়া যাবে না। যে সোনার মানুষ হবে সেই সোনার মানুষের খোঁজ পাবে। এর কোনো বিকল্প নেই। যে দিকশূন্য হতে পারবে সেই দিকশূন্যতার পথ পাবে। যে নিশ্চিন্ত হতে পারবে সেই নিশ্চিন্তপুরের পথ পাবে। আর সবচেয়ে সহজ পথটা হচ্ছে, আয়নার মতো নিজেকে দেখতে শুরু করলেই আরশিনগরে যাওয়া যায়। এর জন্য বিশাল কোনো আয়োজনের প্রয়োজন নেই। নেই প্রয়োজন আতশবাজির বর্ণাঢ্য উদ্বোধন। ব্যানার-পোস্টার-ফেসবুকের বুস্ট। যখন থেকে সাধক চাইবে তখন থেকেই যাত্রা শুরু হবে।
‘লালনের গান তো গান না এ হইলো বাপজি জ্ঞান’ এই কথাটা প্রথমবার লালন সাইজির মাজারে বসেই শুনেছিলাম কিন্তু তা বুঝতে আমাকে অর্ধেকের বেশি জীবনটা কাটিয়ে দিতে হলো। লালন সাঁইজি আমাকে প্রতিনিয়ত শেখায় সোনার মানুষ কি করে মানুষের ভেতরে থাকে; কি করে তাকে দেখতে হয়। যে কেউ লালনে ডুবলেই এই বিদ্যা শিখতে পারে। এরজন্য মেজবানি ভোজের আয়োজন করে জানান দেয়ার কিচ্ছুটি নেই। লালন তার প্রতিটি পদে, প্রতিটি শব্দে, প্রতিটি অক্ষরে এই জ্ঞানই দিয়ে গেছেন। ঠিক যেমনটা বর্ণমালা না শিখলে কোনো ভাষা পড়তে শেখা যায় না। ঠিক তেমনি লালনকে বুঝতে গেলেও লালনের বর্ণমালা শিখতে হয়। আর সেই বর্ণমালার ছিটেফোটা বুঝতে পারলও বোঝা যায়-

সোনার মানুষ ভাসছে রসে
যে জেনেছে রসপন্থি সে
দেখিতে পায় অনায়াসে।।

তিনশো ষাট রসের নদী
বেগে ধায় ব্রহ্মাণ্ড ভেধী।
তার মাঝে রূপ নিরবধি
ঝলক দিচ্ছে এই মানুষে।।

মাতা পিতার নাই ঠিকানা
অচিন দেশে বসত খানা।
আজগুবি তার আওনা যাওনা
কারণবারির যোগ বিশেষে।।

অমাবস্যায় চন্দ্র উদয়
দেখতে যার বাসনা হৃদয়।
লালন বলে থেকো সদাই
ত্রিবেনীর ঘাটে বসে।।

বর্তমান প্রজন্মের সবচেয়ে কাছের ও জনপ্রিয় ধারার লেখক হুমায়ুনর আহমেদও তার বইয়ে ময়ুরাক্ষী নদীর কথা বলেছিলেন। যেটা নিজের একটা নদী। আসলে তিনি কোনো নদীর কথাই বলেননি, নিজের মতো করে নিজস্ব একটা জগৎ তৈরি করার কথাই বলেছেন বলে আমার ধারণা। সমস্যা হল আমরা নদী তো দূরের কথা মনে মনে নিজের মত করে একটা ছোটখাটো একটা ডোবাও তৈরি করি না। তাই নিজস্বতা বলে আর কিছুই থাকে না। আর এই কিচ্ছুই থাকে না যখন তখনই অন্যের জীবনে ফফরদালালী করে কাটিয়ে দেই। একটা এতো মূল্যবান এবং একই সাথে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা জীবন অন্যলোক কি ভাববে… কি ভাবছে… কি করছে… তা ভেবে ভেবে… বলে বলে কাটিয়ে দিচ্ছি। আজ আর কিছুই লিখতে ইচ্ছে করছে না চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি। সত্যজিৎ রায়ের অরণ্যের দিনরাত্রিতে রবিঘোষ পত্রিকার পাতায় দিয়াশলাইয়ের কাঠি জ্বালিয়ে আগুন দিয়ে খুব কোমল অথচ উৎফুল্ল কণ্ঠে বলছেন, ‘সভ্যতার সঙ্গে সকল সম্পর্ক শেষ’।

Ajit Dash

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ভাষা
Scroll to Top