আমি জলদি নিজের গ্লাসটা নিয়ে চুমুক দিলাম। জিনিসটা পুরো পানসে লাগল। তবে সেটা দেখাতে চাচ্ছিলাম না। ভাবছিলাম যে বাবার সাথে যদি শরবতের স্বাদ নিয়ে ভালো ভালো কথা বলি, তবে হয়ত সে ভুলেই যাবে যে সে জাজাকে এখনো শাস্তি দেয়নি।
“এটা খুব ভালো খেতে, বাবা,” আমি বললাম।
বাবা ওটা মুখে নিয়ে তার স্ফীত গালের মধ্যে ঘুরিয়ে গিলে ফেলে বলল, “হ্যাঁ, হ্যাঁ।”
” একদম তাজা কাজুর মত স্বাদ,” মা বলল।
কিছু বল, মুখটা খোল, আমি জাজাকে বলতে চাইছিলাম। ওর এখনই কিছু বলা উচিত, আলোচনায় যোগ দেয়া উচিত, বাবার ফ্যাক্টরির খাবারের প্রশংসা করা উচিত। আমরা সবসময় তাই করি যখন কোনো কর্মচারী বাবার ফ্যাক্টরির কোনো পণ্যের স্যাম্পল নিয়ে আসে।
“একদম সাদা ওয়াইনের মত,” মা আবার বলল। মা ভয় পেয়েছিল, আমি তা বুঝতে পারছিলাম। শুধু এজন্য নয় যে সতেজ কাজু কখনোই সাদা ওয়াইনের মত খেতে লাগে না, বরং এইজন্য যে মায়ের গলা স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি হালকা শোনাচ্ছিল। “সাদা ওয়াইন”, মা চোখ বুজে যেন আরও ভালোভাবে স্বাদ নিতে চাইছে এমনভাবে আবার বললো, “রসালো সাদা ওয়াইন।”
” হ্যাঁ”, আমি বললাম। বলতে বলতে আমার হাত থেকে একটা ছোট ফুফুর গোল্লা টুপ করে স্যুপের মধ্যে পড়ে গেল।
বাবা একদম স্পষ্ট চোখে এবার জাজার দিকে তাকালো৷ “জাজা, তুমি তো আমাদের সাথে শরবতটা খেলে না? তোমার মুখে কোনো কথা নেই?”, সে জিজ্ঞেস করল, পুরোটাই ইগবুতে। খুব খারাপ লক্ষণ। বাবা ইগবুতে কথা প্রায় বলেই না। যদিও আমি আর জাজা বাড়িতে মায়ের সাথে ইগবুতে কথা বলি, কিন্তু বাইরে কখনোই না। বাবা একদমই পছন্দ করে না। বাইরে ভদ্র ভাষায় কথা বলতে হবে, সে আমাদের বলত। তাই বাইরে আমরা সবাই ইংরেজিতে কথা বলতাম।
বাবার বোন, ইফিওমা ফুপু একবার বলেছিল যে বাবা আগাগোড়াই একটা ঔপনিবেশিক দ্রব্য। সে এটা বলেছিল একটা মৃদু ক্ষমাশীল ভঙ্গিতে যেন এতে বাবার কোন দোষ নেই। যেন সে এমন এক লোকের ব্যাপারে বলছে যে কিনা ম্যালেরিয়ায় মরণাপন্ন হয়ে ভুলভাল প্রলাপ বকে চলেছে।
” তোমার কিছু বলার নেই? জাজা?”, বাবা আবার জিজ্ঞেস করল।
” না, আমার মুখে কোনো কথা নেই,” জাজা বলল।
” কি?”, বাবার চোখে একটা কালো মেঘের মত ছায়া নেমে এলো, যে ছায়াটা এতক্ষণ জাজার চোখে ছিল। ভয়, ভয়ের ছায়া। যেটা এখন জাজার চোখ ছেড়ে বাবার চোখে ঢুকে গেছে।
” আমার কিছুই বলার নেই,” জাজা বলল।
” শরবতটা ভালোই খেতে….” মা বলতে শুরু করল। আর ঠিক তখনই জাজা চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল।
