মৃত্যুর গুমর
মৃত্যু এক অনন্ত যাত্রার সঙ্গে বিবাহ।
এ কিসের গুমর? পরমেশ্বর তো অখণ্ড।
সূর্যালোক জানালা গলিয়ে ঘরে ঢোকার বেলায়
ভেঙে চিলতা হয়।
আঙ্গুর ফলের বাকল বহুবিধের যৌগ,
কিন্তু আঙুরের রসে কোন ভাগ নেই।
যে ঈশ্বরের আলোর নিরিখে বাঁচে
মৃত্যুর ফলে তার আত্মা আরেক বর্ধিত উদযাপনে
অধিষ্ঠিত হয়।
যে চলে গ্যাছে তাকে আর ভালো-মন্দের তকমায় বেঁধো না,
বরং তোমার চোখ একাগ্র করো ঈশ্বরে;
যে অদৃশ্য তাকে নিয়ে বেহুদা কথা বলো না-
সে হয়তো তোমার দৃষ্টির অতলে ভর করে আছে।
চর্মচক্ষুর দৃকপাত কেবলই এক জাগতিক আচার,
তারমধ্যে দেখাদেখির কোন অদেখা নেই,
কিংবা নেই গোপনতার মর্ম!
অথচ এই চোখই যদি পরমার্থের বিভামণ্ডিত হয়
তাতে থাকতে পারে দেখার অন্তঃপুরে দেখার আড়াল।
যে-কোন ঝলকানিকেই ঈশ্বরের নূর ভেবো না।
ক্ষণাচারী আলোর স্ফূর্তি হতে পারে শুধুই দুনিয়াদারির জরি।
যে-আলো সমগ্রের অধীন ও উপর কেবল তা-ই পারমার্থিক উদ্ভাসের বিস্তার।
ঈশ্বর, কেবল তুমিই জানো আলোর কী মাজেজা!
তোমার আলোয় মিলনের তীব্র বাসনা লইয়া পক্ষী
তোমা পানে ধায়!
ইংরেজি পাঠ : Secrets of Death.
ইংরেজি ভাষান্তর : সিমোন ফেটাল
নতশির চূড়া
আমি ছিলাম মৃত, সহসা আবার জীবন পাই;
কাঁদছিলাম, আবার হাসছি এখন।
আমার মধ্যে প্রেম জন্মায়,
আমি সিংহের প্রচণ্ডতায় মাতি,
তারপর সন্ধ্যাতারার স্নেহাশিসে আসমানে উদিত হই।
অধিকর্তা বলেন, তুমি এখনও যথেষ্ট উন্মাদ নও,
এই ঘরে তুমি থাকতে পারো না।
আমি বন্যতার চূড়ান্ত করি- তার বেশি কিছু করার ছিল না।
অধীশ্বর কহেন, এখনও সেরকম বন্য হয়ে উঠতে পারো নি
যাতে আমাদের সঙ্গে থাকতে পারো।
আমি অতঃপর আনন্দের জোয়ারে উন্নীত স্তরে পৌঁছাই।
তিনি বলেন, না, না, এ যথেষ্ট নয়।
আমি মৃত্যুবরণ করি।
পরমেশ্বর বলেন, তুমি ভীষণ চতুর,
তুমি কানায় কানায় উচ্ছ্বাস আর দোটানার আধার!
আমি আমার শরীর থেকে সব পালক তুলে ফেলি
আর নিজেকে বানিয়ে ফেলি সম্পূর্ণ অবুঝ
তিনি ঘোষণা করেন, এই তো এতোক্ষণে তুমি হয়েছো
এই সমাবেশের মোমবাতি সম।
কিন্তু না, আমি মোমবাতি নই- ভালো করে দেখো
আমি ছড়িয়ে পড়ছি ধুঁয়ার টুকরো ও ছিন্নতায়।
তিনি বলেন, তুমিই এখন বুজুর্গ, তুমিই চলনদার।
কিন্তু না আমি শিক্ষক নই, আমার কোন ক্ষমতা নেই।
পরমনিধি কহেন, তুমি জানো না- তোমার পাখা আছে
আমি তোমাকে আর পাখা দিতে পারি না।
কিন্তু আমি যে পরমাশ্বরের ডানা চাই।
আমি যে এখনও পাখাহীন মোরগের ছানা হয়ে আছি!
আমি এবার এক গায়েবি আওয়াজ শুনি-
তুমি স্থিতধী হও, এক অলক্ষ্যের অনুকম্পা
তোমার মধ্যে প্রোথিত হোক- তুমি স্থির হয়ে থাকো!
