যাও তুমি যেই দিকে,
ফোটে ফুল সেই দিকে!
আমারে যমুনা দিয়া
যাও তুমি সব নিয়া!
এই যদি হয় কারবার,
আমিও কলসি নিয়া হবো ছারখার।
পাল নিয়ে এগোতে থাকে মঙ্গল সর্দারের দল। নতুন এলাকার দিকে যেতে থাকে মাঠ পেরিয়ে। সবাই স্বাভাবিক। সুবোধের মুখ শুধু ব্যাজার। গজগজ করতে থাকে।
সুবোধ : এ কিরাম কারবার। যা মনে চায় তাই করবে সর্দার। একবার জানালোও না আমারে যে আজকেরে পাল সরাবে।
দিপেন : তোরে কবে কি জন্যি? তুই থাহিস রান্না নিয়ে আর মাইয়ে ছুয়ালের ভাবনায়।
সুবোধ : ফাউ কইসন্যে দিপেন, ঘা দিবানি।
দিপেন দাঁত বের করে হাসে।
দিপেন : দিয়ে দেখ না ঘা, সর্দাররে কবানি তারপর দেখিসকেনে কিরাম হয়। একটা মাঠের কিনারায় এসে পাল দাঁড়ায়। মঙ্গল চারদিক তাকিয়ে ইশারা দেয়,
মঙ্গল : দিনেশ নামায় দে।
হরিপদ : রাতি কি এহেনে থাকপা কাকা?
মঙ্গল : হয় আজকেরে এহেনে থাইকে কালকেরে এগোবো আরো। এদিকি বেশি খাবার নেই। এক দুইদিনির বেশি হবে নানে। দেখতিছিস না শুকনো কিরাম।
হরিপদ : হেঁই সুবোধ, ঐ আম গাছের ওদিকে চুলো খোড়। অহেনে খোঁয়াড় দেবো রাত্তিরে।
সুবোধ : উউউ। সর্দার মারাইছে উনি। হুকুম ছাড়া কথা কয় না সাইয়ো।
সুবোধ চুলো খুঁড়তে থাকে বিরক্তি নিয়ে। অঞ্জনা পাশে বাঁশঝাড়ে এসে দাঁড়ায়। হাতে একটা পলিথিনে কিছু মোড়ানো। ঢিল ছুঁড়ে মারে সুবোধের সামনে। সুবোধ তাকায়, এগিয়ে গিয়ে হাত টেনে ঝোপের দিকে নিয়ে যায়।
অঞ্জনা : ইরাম কইরে এট্টা খবর না রাইখে পলায় আসাডা কি কাব্রা বিটাগের নিয়ম?
সুবোধ : তুমি এহেনে?
অঞ্জনা : আসলাম তোমারে দেখতি। যেই কয়দিন আছো সীমানার মধ্যি দেইখে নিই।
সুবোধ : তুমি ইরাম কইরে আইসে কলাম ঝামেলা বাঁধায় ফেলিছো। সইরে যাও। সর্দার দেখলি সর্বনাশ হবেনে। আমি কিছু জানতাম না, সর্দার ফট কইরে কল সব গোছাতি।
অঞ্জনা : থাক। আর মিথ্যে কতি হবে না। লোকে যে তোমাগে নিয়ে ফাউ কথা কয় তা কলাম মিথ্যে না। এট্টা খবর কলাম ইচ্ছে কল্লিই রাইখে আসতি পারতা।
সুবোধ : খবর দেতাম বিকেলে। কেবল মাত্তর আইছি এহেনে। এহনো চুলো খুইড়ে পারিনি।
অঞ্জনা : মিথ্যে কথা ছাড়া তোমার আর কিছু নেই?
সুবোধ : তোমার এলাকা ছাইরে তো আর চইলে যাই নি। এক মাইল সইরে আইছি শুধু। পলাতি যদি চাতাম তালি এলাকাই ছাড়তাম।
অঞ্জনা : ধরা পড়া মুর্গি কক কক করে বেশি। জানো তো।
সুবোধ : ইরাম করতিছো ক্যান কও দিনি বাড়া? মুখখান তো শুকোয় চিমসে বানায় ফেলিছো। কান্দিছো?
