তালাল আসাদের বৃটিশ সামাজিক-নৃবিজ্ঞানে সাংস্কৃতিক-অনুবাদের ধারণা (২য় পর্ব) // অনুবাদ: মোহাম্মদ সাঈদ হাসান খান

একটি তত্ত্বীয় টেক্সট

ফাংশনালিস্ট নৃবিজ্ঞানীরা ভিনদেশীয় গোষ্ঠীসমূহের ডিসকোর্সের ব্যাখ্যা ও অনুবাদের সমস্যাগুলো কি উপায়ে সমাধানের চেষ্টা করেছেন তাই নিয়ে গেলনার তার “কন্সেপ্টস অ্যান্ড সোসাইটি” প্রবন্ধটিতে কাজ করেছেন। তার মূল যুক্তি হলো ক) সমসাময়িক নৃবিজ্ঞানীরা একযটিক ধারণা ও বিশ্বাসগুলো একটি সামাজিক প্রাসংগিকতার প্রেক্ষিতে ব্যখ্যা করার ওপর জোর দেন, কিন্তু খ) তা করতে গিয়ে তারা সবসময় দৃশ্যত অযৌক্তিক ও অসংলগ্ন যে কোন কথনও যেন একটা গ্রহণযোগ্য অর্থ লাভ করে তা নিশ্চিত করেন, আর গ) সামাজিক প্রাসংগিকতার পরিপ্রেক্ষিতে অনুবাদ-এই ধারণা নৈতিক ভাবে বৈধ হলেও এর সাথে প্রচলিত “দাক্ষিণ্যের এই আতিশয্য” গ্রহণযোগ্য নয়। প্রাসঙ্গিক সাংস্কৃতিক প্রক্রিয়াসমূহ নির্ধারণ ও তাদের সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা প্রদানের জন্য গেলনার তার প্রবন্ধটিতে বেশ কিছু ডায়াগ্রাম তুলে ধরেছেন।

গেলনার অনুবাদের বিপত্তির এই ধারণা উপস্থাপন করতে গিয়ে কার্ট স্যামুয়েলসনের লেখা রিলিজিয়ন অ্যান্ড ইকোনমিক অ্যাকশন (১৯৬১) বইটির সাহায্য নিয়েছেন। বইটিকে ওয়েবার কর্তৃক প্রচারিত প্রোটেস্টান্ট নৈতিকতা তত্ত্বের বিরুদ্ধে একজন অর্থনৈতিক ইতিহাসবীদের আক্রমণ হিসেবে দেখা যেতে পারে। স্যামুয়েলসন প্রমাণ করতে চেয়েছেন যে, ওয়েবার ও তার অনুসারীরা ধর্মীয় লেখনীগুলো এমন ভাবে পুনর্ব্যাখ্যা করেছেন যেন তারা এমন অর্থই বের করে নিয়ে আসতে পারেন যা ধর্মটির মূল তত্ত্বকেই সমর্থন করে। গেলনার এই উদাহরণটি দিয়েছেন শুধুমাত্র ফাংশনালিস্ট নৃবিজ্ঞানীদের এই বিপরীতমুখী অবস্থানটি আরো সুচারুভাবে ফুটিয়ে তোলার জন্য:

যে বিবৃতি পাওয়া গেছে তা আর পুনর্ব্যাখ্যার প্রয়োজন নেই, স্যামুয়েলসনের এমন মৌন নীতি কতটা বৈধ তা নিয়ে বিতর্ক করবার ইচ্ছা বা সামর্থ্য কোনটাই আমার নেই। এখানে যে বিষয়টি প্রাসঙ্গিক তা হলো, যদি এমন একটা নীতি সর্বজনীনতা পায় তবে বিশ্বাস আর আচারের মধ্যকার সম্পর্ক নিয়ে সমাজবিদ্যাগত বেশিরভাগ গবেষণাই অর্থহীন হয়ে যাবে। বরং ভবিষ্যতে আমরা দেখব নৃবিজ্ঞানীরা সম্পূর্ণ বিপরীত একটি নীতি প্রয়োগে আগ্রহী হবেন। অর্থাৎ,তারা সামাজিক প্রাসঙ্গিকতায় পুনর্ব্যাখ্যার ধারণাকে প্রত্যাখ্যান করার পরিবর্তে উলটো তার ওপরই জোর দিবেন (২০)।

              কিন্তু সামর্থ্যহীনতার বিষয়ে এমন বিনয়ী স্বীকারোক্তির মধ্য দিয়ে তিনি বেশ কতগুলো গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন পাশ কাটিয়ে গিয়েছেন। প্রথমেই বলা যায়, প্রাপ্ত বিবৃতির কোন পুনর্ব্যাখ্যারই প্রয়োজন নেই—স্যামুয়েলসন নিজে যে এমন নীতি ধারণ করতেন না তা বলার জন্য বিশাল বেত্তা হবার দরকার হয় না। তিনি কখনো এ কথাও বলেননি যে ধর্মীয় টেক্সট আর সামাজিক প্রাসঙ্গিকতার মধ্যে কোন গুরুত্বপূর্ণ সংযোগ নেই। কিন্তু স্যামুয়েলসন এই সব প্রশ্নগুলো পাশ কাটিয়ে কেবল ওয়েবার-তত্ত্বের মূল সিদ্ধান্তের বিরোধীতা করেছেন (১৯৬১, পৃষ্ঠা ৬৯ দ্রষ্টব্য)। এছাড়া, একজন নৃবিজ্ঞানীকে সাধারণত যে সব বিপত্তিতে পরতে হয় তার সাথে স্যামুয়েলসনের ঐ উদাহরণের যে সত্যিকারের একটা পার্থক্য রয়েছে গেলনার হয়তো সে-বিষয়টাও তুলে ধরতে পারতেন। ওয়েবার বিতর্কে জড়িত অর্থনৈতিক ইতিহাসবীদ ও সমাজবিজ্ঞানীদের নিকট ঐতিহাসিক টেক্সট সমূহ হল প্রাথমিক উপাত্ত। আর এর সাথে সামঞ্জস্য রেখেই তারা সামাজিক প্রাসঙ্গিকতার ধারণাকে পুনর্নির্মাণ করেন। অন্যদিকে, একজন নৃতাত্ত্বিক মাঠকর্মী কাজ শুরু করেন এমন একটি সামাজিক পরিস্থিতিকে কেন্দ্র করে যার মধ্য থেকে কোন বক্তব্য পাওয়া যায়। আর এ সকল বক্তব্যের সাংস্কৃতিক গুরুত্ব পুনর্নির্মাণই তার প্রধান কাজ। অবশ্যই তার মানে এই নয় যে, একজন ইতিহাসবেত্তা কোন একটি পুরাকালীন বিষয়ের ঐতিসাহিক অনুষঙ্গসমূহ সম্পর্কে কোন রূপ ধারণা ছাড়াই ঐ পুরাকালীন বিষয়টি নিয়ে কাজ করতে পারেন কিংবা একজন নৃতাত্ত্বিক মাঠকর্মী একটি সামাজিক অবস্থায় প্রদত্ত বক্তব্য সমূহ ব্যাতিরেকেই সামাজিক অবস্থাটিকে সংজ্ঞায়িত করতে পারেন। ইতিহাসবেত্তা আর জাতিতাত্ত্বিকের মধ্যকার এই যে বৈসাদৃশ্য তা মূলত চিন্তাধারার বৈসাদৃশ্য। ইতিহাসবেত্তার নিকট টেক্সট আগে থেকেই প্রদত্ত একটি বিষয় আর অন্যদিকে জাতিতাত্ত্বিককে টেক্সট তৈরী করে নিতে হয়, আর চিন্তাধারার বৈসাদৃশ্যের সৃষ্টি এখান থেকেই।

এই গুরুত্বপূর্ণ বৈসাদৃশ্য নিয়ে পর্যালোচনার পরিবর্তে গেলনার বরং তড়িঘড়ি করে আরেকটি নতুন পদ্ধতির কথা উল্লেখ করলেন যার নাম দিলেন তিনি “মধ্যপন্থী ফাংশনালিজম”। এই পদ্ধতিকে সংজ্ঞায়িত করতে গিয়ে তিনি বললেন:

ধারণা ও বিশ্বাস যে কেবল কোন টেক্সট অথবা কোন ব্যাক্তির মস্তিস্কে থাকা কোন বিচ্ছিন্ন বিষয় নয় বরং এই বিষয়টিতে জোর দেয়া হয়েছে যে ধারণা আর বিশ্বাসের অবস্থান মানুষ আর তার সমাজের মাঝেই । কোন শব্দ বা বাক্যের অর্থ বোঝার আগে, কোন ধারণা অথবা বিশ্বাসের বিষয়ে কথা বলার আগে, ঐ সব শব্দ আর বাক্যগুলো যে সকল কর্মকান্ড আর নীতির পরিপ্রেক্ষিতে ব্যবহৃত হয়েছে সেগুলো জানা দরকার। (২২)