আমি অতঃপর শ্রবণ করি আদিতম প্রেমের বাণী-
তুমি আমার নিবিড়ে রহো।
আমি কহি: আমি থাকিবো!
তুমি যে আলোকের এই ঝর্ণাধারা,
আমি গাছের কথায় লতায় পাতায় শ্যামলিমা ছায়া
আমার জীর্ণ বসনে তুমি মখমলের ছোপ।
প্রাণ বুঝি প্রভাতের কৃষ্ণ কালো জল
যে কানে কানে বলে, আলোকের এই ঝর্ণাধারায় বইয়ে দাও!
প্রভাকর মুখ লুকায় সন্ধ্যার আবীরের নিচে
আবার আলতো করে মুখ বাড়ায় চাঁদের কায়ায়
অসীম আকাশের নীল জ্যোৎস্না লহরায় সমস্ত ভাসায়!
তোমার হাসি ওই দূর হাসির গরিমায় মেশে।
এই সংসার দাবার ছকে খেলতে বসে না বড় খেলোয়াড়
নিঃসীমের আড়ালে থেকে চাল দেয় মৌল কারিগর।
আমি না-বোঝ, চালের গুটি
যেমনি বলো তেমনি খেলি- আমি আছি, আছি আমি
দাবার ছকে- তাইতো খুশি পরমপুরে নিত্য দিবস যামি!
English version: Sublime Generosity.
ইংরেজি তরজমা : কোলম্যান বার্কস।
কাঠামো পেরিয়ে
রাত্তিরে তোমার কাজের জায়গা কিংবা বাড়ি থেকে
যেই না রাস্তা পেরুতে পা বাড়াও- সামনে পড়ে কবরখানা।
তুমি শোনো- আমি তোমার অন্তরের অচিনপুর থেকে
তোমাকে ডাকি,
তোমার সামনের উন্মুখ কবরখানার দিকে চাইলেই
বুঝতে পারো-
আমাদের মধ্যে কোন ফাঁক নেই- আমরা একসঙ্গেই আছি!
তুমি যে মানব নিধি- আমি তার অন্তহীন সজ্ঞা
তোমার বিষাদের মর্মমূলে আমি আনন্দ উৎসার।
সে রাতের কথা ভেবে দেখো-
সাপে কাটার ভয়ে তুমি পালিয়ে গ্যাছো, আর পিলপিলিয়ে শরীরে উঠে আসছে পিপড়া,
তারমাঝে মোম জ্বলে আছে, আমি ডাকছি তোমায়-
শুনতে পাও আমার চিরচেনা গলা,
ধুপবাতির ঘ্রাণ নীরবে মৌমৌ;
খাবারের আয়োজন দেখে তুমি রীতিমতো হতবাক!
একজনের ভালোবাসা কতো প্রাণের অন্তরালে
ফল্গুধারায় জাগে।
.
জানি আমার তারস্বরে তোমার অন্তরাত্মা কেঁপে ওঠে,
আমি এভাবেই চেঁচাই- তুমি যেন কবরে মাতমে জ্বলে ওঠো।
কাফনের কাপড় নিয়ে অনুযোগ করো না,
গোরস্তানের পথ থাক না ধুলামলিন, তাতে কী!
শবদেহে মোড়ানো কাপড় ছেঁড়া হয় গেরোদেয়া কোণায়।
আখেরাতে দীর্ণ মানুষের স্বনন ধুয়ে দেয়
মৃতদের শ্রান্তি ও ঘাম!
আমাকে খোঁজো না মানুষের দেহ-খাঁচায়
ভালোবাসার তীব্র ঝড় আমাকে ভেঙে একাকার করে দিয়েছে
সকল আকার, ক্ষেত্রফল ও মালিকানা।
বাজাও ডঙ্কা, কবিকে আমন্ত্রণ- বলুক তিনি পদাবলী কালাম।
এদিন এসেছে সেদিনের কাছে- যেদিন তুমি পরিশুদ্ধ
হতে পারো- যারা পেয়েছো বোধের মখমল,
যারা প্রেমের আঙিনায় আসবে বলে নিয়ত করেছো।
তুমি মৃত্যুর কিনারা অবধি অপেক্ষা করো না,
এখানে বহুকিছু চাওয়ার আছে যা টাকার চেয়ে দামী,
কেবল বিখ্যাত হয়ে ওঠার কী-বা মূল্য আছে বলো-
কাচ্চিবিরিয়ানি এমন কিছু নয় যার জন্য লালায়িত হও!
