`থিয়েটার অব এনার্কি’ ধারনার প্রতিধ্বনি নাটক হাওয়ার্ড জিনের এমা II মোস্তফা কামাল যাত্রা

৬০ এর দশকের প্রারম্ভে এক কনফারেন্স এ যোগ দিতে গিয়ে ইতিহাসবিদ রিচার্ড ড্রেনোন এর সাথে পরিচয় ঘটে এমা নাটকের নাট্যকার ইতিহাসবিহাদ হাওয়ার্ড জিনের। রিচার্ডের সাথে আলাপচারিতায় জিন প্রথম শোনেন এমা গোল্ডম্যানের নাম। জিনকে ড্রেনোন জানান যে, তিনি এমাকে নিয়ে একটি জীবনীগ্রন্থ রচনা করেছেন। যার শিরোনাম রিবিল ইন প্যারাডাইস
মূলত এমা আমেরিকার ইতিহাসের এক অন্যতম প্রধান নারী। যার রাজনৈতিক দর্শন হলো এনার্কিজম। একজন বিস্ময়কর নারী হিসাবে, একজন এনার্কিস্ট হিসাবে তার সমকালের একজন অত্যাবশ্যক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হলেও; আমেরিকার প্রচলিত ইতিহাসে তিনি অন্তর্ভুক্ত নন। প্রাতিষ্ঠানিক ইতিহাস চর্চায় এমার নাম উচ্চারিত না হওয়া বা সংরক্ষিত না থাকলেও সমাজবিশ্লেষক হিসাবে বিশেষ করে রাজনৈতিক দর্শন এনার্কিজম আলোকপাত করতে গেলে এনার্কিস্ট এমাকে অস্বীকারের সুযোগ নেই।

আমেরিকার ইতিহাসের অনিবার্য সত্য লুডলো হত্যাযজ্ঞ, লরেল টেক্সটাইল ধর্মঘট, হে মার্কেট ঘটনাক্রম এবং সমকালের অন্যতম রাজনৈতিক নেতৃত্ব মাদার জোনস, বিগ বিল, হে ইউড, জন রিড এর কর্মযজ্ঞ যেমন ইতিহাসের পাতায় স্থান পায়নি তেমনি এমা গোল্ডম্যান এর জীবন ও দর্শন আমেরিকার প্রাতিষ্ঠানিক ইতিহাস এবং প্রাতিষ্ঠানিক কারিকুলামেও স্থান পায়নি। আর এটাই স্বাভাবিক। কারণ বিপ্লবী, শ্রমিক নেতা, সমাজতন্ত্রী, এনার্কিস্টগণ বরাবরই প্রচলিত ইতিহাসে অনউল্লেখিত থাকে। পাঠ্যক্রমে গুরুত্ব নিয়ে আলোকপাত হয় সমরনায়ক, শিল্পপতি আর রাষ্ট্রপ্রধানদের জীবন ও জীবনাচার।

গতানুগতিক অর্থডক্স রাজনৈতিক তত্ত্বের বিপরীতে এনার্কিজম-দর্শন বুঝতে হলে প্রয়োজন রাশিয়ান এনার্কিস্ট মিখাইল বুুখারিন এবং পিটার ক্রপোটকিন রচিত প্রবন্ধ-নিবন্ধের নিবিড় পঠন-পাঠন। প্রাসঙ্গিক আর অবশ্য পাঠ্য রচনা হলো ‘নো হয়ার এট হোম’ শিরোনামে আনা মারিয়া ড্রেনোন এবং রিচার্ড ড্রেনোনের যৌথ সৃজন পাঠ করা। এই গ্রন্থনাটি মূল আলেকজান্ডার বার্কম্যান ও এমা গোল্ডম্যানের মধ্যে বিনিময় হওয়া চিঠিপত্রের সমাহার ও সংশ্লিষ্ট বিশ্লেষণ । প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শুরুতে আমেরিকা থেকে নির্বাসিত হয়ে ইউরোপে আশ্রয় নেওয়া সময়কালে পরস্পরকে লেখা চিঠিপত্রের এই সংকলন এমা গোল্ডম্যানকে বুঝা বা উপলব্ধি করার জন্য এক বিরল দলিল। যা বিশ্বসাহিত্যে অসামান্য পত্রসাহিত্য হিসাবে পরিগণিত।