কথাগুলো গেলনার বেশ স্পষ্ট ভাবেই তুলে ধরেছেন, আর বিষয়টি যদি পূর্বোক্ত হয়েও থাকে তবুও এর পুনরুল্লেখ গুরুত্বপূর্ণ। আলোচনার এই পর্যায়ে, এমন পরিস্থিতিতে জাতিতাত্ত্বিকেরা  যে সকল ভিন্ন ভিন্ন উপায়ে ভাষা বিষয়ক নানা প্রশ্নের সুরাহা করে থাকেন সে সব বিষয়ে আলোকপাত করা যেতে পারে, যেমনঃ কথা কিভাবে তৈরী হয়, বাচনিক অর্থগুলো কিভাবে নির্মিত হয়, কিভাবে অলংকার অর্জিত হয় এবং কি করে সংস্কৃতির সাথে সাজুজ্জ্যপূর্ণ প্রতিউত্তর প্রকাশ পায়। ইতিমধ্যে উইটেনস্টাইন প্রচলিত ভাষা সমূহের জটিলতার বিষয়ে বৃটিশ দার্শনিকদের সচেতন করেছেন, আর জে, এল, অস্টিন ভাষার উৎপাদন ও তা গৃহীত হবার বিভিন্ন ধাপের মধ্যকার বৈসাদৃশ্যগুলো উপস্থাপন করেছেন, যার ছায়া  পরবর্তীতে নৃবিজ্ঞানীরা যে বিষয়টিকে বলছেন কথনের জাতিত্ত্ব (ethnography of speaking), তার মধ্যে দেখতে পাওয়া যায়। কিন্তু এর আগে গেলনার দর্শনশাস্ত্রগত এই আন্দোলন থেকে মূল্যবান কিছুই শেখার নেই বলে এই আন্দোলন প্রত্যাখ্যান করেছিলেন (ওয়ার্ডস অ্যান্ড থিংস ১৯৫৯)। আর অন্যান্য সমালোচকদের মতই তিনিও সবসময় জোর দিয়ে বলেছেন যে, নিত্যদিনের ভাষা বুঝতে পারা নিয়ে এই আন্দোলনের যে আগ্রহ, তা আসলে কেবল বিশ্ব সম্পর্কে কথা বলার যে প্রতিষ্ঠিত ধারাটি রয়ছে সেই ধারাটিকে রক্ষা করা আর প্রতিষ্ঠিত ঐ ধারাটি যে অযৌক্তিক আর অর্থহীন হতে পারে তা অগ্রাহ্য করার প্রচ্ছন্ন একটি প্রচেষ্টা মাত্র। গেলনার সবসময়ই চেষ্টা করেছেন “ধারণা ও বিশ্বাস” কে সমর্থন ও তাদের সংজ্ঞায়ন এই দুটো বিষয়ের মধ্যে পার্থক্য বজায় রাখতে। ধারণা কিভাবে কাজ করে তা ব্যাখ্যা করার জন্য একটি সমালোচনামূলক দূরত্বের প্রয়োজন হয়—প্রচলিত এই প্রক্রিয়াটিকে খারিজ করে দেয় এমন নৃতাত্ত্বিক অনুবাদের বিষয়েও তিনি সাবধান করেছেন। কারন গেলনার বলেন, “কোন সমাজের ধারনা সমূহ কিভাবে কাজ করে তা বুঝতে পারার অর্থ হল সমাজটির প্রতিষ্ঠানগুলোকে বুঝতে পারা”। (পৃষ্ঠা ১৮, একই পৃষ্ঠায় এক নং টীকা দ্রষ্টব্য)

মধ্যপন্থী ফাংশনালিজম নিয়ে গেলনার প্রদত্ত পূর্বোক্ত সংক্ষিপ্ত সংজ্ঞাটিই তাকে ডুরখেইমের লেখা ইলিমেন্টারি ফরমস অফ দ্যা রিলিজিয়াস লাইফ বইটির বিষয়ে আলোচনার দিকে পরিচালিত করে। “সাধারন ভাবে বলতে গেলে, বইটি ফাংশনালিজমের উৎস সমূহের একটি”, আর বইটি ধারনাসমূহের সমর্থন নয় বরং ব্যাখ্যা নিয়ে কাজ করেছে। বইটিতে নির্দিষ্ট কিছু সমষ্টিগত প্রক্রিয়ার প্রেক্ষাপটে আমাদের পরম-ধারণা সমূহের প্রতিক্রিয়াশীল চরিত্রটি আরো সুস্পষ্ট ভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে এভাবেঃ

আমাদের সমকালীন সময়ে ধারণাসমূহের পাঠ ও ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে ফাংশনাল, সামাজিক প্রাসঙ্গিকতা—এ সব প্রক্রিয়ার ব্যবহার নানা দিক থেকেই ডুর্খেইম প্রদত্ত প্রক্রিয়া থেকে ভিন্ন। আদিম সমাজের ধারণাসমূহকে সমর্থনের বিষয়ে ডুর্খেইমের মাথা ব্যথা ছিল না। তার মতে নিজ অবস্থানের পরিপ্রেক্ষিতে আদিম সমাজের ধারণাসমূহের প্রতিরক্ষার প্রয়োজন ছিল না। আর আধুনিক পরিবর্তনশীল সমাজের পরিপ্রেক্ষিতে প্রাচীন কোন বিষয়কে সমর্থন যুগিয়ে যাওয়া নিয়ে ডুর্খেইম বিচলিত ছিলেন না। বরং জ্ঞানের তল্পিতল্পাও যে প্রাচীনত্ত্বের দোষে দুষ্ট হতে পারে সে কথা বলতেও তিনি পিছ-পা হননি। তো আপাত দৃষ্টে পৃষ্ঠপোষকের প্রয়োজনীয়তাহীন এ বিষয়টির প্রতিক্রিয়াশীল চরিত্রটি ব্যাখ্যা করা নিয়েই তিনি চিন্তিত ছিলেন (তার ভাষ্য মতে এ কাজ করতে গিয়ে জ্ঞানের প্রশ্নে যে সমাধান তিনি দিয়েছেলেন, তেমন একটি সমাধান নাকি কান্ট ও অন্যান্য দার্শনিকদেরও দৃষ্টি এড়িয়ে গিয়েছিল)। তিনি সফল হয়েছিলেন কিনা সে বিষয়ে আর এখানে বিষদ আলোচনা করছি না খালি এটুকু বলি আমার কাছে বেশ কিছু প্রমাণ আছে যা থেকে বলা যায় যে তিনি সফল হন নি। (২৩)

গেলনার যে ইলিমেন্টারি ফরমস বইয়ের সারমর্মটি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন তা নিশ্চিত। সামাজিক ভাবে সংজ্ঞায়িত ধারণা সমূহের প্রতিক্রিয়াশীল চরিত্রটি ব্যখ্যা করার প্রচেষ্টা বইটিতে ছিল। কিন্তু এই ধরনের একটি সমস্যার সাথে আরো কি কি বিষয় জড়িত থাকতে পারে সেগুলো গেলনার শুধু আমলেই নেন নি তা না, বরং বিষয়গুলো ব্যাখ্যা করার ক্ষেত্রে ডুর্খেইমের যে প্রচেষ্টা, সেই প্রচেষ্টাকেও তিনি তড়িঘড়ি করে নাকচ করে দিয়েছেন। ধারণাসমূহের সমর্থন কিংবা গোড়াতেই কোন প্রকার বিশ্লেষণ ছাড়াই তাদের নাকচ করে দেওয়া, এই দুটি প্রক্রিয়ার কোনটিই যে ধারণা সমূহের ব্যাখ্যার কাজটিকে এগিয়ে নিতে পারে না এমন সম্ভাবনা আপাতদৃষ্টে “কন্সেপ্টস অ্যান্ড সোসাইটি” প্রবন্ধটিতে বিবেচিত হয় নি। বরং লিয়েনহার্ডটকে উদ্ধৃত করে পাঠককে মনে করিয়ে দেওয়া হয়েছে যে, সাধারণত সমকালের নৃবিজ্ঞানীর কাছে “একটি ভাল অনুবাদের শর্ত হল আদিম ঐ ভাবনার মধ্যে যে সঙ্গতি রয়ছে বলে অনুবাদক মনে করেন ভাবনার সেই সঙ্গতিটি তার অনুবাদের মধ্যে প্রকাশ করা” (২৬)। তাই আমার মনে হয়, ডুর্খেইম কর্তৃক ধারণা সমূহকেকে  ব্যখ্যা করার প্রচেষ্টা আর সমকালীন নৃবিজ্ঞানীদের সেগুলোকে সমর্থন করে যাবার প্রচেষ্টার তুলনা করতে চাওয়ার মধ্য দিয়ে আমরা এখানে একটি বিভ্রান্তিকর তুলনা কার্যে ব্যাপৃত রয়েছি। এই আলোচনায় আমি আবারো ফিরে আসবো, তবে এ পর্যায়ে আমি জোর দিয়ে বলতে চাই যে কোন বক্তব্যের অর্থসংগতির যে কাঠামো রয়েছে তার পক্ষে কথা বলা আর বক্তব্যটিকে সমর্থন করা এক কথা নয়। বক্তব্যের অর্থসংগতির কাঠামোটিকে সমর্থন আসলে বক্তব্যটির প্রতিক্রিয়াশীলতা ব্যাখ্যা করার ক্ষেত্রে একটি প্রাথমিক পদক্ষেপ মাত্র। মনঃসমীক্ষণের সাথে পরিচিত যে কেউ বিষয়টি খুব সহজেই বুঝতে পারবেন। বিষয়টিকে অন্যভাবেও উপস্থাপন করা যায়ঃ সব সময় সব ক্ষেত্রে, কোন বক্তব্যের বিমূর্ত “সংগতি” অথবা “যৌক্তিকতা”, বক্তব্যটি গৃহীত হবে না বর্জিত হবে তার মানদণ্ড হিসেবে কাজ করে না। এর কারণ হিসেবে গেলনার খুব সঠিক ভাবেই যে বিষয়টি উল্লেখ করেছেন তা হলো— “ভাষা, ‘উদ্দেশ্য কে নির্দেশ করা’ ছাড়াও আরো বিভিন্ন ভাবে কাজ করে” (২৫)। সব কথাই বিবৃতি নয়। ব্যবহৃত ভাষাটি আরো অনেক কিছুই করে আর আরো অনেক কিছু করার অভিপ্রায়ে ব্যবহৃত হয়, আর এ কারনেই “যুক্তির” সংকীর্ণ প্রেক্ষাপট থেকে অনুপযুক্ত বলে গ্রাহ্য বক্তব্যেও আমরা সাগ্রহে সাড়া দেই। প্রত্যেক জাতিতাত্ত্বিকই তার নিজ ভাষাতে একটি যথোপযুক্ত অনুবাদের চেষ্টা করার আগে অপর ভাষাটির ক্রিয়াকলাপ, প্রদত্ত বক্তব্যের অভিপ্রায়, এসবই ভাল করে আয়ত্ত্ব করার চেষ্টা করেন।

এ বিষয়ে গেলনার অর্ধসচেতন বলেই মনে হয়, কিন্তু বিষয়টি তার লেখায় তেমন গুরুত্ব পায়নি কারণ সাংস্কৃতিক-অনুবাদের ক্ষেত্রে ফাংশনালিস্ট  নৃবিজ্ঞানীদের “দাক্ষিণ্যের” যে “আতিশয্য” তা তুলে ধরতেই তিনি বিশেষ আগ্রহী ছিলেন।

কোন ভিনদেশীয় সংস্কৃতির একটি ধারণা, বিবৃতি, অথবা মতবাদ কে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে একজন সামাজিক-নৃবিজ্ঞানীকে যে পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয় তাকে খুব সহজেই ব্যাখ্যা করা যায়। ধরুন, তিনি কোন একটি স্থানের স্থানীয় ভাষার একটি বিবৃতিকে তার নিজ ভাষায় অনুবাদ করবেন। এই অনুবাদের ক্ষেত্রে তিনি তার নিজ ভাষাতে অনেক এমনকি অসংখ্য সংখ্যক সম্ভাব্য বাক্য থেকে বেছে নিতে পারেন।

