উৎসর্গ
গাজা গণহত্যার শিকার নারী, পুরুষ, ও শিশুদের
আমার ফিলিস্তিনি হৃদয়ের সাথে কথোপকথন
তুমি কি আমাকে লবনের মত ভালোবাসো?
না, আমি রাজার মেয়ে নই, আমি পুরুষ।
তাহলে?
পাগলের মত।
কেন?
কারণ আমি পাগল।
কতটুকু?
যতটুকু হলে কোন হাসপাতাল আমাকে নেবে না।
কেন?
ডাক্তারদের কামড় দিব, আর নার্সদের ভয় দেখাব।
তুমি খুবই অদ্ভুত।
কারণ আমি মাজনুন।
এর মানে কী?
জ্বিনগ্রস্ত।
জ্বিনগ্রস্ত হলে পরীগ্রস্ত হয় না কেন?
কারণ পরীদের ডানা থাকে ও পালিয়ে যায়।
আর?
তারা বলে, “তোমার মন খারাপ হলে আমার কিছু যায় আসে না।”
আর?
তারা বলে, “আমি তো তোমাকে কোন কথা দেইনি।”
আর?
তারা বলে, “শনিবার সকাল থেকে আমাকে ভুলে যেও।”
আমি পরী নই।
জানি।
তুমি কচু জানো।
জানি।
তুমি আসলেই একটা পাগল।
না, আমি একটা ভাল্লুক।
কেমন?
আমি মধু ভালোবাসি।
সুন্দরবনের?
না, নারীর।
আর?
তোমার চোখের।
আমার চোখে কোন মধু নেই।
কী আছে?
বিষাদ।
কেন?
কারণ আমার নিজেকে নির্বাসিত মনে হয়।
আমারও।
তাই?
হ্যাঁ, দারবিশেরও হত।
ফিলিস্তিন থেকে আসা প্রেমিক?
হ্যাঁ, তিনি নিজের ডানা পুড়িয়ে ফেলতে চেয়েছিলেন।
কিন্তু পারেননি, কারণ…
তিনি পাখি নন।
আই ক্যান ফীল হিম।
অ্যান্ড আই ক্যান ফীল সাঈদ।
সাঈদ?
উনার বোনের নাম রোজমেরি।
বোনের নাম জেনে কী করব?
তাও কথা ঠিক।
কেন মেহসুস কর সাঈদকে?
দারবিশ বলেছিলেন, নির্বাসন কোন ভূগোলের বই নয়।
তাহলে?
মানুষ নিজের ঘরেও নিজেকে নির্বাসিত ভাবতে পারে।
কবরেও।
মাতৃগর্ভেও কী পারে?
হয়তো, যেমন তৌফিক আর ডানার না-জন্মানো বাচ্চাটা।
কী হয়েছিল ওর?
গাজায় মায়ের পেটেই খুন হয়ে গেছে।
শহিদ হয়েছে বল।
শহিদ।
আমরা কতকাল গাজী হই না…
কতকাল…
আমাদের শুধু শহিদ আছে, সালাউদ্দিন আইয়ুবী নেই।
কোথাও কেউ নেই।
আইয়ুবী জেরুসালেমকে ভালোবাসত।
তুমিও তো বাসো।
আমার কান্না পায়।
কেন, তুমি কি পশ্চিম দেয়াল?
না।
আল আকসা?
না।
পবিত্র সমাধির গির্জা?
না।
তাহলে তুমি কে?
আমি ৭ লক্ষ ঘরে না ফেরা চাবি।
যারা?
যারা ৬০ লক্ষ লাশের নিচে চাপা পড়েছে।
আস্তে বলো, প্লিজ…
নইলে?
এডিএল শুনে ফেলবে।
তারপর?
তারপর তুমি এন্টাই-সেমিটিক বলে চিহ্নিত হবা।
তারপর?
তারপর এলি ভিজেলরা তোমার অনেক নিন্দামন্দ করবে।
এলি মরে গেছে।
জানি, ২০১৬ সালে।
না, ওর আত্মা আরো অনেক আগে মরে গেছিল।
আহা…
সে একদিন লিখেছিল…
কী লিখেছিল?
ভালোবাসার বিপরীত ঘৃণা নয়, ভালোবাসার বিপরীত নির্লিপ্ততা।
আর সেই কিনা…
ফিলিস্তিনিদের ব্যাপারে নির্লিপ্ত রয়ে গেছে সারাটা জীবন।
এলি এলি লামা সাবাখতানি…
কে, কে ওখানে?