সুবোধ এগিয়ে গিয়ে জাপ্টে ধরে অঞ্জনাকে। হরিপদ আসে জল নিতে। এসে দেখে সুবোধ নেই। আশপাশে খোঁজ করে, তাকায়। পাশের ঝাড়ের মধ্যে কথার শব্দ শুনে এগিয়ে গিয়ে ঝোপের আড়াল থেকে দেখে। সুবোধ আর অঞ্জনা চুমু খাচ্ছে। দ্রুত বেরিয়ে আসে হরিপদ। সর্দারের কাছে যায়।
অঞ্জনা চলে যায়। একটা পলিথিনে মোড়ানো কয়েকটা মিষ্টি আলু দিয়ে যায়। সুবোধ পলিথিন খুলে আলু দেখে হতাশ হয়। অঞ্জনার চলে যাবার দিকে তাকিয়ে থাকে সুবোধ। একটা ভ্যান নিয়ে এসেছিল সে। ভ্যান চলতে শুরু করে ক্রমে রোদের মধ্যে একটা কালো বিন্দু হয়ে মিলিয়ে যায়। সুবোধ চুলো খুঁড়তে ব্যস্ত হয়। কিন্তু সুবোধের ডাক পড়ে তখন সর্দারের কাছে। সুবোধ টের পেয়ে যায় খবর পৌঁছে গেছে।
বাথানের একপাশে গাছের নিচে দাঁড়িয়ে সব কাওড়ারা। পরিস্থিতি থমথমে। সুবোধের সালিশ হচ্ছে। হরিপদ জানিয়ে দিয়েছে ঘটনা। মঙ্গল সর্দার ক্ষেপে ফুঁসে আছে। সুবোধ মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। সুবোধকে নিয়ে তার ইচ্ছা ছিল নিজের মেয়ের সঙ্গে বিয়ে দেবার। মঙ্গল রেগে গিয়ে গায়ে হাত তোলে, চড় দেয় গালে। সুবোধ স্থির দাঁড়িয়ে থাকে। সবাই চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে।
মঙ্গল : তুই এহনই বিদেয় হবি আমার পালের থে। আজকেরে পয়তিরিশ বচ্ছর কাওড়াগিরি করি আমি। কেউ এট্টা বদনাম দিতি পারবে না। আর তুই দুইদিনের ছাওয়াল। কি কইরে বেড়াচ্ছিস? ধোনে এতো জ্বালা তোর? জাত বেজাত কিছু দেহাদেহি নেই? নিজেরে তুই কি জানিস? আজকেরে তুই বদনাম বাঁধাবি তোর জন্য আমাগের সমাজের সবাইরে দেখলি এরা গাইল দেবে। ঢুকতি দেবে না এলাকায়। কুত্তো হয়ে গেইছিস? তোরে আমি কি ভাবিলাম আর তুই কি বের হলি? আমার কান্ধে চইড়ে তুই লাগায় বেড়াবি? নিজের জাতের দিকি একবার তাকালি না? যাহ। তোর কাজ শেষ আজকের থে। আমার পালে আর লাগবে না তোরে। কোনদিন যেন তোরে না দেহি।
মঙ্গল বেরিয়ে যায় অন্য দিকে। দিনেশ অন্যদের বলে,
দিনেশ : নেও নেও মাঠে যাও। পাল সামলাও। যাও সবাই যাও।
সুবোধ পায়ের বুড়ো আঙুল দিয়ে মাটি খুঁড়তে থাকে। একসময় হনহনিয়ে হেঁটে বেরিয়ে যায়। দিপেন অসহায়ের চোখে হরিপদের দিকে তাকায়।
২৫
আমারে বন্দনা করো
আমি মা তোমার,
স্তন দিয়ে সর্বপ্রাণে
পৃথিবীকে করেছি আমার।
কাওড়া পাড়ায় সন্ধ্যা নামে। তুলসিতলায় সন্ধ্যা দেয় কালি। বারান্দায়র খুঁটিতে হেলান দিয়ে বসা নীলে। কালি তার দিকে তাকাতেই হাত ইশারা করে। কালি গুছিয়ে তার ঘরের দিকে আসে। অন্য সবাই যে যায় ঘরে। সন্ধ্যা দেয়া নিয়ে ব্যস্ত সবাই। কালি ঘরে আসতেই তাকে বসায়। ঘরের মাঝ বরাবরা একটা পর্দার মতন শারি ঝুলিয়ে ঘরকে দুইভাগ করা। কালিকে বসিয়ে নীলে পর্দার ওইপাশে যায়। ওখান থেকে কথাবার্তা চলতে থাকে। ঘরের মধ্যে একটা দুগ্ধপোষ্য শুয়োর হেঁটে বেড়াচ্ছে। কালি বাচ্চাটাকে খোটায়।
কালি : ডাকিছো ক্যান দিদি?