পুরো পরিস্থিতিটা নিয়ে তিনি সন্তুষ্ট নাও থাকতে পারেন, কিন্তু এই পরিস্থিতিকে তিনি এড়াতে পারেন না। এখানে তৃতীয় কোন ভাষা নেই যা কিনা স্থানীয় ভাষা ও অনুবাদকের নিজ ভাষার মধ্যে মধ্যস্থতার কাজটি করবে, আর তাদের মধ্যকার সাদৃশ্যকে প্রকাশ করবে; এখানে এমন কোন তৃতীয় ভাষা নেই যা এই যে সত্য, যে, পুরো বিশ্বকে চালনা করার নিজস্ব একটি উপায় অনুবাদকের ভাষার রয়েছে- সেই সত্যের মধ্যে যে ফাঁদটি রয়েছে তাকে এড়াতে পারবে, এমন কোন তৃতীয় ভাষা নেই যা চর্চিত দেশীয় ভাষা গুলোর বাইরের কোন ভাষা হবে, আর ফলাফল স্বরূপ অনুবাদকৃত অংশটির বিকৃতির জন্য দায়ী থাকবে।

কখনো কখনো মানুষ মনে করে বাস্তবতাই এই মধ্যস্থতাকারী “তৃতীয় ভাষা” হিসেবে কাজ করতে পারে. . .। এটা যে কোন কাজের কথা নয় তা বেশ কিছু শক্তিশালী যুক্তি দিয়ে বুঝিয়ে দেয়া সম্ভব (২৪-২৫)।

আবার কোন কোন পাঠকের মনে হতে পারে এই বক্তব্যের মধ্য দিয়ে এই বিষয়ে সমর্থন দেয়া হচ্ছে যে,একজন জাতিতাত্ত্বিকের উচিত, কোন ভিনদেশীয় বক্তব্যেকে তার নিজ জাতিতাত্ত্বিক টেক্সটের ভাষায় অনুবাদ করবার আগে, তার স্থানীয় ঐ ভাষাটির তাবৎ বিশ্বটাকে দেখার, তথ্য প্রকাশ করার, আর অভিজ্ঞতা তৈরীর যে বিভিন্ন ধরণ রয়েছে সেগুলো পুনর্নির্মান করা। কিন্তু গেলনার সেদিকে না গিয়ে বরং পুরোপুরি ভিন্ন এক অনিশ্চিত পথের দিকে এগোলেন।

তিনি বললেন, ভিনদেশী একটি বাক্য অনুবাদ করতে গিয়ে একজন জাতিতাত্ত্বিক যদি ইংরেজি ভাষাতে তার একটি সমতুল বাক্য খুঁজে পান তবে তিনি খেয়াল করলেই দেখবেন যে সেই সমতুল বাক্যটি নিশ্চিত ভাবেই একটি নীতিগত অর্থ বহন করে, যা ‘ভালো’, নয়তো ‘মন্দ’। “আমি বলছি না হয় ‘সত্য’ নয় ‘মিথ্যা’, কারণ সীমিত সংখ্যক বক্তব্যের ক্ষেত্রেই এমন দ্বিবিভাজন করা যায়। অন্যান্য বক্তব্যের ক্ষেত্রে ‘অর্থপূর্ণ’ আর ‘অর্থহীন’ কিংবা ‘যুক্তিযুক্ত’ আর ‘অযৌক্তিক’ এমন বৈপরীত্য সমূহও প্রয়োগের প্রয়োজন হতে পারে। আর আমি বুঝেশুনেই ‘ভাল’ অথবা ‘মন্দ’ এই ভাগ দু’টি করেছি। যে বৈপরীত্যগুলোর কথা উল্লেখ করা হয়েছে সম্ভাব্য এমন সকল বৈপরীত্যকেই, উৎসের সমতুল হিসেবে যেখানে যেটি প্রযোজ্য তার ভিত্তিতে, এই ভাগ দু’টির একটিতে ফেলা যায়,” (২৭)।

এখানে অনুবাদ সম্পর্কে কতগুলো অদ্ভুত ধারণাই না পেলাম আমরা। এর আগে কোন অভিজ্ঞ অনুবাদকের কাছে আমরা এমনটা শুনিনি। প্রথমটা হলো, মূল্যায়নের প্রভেদ নাকি সবসময়ই দুই মেরুর দুইটি বিপরীত ধারার মধ্য থেকে যে কোন একটি ধারাকে বেছে নেওয়ার ওপর পুরোপুরি নির্ভর করে। দ্বিতীয়ত, মূল্যায়নের এই প্রভেদকে নাকি শেষ পর্যন্ত “ভাল” আর “মন্দ” এই দুই ভাগেই ভাগ করা যায়। স্পষ্টতই এই দুই ধারনার একটিও সর্বজনীন বিধান হিসেবে মেনে নেওয়ার মত নয়। এরপর আবার এখানে এই পরামর্শও দেওয়া হয়েছে যে অনুবাদকের কাজই হল মূল টেক্সটের প্রতিটি বাক্য ধরে ধরে অনুবাদ করা। কিন্তু অনুবাদ করতে গিয়ে একজন দক্ষ অনুবাদক প্রথমে মূল টেক্সটের মধ্যকার অর্থসঙ্গতিটি খুঁজে বের করার চেষ্টা করেন, তারপর নিজ ভাষাতে সেই অর্থসংগতিকে যথাসম্ভব পুনর্নির্মাণের চেষ্টা করেন আর তা করতে গিয়ে অনুবাদক কোনটিকে একক হিসেবে ধরবেন তার কোন সর্বজনীন বিধান থাকতে পারে না, অর্থাৎ, অর্থসঙ্গতির পুনঃনির্মাণের জন্য অনুবাদক বাক্য, অনুচ্ছেদ, কিংবা তার চেয়েও বড় কোন অংশকে একক হিসেবে ধরে নিতে পারেন। বিষয়টিকে এভাবেও বলা যায়: ব্যবহৃত এককটির যথোপযুক্ততা অর্থসঙ্গতির নীতির ওপর নির্ভরশীল।

কিন্তু নৃবিজ্ঞানী-অনুবাদক সংক্রান্ত তার রূপগল্পে গেলনার, এই গল্পের প্রয়োজনেই, এ কথা প্রমাণ করতে চেয়েছেন যে একজন অনুবাদক মূল টেক্সটের কেবল বাক্যের সাথে সাদৃশ্য রেখেই অনুবাদ করেন। কারণ, একথা প্রমাণ করা গেলে অতিশয় দাক্ষিণ্যের পাপ কর্মটি কিভাবে সম্পন্ন হয় তা দেখানো সহজ হয়ে যায়। প্রথমে হয়তো একজন নৃবিজ্ঞানী স্থানীয় ভাষায় লিখিত একটি বাক্যের সাথে তার নিজ ভাষায় (ইংরেজি) একটি প্রাথমিক সাম্য খুঁজে পান। কিন্তু পরে তিনি লক্ষ্য করেন যে ভাষান্তরিত ইংরেজি বাক্যটি একটি “মন্দ” ছাপ বহন করছে। এমন ঘটনা একজন নৃবিজ্ঞানীকে বিচলিত করে তোলে, কারণ গেলনারের রূপগল্প মতে একজন নৃবিজ্ঞানীর এমন কর্ম তিনি যে স্থানীয় জাতিকে নিয়ে কাজ করেছেন তার প্রতি অবমাননাকর বলে পরিগণিত হবে। আর অপর সংস্কৃতিকে অবমাননা করা হলো জাত্যাভিমানের লক্ষণ এবং ফাংশনালিস্ট নৃবিজ্ঞানতত্ত্ব অনুযায়ী জাত্যাভিমান হলো ত্রুটিপূর্ণ নৃবিজ্ঞানের লক্ষণ। ফাংশনালিস্ট কার্যপদ্ধতিতে এই দাবিই করা হয় যে বাক্য গুলোকে যেন সবসময় তাদের নিজস্ব সামাজিক প্রেক্ষাপট থেকে মূল্যায়ন করা হয়। তাই একজন চিন্তাশীল নৃবিজ্ঞানী একটি “ভাল” অনুবাদ তৈরীর নিমিত্তে প্রাসঙ্গিকতার পদ্ধতিটি আরো আনম্য ও সচেতন উপায়ে ব্যবহার করেন।

গেলনারের মতে, অতিশয় দাক্ষিণ্যের পাপ আর প্রাসঙ্গিকতার (কনটেক্সচুয়াল) পদ্ধতি, এই বিষয় দুটি একত্রে চিন্তনের যে আপেক্ষিক ফাংশনালিস্ট দর্শন রয়েছে তার সাথে যুক্ত আর এর সূচনা সেই এনলাইটেনমেন্টের আমল থেকে:

এনলাইটেনমেন্টের ধারণাকে একটি (আমিমাংসিত) দোটানার মধ্যে পড়তে হয়েছিল। একদিকে ছিল চিন্তনের আপেক্ষিক-ফাংশনালিস্ট-দর্শন আর অন্য দিকে এনলাইটেন্ড রিজনের স্বৈরতান্ত্রিক দাবি। এনলাইটেন্ড রিজন সহজাত ভাবেই মানুষকে প্রকৃতির অংশ হিসেবে গণ্য করে আর একই সাথে মানুষের জ্ঞান অর্জন ও বিশ্লেষণের ক্ষমতাকেও প্রকৃতির অংশ হিসেবে গণ্য করে, আর সে কারণেই যুক্তিসঙ্গতভাবে ব্যক্তি ও প্রসঙ্গ ভেদে তাদের ভিন্নতাকেও মেনে নেয়। (এটাই হল আপেক্ষিক ফাংশনালিস্ট দর্শন।) কিন্তু এনলাইটেনমেন্টের ধারণা মানুষের জীবনকে যুক্তি আর প্রকৃতির সমন্বয় হিসেবে বিবেচনা করলেও একই সাথে সে চেয়েছে নিজেকে এমনতর আপেক্ষিকতাবাদ থেকে মুক্ত রাখতে। (৩১)

