Home » বিদায় নেয়ার আগে // ইরফানুর রহমান রাফিন

বিদায় নেয়ার আগে // ইরফানুর রহমান রাফিন

বিদায় নেয়ার আগে

অথচ, যা হয়েছিল, তা নাও হতে পারত।

কিছু লাইনে এসে মানুষের নিঃশ্বাস থেমে যায়।

ফার্স্ট লাইনটা সেরকম।

*

মনে কর, তুমি হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে আছ। নাকেমুখে নল লাগান। কেবিনের বাইরে ভিড় জমাচ্ছে আত্মীয়তা নামের উৎকণ্ঠা।

আহা, সামাজিকতা বলেও তো একটা কথা আছে!

তুমি বুঝতে পারছ তোমার সময় বেশি নেই। তাই তুমি তোমার কিছু স্মৃতি রিরাইট করবে। চল, শুরু করি।

*

স্মৃতি পুনর্লিখন [১]

শিশু বয়সের তুমি। বাহারি জামা পরে ঘুরে বেড়াচ্ছ পুকুর পাড়ে। অই যে লোকটা, বাবার বন্ধু, এলাকা সম্পর্কিত। সে মুখে হাসি মেখে তোমার দিকে আসছে। হাতে একটা কিটক্যাট। সে এসে তোমার হাতে চকলেট ধরিয়ে দিল, তারপর মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করল। সেই স্পর্শে স্নেহ ছাড়া আর কিছু নেই।

একটা শৈশব বেঁচে গেল ট্রমার হাত থেকে।

*

স্মৃতি পুনর্লিখন [২]

তুমি এখন কিশোরী। এক বিকালে বন্ধুদের সাথে উঠানে এক্কাদোক্কা খেলছ। হঠাৎ রক্ত, যার জন্য প্রস্তুতি ছিল না। পরনে শাদা জামা। ছেলের দল হেসে উঠল না খিলখিল করে। একজন এসে বলল, যা, জামাটা পাল্টে আয়। সেই বলায় মমতা ছাড়া আর কিছু নেই।

একটা কৈশোর বেঁচে গেল অপমানের হাত থেকে।
*

স্মৃতি পুনর্লিখন [৩৩]

আমার সাথে তোমার একদিন দেখা হয়ে গেল।

আমি সান্নিধ্যের লোভে মিথ্যা কথাটা বললাম না।

বাকি সবকিছু আগের মত রেখে দেয়া যাক।

ভোরবেলা, কাক ডাকছে, পায়চারি করছে কয়েকটি কুকুর। মানুষেরা আসে নি। আঙ্কর ওয়াটের মত প্রাচীন দেখাচ্ছে মধুর ক্যান্টিন।

দুপুর, ক্যাম্পাস সরগরম, কিচিরমিচির করছে তালেবে এলেমরা।

বিকাল, শ্যাডোর ফটোকপি মেশিনের শব্দ অস্থিরতা বাড়াচ্ছে। কার্জনের আকাশে দেখে নেয়া যাচ্ছে না-থাকা ভবিষ্যৎ। টিএসসিতে চলছে বন্ধু-আড্ডা-গান।

এত মায়া লাগে। মনে হয় সব পকেটে নিয়ে ঘুরে বেড়াই। হাকিম চত্বর থেকে পলাশী, বা সেমিনার রুম।

*

স্মৃতি পুনর্লিখন [শেষ]

মনে কর, আজিজের সিঁড়ি প্রথম চুমুর সাক্ষী।

মনে কর, বিকালে একটা মশাল মিছিল দেখলাম।

জাতীয় যাদুঘরের সামনে মাটিতে তাকিয়ে দেখলাম —

কাগজের ফুলের মত কিছু লিফলেট পড়ে আছে।

হলুদ আলোয় লিফলেটও কেমন রহস্যময় মনে হয়।

হয়তো তাতে তেল গ্যাস, জাগো জাগো সর্বহারা। বা ঘুমিয়ে-পড়া জয়ধবনি। কিন্তু হলুদ আলোয় মনে হবে হারিয়ে-ফেলা-পৃথিবীর গান।

কোনো এক ইনকা কুমার লিখেছিল প্রেমিকার তরে।

*

এরপর তোমার সাথে আমার আর স্মৃতি নেই। ভেঙে পড়েছিল যোগাযোগসেতু। এরপর তুমি আমার জন্য অন্য যে কেউ।

*

তোমার কথা মনে পড়লে খুব খারাপ লাগে।

তোমার সাথে আমার আর দেখা হয় না।

খুব খারাপ লাগে।

তোমার সাথে আমার আর কথা হয় না।

খুব খারাপ লাগে।

বেঁচে আছ, না মরে গেছ, জানি না।

বিয়ে করেছ, না কর নি, জানি না।

*

আমি তোমাকে কখনো বলি নি ভালোবাসার কথা।

আমি আমার অনুভূতির প্রতি সৎ ছিলাম না।

আমার ভয় লাগত।

আমি ভাবতাম মিথ্যা বলে ধরে রাখা যাবে —

শরীর না পাই, মন না পাই; অন্তত

সান্নিধ্য তো পাব!

মিথ্যা বলে বেশিদিন ধরে রাখা যায় না, যখন এটা বুঝলাম, ততদিনে তুমি আমার নেটওয়ার্কের বাইরে চলে গেছ…

*

আমি মদ খাই নি, সুইসাইড করি নি।

শুধু একটা লাশের মত এই লাশনগরীতে ঘুরেছি।

আর নিজের কাছে নিজে ছোট হয়ে গেছি।

*

অথচ, আমাদের কোনোদিন, পরিচয় নাও হতে পারত।

আমরা কেউ কারো টাইমলাইনে নাও আসতে পারতাম।

সবকিছু অন্যরকম হত।

আমাদের জীবন, আমাদের বন্ধুত্ব, আর আমাদের শত্রুতা।

সেই অন্য জীবনে

হয়তো অনেক সুখ থাকত, হাহাকার থাকত না।

কিন্তু তেমন জীবন কি যাপন করার মত?

*

আমি ক্ষমা চেয়েছি, তুমি হয়তো করবে না।

ক্ষমা চাওয়া কঠিন

কিন্তু তারচেও অনেক বেশি কঠিন ক্ষমা করা।

*

কিছু লাইনে এসে মানুষের নিঃশ্বাস থেমে যায়।

লাস্ট লাইনটা সেরকম।

বিদায়।

ইরফানুর রহমান রাফিন

জন্ম ১০ এপ্রিল, ১৯৯২; লেখক, অনুবাদক, গবেষক। প্রকাশিত গ্রন্থ— চলে যাওয়া সময় [কবিতা, আনন্দম, ২০১৯ এক অসাধারণ অন্ধ সময়ের স্মৃতি [উপন্যাস, কাউন্টার এরা, ২০২০

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ভাষা
Scroll to Top