নীলে : এম্নিই ডাকিছি। একদিন তো আসলি না আমার ঘরে। ভাবলাম তোরে এট্টু ডাকি।
কালি : ও।
নীলে : না হয় আমাগের স্বামী নেই। তা বইলে এরাম দূরছাই করতি হয়?
কালি : ছি ছি। কি কচ্ছ দিদি। আমি আবার কবে দূরছাই করলাম।
নীলে : না ডাকলি তো আসিস না আমার কাছে। সারাদিন খালি ঐ ধাড়ি মাগী গুলোর সাথে থাহিস।
কালি : কই আমি তো সবার সাথে মিশি।
নীলে : ও আমার জানা আছে। ওরা নিষেধ দেছে তাই না আমার সাথে মিশতি?
কালি : না তো। কিসব কচ্ছ।
নীলে পর্দার ওপাশ থেকে এপাসে বেরিয়ে আসে। রঙিন শারি পরে। কালি দেখে থতমত খায়।
নীলে : কিরে কিরাম লাগতিছে কদিনি? তোর চাইতে সুন্দর না কম সুন্দর? যুয়োন লাগতিছে না তোর চাইতে? আবার ব্যে দেয়া যাবে আমারে? কথা কচ্ছিস নে ক্যান?
কালি : যাবে। রঙিন কাপড় পরিছ দিদি?
নীলে : ক্যান বিধবা বইলে কি সাধ আহ্লাদ নেই আমাগের?
কালি : তা কই নি। কচ্ছিলাম লোকে কি কবেনে?
নীলে : লোক খিডা? তারা কি আমারে ভাত দেয় না কাপড়?
কালি : না তা না।
নীলে : তোগের শ্যাটায় জ্বালা থাকলি আমার শ্যাটায় জ্বালা নেই? নাকি ভাতার মরার সাথে তাও চিতেয় গেইছে?
কালি : ও দিদি ইরাম করতিছো ক্যান?
নীলে : এম্নি। পাড়ায় তুই আসার পরের থে দেখতিছি তো সবাই তোরে নিয়ে টানাটানি। দ্যাখ আমার শরীর আর তোর শরীর।
কালি হা হয়ে তাকিয়ে থাকে।
কালি : কচ্ছ কি দিদি?
নীলে : ভাতার তো তোরও নেই। কাওড়া মাগীগের ভাতার থাইকে থাকে না। তা মরা আর জ্যান্তা সমান। দুইদিন ঠাপানো স্বামীর চাইয়ে আর বিটাগের ঠাপ খাওয়া ভালো।
কালি চোখমুখ বড়বড় হয়ে যায়। একটা কলা এগিয়ে দিয়ে বলে,
নীলে : নে খা। ভয় নেই জাদুমন্তর করা কলা না।
কালি তাকিয়ে থাকে।
নীলে : মুখটা অইরাম আমশি কইরে রাখিস ক্যান সারাদিন? বরের জন্য মন পোড়ায়ে লাভ নেই। এরা কেউ ফেরে না। শুয়োর আর মাঠই এগের জীবন।
শূকরের বাচ্চাটাকে কোলে টেনে আদর করতে থাকে নীলে। কালি ভ্যাব্দা খেয়ে বসে থাকে এতোসব কথাবার্তা শুনে।
নীলে : এট্টা মজা দেখপি?
কালি : কি?