স্বাভাবিকভাবেই এই অমিমাংসিত বিতর্ককে গেলনার তার দার্শনিক অভিব্যক্তির বদৌলত “চিন্তনের আপেক্ষিক-ফাংশনালিস্ট-দর্শন” ও “এনলাইটেনণ্ড রিজনের স্বৈরতান্ত্রিক দাবি” এই দুটি ধারণার মধ্যকার ভাবগত বৈপরীত্য হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এই ধারনা দুটি কি করে (পশ্চিমা) সমাজের প্রতিষ্ঠানসমূহের সাথে সম্পর্ক তৈরী করে কাজ করে? (গেলনার, পৃ ১৮-এর সাথে তুলনীয়)। এই কথা প্রমান করা কঠিন হবে না যে, তৃতীয় বিশ্বের অনেক দেশেই অপেক্ষিকতাবাদের দর্শনের চেয়ে এনলাইটেনণ্ড রিজনই বাস্তব ক্ষেত্রে বেশি সাফল্য অর্জন করেছে আর শিল্প-অর্থনীতির উন্নয়ন ও জাতি ভিত্তিক রাষ্ট্র গঠনে অনেক বেশি কর্তৃত্ব প্রয়োগে সক্ষম হয়েছে। অনুবাদ কিভাবে ক্ষমতা প্রতিষ্ঠার একটি মাধ্যম হিসেবে কাজ করে সে বিষয়ে আলোচনায় আমরা এই ব্যাপারটি নিয়ে আরো বিস্তারিত কথা বলবো। আসল বিষয়টি হলো, “এনলাইটেন্ড রিজনের স্বৈরতান্ত্রিক সত্ত্ব” মূলত একটি প্রাতিষ্ঠানিক শক্তি এবং সংজ্ঞানুসারেই এটি ভিনদেশী অঞ্চলের দিকে অগ্রসর হতে ও তাকে নিজের করে নিতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ আর সংজ্ঞানুযায়ীই এর প্রতিপক্ষ (স্পষ্টভাবে আপেক্ষিকতাবাদী হোক আর না হোক) আদতে আত্মরক্ষনাত্বক। এভাবে গেলনার যখন সব নৃবিজ্ঞানীর মাঝে এই ভাবগত বৈপরীত্যের বৈশিষ্ট্যই চিহ্নিত করেছেন, তখন, তিনি আসলে বিষম-সমাজসমূহের মধ্যেকার সম্পর্কের বৃহৎ পরিসরে প্রাতিষ্ঠানিক চর্চা হিসেবে বিবেচিত “সাংস্কৃতিক অনুবাদ” এর অন্তর্ভুক্ত বিষয়সমূহ অনুধাবনেই ব্যার্থ হয়েছেন। কারণ ব্যক্তিগত ভাবে বিভিন্ন পশ্চিমা নৃবিজ্ঞানীরা তাদের জাতিতত্ত্বে যে সব বিমূর্ত যুক্তি ব্যবহার করছেন সেগুলোকে কেন্দ্র করে এই আলোচনার শুরু করাটা অর্থহীন, বরং বাস্তবেই পশ্চিমা এই দেশগুলো (হয়তো তারা নিজেরাও) তৃতীয় বিশ্বের দেশসমূহের সাথে কি রূপ আচরণ করছে আলোচনার শুরুটা হওয়া দরকার সেখান থেকেই। “আপেক্ষিকতাবাদের” দোটানা ভিন্ন ভিন্ন ভাবেই সামনে আসে আর তা নির্ভর করে বিমূর্ত বোধশক্তি আর ঐতিহাসিক ভাবে প্রতিষ্ঠিত পরিশীলন এর মধ্যে আমরা কোন বিষয়টিকে গুরুত্ব দিচ্ছি তার ওপর।

যাই হোক, গেলনার অবশ্য বলেন যে, তিনি নীতিগতভাবে নৃতাত্ত্বিক-আপেক্ষিকতাবাদ বিরোধী নন। তিনি বলেন, “সহিষ্ণুতা-উৎপাদী প্রাসঙ্গিক অনুবাদ বিষয়ে আমার মূল আপত্তির জায়গাটি হলো এই প্রক্রিয়াটি নিজে থেকেই একটি সতর্কতার দাবি জানায়” (৩২)। কিন্তু সতর্কতার এই বিষয়টি কেন অসহিষ্ণুতা-উৎপাদী প্রাসঙ্গিক অনুবাদের ক্ষেত্রে নয়, বরং কেবল “সহিষ্ণুতা-উৎপাদী প্রাসঙ্গিক অনুবাদ” এর ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য হবে তার ব্যাখ্যা অবশ্য তার লেখায় পাওয়া যায় না। সর্বোপরি, গেলনার কিন্তু আগেই জোর দিয়ে বলেছেন যে সব ভাষান্তরিত বাক্যই হয় “ভাল” নয়তো “মন্দ” হিসেবে গৃহীত হবে। কিন্তু প্রশ্ন হলো আমরা কেন কেবল যেগুলো “ভালো” বলে প্রতীয়মান হবে তাদের বিষয়েই সন্দেহপ্রবণ হবো? দেশজ বাক্যটিকে পক্ষপাতমূলক ভাবে অনুবাদের ক্ষেত্রে ঐ উৎসের ঠিক কতোটুকু আমলে নেয়া দরকার তা যদি আগে থেকেই ঠিক করে নেয়া হয় তবে কি আমরা অনুবাদের ক্ষেত্রে সমবেদনাশূণ্য মনোভাব পরিগ্রহের মধ্য দিয়ে এই দুষ্ট চক্রকে এড়াতে পারি? এখানে গেলনার নিজে সরাসরি এমন সম্ভাবনার কথা উল্লেখ করেন নি, কিন্তু এটা যে কোন সমাধান হতে পারে না তা কিন্তু সহজেই অনুমেয়, বিশেষ করে যখন এ কথা দাবি করা হয় যে, “বস্তু অথবা সমাজের বৈশিষ্ট্য সমূহের মধ্যে এমন কিছুই নেই যা প্রদত্ত বাক্যটির জন্য ঠিক কতোটুকু পরিমাণ প্রাসঙ্গিকতা গ্রহণযোগ্য, কিংবা প্রাসঙ্গিকতার বিষয়টিকে কিভাবে বর্ণনা করা প্রয়োজন তা নির্দিষ্ট করে দিতে পারে”। (৩৩)

তারপরও শেষের এই উক্তিটি কি সত্যিই মেনে নেওয়ার মতো? সত্যিই কি এমন কিছু নেই?! তাহলে, একই সমাজের দুজন ব্যাক্তির মধ্যেই বা কি করে ভাবের আদান-প্রদান সম্ভব হয়? কেনইবা বিদেশীদের এই কথা বলা হয় যে তারা যা শুনেছেন বা দেখেছেন তার ভুল অর্থ করেছেন? সামাজিক শিক্ষা কি সম্পর্কিত প্রসঙ্গ সমূহের মধ্যে পার্থক্য নিরূপনের কোন দক্ষতা তৈরী করে না? এমন সব প্রশ্নের উত্তর গুলো হওয়া উচিত একদম স্পষ্ট, আর সেই উত্তরগুলো এই বাস্তবতার সাথেও সম্পর্কিত যে, একজন নৃবিজ্ঞানীর নিকট ভাষান্তর মানে কেবল ভাবার্থের মিল রেখে বাক্যের অনুবাদ নয়, বরং জীবনের আরেকটা ধরকে যাপন করতে শেখা, আরেকটা ভিন্ন ভাষায় কথা বলতে শেখা। ভিন্ন ভিন্ন ঘটনাবলীর ক্ষেত্রে কোন কোন অনুষঙ্গ প্রাসঙ্গিক হিসেবে বিবেচিত হবে তা ব্যক্তি তার জীবন যাত্রার চলমান প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই শিখবে। আর যদিও এমন জ্ঞানের বহিঃপ্রকাশ ঘটানো বেশির ভাগ সময়ই বেশ কঠিন, তবুও, সমাজের প্রকৃতির বিষয়ে, আর জীবন যাপনের নানা পরিপ্রেক্ষিতের বিষয়ে অর্জিত এই জ্ঞান, কোন একটি বক্তব্য অনুবাদের ক্ষেত্রে ঠিক কতটুকু অনুষঙ্গ প্রাসঙ্গিক সেই বিষয়টি বুঝতে সাহায্য করে। অবশ্যই আমি এ কথা বলতে চাচ্ছি না যে, কোন সাধারণ একটি বাক্যের অর্থ দাঁড় করানোর জন্য কোন প্রসঙ্গটি জুতসই তা একজন নৃতাত্ত্বিক জানতে পারবেন না, কিংবা তিনি অনুবাদের ক্ষেত্রে প্রয়োজনের তুলনায় অতিরিক্ত দানশীল হবেন, বরং বলতে চাচ্ছি যে অনুবাদের কাজ করতে গিয়ে সে হয়তো এমন সব সমস্যার সম্মুখীন হতে পারেন যে সব সমস্যার মূল রয়েছে তিনি যে ভাষাগত উপাদান এবং অপর ও নিজস্ব এই যে দুই প্রকার সামাজিক পরিস্থিতির মধ্যে কাজ করেন তার ভেতরে। পরে এই বিষয়ে আরো আলোচনা করা হবে।

গেলনারের প্রবন্ধের পরবর্তী ভাগটিতে নৃতাত্ত্বিক গবেষণা থেকে পাওয়া বিভিন্ন উদাহরণ রয়েছে। উদাহরণ গুলো প্রথমত,অনুবাদের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত দানশীলতার বিষয়টিকে স্পষ্ট করে আর দ্বিতীয়ত, ভিনদেশীয় ধর্মীয় ডিসকোর্সের যুক্তির প্রতি সমালোচনামূলক দৃষ্টিভংগি পরিগ্রহের যে সব ব্যখ্যামূলক সুবিধাদি রয়েছে সগুলো তুলে ধরে।

উদাহরণের প্রথম সেটটা আসে ইভান্স- প্রিটচার্ডের এনইউইআর রিলিজিয়ন  বই থেকে যেখানে এনইউইআর[1] ধর্মীয় ডিসকোর্স এর প্রথম দিককার অনুবাদগুলো যেমন “যমজ শিশু দুটি হলো পাখি”- এগুলো পুনর্মূল্যায়ন করা হয়েছে। গেলনারের মতে “এই ধরণের বক্তব্যগুলো একরূপতা বা অসঙ্গতিহীনতা কিংবা সাধারণ বোধের যে নীতি কিংবা স্পষ্টই যা চোখে দেখা যায়, এই যেমনঃ যমজ মানব শিশু দুটি যে পাখি না কিংবা তার উল্টাটাও না, এসবের সাথে সাংঘর্ষিক” (৩৪)। গেলনারের মতে, প্রাসঙ্গিকতা পদ্ধতির যথেচ্ছ ব্যবহারের মাধ্যমে করা ইভান্স-প্রিটচার্ডের এই পুনর্মূল্যায়ন এনইউইআর চিন্তাধারাকে “প্রাক-যুক্তিবাদী মানসিকতার” অভিযোগ থেকে মুক্তি দিয়েছে। এনইউইআর বিশ্বাস যে প্রকৃত বাস্তবতার সাথে সাংঘর্ষিক সে কথাকে অস্বীকার করতেইএই আপাত অর্থহীনতাকে পুনঃঅনুবাদ করা হয়েছে আর তা করা হয়েছে এমন অদ্ভুত বক্তব্য সমূহের অর্থ গুলোর সাথে যুক্তিসংগত আচরণের সম্পর্ক স্থাপনের মধ্য দিয়ে। ঘটনাটি কিভাবে ঘটে তা তুলে ধরার জন্য গেলনার (সচেতন ভাবেই একটি গুরুত্বপূর্ণ বাক্যকে বাদ রেখে) ইভান্স-প্রিটচার্ডকে উদ্ধৃত করেছেন:

এনইউইআর ধর্ম চিন্তার যে নিয়ম-কানুন তার আলোকে এনইউইআর ভাষায় যখন কেউ এমন বক্তব্য দেন তখন তাতে কোন অসঙ্গতি পাওয়া যায় না, উলটো তা বেশ অর্থবোধক আর সত্য বলেই প্রতীয়মান হয়। [যমজ শিশু বিষয়ক এই বাক্যটির যে আক্ষরিক অর্থটুকু তারা তৈরী করেন ও বোঝেন তার থেকে অতিরিক্ত কোন অর্থ তখন তারা গ্রহণ করেন না।] তারা বলছেন না যে যমজ শিশু দুটির চঞ্চু, পালক এসব আছে। এনইউইআর ভাষাভাষীরা যমজদেরকে পাখি বলে গণ্য করেন না আর তাদের সাথে এমন ভাবে ব্যবহার করেন না যেন তাদের পাখি বলে মনে হয়। (৩৫। বন্ধনীবদ্ধ বাক্যটি গেলনার উপেক্ষা করে গেছেন)

এই পর্যায়ে এসে গেলনার উদ্ধৃতিটুকু শেষ করেন আর ব্যঙ্গাত্মক হতাশা নিয়ে প্রশ্ন করেন: “তাহলে কোন আচরণটি প্রাক-যুক্তিবাদী চিন্তা হিসেবে বিবেচিত হবে? ধারণা করা যায় কেবল মাত্র কোন বদ্ধ উন্মাদ যে কিনা স্থায়ীভাবে হেলুসিনেসনে ভোগে, যে কিনা একজন জলজ্যান্ত মানুষকে পাখি বলে গণ্য করে তার আচার আচরণকেই প্রাক-যুক্তিবাদী বলা যেতে পারে” (৩৫)। “প্রাক-যুক্তিবাদী চিন্তনের” অভিব্যক্তি হিসেবে নিশ্চিত ভাবেই বিবেচিত হওয়া উচিত এমন কথনসমূহ খুঁজে বের করার কাজে গেলনার এতোটাই আগ্রহী (এতো বেশি আগ্রহের কারন কি?) যে ইভান্স-প্রিটচার্ড এখানে আসলে কি করতে চাইছেন তা গেলনার একবার একটু ভালো করে চিন্তাও করে দেখেন নি। এই অদ্ভুত বাক্যটিকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ইভান্স-প্রিটচার্ড আসলে বেশ কয়েকটি পৃষ্ঠা খরচ করেছেন। তিনি আসলে বাক্যটিকে (পশ্চিমা সাধারণজ্ঞান ও পশ্চিমা মূল্যবোধের প্রেক্ষাপটে) সমর্থন দেওয়ার চেষ্টা করেননি , বরং (এনইউইআর সামাজিক জীবনের কথা চিন্তা করলে) ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন । নিশ্চিত ভাবেই, পশ্চিমা পাঠকদের এনইউইআর ধর্ম গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করা এই ব্যাখ্যার উদ্দেশ্য নয়। কিংবা এটা এই সম্ভাবনাকেও নাকচ করে দেয়না যে, এক একজন কথক তাদের ধর্মীয় বক্তব্যের ক্ষেত্রে ঐতিহ্যগত চিন্তন প্রয়োগ করতে গিয়ে নানা রকমের ভুল আর চূড়ান্ত রকম অযৌক্তিকতার ব্যবহার করেন। তাই ফাংশনালিস্ট নৃবিজ্ঞানীদের ওপর আরোপিত তার এই অভিযোগ যে তারা অতিরিক্ত দানশীলতার দায়ে দুষ্ট, তা প্রমান করার জন্য গেলনার কেনো এনইউইআর রিলিজিয়ন বই থেকে এই উদাহরণটি উল্লেখ করলেন তা স্পষ্ট নয়। ইভান্স-প্রিটচার্ড আসলে চেয়েছেন সেই সঙ্গতির বিষয়টি ব্যাখ্যা করতে যা, এনইউইআর ধর্মীয় ডিসকোর্সটির নিজস্ব অর্থ তৈরী করে। এই ধর্মীয় ডিসকোর্সটিকে একটি সর্বজনীন ডিসকোর্স হিসেবে সমর্থন যোগান তার উদ্দেশ্য ছিল না। আর যাই হোক ইভান্স-প্রিটচার্ড এনইউইআর ধর্মের ওপর এই প্রকরণগ্রন্থটি লেখা শুরু করবার আগেও যেমন তেমনি পরেও একজন ক্যথলিকই ছিলেন।

ইভান্স-প্রিটচার্ড কি এনইউইআর ধর্মীয় ডিসকোর্সের মূল সঙ্গতিটাকে ব্যাখ্যা করতে সফল হয়েছিলেন কিনা সেটা ভিন্ন প্রসঙ্গ। রেমন্ড ফার্থ (১৯৬৬) এর মতো বেশ কয়েকজন বৃটিশ নৃবিজ্ঞানী (যদিও আমার জানা মতে তারা কেউই এনইউইআর ভাষাভাষী ছিলেন না) ইভান্স-প্রিটচার্ড কর্তৃক প্রদত্ত ব্যাখ্যার বিভিন্ন বিষয়াদির সাথে দ্বিমত পোষণ করেছিলেন। কিন্তু সেই দ্বন্দগুলো ছিলো এনইউইআর ধর্মীয় ডিসকোর্সের অর্থ নিরূপনে গৃহীত বিভিন্ন মাধ্যম সমূহ কেন্দ্র করে, অনুবাদের ক্ষেত্রে অতিশয় কিংবা অত্যাল্প দানশীলতার বিষয়ে নয়। বরং আদতে গেলনারের অভিযোগের ঠিক উলটো ঘটনাটিই ঘটেছে, এনইউইআর ধারনায় যে সকল আপাত “স্ববিরোধীতা” বা অস্পষ্টতা রয়েছে সেগুলো ইভান্স-প্রিটচার্ডের ব্যাখ্যায় আরো স্পষ্ট ভাবে ফুটে উঠেছে। যেমন- “মহান ও সর্বব্যাপী সত্তা” আর “অধঃস্থ আত্মা” এই দুটি ধারণাকেই কোথ শব্দটি দ্বারা প্রকাশ করা হয়েছে। ইভান্স-প্রিটচার্ড কোথ এর এই ভিন্ন দুটি অর্থকে একত্রে “একটি ধারণারই” অংশ হিসেবে বিবেচনা করার ওপর জোর দিয়েছেন এবং তিনি শব্দটিকে ভিন্নার্থবোধক সমোচ্চারিত শব্দ বলেও গণ্য করেন না (যেভাবে হয়তো মালনস্কি ভিন্ন ভিন্ন প্রেক্ষাপটের সাথে মিলিয়ে নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন ভাবে ব্যবহার করতেন), যার দরুন এনইউইআর ভাষায় আত্মার ধারণাটিকে বলা যায় “স্ববিরোধী”। কিন্তু ভাষার মূলে থাকা বিষয় সমূহে যদি অস্পষ্টতা আর “স্ববিরোধীতার” ছাপ পাওয়া যায় তাহলেই তাকে “প্রাক-যুক্তিবাদী চিন্তনের” অকাট্য প্রমাণ হিসেবে গণ্য করা হবে কিনা তা অবশ্য একটি ভিন্ন আলোচনার বিষয়, তবে আমি বলবো অনুবাদের সাথে কি কি বিষয় যুক্ত সে বিষয়ে যাদের ধারণা খুবই কম কেবল মাত্র তাদের পক্ষেই এমনটা ভাবা সম্ভব। যেসব সমস্যাগুলো গেলনার উত্থাপন করলেন সেগুলোই আবার তিনি কৌশলে এড়িয়ে গেলেন:

আমাকে কেউ ভুল বুঝুক তা আমি চাই নাঃ আমি বলছি না যে এনইউইআর সম্পর্কে ইভান্স-প্রিটচার্ডের ধারনাটি মন্দ। (আমি লেভি-ব্রুলের মতন প্রাক-যুক্তিবাদী চিন্তাপ্রণালী সংক্রান্ত মতবাদের পুনঃজাগরণ ঘটাতেও উদগ্রীব নই।) বরং উলটো আমি এটা বেশ পছন্দই করি। আমার কাছে বিতর্কের বিষয়টি হলো এই যে, প্রসঙ্গ থেকে আলাদা করে নিয়ে বিচ্ছিন্ন ভাবে বাক্যটির যে অর্থ প্রতিভাত হয় তার পরিবর্তে, বক্তব্যটির আসল অর্থটি প্রকাশকারী প্রাসঙ্গিক অনুবাদ নিজে থেকে সব সমস্যাগুলোর সমাধান করতে পারে না (৩৮)।

কিন্তু কেই-বা এমন দাবী করেছে? নিশ্চিত ভাবেই ইভান্স-প্রিটচার্ড করেননি। সর্বক্ষেত্রেই, যে অনুবাদ বর্ণনা-প্রাসঙ্গিক (কন্টেক্সচুয়াল) আর যে অনুবাদ বর্ণনা-প্রাসঙ্গিক নয়, তাদের মধ্যকার বিরোধটা আসলে একটি কৃত্রিম বিরোধ। বিচ্ছিন্ন ভাবে কোন কিছুরই কোন অর্থ নেই। বরং- কি ধরণের কন্টেক্সট?  তার উত্তর করাটাই কঠিন।