” ধন্যবাদ ঈশ্বর, ধন্যবাদ বাবা, ধন্যবাদ মা।”
আমি ওর মুখটা ঠিকমতো দেখতে ঘাড় ঘোরালাম। ধন্যবাদটা ও ঠিকভাবেই দিচ্ছিলো, যেভাবে প্রতিবার খাবার শেষে দেয়। কিন্তু একইসাথে ও সেটাও করছিল যেটা আমরা কখনোই করি না। ও বাবার খাবার শেষে করা প্রার্থনার আগেই টেবিল ছেড়ে উঠে যাচ্ছিল।
” জাজা!” বাবা বলল। ছায়াটা বাড়তে বাড়তে যেন বাবার চোখের সাদা অংশটাকেও গ্রাস করতে চাইছে। জাজা নিজের প্লেট হাতে নিয়ে ডাইনিং রুমের বাইরে চলে যাচ্ছিল। বাবা উঠে দাঁড়াতে গিয়েও ধপ করে নিজের জায়গায় আবার বসে পড়ল। বুলডগের মত তার গালদুটো ঝুলে পড়েছিল। আমি আমার গ্লাসটা নিয়ে শরবতটার দিকে তাকিয়ে রইলাম, পানসে হলুদ, প্রস্রাবের মত। পুরোটা গলায় ঢেলে একবারেই খেয়ে নিলাম। কি করব বুঝতে পারছিলাম না। এমন ঘটনা আমার পুরো জীবনে কখনো ঘটেনি, কোনদিন না। বাড়ি ঘিরে দাঁড়িয়ে থাকা দেয়ালটা চূর্ণ হয়ে যাবে, আমি নিশ্চিত ছিলাম, ওটা ভেঙেচুরে কাঠগোলাপ গাছগুলোকেও ধ্বংস করে দেবে। আকাশ মিলিয়ে যাবে। চকচকে মার্বেলের মেঝের ঘষাদাগ ঢাকতে পেতে রাখা পুরু ইরানি চাদরটা কুচকে সংকুচিত হয়ে যাবে। কিছু একটা তো হবেই।
কিন্তু হওয়ার মধ্যে এই হলো যে আমার গলায় খাবার আটকে গেল। কাশির দমকে আমার পুরো শরীর কেপে উঠল। বাবা মা ছুটে এলো। বাবা আমার পিঠে চাপড় মারতে লাগল আর মা আমার কাঁধ ঘষতে ঘষতে বলল, ” ও সোনা, কাশি বন্ধ কর।”
ওইদিন সন্ধ্যায় আমি বিছানাতেই রইলাম আর সবার সাথে রাতের খাবার খেলাম না। আমার ঠান্ডা লেগে গেল আর গালের তাপে হাতের ওপরের অংশ যেন প্রায় পুড়েই উঠলো। আমার মাথার মধ্যে হাজারটা রাক্ষস একটা কষ্টকর লোফালুফি খেলা খেলছিল। কিন্তু বলের জায়গায় ওগুলো একটা খয়েরি চামড়ায় বাঁধানো ধর্মগ্রন্থ একে অন্যের দিকে ছুঁড়ে দিচ্ছিল। বাবা আমার ঘরে এলো। সে এসে বসায় আমার তোষকটা বিছানার আরও গভীরে সেঁধিয়ে গেল। বাবা বসল, আমার গালে হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করল আমার কিছু লাগবে কিনা। মা আমার জন্য ওফে নসালা তৈরি করছিল। তাই আমি না বললাম আর তারপর দুজনে চুপচাপ বসে রইলাম, আমাদের হাত অনেকক্ষণ ধরে পরস্পরকে আঁকড়ে রইল। বাবার নিঃশ্বাসে সবসময়ই খুব শব্দ হত, কিন্তু এখন সে এতটাই হাঁপিয়ে নিঃশ্বাস নিচ্ছিলো যেন তার দম আটকে আসছে। আমি ভাবছিলাম যে বাবা কি ভাবছে, হয়ত মনে মনে বাবা দৌড়োচ্ছে, কোনকিছু থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে নেবার চেষ্টা করছে। আমি বাবার মুখের দিকে তাকালাম না, কারণ আমি তার মুখের প্রতিটি ইঞ্চিতে ছড়িয়ে থাকা ঘামাচিগুলো দেখতে চাইছিলাম না। ওগুলো ছিলো অসংখ্য, এতটাই সমানভাবে ছড়ানো যে বাবার পুরো মুখটাই ফুলে ঢোল হয়ে থাকত।
