আমাদের মঞ্চনাটক মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফসল – একথা মঞ্চকর্মী এবং দর্শক উভয়ই জানেন এবং বিশ্বাস করেন।
এই ভূখণ্ডে নাট্যচর্চার ইতিহাস হাজার বছরের বলা হলেও, স্বাধীন বাংলাদেশে নবনাট্য আন্দোলনের পথচলা স্বাধীনতার হাত ধরেই এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করেই। এখানে যারা পথিকৃৎ তারা সবাই বীর মুক্তিযোদ্ধা। স্বাধীন কিন্তু বিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনে তারা হাতে তুলে নিয়েছিলেন শক্তিশালী এই শিল্পমাধ্যমকে, মন দিয়েছিলেন মঞ্চনাটকের সংস্কারে। আর তাই শত প্রতিকূলতার মধ্যেও বাহাত্তরেই শুরু হতে পেরেছিলো দর্শনীর বিনিময়ে নিয়মিত নাট্যচর্চা। কালে আমাদের মঞ্চনাটক হয়ে উঠেছে শিল্প আর দ্রোহের অনন্য এক মেলবন্ধন। থিয়েটার বা মঞ্চনাটক এদেশে শিল্পের গণ্ডি ছাড়িয়ে রুপ নিয়েছে নাট্য আন্দোলনে।
জাতির যেকোন ক্রান্তিলগ্নে মঞ্চনাটক এবং এর কর্মীদের দ্বিধাহীন ও বিশেষ ভূমিকা পালন করতে দেখা গেছে। মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও চেতনাকে নতুন প্রজন্মের মধ্যে সঞ্চারিত করতে এবং প্রতিবাদ-প্রতিরোধে মঞ্চনাটক হয়ে উঠেছে সমাজ, রাষ্ট্র ও জাতির চির জাগ্রত মননে। এবং এসব নাটকে অবধারিতভাবে উঠে এসেছে মুক্তিযুদ্ধ।
মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে যেমন মৌলিক নাটক রচিত হয়েছে, তেমনি দেশি সাহিত্য নির্ভর ও ভিনদেশি নানা নাটক-গল্প-উপন্যাস অবলম্বনেও অনেক নাটক রচিত ও মঞ্চায়িত হয়েছে। এবং এখনও হচ্ছে। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম পাঁচ বছরেই রচিত হয়েছে প্রায় পঞ্চাশটি বাংলা নাটক। এদের সবগুলোই হয়তো মহৎ রচনা বা শিল্পোত্তীর্ণ নয়, তবে এর পেছনের আবেগ এবং দায়কে অস্বীকার করা যায় না।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সফল ও জনপ্রিয় নাট্যকারদের মধ্যে অন্যতম সাঈদ আহমেদ, আল মনসুর, মমতাজ উদদীন আহমেদ, রণেশ দাশগুপ্ত, পংকজ বিভাস, এস এম সোলায়মান, জিয়া হায়দার, আলাউদ্দিন আল আজাদ, সৈয়দ শামসুল হক, ড. সেলিম আল দীন, আবদুল্লাহ আল মামুন, মামুনুর রশীদ, ড. ইনামুল হক, গোলাম সারোয়ার, মান্নান হীরা প্রমুখ। মঞ্চে মুক্তিযুদ্ধকে নিয়ে নতুনভাবে ভাবনা, ভিন্ন ভিন্ন দিক থেকে দেখা, গবেষণা এবং তার শিল্পিত প্রয়োগ এখন সময়েরই দাবী।
বিজয়ের পঞ্চাশ বছরে নাট্য আন্দোলন এবং স্বাধীনতাকে এক সুতায় গেঁথে তৈরী করতে হবে মালা। তাতে বেঁচে থাকবে মহান মুক্তিযুদ্ধের সবচে’ উর্বর এই অর্জন। আর তাতে এগিয়ে আসতে হবে রাষ্ট্রকেই। গড়ে তুলতে হবে নাট্য কর্মকাণ্ডের অনুকূল পরিবেশ, জাতীয় বাজেটে রাখতে হবে ন্যায্য বরাদ্দ, বাঁচিয়ে রাখতে হবে নাট্য কর্মীদের। অবকাঠামোও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। প্রায় সতের কোটি মানুষের দেশে প্রতিটি জেলায় অন্তত একটি আধুনিক নাট্যগৃহ তৈরী করতে হবে যার দেখভাল ও আবাদ করতে দিতে হবে নাট্যকর্মীদের। আর প্রায় এককোটি মানুষের নগরী রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন প্রান্তে তৈরী করতে হবে অন্তত: আরো ত্রিশটি বিভিন্ন মাপের আধুনিক নাট্যকেন্দ্র।
বাংলাদেশের নাট্য আন্দোলনের অন্যতম অনুসঙ্গ পথ নাটকের কথাও মাথায় রাখতে হবে। তবে প্রথমদিকের পথনাটক ও মঞ্চনাটক যেভাবে দর্শককে দেশাত্মবোধের চেতনায় আন্দোলিত করেছে, সময়ের সাথে সেই ধার অনেকটাই স্তিমিত হয়েছে। নতুন নতুন বিষয়ের, সামাজিক এবং বৈশ্বিক সমস্যার অবতারনা এবং তরুণ প্রতিশ্রুতিশীল নাট্যকারের অভাব এক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করেছে। যাপিত জীবনের বর্ধিত গতি এবং নাট্য কর্মকাণ্ডের পুরনো এবং নতুন প্রতিকূলতাও দায়ী। তবে শত প্রতিকূলতার পরও নাট্য কর্মীদের নিরলস পরিশ্রম ও প্রাপ্তিযোগহীন অবর্ণনীয় কষ্টকর যাত্রা এখনও টিকিয়ে রেখেছে বাংলাদেশের মঞ্চনাটককে। আর নিরন্তর বহন করছে মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার চেতনা।