কিন্তু গেলনার কখনই এই বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেননি, বরং এই প্রশ্নের উওরের সাথে যে দুষ্ট চক্রের বিষয়টি জড়িত সে কথাই উল্লেখ করেছেন কিংবা “অপরিমিত” দানশীলতার বিষয়ে সতর্ক করেছেন (দান আবার পরিমিত হয় কিভাবে?)। তিনি মনে হয় জানেন না যে, একজন অনুবাদকের জন্য প্রতিটি ক্ষেত্রে উপযুক্ত প্রাসঙ্গিক অবস্থাটি নির্দিষ্ট করার বিষয়টি সংশ্লিষ্ট ভাষা সমূহে তার দক্ষতার ওপর নির্ভর করে, তার ঐ ভাষার প্রতি পূর্ব থেকেই পরিগৃহীত সহিষ্ণুতা বা অসহিষ্ণুতার মনোভাবের ওপর নির্ভর করে না। আর দক্ষতা হচ্ছে এমন একটি বিষয় যা শিখে নিতে হয়– অপরিহার্য ভাবেই বিষয়টি চক্রাকারেই ঘটে, তাই বলে এটা কোন দুষ্ট চক্র নয়। দুই সেট বাক্যের মধ্যে একটি ভাবগত মিল খুঁজে বের করা আমাদের কাজ নয় বরং আমাদের কাজ হলো ভিন্ন ভিন্ন জীবন প্রথার ভেতর প্রথিত জীবন-আচরনের মিল খোঁজা। একজন মানুষ যেমন তার যাপিত জীবনে ভুল করে কিংবা মিথ্যা বলে তেমনি, একজন অনুবাদকও ভুল করতে পারেন, অথবা তিনি জেনে শুনেই কোন কিছুকে ভুল ভাবে উপস্থাপন করতে পারেন। কিন্তু এই বিষয় গুলো নিরূপণে আমরা কোন সর্বজনীন নীতি গ্রহণ করতে পারি না—বিশেষত এমন নীতি যেখানে অনুবাদের ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিকতার পদ্ধতি ব্যবহারের বিষয়ে সতর্ক করা হয়।

“এসব কথার মানে এই নয় যে, ভিনদেশীয় ভাষাভাষি মানুষেরা তাদের ভাষায় যা বোঝাতে চায় তার প্রতি আমি সংশয়বাদীতা বা অজ্ঞেয়বাদীতা প্রকাশের পক্ষালম্বী, কিংবা অনুবাদের ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিকতার পদ্ধতি ব্যাবহার থেকে বিরত থাকার পক্ষপাতী। (উল্টো আমি এর পরিপূর্ণ ব্যাবহারেরই পক্ষে, কারন মানুষ তার কথার ভেতর দিয়ে যা বোঝায় তা  যে কখনো কখনো অর্থহীন হতে পারে সেই সম্ভাবনাটির পক্ষে সম্মতিটুকু এই পদ্ধতির ব্যাবহারে পাওয়া যায়।)”- এমন বলিহারি দাবি গেলনার আরো করেছেন। এমন বাক্যের যাদুটাই হলো এই যে এর মধ্য দিয়ে তিনি তার প্রতিপক্ষের পদ্ধতিটিকে এমনভাবেই আত্মীকরণ করলেন যার ফলে তার নিজের স্বতন্ত্র অবস্থানটিই আরো শক্তিশালী হয়।

কিন্তু এরো আগে লিচের পলিটিকাল সিস্টেমস অব হাইল্যান্ড বার্মা বইটিতে সহিষ্ণুতা উৎপাদী প্রাসঙ্গিক অনুবাদের আরো বেশ কিছু উদাহরণ পাওয়া যায়। লিচের মতে,শেষ বিচারে, “কাচিনের সাধারন মানুষের একে অপরের মধ্যকার আনুষ্ঠানিক সম্পর্কটি বর্ণনা করার যে পক্রিয়া তা থেকে ”অতিপ্রাকৃতের দুনিয়া নিয়ে কাচিনে প্রচলিত বিবৃতিসমূহ “কোন ভাবেই ভিন্ন কিছু নয়” (পৃষ্ঠা ৪০ এ উদ্ধৃত)। এখানটায় গেলনার হস্তখেপ করেন: “এখানে কি ঘটেছে তা ঠাওর করা সম্ভব। কাচিন ভাষাভাষিরা আপাত ভাবে যে কথা বলে বোলে মনে হয় তার প্রতি স্বীকৃতি লিচের ব্যখ্যামূলক পক্রিয়ায় পাওয়া যায় না। আর এর মধ্য দিয়ে তিনি বিবৃতি গুলোকে অর্থবোধক করে তুলতে পেরেছিলেন যা অন্যথায় সম্ভব হতো না” (৪১)। গেলনার বারবার জোর দিয়ে বলেছেন যে, তিনি লিচের ব্যাখ্যার সাথে দ্বন্দে জড়াতে আগ্রহী নন, বরং “প্রসঙ্গের পরিধি আর প্রসঙ্গের প্রতি প্রবর্তিত দৃষ্টিভঙ্গি যে অবধারিতভাবেই অনুবাদকে প্রভাবিত করে তাই দেখাতে চেয়েছেন” (৪১)। এই বক্তব্যটি কিন্তু খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কেননা প্রকৃতপক্ষে গেলনারের আপত্তি লিচের সংকোচন-নীতির (reductionism) বিষয়ে নয় বরং এই সংকোচন-নীতি—যাকে কিনা গেলনার বিভ্রান্তিবশত বলছেন প্রাসঙ্গিকতাবাদ—তার উদাহরণ-যে সংশ্লিষ্ট সাংস্কৃতিক ডিসকোর্সটিকে আক্রমণ করার পরিবর্তে তার প্রতি সমর্থন জানায় তাই নিয়ে তার আপত্তি।

দানশীল না হয়েও আরো গভীর ভাবে কি করে ‘প্রাসঙ্গিকতার পক্ষাবলম্বী’ হওয়া যায়” তা দেখাতে গিয়ে গেলনার একটি কাল্পনিক সমাজের একটি কাল্পনিক শব্দের উদাহরণ দিলেন। শব্দটি হলো “ব’বেল”, যার ব্যবহার অনেকটা ইংরেজি “ন’বেল” শব্দটির মতন। আর আমাদেরকে বলা হলো যে, এই শব্দটি সেই সকল মানুষদের নির্দেশ করে যাদের আচরণে কতগুলো নির্দিষ্ট অভ্যাসগত ধরণ দেখতে পাওয়া যায়, একই সাথে এই শব্দটি সেই মানুষদেরকেও নির্দেশ করে যারা তাদের আচার-আচরণ নির্বিশেষে একটি নির্দিষ্ট সামাজিক মর্যাদার অধিকারী। “কিন্তু যে সমাজে শব্দটি ব্যবহৃত হয় সেখানে “ব’বেল” শব্দটির (উপরোক্ত) প্রথম আর দ্বিতীয় ধারণা দু’টির মধ্যে কোন প্রকার প্রভেদের ব্যবস্থা রাখা হয় নি, কেবল “ব’বেল” শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে”। পরবর্তী কালে গেলনার তার এই যুক্তির আরো অধিকতর ব্যখ্যা দিয়েছেন এই বিষয়টি স্পষ্ট করার জন্য যে কিভাবে ব’বিলিটি একটি ধারনামূলক বিষয় হিসেবে কাজ করে যার মধ্য দিয়ে একটি সমাজের বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত একটি শ্রেনী নির্দিষ্ট কিছু সদ্গুনাবলী অর্জনের মর্যাদা পায় যেগুলোর কদর ঐ সমাজে আছে। অবশ্য, সেই শ্রেনীর ওপর সেই সদ্গুনাবলী সমূহের চর্চার বাধ্যবাধকতা নেই। কারণ এই শব্দটিই হয় ঐ সদ্গুনাবলী সমূহ চর্চাকারীদের নির্দেশ করে নয়তো সমাজের সেই বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত শ্রেণিভুক্তদের নির্দেশ করে । একই সাথে, এই প্রক্রিয়াটি হলো সমাজে প্রচলিত প্রতিপত্তি ও ক্ষমতার ধারণার সাথে সদ্গুনাবলী সমূহের ধারণার একটি মেলবন্ধন স্থাপনের মধ্য দিয়ে ঐ সদ্গুনাবলীসমূহের আবেদনকে সমাজে পুনরুজ্জীবিত করার প্রচেষ্টা। তো এই ধারণাটির মধ্যে যে সামাজিক ভাবে ক্রিয়াশীল একটি অভ্যন্তরীণ অসংলগ্নতা রয়েছে তা এই আলোচনার মধ্য দিয়ে স্পষ্ট হয়। (৪২)

আসলে “ব’বিলিটি” শব্দটির ধারণায় কোন অসংলগ্নতা নেই। এমনকি যদি এ কথাও মেনে নেয়া হয় যে “ব’বিলিটি” শব্দটির অর্থগত অস্পষ্টতার কারনেই শাসক শ্রেনীর বৈধতার বিষয়টিকে মজবুত করতে, (আবার নীতিগত ভাবে ঐ বৈধতার বিষয়টিকে দুর্বল করতেও) রাজনৈতিক ডিসকোর্সে  শব্দটিকে ব্যবহার করা হয়, তবুও শব্দটির মধ্যে কোন অসংলগ্নতা থাকে না। কতো দ্রুতই না গেলনার তার মনগড়া উদাহরণের এমন তৃপ্ত উপসংহার টেনে দিলেনঃ “যাই হোক, এখান থেকে যা বোঝা যায় তা হলো, একজন অনুবাদক যদি তার নিরীক্ষাধীন ধারণা সমূহকে যৌক্তিক অসংলগ্নতার দায় থেকে রক্ষা করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ থাকেন তবে ঐ অতি দানশীল অনুবাদক সামাজিক পরিস্থিতির ভুল বর্ণনা প্রদানে বাধ্য। ধারণাকে বোধগম্য করা মানে পুরো সমাজকে অবোধ্য করে তোলা” (৪২, জোর দেয়া হল)। বিশেষ কিছু বাক্যে, “ব’বিলিটি” শব্দটির অর্থবোধকতা যে তার ব্যবহারকারীদের মধ্যে রয়েছে সে কথা নিশ্চিত (তা না হলে এ শব্দটি তারা ব্যবহার করত না)। গেলনারের কাছেও শব্দটির অর্থবোধকতা রয়েছে তবে তা ভিন্ন ধরণের। তার মতে, শব্দটি তার ব্যবহারকারীদেরকে প্রতারিত করে কোন একভাবে সামাজিক কাঠামোকে সমর্থন যোগায়। সত্যাসত্যের মত, অর্থবোধকতা বা অর্থহীনতার বিষয়টিও বিমূর্ত ধারণাসমূহের প্রতি নয় বরং বক্তব্যসমূহের প্রতি প্রযোজ্য। এখানে “অর্থহীন” ধারণার কোন নজির আছে বলে আমার মনে হয় না, কারণ, সামাজিক পরিসরে ব্যবহৃত হওয়া কোন বক্তব্যের বিশ্লেষণ এখানে করা হয়নি।