এমা গোল্ডম্যানের আত্মজীবনী লিভিং মাই লাইফ পাঠ না করলে একজন এনার্কিস্ট হিসাবে এমা’র জীবন ও রাজনৈতিক বিশ্বাসকে অনুধাবন করা কঠিন। লিভিং মাই লাইফ গ্রন্থে এমা’র বৈচিত্রময় জীবন ও জীবন দর্শনের নানাদিক যেমন ফুটে উঠেছে তেমনি সমকালীন সমাজ বাস্তবতা ও আর্থ-মানসিক পরিস্থিতি চিত্রিত হয়েছে চমৎকারভাবে।

তৎকালীন রাশিয়ার অধীনস্থ লিথুনিয়ার কভনোতে এক দরিদ্র ইহুদি পরিবারে এমার জন্ম । দারিদ্রতার কষাঘাতের দুঃখময় স্মৃতি এবং কৈশোর বেলার প্রথম যৌন অভিজ্ঞতার আবেগঘন বর্ণনার পাশাপাশি কোনিংসবার্গে বেড়াতে গিয়ে অপেরায় ভার্দির কনসার্ট উপভোগকালে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠার স্মৃতিচারণ করেছেন এমা সাবলীল ভাষায়। মিলনায়তনপূর্ণ দর্শক-শ্রোতাদের মাঝে তার সেই বেদনা-বিধূর অনুভূতি প্রকৃতপক্ষে এমার অন্তরাত্মার এক মানবীয় দিক।

হাওয়ার্ড জিন রচিত এমা নাটকের বাংলা অনুবাদ করেছেন লিটলম্যাগ লেখালেখির উঠান এর সম্পাদক মাজহার জীবন। তিনি ইতোমধ্যে সাহিত্য কর্মে, সৃজনে প্রকাশনা জগতে একটি নিজস্ব অবস্থান গড়ে তুলেছেন। নাটকটিতে রাশিয়া থেকে যুক্তরাষ্ট্রে স্ব-পরিবারে এমার ইহুদি পরিবারের অভিবাসী হওয়ার সময়কাল থেকে তার আমেরিকা থেকে বহিস্কার হওয়ার আগ পর্যন্ত ঘটনাক্রম, তথ্য-উপাত্ত ব্যবহৃত হয়েছে। নিউইয়র্ক এবং রোচেস্টার শহরে প্রাথমিক অবস্থায় তার পারিবারিক জীবন অতিবাহিত হয়। বদ মেজাজী পিতার অনুগ্রহ থেকে বাঁচার জন্য অল্প বয়সেই স্থানীয় এক যুবককে সে বিয়ে করে পিতার পরিবার থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করেছিল। যদিও সে জীবন সুখের ছিল না। মাত্র ১৬ বছর বয়সেই তাকে যোগ দিতে হয়েছিল কাজে। বাবার বিদ্বেষপূর্ণ আচরণ থেকে মুক্তি এবং স্বামীর অনুগ্রহের পাত্র না হয়ে থাকার মানসিকতা বালিকা এমার জীবনে উন্মেষ ঘটায় নতুন জীবনবোধ।

একজন পোশাক শ্রমিক হিসাবে কর্মজীবন শুরু করা এমা ১৭ বছর বয়সেই অবগত হয় ১৮৮৬ খ্রিষ্টাব্দে আমেরিকার শিকাগো শহরে আটঘন্টা শ্রমঘন্টার দাবিতে হওয়া শ্রমিক আন্দোলন এবং হে মার্কেটকেন্দ্রিক ঘটে যাওয়া ঘটনাবলীর ইতিবৃত্ত। রোচেস্টার শহরের যে ফ্যাক্টরিতে এমা কর্মরত ছিল; সেখানকার কর্ম অভিজ্ঞতা এবং মালিক ও মালিক পক্ষ কর্তৃক শ্রমিকদের উপর যে নির্যাতন চলমান ছিল; যা তাঁকে ক্ষুব্ধ-বিক্ষুব্ধ করে তুলেছিল। ফলে তার মন ও মানস গড়ে ওঠে একজন শ্রমজীবীর আত্মোপলোব্ধির আলোকে।