নাজারেথের একটা লোক।
কী চায় সে?
ক্রুশে ঝুলে থাকতে ওর খুব কষ্ট হচ্ছে।
আর?
বেথলেহেমের ওর জন্য খুব কষ্ট হচ্ছে।
আর?
গালিলি, গালিলি…
কিন্তু আমাদের আর কীই বা করার আছে?
কিছু করার নেই।
মরে যাওয়া ছাড়া।
চারপাশে বৃষ্টির মত বোমা পড়ছে, তুমি দেখো…
হ্যাঁ।
আমরা কোথায় আছি?
একটা উদ্বাস্তু শিবিরে।
গাজায়?
হ্যাঁ।
অধিকৃত অঞ্চলে?
হ্যাঁ।
রাফা ক্রসিং দিয়ে মানবিক ত্রাণ ঢুকছে, না?
হ্যাঁ।
আচ্ছা, মৃত শিশুরা কি ত্রাণ খেতে পারে?
না।
একটু খেলে কী হয়?
চুপ করো।
খিদা লাগে তো অনেকক্ষণ না খেয়ে থাকলে।
চুপ করো।
নিজের মাংস নিজে ছিঁড়ে খেতে ইচ্ছা করে।
আল্লার দোহাই লাগে তুমি একটু চুপ করো।
না করব না।
কেন?
কারণ চুপ করলে আমি পাগল হয়ে যাব।
তুমি তো পাগলই।
না, আমি সাবরা শাতিলা উদ্বাস্তু শিবিরের ঘোড়া।
ঘোড়াগুলোকেও মেরে ফেলেছিল?
হ্যাঁ।
ঘোড়ারা কি মুসলমান?
জানি না।
আরব?
জানি না।
ঘোড়াদের কী দোষ, ওরাও কি সন্ত্রাসবাদী ছিল?
আমি জানি না, জানি না, জানি না।
আচ্ছা, অসলোতে কিন্তু শান্তি প্রতিষ্ঠা হয়ে গেছিল।
কবরের শান্তি।
ক্যাম্প ডেভিড সংলাপ…
তরবারির সাথে গর্দানের কোনদিন সংলাপ হয় না।
কানাফানি?
হ্যাঁ।
ওর ভাগনিটাকেও মেরে ফেলেছিল মোসাদ, তাই না?
হ্যাঁ।
কী অপরাধ ছিল?
সন্ত্রাসবাদী শিশু।
কে যেন বলেছিল…
ওদের গর্ভবতী নারীদের জবাই করা দরকার।
কেন?
ওদের পেট থেকে সন্ত্রাসবাদী শিশু বের হয়।
একেই কি বলে সভ্যতা?
হ্যাঁ।
ফিলিস্তিনি শিশুরা কোনদিন অ্যান ফ্রাঙ্ক হয় না।
ঠিক।
ওদের ডায়েরি নীলক্ষেতের ফুটপাতে বিক্রি হয় না।
ঠিক।
ওদের নিয়ে হলিউড কান্নাপ্রবণ সিনেমা বানায় না।
ঠিক।
বার্লিন দেয়ালের ইট দিয়ে বানিয়েছে সেপারেশন ব্যারিয়ার।
দেয়ালের ওপারের মানুষেরা…
তেল আবিবের মত সুখী।
অনেক মজা না?
হ্যাঁ, অনেক মজা।
অনেক জ্ঞান?
অনেক।
অনেক আলো?
অনেক।
আর অন্যদিকে?
ফিলিস্তিন।
যা মানচিত্র থেকে মুছে যাচ্ছে?
প্লিজ থামো।
সব শিশুরা খুন হয়ে যাচ্ছে?
থামো।
না, থামব না।
কেন?
ওরা কোনদিনও ফিলিস্তিনকে মুছে ফেলতে পারবে না।
কীভাবে?
ফিলিস্তিন মানে জেরুসালেম।
আর?
জেরুসালেমের মৃত্যু নেই।
আর?
মানুষ যেখানেই যায়, জেরুসালেমকে সাথে নিয়ে যায়।
চলো।
কোথায়?