কিন্তু আরো বড় একটি ব্যার্থতার প্রমাণও এই উদাহরণের মধ্য দিয়ে পাওয়া যায়, আর তা হলো, এখানে সঙ্গতির বিষয়টি বিশ্লেষণের কোন চেষ্টাই করা হয়নি, যদিও একটি শব্দের অর্থসঙ্গতিই শব্দটির সামাজিক প্রভাবের সম্ভাবনাকে অনেক গুণ বাড়িয়ে দেয়। নিশ্চিতভাবেই রাজনৈতিক ডিসকোর্সে মিথ্যা, অর্ধ সত্য, যুক্তির মারপ্যাঁচসহ এমন আরো অনেক কিছু থাকে। তবে বাধিত করার যে বৈশিষ্ট্য রাজনৈতিক ডিসকোর্সের রয়েছে তা এসব উপাদানের উপস্থিতি ততোটা এনে দিতে পারে না যতোটানা সত্য আর স্পষ্ট বক্তব্যের উপস্থিতি পারে, আর নিজ ধারণায় সকলকে বাধিত করার প্রচেষ্টা গেলনারের উদাহরণটিতে স্পষ্ট। ধারণাসমূহের বিমূর্ত যৌক্তিক মর্যাদার বিষয়টি এখানে প্রাসঙ্গিক নয়, বরং নির্দিষ্ট কিছু রাজনৈতিক ডিসকোর্স যে উপায়ে একটি নির্দিষ্ট সাংস্কৃতিক পরিবেশের অন্তর্গত জনসাধারণের আচরণকে তৈরী করে বা পরিচালিত করে বলে মনে হয়, তা-ই, এখানে প্রাসঙ্গিক। রাজনৈতিক ডিসকোর্স হিসেবে “ব’বিলিটি” ধারণাটির মধ্যে বাধিত করবার যে ক্ষমতা রয়েছে তা একদল বোকাসোকা মানুষের চিন্তার ফলাফল নয় বরং তা একটি সুসংগত ডিসকোর্স আর চর্চার ফল। তাই একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক ভাবাদর্শের অনুবাদ করতে গেলে এই সুসঙ্গতির বিষয়টির কিছুটা প্রকাশ করা অপরিহার্য। ধারণাকে অবোধ্য করা মানেই পুরো সমাজকে অবোধ্য করা।

সর্বশেষ যে উদাহরণটি গেলনার দিয়েছেন তা তিনি নিয়েছেন তার নিজ কর্মক্ষেত্র মধ্য মরোক্কর বারবার জাতি থেকে, আর এর উদ্দেশ্যই হলো এই কথাটি সপ্রমাণ করা যে, একজন দয়াশূণ্য-প্রাসঙ্গিকতাবাদী (uncharitable contextualist) একটি সমাজের ধারনা সমূহের মধ্যকার অসঙ্গতি সমূহের ওপর জোর দেয়ার মাধ্যমে ঐ সমাজকে আরো ভালভাবে প্রকাশ করতে পারেন। গেলনার বলেন “বারাকা আর আগুরাম (বহুবচনে ইগুরামেন) এই ধারনা দু’টি পরস্পর সম্পর্কিত”। সাদামাটা ভাবে “বারাকা” শব্দটির অর্থ হতে পারে “পর্যাপ্ত”, কিন্তু এই শব্দটির অর্থ প্রাচুর্যও হয়, এবং সর্বোপরি সমৃদ্ধির ক্ষেত্রে সৌভাগ্যের যে বিষয়টি রয়েছে তা এই শব্দটি দ্বারা বোঝান হয়, আর সেই সাথে অতিপ্রাকৃতিক উপায়ে অন্যদেরকে সমৃদ্ধশালী করার ক্ষমতাকেও এই শব্দ দ্বারা নির্দেশ করা হয়। আর যে ব্যক্তি বারাকার অধিকারী সে হল আগুরাম” (৪৩)।

গেলনার “ইগুরামেন” শব্দটিকে অনুবাদ করে পরবর্তী লেখা গুলোতে লিখলেন “সাধুসন্ত” (১৯৬৯ দ্রষ্টব্য)। মধ্য মরক্কোর বারবার উপজাতীয়দের কাছে তারা একটি বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত আর প্রভাবশালী সংখ্যালঘু যারা কিনা ওই সমাজের ধর্মীয় মূল্যবোধের উৎস বিন্দু আর একই সাথে সেই উপজাতীয়দের মাঝে মধ্যস্থতাকারী আর বিচারক হিসেবেও কাজ করে। “তাদের সম্পর্কে স্থানীয়রা বিশ্বাস করে যে তারা ঈশ্বর কর্তৃক মনোনীত। আর এই মনোনয়নের ব্যাপারটি দৃশ্যমান করবার জন্যই ঈশ্বর ঐ সকল মনোনীতদের বিশেষ কিছু বৈশিষ্ট্য প্রদান করেন, এই যেমন জাদুকরী ক্ষমতা, আর আসাধারণ মহত্ত্ব, সাফল্য, নির্লোভ মনোভাব (লিলি ফুলের মতন), শান্তিবাদীতা ইত্যাদি” (৪৩)।

এই হলো গেলনারের “অনুবাদ”। কিন্তু অনুবাদের ক্ষেত্রে গেলনারের ধর্মীয় শব্দাবলীর অত্যধিক স্বচ্ছন্দ ব্যবহার আর তাতে খ্রিস্টধর্মজাত-ধারণার জোরালো এবং সম্ভবত অপ্রাসঙ্গিক উপস্থিতি নিশ্চিত ভাবেই এ পর্যায়ে এসে সন্দেহ আর প্রশ্নের জন্ম দেয়। লিলি ফুলের মতন নির্লোভ মনোভাবের সাথে তুল্য ঠিক কি ধরণের আচরণ ও ডিসকোর্স এখানে অনূদিত হয়েছে যা এক্ষেত্রে গেলনারের এমন পছন্দের বহিঃপ্রকাশ ও অলংকরণ ঘটায়? বারবাররা কি বিশ্বাস করে যে, তাদের “সাধুসন্তদের” ঈশ্বর “আসাধারণ মহত্ত্ব আর শান্তিবাদীতা”র মতন চারিত্রিক গুণাবলী দ্বারা ভূষিত করবেন, নাকি তারা মনে করে যে, সাধুতার আর ইগুরামেনের সাথে ঈশ্বরের নৈকট্যের শর্তই হলো এই সকল বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হওয়া? সত্যিই কি বারবাররা এমন আচরণ করে যাতে মনে হতে পারে যে, ধর্মীয় আর নৈতিক গুণাবলীসমূহের উপস্থিতি ঈশ্বরের মনোনয়নের বহিঃপ্রকাশ? বারবার জাতির লোকেরা কি বলে আর কেমন আচরণ করে যখন তারা দেখতে পায় যে, যেসব গুণাবলী ঐ সকল মনোনীতদের মধ্যে থাকার কথা সেগুলো তাদের কাজকর্মে প্রকাশ পাচ্ছে না? একজন আগুরামেন যে চরিত্রগত দিক থেকে লিলি ফুলের মতন লৌকিক কামনাহীন হবেন এমন ধারণাই বা কে দাঁড় করালো, যেখানে একজন আগুরামেনের পরিবার আর সম্পত্তি দু’টোই আছে, আর যেখানে এই ব্যবস্থাকে বারবাররা সম্পূর্ণ নীতিসিদ্ধ বলেই মেনে নিয়েছে? এই সব গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের উত্তরের জন্য প্রাসঙ্গিক তথ্যাদি গেলনার তার পাঠকদের সামনে উপস্থাপন করেননি, আর তার অনুবাদের ওপর এ বিষয়টির গুরুত্ব কি তা আর কিছুক্ষণের ভেতরই স্পষ্ট হয়ে যাবে।

যাহোক এই পরিস্থিতির বাস্তবতা হলো, ইগুরামেন আসলে নির্বাচিত হয় ঐ নৃগোষ্ঠীর সাধারণ সদস্যদের দ্বারাই যারা কিনা ঐ ইগুরামেনদের সেবা গ্রহণ করে। আগ্রহী প্রার্থীদের ঐসব কাজগুলো সম্পাদন করতে বলা হয়, আর প্রতিদ্বন্দীদের কর্মদক্ষতার ভিত্তিতে সেরাদের বেছে নেওয়া হয়। যে বিষয়টি আপাত-দৃষ্টে ঈশ্বরের বাণী বলে প্রতীয়মান, বাস্তবে তা ঐ জনগোষ্ঠীর ইচ্ছার বহিঃপ্রকাশ। উপরন্তু আগুরাম এর চিহ্নসমূহ, অর্থাৎ, তার পবিত্র বৈশিষ্ট্যসমূহের বিষয়টি আরো বেশি জটিল। আগুরাম পদমর্যাদার একজন সফল প্রার্থীর জন্য এই সকল বৈশিষ্ট্যের আমানতদার হওয়া জরুরি, কিন্তু যেভাবেই সম্ভব হোক না কেন ঐ সকল বৈশিষ্ট্যের মধ্যে কয়েকটির অধিকারী না হওয়াও তার জন্য সমান জরুরি। যেমন, লিলি ফুলের মতন নির্লোভ এই ধারণাটি ধারণ করে একজন আগুরাম যদি অত্যন্ত মহানুভব হন তবে তিনি সাফল্যের মতন আরেকটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষায় ব্যর্থ হবেন।

ধারণা ও বাস্তবতার মাঝে খুবই গুরুতর বৈসাদৃশ্য এখানে রয়েছে। সামাজিক কাঠামো ঠিক ভাবে কাজ করার জন্য এই বৈসাদৃশ্য আবার বেশ গুরুত্বপূর্ণ (৪৩-৪৪)।

এই যে বক্তব্য যে, “স্থানীয়রা বিশ্বাস করে আগুরামেন ঈশ্বর কর্তৃক মনোনীত”—এর দ্বারা কি বোঝান হয় তার উত্তর গেলনার প্রদত্ত ব্যাখ্যায় একদমই স্পষ্ট হয় না। আসলে তারা ঠিক কিসের জন্য “মনোনীত”? সালিশকারী হবার জন্য? কিন্তু সালিশির প্রাথমিক উদ্যোগটি নৃগোষ্ঠীটির কোননা কোন সদস্যেকেই নিতে হয় আর এই সত্যটি নৃগোষ্ঠীটির সদস্যদের না জানার কোন কারণ নেই। শান্তিবাদী হবার জন্য? কিন্তু শান্তিবাদীতা একটি গুণ, পুরস্কার নয়। জাগতিক সাফল্য ও সমৃদ্ধির জন্য? কিন্তু এটা সাধুতার আঞ্চলিক-সংজ্ঞা হতে পারে না, তাহলে তো যে কোন আগুরামের থেকে ফরাসী উপনিবেশিক শাসকরাই অধিকতর সাধু বলে বিবেচিত হতেন।