হে মার্কেট আন্দোলনের সাথে সংশ্লিষ্ট শ্রমিকদের উপর ইন্টারন্যাশনাল হার্ভেস্টার কোম্পানির প্ররোচনায় পুলিশ কর্তৃক হওয়া নৃসংশতা এবং রহস্যজনক বোমা বিস্ফোরণে মৃত্যুবরণকারী পুলিশ ও শ্রমিকদের হত্যার দায় আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারীদের উপর চাপিয়ে দিয়ে আদালতের মিথ্যা রায়কে আইনি ভিত্তি দিয়ে ৮জন শ্রমিককে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ হয়েছিল। এই আন্দোলনের সাথে সংশ্লিষ্টদের সমর্থনে তৎকালীন এনার্কিস্টদের দ্বারা প্রচারিত “রিভেঞ্জ” নামের সার্কুলার বিদ্বেষমূলক পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছিল বলে বিচারক ও রাষ্ট্রপক্ষের অবস্থান তরুনী এমার মানসপটে নতুন ক্ষতের জন্ম দেয়।

পারিবারিক বিচ্ছিন্নতা ব্যক্তিগত জীবনের অস্থিরতা এবং পেশাগত জীবনের সংক্ষুদ্ধতা এমা গোল্ডম্যানের শ্রেণি চেতনা ও রাজনৈতিক মানস গঠনে রেখেছিল অগ্রগন্য ভূমিকা। তিনি রোচেস্টার শহরে থাকা পরিবার পরিজন ছেড়ে চলে যান নিউইয়র্ক শহরে। পরিচিত হন কয়েকজন নবীন এনার্কিস্টের সাথে। যাদের মধ্যে অন্যতম হলেন আলেকজান্ডার বার্কম্যান বা সাশা। সাশার সাথে এমার প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে।

সাশা ছিলেন নতুন সমাজ গড়ার প্রত্যয়ে প্রত্যয়ী এক তরুণ। যিনি কিনা নিজেও আসেন আমেরিকায় একজন রাশিয়ান অভিবাসী হিসাবে। তরুণ এই দুই এনার্কিস্ট (সাশা ও এমা) এই সময়কালে এনার্কিজমের অন্যতম প্রচারক জার্মান সাংসদ বিপ্লবী জোহান মোস্টের সাথে পরিচিত হন। এই মোস্টের সাথে এমা এক সময় ব্যক্তিগত সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে। যা নিয়ে সাশা এবং এমার মধ্যে সৃষ্টি হয়েছিল ব্যক্তিগত দূরত্ব। দ্বিমুখী ব্যক্তিগত সম্পর্কের কারণে মোস্ট ও সাশার সাথে ব্যক্তিগত টানাপোড়েন থাকলেও এনার্কিজম প্রমোশনে তারা সকলেই ছিলেন একাট্টা এবং অঙ্গীকারাবদ্ধ। প্রবাসী শ্রমিকদের সংগঠিত করে এনার্কিজমের দীক্ষা দিতেন তারা। ম্যানহাটন শহরের একটি ফ্যাক্টরিতে চাকুরী নিয়ে এমা সেখানে কর্মরত নারী শ্রমিকদের এনার্কিস্ট হিসাবে গড়ে তুলতে থাকেন।

হাওয়ার্ড জিন রচিত নাটকের সুচনা হয় ফ্যাক্টরিতে কর্মরত নারী শ্রমিকদের মধ্যে কর্ম পরিবেশ ও কর্মকর্তাদের অমানবিক আচরণের প্রসঙ্গ নিয়ে কথোপকথনের মধ্য দিয়ে। যা নাট্যকাহিনীর সূত্রপাত ঘটায়। নাটক এগিয়ে চলে এমার কর্মময় জীবন ও ব্যক্তিগত বৈচিত্রময় চারিত্রিক নানান দিকের প্রেক্ষিতকে তুলে ধরার পরম্পরার ধারাবাহিকতায়।