নীলে আঁচল সরিয়ে শুয়োরের বাচ্চাটা সামনে তার স্তন ধরে। বাচ্চাটা চুষতে শুরু করে। নীলে শান্তিতে চোখ বুজে থাকে। কালি হতভম্ব হয়ে বলে ওঠে,
কালি : হা ভগবান।
নীলে চোখ বুজে স্থির বসে থাকে। কালি দরজা ঠেলে বেরিয়ে আসে তার অস্বস্তি কাটে না। বারান্দায় বসে চাল ঝাড়তে থাকা নারায়ণী দেখে কালিকে। তার সন্দেহ হয়। কুলো রেখে দাঁড়ায়।
২৬
গতরের জোরে তুমি মাটি কেটে খাও
জোর গেলে নুলা তুমি মাটিতেই যাও।
সন্ধ্যা নামে। মঙ্গল থম মেরে বসে আছে। দিপেন রান্না করছে। অন্য কাওড়ারা যে যার মতন আছে। অন্ধকার চিরে তখন দুটো বাইক আসে। বাইকে জনা চারেক স্থানীয় গুন্ডা ছেলেপেলে।
গুন্ডা ১ : লোকজন নেই?
গুন্ডা ২ : হেঁই এহেনে কাওরাগের লিডার খিডা?
কাওড়ারা সবাই সন্ত্রস্ত হয়ে ওঠে। মঙ্গল এগিয়ে যায়। তার পিছনে দিনেশ দিপেন।
মঙ্গল : পালের সর্দার আমি। কিছু বলবেন বাবারা?
গুন্ডা ৩ : বাবা? কাকার দেহি কথা কওয়ার কায়দা আছে।
গুন্ডা ৪ : শোনেন এলাকার উপর দিয়ে তো শুয়োর চরায় যাচ্ছেন বছরের পর বছর। এহন আমাগের এট্টু সেবা দেন।
মঙ্গল : যদি এট্টু খুইলে বলতেন।
গুন্ডা ২ : শোনো কাকা, কালকে সকালে এহেনের পার্টি অফিসে দুইডে কচি শুয়োর দিয়ে আস্পা। সকালে আমার লোক আস্পে ওগের সাথে তোমার দুইজন লোক দিয়ে দিবা যারা জবাই দিয়ে মাংস বানায় দেবে।
মঙ্গল : কি কচ্ছ এইসব?
গুন্ডা ১ : টাউনের থে আমাগের লিডাররা আস্পে। তারা খাতি চাইছে।
গুন্ডা ৩ : অত জানাজানির দরকার নেই কাকা। যা কলাম তা করবা। ফিরি খাওয়ায় যাবা আমাগের এলাকার জমির উপর দ্যে তা খাজনা দেবা না?
মঙ্গল : এ কিরাম কথা বাবারা। আপনারা বোঝার চেষ্টা করেন। আমরা তো মালিক না জোন খাটি। মালিক থাহে দেশে। তার অনুমতি না পালি দেয়া যায় না।
গুন্ডা ২ : তা দিয়ে আমরা করবো কি কাকা?
গুন্ডা ১ : শোন কাকা, কথা বাড়ায়ে প্যাঁচায়ে লাভ নেই। মাল দুইডে কাইল দিয়াস্পা সাথে দুইজন লোক। এহন কেম্নে দিবা সেডা তুমার ব্যাপার।
মঙ্গল : এরম কইরেন না আপ্নারা। মারা পরবো আমরা।
গুন্ডা ৪ : কালকে আমাগের লিডাররা খাবে। এহন মাল যদি না দিয়াইছো তালি কলাম এই পাল শুদ্ধ আমরা খায়ে ফেলাব।
মঙ্গল করজোড়ে এগিয়ে এসে বলে,
মঙ্গল : বাবারা আমরা গরিব মানুষ আমাগেরে ছাড় দেন। দরকার হলি এই টাকাডা নেন। উনাগেরে মাংস কিনে ভোজ দেন। ৫০০ টাকার একটা নোট গাঁট থেকে বের করে এগিয়ে দেয়।
গুন্ডা ১ : চুদনা পাইছ নাকি কাকা আমাগেরে? এই টাহায় কয়কেজি মাংস হয়? টাহা কি আমরা নিতি আইছি?
