রাত আরো গাঢ় হলে
এখনো নামেনি রাত ঘন হয়ে
গাঢ় শীত নামেনি এখনো
ইঞ্জিনে এখনো অগ্নি পুড়ে যাচ্ছে তেল
চাকায় এখনো গতি
ছুটে যাচ্ছে কোন্ দিকে যেন . . .
ভাঙ্গেনি মোড়ের আড্ডা
একদিন ভাঙ্গবে যদিও ।
তবুও কি ভেঙ্গে যাবে
শেষ হবে এই কোলাহল ?
পদ্মায় বালুর চরে ক্ষীণ ধারা
দুর্বল রক্তের শিরা
নদীতে কি থেমে যাবে জল ?
হয়তো ক’দিন পরে
কুয়াশার মতো ঘন শীত
রাত্রি জুড়ে হানা দেবে
নদীটি হারিয়ে যাবে চরের খরায় ।
এখানে এখনো দেখি শব্দ করে ট্রাক ছুটে যায়
রাতেও মাটির বুকে হানা দেয়
এক্সক্যাভেটর ।
কুঁড়েঘর ভেঙ্গে নিয়ে চলে গেছে যারা-
ফেলে যাওয়া শূন্যতায় ঢুকে যাচ্ছে শিকের শিকড়
পাথুরে বৃক্ষের মতো দালানের একরোখা ধড়
ক্রমেই উত্থিত হয়ে
ঢুকে যাচ্ছে বায়ুর জঙ্ঘায় ।
একদা হাতের ভাঁড় ভরা ছিল কানায় কানায়
এখনো রয়েছে কিছু নিকষ তলানি
এখনো রয়েছে কিছু গ্লানি-
রাত আরো গাঢ় হলে
হয়ে যাবে তাদেরও কবর।
এক দুই . . . নয় শূন্য সংখ্যার মতোন
আমরা এখানে যেন
কোন এক স্টেশনের দীর্ঘ বারান্দায়
অচেনা ট্রেনের অপেক্ষায় ।
ঘন্টি দিয়ে চলেছে সময় ।
রেলপথ দীর্ঘ এক মই এর মতোন
কোথায় হারিয়ে গেছে —
জানিনা উপরে কিংবা নিচে
সম্মুখে বা পিছে
কে জানে কোথায় নিয়ে যাবে !
যাত্রীসব চলে যাবে
যাত্রা হলে শেষ,
ঘন্টিম্যান হবে নিরুদ্দেশ ;
অন্য কেউ হেনে যাবে
বদলির হাতুড়ি ।
টিকেটের মাস্টারের ঘড়ি
ঘুরে ঘুরে রাত্রি হবে,
লালরঙা জামা গায়ে কুলি
নিজের মাথার খুলি রিলে করে
বয়ে নিয়ে মাথায় মাথায়
সারি সারি চাকা যেন কক্ষপথে
ঘুরে ঘুরে মিশে যাবে
রক্ত ঘাম বাষ্প তাড়নায় ।
এখানে ঘুমায় যারা
বাস্তুহারা যাহাদের নাম,
সাকিন ঠিকানাহীন
ভেসে যাওয়া মানুষের স্রোতে,
আমরাও তাদের নিকটে
যাত্রী শুধু, হাতের টিকেটে
খুঁজে চলি কোথায় আসন ?
এক দুই . . . নয় শূন্য সংখ্যার মতোন।
অজানা প্লাবন
চলে যেতে হয়, চলে যাই।
তবুও মানুষ কিছু চলে গেলে
ভেঙ্গে পড়ে ভীষণ বর্ষণ।
কখনো বা শব্দ শুনি,
কখনো সে নীরব ক্রন্দন
কথাহীন বন্যার মতন
গহীন অরণ্য মাঝে বয়ে যাওয়া
অজানা প্লাবন ।
আবারো একটি দিনের মৃত্যু হলো
আবারো একটি দিনের মৃত্যু হলো
রাত্রির কালো কাফনে মোড়ানো লাশে
কবরে শোয়ানো শীতল শরীর ঘিরে
সময়ের পোকা মেতেছে ভোজোল্লাসে।
জেগেছে কি বোধ আমাদের অনুভবে !
আমার অজানা, তুমি কি বুঝতে পারো ?
শব্দহীনতা নাকি জোর কলরব ?
দৃশ্যের পটে আঁকা আছে কোন ছবি,
অথবা কুয়াশা মুছে দিয়ে গেছে সব ?
রূপান্তর
রূপ কোন রূপ নয়
রূপান্তর শুধু রূপান্তর
রূপের প্রতিটি কণা
ভাঙ্গাগড়া চির নিরন্তর।
যার কোন শুরু নেই
বৃত্তাবদ্ধ
নেই কোন শেষ
ভাঙ্গার যন্ত্রণা অনিঃশেষ।
ভাঙ্গে অনু পরমাণু
ইলেকট্রন প্রোটন নিউট্রন—
যতই গভীরে যাও
ক্রমাগত ভাঙ্গন ভাঙ্গন।
ভাঙ্গে যত গড়ে ওঠে
নবজন্ম নব রূপান্তর
তুমি আর আমি তাই
একই দেহ অভিন্ন অন্তর।
রূপান্তর ২
জন্ম বলে কোন কিছু নেই
মৃত্যু বলে কোন কিছু নেই
রূপান্তর শুধু রূপান্তর ।
কোন এক ভোরের আলোতে
অথবা গভীর কালো অন্ধকার রাতে . . .
যদিও সময় বলে কোন কিছু নেই,
তবু এক গণনার কালে
কোন এক রূপে
আমাদের দেখা হয়ে যায়
পরস্পর । ক্রমপরিবর্তনের ঘূর্ণিপাকে
সদা বিবর্তিত চেতনায়,
মায়া ভ্রম বিভ্রমের
বয়ে চলা এই মোহনায়।
জানোনাকি, এ দেখা নতুন কিছু নয় ?
কেননা তুমিও ছিলে
মহাবিশ্ব- কণায় কণায় ,
উড়ে যাওয়া পুষ্পরেণু করোনায়
মিলেমিশে উড়েছি হাওয়ায়,
আরো কত রূপে দেখা হয়েছিল
ভাঙ্গাগড়া খেলার ধাঁধায়!
ধরো এক শ্রাবণের সাঁঝে
পৃথিবীর মিছামিছি কাজে
এই রূপে আমাকে পাবে না- – –
হয়তো আমার দেহ রক্ত মেদ
হয়ে যাবে শ্মশানের ছাই
অথবা মাটির নীচে
কোটি কোটি কীটের উৎসবে. . .
সমাধিক্ষেতের বুড়ো বট নিম
শিকড়ের অক্টোপাস এই দেহ খাবে
আমারই মাংসের স্বাদে পুষ্ট হবে ফুলে ও পাতায়
নিমফল ঠোঁটে নিয়ে উড়ে যাবে
বৃত্তাহারী পাখি . . .
আমিও তাদের সাথে উড়ে যাবো ,
তাদের উদোর হতে উদগারিত বীজ হতে
পুনরায় অংকুরিত হবো – –
নিম হবো বট হবো; রাধাচূড়া জারুলের ফুলে
এইসব রূপান্তরে দেখা হবে আবার আবার
শিমুলের অন্তহীন লালে।
রূপান্তর-৩
কেন এতো মৃত্যুভয় ? নির্ঘুম রাতের দাগ, চাবুকের
সাপ যতো জড়ানো শরীরে আর এতো রক্তচাপ
যেন ছিঁড়ে যাবে চেতনার পরিবাহী তার, স্নায়ু,
রক্তনালী, ইড়া! যেন থেমে যাবে দুন্দুভির ক্রীড়া।
কোথা থেকে এসেছিলে, চলে যাবে আবার কোথায় ?
এরূপে তুমি কী ছিলে ? রূপান্তরের কেন তবে ভয় ?