১৮৯২ খ্রিস্টাব্দে পেনসিলভেনিয়ার অন্যতম শহর হোমস্টিড এ ধর্মঘটি শ্রমিকদের আন্দোলনের তীব্রতাকে দমন করতে ধর্মঘট দমনে সমকালের অন্যতম এজেন্সি ফ্রিক পিঙ্কারটন ডিটেকটিভকে নিযুক্ত করা হয়। এন্ড্রু কার্নেগির স্টিল মিলের বিরুদ্ধে অনুষ্ঠিত সেই শ্রমিক ধর্মঘটকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য আন্দোলনরত শ্রমিকদের উপর গুলিবর্ষণ করা হলে ৭জন শ্রমিক নিহত হয়।
১৮৯৩ খ্রিস্টাব্দে শুরু হয় ভয়ংকর অর্থনৈতিক মন্দা। শত শত শিশু এই মন্দায় না খেয়ে মারা যায়। আলোচ্য নাটকের কেন্দ্রীয় চরিত্র এমা গোল্ডম্যান এই সময়কালে সাধারণ মানুষকে মন্দার কার্যকারণ বিষয়ে সচেতন করতে সচেষ্ট ছিলেন। খাদ্য গুদাম লুট করতে ভূক্তভোগী মানুষকে উৎসাহিত করতে এমা সভা-সমাবেশে বক্তব্য রাখতে শুরু করেন। যা এনার্কিস্ট মুভমেন্টের ইতিহাসে ‘ডাইরেক্ট একশন’ নামে স্বীকৃত। এ পর্যায়ে এনার্কিস্টগণ সিদ্ধান্ত নেয় যে, মন্দার শিকার মানুষ ও ধর্মঘটি শ্রমিকদের উপর নিষ্ঠুর আচরণের নেপথ্যপুরুষ হেনরী ক্লে ফ্রিককে হত্যা করা হবে। এই প্রতিশোধমূলক হত্যা পরিকল্পনার লক্ষ্য ছিল এটা প্রমাণ করা যে, কল-কারখানাগুলো তাদের মালিকদের জন্য নিরাপদ নয়। আতঙ্ক সৃষ্টির মাধ্যমে বিশ্ববাসীকে জানান দেওয়া যে- কেউই বাঁচাতে পারবে না। এই হত্যাচেষ্টা অসফল হলেও আলেকজান্ডার বার্কম্যান ধরা পড়ে এবং বিচারে তার ২২ বছরের সাজা হয়।
জেল জীবনের অভিজ্ঞতাকে নিয়ে সাশা একটি ক্লাসিক কারাসাহিত্য রচনা করেন। যার শিরোনাম হল- প্রিজন মেমোর’র অব এন এনার্কিস্ট। সাশা যখন জেলে তখন এমা শ্রমিক আন্দোলনের একজন অন্যতম সংগঠকে পরিণত হয় এবং একজন এনার্কিস্ট হিসাবে বিভিন্ন প্রতিবাদী কর্মসূচিতে বক্তৃতা দিয়ে নিজেকে একজন অন্যতম এনার্কিস্ট বক্তা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করেন। তিনি এ সময় অপরাপর র‌্যাডিক্যাল বন্ধুদের মতো মনে করতেন হত্যা হল এনার্কিমের একটি কৌশল। যদিও হত্যাকাণ্ড অযৌক্তিক তথাপিও হত্যাকারীর ক্ষোভের পেছনে যৌক্তিক কারণ থাকে। যা এনার্কিস্টদের বাধ্য করে সেই অমানবিক তথা অযৌক্তিক কাণ্ড ঘটাতে।
১৯০১ খ্রিস্টাব্দে প্রেসিডেন্ট ইউলিয়াম ম্যাককিনলেকে সমকালীন এনার্কিস্ট লিওন ক্লোগেজকে যখন গুলি করে হত্যা করে; তখন পুলিশি অভিযানের তোপে আত্মগোপনে চলে যেতে বাধ্য হন।
১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে আলেকজান্ডার সাশা যখন জেল থেকে মুক্তি পায় তখন তাদের সম্পর্ক পুনরায় সুদৃঢ় হয় এবং তারা যৌথভাবে মাদার আর্থ নামে একটি জার্নাল প্রকাশ করার উদ্যোগ নেয়। যা এনার্কিজমের স্বপক্ষে একটি তাত্ত্বিক প্রকাশনা হিসাবে সুখ্যাতি অর্জন করে।
১৯০৮ খ্রিস্টাব্দে শিকাগোতে এনার্কিজমের উপর বক্তৃতা করতে গিয়ে এমা এক অসমবয়সী প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন। ঊনত্রিশ বছর বয়সী কেতাদূরস্থ সু-পুরুষ বেন রেইটম্যানের নামের এক ডাক্তারের সাথে সম্পর্ক গড়ে তোলেন ঊনচল্লিশ বছর বয়সী এমা। তাদের দুজনের সখ্যতার পাশাপাশি বেন ছিলেন এমার অসংখ্য বক্তৃতার প্রধান আয়োজক ও সংগঠক। বিক্ষোভ সৃষ্টি আর জনগণকে সংগঠিত করার মাধ্যমে এনার্কিস্ট আন্দোলনের ব্যাপ্তি দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে দিতে এই প্রেমিক জুটি রেখেছিল অগ্রগন্য ভূমিকা। নাটকটিতে বেন রেইটম্যান একটি অন্যতম প্রধান নাট্য চরিত্র হিসাবে যেমন দ্যুতি ছড়িয়েছে তেমনি নাট্য ঘটনাক্রমের অগ্রগমনে ছিল সক্রিয় ভূমিকা।
উল্লেখিত আলোচনাগুলো আয়োজন করা হতো ব্যাপক প্রচারণার মধ্য দিয়ে। যার শিরোনাম থাকতো যদি মুক্তই না হই-তবে কিসের ভালোবাসা? কিংবা জন্ম নিয়ন্ত্রণ। কখনওবা ‘ভালোবাসার সাথে বিবাহের কোন সম্পর্ক থাকতে পারে না’ কিংবা ‘দেশপ্রেম’। উল্লেখিত শিরোনামে বক্তৃতা আয়োজন করলেও প্রকৃতপক্ষে এমা ঐ বক্তৃতাগুলোর আশ্রয়ে এনার্কিজমের প্রচার প্রসারে নিয়ত ছিলেন। যার কারণে তিনি বেশ কয়েকবার গ্রেফতারও হয়েছিলেন।
সরকারের আগ্রাসী দৃষ্টি এড়াতে কৌশলী এমা এই সময়কালে নাট্যকার স্ট্রিন্ডবার্গ, বার্নাড শ, আন্তন চেখভ কিংবা ইবসেন এর নাটক নিয়ে বক্তৃতা দিতে আরম্ভ করেন। সমকালীন বিখ্যাত এই সকল নাট্যকার সৃষ্ট নাট্যচরিত্র ও নাট্যমূহুর্ত বিশ্লেষণ করতে গিয়ে এনার্কিজমের সুক্ষ ইঙ্গিত রেখেই তিনি তাঁর বক্তৃতাবলী চালিয়ে যেতেন।
মূলত পুলিশি আগ্রাসন এড়াতে এমার বক্তৃতার শিরোনাম নির্বাচন এবং বক্তৃতা প্রদানের সময় ইঙ্গিতময় বিশ্লেষণের মাধ্যমে এনার্কিজমের প্রতি শ্রোতাদের আগ্রহী করে তোলার পাশাপাশি এনার্কিস্ট হয়ে মানবাধিকার রক্ষায় শ্রোতাদের উৎসাহিত করতে স্বনামখ্যাত নাট্যকারদের রচিত নাটকের বিষয়বস্তু ও চরিত্রগুলোর কৌশলী মূল্যায়ন করতেন। বক্তৃতার ইতিহাসে এমার সেই চিন্তা ও ভূমিকা এক বিস্ময়কর ও মডেল বক্তৃতা কৌশল হিসাবে পরিগণিত হবে বলে আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি। পুলিশ কর্তৃক এমার অনুরূপ ১১টি বক্তৃতা সভা পন্ড করা হয়েছিলো। ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দে এমাকে এক বক্তৃতা মঞ্চ থেকে গ্রেফতার করা হয়।
১৯০৯ খ্রিস্টাব্দে সান ফ্রান্সিসকোতে পাঁচ হাজার শ্রোতার সামনে দেশপ্রেমের উপর বক্তৃতা করছিলেন এমা। পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করতে এলে উপস্থিত শ্রোতা ও দর্শকদের বাঁধার মুখে পুলিশকে বক্তৃতা শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছিল।
মাজহার জীবন অনুদিত এমা নাটকের সমাপ্তি ঘটে এমন একটি দৃশ্যমূহুর্ত এর নাট্যায়নের মধ্য দিয়ে। ফেডারেল এজেন্ট ভর্তি মিলনায়তনের বক্তৃতামঞ্চে এমা। হারলেম ক্যাসিনোতে অনুষ্ঠিত সেই সভাস্থলে দর্শক শ্রোতার উদ্দেশ্যে হঠাৎ পুলিশের ঘোষণা: “হল ছাড়ুন; এটা যুক্তরাষ্ট্র সরকারের আদেশ! যেখানে আছেন সেখানেই থাকুন (এমা’র উদ্দেশ্যে)।”
নাট্যসাহিত্য এবং নাট্য উপস্থাপনার ক্ষেত্রে এনার্কির স্বপক্ষে পান্ডুলিপি ও প্রয়োগের চর্চা ও অনুশীলনকে পর্যালোচনা করলে আমরা এনার্কিজম সম্পর্কে একটি নতুন সৃজনশীল মূল্যায়ন ব্যাখ্যা করতে সক্ষম হব। যার ব্যাপকতা ও ব্যাপ্তি এর সংশ্লেষণে এমন এক নাট্যধারার অনুসন্ধান সম্ভব; যাকে আমি ‘থিয়েটার অব এনার্কি’ হিসাবে অভিধা দিতে চাই। যে ধারার অন্যতম নিয়ামক সৃষ্টি ও সৃজন হিসাবে আলোচ্য নাটক এমা বিশ্লেষকদের কাছে একটি বিশেষ পান্ডুলিপি হিসাবে চিহ্নিত হবে। এমন একটি বিশেষ নাটক অনুবাদের মাধ্যমে বাংলা ভাষাভাষীদের নজরে নিয়ে আসার জন্য মাজহার জীবনকে অন্তহীন ধন্যবাদ।
এনার্কিকে শ্রমজীবী মানুষের মুক্তির হাতিয়ারে পরিণত করতে এমা গোল্ডম্যান তার জীবনকে এক সৃজনশীল রাজনৈতিক অভিযানে পরিণত করেছিলেন। যা একটি দৃষ্টান্তমূলক জীবনযুদ্ধ। শেষ জীবনে নাট্যবেত্তা হিসাবে এমা বক্তৃতা করে বেশ সুনাম কুড়িয়েছিলেন। রাজনীতিকে সৃজনশীলতার উপমায় সুষমামন্ডিত করেছিলেন এমা গোল্ডম্যান। যা “থিয়েটার অব এনার্কি” হিসাবে ইতিহাসের পাতায় সন্নিবেশিত হয়েছে হাওয়ার্ড জিন রচিত জীবনাচরিতামূলক নাটক এমা’র পরতে পরতে। মাজহার জীবন কর্তৃক করা যার সাবলীল অনুবাদ; বাংলা ভাষায় অনুবাদ নাট্যে এক নবতর সংযোজন।
এমা গোল্ডম্যান প্রাতিষ্ঠানিক ইতিহাসবেত্তাদের কাছে উপেক্ষিত এক বিস্মৃত নারী। নারী স্বাধীনতা ও ক্ষমতায়নে নারীর অংশগ্রহণ ও ভূমিকা মূল্যায়নে এমার উজ্জ্বল অবস্থান নতুন প্রজন্মের সামনে দৃশ্যায়ন এবং সাহিত্য হিসাবে সমাদৃত হতে সহায়ক সৃজনকর্ম হিসাবে ব্যবহৃত হবে। যা প্রাতিষ্ঠানিক ইতিহাসের পাঠ্যক্রমভূক্ত হওয়ার ক্ষেত্র প্রস্তুত করবে।
হাওয়ার্ড জিনের হাত ধরে মাজহার জীবনের অনুবাদে বাংলাভাষীদের কাছে এমা নাটকটি অন্যতম স্মারক নাট্য পান্ডুলিপি হিসাবে ‘থিয়েটার অব এনার্কি’ ধারণার নাট্যশৈলীর বিকাশ ও বিস্তৃতিতে মাইলফলক নাট্যকর্ম হিসাবে মূল্যায়িত হবে বলে আমার প্রত্যাশা।
বাংলা ভাষায় অনুদিত এই নাট্যসাহিত্যের মঞ্চভ্রমণ বাংলা নাট্য উপস্থাপনায় অনুসন্ধিৎসু পরিচালকের পৃষ্ঠপোষকতা পাবেই পাবে। কারণ এনার্কিজম ধারণার রাজনৈতিক দর্শন এবং একজন নারী এনার্কিস্ট হিসাবে এমা গোল্ডম্যানের অনবদ্য অবদান একটি তুলনাহীন উদাহরণ।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ভাষা
Scroll to Top