কী নামে ডাকি তারে-
এই নগরে গড়েওঠা নতুন এক নিরুদ্বেগের বাড়ি-
মানুষেরা বসে নিঃশব্দ, চোখ ডোবে সহজ দৃশ্য প্রভার কারণ
প্রশ্ন নেই, উত্তরে হাওয়ায় মেশে প্রাণের শনশন!
ইংরেজি পাঠ : No Room for Form.
ইংরেজি ভাষান্তর : কোলম্যান বার্কস
অদৃশ্যকে দেখার উড়াল
অবশেষে তুমি অদৃশ্যকে দেখতে উড়াল দিয়েছো।
তুমি এই জগৎ থেকে ওই দুনিয়ায় যেতে
কোন অধীর পথে পাড়ি দাও?
পালকের পর পালক খসিয়ে ডানা ঝাপটে
খাঁচা ভেঙে পাখি শূন্যের বাড়ি-
আকাশের ওপারে আকাশে মিলাও।
এবার তুমি একাত্ম হও আত্মাদের দুনিয়ায়।
তুমি এক বুড়ির ছলাকলায় বন্দী ছিলে
বুঝি এক বাজপাখি।
তুমি অকস্মাৎ শুনতে পাও অসীমের টঙ্কার-
উড়ে যাও সময় ও অন্তরীক্ষের ওপারে।
তুমি সঙ্গকাতর, তাই পাখা মেলাও পেঁচাদের সাথে
উড়ে উড়ে তোমার বোধে আসে গোলাপ বাগান।
উন্মাতাল তুমি- পেঁচাদের থেকে অতঃপর আলাদা হয়ে পড়ো
একাকিত্বের জৌলুসে দলছুট ঘুরে যাও,
এবার এসে মেশো তুমি গোলাপের সনে।
এ মায়া দুনিয়ায় তুমি নেশায় বুঁদ হয়েছিলে
শোরগোলে তোমার মাথা ঝিমঝিম করছিলো!
অবশেষে তুমি অনন্তের জারণখানায় মিলনবাড়ি আসো।
ঠিক যেন ধনুক থেকে ছিটকে আসে তীরের ফলা
আর লক্ষ্যভেদী ছুটে যাও মূল বিন্দুর দিকে।
রংতামাশার দুনিয়া তোমাকে অনেক মেকি নিশানা দেখিয়েছে
তবু তোমাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে রাখতে পারে নি,
তুমি ঠিকঠিক এসে নোঙর করেছো সত্যের উৎস ঠিকানায়।
তুমি এখন নিজেই সূর্য,
মাথার তাজ হতে আর কী চাই তোমার?
তুমি এই জাগতিক জগৎ থেকে আলাদা হয়ে গ্যাছো,
এখন অন্তহীন বিস্তার,
কে আর তোমাকে ক্ষীণতায় বাঁধতে পারে?
তুমি যদি তোমার আত্মার সাক্ষাৎ চাও-
শত আয়োজনে আশায় বড়জোর তার কিঞ্চিৎ দেখা পাও।
অংশবিশেষে আর তোমার মন ভরে না-
যখন তুমি নিজেই সামগ্রিক আত্মায় রূপান্তরিত হয়ে গ্যাছো।
আমার প্রাণ, তুমি কী যে এক কীর্তিমান পাখি-
অবিরাম খোঁজ করো অনিঃশেষ সত্যের মোকাম;
পাখা ঝাপটাও, শত্রুর তীব্র তীর তোমাকে জখম
করতে পারে না।
প্রকৃতির বৈরিতার মুখে পুষ্প নিজেকে আড়ালে
লুকিয়ে ফেলে,
অথচ তুমি এমন এক গোলাপ-
শীতের বরফ প্রতিকূল তোমাকে হারাতে পারে না-
তুমি অনুকূল ফুটে রও!
এইযে বেহেস্তের নেকদার বৃষ্টির ফোঁটা
এই দুনিয়ার টিনের চালে ঝরে পড়ো অফুরান।
কেউ তোমাকে আটকাতে পারে না,
জলের গলানের সাথে আবার কল্লোলে হারিয়ে যাও।
এতোদিনে কথার ফেনা মিশে গ্যাছে নীরবতায়।
দুঃখ- যে এসেছিল প্রগলভতার কেশরে চেপে
অন্তর্হিত, তা-ও অন্তর্হিত।
তুমি এখন প্রিয়তম সখার যত্নশীল হাতের অধীন-
এবার হিয়ার অনুকূল আত্মায় বিস্তার লাভ করো।।
English version: Gone to the Unseen.