নিজেকে এ প্রশ্ন করে খুঁজি যেন আত্মপরিচয় —
মাটি থেকে উঠে আসা, মিশে যাবো মাটির আত্মায়।
অমোঘের বরিষণে
সন্ধ্যা নামছে বৃষ্টির জলে ধোয়া
রাতের আগেই নেমেছে অন্ধকার
কান্না জমানো আকাশের ঘোলা চোখে
ঘনায় মেঘেরা অসিতবরণীধোঁয়া।
আমি যেন এক পারের খেয়ার খোঁজে
বসে আছি একা ভেসে যাওয়া নদীতীরে
ভেসে গেছে কত জীবনের তরণীয়া
পাড়ভাঙ্গা স্রোতে অমোঘের বরিষণে।
চলে গেছে যারা সাগরের পরাপারে
মিলেছে অজানা গহনের আবাহনে
জেগে আছে তারা তারাদের নির্জনে
একাকার হওয়া আলো ও অন্ধকারে।
শিকার
আমি কি ছেড়েই দেবো হাল ?
ডিঙ্গিটাকে ভেসে যেতে দেবো ঘোলা স্রোতে ?
গুটিয়ে নিচ্ছি যেই জাল
নেই জেনে মাছের কম্পন
ছেড়ে দিয়ে রশি
পাটাতনে মুখ ঢেকে বসি;
ঊর্ধ্বচোখে খুঁজে দেখি কোথায় ঈশ্বর–
নীলিমা শুধুই বালুচর,
উজানে বেঁধেছি যেই ঘর
মিশে গেছে ধোঁয়াটে রেখায়।
আসলে উজান-ভাটি নেই।
ভাটিও উজান হয়ে যায়,
শিকারি জালের জেলে
মাছেদের খাদ্য হয়ে যায়
ভরা পূর্ণিমায়
আমি ভাবি
ছেড়ে দিয়ে হাল
ছুটে আসা স্রোতে বেসামাল
ডিঙ্গিটার সাথে আমি নাচি —
অরূপ অদৃশ্য জাল ফেলে
আমাকে শিকার করে নিয়ে যাক
রুদ্র মহাকাল।
প্রজাপতি
একটি প্রজাপতি ঝলসে গেল মোমের আগুনে।
বর্ণিল কারুময় সুন্দর পাখাদুটি
ছাই হয়ে যাবার পরেও
দীর্ঘক্ষণ চেয়ে ছিল সে ঐ আগুনেরই দিকে,
তারপর রূপান্তর পেল
আরো বেশী স্তব্ধতার সারাৎসারে
ক্রমশই মাটি হয়ে গেল-
মাটির ভেতরে তার ঘুম ।
তবু যারা অগ্নি জ্বেলেছিল
দূরের পাহাড় থেকে বয়ে এনে বজ্রের আকর
অথবা অরণী ঘসে, শিলার লাঙল চষে
প্রান্তরে ফুটিয়েছিল আগুনের মতো রাঙা ফুল;
হোমো-ইরেক্টাস সেই আমাদেরই আদি পিতামাতা ।
তাদেরই সন্তান আমি । তুমিও হে পতঙ্গ-দুহিতা
মাটি থেকে উৎসারিত আমারই মতোন,
বনাগ্নির বহ্নুৎসবে জড়ো হওয়া হে আমার প্রিয়তমা বোন –
আমিও পুড়েছি কত শতাব্দীর দহনের আঁচে,
আমাদের ঝলসানো মাংস খেয়ে বেড়ে ওঠা
আমাদেরই প্রজন্ম প্রজাতি – পিতৃমাংস জ্বলে তার দেহে,
তোমারই পাখার রঙ ঝলে তার দেহে,
হে আমার পুষ্পপারিজাতরাঙা হৃদয়ের রক্তপ্রজাপতি।
সৎকার
অন্তেষ্টিক্রিয়ার ভিড়ে মিশে ছিল আমাদের চোখ।
নির্বিকার লালসার রসনায় পবিত্র পাবক,
ভস্মীভূত করেছিল চিতাকাঠে শুয়ে থাকা দেহ;
আমাদের মন থেকে মুছে দিয়ে সকল সন্দেহ।
চারিদিকে অন্ধকারে জমেছিল আরো কত কিছু,
চেনা শবযাত্রী ছাড়া অচেনারা নিয়েছিল পিছু —
সময়ের স্রোত ভেঙ্গে আদি আর অন্ত থেকে আসা,
মগজের তেপান্তরে গুঞ্জরিত শব্দহীন ভাষা,
বিচিত্র বিস্মৃত ছবি পুড়ে যাওয়া ধূম্রজাল স্মৃতি,
জীবনের কোলাহল জীবনের সঞ্চিত নিভৃতি,
আগুনে আগুন পোড়ে, পুড়ে যায় জলে ধোয়া জল,
পোড়ানো বাতাসে ওড়ে ছাই হওয়া মানুষের দল।
লাগাম
অনেক দূরের পথ যেতে হবে
এই বলে কে যেন তাড়ায় —
আমার অবশ দেহ পরিশ্রান্ত
সামান্য বিশ্রাম পেতে যদি বা দাঁড়ায়
পিঠে পড়ে চাবুকের সুতীব্র আঘাত
দাঁতে চেপে দাঁত বুকে রুদ্ধশ্বাস
ছুটে চলি শুধু ছুটে চলি —
আমিতো জানিনা আমি কেন ছুটি
কোন দিকে কেই বা ছোটায় —
গ্রীবায় লাগাম আঁটা চোখে ঠুলি
সাধ্য নেই চেয়ে দেখি তাকে
কখনো পাহাড় ভেঙ্গে নদী ভেঙ্গে
অরণ্য মরুর পথে
রাত্রিদিন ছোটায় আমাকে।
মাঝে মাঝে মনে হয় থেমে যাই
নামুক নিবিড় নীল ঘুম —
সে যেন আঁধার চিরে স্বপ্ন হয়
চালায় হুকুম
দানবের মতো ছায়া ধেয়ে আসে
উঁচিয়ে চাবুক
কোনদিন আমি তার দেখি নাই মুখ
শুনেছি কি কন্ঠস্বর নাকি প্রতিধ্বনি
আলো-অন্ধকারে সেই দানবের শীতল শাসানি
মোহাবিষ্ট মায়াবী মন্ত্রের মতো স্বর
আর শুনি রাত্রিদিন অবিশ্রান্ত চাকার ঘর্ঘর
কখনো বা মনে হয় সেই যেন আমার ঈশ্বর
অনাদ্যন্ত নিয়তি লেখক
আমার দুচোখে ঠুলি এঁটে দিয়ে
খুঁজে নিতে বলে ঠিক পথ
যেন আমি ক্রীতদাস জন্মাবধি কেনা
যে পথে ছোটায় ছুটি
সম্মুখে কিছুই নয় চেনা
বোধাতীত সৌরগতি শূন্যতার চন্দ্রমতি রাত
কখনো হলো না দেখা লাগামে রয়েছে কার হাত।
ঝম ঝম অন্ধকার নাচে
গাছে গাছে
জোনাকি দেখি না
জানি না আগুনপোকা
বিলুপ্ত প্রজাতি কিনা আজ
হয়তো সুশীল সব কীটতত্ত্বপ্রত্নবিদ জানে
গবেষণাগারে
অতি যত্নে সংরক্ষিত বিরল নমুনা
বিলুপ্ত বিলুপ্তপ্রায় অন্যসব প্রাণিদের সাথে
তখন জোনাকি আসে
মগজের আবর্জনাকূপে
প্রতিটি ক্ষ্যাপাটে রাতে
দুচোখেজোনাকিছোটা তারা
জীবশ্রেষ্ঠশিবশ্রেষ্ঠ প্রকৃতিপ্রেমিকশ্রেষ্ঠ
মানুষেরা দিয়ে যায়
সন্তর্পনে জোনাকি পাহারা।