আমি জানি না।
আমিও জানি না।
কিন্তু তুমি জানো…
আর আমিও জানি…
জর্দান নদী থেকে ভূমধ্যসাগর পর্যন্ত
ফিলিস্তিনের প্রতিটি কমলা গাছের কাছে ওয়াদা করলাম
হাবাশ!
ফিলিস্তিনের প্রতিটি জলপাই গাছের কাছে ওয়াদা করলাম
হাবাশ!
ফিলিস্তিনে জন্মানো প্রতিটি কিশলয়ের কাছে ওয়াদা করলাম
হাবাশ!
আমরা লড়াই চালাব
আমরা লড়াই চালাব
আমরা লড়াই চালাব
বছরের পর বছর
দশকের পর দশক
শতাব্দীর পর শতাব্দী…
*
তুমি আমাকে কিসের মত ভালোবাসো?
আমি তোমাকে ফিলিস্তিনের মত ভালোবাসি।
হিন্দ রাজাব আক্ষরিক অর্থেই একটা ছোট মানুষ
একটি মিসড কলের জন্য এলিজি
৫ বছরে কতটাই বা বড় হওয়া যায়?
উত্তর গাজা থেকে একটা গাড়িতে করে সে
যাচ্ছিল রাফায়!
সেই গাড়িতে আরো চারটা ছোট মানুষ ছিল
বড় মানুষদের সাথে
নেভার এগেইনদের গুলির মুখে গাড়িটা আটকে গেল।
ফাঁদে আটকে পড়া একটা ইঁদুরের মত
আতঙ্কে অবশ হয়ে
সাহায্যের জন্য কল করল হিন্দ রাজাব।
“আসো আমাকে নিয়া যাও। আমারে এসে নিয়া যাবা না তোমরা? আমার খুব ভয় লাগছে, প্লিজ আসো।”
কেউ আসে নাই। ১২ দিনেও। কেউ না।
সুখের খবর হচ্ছে, কলটা রেকর্ড করা হয়েছে।
দুঃখের খবর হচ্ছে, কলদাতা আর বেঁচে নেই।
আরেকটা দিন গেলেই
জীবিত সুখী মানুষদের পৃথিবী ভালোবাসায় ভরে উঠবে
আর বসন্ত উৎসবে।
সেই সবকিছু থেকে অনেক, অনেক, অনেক দূরে
একটা আতঙ্কে অবশ হয়ে যাওয়া ছোট মানুষ
অপেক্ষায় থাকবে, কেউ এসে তাকে নিয়ে যাওয়ার।
ওর খুব ভয় লাগছে। কেউ আসো। প্লিজ।
দ্বিতীয় নাকবার দিনগুলিতে একটি ঘরে ফেরার গান
জিগার,
আমার মিষ্টিতম বন্ধু
আমার সুন্দরতম দুঃখ…
তোমার চোখগুলো আমাকে মনে করিয়ে দেয় জেরুসালেম
তোমার দীর্ঘশ্বাসগুলো আমাকে মনে করিয়ে দেয় আল-আকসা
তোমার অশ্রুগুলো মানচিত্র থেকে মুছে ফেলা দেশ…
আমি তোমাকে ভালোবাসি
জাবালিয়া শরণার্থী শিবিরের লোকেরা যেমন ফিলিস্তিনকে বাসে
দেশ হারিয়ে ফেলার পরও…
আমি তোমাকে ভালোবাসি
ধ্বংসস্তূপে চাপা পড়া শিশুরা যেমন ফিলিস্তিনকে বাসে
শ্বাস থেমে যাওয়ার পরও…
বিবি নেতানিয়াহুর হাতগুলো
ধবংস হোক আর ধ্বংস হোক সে নিজে
আমরা, আমরা, ১৪০০ বছর ধরে অভিশাপ দিব
যেন তেল আবিব একদিন তলিয়ে যায় ভূমধ্যসাগরে
কবর থেকে তুলে আনব নাকবায় হারানো গ্রামগুলো
যাতে লোকেরা একদিন ঘরে ফিরতে পারে
শিশুরা মায়ের বুকে…
তুমি একটা অসুখী কমলা গাছ পেরিয়ে যাও
আমি একটা ক্লান্ত তরমুজ ক্ষেত পেরিয়ে যাই
গ্রিক লোকটার ভাষায়, “দুই দেহ, এক আত্মা।”…
আমি তোমাকে ভালোবাসি — নদী থেকে সাগর অবধি।