ইংরেজি তরজমা : জনাথন স্টার
জালালউদ্দিন রুমি ১২০৭ সনের ৩০শে সেপ্টেম্বর আফগানিস্তানের বাল্খে জন্মগ্রহণ করেন। জীবনের প্রারম্ভিক বিলোড়ন থেকেই তিনি এক আধ্যাত্মিক উন্মত্ততার ভিতর বড় হয়ে উঠতে থাকেন : রুমির জনক বাহাউদ্দীন ওয়ালাদ একইসঙ্গে তাঁর জন্মদাতা পিতা ও মুরশিদ। ক্রমান্বয়ে রুমি অতুল সিদ্ধপুরুষ ফরিদউদ্দীন আত্তার, এবং হাকিম আবদুল মাজিদ মাজদুদ ইবনে আদম সানাই গজনভির সংস্পর্শে আসেন, মাওলানা রুমি সঠিকভাবেই তৎকালে বুজুর্গ পণ্ডিত, ধর্মের ব্যাখ্যাকার, কাজি, মুরশিদ ও অনন্য এক ধর্মতত্ত্ব বিশারদে পরিণত হয়ে ওঠেন। কিন্তু এই সামগ্রিক প্রস্তুতির পরও জালালউদ্দিন রুমির জীবন এক অন্য স্তরে সমাসীন হয় যেদিন তাঁর সাক্ষাৎ ঘটে শামস তাব্রিজির সাথে। বলা হয়, তাব্রিজি এবং জালালউদ্দিন রুমির দেখা হলে একজন আরেকজনের পায়ের ধুলি নিতেন: এভাবেই দৃশ্যত আশেক-মাশেক, গুরু-শিষ্য, ছাত্র-শিক্ষক, পীর ও মুরীদানের মধ্যকার দূরত্ব ঘুছে এক নোতুন পরম্পরা তৈরি হয় : লাভার ও বিলাভেডকে আলাদা করার শরিয়া লুপ্ত হয়ে যায়- এ যেন থিসিস নয়, নয় এন্টিথিসিস- এ হলো সিনথেসিসের খেলা: যেভাবে স্রষ্টা মানুষের গোপন- মানুষ স্রষ্টার গোপন।
দার্শনিক কবি জালালউদ্দিন রুমি ১৭ই ডিসেম্বর, ১২৭৩ সনে তুরস্কের কোনিয়ায় অদৃশ্যতার বন্ধনে উড়ে যান।
বদরুজ্জামান আলমগীর
কবি, নাট্যকার, অনুবাদক। জন্মেছিলেন ভাটি অঞ্চল কিশোরগঞ্জের বাজিতপুরে। পড়াশোনা বাজিতপুরে, পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। বহুদিন দেশের বাইরে- যুক্তরাষ্ট্রের ফিলাডেলফিয়ায় থাকেন।
বাঙলাদেশে নাটকের দল- গল্প থিয়েটার- এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য; নাট্যপত্রের সম্পাদক। নানা পর্যায়ে আরও সম্পাদনা করেছেন- সমাজ ও রাজনীতি, দ্বিতীয়বার, সাংস্কৃতিক আন্দোলন, পূর্ণপথিক, মর্মের বাণী শুনি, অখণ্ডিত।
প্যানসিলভেনিয়ায় কবিতার প্রতিষ্ঠান- সংবেদের বাগান-এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য।
প্রকাশিত বই:
আখ্যান নাট্য: নননপুরের মেলায় একজন কমলাসুন্দরী ও একটি বাঘ আসে (বাঙলা একাডেমি, ১৯৯৭)
কবিতা: পিছুটানে টলটলায়মান হাওয়াগুলির ভিতর (অপরাজিতা, ২০০৫)
আখ্যান নাট্য: আবের পাঙখা লৈয়া (জন্মসূত্র, ২০১৬)
প্যারাবল: হৃদপেয়ারার সুবাস (ঘোড়াউত্রা প্রকাশন, ২০১৮)
কবিতা: নদীও পাশ ফেরে যদিবা হংসী বলো (ঘোড়াউত্রা প্রকাশন, ২০১৯)
কবিতা : দূরত্বের সুফিয়ানা (ভাঁটফুল, ২০২০)
ভাষান্তরিত কবিতা: ঢেউগুলো যমজ বোন (ঘোড়াউত্রা প্রকাশন, ২০২০)