মঙ্গল : এরাম দাবি কইরে না। আমরা অসহায়। মালিক আমাগেরে রাখপে না তালি। এম্নিতেই মড়কে মরিছে। তোমরা আমার ছুয়ালের মতন।
গুন্ডা ৪ : হেহ। তোমাগের ছুয়াল আমরা হতি যাবি কোন দুঃখে? সবাইরে কাওড়ার বাচ্চা মনে করো?
মঙ্গল : ক্ষমা চাচ্ছি বাবা। আমাগের ছেলেমেয়েরাও তো রক্ত মাংসের মানুষ তোমাগের মতন, তাই বইলে ফেলিছি। কিন্তু শুয়োর আমি ফাউ দিতি পারবো না।
গুন্ডা ৩ : ফাউ না, এডা হচ্ছে খাজনা। আমাগের এলাকার উপর দিয়ে ফিরি ফিরি ব্যবসা কইরে যাবা ক্যান?
বলতে বলতে ৫০০ টাকার নোটটা ছিনিয়ে নিয়ে নেয়।
গুন্ডা ২ : কালকে মাল দেবা। আর কোনো কথা হবে না। বেশি কথা হলি গুষ্টি শুদ্ধো চোদন হবে।
বাইকে উঠে পড়ে। শেষ বাক্যে মঙ্গলের রাগ হয়। শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে সে। মঙ্গল ক্রোধ চেপে গর্জে উঠে পালের সবাইকে নির্দেশ দেয় রাতের মধ্যে পাল নিয়ে পাড়ি দেবে নদী। প্রস্তুত হতে বলে সবাইকে।
মঙ্গল : হেঁই দিপেন, দিনেশ, হরি
দিপেন : কাকা?
দিনেশ : সর্দার?
হরিপদ : সর্দার?
মঙ্গল : পাল সরায় ফেলতি হবে রাত্তিরের মধ্যি। পারবি না?
দিনেশ : নদী পাড়ি দিবা?
মঙ্গল : হয়। এগের গ্রাম ছাড়া লাগবে।
হরিপদ : নদী এহেন থে সাত আট মাইল। পারা যাবে তয় এগের কষ্ট হয়ে যাবেনে।
মঙ্গল : হোক। পালের শুয়োর তবু ফাউ দেবো না কুত্তো গুলোন রে।
২৭
তুমি দিলা পায়ে বেড়ি
আমি দিলাম খাড়ু,
কে কারে বান্ধে মায়ায়
কে মারে ঝাড়ু।
সুবোধকে পাল থেকে বের করে দেওয়ার পর বোঁচকা নিয়ে অঞ্জনাদের গ্রামে হাজির হয় সে। যেখানে পাল ছিল সেইখানে ঝোপের মধ্যে তারা দেখা করে।
অঞ্জনা : তুমি এহেনে আসলা ক্যান? লোকে জাইনে গেলি সর্বনাশ হবেনে।
সুবোধ : ক্যান শ্যাটার জ্বালা কি কুইমে আইছে? পায়ে ঠেলতিছ। সকালেও তো কাইন্দে আইস্লে।
অঞ্জনা : তা কইনি আমি। এহেনে এরাম কইরে আইস্লে?
সুবোধ : বুঝিছি। খেলা শেষ।
কিছুক্ষণ নিরব থাকে দুইজন।
সুবোধ : পাল ছাইড়ে আইছি। খেদায় দিছে সর্দার।
অঞ্জনা : মানে? কহন কী হলো?
সুবোধ : আজকেরে সকালে তোমারে আর আমারে দেখিছে ঝোপে। সেই দোষে।
অঞ্জনা : খেদায় দেলো একেবারে?
সুবোধ : বদনাম হলি পালের সর্বনাশ হবে। কাওড়া জাতের বদনাম হবে। দেবে না? ঠিকই আছে। আমার জন্যি ক্যান উগের দোষ হবে।
অঞ্জনা : এহন করবা কি?
সুবোধ : আগে কও তুমি কি করতি চাও?
অঞ্জনা : মানে?
সুবোধ : যাবা আমার সাথে?