মা কিছুক্ষণ পর আমার জন্য ওফে নসালা নিয়ে এলো,কিন্তু ওই সুগন্ধি স্যুপটা আমার বমিভাবটাকেই আরও উসকে দিল। বাথরুমে গিয়ে বমি করার পর আমি মাকে জিজ্ঞেস করলাম জাজা কোথায়। ওকে দুপুরের পর আর দেখিনি, আমায় দেখতেও আসেনি। “ওর ঘরে আছে, রাতের খাবার খেতে নিচে আসেনি।” মা আমার চুলের বেনিতে হাত বোলাতে লাগল, এটা করতে সে পছন্দ করত। যেন দেখতে চাইত কিভাবে আমার মাথার বিভিন্ন অংশের চুল মিশে এক হয়ে আছে। সামনের সপ্তাহ অব্দি সে বেনি করতেই থাকবে। আমার চুল খুব ঘিঞ্জি, মা চিরুনি চালানোর পর চুলগুলো সব মাথার পেছনে শক্ত ঝোঁপের মত হয়ে থাকে। এখন চুলে চিরুনি চালানোর চেষ্টা আমার মাথার ভেতরের রাক্ষসগুলোকে আরও ভয়ংকর করে তুলবে।
” তুমি কি আগের মূর্তিগুলোর জায়গায় নতুন মূর্তি আনবে?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।
আমি তার হাতের নিচের শুষ্ক ডিওড্রেন্টের গন্ধ পাচ্ছিলাম। তার দাগহীন খয়েরি মুখ ছিলো অনুভূতিহীন, যেখানে কিনা নতুন একটা কাটা দাগ দেখা যাচ্ছিলো কপালে। “না”, সে বলল, ” আমার আর নতুন দরকার নেই।”
সম্ভবত মা বুঝতে পেরেছিল যে মূর্তিগুলোর আর প্রয়োজন হবে না ; যে যখন বাবা ধর্মগ্রন্থটা জাজার দিকে ছুঁড়ে দিয়েছিল, তখন শুধু মূর্তিগুলো নয়, সবকিছুই ভেঙে নিচে পড়ে গেছে। আমিই শুধু এত দেরিতে বুঝতে পারছি সব, এখন নিজেকে এ ব্যাপারে ভাবতে দিচ্ছি।
মা চলে গেলে আমি বিছানায় শুয়ে পড়লাম আর আমার মন অতীতের গহবরে ঢুকে পড়ল, সেইসব বছরগুলোর অলিগলিতে যখন জাজা, মা আর আমি নিজেদের মধ্যে মুখে কম, মনে মনেই বেশি কথা বলতাম। এনসুকায় যাবার আগ অব্দি, এনসুকাতেই সব শুরু হলো। ইফিওমা ফুপুর এনসুকার ফ্ল্যাটবাড়ির বারান্দার সামনের ছোট্ট বাগানটা মৌনতায় ছেদ টেনে দিতে শুরু করলো। জাজার প্রকাশ্য অবাধ্যতা মনে হতে লাগল ঠিক যেন ইফিওমা ফুপুর পরীক্ষামূলক বেগুনি জবার মত ; দুষ্প্রাপ্য, স্বাধীনতার প্রচ্ছন্ন ঘ্রাণ ছড়িয়ে দেয়া। এমন স্বাধীনতা যেটা কিনা অভ্যুত্থানের পরে গভর্নমেন্ট স্কয়ারে দাঁড়িয়ে সবুজ পাতা নেড়ে জনতার জপ করা স্বাধীনতা বোধের থেকে আলাদা। অস্তিত্বের স্বাধীনতা, কাজের স্বাধীনতা।
কিন্তু আমার স্মৃতির শুরু এনসুকোতে নয়। এর শুরু আরও আগে, যখন আমাদের সামনের উঠোনের সব জবাগুলো টকটকে লাল ছিল।
(চলবে —)