একজন ইউরোপিয় নৃবিজ্ঞানীর জন্য তার অজ্ঞেয়বাদী আর/ অথবা আধুনিক ইউরোপিয় পাঠকদের এই তথ্য দেওয়া আসলেই কোন অর্থপূর্ণ অর্জন নয় যে- বারবাররা তাদের দৈনন্দিন কাজে ঈশ্বরের সরাসরি হস্তক্ষেপ রয়েছে বলে বিশ্বাস করে, তাদের এই বিশ্বাস আসলে ভ্রান্ত বিশ্বাস আর ঐ সমাজে এই ধরণের ভ্রান্ত বিশ্বাসের প্রভাব থাকতে পারে। এমন ধরণের চর্চার মধ্য দিয়ে তারা যে কি বিশ্বাস করে সে কথা আমরা  জানতে পারি না, শুধু জানতে পারি যে তারা যা বিশ্বাস করে তার পুরোটাই ভুল: এ-মতে, বারবাররা বিশ্বাস করেন যে, ঈশ্বর ইগুরামেন নির্বাচিত করেন; আমরা জানি ঈশ্বরের অস্তিত্ব নেই (অথবা আমাদের মধ্যে এখনো যদি এমন কেউ থাকেন যিনি এখনো বিশ্বাস করেন যে, ঈশ্বরের অস্তিত্ব আছে, তবুও আমরা জানি লোকায়ত ইতিহাসের বিষয়ে সরাসরি হস্তক্ষেপ তিনি করেননা); অতএব, এই “মনোনয়নকারী” নিশ্চয়ই অন্য কোন কার্যকর্তা—বস্তুত ঐ নৃগোষ্ঠীর সদস্যরা নিজেরাই—যাদেরকে কার্যকর্তা হিসেবে ঐ নৃগোষ্ঠীর সাধারণ-সদস্যরা চেনে না। “ইগুরামেন”-রা মানুষের দ্বারা “মনোনীত” (একটা নির্দিষ্ট সামাজিক ভূমিকা পালনের জন্যে? একটি নৈতিক গুণের জন্যে? একটি ধর্মীয় লক্ষ্য সাধনের জন্যে?)।“মনোনয়ন”-টা ঈশ্বরের বাণী বলে প্রতিয়মান হলেও বস্তুত তা জনগণের ইচ্ছারই বহিঃপ্রকাশ। তাই কি?

বাস্তবে নৃবিজ্ঞানী কর্তৃক বিবৃত “মনোনয়নের” মতন সামজিক প্রক্রিয়াকে কথনের কেন্দ্রবিন্দু বলে বিবেচনা করা যায়, কেবল যদি ধরে নেয়া হয় যে, এই সামাজিক প্রক্রিয়া একটি সাংস্কৃতিক-টেক্সট নির্মাণ করে। কারণ একটি টেক্সটের নিশ্চিত ভাবেই একজন রচয়িতা আছেন—তার রচনার মধ্য দিয়েই আমরা তার স্বর শুনতে পাই। আর সেই স্বর যদি ঈশ্বরের নাই হয়, নিশ্চয়ই তা অন্য কারো হবে—অর্থাৎ মানুষের হবে। কে কথা বলে ইতিহাসের মধ্য দিয়ে, সমাজের মধ্য দিয়ে?—গেলনারের মতন একজন নিরীশ্বরবাদী এমন একটি ধর্মতত্ত্বীয় প্রশ্নের উত্তর করবার গোঁ ধরেন। বিশেষ করে এই ঘটনার ক্ষেত্রে এর উত্তর নির্ভর করে একই সাথে এই টেক্সটটির “রিয়েল” (real) অর্থ , অ-চেতন অর্থ (unconscious) এবং টেক্সটটির যথোপযুক্ত অনুবাদের ওপর। সিগনিফায়ার আর সিগ্নিফাইডের সম্মিলন ঘটানোর বিষয়টি বিশেষ ভাবে প্রমাণিত হয় তখন যখন দেখা যায় যে “বারকা” শব্দটির ইসলামী ধারণাটিকে এমনভাবে অনুবাদ করা হলো যেন, খ্রিস্টান ধর্মের “গ্রেস” এর ধারণাটিকে আঠারোশ শতকের একজন সংশয়বাদী যেভাবে ব্যাখ্যা করতেন হুবহু সে রকম শোনায়, যাতে করে একটি গিব্বনীয় হাসি দিয়ে “আগুরামের বারাকা”র মতন অবস্থাটিকে “স্টিগমাটা”র (ক্রুশারোহণের ক্ষত) সাথে তুলনা করা যায়—আর সেই কুশলী সাইনের মাধ্যমে গেলনারের টেক্সটে “বারবার” সাংস্কৃতিক টেক্সটের একটি অংশকে এক নিমিষেই কল্পনা করে নেয়া হয়েছে ও দেখানো হয়েছে, শব্দ আর বস্তুর এমন জোরালো সম্মিলনই এখানে ঘটেছে যার নিদর্শন গেলনারের সব লেখাতেই পাওয়া যায়।

কিন্তু সমাজ তো এমন কোন টেক্সট নয় যা নিজে নিজেই তার দক্ষ পাঠকদের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করে। জনসাধারণ কথা বলার কাজটি করে এবং তারা যা বলে তার চূড়ান্ত অর্থ সমাজের মধ্যে অধিষ্ঠিত নয়- সমাজ হচ্ছে সেই সাংস্কৃতিক ক্ষেত্র যার মধ্যে কথক ক্রিয়া করে এবং কথকের ওপর ক্রিয়া সম্পাদিত হয়। “বারবাররা” যা বলে তার আসল অর্থ পাঠোদ্ধারের ক্ষেত্রে গেলনার তার নিজের জন্য যে সুবিধাজনক অবস্থান তৈরী করে নিয়েছেন তা কেবল সেই মানুষের পক্ষেই বজায় রাখা সম্ভব যিনি একথা বিশ্বাস করেন যে, ভিন্ন সংস্কৃতির অনুবাদ মানে মূলত ভাষা দুটিতে লিখিত বাক্য গুলোর মধ্যে সাদৃশ্য স্থাপন, আর তা এমন ভাবে যাতে করে দ্বিতীয় সেটের বাক্য গুলো প্রথম সেটের বাক্যগুলোর রিয়েল অর্থ হিসেবে পরিণত হয়—মাঠ পর্যায়ের নোটবই থেকে শুরু করে মুদ্রিত নৃকুলবিদ্যার বই পর্যন্ত পুরো কাজটাই এমন যা কিনা ঐ নৃবিজ্ঞানী একাই পরিচালনা করেন। অন্য ভাবে বলতে গেলে, এমন সুবিধাজনক অবস্থানে থাকা এই ব্যক্তি একসময় তিনি যাদের সাথে থাকতেন আর এখন যাদের সম্পর্কে লিখছেন তাদের সাথে নিখাদ ভাব বিনিময়ে জড়ান না আর সে সুযোগও তিনি করে উঠতে পারেন না (তুলনার জন্য দ্রষ্টব্যঃ আসাদ, ইডি। ১৯৭৩: ১৭)।

তার প্রবন্ধের মধ্যভাগে নৃতাত্ত্বিক অপেক্ষবাদের বিষয়টি আলোচনা করতে গিয়ে গেলনার অভিযোগ করেন যে, “নৃবিজ্ঞানীরা আপেক্ষিকতাবাদী ছিলেন, সহিষ্ণু ছিলেন, প্রাসঙ্গিকতার চৈতন্য তাদের ছিল, অপর দিকে, ঐ বরবরেরা তাদের পার্শ্ববর্তী প্রতিবেশী অথবা তাদের পূর্বপুরুষ, আমাদের নিজস্ব সমাজের যে সকল সদস্যরা এই সমাজের অন্যান্য সদস্যদের মতন চৈতন্যপূর্ণ দৃষ্টিভংগীর অধিকারী নয় এবং যারা নিজেরাই ‘জাত্যভিমানী’ তাদের তুলনায় এমনিতেই অনেকটা পশ্চাতপদ, কিন্তু সেই সাথে তারা স্বৈরতান্ত্রিক আর অসহিষ্ণু…” (৩১)।

যদি আমি আমার লেখায় এই বিষয়টির ওপরই জোর দিতে চাই যে, কোন ব্যক্তি যদি ভিন্নভিন্ন সংস্কৃতির অনুবাদের সাথে জড়িত থাকে তবে তাকে অবশ্যই ডিসকোর্সের মধ্যকার সঙ্গতির খোঁজ করতে হবে, তাহলে গেলনারের টেক্সট যে মূলত অসঙ্গতিপূর্ণ তা দেখানোর জন্য কেন আমি এতোগুলো পৃষ্ঠা খরচ করলাম? কারণটা খুবই সাধারণ, গেলনার আর আমি একই ভাষায় কথা বলি, একই একাডেমিক পেশায় নিয়োজিত, একই সমাজে বাস করি। তার টেক্সটের প্রতি সমালোচনামূলক অবস্থান নিতে গিয়ে তিনি যা বলেছেন আমি যুক্তি দিয়ে তার বিরোধীতা করেছি, তার বক্তব্যের অনুবাদ করিনি, আর এই দুই ধরণের কাজের মধ্যে যে মৌলিক একটি পার্থক্য রয়েছে আমি আসলে সেই ব্যাপারটিতেই জোর দিতে চেয়েছি। তথাপি, “পার্শ্ববর্তী প্রতিবেশী”র প্রতি “অসহিষ্ণুতা”র মনোভাব প্রদর্শণ আমার এই তর্কের উদ্দেশ্য নয়, বরং এর উদ্দেশ্য হলো তার টেক্সটের মধ্যকার অসঙ্গতিগুলো চিহ্নিত করা, কারণ, অনুবাদের নৃতাত্ত্বিক কর্মভারটি আরো বেশি সঙ্গতিপূর্ণ হয়ে ওঠার দাবী রাখে। একটি সম্মিলিত প্রচেষ্টাকে অরো সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়াই এই সমালোচনার উদ্দেশ্য। আমার মনে হয় না সেই একই উদ্দেশ্য নিয়ে এই ধরণের একটি নৃতাত্ত্বিক প্রবন্ধ লেখা হয়েছে যা “সর্বপোরি অনেকটা পশ্চাতপদ আদিমদের” সমালোচনায় মুখর আর যাদেরকে নিয়ে সেই সমালোচনা, তারা তা পড়তেও পারে না। দায়িত্বপূর্ণ সমালোচনার নিয়মই হলো এই যে তা সবসময় এমন কারো উদ্দেশ্যেই করতে হয় যিনি সেই সমালচনার প্রতিবাদ করতে পারেন।

[1] দক্ষিণ সুদানে নীল নদ তীরবর্তী স্থানে বসবাস্কারী জাতিগোষ্ঠী।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ভাষা
Scroll to Top