অঞ্জনা : কোথায়?
সুবোধ : আমাগের দেশে। কাওড়া পাড়ায়।
অঞ্জনা : অহেনে যাবো কোন দুঃখে? ছি ছি। পিচেসের যায়গা। ও সমাজ তো আমাগের না।
সুবোধ : ও! তা ঠিক। আমরা তো নিচু জাতের। অচ্ছুৎ। তোমরা উঁচু জাতের। ভুল আমারই। আগে খেয়াল করা উচিৎ ছিল। তাছাড়া কাওড়া পাড়ায় যাইয়ে থাকপাই বা কিরাম কইরে। আমাগের সমাজ তো মানুষের সমাজ না।
অঞ্জনা : আমি আসলে তোমারে দুঃখ দিতি চাই নি। কথাডাও ওরাম কইরে কইনি। কচ্ছিলাম যে, আমাগের সম্পর্ক তো সমাজ মাইনে নেবে নানে। আমারা উঁচু জাতের তোমরা নিচু। লোকে শুনলি কবেনে কি। তাছাড়া আমি কি তোমাগের জীবন পোহাতি পারবো?
সুবোধ : বুঝিছি। দোষ দিচ্ছি না তোমারে। আমার ভুল হইয়ে গেইছে ফিরে আইসে। সকালে কাইন্দে কাইটে আইলে তো সেই মায়াডা রয়ে গেইছে। এর চাইয়ে সর্দারের পা জড়ায়ে ক্ষমা চাইয়ে পালে থাইকে যাওয়াডাই ভালো ছিল।
অঞ্জনা : এরাম করতিছ ক্যান? আমি কচ্ছি যে, যদি তুমি অন্য কিছু করো কাওড়াগিরি বাদ দিয়ে তালি কলাম হয়।
সুবোধ : নিজের জাত মুইছে ফেলাব? তা হয় না। অন্য কাজ আমাগের মন বসে না, আমাগের দিয়ে হয় না। রক্তে শুয়োর চরানো। যাযাবর আমরা! অন্য কাজে গেলি ফেল খাতি হয়।
অঞ্জনা : ধরো চুড়ি-ফিতে বেইচলে?
সুবোধ : তাতে কি হবে? যাবা তালি সাথে?
অঞ্জনা : যাবো তয় কাওড়া পাড়ায় না।
সুবোধ অসহায়ের মতো মুচকি হাসে।
অঞ্জনা : অন্য কোথাও। অন্য কোন গিরামে। আমি আর তুমি। যেহেনে কেউ জানবে না আমরা কিডা।
সুবোধ : আমার আপত্তি নেই। তুমি পারবা তো? সে দেশে কলাম তোমার আমার জাত থাকপে নানে। লোকে যেই জাত দেবে মুখে মুখে তাই হবে?
অঞ্জনা : যাবো।
সুবোধ : তালি আসো।
অঞ্জনা : কিন্তু এহন না।
সুবোধ : এতো নক্সা তোমার আগে জানতাম না।
অঞ্জনা : বুঝতিছো না তুমি আমারে এট্টু সময় দিতি হবে। এই ধর দুইদিন। কিছু জিনিস নিতি হবে। ফট কইরে হবে না।
সুবোধ : আচ্ছা সময় নেও। যা মনে চায় তাই করো। আমার মাথা কাজ কঅরতেছে না আর!
অঞ্জনা : তুমি এই জংলায় লুকোয় থাকপা। লোকে যেন না দেহে। আমি দুইবেলা আইসে খাবার দিয়ে যাবো।
সুবোধ : তুমি যা কবা তাই হবে এহন থে।
অঞ্জনা : খোঁচা দিচ্ছ?
সুবোধ : নাহ। সব ভাসায় দিচ্ছি।
অঞ্জনা : আমি গোছ কইরে নিই আগে। কাইল না হলি পরশু ভাইগে যাবো আমরা।
সুবোধ : তালি তাই।
অঞ্জনা : কী?
সুবোধ : তুমি যা আমি তাই।
অঞ্জনা হেসে দিয়ে সুবোধের বুকে মুখ ঘষে বেরিয়ে যায়। সুবোধ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে।